1 of 2

আরক্ত রজনীর পর – কৃশানু বন্দ্যোপাধ্যায়

আরক্ত রজনীর পর – কৃশানু বন্দ্যোপাধ্যায়

বেশ বিপদে পড়ে গেছে অশোক শ্রীবাস্তব।

এরকম বিপদে পড়লে মানুষের ভবিষ্যৎ বলে কিছু থাকে না। ভয়ে-ভাবনায় ত্রিশ বছরের শক্ত-সমর্থ মানুষ একেবারে নুয়ে পড়েছে। এই বিপদের দিনে ত্রাতা হিসাবে পাশে এসে দাঁড়াবে, এমন নিজের বলতে অশোকের কেউ নেই। তবে সহকর্মীরা—স্থানীয় বীমা কর্পোরেশনের পদস্থ কর্মচারী, অফিসের বন্ধুরা তাকে এই বিপদ থেকে সরিয়ে আনবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন।

সরকারি পক্ষের দুঁদে ব্যবহারজীবী বলেশ্বর সিনহার গম্ভীর কণ্ঠস্বর এখনও অশোকের কানে বাজছে। নিজের বেঁটেখাটো নিরেট চেহারা নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। বিচারকক্ষে তখন শ্মশানের নীরবতা বিরাজ করছে। তিনি রুমাল দিয়ে একবার মুখ মুছে নিয়ে আরম্ভ করলেন, ইয়োর অনার, আসামী অশোক শ্রীবাস্তব ও দয়ানন্দ ভর্মার মধ্যে বিবাদ চলছিল দীর্ঘদিন ধরে। দুজনের পাশাপাশি বাড়ি। বাড়ির পেছন দিকের বাগানের কিছু অংশ নিয়েই বিবাদ। গত ৮ই নভেম্বর সন্ধ্যায় এই বিবাদ চরমে ওঠে। অসম্ভব উত্তেজিত হয়ে দয়ানন্দ গালিগালাজ করছিলেন। আসামী তাঁকে মারতে তেড়ে যায়—প্রতিবেশীরা ছুটে এসে দুজনকে থামান কোনও-রকমে। তার পরের দিন, অর্থাৎ ৯ই নভেম্বর ভোরে সেই মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটে।

ঘুম থেকে উঠেই দয়ানন্দের স্ত্রী বিশ্রী ধরনের গন্ধ পান। লক্ষ করেন, বিছানায় স্বামী নেই। খোঁজাখুঁজি করার পর বাগানের সেই বিতর্কিত জমির ওপর দয়ানন্দকে দেখতে পাওয়া যায়। তাঁর শরীর জ্বলছিল—বাঁচার তাগিদে তিনি ছটফট করছিলেন। কোনওরকমে আগুন নিভিয়ে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু তাঁকে বাঁচানো যায়নি। ইয়োর অনার, দয়ানন্দ মারা যাওয়ার আগে এক স্বীকারোক্তি দিয়ে গেছেন। তা থেকে জানা যায়, ভোরবেলায় তিনি যখন বাগানে বেড়াচ্ছিলেন তখন অশোক শ্রীবাস্তব অতর্কিতে সেখানে উপস্থিত হয়। মুখে আঘাত করে দয়ানন্দকে পেড়ে ফেলে মাটিতে। একজন যুবকের পক্ষে একজন প্রৌঢ়কে আয়ত্বে আনা কিছুই নয়। তারপর সে কেরোসিন তেল ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় দয়ানন্দের শরীরে। ইয়োর অনার, পুলিশ অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গেই সমস্ত কিছু পর্যবেক্ষণ করে দেখেছে। ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা-প্রসূত এই হত্যা। দীর্ঘদিনের বিরোধকে এইভাবে মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ১২০-র বি এবং ৩০২ ধারায় আসামী অশোক শ্রীবাস্তবকে সোপর্দ করার আবেদন আমি আদালতের কাছে রাখছি।

অশোকের উকিল গুণেশ্বর প্রসাদ বেলের জন্য আবেদন করেছিলেন, কিন্তু সে-আবেদন গ্রাহ্য হয়নি। অগত্যা, সমস্ত দিক বিচার-বিবেচনা করে দেখে নেওয়ার জন্য কিছু সময় প্রার্থনা করলেন। বিচারক উনিশ দিন সময় দিয়ে তারিখ ফেললেন। অশোককে সেলে নিয়ে যাওয়া হল।

তারপর পাঁচদিন কেটে গেছে। চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে থেকে অশোক ভয়ে-ভাবনায় আধমরা হয়ে পড়েছে। অথচ, সে ছাড়া আর বেশি করে কে জানে এই হত্যাঘটিত ব্যাপারের সঙ্গে তার কোনও যোগ নেই। এখন মামলা সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য আইনের তীক্ষ্ন সমস্ত ধারা খুঁজে বের করা দরকার। গুণেশ্বর প্রসাদ কি পারবেন?

তা ছাড়া, অনেক দৌড়োদৌড়ি, অনেক তদ্বির, এ-সমস্তই বা করবে কে? অশোকের নিজের বলতে তো কেউ নেই। অবশ্য লীনা আছে। কিন্তু, এই ঘটনার পর ওর সম্পর্কে তার মনে কি আর কোনও আগ্রহ বজায় আছে? না থাকলে, দোষ দেওয়া যায় না।

লীনা শহরের বিত্তশালী ব্যবসাদার লালা আনোখেলালের একমাত্র মেয়ে। অপূর্ব সুন্দরী কিছু নয়। তবে একটা আলগা শ্রী তাকে মিষ্টি মেয়ে করে তুলেছে। বছরদুয়েক আগেকার কথা। পুজোর ছুটিতে অশোক বেনারস বেড়াতে যাচ্ছিল। লীনার সঙ্গে আলাপ হয়ে যায় ট্রেনে। বাবা-মার সঙ্গে সে যাচ্ছিল দিল্লি। ঘণ্টাকয়েক ট্রেনে কথাবার্তার মধ্যে ভালোই কেটেছিল।

বেনারস থেকে ফিরে আসার পর ইচ্ছে হয়েছে তাদের বাড়ি যাওয়ার, কিন্তু যেতে পারেনি। সঙ্কোচ বাধা দিয়েছে। অথচ অনাহূত অতিথি হয়ে যে ওখানে উপস্থিত হবে, তা নয়। লীনার মা বলেছিলেন, আমরা তো মাত্র এক সপ্তাহ দিল্লিতে থাকব। তুমিও বেনারস থেকে ফিরে আসবে। তারপর একদিন এসো আমাদের বাড়ি।

লীনাকে কিন্তু মোটেই মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছিল না অশোক। সঙ্কোচ কাটিয়ে উঠতে দিন-কুড়ি সময় লেগে গেল। একদিন সন্ধ্যার মুখে পৌঁছল তাদের ওখানে। বলতে গেলে দুজনের মনের মিলের সূত্রপাত তখন থেকেই। তারপর দিন গড়িয়ে গেছে। ব্যাপারটা দশজনে আঁচ করেছে।

লীনার মা-বাবাও।

একদিন বলেছে অশোক, আমার হাতে মেয়েকে তুলে দিতে তোমার বাবার আপত্তি হবে না?

আপত্তি হবে কেন!

আমি আহামরি গোছের তো আর কিছু নই। তোমরা প্রচণ্ড বড়লোক। পয়সাওয়ালা ছেলের হাতেই তো তিনি তোমাকে দিতে চাইবেন।

তাই হয়তো চাইতেন। কিন্তু এখন তো আর উপায় নেই। আমি যে তোমাকে ভীষণ পছন্দ করে ফেলেছি, এ-কথা ওঁরা জানেন কিনা। আর এ-কথাও ওঁরা বিশ্বাস করেন, এ-ব্যাপারে আমার পছন্দই হল শেষ কথা।

কথাটা শেষ করেই লীনা মৃদু হাসল।

এখন পরিস্থিতি অন্যরকম। আগেকার লেখা খাতার পুরোনো পাতাগুলো পড়া যায় কিন্তু নতুন করে আর কিছু লেখা যায় না। হত্যাকারী হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে যে, তাকে আর মনের মণিকোঠায় রাখা যায় না, ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিতেই ইচ্ছে হয়।

তালা খোলার ঝনঝনানিতে অশোকের চিন্তাস্রোত বাধা পেল। চোখ তুলে দেখল, একজন সুট পরিহিত ভদ্রলোক সেলের মধ্যে প্রবেশ করছেন। গম্ভীর মুখ। চোখে লাইব্রেরি ফ্রেমের চশমা। মনে হল, এঁকে আগে কয়েকবার কোথায় যেন দেখেছে!

