প্রথম খণ্ড (শ্রদ্ধেয় ফণিভূষণ আচার্যকে)
1 of 2

আলোর বদলে আলেয়া

আলোর বদলে আলেয়া

বকরূপী ধর্ম যুদ্ধিষ্ঠিরকে নানা প্রশ্ন করেছিলেন। ধার্মিক যুধিষ্ঠির সব প্রশ্নেরই সঠিক উত্তর

দিয়েছিলেন। একালের যুধিষ্ঠিরকে একালের ধর্ম প্রশ্ন করলেন, ‘বলো তো বাছা, সবচেয়ে রসিক কে?’

যুধিষ্ঠির ভেবেচিন্তে বললেন, ‘যাঁরা হঠাৎ হঠাৎ লোডশেডিং প্রকল্প চালু রেখেছেন তাঁরাই এ যুগের রসিক-পুরুষ প্রভু! এই আলো—এক ফুঁয়ে সব অন্ধকার। মুখের ওপর ছাতা বন্ধের মতো।’

ধর্ম হাসলেন, ‘তুমি দু-নম্বর রসিক পুরুষদের কথা বললে। এক নম্বর কে?’

যুধিষ্ঠির অনেক ভাবলেন। মাথায় কিছু এল না। একবার ভাবলেন, ‘যাঁরা রাস্তায় একের পর এক গর্ত খুঁড়ে চলেন তাঁরা, অথবা যাঁরা ম্যানহোলের ঢাকা নিয়ে সরে পড়েন তাঁরা। একবার ভাবলেন তাঁরা, যাঁরা একই সঙ্গে বন্ধ আর বন্ধবিরোধী নীতি সমর্থন করেন। শেষে কুল-কিনারা না পেয়ে আত্মসমর্পন করলেন, ‘পারলুম না প্রভু।’

ধর্ম বললেন, ‘তোমার পকেটে দেশলাই আছে?’

‘আছে প্রভু।’

‘বের করো।’

যুধিষ্ঠির দেশলাই বের করলেন। ধর্ম নিজের ঠোঁটে একটা সিগারেট লাগিয়ে বললেন, ‘নাও, ধরিয়ে দাও।’

যুধিষ্ঠির বারুদে খ্যাঁচাক খ্যাঁচাক করে কাঠি ঘষতে লাগলেন। একটা গেল, দুটো গেল, তিনটে গেল। কাঠি ঘষতে-ঘষতে বারুদের ছালচামড়া উঠে গেল। একটা যদিও বা জ্বলল, ফিড়িক করে নিবে গেল। অধিকাংশ কাঠির মুন্ডু ভেঙে ছিটকে চলে গেল। যতই ঘষছে যুধিষ্ঠিরের উত্তেজনা ততই বেড়ে যাচ্ছে। রাগে ভেতরটা কষকষ করছে। হাত কাঁপছে। মনে-মনে একবার শ্যালক সম্বোধন করে ফেলেছেন।

ধর্ম ঠোঁট থেকে সিগারেট নামিয়ে বললেন, ‘কী বুঝলে?’

‘আজ্ঞে প্রভু, রাশকেল।’

ধর্ম হেসে ফেললেন, ‘এক নম্বর রসিক পুরুষ হলেন তাঁরা, যুধিষ্ঠির, যাঁরা এই দেশলাই নামক বস্তুটি বানান। তোমার হাতে সময় আছে তো?’

‘আছে প্রভু।’

‘তাহলে এই ঢিবির ওপর আসন গ্রহণ করো।’

ধর্ম আর যুধিষ্ঠির পাশাপাশি বসলেন। ঢিবির একপাশ থেকে খুকখুক করে দুবার কাশির শব্দ ভেসে এল। দুজনেই ফিরে তাকালেন। একটি ছেলে আর একটি মেয়ে পাশাপাশি বসে আছে ঘনিষ্ঠ হয়ে আগাছার জঙ্গলে।

ধর্ম বললেন, ‘ওহে, তোমাদের যে সাপে কামড়াবে। জায়গাটা বাপু ভালো বাছা হয়নি। ছেলেটি উদ্ধত ভঙ্গিতে বললে, ‘রেসের বই দেখছেন, দেখুন। আমাদের ব্যাপারে মাথা গলাতে হবে না।’

যুধিষ্ঠির বললেন, ‘রেসের বই মানে?’

তোমার তো জানা উচিত। ভুলে গেলে! পাশা খেলতে গিয়ে বনবাসে গিয়েছিলে, মনে আছে? ঘোড়া, সাট্টা, তিন তাস, লটারি, সবই জোর কদমে চলছে। না:, এই জায়গাটা আমাদের জন্যে নয়। আমরা প্রেম-পারাবারে এসে পড়েছি। চলো, আমরা অন্য কোথাও যাই।’

যুধিষ্ঠির যেতে-যেতে প্রশ্ন করলেন, ‘প্রভু যে দেশে এত প্রেম, সে-দেশে রোজ শয়েশয়ে লাশ পড়ছে। প্রদেশে প্রদেশে কোস্তাকুস্তি চলছে, কেন প্রভু! প্রেম-পারাবারে জাতির ভরাডুবি। এর কারণ কী!

‘যুধিষ্ঠির! তোমরা পঞ্চস্বামী দ্রৌপদীকে কী ভালোবাসতে না?

‘বাসতুম, প্রভু।’

‘তাহলে রাজসভায় যখন মায়ের কাপড় খোলার চেষ্টা হচ্ছিল, তখন তোমরা পাঁচ-পাঁচটা বীর বসে দাঁত দিয়ে আঙুলের নখ কাটছিলে কেন?’

‘কী করব, প্রভু! দ্রৌপদীকে যে বাজি রেখে হেরে গিয়েছিলুম। আর কোনও উপায় ছিল না।’

‘সেই একই ব্যাপার, যুধিষ্ঠির, এই দেশের এখন পাঁচশো স্বামী। পাশার দান পড়ছে। শকুনিমামার খিলখিল হাসি আর দু:শাসনের শাড়ি ধরে টানাটানি। শ্রীকৃষ্ণ গীতা মাথায় দিয়ে যোগনিদ্রায়। তুমি বাপু, পুরোনো কাসুন্দি আর ঘেঁটো না। এসো, এই জায়গায় একটু বসা যাক।’

‘স্থানটি বড় নির্জন, প্রভু! ছেনতাই মেনতাই হতে পারে।’

আমাদের আর কী নেবে? প্রাণ ছাড়া আর কিছুই তো নেই আমাদের। বোসো। দেশলাই-এর গল্প শোনো।’

‘প্রভু, লাল পিঁপড়ে ঘুরছে।’

‘ঘুরুক। প্রতিবেশীর কামড়ের চেয়ে মিষ্টিই লাগবে। হ্যাঁ, কী বলছিলুম? রসিক দেশলাই। গোটাকতক ঢ্যাঙা-গলা চিমনি কিনেছি। যাকে তোমরা বলো পিকক ল্যাম্প। আলো বেশ ভালোই হয়। সেদিনে কী হল শোনো! ধাঁই করে আলো নিবে গেল। হাতড়ে হাতড়ে চিমনি বের করে আনলুম। জিরাফ-গলা চিমনি খুলে মেঝেতে রেখে, দেশলাইয়ের খেল শুরু করলুম। খ্যাঁচ খ্যাঁচ। বাঙালির মতো চমকায়, জ্বলে না কিছুতেই। মেজাজ চড়ছে। হাতের জোর বাড়ছে। ডবল কাঠি, ট্রিবল কাঠি একসঙ্গে করে জ্বালাবার চেষ্টা। একা না পারিস, সকলে মিলে জ্বলে ওঠ। ফিস করে একটা যাওবা জ্বলল, সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে ফুস। শুনে রাখো, যুধিষ্ঠির, গুমট দিনে যদি বাতাস চাও তো একের পর এক দেশলাই জ্বেলে যাও। ঝড় বয়ে যাবে। অবশেষে কী হল জানো! ধৈর্য হারিয়ে বারুদের গায়ে জোরে কাঠি মারলুম। অন্ধকারে হাত ফসকে গেল। চিমনি ছিটকে চলে গেল, এ-কোণ থেকে ও-কোণে। ভাঙা কাচের হাসি। বুঝলে যুধিষ্ঠির, সবচেয়ে বড় রসিক তারা, যারা স্বাধীন দেশলাই তৈরি করে। বুকে আগুন, মুখে আগুন। ঘুমিয়ে আছে। সেই ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে! বিদেশি দেশলাই চাই। সেই আগুনে যদি স্বদেশি দেশলাই জ্বলে! স্বদেশি চেষ্টায় সব চুরমার।’

‘বুঝেছি প্রভু, জ্বলতে চায়, তবু জ্বলে না। জ্বালাবার চেষ্টায় ছটফট। যত ছটফটানি তত ভাঙন।’

‘শোনো বৎস। শেষ রসিকতাটি শোনো। যার নাম ভাগ্য। কাঠি একদিন জ্বলেছিল। অন্ধকারে তাড়াতাড়ি পলতে বাড়াতে গেলুম। বামে ঘোরাব, না ডানে ঘোরাব। খেয়াল নেই। পলতে তলিয়ে গেল তেলের গর্ভে। হাতের কাঠি হাতে জ্বলে, হাতেই নিবে গেল। দীপের বদলে ফোসকা।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *