আলেকজান্ডার ফ্লেমিং (১৮৮১–১৯৫৫) – পেনিসিলিনের আবিষ্কারক
জীবাণু নিয়ে নানাধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা করছিলেন তিনি। কিন্তু বারবারই ব্যর্থ হচ্ছিলেন। ইনফ্লুয়েঞ্জা সম্পর্কিত জীবাণু প্রতিপালনের ডিশগুলোর কাছে তিনি যতবার যাচ্ছিলেন, ততবারই বিরক্ত হয়ে সেগুলোকে আবার নামিয়ে রাখছিলেন।
ব্যর্থতা আর বিরক্তিতে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছিল ড. আলেকজান্ডার ফ্লেমিংয়ের (Alexander Fleming)। সব নষ্ট হয়ে গেল। যে জীবাণুগুলোকে তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য এতদিন ধরে যত্নে প্রতিপালন করছিলেন, তার সবই কিনা নষ্ট হয়ে গেল একটা সবুজ ছত্রাকের জন্য!
আর কী অবাক করা ঘটনা, যে-সবুজ ছত্রাকগুলোর জন্য তাঁর গবেষণা নষ্ট হয়ে গেল বলে দুঃখ করছিলেন, শেষ পর্যন্ত সেগুলোই তাঁকে এনে দিল বিশ্বজোড়া খ্যাতি। আসলে তিনি যা অনুসন্ধান করছিলেন, তা ছিল এই সবুজ ছত্রাক, যার বৈজ্ঞানিক নাম পেনিসিলিম নোটা টু উম (Penicillium Notatum)। তিনি প্রথমে দেখে চিনতে পারছিলেন না বলেই ঘটেছিল এই বিপত্তি।
পরবর্তীকালের চিকিৎসাশাস্ত্রের আলোড়ন সৃষ্টিকারী যে অধ্যায়, সেই পেনিসিলিন আবিষ্কারের এটাই ছিল গোড়ার কথা। ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯২৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, লন্ডনের সেন্ট মেরি হাসপাতালে।
প্রথমটায় না পারলেও এই রহস্যময় সবুজ ছত্রাক চিনতে বেশিক্ষণ দেরি হয়নি ড. ফ্লেমিংয়ের। কৌতূহলের বশেই তিনি এই বিরক্তিকর সবুজ ছত্রাকটি কী, সেটা পরীক্ষা করতে গিয়েছিলেন। তিনি অণুবীক্ষণ যন্ত্রে পরীক্ষা করে দেখলেন রকফোর্ট পনিরের মতো দেখতে এই সবুর ছত্রাকের চারপাশে একটি আশ্চর্য চক্রের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বিস্ময়ে আরও লক্ষ্য করলেন যে, এই চক্রাকার স্থানটি জীবাণুমুক্ত। আর তখনই বুঝতে পারলেন, তিনি এমন কিছু আশ্চর্য পদার্থের সাক্ষাৎ পেয়েছেন, যা জীবাণুকে ধ্বংস করতে সক্ষম।
এভাবেই এক চরম হতাশাকর অবস্থা থেকে সহসাই আলোর সন্ধান লাভ করলেন ড. আলেকজান্ডার ফ্লেমিং।
পরে তিনি এই সবুজ ছত্রাককে টেস্টটিউবে ভরে পরীক্ষা করে দেখলেন এগুলো রুটি, মাংস এবং পনিরের মধ্যে ভালো থাকে। তিনি এও লক্ষ্য করলেন এই সবুজ ছত্রাক জীবাণু ধ্বংস করে এবং রক্তের শ্বেতকণিকারও কোনো ক্ষতি করে না।
প্রাথমিক পর্যায়ে কৃতকার্য হলেও ড. ফ্লেমিং তাঁর গবেষণাকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হলেন না। এরপর ১৯২৯ সালে তাঁর গবেষণাকাজে সার্বিক সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে এলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. হাওয়ার্ড ফ্লোরে (Dr. Howard Florey)। তিনি ফ্লেমিংয়ের সূত্র অনুসারে সর্বপ্রথম তৈরি করতে সক্ষম হন স্বাভাবিক পেনিসিলিন। প্রথমে ইঁদুরের ওপর, পরে মানুষের ওপর গবেষণা চালিয়েও সফল হন তিনি।
১৯৪০ সাল নাগাদ পেনিসিলিনের জাদুকরি নিরাময়ক্ষমতা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। নিজের এই সাফল্যের আনন্দে অভিভূত হয়ে ফ্লেমিং বলেছেন, মানুষ এটাকে অলৌকিক জিনিস বলে অভিহিত করেছে। বিজ্ঞানী হিসেবে এই প্রথমবারের মতো আমিও স্বীকার করছি, এর সাহায্যে হাজার হাজার মানুষের জীবন রক্ষা পেয়েছে।
১৯৪৫ সাল থেকে পেনিসিলিনের ব্যাপকভিত্তিক উৎপাদন শুরু হয়।
পেনিসিলিন আবিষ্কারের জন্য ১৯৪৫ সালে ড. ফ্লেমিং এবং ফ্লোরেকে যৌথভাবে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করা হয় এবং দেয়া হয় নোবেল পুরস্কার। এ ছাড়াও মার্কিন ঔষধ প্রস্তুতকারক সমিতি ফ্লেমিংকে অ্যাওয়ার্ড অব ডিস্টিংশন উপাধিতে ভূষিত করে।
তৎকালীন মহামান্য পোপ পায়াস তাঁকে মানবজাতির মহোপকারী বলে অভিহিত করেন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় ও প্যানিসিলভ্যানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি প্রদান করে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে বলেন, মানবজাতি আপনার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞ।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি, এই মহান বিজ্ঞানীর, জীবন-বৃত্তান্ত সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় নি। কারণ, তিনি সবার কাছ থেকে নিজের জীবনকে আড়াল করে রাখতে পছন্দ করতেন বেশি।
আলেকজান্ডার ফ্লেমিং-এর জন্ম ১৮৮১ সালে স্কটল্যন্ডের আয়র শহরে। পিতা ছিলেন একজন কৃষক। একেবারে ছোটবেলা থেকেই প্রচণ্ড কৌতূহলী ছিলেন তিনি। সবকিছুকেই খুঁটিয়ে দেখা ছিল তাঁর অভ্যাস। এটা ছিল তাঁর এক ধরনের খেলাও, যে অনুসন্ধানের খেলা খেলে গেছেন তিনি জীবনভর।
শুধু অনুসন্ধানী নয়, বাল্যকালে বেশ দুরন্তও ছিলেন তিনি। আধা-পাড়াগাঁ এবং আধা-শহর জাতীয় একটি গ্রামে ছিল তাঁদের বাড়ি। চারদিক ছিল বনজঙ্গলে ঘেরা।
আলেকজান্ডার আর তাঁর ভাই সারাদিন ঘুরে বেড়াতেন বনে-বাদাড়ে। খরগোশ ধরে বেড়ানো, নদীতে সাঁতার কাটা, পাখির ছানা পেড়ে আনা আর গাছের মগডালে চড়ে আকাশ দেখা ছিল তাঁদের নিত্য দিনের কাজ। মজার খেলাও।
এই খেলা নিয়েই ছিলেন তাঁরা ভয়ানক সুখি। বাল্যকালটা এরকমের এক গ্ৰাম্য পরিবেশে হেসেখেলেই দিন কেটে গিয়েছিল আলেকজান্ডারের।
গ্রামের পাঠশালাতে শুরু হয় তাঁর শিক্ষাজীবন। চৌদ্দ বছর বয়সে, তাঁকে ভালো কোনো স্কুলে পড়ার জন্য পাঠানো হয় লন্ডনে।
সেখানকার মেরিলিবোন রোডে থাকতেন ফ্লোমিংয়ের এক বড় বোন। তাঁর বাসাতে থেকেই পড়াশোনা করতে লাগলেন তিনি। কিছুদিন স্কুলে গেলেও কেন জানি পড়াশোনায় মন বসাতে পারলেন না। ফলে স্কুল যাওয়া ছেড়ে দিয়ে সামান্য বেতনের কেরানির চাকুরি নিলেন একটি জাহাজ কোম্পানিতে। এই চাকরি করার সময়েই তাঁর আরেক বড় ভাই টমের পরামর্শে তিনি ভর্তি হন মেডিকেল স্কুলে। ভর্তি তো হলেন, কিন্তু এই স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে তিনি ছিলেন সত্যি বড় বেমানান। তাদের প্রত্যেকের চাইতে বয়সে বড়। যেন সকলের বড় ভাই।
কিন্তু এমনটা হলে কী হবে, রক্ষা করতে সক্ষম হলেন নিজের মর্যাদা। সমগ্ৰ গ্ৰেট ব্রিটেনের সমস্ত শিক্ষার্থীদের ডিঙিয়ে সর্বোচ্চ স্থান দখল করে মেডিকেল স্কুল থেকে পাশ করেন। সালটা ১৯০১। এবার ভর্তি হলেন প্রডিংটনের সেন্ট মেরিজ হাসপাতালে। এখানে তাঁর পরিচয় হয় জীবাণুবিজ্ঞানী অ্যাথ রাইটের সঙ্গে। এই রাইট সাহেবের ল্যাবরেটরিতেই তিনি প্রথম গবেষণা করার সুযোগ লাভ করেন। ফলে জীবাণু নিয়ে তাঁর গবেষণা কাজের অবারিত হয়ে যায়। এখানে তিনি টানা ১৯০৮ সাল পর্যন্ত কাজ করেন।
এই গবেষণাগারে কাজ করার সময়েই তিনি লন্ডনের চেলসিয়া আর্টস ক্লাবে যোগদান করেন। এখানে তিনি অন্যান্য খেলাধুলার পাশাপাশি রাইফেল চালনারও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
এরপর শুরু হয় প্রথম মহাযুদ্ধ। এ-সময় তিনি লন্ডন স্কটিশ টেরিটরিয়াল রেজিমেন্টে ডাক্তার হিসেবে যোগদান করেন। এখানেও তিনি চাকরি করেন বেশ কয়েক বছর ধরে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার মাত্র সপ্তাহ কয়েক আগে পদত্যাগ করেন সেনাবাহিনী থেকে। ততদিনে তিনি পদে পদোন্নতি পেয়েছেন লেফটেন্যান্ট। যুদ্ধের শেষে তিনি ফ্রান্সের বোলন রিসার্চ সেন্টারে যোগদান করেন। এখানেই তিনি জীবাণুতত্ত্বের ওপর গবেষণা করতে গিয়ে লাভ করে প্রথন সাফল্য।
এই গবেষণা ক্ষেত্রে প্রতিদিন বহু রোগী আসত নানা রোগব্যাধি নিয়ে। তাদের মধ্যে এমন কিছু জীবাণুবহনকারী রোগীর সন্ধান তিনি পান, যাদের দেহে অ্যান্টিসেপটিক কোনো কাজে আসত না। শুধু তা-ই নয়, কোনো ওষুধেই তাদের দেহকোষে লুকিয়ে থাকা জীবাণুকে ধ্বংস করা সম্ভব হচ্ছিল না।
যেমন, গ্যাংগ্রিনের। ক্ষেত্রে প্রতিষেধক ব্যবহার করে কিছুক্ষণের জন্য ভালো ফল পাওয়া গেলেও, স্বল্প সময়ের ব্যবধানেই আবার তার প্রকোপ দেখা দিত।
এর মধ্যেই অবশেষে তিনি আশার আলো দেখতে পেলেন। ভাবলেন, এখানেই এমন কিছু আছে, যা জীবাণুকে ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু সেটা কোন্ বস্তু তার হশিদ তখনও তিনি করতে পার ছিলেন না।
১৯১৮ সালে তিনি আরও সক্রিয়ভাবে সেই আনুবীক্ষণিক বস্তুটির অনুসন্ধান করতে শুরু করলেন। অবশ্য ১৯২১ সালেই তিনি এ ব্যাপারে সবচেয়ে শক্তিশালী পদক্ষেপ রাখতে সক্ষম হন। তিনি লক্ষ্য করলেন, মানুষের অশ্রুবিন্দুতে এক জাতের পদার্থ লাইসোজাইম আছে, যা জীবাণুর বিস্তার রোধে সহায়তা করে। এরপর থেকেই তিনি জীবাণুর ওপর একনিষ্ঠভাবে গবেষণা চালিয়ে যান এবং পেনিসিলিন আবিষ্কার করতে সক্ষম হন।
১৯৩৯ সাল থেকেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ঘনঘটা শুরু হলে এরপর তাঁর গবেষণা কাজ আর তেমন অগ্রসর হতে পারেনি। একই কারণে পেনিসিলিন আবিষ্কৃত হলেও বাণিজ্যিক-ভিত্তেতে এর ব্যাপক উৎপাদন করা সম্ভব হয়নি। এ-রকম অবস্থাতেও ৯৪১ সালে তিনি পেনিসিলিনের ইনজেকশন তৈরি করতে সক্ষম হন।
১৯৪৯ সালে তাঁর প্রথম স্ত্রীর মৃত্যু হলে তিনি খুবই ভেঙে পড়েন। তাঁর এই রকম বিধ্বস্ত মানসিক অবসস্থায় তাঁর পাশে এসে দাঁড়ান তাঁরই অনুরাগিণী ড. এমেমালিয়া ভোরেকা। প্রথমে সুন্দরী ভোরেকা এগিয়ে আসেন বন্ধু হিসেবে, পরে হন ফ্লেমিংয়ের জীবনসঙ্গিনী।
১৯৫৫ সালে ফ্লেমিং আয়ারল্যান্ডে ফিরে যাবেন বলে স্থির করেন। কিন্তু তা আর হয় নি। হঠাৎ করেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর কিছুদিন পরেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।