ভদ্রলোক কোনও ভূমিকা না করে নিজের পরিচয় দিলেন।

আমি শৈলেন সান্যাল। স্থানীয় কোর্টে প্র্যাকটিস করি। আপনার কেসের দায়িত্ব বর্তমানে আমার হাতে। সেই সম্পর্কে—।

তাঁকে বাধা দিয়ে অশোক বিস্মিত গলায় বলল, আমার উকিল তো গুণেশ্বর প্রসাদ। আপনাকে তো—!

আমাকে অ্যাপয়েন্ট করেছেন লালা আনোখেলাল। গুণেশ্বরের সঙ্গে কথা হয়েছে। সে আমাকে অ্যাসিস্ট করবে।

বিস্ময়ের উপর বিস্ময়।

এ-ক’দিন যা ভেবেছে সমস্ত মিথ্যে! লীনা তাকে মোটেই মন থেকে সরিয়ে দেয়নি! ওর মা-বাবাও নয়! বরং ওঁরা বারের প্রখ্যাত ব্যবহারজীবীকে নিযুক্ত করেছেন তাকে মুক্ত করে আনার জন্য! এতক্ষণে শৈলেন সান্যালের খ্যাতির কথা অশোকের মনে পড়ে গেছে। আনন্দ আর বিস্ময় মনকে মথিত করে তুলল, চোখে জল এসে গেল তার।

সান্যাল আবার বললেন, গুণেশ্বর আমাকে ঘটনাটা বলেছে। তবে আপনার মুখ থেকে বিস্তারিতভাবে শুনতে চাই।

বিস্তারিতভাবে বলতে যা বোঝায় তা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। ৯ই নভেম্বর বেলা আটটার সময় আমি পড়াশুনো করছিলাম—এমনসময় পুলিশ গিয়ে আমায় গ্রেপ্তার করে।

পাশের বাড়িতে একটা খুন হয়ে গেছে আপনি বুঝতে পারেননি?

একেবারেই না। দুটো বাড়ি সাঁটাসাঁটি হলেও পাশাপাশি বলতে যা বোঝায় ঠিক তা নয়। আমার সদর হল প্রধান সড়কের ওপর। ও-বাড়ির সদরে পৌঁছতে গেলে গলি দিয়ে যেতে হবে। কাজেই ওধারে কিছু ঘটলে আমার পক্ষে চট করে জানা সম্ভব নয়।

দয়ানন্দের সঙ্গে শেষ কবে দেখা হয়েছিল?

আগের দিন সন্ধ্যায়। আমার বাগানের কাঠাতিনেক জমি চেপে উনি পাঁচিল তুলে দিয়েছিলেন, শুনেছেন বোধহয়? মনকষাকষি আমাদের মধ্যে ছিল। সেদিন দারুণ ঝগড়া হয়ে গেল।

একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না, এ-সমস্ত ব্যাপারে আইনের সাহায্য নেওয়াই তো হল উপযুক্ত ব্যবস্থা। তা আপনি নেননি কেন?

শেষ পর্যন্ত আমাকে কোর্টেই যেতে হত। তবে—।

মৃত দয়ানন্দ কী করতেন?

সুদের কারবার করতেন।

ভালো কথা, আপনার সঙ্গে যখন দয়ানন্দের বচসা হয় তখন সেখানে আর কেউ ছিল?

তাঁর স্ত্রী ছিলেন। তিনিও দু-চারটে টিপ্পনি কেটেছিলেন।

স্ত্রী ছাড়া কোনও চতুর্থ ব্যক্তি সেখানে ছিলেন না?

ভদ্রলোকের ভাইপো এসে পড়েন। কথাকাটাকাটি হচ্ছিল উচ্চগ্রামে। তাই কয়েকজন প্রতিবেশীও আসেন।

শৈলেন সান্যাল ভ্রূ কুঁচকে গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ কী ভাবলেন। তারপর বললেন, ডাইং ডিক্লেয়ারেশনই আপনাকে বেকায়দায় ফেলেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইন স্বীকার করে নেয়, মানুষ মরার পূর্বমুহূর্তে বড় একটা মিথ্যে কথা বলে না। তবে একটা ফাঁক দেখতে পেয়েছি…দেখা যাক, কতদূর কী হয়। আপনি ঘাবড়াবেন না। আমি যা করবার করছি।

আরও দু-চার কথার পর সান্যাল বিদায় নিলেন।

ওখান থেকে বেরিয়ে টাউন থানায় এলেন তিনি। পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট দেখলেন। কেরোসিন তেল দিয়েই শরীর পুড়িয়ে খাক করে দেওয়া হয়েছে। তবে মাথায় আঘাতের আঁচ পাওয়া গেছে। মৃত্যু হয়েছে সকাল চারটে থেকে ছ’টার মধ্যে।

ডাইং ডিক্লেয়ারেশনের কপির ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে সান্যাল বললেন, ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে শেষ জবানবন্দি নেওয়া হয়নি দেখছি। এটা কি ভ্যালিড, ইনস্পেক্টর?

থানা ইনচার্জ কিন্তু-কিন্তু ভঙ্গিতে বললেন, ম্যাজিস্ট্রেট হাসপাতালে উপস্থিত হওয়ার আগেই দয়ানন্দ বর্মা মারা যান। এক্ষেত্রে—।

আপনারা সেসময় উপস্থিত ছিলেন?

ম্যাজিস্ট্রেটকে আর থানায় একইসঙ্গে খবর পাঠানো হয়েছিল। আমরা প্রায় একই সময় উপস্থিত হয়েছিলাম। উপায়হীন অবস্থায় শেষ জবানবন্দি নিতে ডাক্তার বাধ্য হয়েছিলেন। তবে ডাইং ডিক্লেয়ারেশনের কথা ছেড়ে দিলেও, অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে আপনার মক্কেল রেহাই পাবে বলে মনে হয় না। অবস্থার গতি সম্পূর্ণ তাঁর বিরুদ্ধে।

আর কথা না বাড়িয়ে সান্যাল ওখান থেকে বিদায় নিলেন। তিনি অসম্ভব একরোখা লোক। যে-কাজ হাতে নেন তার সুষ্ঠু সমাধানের জন্য সমস্ত কিছু করতে প্রস্তুত থাকেন। বাড়ি ফিরেই তিনি লালা আনোখেলালের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলেন।

হ্যালো…লালাজী…আমি সান্যাল—বিশেষ একটা কথা বলার জন্যে আপনাকে বিরক্ত করলাম…।

ও-সম্পর্কে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন…কেসের তারিখ খোলার পর যা করণীয় তা আমি নিশ্চয় করব…তবে…।

না, না, হেজিটেশানের কোনও প্রশ্ন নেই…কেস যে দারুণ ঘোরালো তা আপনি বুঝতেই পারছেন…আমার মত হল…যে-সময় পাওয়া গেছে এর মধ্যে পুরো ব্যাপারের ভালোরকম তদন্ত করানো…।

আহা-হা! আমি তো আছিই…আমি যা করবার কোর্টে করব…ভাবী জামাইকে যদি বাঁচাতে চান তাহলে আগে কিছু করা দরকার…।

ঠিক আছে…এ-ব্যাপারের যিনি অথরিটি তাঁকেই কলকাতা থেকে আনাবার ব্যবস্থা করতে হয়…খরচপত্র অবশ্য একটু বেশি পড়বে…।

খরচপত্রের জন্যে চিন্তা নেই বলছেন…আমি তাহলে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করছি…এখন ছেড়ে দিলাম…কাল সকালে আপনার ওখানে যাওয়ার ইচ্ছে রইল, লালাজী…।

সান্যাল রিসিভার নামিয়ে রাখলেন।

দিনদুয়েক পরেই বাসব পৌঁছল।

সান্যাল যতদূর যা জানেন, গুছিয়ে বললেন ওকে। এবং এ-কথাও জানালেন, তাঁর ধারণা, এই হত্যাকাণ্ডের মূলে আছে দয়ানন্দের সুন্দরী স্ত্রী। মহিলাটির স্বভাব-চরিত্র ভালো নয়, এইরকমই সংবাদ পাওয়া গেছে। কারও সঙ্গে যোগসাজস করে বৃদ্ধ স্বামীটিকে সরিয়ে দেওয়া এমন কিছু অসম্ভব ঘটনা নয়।

দাঁতে পাইপ চেপেই বাসব বলল, কিন্তু ডাইং ডিক্লেয়ারেশন? ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে না হলেও, হাসপাতালের চিকিৎসকের মতো একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির সামনে দয়ানন্দ সবার আগে বলেছেন, অশোক শ্রীবাস্তব এই ঘটনার জন্যে দায়ী। এই ভাইটাল পয়েন্টকে উপেক্ষা করলে আমরা ভুল করব, মিস্টার সান্যাল।

হুঁ, বেশ জট পাকিয়ে গেছে।

দেখি চিন্তা-ভাবনা করে। এখন পুলিশ সুপারের সঙ্গে দেখা করতে যাব। আমার বেসরকারি তদন্তের অনুমতি নেওয়া আছে তো?

সান্যাল সম্মতিসূচকভাবে ঘাড় নাড়লেন।

বাসব রিকশায় চেপে রওনা হয়ে গেল। পুলিশ সুপার নরেন্দ্র গোয়েল মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি। পরিচয় পেয়ে সাদরে আহ্বান জানালেন। বাসবের সুনাম তাঁর অজানা নয় বলেই মনে হল। কথাবার্তা আরম্ভ হল দুজনের মধ্যে।

বাসব বলল, আমি সকলের সঙ্গে দেখা করতে চাই। একজন সাব-ইনস্পেক্টরকে যদি আমার সঙ্গী করে দেন তাহলে ভালো হয়। নইলে কেউই আমায় আমল দিতে চাইবে না।

বেশ। কার-কার সঙ্গে দেখা করতে চান?

দয়ানন্দের স্ত্রীর সঙ্গে, ভাইপোর সঙ্গে, হাসপাতালের ডাক্তারের সঙ্গে, প্রতিবেশীদের সঙ্গেও কথা বলার ইচ্ছে আছে।

দয়ানন্দের স্ত্রী সুনীতাদেবী এখন হাসপাতালে—।

কেন?

স্বামীর মৃত্যুর পরই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এখন পেইংবেডে রয়েছেন ওখানে।

উনি হাসপাতালে থাকলেও, বাড়িতে একবার যেতে হবে। দুর্ঘটনাস্থলের চারপাশে একটু ঘোরাঘুরি করতে চাই।

ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। কখন যাবেন বলুন?

ধরুন, কাল সকালে। আজ বিকেলে ভদ্রমহিলা ও আর-সকলের সঙ্গে কথাবার্তা বলে নেব ভাবছি।

এরপর অনেকক্ষণ ধরে আলাপ-আলোচনা হল দুজনের মধ্যে। নরেন্দ্র গোয়েল ওকে চা না খাইয়ে ছাড়লেন না। পুলিশ সুপারের বাংলো থেকে বেরিয়ে বাসব আর কোথাও না দাঁড়িয়ে হোটেলে ফিরে এল। নটরাজ এখানকার সেরা হোটেলের অন্যতম। লালা আনোখেলাল ওখানেই ওর থাকার ব্যবস্থা করেছেন।

সারা দুপুর বাসব হোটেলে কাটিয়ে বিকেলে থানায় পৌঁছল। পূর্ব ব্যবস্থামতো সাব-ইনস্পেক্টর দয়াল ওর জন্য অপেক্ষা করছিল। বেশ চটপটে ছোকরা। সময় নষ্ট না করে দুজনে বেরিয়ে পড়ল হাসপাতালের উদ্দেশে।

হাসপাতালের অবস্থান শহরের একপ্রান্তে। আহামরি ধরনের কিছু নয়। সাদামাটা, ছোটখাটো। প্রধান চিকিৎসককে তাঁর অফিসেই পাওয়া গেল। তাঁকে দেখে বাসব অবাকই হল একটু। বয়েস চল্লিশের কিছু নীচেই। দর্শনীয় চেহারাই শুধু নয়—অত্যন্ত স্মার্ট। এত অল্প বয়েসে এরকম দায়িত্বে বড় একটা কাউকে দেখা যায় না।

দয়াল আগমনের উদ্দেশ্য বর্ণনা করল।

ডাক্তার দ্বিবেদী বললেন, যা জানি তা তো আগেই বলেছি।

বাসব বলল, হত্যাকারী হিসেবে যিনি চিহ্নিত হয়েছেন তাঁর হয়েই আমি তদন্তে নেমেছি। প্রকৃতপক্ষে, এখনও আমার কিছুই জানা হয়নি। আপনার সহযোগিতা চাই, ডক্টর।

কী জানতে চান বলুন?

ডাইং ডিক্লেয়ারেশন তো আপনিই নিয়েছিলেন?

হ্যাঁ।

সেই সময়কার অবস্থাটা যদি বিস্তারিতভাবে বলেন তাহলে আমার পক্ষে সুবিধে হয়।

একটু থেমে ডাক্তার দ্বিবেদী বললেন, ভোর তখন পাঁচটা হলেও চারিধার অন্ধকারে ঢাকা। ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। বিছানা থেকে উঠব-উঠব করছিলাম, এমনসময় চাকর এসে খবর দিল, রিকশায় করে একটা পোড়া বডি বয়ে আনা হয়েছে। তাড়াতাড়ি ছুটলাম এমার্জেন্সিতে। সুইপাররা তখন বডি শুইয়ে দিয়েছে যথাস্থানে। নিদারুণভাবে পুড়ে গেছে সারা দেহ। ভেবেছিলাম, মারা গেছে। পরীক্ষা করে দেখলাম, প্রাণ তখনও আছে, এমনকী জ্ঞানও রয়েছে। ক্ষীণস্বরে ভদ্রলোক বললেন, তিনি কিছু বলতে চান। কম্পাউন্ডার এসে পড়েছিল। আমি তাকে পাঠালাম ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে, তিনি যাতে এসে পড়েন। পুলিশকেও খবর দিয়ে যেতে বললাম।

তারপর?

এরকম ভয়ানকভাবে ঝলসানো মানুষ, সত্যি কথা বলতে, আগে দেখিনি। করণীয় যা কিছু সমস্তই করলাম। কিন্তু অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে লাগল। তখন বাধ্য হয়েই আমাকে নিতে হল ভদ্রলোকের শেষ জবানবন্দি। ম্যাজিস্ট্রেট যখন এসে পৌঁছলেন তখন আর কিছু করার নেই। মৃত্যু মিনিট-দশেক আগেই ভদ্রলোকের তীব্র যন্ত্রণাকে লাঘব করে দিয়ে গেছে।

ভদ্রলোকের স্ত্রী তখন কোথায় ছিলেন?

ওখানেই ছিলেন। কী হৃদয়-বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল বুঝতেই পারছেন। এমনই দুর্ভাগ্য, এইরকম অবস্থার মধ্যেই আমাদের বারবার পড়তে হয়।

মহিলাটি এখন এখানেই আছেন?

হ্যাঁ। স্বামীর মৃত্যুর পর শকড হয়ে হিস্টিরিয়ার মতো হয়েছে। পেইংবেডে রয়েছেন।

বাসব পাইপ ধরিয়ে একটু চুপ করে রইল। তারপর বলল, সেদিন রাত্রে ডিউটিতে ক’জন ডাক্তার ছিলেন?

একটু হেসে ডাক্তার দ্বিবেদী বললেন, শুনলে অবাক হবেন, একজনও নয়। আসল কথা হল, ডাক্তারের শর্টেজ চলছে হাসপাতালে। লেখালেখি করেও কাজ হচ্ছে না। নাইট ডিউটিতে একেবারেই কাউকে পাওয়া যায় না। প্রয়োজনের সময় আমাকেই আসতে হয় ছুটে-ছুটে।

ধন্যবাদ, ডক্টর। আপনাকে আর বিরক্ত করব না। মহিলাটির কী যেন নাম—সুনীতা ভর্মা। তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই।

আসুন আমার সঙ্গে।

ডাক্তার দ্বিবেদী ওদের দুজনকে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালের মেন বিল্ডিং-এ এলেন। দীর্ঘ বারান্দা অতিক্রম করে পেয়িং ওয়ার্ডে পৌঁছতে বেশি সময় লাগল না। নির্দিষ্ট কেবিনের ভেতর আর ডাক্তার গেলেন না। প্রবেশ করল বাসব ও দয়াল। সুনীতা বিছানায় অর্ধশায়িত অবস্থায় পত্রিকার পাতা ওলটাচ্ছিলেন। পায়ের শব্দে মুখ তুললেন। দু-চোখে বিস্ময়ের ছোঁয়া।

বাসব দেখল অপরূপ এক নারীমূর্তির ছন্দোময় অবস্থান। গায়ের রং থেকে শরীরের গঠন, সবই যেন তুলনারহিত। বয়েস ছাব্বিশ-সাতাশের বেশি হবে না। দয়াল বাসবের এখানে আসার কারণ বর্ণনা করল। সুনীতার মুখ এবার কিছুটা গম্ভীর হয়ে উঠল। উঠে বসে আঁচল ঠিক করে নিলেন নিজের।

আমার মনের অবস্থা ভালো নেই। আপনারা কেন যে বারবার এসে আমাকে বিরক্ত করেন বুঝতে পারি না।

বাসব বলল, আমরা দুঃখিত। কিন্তু এ ছাড়া উপায়ও তো আর কিছু নেই! আপনার স্বামী মারা গেছেন ঠিকই—এদিকে আমার মক্কেলেরও তো জীবন-মরণ সমস্যা। মানবিকতার কথা মনে রেখে আপনার উচিত আমার সঙ্গে সহযোগিতা করা।

একটু উষ্ণভাবেই সুনীতা বললেন, আপনার মক্কেল আমার স্বামীকে পুড়িয়ে মেরেছেন—এতে কোনও সন্দেহ নেই।

নিজের চোখে দেখেছেন কি?

না দেখলেও আমি জানি ব্যাপারটা সত্যি। আমার স্বামী তো মারা যাওয়ার আগে অশোক শ্রীবাস্তবের নাম করে গেছেন।

তা হয়তো করেছেন। তবে কথাটা কী জানেন মিসেস ভর্মা, আমি যা প্রশ্ন করব তার উত্তর আপনাকে দিতেই হবে। না দিতে চাইলে ব্যাপারটা সন্দেহজনক পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াতে পারে।

এ আপনাদের জুলুম।

আমি তা মনে করি না।

বেশ, বলুন।

সেদিন ঠিক কী অবস্থায় আপনার স্বামীকে আবিষ্কার করেছিলেন প্রথমে সে-কথাই বলুন।

বাথরুম যাওয়ার তাগিদে শেষরাত্রির দিকে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। বিছানায় স্বামীকে না দেখে অবাক হলাম। খোঁজাখুঁজি করতেই দেখলাম, বাগানের ধারে যে-বারান্দা, তারই সামনে পড়ে আছেন। আগুন আর তাঁর শরীরের কিছু রাখেনি বলতে গেলে। তারপর কীভাবে যে রিকশা জোগাড় করে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে আসতে পেরেছিলাম তা বলে বোঝাতে পারব না।

সেসময় আপনার স্বামীর জ্ঞান ছিল?

এখানে আসার পথে জ্ঞান হয়েছিল।

বাড়িতে আর কেউ ছিল না তখন?

না। আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ থাকত না।

চাকর-বাকর?

ছোট সংসার। ঠিকে ঝি দিয়েই কাজ চলে যায়।

আর কোনও আত্মীয়স্বজন আপনার কাছাকাছি ছিল না, এই বিপদের সময় যে সাহায্য করতে পারত?

পাড়াতেই আমার স্বামীর ভাইপো থাকেন। তাঁর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালো ছিল না। তাই আর ডাকিনি।

আপনার বাপের বাড়ি কোথায়?

হাজারিবাগে।

বাসব থেমে-থেমে বলল, কিছু মনে করবেন না। প্রশ্নটা একটু ব্যক্তিগত হলেও না করে পারছি না। শুনলাম, দয়ানন্দ ভর্মা বৃদ্ধ মানুষ ছিলেন, আপনার মতো অল্পবয়েসী মেয়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছিল কীভাবে?

ভ্র কুঁচকে উঠল সুনীতার। তবে পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, গরীব বাপরা বড়লোকের ঘরে মেয়ে দিতে পারলেই বেঁচে যায়, পাত্রের বয়েস দ্যাখে না।

আর আপনাকে বিরক্ত করব না। চলি।

হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসার পর দয়াল বলল, কীরকম বুঝলেন?

আরও অনেক কিছু এখনও বুঝতে বাকি আছে। চলুন, দুর্ঘটনাস্থলে যাওয়া যাক। এখান থেকে কতদূর?

কাছেই। রিকশার দরকার হবে না।

ঠিকই বলেছিল দয়াল। দয়ানন্দের বাড়ি পৌঁছতে মিনিট-সাতেকের বেশি সময় লাগল না। সদর রাস্তার দিকে মুখ করে অশোক শ্রীবাস্তবের বাড়ি। আর পিছনদিকেরটা দয়ানন্দের। সেখানে যেতে হলে গলি দিয়ে যেতে হয়। নির্জন পাড়া। অধিকাংশ বাড়ির লাগোয়া ফুলের বা সবজির বাগান।

দয়ানন্দের বাড়ির সদরে তালা লাগানো ছিল। সেকেলে বাড়ি হলেও বেশ ঝকঝকে অবস্থা। সংলগ্ন বাগানের গেটে লোহার ফাঁস লাগানো ছিল। দয়াল বাসবকে সঙ্গে নিয়ে বাগানে ঢুকে এগিয়ে গেল দক্ষিণ দিকে। তারপর থামল করোগেট শেড দেওয়া বারান্দার সামনে। বারান্দার শেষেই আরম্ভ হয়েছে মূল বাড়ির পিছনের অংশ। দরজা-জানলা অবশ্য সমস্তই ভিতর থেকে বন্ধ।

এখানেই কাণ্ডটা ঘটে।

দয়ালের নির্দেশ করা জায়গাটার ওপর ঝুঁকে পড়ল বাসব। জায়গাটা খাপচা-খাপচা ঘাসে ছাওয়া। ঘাসের ওপর হাত বুলিয়ে কী যেন অনুভব করবার চেষ্টা করল। সেই হাত তুলে আনল চোখের কাছে। তারপর আরও মুখ নিচু করে জমির ঘ্রাণ নিতে লাগল। অবাক হয়ে ওর কার্যকলাপ দেখতে থাকল দয়াল।

হিসেব তো মিলছে না, মিস্টার দয়াল?—বাসব উঠে দাঁড়িয়ে বলল।

কীসের হিসেব?

এই জায়গায় দয়ানন্দকে পোড়ানো হয়েছিল, আপনারা বলছেন?

সুনীতা দেবী আমাদের সে-কথাই বলেছিলেন।

একটা মানুষকে পোড়াতে গেলে প্রচুর কেরোসিন তেল দরকার হবে। চুঁইয়ে-চুঁইয়ে পড়াও স্বাভাবিক। অথচ দেখুন, এই জায়গাটা মোটেই ভিজে নয়। এমনকী কেরোসিনের গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে না। ঘাসও পুড়ে যায়নি।

এখানে ব্যাপারটা ঘটেনি বলছেন?

তাই তো মনে হচ্ছে।

এইসময় গেটের সামনে থেকে কে বলে উঠল, আমি কি আপনাদের কাছে যেতে পারি?

দুজনে মুখ ফিরিয়ে দেখল। গেটের ওপর হাত রেখে একজন মোটাসোটা লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। বয়েস আন্দাজ চল্লিশ। গায়ের রং মিশমিশে কালো। মাথা জুড়ে চকচকে টাক। বিচিত্র মূর্তি।

খাটো গলায় বলল দয়াল, দয়ানন্দের ভাইপো সদানন্দ।

আসুন।

বাসবের আহ্বান পেয়ে সদানন্দ হেলতে-দুলতে এলেন।

পরিচয় দেওয়ার দরকার নেই। আপনি কে আমি জেনেছি। আপনার কাছে আমায় যেতে হত। এসে পড়ে ভালোই করেছেন। কিন্তু আপনি কীভাবে জানলেন যে, আমরা এখানে এসেছি?

