2 of 3

আমার দুঃখিনী বর্ণমালা

আমার দুঃখিনী বর্ণমালা

পৃথিবীর প্রায় পঁচিশ কোটি লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে, বাঙালির জন্য এটি খুব বড় গৌরব। কিন্তু বাঙালি কি নিজের ভাষা নিয়ে সত্যিই গৌরবান্বিত? যে ভাষাটিকে ভালবেসে বাহান্ন সালে রাজপথে নেমেছিল অগণন বাঙালি, যে ভাষাটির জন্য মমতা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন এনেছিল এবং যে আকাশচারী স্বপ্নটিই দীর্ঘ নমাস যুদ্ধের পর হাতের মুঠোয় এসেছিল, বাঙালি কি গৌরব করে সেই স্বপ্নময় ভাষাটির জন্য? আমার মনে হয় না। পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক করুণ, ওখানে কান পাতলে ইংরেজি, হিন্দি শোনা যায়, বাংলা নয়। যেন বাংলা অচ্ছ্যুতের ভাষা। এ ভাষায় কথা বললে জাতে ওঠা যায় না, জাতে ওঠার প্রথম শর্ত নিজের ভাষা বাংলাটি ত্যাগ করা। হায় দুর্ভাগা জাতি। একটি বাংলা রাষ্ট্র হয়েও পশ্চিমবঙ্গের অফিস-আদালত সব কিছুর কাজ ইংরেজিতে হয়, দোকাঁপাটের সাইনবোর্ড হাতেগোনা বাংলা, বাদবাকি হয় ইংরেজি নয় হিন্দি। ছেলেমেয়েরা ইংরেজি স্কুলে লেখাপড়া করছে, ইংরেজি, হিন্দি ছাড়া নাকি ভবিষ্যৎ নেই। ভালো চাকরি করতে চলে যাচ্ছে বোম্বে-ব্যাঙ্গালুরু। অবাঙালি যারা পশ্চিমবঙ্গে কাজ করতে আসে, তারা সারা জীবন ওখানে থেকে যেতে পারে এক অক্ষর বাংলা না জেনে। ভিন ভাষার চাপে পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষার প্রাণ যায়-যায়। ভাষার প্রাণটি বাঁচাতে রাস্তায় নামছেন ওখানকার কিছু সচেতন বাঙালি। আন্দোলন করেও যে খুব কিছু লাভ হয়েছে বা হচ্ছে তা আমার মনে হয় না। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা বলেন, বাংলা টিকে থাকবে বাংলাদেশেই। বাংলাদেশে বাঙালির সংখ্যা বেশি, এটি কোনও দেশের ছোট্ট দারিদ্র প্রদেশ নয় যে, বাংলা রক্ষায় কোনও অশান্তি হবে। কিন্তু বাংলাদেশেই কি বাংলা রক্ষা হচ্ছে? বাংলা ভাষাকে ভালবাসে কজন? সারা দেশে কচুরিপানার মতো গজিয়ে উঠছে ইংরেজি ইস্কুল। বাচ্চাকে ইংরেজি ইস্কুলে পড়ানোর জন্য বাবা-মা আকূল। বাচ্চার মুখে বাংলা ছড়া শোনার চেয়ে ইংরেজি রাইম শুনতে তাদের আগ্রহ বেশি। বাংলা বলতে গিয়ে অযথা কিছু ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা একধরনের বাতিক বাঙালির। ইংরেজি বলতে যে জানে, তাকেই ধারণা করা হয়, শিক্ষিত। বিদ্যা জাহির করতে গেলে ইংরেজি ছাড়া উপায় নেই বলে অধিকাংশ লোকের বিশ্বাস। তো এই যখন অবস্থা তখন কী করে বলি যে, বাঙালি গৌরব করে নিজের ভাষাটি নিয়ে? অনেকে বলে অনেক ইংরেজি শব্দের বাংলা নেই, তাই নাকি ইংরেজি শব্দের এমন যথেচ্ছ ব্যবহার। বাংলা পরিভাষিকগণ, আমি ঠিক বুঝি না কী করছেন ওই আকাদেমিতে বসে? অতলান্তিকের ওপর ছোট্ট একটি দ্বীপ, আইসল্যান্ড নাম, মাত্র তিন লক্ষ লোকের বাস, সে দেশের ভাষাটির মধ্যেও কোনও রকম ইংরেজি শব্দ ঢুকতে দেয়া হয় না। প্রযুক্তি সম্পর্কিত প্রচুর ইংরেজি শব্দ এখন দ্রুত ছড়াচ্ছে বিশ্বময়, কিন্তু আইসল্যান্ডের মতো ছোট্ট দেশটিতেও ওই সব শব্দকে শব্দান্তরিত করা হয়। ভাষাকে ভালবাসলে এই করতে হয়।

আমি ভাষার ব্যাপারে খুব সংকীর্ণ নই, এক ভাষায় অন্য ভাষার শব্দ ঢুকে ভাষাকে সমৃদ্ধ করে এ আমি মানি, কিন্তু সেই সঙ্গে নিজের ভাষারও পরিচর্যার প্রয়োজন আছে। নিজের স্বকীয়তা এবং নিজের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের জন্য, এ বিশ্বাস আমার গভীর। ইংরেজি ভাষাটি পৃথিবীর একটি বড় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ভাষা, ঔপনিবেশিকতার কারণে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ভাষাটি ভ্রমণ করেছে। কেবল ভ্রমণ নয়, এই ভাষাটি বহু জাতির ওপর চাপিয়ে দিয়ে বহু ভাষার মৃত্যু ঘটিয়েছে নির্দয় সাম্রাজ্যবাদীরা। ভাষাটি আজ সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মতো সর্বত্র অনুপ্রবেশ করছে, বৈধ এবং অবৈধ দুইরকম উপায়েই। এতে ভাঙন লাগছে পৃথিবীর অনেক ভাষায়। ভাঙন সম্ভবত আমাদের অঞ্চলেই প্রকট। ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের কথ্য ভাষা এখন জগাখিচুড়ি ছাড়া আর কিছু নয়। আমি যখন কোনও বাঙালির সঙ্গে কথা বলি, আমার বিদেশি বন্ধুরা অবাক তাকিয়ে থাকে আমার দিকে, প্রশ্ন করে, তুমি এত ইংরজি শব্দ ব্যবহার করছ কেন? যে শব্দগুলো ব্যবহার করছ, ওই শব্দগুলো কি তোমার ভাষায় নেই? তোমার ভাষা কি এমনই দরিদ্র? লজ্জায় মাথা নোয়াতে হয় আমাকে। এ লজ্জা আমার। পৃথিবীর অন্য কোনও দেশের কেউ নিজের ভাষায় যখন কথা বলে, অহেতুক কোনও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে না, এক হতদরিদ্র আমরা ছাড়া। ঔপনিবেশিক শক্তি ভারতবর্ষ থেকে বিদায় নিয়েছে, ভারতবর্ষের মানুষই কেবল আজও ধরে রেখেছে প্রভুভক্তির চিহ্ন। এই প্রভুভক্তি এমনই ভয়ংকর যে, দৈনন্দিন প্রতিটি কর্মকান্ডে আমাদের নিজস্বতা বিশেষ কিছু অবশিষ্ট থাকে না, অনুকরণপ্রিয়তা আমাদের এমনই প্রকট যে, আমাদের পোশাক, আমাদের ভাষা, আমাদের খাদ্য, আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি বিসর্জন দিতে আমাদের এতটুকু অনুতাপ হয় না। মিরা নায়ারের মনসুন ওয়েডিং ছবিটি ভারতবর্ষের মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবারের লোকেরা দিনে যদি একশোটি শব্দ উচ্চারণ করে, তার আশিটিই যে ইংরেজি, তাঁর একটি চমৎকার উদাহরণ।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমি বিভিন্ন পন্ডিত ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছি, একটিও ইংরেজি বা ভিনদেশি শব্দ না জেনে তাঁরা কেবল নিজের দেশেই পন্ডিত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত কেবল নিজের মাতৃভাষাটি জেনেই। অনেক মানুষই বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজের মেধা ও দক্ষতার কারণে বিখ্যাত হয়েছেন, অমর হয়েও রয়েছেন।

অর্থনৈতিক দারিদ্র্য বিরাজ করায় বাংলা ভাষাটি কোনও মূল্যবান ভাষা হিসেবে বিশ্বের বাজারে স্থান পায় না। জাপানি ভাষা আজ পশ্চিমি দেশের বাজারে প্রয়োজনীয়। একটি ভাষা, বড় বড় রেস্তোরাঁর মেনুতে যে ভাষাটি দ্বিতীয় স্থান দখল করে, সেটি জাপানি, বড় হোটেলে, দোকানপাটেও তাই, একজন জাপানি জানা দোভাষীকে চাকরি দেওয়া হয়। এর কারণ জাপানিরা পশ্চিমি দেশ ভ্রমণ করতে যায় অঢেল টাকা নিয়ে। বাংলা ভাষাটি বিশ্বের দ্রব্য বাজারে যদি স্থান না পায়, ক্ষতি কী, মানুষের অন্তরে তো স্থান পেতে পারে। আর সে স্থান নিশ্চিত করতে গেলে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির মান আরও উন্নত করা চাই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সত্যজিৎ রায়ের সাহিত্য ও শিল্পকর্ম অনেক বিদেশিকে বাংলা ভাষার প্রতি আকৃষ্ট করেছে, অনেকে বাংলা ভাষা শিখেছে। ফরাসি সাহিত্যে আকৃষ্ট হয়ে মূল ভাষায় ফরাসি সাহিত্য পাঠ করার জন্য পৃথিবীতে প্রচুর লোক ফরাসি ভাষা শিখছে। ইদানীং ডেনমার্কের কিছু পরিচালক তাক লাগিয়ে দেওয়া চলচ্চিত্র তৈরি করছেন বলে অনেকের আকর্ষণ ডেনিশ ভাষাটির প্রতি, ছোট্ট একটি ভাষা, মাত্র পঞ্চাশ লক্ষ লোক এ ভাষায় কথা বলে, তবুও। অন্যান্য ভাষা জানার অর্থ এই নয় যে নিজের ভাষাকে হেলা করা। হেলার ফল কখনও কোন কালেই ভাল হয় না। ভাষা নিজের পরিচয়, নিজের পরিচয়টিই যদি লজ্জাজনক হয়, তবে নিজের অস্তিত্বই একটি মস্ত লজ্জা। যত ছোট, যত দরিদ্রই নিজের ভাষা হোক, ভাষাকে ভালবাসলে নিজের কাছে নিজে তো বটেই, অন্যের কাছেও বড় হওয়া যায়। আমি বাংলাদেশে দেখছি, বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা লুকিয়ে তথাকথিত পুস্তকি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার আপ্রাণ চেষ্টা চলে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে। আমি মনে করি মুখের যে কোনোও ভাই শুদ্ধ।অশুদ্ধ ভাষা বলে কোনও ভাষা নেই পৃথিবীতে।

 জার্মানির দক্ষিণে বাভারিয়া অঞ্চলে একধরনের জার্মান বলে লোকেরা যা ঠিক জার্মান নয়। তারা নিজেদের সেই জার্মান-মিশেল ভাষাটি নিয়ে ভীষণ রকম গর্বিত। ভাষা নিয়ে গৌরব করা যদি না যায়, তবে মনে এমনই হীনম্মন্যতা বাসা বাঁধে যে মেরুদন্ড সোজা করে একজন ব্যক্তি দুপায়ে ভর করে দাঁড়াতেও কুণ্ঠিত হয়। ব্যক্তি থেকে গোষ্ঠী, গোষ্ঠী থেকে জাতি, জাতি থেকে দেশ সবই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ময়মনসিংহের বেড়ে ওঠা মেয়ে হয়েও একসময় আমি ময়মনসিংহের আঞ্চলিকতা যথাসম্ভব আড়াল করে কলকাতাইয়া উচ্চারণে বাংলা বলতে চেষ্টা করতাম, যেহেতু ওটিকে শুদ্ধ বলে মনে করা হয়। শুদ্ধের চর্চা করতে কে না চায়! কিন্তু ইউরোপে বহু বছর কাটিয়ে নিজ দেশের আঞ্চলিক ভাষার প্রতি মানুষের ভালোবাসা এবং মমতা এবং এটির সৌন্দর্য দেখার পর আমার ভেতরের সেই লুকোনো প্রবণতা সম্পূর্ণ লুপ্ত, শুদ্ধের সংজ্ঞাটিও একই রকম লুপ্ত, আমি এখন মহানন্দে খাঁটি ময়মনসিংহি ভাষায়। যে-কোনও বাঙালির সঙ্গে কথা বলি। আইলাম, খাইবাম, যাইবাম-এর অনাবিল সৌন্দর্য আমি আগে এত করে উপলব্ধি করিনি, এখন যেমন করি।

আমার রিস্টওয়াচটা খুঁইজা পাইতেছি না, একজন লোক আমারে ইনভাইট করছে, আমার তো টাইম চইলা যাবে। যে তিনটি ইংরেজি শব্দ এখানে ব্যবহার হচ্ছে, সেই তিনটি শব্দের যে কোনও বাংলা শব্দ নেই, তা নয়, আছে এবং সে শব্দগুলো যে অচল হয়ে গেছে তাও নয়, রীতিমতো সচল শব্দ, কিন্তু তারপরও ব্যবহার করা হচ্ছে না, কী কারণ এর? কোনও কারণ নেই। বাঙালির বেশির ভাগ কথা ও কাজের পেছনে অনেক সময় কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। অকারণে বিস্তর কথা বলে বাঙালি, অকারণে বিস্তর কাজও করে। রাগারাগি, দলাদলি, খুনোখুনি নানা রকম কাজ। যুক্তিহীন কাজ। ভাষার প্রতি আবেগ ফেব্রুয়ারি এলে বাঙালির মনে উথলে ওঠে, এ কথা ঠিক, কিন্তু সারা বছর ভাষাটিকে ভাল না বাসলে এক মাসের ভালবাসায় আর যার লাভ হোক, ভাষার কোনও লাভ হয় না। দেশকে না ভালবাসলে ভাষাকে ভালবাসা যায় না। আর ভাষাকে ভাল না বাসলে নিজেকে ভালবাসা যায় না, নিজেকে ভাল না বাসলে অন্যকে ভালবাসা যায় না। অন্যকে ভাল না বাসলে মানুষে-মানুষে সৌহার্দ্য ও প্রীতি যা একটি সুস্থ দেশের জন্য প্রয়োজন, তা বিনষ্ট হতে সময় নেয় না। অন্যের গোলামি করা আর অন্যকে ভালবাসা দুটো দুজিনিস।

রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করোনি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন। সেটি অন্য রকম করে বলতে ইচ্ছে হয়, বাঙালি যদি মানুষ হতে চায়, তাকে আগে বাঙালি হতে হবে। দেশ ও জাতিকে, জাতির ভাষাকে সংস্কৃতিকে ভালবেসে রফিক-সালাম বরকতের উত্তরসূরিরা, বাংলাদেশ নামের দেশটি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের দেশ হিসেবে চিরকাল যেন সম্মানিত হয়, সেরকম একটি ব্যবস্থা করবেন, এ কেবল আশা নয় আমার, স্বপ্নও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *