আহ্বান – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
দেশের ঘরবাড়ি নেই অনেকদিন থেকেই। পৈতৃক বাড়ি যা ছিল ভেঙেচুরে ভিটেতে জঙ্গল গজিয়েছে। এ অবস্থায় এক দিন গিয়েচি দেশে কিসের একটা ছুটিতে।
গ্রামের চক্কোত্তি মশায় বাবার পুরাতন বন্ধু। আমায় দেখে খুব খুশি হলেন। বললেন—ওঃ কতকাল পরে বাবা মনে পড়ল দেশের কথা?
প্রণাম করে পায়ের ধুলো নিলাম।
বললেন—‘এসো, এসো, বেঁচে থাকো, দীর্ঘজীবী হও। বাড়িঘর করবে না?
—আজ্ঞে সামান্য মাইনে পাই—
—তাতে কি? গ্রামের ছেলে গ্রামে বাস করবে, এতে আর সামান্য মাইনে বেশি মাইনে কি? আমি খড় বাঁশ দিচ্চি, চালাঘর তুলে ফেল, মাঝে মাঝে যাতায়াত করো। আহা পরেশের ছেলে, দেখেও সুখ। ক’দিনই বা আছি? বাস করো গাঁয়ে।
আরও অনেকে এসে ধরলে, অদ্ভুত খড়ের ঘর একটা ওঠাতে হবে।
অনেকদিন পরে গ্রামে এসে লাগছে ভালই। যাদের বাল্যকালে ছোট দেখে গিয়েছি, তাদের আর চেনা যায় না, যাদের যুবক দেখে গিয়েছিলাম, তারা হয়েছে বৃদ্ধ।
বড় আমবাগানের মধ্য দিয়ে বাজারের দিকে যাচ্চি, আমগাছের ছায়ায় একটি বৃদ্ধার সঙ্গে দেখা। বৃদ্ধার চেহারা ভারতচন্দ্রের বর্ণিত জরতীবেশিনী অন্নপূর্ণার মতো। কোনও তফাত নেই। ডান হাতে নড়ি ঠুক ঠুক করতে করতে বোধ হয় বা বাজারের দিকেই চলেছে। বগলে একটা ছোট থলে।
বুড়িকে দেখেই আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। এ ধরনের বুড়িকে দেখে আমার বড় মায়া হয়—নারীরূপের এ এক অপূর্ব পরিণতি।
জিজ্ঞেস করলাম—কোথায় যাবে?
—বাজারে বাবা—
বুড়ি আমায় ভাল না দেখতে পেয়ে কিংবা না চিনতে পেরে ডান হাত উঁচিয়ে তালু আড়ভাবে চোখের ওপর ধরলে।
বললে—কে বাবা তুমি? চেনলাম না তো?
—চিনবে না। বাঁড়ুজ্যেপাড়ার নরেশ বাঁড়ুজ্যের ছেলে। আমি অনেকদিন গাঁয়ে আসিনি—
—তা হবে বাবা। আমি আগে তো এপাড়া-ওপাড়া যাতাম আসতাম না। তিনি থাকতি আবাব ছেলো না কোনও জিনিসের। গোলা পোরা ধান, গোয়াল পোরা গোরু—
—তোমাকে তো চিনতে পারলাম না বুড়ি?
—আমার তো তেনার নাম করতি নেই বাবা। করাতের কাজ করতেন?
বলে সে জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে থাকে অর্থাৎ আমি চিনতে পেরেছি কি না। কিন্তু আমার পক্ষে চেনা সম্ভব নয়, আমার বাল্যকালে কে এ গ্রামে করাতের কাজ করত তা আমার মনে থাকবার কথা নয়। বললাম— তোমার ছেলে আছে?
—কেউ নেই বাবা কেউ নেই। এক নাতজামাই আছে তো সে মোরে ভাত দেয় না। ওই আমার নাতনিকে রেখে মোর মেয়ে মারা যায়। আমার বড্ড কষ্ট, ভাত জোটে না সবদিন। বাজারে যাচ্ছি তিন পয়সার নুন কিনে আনব—দুটো ক’টা চাল জোগাড় করিচি ও-বেলা।
বুড়িকে পকেট থেকে কিছু পয়সা বার করে দিলাম।
ব্যাপারটা এখানেই চুকে যাবে ভেবেছিলাম, কিন্তু তা চুকল না—উপরন্তু এই বুড়িকে কেন্দ্র করে আমার জীবনে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার শুরু হল।
নিজের জীবনে না ঘটলে বিশ্বাস করতাম না এমন ঘটনা।
পরের দিন সকালে ঘুম ভেঙে উঠেচি এমন সময় কালকার সেই বুড়ি লাঠি ঠুক ঠুক করতে করতে এসে হাজির উঠোনে। থাকি এক জ্ঞাতি খুড়োর বাড়ি। তিনি বললেন—এ হল জমীর করাতির স্ত্রী— অনেকদিন মরে গিয়েছে জমীর। তোমাদের ছেলেবেলায়।
বুড়ি উঠোনে দাঁড়িয়ে ডাকলে—ও বাবা—
সে বোধ হয় চোখে একটু কম দেখে। ও বয়সে সেটা অবশ্য তেমন আশ্চৰ্যই বা কি।
বললাম—এই যে আমি এখানে।
—কাল পয়সা কডা পেয়ে ভাবলাম যাই দিনি বাওনপাড়ার দিকি। কে পয়সা দিলে চিনতিও পারলাম না। বিকেলবেলা চোখে ঠাওর পাইনে।
আমার খুড়োমশায় বুড়িকে বুঝিয়ে দিলেন আমি কে। সে উঠোনের কাঁটালতলায় বসে আপন মনে খুব খানিকটা বকে উঠে গেল। তার যাবার সময় আরও দু’ একটা পয়সা দিলাম।
পরদিন কলকাতা চলে গেলাম, ছুটি ফুরিয়ে গেল। আমার জ্ঞাতি খুড়োকে কিছু টাকা দিয়ে এলাম আসবার সময়ে, আমার জন্যে ছোটখাটো দেখে একটি খড়ের ঘর তুলে রাখবার জন্যে।
কয়েকমাস পরে জ্যৈষ্ঠ মাসে গরমের ছুটিতে আমার সেই নতুন-তৈরি খড়ের ঘরখানাতে এসে উঠলাম। কলকাতাতে কর্মব্যস্ত এই ক’মাসের মধ্যে বুড়িকে একবার মনেও পড়েনি বা এখানে এসেও মনে হঠাৎ হয়তো হত না যদি সে তার পরের দিনই সকালে আমার ঘরের নিচু দাওয়ায় এসে না বসে পড়ত।
বললাম—কি বুড়ি, ভাল আছ?
ময়লা ছেঁড়া কাপড়ের প্রান্ত থেকে গোটাকতক আম খুলে আমার সামনে মাটিতে রেখে বললে— আমার কি মরণ আছে রে বাবা!
জিজ্ঞেস করলাম—ও আম কীসের?
দন্তহীন মুখে একটু হাসবার চেষ্টা করে বললে—অ গোপাল আমার, তোর জন্যি নিয়ে অ্যালাম। গাছের আম কডা বেশ মিষ্টি, খেয়ে দেখো এখন।
আমি ওর সম্বোধনের নতুনত্বে কৌতুক অনুভব করলাম, কিন্তু কি জানি কেন বড় ভাল লাগল। গ্রামে অনেকদিন থেকে আপনার জন কেউ নেই, একটা ঘনিষ্ঠ আদরের সম্বোধন করার লোকের দেখা পাইনি বাল্যকালে মা পিসিমা মারা যাওয়ার পর থেকে। প্রতিবেশিনীদের মধ্যে অত বেশি বয়সের স্ত্রীলোক কেউ নেই যে আমাকে ‘গোপাল’ বলে ডাকে।
বুড়ি বললে—খাও কোথায় হ্যাঁ বাবা?
—খুড়োমশায়ের বাড়ি।
—বেশ যত্ন করে তো ওনারা?
—তা করে।
—দুধ পাচ্চ ভাল?
—ঘুঁটি গোয়ালিনী দেয়, মন্দ না।
—ও বাবা, ওর দুধ! আদ্ধেক জল— দুখ খেতি পাচ্চ না ভাল। সে বুঝিচি।
পরদিন সকাল হয়েছে সবে, বুড়ি দেখি উঠোনে এসে ডাকছে—অ গোপাল—
বিছানা ছেড়ে উঠে বললাম—আরে এত সকালে কি মনে করে? হাতে কি?
বৃদ্ধা হাতের নড়ি আমার দাওয়ার গায়ে ঠেস দিয়ে রেখে বললে—এক ঘটি দুধ আনলাম তোর জন্যি।
—সে কি? দুধ পেলে কোথায় এত সকালে?
—আমায় মা বলে ডাকে ওই হাজরা ন্যাটার বউ। তারও কেউ নেই, মোর চালাঘরের পাশে ওর চালাঘর। ওরে কাল রাত্তিরে বলে রেখে দিয়েলাম, বলি বউ আমার গোপাল দুধ খেতি পায় না। সকালে চা না কি খায়, ওরে খুব ভোরে উঠে গাই দুয়ে দিতি হবে। তাই আজ কুঁকুড়ো ডাকা ভোরে দেখি উঠে আমারে ডাকচে—মা ওঠো, তোমার গোপালের জন্যি দুধ নিয়ে যাও—
—আচ্ছা কেন বল তো তোমার এসব! ছি—না এসব ভাল না। এ রকম আর কখনও এনো না। কত পয়সা দাম দিতে হবে বলে। কতটা দুধ?
আমার গলার সুর একটু রুক্ষ হয়ে উঠেছিল হয়তো, কারণ মুসলমানের বাড়ি দুধ আমাদের গ্রামে চলে না, কে কোনদিক থেকে দেখে ফেলবে এই ছিল আমার ভয়। কেন আবার এসব ঝাট জোটে!
বুড়ি আমার কণ্ঠস্বরের অপ্রত্যাশিত রূঢ়তায় যেন একটু ঘাবড়ে গেল, ভয়ে ভয়ে বললে—কেন বাবা, পয়সা কেন?
—পয়সা না তো তুমি দুধ পাবে কোথায়?
—ওই যে বললাম বাবা আমার মেয়ের বাড়ি থেকে—
—তা হোক তুমি পয়সা নিয়ে যাও। সেও তো গরিব লোক—
বুড়ি পয়সা নিয়ে চলে গেল বটে, কিন্তু সে যে বেশ দমে গিয়েছে তার কথাবার্তার ধরনে বেশ বুঝতে পারলাম।
মনে একটু কষ্ট হল বুড়ি চলে গেলে, পয়সা দিতে যাওয়া ঠিক হয়েছে কি? বুড়ির কি রকম হয়তো মন পড়ে গিয়েছে আমার ওপর, স্নেহের দান—এমন করা ঠিক হয়নি।
বুড়ি কিন্তু এ অবেহলা গায়ে মাখল না আদৌ। প্রতিদিন সকাল হতে না হতে সে এসে জুটবে।
—অ গোপাল, এই দুটো কচি শসার জালি মোর গাছের—এই ন্যাও। নুন দিয়ে খাও দিনি মোর সামনে?
—বুড়ি তোমার চলে কিসে?
—নাৎ জামাইয়ের দেবার কথা, তা সে সবদিন দেয় না। ওই যারে মেয়ে বলি, ও বড্ড ভাল। লোকের ধান ভানে, তাই চাল পায়, আমারে দুটো দুটো না দিয়ে খায় না।
—একা থাকো?
—তা একদিন মোর ঘরখানা না হয় দেখতি গেলে অ মোর গোপাল? আমি নতুন খাজুরপাতার চেটাই বুনে রেখে দিয়েলাম তোমারে বসতি দেবার জন্যি। বাউনের ছেলে মোদের এঁটোকাটা মাদুরে কি বসবে? তাই বলি একটা নতুন চেটাই বুনে রাখি, যখন আসবে এখানেতেই বসবে।
সেবার বুড়ির বাড়িতে আমার যাওয়া আর ঘটে উঠল না ওর এত আগ্রহ সত্ত্বেও। নানাদিকে ব্যস্ত থাকি, তার ওপর আছে সমবয়সী বন্ধুবান্ধবদের দাবি। অনেকদিন পরে গ্রামে এসেছি তো? যে ক’দিন গ্রামে থাকি, বুড়ি রোজ সকালে একবার আসতে ভুলবে না। কিছু না কিছু আনবেই। কখনও পাকা আম, কখনও পাতি লেবু, কখনও এক ছড়া কাঁচকলা কি এক ফালি কুমড়ো। দু আনা চার আনা প্রায় দিই। একদিন একখানা পুরনো কাপড় দিলাম। একটা জিনিস লক্ষ্য করে আসছি, বুড়ি কোনওদিন আমার কাছে কিছু মুখ ফুটে চায়নি। কখনও বলেনি, পয়সা দাও কি অমুক দাও। বরং তার উল্টো, শুধু হাতে কখনও আসে না।
একবার কলকাতা থেকে কয়েকটি বন্ধু গেলেন দেখা করতে।
তাদের নিয়ে ঘরে বসে চা খাচ্চি, স্টোভ ধরিয়ে ঘরেই চা নিজে করেচি, পল্লীগ্রামে এত সকালে কেউ উনুন ধরায়নি। বুড়ি লাঠি ঠুক ঠুক করতে করতে এসে হাজির। বাইরে দাঁড়িয়ে ডাক দিল, অ মোর গোপাল।
হঠাৎ আমার লজ্জা করতে লাগল। কলকাতার বন্ধুবান্ধবদের সামনে, ও আজ না এলেই পারত ছাই। ভাল বিপদ।
—অ মোর গোপাল! ঘরে আছিস নাকি?
ঈষৎ বিরক্তির সুরেই উত্তর দিলাম—হ্যাঁ কেন?
—এই এয়েলাম বলি যাই, গোপালকে দেখে আসি একবার।
বন্ধুদের মধ্যে একজন জিজ্ঞেস করলেন—ও কে হে?
চাপা দেবার চেষ্টায় বললাম—ও এমনি—গাঁয়ের লোক।
আর একজন বললে—তোমার ডাক নাম কি গোপাল নাকি হে গ্রামে?
—হ্যাঁ—না—এই
বুড়ি বললে—কাল রাত্তিরে কি গরম পড়ল। গোপাল ঘুমুতে পেরিলি কাল? মুই চোখ বুঁজিনি সারারাত।
বেশ করনি। ভাল বিপদেই পড়া গেল রে সকালবেলা। আজ না এলে কি চলত না বুড়ির?
বন্ধুটি পুনরায় বললে—ও গোপাল বলছে কাকে হে?
—ইয়ে—হ্যাঁ, আমাকেই বলচে—
কথা শেষ করে ঈষৎ হেসে মাথার দিকে দুটি আঙুল দেখিয়ে ইঙ্গিত করে বললাম—মাথাটা একটু—
বন্ধুটি বললেন—ও।
কথা অনুযায়ী কাজের সামঞ্জস্য রাখতে গিয়ে বুড়ির দিকে চেয়ে যেমন সুরে লোকে দুর্দান্ত পাগলকে সান্ত্বনা দেবার ও স্তোকবাক্য প্রয়োগ করার চেষ্টা করে তেমনি সুরে বলি—আজ যাও, বড্ড ব্যস্ত আছি—বুঝলে? কলকাতার বন্ধুরা সব এসেছেন। হ্যাঁ—
ফল সুবিধেজনক হল না। বুড়ি একগাল হেসে বললে—আজ কি এনেচি বলে দিকি গোপাল? এই দ্যাখো—
এতক্ষণ টের পাইনি যে বুড়ি তার পেছন দিকে একটা ময়লা কাপড়ের পুঁটলি লুকিয়ে রেখেছে। সেটা সামনের দিকে এনে খুলতে খুলতে বললে—সেই যে মেয়েটা মোরে মা বলে, সে দুটো চিড়ে কুটেলো। আমি বললাম, ওকি কুটচিস? ও বললে—কামিনী সরু ধানের ভাল চিড়ে। তোমার গোপালের জন্যি দুটো নিয়ে যেও এখন কাল বেন বেলা। আমার মনডা বড্ড খুশি হল—তা সেও আসছে। সেও তোমারে দেখতি চায়। বড় দুঃখে কাঙাল মেয়েডা। ধান ভেনে চিড়ে কুটে একরকম করে চালাচ্ছে।
একে রামে রক্ষা নেই, বুড়ির কথা শেষ হতে না হতে দেখি একটি আধফর্সা মধ্যবয়সী স্ত্রীলোক অদূরে আমতলায়, এদিকেই আসচে। আরও বিপদে পড়লাম এই জন্যে যে, ঠিক সেই সময় আমার জ্ঞাতি খুড়ো মশায়কেও এদিকে আসতে দেখা গেল। সর্বনাশ! তাঁর বাড়িতে আমার খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা, আর তিনি যদি জানতে পারেন যে এদের হাতে তৈরি চিড়ে বা খাবার জিনিস আমি খাই— তা হলেই তো এ পাড়াগাঁয়ে হয়েছে। চিড়ে যে ওরা আজই প্রথম এনেছে একথা কি তিনি বিশ্বাস করবেন? আজ দুধ, কাল চিড়ে—
রুক্ষ সুরেই বললাম—এখন যাও না—দেখছ না ব্যস্ত আছি?
—চিড়ে কটা নেবার একটা কিছু দ্যাও বাবা।
—ও সব এখন নিয়ে যাও—হ্যাঁ, হ্যাঁ—পরে হবে। এখন যাও—
বুড়ি একটু অবাক হয়ে বললে—তা চিড়ে ক’টা—
খুড়োমশায় প্রায় এসে পড়েছেন দাওয়ার ধারে।
হাত নেড়ে ফেলবার ভঙ্গিতে বুড়ির দিকে চেয়ে বলি—আঃ নিয়ে যাও না—ভাল জ্বালা!
খুড়ো মশায় বললেন—কি ওতে? কি বলচে জমীরের স্ত্রী?
—ও কিছু না। ইয়ে বিক্রি করতে এসেছে—যাও এখন—
ভগবান জানেন, বুড়ি আমার কাছে চিড়ের বদলে পয়সা নিতে আসেনি।
খুড়ো মশায় বললেন—তোমার এখানে ওর বড্ড যাতায়াত—
কথাটা চাপা দেবার জন্যে বললাম—আমার এই বন্ধুরা একদিন মাছ ধরবার কথা বলছিলেন, তা ভাদুড়িদের পুকুরে কি সুবিধে হবে?
পুনরায় গ্রামে এলাম মাস পাঁচ ছয় পরে আশ্বিন মাসের শেষে।
কয়েকদিন পরে ঘরে বসে আছি, বাইরের উঠোনে দাঁড়িয়ে কে ক্ষীণ নারীকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলে— বাবু ঘরে আছেন গা?
বাইরে এসে দেখি গত জ্যৈষ্ঠ মাসে যাকে বুড়ির সঙ্গে দেখেছিলাম সেই মধ্যবয়সী স্ত্রীলোকটি। আমায় দেখে সলজ্জভাবে মাথার কাপড়টা আর একটু টেনে দেবার চেষ্টা করে সে বললে—বাবু, কবে এয়েচেন?
—দিন পাঁচ ছয় হল। কেন?
—আমিও তাই শুনলাম। বলি একবার যাই। আমার সেই মা পাঠিয়ে দেলে, বললে দেখে এসো গিয়ে।
—কে?
—ওই সেই বুড়ি—এখানে যিনি আসত। তেনার বড্ড অসুখ—এবার বোধ হয় বাঁচবে না। গোপাল কবে আসবে, গোপাল কবে আসবে অস্থির, আমারে রোজ শুধোয়। আমি বলি তিনি কলকাতায় চাকুরি করেন, সব সময় কি আসতে পারেন? কি মায়া আপনার ওপর, আর জন্মে বোধ হয় পেটে ধরেল। এ জন্মে তাই এত টান—একবার দেখে আসুন গিয়ে। বড় খুশি হবে তা হলি—
উদাসীনভাবে বললাম—ও!
মন তখন অন্য চিন্তায় বিব্রত। এবার কাউন্সিল ইলেকসনে দুটি বন্ধুর পক্ষ থেকে ভোট সম্বন্ধে গ্রামে গ্রামে বেড়িয়ে লোককে অনুরোধ করবার গুরুভার নিয়ে এসেছি। কাল থেকেই বেরুতে হবে, ওদের মোটর আসবে। কীভাবে কি করা যায়, সেকথাই চিন্তা করছিলাম। কোথায় কোন বুড়ি অসুখ হয়ে পড়ে আছে, ওসব দেখবার সময়াভাব।
স্ত্রীলোকটি বললে—ওবেলা যাবেন বাবু?
—আচ্ছা—তা—এখন ঠিক বলতে পারচিনে—
স্ত্রীলোকটি অনুনয়ের সুরে বললে—একবার যাবেন বাবু ওবেলা। হয়তো বুড়ি বাঁচবে না—
বিকেলের দিকে বেড়াতে যাবার পথে দেখতে গেলাম বুড়িকে। খুব উঁচু দাওয়া, সেকালের প্রণালীতে তৈরি পাঁচচালা ঘর। বুড়ির স্বামীর আমলে আমার জন্মগ্রহণের পূর্বে এ ঘর তৈরি হয়েছিল, তখন এদের অবস্থা যে ভাল ছিল, এই প্রশস্ত পাঁচচালা ঘরখানাই তার নিদর্শন। কিন্তু ঘরখানার সংস্কার হয়নি অনেকদিন, খড় উড়ে পড়চে চালা থেকে, দড়ি বাখারি ঝুলচে, মাটির দাওয়া নানা স্থানে ভেঙে পড়েচে, বাঁশের খুঁটি নড়বড়ে করচে।
বুড়ি শুয়ে আছে একটা ছেঁড়া মাদুরের ওপর, মাথায় তেলচিটা মলিন বালিশ। বুড়ির সেই পাতানো মেয়েটি পাশে বসে ছিল, আমায় দেখে বুড়িকে বললে—অ মা কে এসেচে দ্যাখো—অ মা—
আমি গিয়ে কাছে দাঁড়াতেই বুড়ি চোখ মেলে আমার দিকে চাইলে। পরে আমাকে চিনে ধড়মড় করে বিছানা ছেড়ে উঠবার চেষ্টা করতেই আমি বললাম—উঠো না, উঠো না—ওকি?
বুড়ি আহ্লাদে আটখানা হয়ে বললে—ভাল আছ অ মোর গোপাল? বসতে দে গোপালকে—বসতে দে—
—বসবার দরকার নেই, ব্যস্ত হয়ো না। থাক—
—ওখানা কেন দিচ্ছিস? গোপালের জন্যে ওই খাজুরের চটাখানা পেতে দে—
পরে ঠিক যেন আপনার মা কি পিসিমার মতো অনুযোগের সুরে বলতে লাগলো—তোর জন্যি খাজুরের চটাখানা কদ্দিন আগে বুনে রেখেলাম। ওখানা পুরনো হয়ে ভেঙে যাচ্চে। তুমি একদিনও এলে না গোপাল— অসুখ হয়েছে তাও দেখতে আসো না—
আমি বললাম—আচ্ছা, চুপ করে শুয়ে থাকে। ব্যস্ত হয়ো না।
ইতিমধ্যে পাড়ার অনেক লোকে এসে জড়ো হল, আমি এসেছি দেখে। কেউ কেউ বললে—বুড়ি কেবল আপনার কথা বলে বাবু। আপনাকে দেখবার বড্ড ইচ্ছে। বুড়ি বোধহয় এবার বাঁচবে না।
বুড়ির দুচোখ বেয়ে জল পড়ছে গড়িয়ে। আমায় বললে—গোপাল, যদি মরি, আমার কাফনের কাপড় তুই কিনে দিস—
পাশের লোককে জিগ্যেস করলাম—সে কি?
—জানেন না বাবু? মাটি দেবার সময় নতুন কাপড় কিনে পরিয়ে দিতে হয়—
—ও বুঝেচি।
আমাকে পেয়ে বুডি খুব খুশি হয়েছে। কত কি বলতে লাগল—ওর নাৎজামাই লোক কেমন খারাপ, এমন যে অসুখ, একবার চক্ষু দিয়ে দেখেও যায় না। ঘর? তা দশ বছর খড় পড়েনি চালে। পচে গলে গিয়েছে পুরোন খড়। নাৎজামাইকে বলেছিল, সে জবাব দিয়েচে, অত বড় হাতি ঘর আমি ছাইতে পারব না। পাশে একটা ছোট কুঁড়ে ঘর মতো বেঁধে থাকো।
বুড়ি চোখের জল মুছে বলে—তা থাকতি পারি, হ্যাঁ বাবা? কি নোকের পরিবার আমি। আজই না হয় কপাল পুড়েচে। তা বলে কুঁড়েঘরে থাকতি পারি মুই?
সান্ত্বনা দেবার সুরে বললাম—কথা ঠিকই তো।
—বলো তুমি, গোপাল।
ঘাড় নেড়ে বলি—সত্যিই তো।
আজও সে চালাঘর, সেই ম্লান সন্ধ্যা, ছেঁড়া মাদুরে শোওয়া বুড়িকে আমার মনে পড়ে। ছেঁচতলায় একটা শীর্ণ লাউগাছ, পেছনে কয়েক ঝাড় বাঁশ, এক আধটা খেঁকি কুকুরের আওয়াজ পাড়ায়। শান্ত ছায়া নেমে এসেছে সামনের সারা উঠোনটাতে। কতগুলো মেয়ে-পুরুষ দেখতে এসে দাওয়ার ছেঁচতলায় দাঁড়িয়ে আছে।
আসবার সময় বুড়ির পাতানো মেয়েটির হাতে কিছু দিয়ে এলাম পথ্য ও ফলের জন্যে। হয়তো আর বেশি দিন বাঁচবে না। এই অসুখ থেকে উঠবে না। বুড়ি কিন্তু সে যাত্রা সেরে উঠল। দিব্যি সেরে উঠল। আমি কলকাতায় চলে যাবার আগে দু একবার আমার কাছে লাঠি ধরে গেল। বসে বসে আপনমনে কত কি বকে, তারপর চলে আসে।
বছর দুই কাটল। এই দুবছরের মধ্যে যখনই গিয়েচি গ্রামে, বুড়ি এসে বসে, কিছু না কিছু নিয়ে আসবেই। অসুখটা থেকে উঠে দুর্বল হয়ে পড়েছিল, সে দুর্বলতা ওর আর সারল না।
আমি বলতাম—কেন আসো রোজ রোজ অতদূর থেকে?
—এই পাকা নোনা ভাবলাম গোপালকে দিয়ে আসি—
—তা হোক, তুমি কষ্ট করে এস না এরকম।
—তুই তো আমাকে দেখতি যাবি নে কোনদিন—
—সময় পেলেই যাব। এখন বাড়ি যাও।
কখনও বুড়ি বলত— অ গোপাল, তুই বিয়ে করলি নে কেন?
—মেয়ে পাওয়া যায় না। তা ছাড়া বয়েস হয়ে গিয়েছে।
—কিচ্ছু বয়েস হয়নি। কাঁচা ছেলে তোমরা। (আমার বয়েস তখন চল্লিশ)
—বেশ।
—ওই মুখুয্যেদের বাড়ি একটা বড় মেয়ে আছে, তোমার সঙ্গে মিল হবে। বলে দেখবানি ওদের।
—আমার ঘটকালি করবার লোকের যখন দরকার হবে, তখন তোমায় ডেকে পাঠাব। এখন যাও।
কিন্তু বুড়ি আমার কথা শুনে না। এক দিন মুখুয্যে বাড়ির নরু আমায় ডেকে বললে—ওহে, একটা কথা বলি। আজ জমীর করাতির বউ বুড়ি বাড়ির মেয়েদের কাছে গিয়ে বলচে কি গোপালের সঙ্গে তোমার পুঁটির বিয়ে দাও। মেয়েরা তো অবাক, গোপাল কে? শেষে জানা গেল—তুমি। ওরা তো শুনে আশ্চর্য্যি। তা তুমি কিছু বুড়িকে বলেছিলে নাকি এ সম্বন্ধে?
আমি নিজেকে নিতান্তই বিপন্ন ও অসহায় বোধ করলাম। বললাম—সে কি কথা? কক্ষনও না। তুমি কি বিশ্বাস কর—
—না-না—বিশ্বাস অবিশ্যি করিনি। যাই হোক, যদি কিছুই বলে থাকো বুড়িকে, অমন ওকে বারণ করে দেবে আর না বলে। গ্রাম ভাল নয়, ও নিয়ে মেয়েটার নামে একটা কথাকথি যদি হয়—
—নিশ্চয়। তুমি বিশ্বাস কর ভাই, আমি এর বিন্দু বিসর্গ জানি নে।
বুড়ি তারপর দিন যেমন সকালে এসেছে, বকলুম ওকে। কে তাকে এসব কাণ্ড করতে বলেছে? ঘটকালি করতে ডেকেছিল কেউ তাকে? গাঁয়ে এই নিয়ে শেষে একটা কথা উঠবে, পাড়াগাঁ জায়গা খারাপ। তুমি বাপু এখানে আর এসো না।
বুড়ি ফ্যাল ফ্যাল চোখে চেয়ে বললে—বকিস নে অ গোপাল, মোরে বকিস নে। তা তুই ও মেয়েডারে বিয়ে না করিস—অন্য কোনও মেয়ে বিয়ে কর। পুঁটিরে তোর পছন্দ হয়নি না?
ধমকে উঠে বললাম—আবার ওই সব কথা?
নিতান্ত সরলা সেকেলে বুড়ি। কিছু বোঝেও না।
সত্যিই এই ঘটনা নিয়ে গ্রামে একটু কথা বার্তার সৃষ্টি হল। বুড়ির ওপর খুব চটে সকালবেলাটা আর ঘরেই থাকিনে, পাছে বুড়ি এসে জ্বালাতন করে। দশ বারোদিন পরে একদিন দুপুরে ঘুমিয়ে উঠেছি, বাইরে বুড়ির গলা শোনা গেল—অ মোর গোপাল।
ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললাম—কি? আবার এসেছ কেন এখানে?
—একটা বাতাবি নেবু নিয়ে এয়েলাম তোমার জন্যি—
—দরকার নেই বাতাবি নেবুতে। যাও এখন—
বিরক্তি নিতান্ত অকারণ নয়। মাত্র পাঁচদিন আগে মুখুয্যে বাড়ির ঘটনা নিয়ে আমার জ্ঞাতি খুড়ো আমায় দুকথা শুনিয়ে দিয়েচেন।
বছরখানেক আর গ্রামে যাইনি এর পরে। বোধ হয় দেড় বছরও হতে পারে। একবার শেষ শরতে পুজোর ছুটির পর কাশী থেকে বেরিয়ে কলকাতায় এসে দেখি তখনও ছুটি হাতে আছে। গ্রামেই গেলাম এই দুদিন কাটাতে। গ্রামে ঢুকতেই প্রথমে দেখা পরশু সর্দারের বউ দিগম্বরীর সঙ্গে। দিগম্বরী অবাক হয়ে বললে—ও মা, আজই তুমি এলে বাবাঠাকুর? সে বুড়ি যে কাল রাতে মারা গিয়েছে। তোমার নাম করলে বড্ড। ওর সেই পাতানো মেয়ে আজ সকালে বলছেল—
আমি এসেচি শুনে বুড়ির নাতজামাই দেখা করতে এল। বাবু এসেচেন, কিছু সাহায্য করুন, কাফনের কাপড় কিনতি। যা দাম কাপড় চোপড়ের। আমার মনে পড়ল বুড়ি বলেছিল সেই একদিন—আমি মরে গেলে তুই কাফনের কাপড় কিনে দিস বাবা।
ওর স্নেহাতুর আত্মা বহুদূর বারাণসী থেকে আমায় কিভাবে আহ্বান করে এনেচে। আমার মন হয়তো ওর ডাক এবার আর তাচ্ছিল্য করতে পারেনি।
কাপড় কিনবার টাকা দিলাম। নাতজামাই বলে গেল—মাটি দেওয়ার সময় একবার যাবেন এখন বাবু। বেলা বারোটা আন্দাজ যাবেন—
শরতের কটুতিক্ত ওঠা বনঝোপ ও মাকাল লতা-দোলানো একটা প্রাচীন তিত্তিরাজ গাছের তলায় বৃদ্ধাকে কবর দেওয়া হচ্ছে। আমি গিয়ে বসলাম। আবদুল, শুকুর মিঞা, নমর, আমাদের সঙ্গে পড়ত আবেদালি, তার ছেলে গণি—এরা সকলে গাছের ছায়ায় বসে। প্রবীণ শুকুর মিঞা আমায় দেখে বললে—এই যে বাবাঠাকুর এস। তামুক খাবা? বুড়ির মাটি দেওয়ার দিন তুমি কনে থেকে এলে, তুমি তো জানতে না? তোমায় যে বড্ড ভালবাসত বুড়ি। তোমার কাছে কাফনের কাপড় নিয়ে তবে ওর মহাপ্রাণীডা ঠাণ্ডা হল। খাও তামুক—
একটা গোরুর গাড়ির পুরনো কাঠামোর ওপর বৃদ্ধাকে কাঁথামুড়ি দিয়ে শুইয়ে রেখেচে। দুজন জোয়ান ছেলে কবর খুঁড়চে। কবর দেওয়ার পরে সকলে এক এক কোদাল মাটি দিলে কবরের ওপর। শুকুর মিঞা বললে—দ্যাও বাবাঠাকুর তুমিও দ্যাও—তুমি দিলে ওর মহাপ্রাণ ঠাণ্ডা হবে—
দিলাম এক কোদাল মাটি। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, ও বেঁচে থাকলে বলে উঠত—অ মোর গোপাল।
বার্ষিক সংখ্যা ১৩৫০(১৯৪৪)