একগাল হেসে সদানন্দ বললেন, আমার বাড়ির সামনে দিয়েই তো এলেন। ভাবলাম, দারোগাবাবু আবার কেন এলেন! বলতে পারেন, একটু আগ্রহ নিয়েই এখানে চলে এলাম। কিন্তু আপনার পরিচয় তো পেলাম না?

দয়াল বাসবের পরিচয় দিল।

তাই নাকি! ভারী খুশি হলাম। কাকা যেভাবে মারা গেছেন—তার জোর তদন্ত নিশ্চয় হওয়া দরকার।

বাসব বলল, এ-কথা বলছেন কেন? হত্যাকারী তো ধরা পড়েছে।

তা পড়েছে। তবে—।

আপনার কি সন্দেহ অশোক শ্রীবাস্তব খুন করেনি?

জিভ কেটে সদানন্দ বললেন, সে কী কথা! সকলেই যখন বলছে তখন আমার সন্দেহ থাকবে কেন!

এ কোনও কাজের কথা নয়। আমি আপনার মতামত জানতে চাইছি।

সত্যি কথা বলতে কী, পরিষ্কারভাবে কিছু বলতে আমি রাজি নই। সে বড় দায়িত্বের ব্যাপার।

বাসব পাইপ ধরাল। ঘন-ঘন কয়েকবার টান দেওয়ার পর বলল, শুনলাম, সুনীতা দেবীর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক ভালো নয়। কেন ভালো নয়, বলবেন কি?

নির্বিকার গলায় সদানন্দ বললেন, আমরা দুজনেই দুজনকে দেখতে পারি না।

দেখতে না পারার কারণ একটা নিশ্চয় আছে?

আছে বইকী! দেখুন, তাহলে অনেক কথাই বলতে হয়। এতে অবশ্য পারিবারিক কেচ্ছা গাওয়া হবে। শুধুমাত্র আপনার তদন্তের সুবিধের জন্যেই বলছি।

পকেট থেকে পানের ডিবে বের করলেন সদানন্দ। একটা পান মুখে ফেলে দিয়ে প্রায় একমিনিট ধরে চর্বণ-সুখ উপভোগ করে বললেন, টাকা রোজগারের ধান্দায় জীবনের বেশিরভাগ সময় বিয়ে না করেই কাটিয়ে দিয়েছিলেন কাকা। বছরচারেক আগে হাজারিবাগ গিয়েছিলেন। বলা নেই, কওয়া নেই, বিয়ে করে ফিরলেন ওখান থেকে। কাকিমার বয়েস আর রূপ দেখে তো আমি হতবাক। কাকার তখন সে কী গদগদ ভাব! গানের মাস্টার রেখে দিলেন। ছ’মাস বেশ কাটল। তারপর বুঝলেন কিনা, গানের মাস্টার আর মহিলাটিকে একটু বেকায়দা অবস্থায় ধরে ফেললাম। কাকা তো সব শুনে রেগে আগুন। মাস্টারকে তাড়ানো হল গলাধাক্কা দিয়ে। সেই থেকে কাকিমা আমার ওপর চটলেন, আমি তাঁর ওপর চটলাম।

এরপর আর বোধহয় আপনার কাকিমা বিপথগামী হননি?

হননি! বলেন কী মশাই? রগরগে যৌবন নিয়ে দিনের পর দিন বয়স্ক স্বামীকে ভালো লাগতে পারে? ইদানীং তো আমার বাড়িতে বিশেষ যাওয়া-আসা ছিল না। কাকার সঙ্গে এই বাগানেই মাঝে-মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ হত। তবে আঁচ পেয়েছিলাম, রাতে-বেরাতে কেউ একজন এখানে আসত। কাকিমাও মাঝে-মাঝে কোথায় যেন যেতেন। পাড়ার লোকেরাও এ-সমস্ত কথা জানে।

আপনার কাকা জানতেন না?

বলতে পারি না। তবে বছরদুয়েক থেকে বউ-এর আঁচল ধরে বসে থাকার চেয়ে, নোট আর টাকা গুনে থাক লাগাবার কাজেই আবার নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন বলে মনে হয়।

আচ্ছা, আপনার কাকা-কাকিমা সম্পর্কে আরও তথ্য কে আমায় দিতে পারে বলতে পারেন?

মনে হয় কপিলবাবু আর রামশঙ্করবাবু পারেন। ওঁরা কাকার বন্ধু। এ-বাড়িতে যাতায়াত আছে।

হুঁ, আপনি কী করেন সদানন্দবাবু?

আমিও সুদের কারবার করি।

আপনি আমাকে অনেক নতুন কথা শুনিয়েছেন, ধন্যবাদ! আচ্ছা, কপিলবাবু আর রামশঙ্করবাবু থাকেন কোথায়?

এ-পাড়াতেই থাকেন।

ভালোই হল। অনুগ্রহ করে তাঁদের যদি এখানে ডেকে আনেন তবে আমার কাজের কিছুটা সুবিধে হয়।

আপনার কিন্তু হওয়ার কিছু নেই। এখুনি ডেকে আনছি।

সদানন্দ চলে গেলেন।

দয়াল বলল, দারুণ ধূর্ত! কথাবার্তার ধরন হল, ধরি মাছ না ছুঁই পানি। সুনীতা দেবীর ইদানীংকালের অন্তরঙ্গটিকে ভালোভাবেই জানে—কেচ্ছা শুনিয়ে আমাদের উসকে দিয়ে গেল, নামটা বলল না!

বাসব কিছু বলল না। তার দৃষ্টি তখন, বারান্দা যেখানে শেষ হয়ে গেছে, সেখানকার একটা চালাঘরের ওপর। ঘরখানা মূল বাড়ির সঙ্গে যুক্ত নয়। দরজা বন্ধ, কড়ায় তালা আছে। তবে তালা লাগানো নেই, খোলা অবস্থায় ঝুলছে।

ওই ঘরের মধ্যে আগে আপনারা গিয়েছিলেন নাকি?

না।

তালা খোলা রয়েছে যখন—চলুন, দেখে আসা যাক ঘরখানা কী কাজে ব্যবহার করা হয়।

দুজনে এগিয়ে গিয়ে পাল্লা সরিয়ে ভেতরে ঢুকল। প্লাস্টারিং করা নয়, মাটির গাঁথনি দেওয়া দেওয়াল। ফ্লোরিংও সিমেন্টের নয়। ঘরের একপাশে পড়ে আছে ঘাসকাটার যন্ত্র, কয়েকটা খুরপি, গাছকাটা কাঁচি এবং ওই ধরনের আরও অনেক কিছু। অর্থাৎ, বাগানের কাজে লাগে এমন সমস্ত সরঞ্জাম রাখার জন্যই এই ঘর।

বাসব তীক্ষ্ন চোখে চারিধার দেখে নেওয়ার পর বলল, বিশেষ কিছু আপনার চোখে পড়ছে?

দয়াল বলল, ঠিক বুঝতে পারছি না।

মেঝের দিকে তাকিয়ে দেখুন। মনে হচ্ছে না কি, সম্প্রতি জায়গাটাকে গোবর দিয়ে নিকোনো হয়েছে? এমনকী তারপর কেউ হাঁটা-চলা করেনি?

তাই তো!

এমন ছন্নছাড়া ঘরকে এমন ভালোভাবে নিকোনোর মানে কী? তা ছাড়া দেখুন, নিয়মিত যে-ঘর নিকোনো হয়, চৌকাঠ বা ওই ধরনের উঁচু জায়গায় গোবরের জমাট লেয়ার পড়ে যায়। এখানে সেরকম কিছু নেই। এর মানে, এই প্রথমবার ঘরখানা নিকোনো হয়েছে।

কিছু ঢাকবার চেষ্টা করা হয়নি তো?

