1 of 2

আয়না – নরেন্দ্রনাথ মিত্র

আয়না – নরেন্দ্রনাথ মিত্র

মাস তিনেক আগে সন্ধ্যার পর বউবাজার স্ট্রীটের একজন বন্ধুর ফার্নিচারের দোকানে বসে গল্প করছিলাম। উত্তর দক্ষিণে লম্বা দোকানটির বেশির ভাগ জায়গা সরোজ গুদামের কাজে লাগিয়েছে। নানা প্যাটার্নের খাট, চেয়ার, আলমারিতে সেই গুদাম ভরতি। দোরের সামনে যে অল্প একটু জায়গা রয়েছে, সেখানে ছোট একটি টেবিল। সরাজের কাউন্টার। আমরা সেই টেবিলের ধারে দু’খানা চেয়ারে পাশাপাশি বসে সুখ দুঃখের কথা বলছিলাম।

বাইরে টিপ টিপ করে বৃষ্টি হচ্ছে। ফোঁটা কখনো ছোট, কখনো বড়। বৃষ্টিটা একটু জোরে শুরু হতেই সরোজ দোর বন্ধ করে দিল। বলল, ‘কাণ্ড দেখ! এক ঝাপটায় সব ভিজিয়ে ফেলল। কার্তিকের শেষে এমন বদরসিক বৃষ্টি আর দেখেছ!’

বন্ধুর সেই বিরক্তিটুকু আমি উপভোগ করলাম। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘এবার যাই।’

কিন্তু সরোজ জোর করে আমার হাত ধরে টেনে বসাল, একটু ধমকের সুরে বলল, ‘এসেই তো যাই যাই করছ! ন’মাসে ছ’মাসে একবার দেখা হয়, যদি দু-দণ্ড বসতেই না পার, তবে আস কেন?’ তারপর হেসে নরম গলায় বলল, ‘বসো আর একটু। মন-মেজাজ খুব খারাপ। যা ওয়েদার চলছে, তাতে কবে যে ফের খদ্দেরের মুখ দেখব, কে জানে!’

বললাম, ‘তোমার গলায় সত্যিই বিরহের সুর ফুটছে।’

আমার কথা শেষ না হতেই দরজায় টোকা পড়ল। আমি গলা নামিয়ে বললাম, ‘দেখ, তোমার খদ্দের বোধ হয় এবার একজন এলেন।’

সরোজ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আসুন, দোর খোলাই আছে।’

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সশব্দে দরজা ঠেলে এক ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন। আমি একটু চমকে উঠে তাঁর দিকে তাকালাম। ভদ্রলোকের বয়স বছর চল্লিশ-বিয়াল্লিশ হবে। লম্বায় প্রায় ছ’ফুট। বেশ সুপুরুষ। গৌরবর্ণ চেহারা। নাক-চোখ টানা-টানা। শুধু সুপুরুষই নয়, ভদ্রলোক বেশ সৌখিন। গায়ে গরদের পাজ্ঞাবি। পরনে মিহি কোঁচাননা ধুতি। এইটুকু পথ আসতেই বেশ একটু ভিজে গেছেন।

এমন একজন সুদর্শন পুরুষকে দেখেও আমার বন্ধু সরোজ খুব খুশি হয়েছে বলে মনে হল না। বরং তাকে যেন একটু অপ্রসন্নই দেখাল।

সরোজ গম্ভীর স্বরে বলল, ‘বসো নিরঞ্জন। এই বৃষ্টি-বাদলের দিনেও বেরিয়েছ?’

এতক্ষণ ভদ্রলোককে বেশ স্বাভাবিক সপ্রতিভ অবস্থায় দেখেছিলাম। কিন্তু সরোজের ওই সাধারণ একটি প্রশ্নে তিনি যেন অন্যরকম হয়ে গেলেন। যেন কি একটা গোপন অপরাধ তাঁর ধরা পড়ে গেছে। চোখে মুখে ঠিক তেমনি এক ধরনের নাভসি ভাব ফুটে উঠল।

তিনি যেন একটা অভিযোগের প্রতিবাদ করছেন তেমনি ভঙ্গিতে বললেন, ‘হ্যাঁ, বেরিয়েছি। কি এমন ঝড়-ঝাপটা হচ্ছে যে মানুষ ঘর থেকে বেরোতে পারবে না! আমার এদিকে কাজ ছিল, তাই বেরিয়েছি।’

সরোজ একটু হাসতে চেষ্টা করে বললে, ‘বেশ করেছ। দরকার থাকলে বেরোবে বৈকি! আমরা কি বেরোই না! বসো, ভাল হয়ে বসো।’

কিন্তু লক্ষ্য করলাম, ভদ্রলোকের মধ্যে যেন কিসের একটা চাঞ্চল্য আরম্ভ হয়েছে। তিনি তাকে জোর করে চাপতে চেষ্টা করছেন, কিন্তু কিছুতে পেরে উঠছেন না। মনে হল, তিনি যেন একবার উঠে বেরিয়ে যেতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু না পেরে হতাশ হয়ে বসে পড়লেন। যেন জোর করে তাঁকে কেউ উঠতে দিচ্ছে না, তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে আটকে রাখছে। তাঁর ভাবভঙ্গি দেখে কেমন যেন একটা অপ্রকৃতিস্থ বলে মনে হল।

তারপর হঠাৎ তিনি বললেন, ‘সেই আয়নাখানা কোথায়? বিক্রি হয়ে গেছে?’

সরোজ তাঁর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি জানতুম, তুমি এ কথাটি ঠিক জিজ্ঞেস করবে। তুমি এর জন্যেই এসেছে।’

ভদ্রলোক ফের প্রতিবাদের সুরে বললেন, ‘এর জন্যেই এসেছি? আশ্চর্য তোমাদের ধারণা। আমার একটা জিনিস তোমাকে বিক্রি করতে দিয়েছি, সেটা তুমি বিক্রি করলে কি করলে না জিজ্ঞেস করলেই তা দোষের হয়ে গেল?’

সরোজ শান্তভাবে বলতে চেষ্টা করল, ‘আমি কি বলছি দোষের! তুমি এত চটছ কেন? সত্যিই তো, তোমার জিনিসের কথা তুমি একবার কেন, হাজার বার জিজ্ঞেস করতে পার, তাতে কিছুই দোষের নেই। ওই তো তোমাদের সেই ড্রেসিং টেবিলটা রয়েছে। এখনো বিক্রি করতে পারিনি। ভেবো না, দরদাম হচ্ছে, একদিন বিক্রি হয়ে যাবে।’

‘আমার ভাবার কি আছে।’

বলে ভদ্রলোক চেয়ারে চেপে বসে রইলেন। তারপর যেন নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে পড়লেন। ধীরে ধীরে গিয়ে দাঁড়ালেন ড্রেসিং টেবিলটার সামনে। এতগুলি ফার্নিচারের মধ্যে আমি সেই টেবিলটাকে এতক্ষণ লক্ষ্যই করিনি। তিনি গিয়ে দাঁড়াতে এবার ড্রেসিং টেবিলটা আমার চোখে পড়ল। দেখলাম, টেবিল-আয়নাখানা সত্যিই বেশ সুন্দর। আগেকার আমলের বামটিকে তৈরি। কালো পালিশ। আয়নাখানা বেশ পুরু আর স্বচ্ছ। আমি ফার্নিচার ডিলার নই। এসব জিনিস তেমন ব্যবহারও করিনে। তবু বুঝতে পারলাম, জিনিসটা বেশ দামী। আজকাল এ জিনিস খুব সুলভ নয়।

কিন্তু আয়নার মধ্যে ভদ্রলোকের মুখের যে ছায়া পড়েছে, তার দিকে হঠাৎ আমার চোখ পড়ায় আমি চমকে উঠলাম। বলতে লজ্জা নেই, আঁৎকে উঠলাম। এমন বিবর্ণ ভীত মুখ আমি আর দেখিনি। ভদ্রলোক আয়নার মধ্যে কি দেখছিলেন জানিনে, কিন্তু তাঁকে দেখে আমার মনে হল যেন তিনি আর আমাদের জগতের কেউ নন, কোন এক অলৌকিক লোকের অধিবাসী। ভয় জিনিসটা বোধ হয় সংক্রামক। নইলে তাঁর ভয় আমাকে এমন ভয়ার্ত করে তুলবে কেন?

আমি সরোজকে ওঁর কথা জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিলাম, দেখি সে ততক্ষণে উঠে গিয়ে ভদ্রলোকের একটা কাঁধ শক্ত করে চেপে ধরেছে। আমি তার গলা শুনতে পেলাম, ‘নিরঞ্জন, নিরঞ্জন!’

ভদ্রলোক ফিরে এবার তাকালেন, অস্ফুট স্বরে বললেন, ‘কি বলছ?’

সরোজ ধমকের ভঙ্গিতে বলল, ‘বলছি কি, তুমি এবার বাড়ি যাও। তোমাকে আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। বেশ রাত হয়ে গেছে। মাসিমা তোমার জন্যে ভাবছেন, বরানগর তো এখানে নয়। যেতেও তো সময় লাগবে। যাও এবার।’

ভদ্রলোক শান্ত বাধ্য ছোট ছেলের মত বললেন, ‘হ্যাঁ, যাই যাই। সত্যি, রাত হয়ে গেছে। আমি খেয়াল করিনি।’

তিনি এবার দরজার দিকে এগোতে লাগলেন। কিন্তু দু’পা যেতে না যেতে আবার ফিরে এসে আমার বন্ধুর দিকে চেয়ে বললেন, ‘সরোজ।’

সরোজ কোমল স্বরে বলল, ‘বল।’

ভদ্রলোক একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘তুমি বরং আয়নাটা আমাকে ফেরৎই দাও। আমি ওটাকে বাড়ি নিয়েই রাখি। সেই আসতে তো আমাকে হবেই—’

তিনি একটু হাসলেন। সে হাসি যেমন করুণ, তেমনি বিষণ্ণ।

সরোজ বলল, ‘কি যা তা বলছ? এবার বাড়ি যাও তো তুমি! মাসিমা তোমার জন্যে ভাবছেন। শিগগির যাও।’

বলতে বলতে সরোজ তাঁকে একরকম জোর করেই ঘর থেকে বের করে দিল।

আমি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে থেকে বললাম, ‘ব্যাপারটা কি সরোজ?’

জন দুই পালিশওয়ালা ভিতরের দিকে বসে কি কাজ করছিল, সরোজ আমার কথার জবাব না দিয়ে তাদের ধমকে উঠল, ‘আচ্ছা, ফটিক, মুকুন্দ, তোমাদের কতদিন বলিনি, টেবিলটা সামনে না রেখে, ভিতরের দিকে কোথাও লুকিয়ে রেখ? আমার কথা গ্রাহ্য হয় না, না?’

পালিশওয়ালাদের একজন বলল, ‘আজ্ঞে ছোটকর্তা, ভেতরেই তো ছিল। একজন খদ্দের নেবেন বলে গেলেন, তাই বাইরে এনে পালিশটালিশ করে রেখেছি। কই, তিনি তো আর এলেন না!’

দ্বিতীয় পালিশওয়ালাটি বলল, খোঁজ নিয়ে দেখুন তাঁর আসবার অবস্থা আছে কিনা। নাকি বেনেপুকুরের মধুবাবুর মত তাঁরও এতক্ষণে হয়ে গেছে।’

সরোজ ফের ধমক দিয়ে উঠল, ‘কি যা তা বাজে কথা বলছ। নিজেদের কাজ করো তো!’

প্রথমজন বলল, ‘আমাদের ধমকান আর যাই করেন ছোটকর্তা, আয়নাটাকে আপনি ঘর থেকে বিদায় করুন। কাউকে বিনি পয়সায় বিলিয়েও যদি দিতে হয়, তাও দিন আপনি। নইলে কবে যে আবার কি ঘটবে—’

সরোজ বাধা দিয়ে বললে, ‘আঃ, ফের ওইসব কথা। তোমাদের মত Superstitious লোক নিয়ে কাজকর্ম করাই মুশকিল।’

আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সরোজ, ব্যাপারটা কি?’

সরোজ একটুকাল চুপ করে থেকে বলল, ‘ব্যাপারটা বড়ই দুঃখের। নিরঞ্জনের যে এমন পরিণতি হবে, তা কোনদিন ভাবতে পারিনি। সত্যি কথা বলতে, কি ওর মত sane আর sober ছেলে আমাদের দলের মধ্যে আর দুটি ছিল না।’

বললাম, ‘হঠাৎ কেন এমন হল?’

সরোজ বলল, ‘ঠিক হঠাৎ একদিনে হয়নি। আর একটা কারণেই যে অমন হয়েছে, তাও আমার মনে হয় না। তবু শেষের ঘটনা যে সবচেয়ে গুরুতর, তা মানতেই হয়। কিন্তু তোমাকে গোড়া থেকে না বললে কিছু বুঝতে পারবে না।’

বললাম, ‘হ্যাঁ গোড়া থেকেই বল।’

সরোজ তখন কাহিনীটা বলল: ‘নিরঞ্জন হালদার সম্পর্কে আমার মাসতুতো ভাই। কিন্তু আত্মীয়তার চেয়ে ওর সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্কটাই আমার বড় ছিল। আমরা এক স্কুলে এক ক্লাসে পড়েছি। কলেজেও এক সঙ্গে ঢুকেছিলাম। আমি বছর দুই যেতে না যেতেই বেরিয়ে আসি। আর নিরঞ্জন ডিস্টিংশনে বি. এ পাশ করে। মেসোমশাই ছিলেন নাম করা অ্যাটর্নি। তাঁর ইচ্ছা ছিল নিরঞ্জন ল’ পড়ে। কলেজে ভর্তিও হয়েছিল। কিন্তু মাস দুয়েক বাদেই ছেড়ে দিল। বলল, ‘দূর, ভাল লাগল না!’ এই নিয়ে মেসোমশাইয়ের সঙ্গে ওর সামান্য ঝগড়া-ঝাটি হয়েছিল। কিন্তু সে এমন বেশি কথা নয়, তিনি ছেলেকে খুবই ভালবাসতেন। একটা কড়া কথা বলে তিনি তিনবার গিয়ে পিঠে হাত বুলোতেন। কিন্তু এত আদরযত্ন সত্ত্বেও নিরঞ্জন বিগড়ে গেল। বিরাজ গাঙ্গুলী বলে নিরুর এক পিসেমশাই ছিলেন। ও তাঁর খপ্পরে পড়ল। নিরুর পিসিমা অল্প বয়সে মারা গিয়েছিলেন। বিরজাবাবু আর বিয়ে করেননি। কিন্তু আর সবই করেছেন। জীবনটাকে উড়িয়ে-পুড়িয়ে না দেখলে তার রসটা পুরোপুরি ভাবে পাওয়া যায় না, এই ছিল তাঁর বাণী। নিরু তাঁর মন্ত্রশিষ্য হল। তাঁর সঙ্গে শেয়ার মার্কেটে যায়, রেসের মাঠে যায়, ফিরে এসে বসে পড়ে। খরচটা পিসেমশাই জোগান। কিছুদিন মেসোমশাই রাগ করে, অভিমান করে রইলেন। তারপর আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধবের পরামর্শে জোর করে নিরঞ্জনের বিয়ে দিলেন। জোরটা অবশ্য ধমকের জোর নয়, চোখের জলের জোর। তাছাড়া যে মেয়েকে তিনি পছন্দ করেছিলেন, সে অসাধারণ সুন্দরী। তাকে দেখে নিরঞ্জনের নিজেরও মন টলল। বিয়ের পর নিরঞ্জনের বাইরের উদ্দামতা কমে এল। আমরা বললুম, ‘সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র।’ এদিকে নিরঞ্জনের সেই মন্ত্রগুরু পিসেমশাই মারা গেলেন। খবরটায় আমার মেলোমশাই খুব নিশ্চিন্ত হলেন। কিন্তু তাঁর শান্তি বেশিদিন টিকল না। নিরঞ্জন আবার বাড়াবাড়ি শুরু করল। এবারকার বাড়াবাড়ির জন্যে শুনলুম মীরা বউদিই দায়ী। কোন এক পুরোন বন্ধুর সঙ্গে দেখা হওয়ায় নিরঞ্জন নাকি সে রাত্রে মাত্র দুটি পেগ খেয়ে ফিরেছিল। তার জন্যে মীরা বৌদি স্বামীকে যা নয় তাই বলে গাল দিয়েছেন। রাগ করে অন্য ঘরে গিয়ে শুয়েছেন। নিরঞ্জন অনেক সাধাসাধি করেও বৌয়ের মান ভাঙাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ক্ষেপে গেছে। মাসিমা মেসোমশাই দুজনই এ নিয়ে মীরা বৌদিকে সেদিন বকাবকি করেছিলেন।

বছর পাঁচেক বাদে মেসোমশাইও চোখ বুজলেন। কিন্তু নিরঞ্জনের তখনও ফেরবার নাম নেই। ওই সেই পিসে বিরাজ গাঙ্গুলী যেন ওর মধ্যে নতুন জন্ম নিয়েছে।

এই সময় একদিন ছেলের অন্নপ্রাশনে ওদের নিমন্ত্রণ করেছিলাম। নিরঞ্জন আসেনি। মাসিমা আর মীরা বৌদি এসেছিলেন। শাশুড়ির অসাক্ষাতে মীরা বৌদি সেদিন আক্ষেপ করে বলেছিলেন, সরোজবাবু, বাবা আমাকে শুধু বাড়ি-ঘর দেখে বিয়ে দিয়েছিলেন, কার হাতে দিলেন দেখেননি।

আমার স্ত্রী মল্লিকা বলেছিল, ওকথা কেন বলছেন মীরাদি। রূপ-গুণ বিদ্যাবুদ্ধি কোনটাতেই তো তিনি খাটো নন। তাঁর তো সবই আছে।

মীরা বৌদি বলেছিলেন, মানুষ তো কেবল বাইরেটাই দেখে, ভিতরে যে থাকে সেই বোঝে সব থাকবার কি জ্বালা।

তাঁর সেই কথাগুলি আজও যেন আমার কানে লেগে রয়েছে।

আরো বছর তিনেকের মধ্যে নিরঞ্জন পৈতৃক বাড়ি-ঘর, বিষয়-সম্পত্তি সব খোয়াল। দামী দামী সব ফার্নিচার ভারি সস্তায় বিক্রি করে দিল। আমাকে একবার জানালও না। আমি জানতে পারলে ওকে অমন করে ঠকাতাম না। মীরা বৌদি রাগ করে গিয়ে বাপের বাড়ি ছিলেন। ফিরে এসে দেখেন, বিয়ের সময় বাবার কাছ থেকে যৌতুক পাওয়া তাঁর খাট আলমারি পর্যন্ত নিরঞ্জন বিক্রি করে দিয়েছে। বাকি আছে ড্রেসিং টেবিলটা। তারও দরদাম হচ্ছে। মীরা বৌদি সেই আয়নার সামনে টেবিলের ওপর মাথা গুঁজে রইলেন। বললেন, আমাকে না বেচে তুমি আমার বাবার দেওয়া এই টেবিল বিক্রি করতে পারবে না। তাঁর দেওয়া একটা জিনিসও আমি রাখতে পারব না?

তারপর ওরা জোড়াবাগান ছেড়ে বরানগরের একটা ছোট ভাড়াটে বাড়িতে উঠে যায়। সেখানেও জোর দাম্পত্য-কলহ চলে। তারপর হঠাৎ নিরঞ্জন অসুস্থ হয়ে পড়ে। ও সেবার মাস ছয়েক ভুগেছিল। মাঝে মাঝে আমি যেতাম। আর দেখতাম, মীরা বৌদির সেবা-শুশ্রুষা। তখন তাঁর গয়না বিক্রি করে চিকিৎসা চলত, সংসার চলত। এই গয়নার বাক্স স্বামীর হাতে পড়বে বলে নিজের দাদার কাছে তিনি লুকিয়ে রেখে এসেছিলেন। বিপদের দিনে সেই বাক্স আবার তিনি ফেরৎ নিয়ে এলেন। নিরঞ্জন একদিন স্ত্রীকে বলেছিল, আয়নাটা বিক্রি করতে দিলে না, অথচ গয়নাগুলি দিব্যি বিক্রি করছ। আয়নাটা কি গয়নাগুলির চেয়ে দামী?

মীরা একটু লজ্জিত হয়ে বলেছিলেন, তা নয়। একটা আয়না বিক্রি করলে, কতই বা হত।

কিন্তু নিরঞ্জন আর মাসিমার কাছে শুনেছি, আয়নার ওপর মীরা বৌদির একটু বেশিরকম দুর্বলতা ছিল। গয়নাগাঁটি তিনি বেশি পরতেন না। কিন্তু সময় পেলেই যখন-তখন আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেন। এক দৃষ্টিতে নিজের ছায়ার দিকে চেয়ে থাকতেন। কি দেখতেন, কি ভাবতেন তিনিই জানেন। যে রূপে স্বামীকে মুগ্ধ করতে পারেননি, সেই রূপকে তিনি কি চোখে দেখতেন তা জানিনে। নাকি নিজের ছায়ার দিকে তাকিয়ে নিজেকে বলতেন, আরো শক্ত হও, ধৈর্য ধর, কিছুতেই ভেঙে পড়ো না।

নিরঞ্জন সুস্থ হয়ে উঠল। ডাক্তার শাসন করে বলেছিলেন, ফের মদ ধরলে আর বাঁচবেন না। অনেক কষ্টে লিভারটিকে রক্ষা করেছি। আর অত্যাচার করলে সইবে না।

তবু মদের জন্য নিরঞ্জনের মন চঞ্চল হয়ে উঠত। কিন্তু উঠলে হবে কি, আর সেই অর্থও ছিল না, সামর্থ্যও ছিল না। মৃদু মোলায়েম নেশা হিসাবে মীরা বৌদি নাকি তাকে এসময় ভাঙের সরবৎ করে দিতেন। নেশার সময়টাকে পার করে দেওয়ার জন্যে সেজেগুজে স্বামীর কাছে গল্প করতে বসতেন।

সুস্থ হওয়ার পর নিরঞ্জনের হঠাৎ সুমতি হল। এতকাল বাদে চাকরির খোঁজে বেরোল নিরঞ্জন। একটা ইনসিওরেন্স অফিসে ভাল চাকরিই পেল। চেহারা আছে, ডিগ্রি আছে, বলতে কইতে পারে, পাবে না কেন! খবর শুনে মীরা বৌদিকে কনগ্রাচুলেট করে এলাম। বললাম, আপনার ক্ষমতা আছে। আপনি ছাড়া ওকে আর কেউ ফেরাতে পারত না।

মীরা বৌদি স্মিত মুখে চুপ করে রইলেন।

বছরখানেক ভালই কাটল। কিন্তু তারপর তাঁর সে সুখ বেশি দিন সইল না।

নিরঞ্জনকে নতুন নেশায় ধরল। মদ নয়, মদের চেয়েও মারাত্মক। রেখা চ্যাটার্জি নামে বাইশ-তেইশ বছরের একটি মেয়ে নিরঞ্জনদের অফিসে টাইপিস্টের কাজ করে। তাঁকে নিরঞ্জনের চোখে পড়ল। আমি সে মেয়েটিকে দেখেছি। দেখতে কালো, রোগা, ঢ্যাঙা চেহারা। তার মধ্যে নিরঞ্জন কি যে দেখেছে সেই জানে। আমরা, টাইপিস্ট আর তার নাম জড়িয়ে নানা কথা শুনতে লাগলাম। ছুটির পর নিরঞ্জন সরাসরি বাড়ি আসে না। রেখাকে নিয়ে বেড়াতে বেরোয়, সিনেমায় যায়, থিয়েটারে যায়। নানারকম সৌখিন জিনিস কিনে প্রেজেন্ট করে। মাইনের বেশির ভাগ টাকাই নাকি তার এইভাবে ব্যয় হয়ে যায়। আর এই নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দিন-রাত ঝগড়া চলে। সত্যি বলতে কি, মেয়ের দিকে নিরঞ্জনের আগে ঝোঁক ছিল না। সে মদেই খুশি থাকত। মীরা বৌদি তখন নাকি বলতেন, তুমি বরং অন্য মেয়েকে ভালবাস তা আমার সইবে, কিন্তু মদের গন্ধ আমি সইতে পারব না। —কিন্তু এখন তিনি টের পেলেন, মদের গন্ধের চেয়ে অন্য মেয়ের গন্ধ আরো কটু। এই নিয়ে ঝগড়াঝাটি খুব চলতে লাগল। তারপর কথার মুখে নিরঞ্জন একদিন বলে বসল, আমার যা খুশি তাই করব। আমি বিয়ে করব রেখাকে। আমি ছেলেমেয়ে চাই। তোমার দ্বারা তো আর তা হবে না।

প্রথম যৌবনে একটি ছেলে হওয়ার সময় হাসপাতালে মীর বৌদির অপারেশন হয়েছিল। সেই থেকেই তাঁর সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যায়।

স্বামীর মুখে ফের সেই পুরোন কথা শুনে মীরা বৌদি হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তারপর আর তিনি কারো সঙ্গে একটি কথাও বলেননি।

নিরঞ্জন অফিস থেকে সেদিনও খুব রাত করেই ফিরে এসেছিল। এসে দেখে, শোবার ঘরের দরজা বন্ধ। অনেক অনুনয় বিনয় রাগারাগির পরও দরজার পাট না খুলতে পেরে, রাত্রের জন্যে নিরঞ্জনকে মার ঘরে আশ্রয় নিতে হয়। পরদিন ভোরে মিস্ত্রি ডেকে ডেঙে ফেলে দরজা। দেখা যায় কড়িকাঠে ফাঁস লাগিয়ে মীরা বৌদি ঝুলছেন। তাঁর পায়ের গয়া পড়েছে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায়। এ দৃশ্য দেখে নিরঞ্জন স্তব্ধ হয়ে যায়, মাসিমা চিৎকার করে উঠল। বাপ-মা মরা সুলতা নামে চোদ্দ-পনেরো বছরের একটি ভাইছি থাকত তাঁর কাছে, সে মূর্ছা যায়। তারপর যা ঘটতে লাগল, সবই গতানুগতিক। আমার স্ত্রী একদিন মাসিমার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে শুনে এল, সুলতা নাকি ও বাড়িতে আর থাকতে চাইছে না। নিরঞ্জন অফিসে বেরিয়ে গেলে ঘরখানা সাধারণত বন্ধই থাকে। সেদিন বিকেল বেলায় সুলতা ঘর ঝাড় দেওয়ার জন্যে যেই দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকেছে, কে যেন তাড়াতাড়ি আয়নার সামনে থেকে সরে গেল। আর একদিন সন্ধ্যার একটু আগে মাসিমা ওই ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় চিরুণীতে চুল আঁচড়াবার শব্দ শুনতে পেলেন।

এমন কিছু নতুন নয়। যে বাড়ির বউ আত্মহত্যা করে মরে, সে বাড়ির মেয়েরা কিছুদিন এ ধরনের অনৈসর্গিক ব্যাপার দেখতে-শুনতে পায়। আমি আমার স্ত্রীর কথা হেসেই উড়িয়ে দিলাম। বললাম, কবে দোকান থেকে ফিরে এসে দেখব, মীরা বৌদি তোমার সঙ্গে বসে বসে গল্প করছেন।

আমার স্ত্রী রাগ করে বলল, তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা আমার ভাল লাগে না।

আমি একটু সপ্রতিভ হয়ে চুপ করে গেলাম। সত্যি, মীরা বৌদিকে নিয়ে ঠাট্টা করা চলে না। কিন্তু এত যাঁর বুদ্ধি, এত যাঁর ধৈর্য, তিনি ঝোঁকের মাথায় ও কাজ করতে গেলেন কেন? নিরঞ্জনকে বাধা দেওয়ার আর কি কোন উপায় ছিল না?

দিনকয়েক বাদে নিরঞ্জন এল এই দোকানে। একথা-সেকথার পর হঠাৎ বলল, মীরা বৌদির ড্রেসিং টেবিলটা সে বিক্রি করে দিতে চায়। তার কথা শুনে আমি তো অবাক। এমন কাজ কেন করতে যাবে নিরঞ্জন। মীরা বৌদির একটা স্মৃতিচিহ্ন থাক না ওদের বাড়িতে। আয়নাটা কত ভালোবাসতেন বৌদি।

নিরঞ্জন সেদিন আর কিছু না বলে উঠে গেল। দিনকয়েক বাদে মাসিমা আমাকে খবর পাঠালেন। তাঁর কাছে শুনলুম, নিরঞ্জন নাকি রাত্রে আলো জ্বেলে ঘুমোয়। অথচ এর আগে ঘরে একটু আলো থাকলে তার ঘুম হত না। এর পর তিনিও আমাকে টেবিলটা নিয়ে আসবার জন্যে অনুরোধ করলেন। বললেন, এখন তোর টাকা দিতে হবে না, বিক্রি হয়ে গেলে যদি কিছু দিতে হয় দিস, না দিলেও কিছু আমার লোকসান হবে না।

মাসিমা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে টেবিলটা নিয়ে আসার জন্যে আমাকে এমন বার বার করে বলতে লাগলেন যে পরদিনই আমি দোকানের একটা কুলিকে পাঠিয়ে দিলাম। নিরঞ্জন মুখে একটু আপত্তি করল, কেন আবার তুমি এত কষ্ট করতে গেলে। আয়নাটা যেখানে ছিল, সেখানেই না হয় থাকত।

কিন্তু ওর ভাবভঙ্গি দেখে আমার মনে হল, আয়নাটা ওর বাড়ি থেকে নিয়ে আসায় নিরঞ্জন নিশ্চিন্ত হয়েছে, খুশি হয়েছে।

ড্রেসিং টেবিলটার যা ন্যায্য দাম, আমি তাই ওকে দিতে গেলাম। কিন্তু নিরঞ্জন কিছুতেই নিল না। বলল, ঘর থেকে কেন দেবে, বিক্রি হয়ে গেলে তারপর দিও।

দাম নিল না বটে, কিন্তু নিরঞ্জন রোজ একবার করে আয়নাটার খোঁজ নিতে আসতে লাগল। জিনিসটা বিক্রি হয়েছে কিনা, কেউ এসে দর করে গেছে কিনা, রোজ এক প্রশ্ন।

মাসিমা আর একদিন খবর নিলেন, বললেন, নিরুর এবার একটা বিয়েটিয়ে দে।

কথাটায় আমি একটু আঘাত পেলাম। এই সেদিন মীরা বৌদি মারা গেলেন, তাও সাধারণ মৃত্যু নয়, আর এরই মধ্যে মাসিমা ছেলের বিয়ের প্রস্তাব করছেন?

মাসিমা আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে বললেন, একা এক ঘরে থাকতে বোধ হয় ভয় হয়। সারা রাত ঘুমোয় না। আমি বলি, আমি এসে তোর কাছে থাকি, কিন্তু তাতে ও রাজী হয় না। বিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কি গতি আছে বল? ও নাকি তাকে ভালবাসে। তুই তাকেই একটু বুঝিয়ে বল।

এরপর সত্যিই আমি সেই রেখা চ্যাটার্জির সঙ্গে গিয়ে দেখা করলাম। খুব বেশি ভূমিকা না করে বললাম, আপনি বোধ হয় দুর্ঘটনার কথা সব শুনেছেন?

মেয়েটি ঘাড় নাড়ল।

আমি বললাম, মাসিমার ইচ্ছা আপনারা তাড়াতাড়ি বিয়ে করুন।

রেখা বলল, তা হয় না।

কেন? আপনিও কি ভূতের ভয় করেন নাকি?

রেখা এবার চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল, বলল, না, ভূত নয়, ভূতে পাওয়া মানুষকে আমার ভয় সবচেয়ে বেশি।

আমার বন্ধু তার কাহিনী শেষ করল।

আমি চুপ করে রইলাম। রেখা চ্যাটার্জির কথা যে কত সত্যি, তা আমি একটু আগেই টের পেয়েছি।

বৃষ্টির জোরটা একটু কমে এলে আমি বন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিলাম। আশ্চর্য, তারপর থেকে রোজই আমার ইচ্ছা করতে লাগল, আয়নাটার একবার খোঁজ নিয়ে আসি। কিন্তু ও-পথ আমি কিছুতেই আর মাড়ালাম না। শেষে আমিও কি নিরঞ্জনের মত হব? তবু বার বার আমার কৌতূহল হতে লাগল, কি হল সেই আয়নাটার, কি হল নিরঞ্জনের।

আজকের সকালের কাগজ আমার সেই কৌতূহল মিটিয়েছে। খবর বেরিয়েছে দমদম স্টেশনে কাল সন্ধ্যায় একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। ট্রেনের তলায় কাটা পড়েছে একজন লোক। নিরঞ্জন হালদার বলে তাকে সনাক্ত করা হয়েছে। রেল পুলিশ যথারীতি তদন্ত করেছে। কেসটি আত্মহত্যা বলেই তাদের সন্দেহ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *