আশার কথা
দুটো আশার কথা বলো তো, সে তোমার গল্পের মতো শোনালেও আপত্তি নেই। যত নিরাশার কথা শুনতে শুনতে কেমন যেন একটা অবসাদ এসে যাচ্ছে।
বেশ, তবে তাই হোক। আমার প্রতিবেশী সমীরবাবু একজন সঙ্গীত শিক্ষক। অত্যন্ত ভালো মানুষ নিরীহ সজ্জন। মেয়ের বিয়ে দেবেন, ব্যাংক থেকে মোটা টাকা, জীবনের সব সঞ্চয় তুলে এনে বাড়িতে রাখলেন। সেই রাতেই সব চুরি হয়ে গেল। যথাসর্বস্ব।
পাশেই থানা। গেলেন। অফিসার ইনচার্জ সব শুনে বললেন, ‘সমীরবাবু, কোনও চিন্তা নেই। মেয়ের বিয়ে যে কত বড় একটা ব্যাপার তা আমি জানি। মাসখানেক আগে আমার বড়মেয়ের বিয়ে দিয়েছি, আরও দুটোর দিতে হবে। নিন চা-টা খান। বাড়ি গিয়ে আরাম করুন, কাল সকালেই টাকা ফেরত পাবেন। গ্যারান্টি।’
সমীরবাবু বললেন, ‘স্যার ক্যাশ ছাড়াও অর্নামেন্টস ছিল। সে-সবও নিয়ে গেছে।’
‘স্যার স্যার করবেন না তো। আপনি আমার শ্রদ্ধেয় দাদা। গুণী মানুষ। জেনে রাখুন, কান টানব মাথা চলে আসবে। ক্যাশের সঙ্গে সঙ্গে অর্নামেন্টস। আপনার কোনও চিন্তা নেই, চোরের কাজ চোর করেছে, এইবার পুলিশের কাজ পুলিশ করবে।’
পরের দিন সকাল দশটার সময় সেকেন্ড-অফিসার সসম্মানে সব ফেরত দিয়ে গেলেন। বললেন, ‘মিলিয়ে নিন, কম বেশি হলে জানাবেন।’
মেলাতে গিয়ে দেখা গেল, ক্যাশ তিনশো টাকার মতো কম, কিন্তু প্রায় দশ ভরির মতো একটা সোনার হার বেশি চলে এসেছে। সমীরবাবু সঙ্গে সঙ্গে দৌড়লেন থানায়। ওসি বললেন, ‘ওটা আপনার মেয়েকে আমাদের উপহার।’
সমীরবাবুর চোখে জল। খারাপ আর ভালোয় মিশিয়ে পৃথিবীটা কত সুন্দর! অমন ভালো একটা ছেলে, বলে কি না বিয়েতে একটা পয়সাও নেবে না। মনের মতো মেয়েকে সহধর্মিণী করছে, এ তো ব্যাবসা নয়।
ছেলের বাবারও কী চমৎকার কথা—’বেয়াই মশাই এতদিন মেয়ে ছিল আপনার এইবার হবে আমার। মাকে যেন সুখে রাখতে পারি।’
(আসলে এসব কিছুই হয়নি সমীর থানায় গিয়ে দাবড়ানি খেয়ে ফিরে এসেছিলেন, ধ্যার মশাই! চোর ধরার সময় আমাদের আছে! ব্যাংক-ডাকাত ধরতেই হিমসিম অবস্থা। এক লাখ টাকা আবার টাকা! এক কোটি হলে দেখা যেত। ওটা আপনার সৎপথের উপার্জন ছিল না। ইনকাম ট্যাক্স দিয়েছিলেন? যান যান, বাড়ি যান। বেশি খোঁচাখুঁচি করলে নিজেই বিপদে পড়ে যাবেন।
ছেলের বাবাকে বলতে গিয়েছিলেন, এইরকম একটা সর্বনাশ হয়ে গেছে, নগদটা যদি একটু কনসিডার করেন। পঞ্চাশ বলেছিলেন, যদি পঁচিশ হয়।
হিমশীতল হেসে ভদ্রলোক বলেছিলেন, ছেলে আমার ইঞ্জিনিয়ার। আজকাল প্রেমের বিয়েতেও নগদ লাগে। আমি তো অনেক কম বলেছি।)
পরিণতি, নিজের বসত বাড়ি বিক্রি করে মেয়ের বিয়ে দিয়ে সমীর এখন সপরিবারে ভেসে বেড়াচ্ছেন।
তুলসী। নতুন বছর এসে গেল। ওই দেখো নতুন প্রভাত। আনন্দ হচ্ছে না?
সঞ্জীব। দু:খ হচ্ছে। মৃত্যুর দিকে এক বছর এগিয়ে গেলুম।
তুলসী। বুড়োদের ওই এক ব্যামো। মরণ ছাড়া মাথায় কিছু আসে না।
সঞ্জীব। আসবে কী করে। পরমায়ু যে কলশির জল। গড়াতে, গড়াতে গড়াতে গড়াতে, একদিন ঠং।
তুলসী। এখান থেকে যখন ওখানে যাবে ঈশ্বর নিশ্চয় তোমাকে জিগ্যেস করবেন, বাপু হে, অভিজ্ঞতাটা কেমন হল? তখন তুমি কী বলবে?
সঞ্জীব। বলব, পিত:, সে এক জবরদস্ত ব্যাপার। আড়ং ধোলাই জিনিসটা কী, তা তাঁতের কাপড়ই শুধু জানে না, আমারও কিছু জানা হল।
তুলসী। সেটা কী?
সঞ্জীব। পাটপাট কাপড়। সেই কাপড়ের পরতে-পরতে মাড় দিয়ে কাঠের মুগুর দিয়ে পেটানো। যত পেটায় ততই জেল্লা খোলে সুতোর। পাটে পাটে মাড় ঢুকে যায়। শুকোবার পর টাইট এক পিস কার্ডবোর্ড। এইবার সেই কাপড় যিনি পরবেন, তিনি বুঝবেন কী জিনিস! এক এক পরত খুলতে জীবন বেরিয়ে যাবে। ধৈর্যের অভাব হলেই ছিঁড়ে ফরদাফাঁই! সেই কাপড় পরার পর পেখমমেলা ময়ূরের মতো দেখাবে। আগে চলে কোঁচা, পিছে চলে বাছা। কোঁচার খোঁচায় চোখ চলে যেতে পারে। প্রভু সংসারে আমার এই অভিজ্ঞতা হল।
তুলসী। বেটা ব্যাখা করো।
সঞ্জীব। জীবন নামক বসনে দু:খসুখের মাড় তারপর নানা হাতের পেটাই। তারপর আড়ষ্ট এক কাষ্ঠখণ্ড। হাত-পা ছ্যাতরানো। চোখে একটা ভ্যালভ্যালে, ফ্যালফ্যালে দৃষ্টি। দেহের জেল্লা বাড়ল না বটে, মনের জেল্লা নিশ্চয়ই বাড়ল, কারণ জীবনের দাম এতটাই কমল যে, মরার সময় মনেই হবে না দুর্লভ একটা কিছু হারাতে চলেছি। ‘এমন মানব-জনম আর পাবে না।’
তুলসী। পড়ে রইল তোমার আম কাঠের জাম্বোজি খাট।
সঞ্জীব। সেই খাটে পেতেছিলাম বোনাসের টাকায় তৈরি ছোবড়ার গদি। এ-বস্তু একমাত্র ভারতেই ভাবা যায়। ভেতরে আড়াই মন ছোবড়ার পাউডার। কত বড় দর্শন। নীরবে পড়ে থাকে আমাদের দেহের তলায়।
তুলসী। একদিন সবাই যা হবে। ছোবড়া!
সঞ্জীব। এ বস্তু হল তাই। সংসার তোমার শাঁস আর জলটি খেয়ে নেবে, তারপর সবাই মিলে তোমার আঁশ ছাড়াবে, তারপর তুমি শুকনো খোলাটি হয়ে স্বর্গারোহণ করবে।
তুলসী। পড়ে থাকবে তোমার ওই লীলাভূমি।
সঞ্জীব। টিকিনের খোল। বেরিয়ে আছে ছোবড়ার হুল জায়গায়-জায়গায়। তার ওপর একটি তোশক।
তুলসী। তুলো আর ফুলো নেই। দেহের চাপে চাটু।
সঞ্জীব। তপ্ত কটাহ একেই বলে। জীবন-রঙ্গমঞ্চও বলা চলে। ফুলশয্যা থেকে মৃত্যুশয্যা।
তুলসী। বুড়োর স্মৃতিতে অতীত আসছে?
সঞ্জীব। ধরেছ ঠিকই। এই ছোবড়ার গদি তৈরি হয়েছিল এক শীতের দুপুরে।
তুলসী। তখনই বোঝা গিয়েছিল নতুন একটি সংসারের পত্তন হচ্ছে।
সঞ্জীব। বত্রিশ নম্বর বাড়িতে। যদিদং হৃদয়ং হয়ে গেছে। ওঁ প্রজাপতয়ে নম: দিয়ে শুরু। মাঝেমাঝে হিন্দি সিনেমার এক-একটা গান এত অর্থবহ হয়ে ওঠে। দৃশ্যটাও
তুলসী। কোনটা?
সঞ্জীব। ফাঁকা মাঠ। এপাশে একটা বাঁশ ওপাশে একটা বাঁশ। টান টান দড়ি। দড়ির ওপর হেমা মালিনীর ব্যালেন্স। নীচে ধর্মেন্দরের নাচ আর গান—আহা, আহা, আহা খেল শুরু হো গয়া।
তুলসী। পৃথিবীতে কী কী অবিচ্ছেদ্য!
সঞ্জীব। কী কী অবিচ্ছেদ্য! হাঁড়ি ও সরা। জুতো ও শুকতলা। গোলাপ ও কাঁটা। গাড়ি আর চাকা। চাল আর কাঁকর। নেতা আর বক্তৃতা। শিল্প আর ধর্মঘট। বাংলা আর বাংলা বনধ। হনুমান ও ল্যাজ। কুকুর ও ঘেউ। ম্যাও আর মিউ। স্ত্রী আর তিরস্কার। গাড়ি আর হর্ন। বিদ্যুৎ আর অন্ধকার। মন্দির ও পাণ্ডা। পুজো আর চাঁদা। উৎসব ও মাইক। মাংস আর পেঁয়াজ। মাথা আর মাথাধরা। আকাশ আর তারা। আঙুল আর নখ, স্বামী আর স্ত্রী।
তুলসী। খাট আর ছোবড়ার গদি। একটা জবরদস্ত কম্বিনেশান। একেবারে মাপে-মাপে খাটে চাপিয়ে দেওয়া হল। তিনমনী এক কৈলাস।
সঞ্জীব। ধুনুরি লাঠি দিয়ে পেটাতে পেটাতে বলে গেল, এ বাবু শুতে শুতে সমান হয়ে যাবে। মোটা কেউ নেই? একজোড়া শুইয়ে রাখবেন একমাস। একেবারে প্লেন, ফাসক্লাশ।
তুলসী। তোমার চেহারা তো বৃষকাষ্ঠের মতো।
সঞ্জীব। মোটা হওয়ার কম চেষ্টা করেছি। শেষে নিউট্রিশান স্পেশ্যালিস্ট বললেন, ‘আপনার আদলটাই ওইরকম। বংশগতির ধারা। আপনার পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ, সকলেই মনে হয় খেতে পেতেন না। এ হল গিয়ে না-খাওয়ার, না খেতে পাওয়ার ট্রাডিশান।
তুলসী। ব্যায়াম। মোটা হয় ব্যায়ামে।
সঞ্জীব। সেও বাকি রাখিনি। কোঁত পেড়ে পেড়ে পঁচিশটা ডন, পঞ্চাশটা বৈঠক। এক জামবাটি আলোচালের ফ্যানে বিট নুন দিয়ে। রক্ত আমাশা। স্কেলিট্যান। পটল তোলে আর কী। শুনেছিলুম বিয়ার খেলে মোটা হয়। হয়ে গেল জন্ডিস। জবরদস্ত আর হওয়া গেল না।
তুলসী। জবরদস্ত আম কাঠের খাটে, জবরদস্ত ড্যালা পাকানো ছোবড়ার গদিতে কেটে গেল জীবন।
সঞ্জীব। ট্রাম, বাস আর ট্রেন থেকে ছারপোকার বাচ্চা এনে ছেড়েছিলুম। চাষ বেশ ভালোই হয়েছিল। মানুষের কথার হুল আর ছারপোকার হুল।
তুলসী। একটা মনে আর একটা দেহে!
সঞ্জীব। এমন ‘ডবল আকুপাংচার’ চিনারাও দিতে পারবে না।
তুলসী। তোমার শেষ কথা।
সঞ্জীব। হোল ফ্যামিলির হাতে, সমাজ সংসারের হাতে জবরদস্ত পেটাই হয়ে মনেপ্রাণে মোক্ষলাভ করে, এখন চলেছি মহাপ্রস্থানে।
তুলসী। কী জ্ঞান লাভ হল?
সঞ্জীব। পৃথিবী ঈশ্বরের লন্ড্রি। ডাইং অ্যান্ড ক্লিনিং। ওপরে মনে হয় এইভাবেই বলাবলি চলে, ‘ওরে ডেট হয়ে গেছে। ডেলিভারি নিয়ে আয়।’
তুলসী। শুরুতেই শেষের কথা বলছ কেন?
সঞ্জীব। শেষ থেকে আবার শুরু হবে বলে, যেমন নববর্ষ। নতুন ক্যালেন্ডার। কেউ শুরু করবে, কেউ শেষ করবে। এদিকে ট্যাঁ, ওদিকে ভ্যাঁ।
জীবনের দোলাঘড়ি দুলছে।
একের আগেই দেখো।
বারো লেখা আছে।