মনে হচ্ছে, তাই। আসুন, গোবর চেঁচে ফেলে দেখি, ব্যাপারটা কী।

দুজনে দুটো খুরপি নিয়ে উবু হয়ে বসে গোবর চাঁচার কাজে লেগে গেল। মিনিট-দশেকের মধ্যে মাঝের অংশ পরিষ্কার হতেই দেখা গেল মাটির খানিকটা বেশ ভিজে রয়েছে। জলে ভেজা নয়, শুঁকে বোঝা গেল কেরোসিন তেল।

বাসব উঠে দাঁড়িয়ে বলল, খুন এই ঘরেই হয়েছে।

সবিস্ময়ে দয়াল বলল, বাগানে পোড়া অবস্থায় দয়ানন্দ পড়েছিলেন এ-কথা সুনীতা দেবীর বানানো! তবে কি—।

বাগানে কথাবার্তার আওয়াজ পাওয়া গেল। সদানন্দ দুই ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে আসছেন। বাসব তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ওর অনুমানই ঠিক! তবে দুজন নয়, একজন এসেছেন।

সদানন্দ বললেন, কপিলবাবু গতকাল কী কাজে পাটনা গেছেন। দিনকয়েক পরে ফিরবেন। রামশঙ্করবাবুকে নিয়ে এলাম।

প্রবীণ রামশঙ্করবাবু চওড়া খাঁচার মানুষ। মাথার কাঁচা-পাকা চুল পাতলা হয়ে এসেছে। চোখে ঔৎসুক্য, মুখের ভাব শান্ত। পরনে ধুতি আর খাদির গলাবন্ধ কোট।

আমার পরিচয় বোধহয় পেয়েছেন।—বাসব বলল, আপনাকে এইভাবে বিরক্ত করার জন্যে আমি দুঃখিত। নিতান্ত…।

ভরাট গলায় রামশঙ্করবাবু বললেন, আমি মোটেই বিরক্ত হচ্ছি না। অশোককে পাড়ার সকলেই স্নেহ করে। তাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করার ব্যাপারে আমরা সকলেই সচেষ্ট।

অশোক এ-কাজ করেনি বলে আপনার ধারণা?

আমার তো তাই মনে হয়।

পুলিশকে এ-কথা বলেছিলেন?

নিশ্চয়।

কেউ তো একজন দয়ানন্দ ভর্মাকে খুন করেছে। অশোক যদি না করে থাকে তবে এ-কাজ কার পক্ষে সম্ভব বলে মনে হয়?

একটু থেমে রামশঙ্করবাবু বললেন, সন্দেহের ওপর নির্ভর করে দু-একজনের নাম যে না করা যায় তা নয়, তবে নিশ্চিত না হয়ে কিছু বলাটা বোধহয় ঠিক নয়।

বাসব পাইপে মিক্সচার ঠাসতে-ঠাসতে বলল, একদিক থেকে অবশ্য কথাটা যথার্থ। দয়ানন্দের সঙ্গে আপনার কতদিনের পরিচয়?

সে আমার বাল্যবন্ধু ছিল।

তিনি নিশ্চয় আপনাকে নিজের মনের-প্রাণের কথা বলতেন? স্ত্রী সম্পর্কে তাঁর ইদানীংকার অভিমত কী ছিল?

একটু ইতস্তত করে রামশঙ্কর বললেন, সে প্রায়ই বলত, অল্পবয়েসী একটা মেয়েকে বিয়ে করা ঠিক হয়নি।

তিনি তাহলে স্ত্রীর চালচলন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন?

বিলক্ষণ! আগে কয়েকবার বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। ফল না পেয়ে হাল ছেড়ে দেয়। স্ত্রীকে বাপের বাড়িতে পাঠাবারও চেষ্টা করেছিল। কিন্তু অন্যপক্ষের জেদের দরুণ সফল হয়নি।

পাইপ ধরিয়ে নিয়ে বাসব বলল, এক্ষেত্রে ডিভোর্স করে দেওয়া তো সহজ পন্থা ছিল। আইন গ্রাহ্য করে এমন প্রমাণ সংগ্রহ করাও কঠিন হত না।

আমিও সেই পরামর্শ দিয়েছিলাম। রাজি হয়নি। বলত, এমন করলে শহরে মান-সম্মান বলে আর কিছু থাকবে না। আমার ধারণা, মুখে যাই বলুক, ভেতরে-ভেতরে স্ত্রীর প্রতি দুর্বলতা ছিল।

এবার কিন্তু মূল প্রশ্নে এসে পড়ছি। সুনীতা দেবীর প্রেমিকটি কে? সদানন্দবাবু তো বলতে চাইলেন না। আপনি অন্তত বলুন!

সত্যি কথা বলতে কী, নিজের চোখে আমি তাঁকে কারও সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করতে দেখিনি—অনুমান করেছি।

তাই বলুন।

হাসপাতালের পেছন দিকে যে-ছোট গেট আছে, তাই দিয়ে তাঁকে কয়েকবার বেরিয়ে আসতে দেখেছি। একবার মুখোমুখি হয়ে পড়েছিলাম। আমাকে দেখে মহিলা ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন।

আপনার ইশারা কি ডাক্তার দ্বিবেদীর দিকে?

আমি নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে চাই না। তবে তিনি ছাড়া অল্পবয়স্ক বা অবিবাহিত ডাক্তার হাসপাতালে আর কেউ নেই?

আপনি ভাবিয়ে তুললেন! পরিস্থিতি ক্রমেই বিচিত্রভাবে মোড় নিচ্ছে। যা হোক, আপনি কী করেন, রামশঙ্করবাবু?

আমার ট্রান্সপোর্টের বিজনেস আছে। ট্রাকে বিভিন্ন ধরনের মাল ক্যারি করি। বিহার-বেঙ্গল সার্ভিস।

কপিলবাবুর সঙ্গে দেখা হলে ভালো হত। তিনি হয়তো আমাকে কিছু নতুন কথা শোনাতে পারতেন। আচ্ছা, দয়ানন্দের কি ফলাও কারবার ছিল?

আগে তাই ছিল। ইদানীং সামলে উঠতে পারত না বলে ব্যবসা গুটিয়ে এনেছিল। জন-পনেরোর বেশি খাতক ইদানীং রাখত না।

মাত্র পনেরো জন!

সকলেই বড় পার্টি। খাতকের সংখ্যা কম হলেও, চার-পাঁচলাখ টাকার কম খাটত না বাজারে।

এখন আর আপনাকে আটকাব না। পরে দরকার পড়লে…।

নিশ্চয়। খবর দিলেই আমি উপস্থিত হব।

সদানন্দকে সঙ্গে নিয়ে রামশঙ্করবাবু বিদায় নিলেন। বাসব আকাশের দিকে অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর দয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, বাড়ির ভেতরটা একবার ঘুরে-ফিরে দেখতে চাই। চাবি কি আপনাদের কাছে আছে?

যতদূর জানি, চাবি সুনীতা দেবীর কাছে আছে।

হুঁ। চলুন, এবার যাওয়া যাক।

গতরাত্রে বাসবের ভালো করে ঘুম হয়নি। চিন্তার স্রোতে হাবুডুবু খেতে-খেতে শেষরাত্রের দিকে মোটামুটি অনুমান করতে পেরেছে, ঘটনার গতি কোন পথ ধরে এগিয়েছে। তারপর ঘুম দু-চোখের পাতা ভারী করে তুলেছে। তখন তিনটে, এখন বেলা ন’টা, বিছানা ছেড়ে সবেমাত্র উঠেছে।

গতকাল দয়ানন্দের বাগান থেকে বেরিয়ে বাসব পুলিশ সুপারের বাংলোয় চলে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ কথাবার্তা হয়েছিল দুজনের মধ্যে। সুপার জানিয়েছিলেন, বাড়ির চাবি তাঁদের কাছে নেই, সুনীতা দেবীর কাছ থেকে সংগ্রহ করে রাখবেন। আগামীকাল দুপুরে বাসব কাজ সেরে নিতে পারবে। সঙ্গে থানা ইনচার্জ থাকবেন।

প্রাতঃকৃত্য সেরে বাসব সামান্য কিছু খেয়ে নিল। এখানে পা দেওয়ার পর থেকে লালা আনোখেলালের সঙ্গে দেখা করেনি। ঠিক হচ্ছে না। ভদ্রলোক তাকে নিয়োগ করেছেন—একবার গিয়ে কথাবার্তা বলে আসা নিতান্ত দরকার। তাঁর বাড়ির উদ্দেশে বাসব রওনা হয়ে গেল।

দুপুরে নির্দিষ্ট সময়ে এসে থানা ইনচার্জ বাসবকে দয়ানন্দের বাড়ি নিয়ে গেলেন। সদর দরজার তালা খুলে ভেতরে ঢুকল দুজনে। প্রথমে সমস্ত বাড়িটা ঘুরে-ফিরে দেখা হল। মোট আটখানা ঘর আছে। শোওয়ার ঘরে স্বামী-স্ত্রীর আলাদা-আলাদা খাট। একবার দেখলেই বুঝতে পারা যায়, তার পরের ঘরটাতেই দয়ানন্দ ব্যবসার কাজকর্ম করতেন।

চেয়ার-টেবিলের ব্যবসা নয়। ফরাস পাতা, মাঝামাঝি জায়গায় নিচু ডেস্ক। ডেস্কের সামনে ডানলোপিলোর কুশন। তার ওপর বসেই গৃহকর্তা কাজকর্ম করতেন। একপাশে রয়েছে ছোট সাইজের স্টিলের আলমারি। দেওয়ালে সিঁদুর দিয়ে স্বস্তিকা কাটা রয়েছে।

বাসব ডেস্কের ডালা তুলল। ভেতরে খবরের কাগজের বিল, পৌরসভার রসিদ, সাংসারিক খরচ লেখার খাতা…এই সমস্ত রয়েছে। এবার স্টিলের আলমারি খোলা হল। নীচের দুটো তাক খালি। ওপরের তাক দুটোয় গোটাকয়েক বাঁধানো খাতা, ফিতে দিয়ে বাঁধা দুটো ফাইল, চেক বুক, ব্যাঙ্ক বুক, ডায়েরি—এইসব।

দয়ানন্দের কোমরেই আলমারির চাবি বাঁধা থাকত। পোড়া কাপড়-চোপড়ের সঙ্গে ওটাও হাসপাতালে পৌঁছেছিল। পুলিশ পরে হস্তগত করেছে। আলমারিতে লকারও ছিল একটা। বাসব লকারটাই প্রথমে ভালোভাবে পরীক্ষা করল। বড় ও ছোট নোট মিলিয়ে ষোলোশো টাকা আছে, আর আছে কিছু জড়োয়া ও সোনার গহনা এবং একটি রিভলভার—লাইসেন্স অবশ্য আছে। ফিক্সড ডিপোজিটের কাগজপত্রও রয়েছে।

লকার বন্ধ করে বাঁধানো খাতাগুলো নিয়ে পড়ল বাসব। কোন বছর কাকে কত টাকা ধার দেওয়া হয়েছে তার ধারাবাহিক লিস্ট। আগে প্রচুর লোককে টাকা ধার দেওয়া হত, ইদানীং কমে এসেছে। চলতি বছরের লিস্টে মাত্র একজনের নাম দেখা গেল। খাতা রেখে বাসব ফিতে-বাঁধা ফাইল দুটো খুলল। প্রথমটায় পাওয়া গেল, এই বাড়ি ও শহরে যে-সমস্ত সম্পত্তি আছে তার রেজিস্টার্ড ডিড এবং সুদের কারবার চালাবার সরকারি হুকুমনামা। দ্বিতীয় ফাইলটায় ছিল, চলতি বছরে টাকা ধার দেওয়া সম্পর্কের দলিল। গুনে দেখা গেল আটখানা রয়েছে। বাসব ভুরু কুঁচকে দলিলগুলির দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।

থানা ইনচার্জ বললেন, কী ভাবছেন?

খাতায় নাম রয়েছে ন’জন খাতকের, অথচ দলিল আছে আটখানা! বাসব আবার খাতা খুলল। দলিলের সঙ্গে কী সমস্ত মিলিয়ে দেখল যেন। তারপর আলমারি বন্ধ করে বলল, এখানে আর কিছু দেখার নেই, চলুন।

সদর দরজায় তালা লাগিয়ে দুজনে রিকশায় চেপে বসল।

একজনকে আপনাদের আটক করতে হবে।

বিস্মিত থানা ইনচার্জ বললেন, কাকে?

চাকর শ্রেণীর একজনকে। তবে কাজটা এমনভাবে সারতে হবে যাতে তার মালিক বুঝতে না পারে।

আমি কিন্তু কিছুই ঠাহর করতে পারছি না।

থানায় চলুন, সমস্ত বুঝিয়ে বলছি। ভালো কথা, সরকারি পক্ষের উকিল ও আসামী পক্ষের উকিলকে খবর পাঠাবেন—বিশেষ প্রয়োজনে আজ রাত্রিটা আমার সঙ্গে তাঁদের জাগতে হবে। পুলিশ সুপারও অবশ্য থাকবেন। তাঁকে আমিই না হয় বলে রাখব।

রাত সাড়ে বারোটা।

হাসপাতাল কম্পাউন্ডের পিছনের গেট দিয়ে কয়েকজন ছায়ায় গড়া মানুষ ভেতরে ঢুকল। বেশিদূর তারা না এগিয়ে আই ওয়ার্ডের সামনের ঝাঁকড়া গাছটার তলায় গিয়ে দাঁড়াল। হাসপাতালের প্রধান বাড়ির কাছাকাছি যে-সমস্ত ফ্লুওরেসেন্ট আলো জ্বলছে, তার আভা এতদূর এসে পৌঁছয়নি।

গাছতলা থেকে বেরিয়ে একজন প্রধান বাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল। বাকিরা দাঁড়িয়ে রইল নিশ্চুপভাবে। দু-মিনিট, চারমিনিট…ক্রমে দশমিনিট কেটে গেল। সেই লোকটি এবার ফিরে এল গাছতলায়।

কী হল?

নেই।

আর কাউকে দেখলেন?

দারুণ অব্যবস্থা! একজন নার্স পর্যন্ত নেই। শুধু জনকয়েক সুইপার এধারে-ওধারে পড়ে ঘুমোচ্ছে।

আবার কিছুক্ষণ কাটল চুপচাপ।

ট্রেজারির পেটা ঘড়িতে একটা বেজে গেছে কয়েকমিনিট আগে।

দারুণ মশা কিন্তু।

মশার কামড় খেয়ে আর লাভ নেই! চলুন এবার।

সকলে আই ওয়ার্ডকে ডানদিকে ফেলে এগিয়ে গেল ছোট একটা বাড়ির দিকে। বারান্দায় সকলে ওঠার পর একজন এগিয়ে গিয়ে দরজায় ধাক্কা মারল। ভেতর থেকে কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। এরপর ক্রমাগত ধাক্কাধাক্কি চলল। শেষে…।

কে?

দরজা খুলুন।

কে আপনি?

সুপারিন্টেন্ডেন্ট অফ পুলিস কথা বলছি।

মিনিটখানেক পরে দরজা খুলে গেল। আলো যেন চলকে পড়ল বারান্দায়। স্প্লিপিং সুট পরিহিত ডাক্তার দ্বিবেদী মহা বিরক্তি সহকারে বললেন, এই অসময়ে আপনারা?

বাসব মৃদু গলায় বলল, সুনীতা দেবী কি পেছনের দরজা দিয়ে সরে পড়লেন? ওখানে কিন্তু আমাদের লোক আছে।

আপনারা অনধিকারচর্চা করছেন!

পুলিশ সুপার ততক্ষণে সকলকে নিয়ে সামনের ঘরে ঢুকে পড়েছেন। বাসব ছাড়া তাঁর সঙ্গে রয়েছেন থানা ইনচার্জ, সরকারি পক্ষের উকিল, শৈলেন সান্যাল, সদানন্দ এবং রামশঙ্করবাবু।

আমি মাথা-মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনারা চানটা কী?

বাসব বলল, অবুঝ হওয়ার চেষ্টা না করে পরিষ্কার কথায় আসুন। আমরা জানি, সুনীতা দেবী অসুখের ভান করে পেয়িংবেডে আছেন এবং প্রতি রাত্রে আপনার কোয়ার্টারে চলে আসেন, আজও এসেছেন।

অসীম বলে নিজেকে সংযত করে ডাক্তার দ্বিবেদী বললেন, বিষয়টি লজ্জাজনক হতে পারে, কিন্তু এক্ষেত্রে খুব কি দূষণীয়? অপারগ, বৃদ্ধ স্বামীর ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে সুনীতা যদি আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকে, তাতে আপনাদের কিছু বলার থাকতে পারে না।

ঠিকই বলেছেন আপনি! অবৈধ প্রেম নিয়ে আমাদের কোনও মাথাব্যথা নেই। মুশকিলটা কোথায় হয়েছে জানেন, আপনার প্রেমিকার স্বামী খুন হয়ে বসে আছেন।

আপনারা বলতে চান, আমিই দয়ানন্দ ভর্মাকে খুন করেছি?

এইসময় থানা ইনচার্জ সুনীতাকে সঙ্গে নিয়ে ভেতর থেকে এলেন। লজ্জায় কি না জানা গেল না, তাঁর মুখ অসম্ভব লাল। মাথা তুলছেন না।

বাসব বলল, ও-কথা পরে আসছে। আগে বলুন, আপনারা দুজন পুলিশকে বা আমাকে মিথ্যে কথা বলেছিলেন কেন?

কোনও মিথ্যে কথা বলিনি।

আপনার চাকর সন্ধ্যার সময় বাজারে বেরিয়েছিল, তারপর ফিরে আসেনি লক্ষ করেছেন বোধহয়? সে এখন থানায়। তার মুখ থেকে জানা গেছে, ৯ই নভেম্বর শেষরাতে সুনীতা দেবী একাই এসেছিলেন প্রথমে। তারপর আপনার পরামর্শ অনুসারে দয়ানন্দকে এখানে বয়ে আনা হয়। তখন তাঁর ডাইং ডিক্লেয়ারেশন দেওয়ার মতো অবস্থা নয়, আগেই মারা গেছেন। চাকরটা সবই বুঝতে পেরেছিল। সে যাতে কাউকে কিছু না বলে তার জন্যে তাকে আপনি একশো টাকা দিয়েছিলেন। এমন কথাও ছিল, পরে আরও দেবেন।

এবার অসম্ভব নার্ভাস হয়ে পড়লেন ডাক্তার দ্বিবেদী। এই শীতকালেও বিন্দু-বিন্দু ঘাম তাঁর সারা কপাল ছেয়ে গেল। কয়েকবার মুখ খুললেন কিছু বলবার জন্য, কিন্তু বলতে পারলেন না।

শেষে ভেঙে-পড়া ভঙ্গিতে বললেন, বিশ্বাস করুন আপনারা, খুন আমি করিনি। সেদিন ভোররাত্রে ভীত-সন্ত্রন্তভাবে সুনীতা এসে জানাল, দয়ানন্দ ভর্মাকে কে পুড়িয়ে মেরেছে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভালো ছিল না। পুলিশ তাকেই সন্দেহ করবে। আমি সুনীতাকে বাঁচাবার জন্যে উতলা হয়ে উঠলাম। শেষে তাকে মৃতদেহ এখানে নিয়ে আসতে বললাম। ডাইং ডিক্লেয়ারেশনের ব্যবস্থা করে সমস্ত দিক রক্ষা করা যাবে। অশোক শ্রীবাস্তব যে এ-কাজ করেছে সে-সম্পর্কে ধারণা আমাদের মনে কেন জানি না বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল। কাজেই…।

এতক্ষণ পরে সুনীতা দেবী বললেন, উনি ঠিকই বলেছেন। নিজেকে সন্দেহমুক্ত করার জন্যেই ওই পথ আশ্রয় করতে হয়েছিল।

আপনিই বোধহয় চালাঘর থেকে মৃতদেহ বের করে এনে গোবর দিয়ে মেঝে নিকিয়েছিলেন?

হ্যাঁ। খুন বাগানে হয়েছে, পুলিশ এ-কথা জানুক, তাই চেয়েছিলাম।

বাসব বলল, দু-পক্ষের উকিল, পুলিশ এবং দুজন বেসরকারি ভদ্রলোক রামশঙ্কর ও সদানন্দবাবুর সামনে আপনারা স্বীকার করলেন, স্বার্থের জন্যে একজন নিরপরাধ মানুষকে ফাঁসিকাঠের দিকে এগিয়ে দিয়েছেন! আমি নিজের দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি—আমার মক্কেল অবশ্যই ছাড়া পাবেন। পুলিশ সুপার স্বয়ং উপস্থিত রয়েছেন, আপনাদের সম্পর্কে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব এখন তাঁর।

সুনীতা বা দ্বিবেদী আর কিছু বলতে পারলেন না।

সদানন্দ এতক্ষণ পরে বললেন, এবার আমি বাড়ি যেতে পারি কি?

নিশ্চয়, আপনারা এবার যেতে পারেন।

সদানন্দ ও রামশঙ্করবাবু বিদায় নিলেন।

শৈলেন সান্যাল বললেন, খুন কে করেছে, তা এখনও বোঝা গেল না।

মৃদু হেসে বাসব বলল, আইনজ্ঞ হিসেবে এ-কথাটা আপনার বলা ঠিক হচ্ছে না। কে খুন করেছে এ-কেসের স্ট্যান্ড কিন্তু তা নয়। অশোক শ্রীবাস্তব খুন করেছেন কি না, সেটাই হল প্রশ্ন। এখন আমরা প্রমাণ করতে পারব তিনি নির্দোষ।

সুপার বললেন, তা ঠিক! তবে হত্যাকারীকে ধরার জন্যে তো পুলিশকে উঠে-পড়ে লাগতে হবে। আপনি কি এ-সম্পর্কে কোনও আঁচ পাননি?

এতক্ষণ পরে বাসব পাইপ ধরাল। ধোঁয়া ছাড়তে-ছাড়তে বলল, আঁচ কেন? আমি তো জানি কে খুন করেছে।

জানেন আপনি?

জানি বইকী।

কে?

দয়ানন্দ ভর্মার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু রামশঙ্করবাবু।

এইমাত্র যিনি চলে গেলেন? ওঁকে যেতে দিলেন কেন?

কী করব বলুন? প্রমাণ কই? আপনারা অবশ্য সত্যি উঠে-পড়ে লাগলে প্রমাণ সংগ্রহ করা অসম্ভব হবে না। পরে হাতকড়া তো রইলই।

সমস্তই কেমন গোলমেলে মনে হচ্ছে। খুলে বলুন।

দয়ানন্দের ব্যবসায়িক খাতায় দেখলাম, মাত্র মাসদেড়েক আগে রামশঙ্কর পঁচাত্তর হাজার টাকা ধার নিয়েছেন। এরপর দলিলগুলো দেখলাম, হিসেবমতো সমস্তই রয়েছে, শুধুমাত্র তাঁর টাকা ধার নেওয়ার দলিলটা নেই। বুঝলাম, টাকাগুলো মেরে দেওয়ার জন্যে তিনি বন্ধুকে সরিয়েছেন। দয়ানন্দ খুন হলে তাঁকে কেউ সন্দেহ করবে না, সন্দেহ করবে সুনীতা দেবী বা অশোক শ্রীবাস্তবকে। সুতরাং ভাবনার কিছু নেই। তবে ব্যাপারটা সর্বাঙ্গসুন্দর হত, যদি তিনি ব্যবসায়িক খাতাটাও সরিয়ে ফেলতেন। তাহলে কখনওই বুঝতে পারা যেত না, তিনি এত টাকা ধার নিয়েছিলেন। আমার মনে হয়, যে-কোনওভাবেই হোক রামশঙ্কর জানতে পেরেছিলেন, সেদিন শেষরাত্রে দয়ানন্দ বাগানে আসবেন। ঘাপটি মেরে বসেছিলেন। প্রথম সুযোগেই আঘাত করেন। চাবিটি হাতিয়ে ঘরে গিয়ে দলিলটা বের করে নেন। তারপর আহত দেহটা করোগেটের শেড দেওয়া ঘরে নিয়ে গিয়ে আগুন ধরিয়ে দেন। তবে এখনও বুঝতে পারিনি, খুন করার অনেক সহজ পন্থা ছিল, আগুনে পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা তিনি কেন করেন। কিন্তু আর কথা নয়, এবার আমি হোটেলে ফিরব। মিস্টার সান্যাল, কাল সকালে আমার পেমেন্ট যাতে রেডি হয়ে যায় তার ব্যবস্থা করবেন।—আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাসব ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

মাসিক গোয়েন্দা

পুজো সংখ্যা, ১৯৭১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *