আয় শীত, যায় শীত
বহুদিন পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি শীত পড়ে আমাদের টাঙ্গাইল বিন্দুবাসিনী বয়েজ হাই ইংলিশ স্কুলের পিছনের পার্কে। অতি নাবালক বয়েসে সেই পার্কের প্যান্ডেল থেকে মাঘ মাসের মধ্য রাত্রে যাত্রা দেখে বাড়ি ফেরার পথে ঝিরঝির বৃষ্টি আর উত্তুরে হাওয়ায় হাড়কাঁপানো ঠান্ডা—এটাই ছিল আমার মনে শীতলতম স্মৃতি।
এর পরে এই সামান্য জীবনে নানা জায়গায় গিয়েছি এবং স্পষ্টই হাড়ে হাড়ে মজ্জায় মজ্জায় টের পেয়েছি শীত কাকে বলে।
আমাদের দেশের খবরের কাগজগুলো যেমন বন্যার খবর নিয়ে মাতামাতি করে মাঝে-মধ্যেই লিখে দেয় এটাই স্মরণকালের মধ্যে চরমতম বন্যা কিংবা এত বড় বন্যা গত পঞ্চাশ বছরে হয়নি, তেমনিই মার্কিন দেশের কাগজগুলো শীত নিয়ে বাড়াবাড়ি করে।
এই তুষারতাড়িত ঝাঞ্ঝাক্ষুব্ধ মধ্য জানুয়ারির ভরা শীতে আমি পৌঁছেছিলাম মার্কিন দেশে। ওয়াশিংটন শহরের এক হোটেলের কাচের জানলা দিয়ে জীবনে প্রথম বরফ পড়া দেখলাম। ঠিক বুঝতে পারিনি, ছেঁড়া তুলোর মতো বাতাসে হালকা ভেসে যাচ্ছে বরফের আঁশ। রাত তখন প্রায় দশটা। সেই সময় আমার এক পরিচিত ভদ্রলোক আমাকে ফোন করলেন। তিনি থাকেন ওয়াশিংটন থেকে বেশ কিছু দূরে। একথা সেকথার পর আমি তাঁকে বললাম, ‘আমার মনে হচ্ছে, বাইরে বরফ পড়ছে’!
আমার কথা শুনে ভদ্রলোক খুবই অবাক হলেন। তিনি বললেন, ‘রেডিয়ো, টিভি, খবরের কাগজ কোথাও বরফের কথা লেখেনি। আপনি বলছেন বরফ পড়ছে।’ তারপর আমাকে বললেন, ‘আপনি তো আগে কখনও বোধহয় তুষারপাত দেখেননি?’ আমি সবিনয়ে আমার অভিজ্ঞতার অভাবের কথা স্বীকার করলাম। তখন ওই ভদ্রলোক আমাকে কাচের জানলার বাইরে যে দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি তার বর্ণনা করতে বললেন। আমি বর্ণনা করতে যাচ্ছি সেই মুহূর্তে তিনি বললেন, ‘আপনি ঠিকই দেখেছেন। এই মাত্র দশটার খবরে বলল ওয়াশিংটনে বরফ পড়ছে। আমাদের এখানেও হয়তো আরও রাতের দিকে পড়বে।’
তবে ওয়াশিংটনে নয়, আসল শীতের ঝড় পেয়েছিলাম ওয়াশিংটন থেকে দুশো কিলোমিটার দূরে নিউইয়র্কে। সেই ঠান্ডা বর্ণনায় আমি যাব না, শুধু মনে আছে মার্কিনি খবরের কাগজগুলো সেই রবিবারে প্রথম পৃষ্ঠায় ঘোষণা করেছিল, ‘শতাব্দীর শীতলতম সপ্তাহ’।
আমরা গরমের দেশের লোক। শীতলতার কথা খুব বেশি জানি না। সুতরাং শীত নিয়ে দু’-একটা উষ্ণ কাহিনী বলি।
শান্তিনিকেতনে পৌষ উৎসবের এক হিমশীতল রাতে পূর্বপল্লীর ইন্টারন্যাশনাল গেস্ট হাউসে আমার পাশের খাটে ছিলেন এক অপরিচিত বৃদ্ধ ভদ্রলোক। সেদিন রাতে ভয়ংকর ঠান্ডা পড়েছিল। বিশেষ করে মেলার ভিড়ের উত্তাপ থেকে দোতলার সেই ঘরে এসে দারুণ শীত করছিল। রাতে কম্বলের নীচে শুয়েও ঠক ঠক করে কাঁপছিলাম, দাঁতে দাঁত জোড়া লেগে গিয়েছিল। পরদিন ভোরবেলা রোদ্দুরে বসে তাপ পোয়াতে পোয়াতে সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোককে প্রশ্ন করলাম। ‘কাল কেমন ঠান্ডা বুঝলেন।’ বৃদ্ধ বললেন, ‘ভয়ানক’।
আমি বললাম, ‘আমি কম্বলের নীচে ঠক ঠক করে কেঁপেছি, দাঁতে দাঁত জোড়া লেগে গিয়েছিল’। বৃদ্ধ স্বীকার করলেন, তিনিও খুব কেঁপেছেন। তবে দাঁতে দাতে জোড়া লাগেনি বা ঠক ঠক করেনি।
এই ইঙ্গিতপূর্ণ বাক্যে আমি তাঁর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে তিনি হেসে বললেন, ‘কারণ আমার দাঁতজোড়া মুখ থেকে খুলে কানের মধ্যে রেখেছিলাম। আমার তো বাঁধানো দাঁত’। এই গল্প যদি কোনও বুদ্ধিমানের খুব অবিশ্বাস্য মনে হয়, তবে পরের গল্পটি শুনে তাঁরা কী বলবেন, ঈশ্বর জানেন।
এ গল্প শুনেছিলাম হিমালয় অভিযাত্রী-দলের এক দুঃসাহসিকা মহিলার মুখে। গঙ্গোত্রীর পাহাড় চূড়ার তাঁবুতে বরফ ও বাতাস ভরা রাত্রিতে অভিযাত্রীরা নিজেদের মধ্যে যেসব কথাবার্তা বলতেন তা মুখ থেকে নিঃসৃত হয়ে শব্দ হয়ে বেরত না, বরফের জমাট টুকরো হয়ে বেরত। কে কী বলেছে সেটা জানার জন্যে পরের দিন সকালে ডেকচিতে স্টোভের উপর বসিয়ে সেই বরফের টুকরোগুলো গরম করলে কথাগুলো একের পর এক বেরিয়ে আসত যেমন বেরিয়ে আসে ক্যাসেট বা গ্রামোফোনের রেকর্ড থেকে।
শীত নিয়ে যথেষ্ট বাতুলতা হল। অতঃপর কাব্যকথায় যাই। সাধারণ মানুষের ভাল লাগুক অথবা নাই লাগুক, শীত কবিদের প্রিয়তম ঋতু। এই শতাব্দীর বিষন্নতম কবি নির্জন শীতের রাতে জানালার ধারে স্থবিরতার অপেক্ষায় প্রদীপ নিবিয়ে বসে থাকার কথা লিখেছিলেন। তাঁর কবিতার অক্ষরে অক্ষরে শীতের ঝরা পাতার আর হিমবাতাসের শব্দ শোনা যায়। বড় বিষন্ন, বড় শীতল সেই অনুভূতি।
আমাদের দেশের শীত তেমন প্রখর নয়। তবুও আমাদের অন্য এক যুগের অন্য এক কবির একটি পঙ্ক্তি, ‘জাকু, ভানু, কৃশানু শীতের পরিত্রাণ’, ‘বহুদূরের এক হতভাগিনীর দীর্ঘশ্বাস বয়ে আনে’।
ভিন্ন পৃথিবীর প্রকৃত শীত-ঋতুর দেশের এক অমর মহাকবি কিন্তু তাঁর বিখ্যাত এক নাটকের একটি দুঃখিত গানে শীতের বাতাসকে বইতে অনুরোধ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘শীতের বাতাস তুমি বও, তুমি বও। মানুষের অকৃতজ্ঞতার মতো তুমি নির্দয় নও।’
এই মুহূর্তে এইখানে রবীন্দ্রনাথকেও কি স্মরণ করা উচিত নয়। কিন্তু তাহলে পাতার পর পাতা ভরে নিবন্ধ তার সীমানা ছাড়িয়ে যাবে। সুতরাং আয় শীত যায় শীত। কলকাতার শীত আসে আর এসেই চলে যায়। এত সংক্ষিপ্ত তার পরমায়ু কিছুতেই মনে পড়ে না ইংরেজ কবির সেই আশ্বাসের কথা, ‘যদি শীত আসে তবে বসন্ত কি দূরে থাকবে?’ আমাদের শীত আর বসন্ত একাকার। শীতের পিছনে নয় শীতের সঙ্গে আসে বসন্ত, তাই শীতের শ্রীপঞ্চমী আমাদের বসন্ত পঞ্চমী।