আমার কুরুক্ষেত্র
জীবন যখন শুকিয়ে আসে, তখন কে বর্ষণ করবেন করুণাধারা? আমি তো আর কাউকে চিনি না ঠাকুর, আপনাকেই আমি চিনি। আপনি আমার পরম ভরসা। আপনিই আমার সাহস, শক্তি। আপনিই আমাকে সংসার চিনতে শিখিয়েছেন। বলেছিলেন : “বদ্ধজীবেরা সংসারে… বদ্ধ হয়েছে, হাত-পা – বাঁধা। আবার মনে করে যে, সংসারেতেই … সুখ হবে, আর নির্ভয়ে থাকবে। জানে না যে, ওতেই মৃত্যু হবে। বদ্ধজীব যখন মরে তার পরিবার বলে, ‘তুমি তো চললে, আমার কি করে গেলে?’ আবার এমনি মায়া যে, প্রদীপটাতে বেশি সলতে জ্বললে বদ্ধজীব বলে, ‘তেল পুড়ে যাবে সলতে কমিয়ে দাও।’ এদিকে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে রয়েছে! বদ্ধজীবেরা ঈশ্বরচিন্তা করে না। যদি অবসর হয় আবোল-তাবোল ফালতো গল্প করে, নয় মিছে কাজ করে। জিজ্ঞাসা করলে বলে, আমি চুপ করে থাকতে পারি না, তাই বেড়া বাঁধছি। হয়তো সময় কাটে না দেখে তাস খেলতে আরম্ভ করে।”
আমি যা করতে পারি আপনি তা জানেন। আমার মন জানেন, আমার স্বভাব জানেন, আমার সংস্কার জানেন। আপনি আমাকে চেনেন। যা করে আমি দিনে দিনে ক্ষয় হয়ে যাব, ক্রমশই বদ্ধ হব, শেষ হওয়ার আগেই নিঃশেষ হয়ে যাব, আপনি তার প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আমি শোধরাতে না পারি, বেরোতে না পারি, অসুখটা আমার জানা গেছে। আপনাকে আমি ভালবাসি, আমার সবচেয়ে আপনজন বলে মনে করি, মনেপ্রাণে চেষ্টা করি আপনার নির্দেশিত পথে চলতে। পারি না, কারণ আমি দুর্বল। আমার রোখ নেই। আমার তেজ নেই। সেকথাও আপনি বলেছেন—সংসারী মানুষের রোখ থাকে না। বলেছেন, বড় বড় কথা বলবে, হেন করেঙ্গা তেন করেঙ্গা। কথার কোন দাম নেই। এই বললে মাছ খাওয়া ছেড়ে দিলুম, তিনদিন পরেই ফিসফ্রাই চেখে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হলো। হঠাৎ মনে হলো ভয়ঙ্কর বৈরাগ্য এসে গেছে, সংসার ছাড়লেই হয়, মন শামুকের মতো গুটিয়ে নিবৃত্তির খোলে ঢুকে গেছে, পরমেশ্বরের ঘণ্টা শুনতে পাচ্ছি, সারা শরীরে ত্যাগ চিনচিন করছে; কিন্তু সংসারত্যাগ আর হয় না ঠাকুর! সেই আপনার কথা—’দক্ষিণে কলাগাছ, উত্তরে পুঁই, একলা কালো বিড়াল, কি করব মুই!’ সংসারে ভোগ তেমন নেই, সবটাই দুর্ভোগ, তবু ঐ যে-বেড়াল যে-বাড়িতে অভ্যস্ত, সেই উঠনেই ম্যাও ম্যাও করে ঘুরবে ল্যাজ তুলে–ঝাঁটাই খাক আর লাথিই খাক।
তবু, আপনি আমার দুর্বলতা ধরিয়ে দেওয়ায় জ্ঞানপাপী হতে পেরেছি। আমার একটা লজ্জা এসেছে। বোলচাল সংযত করতে শিখেছি। আমি যে কতটা বদ্ধ, কি পরিমাণ নির্বোধ সেটা বুঝতে শিখেছি। ভিতরে একটি অবিরত সংগ্রাম চলছে, প্রবৃত্তি আর নিবৃত্তিতে। একটা ইচ্ছা জেগেছে। দেরি হলেও চেষ্টা করতে দোষ কি! বিচার তো এসেছে। সংসারকে চিনতে তো শিখেছি। ‘আমার কি করে গেলে’র দল আমাকে ঘিরে আছে। তেলপোড়ার চিন্তায় বিমর্ষ। নির্জনতায় নিজের সরে আসার কৌশল আয়ত্তে আসছে। আত্মসমর্পণের মাধুর্য আমি উপলব্ধি করতে পারছি। অহঙ্কারের ল্যাজামুড়ো কাটতে না পারলেও কিছুটা ছাঁটতে পেরেছি। আপনি আমাকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন : “সংসার যেন বিশালাক্ষীর দ, নৌকা দহে একবার পড়লে আর রক্ষা নাই। সেঁকুল কাঁটার মতো এক ছাড়ো তো আরেকটি জড়ায়। গোলকধাঁধায় একবার ঢুকলে বেরুনো মুশকিল, মানুষ যেন ঝলসা পোড়া হয়ে যায়।”
দগ্ধ মানুষের কাতর প্রার্থনায় আপনাকে সাড়া দিতেই হবে। আপনি বলেছেন, উপায় আছে। সে-উপায় হলো—সাধুসঙ্গ আর প্রার্থনা। সাধুসঙ্গ বলতে আমি বুঝি আপনার সঙ্গ। প্রার্থনা বলতে বুঝি আপনার নির্দেশ পালন। আপনি বলেছেন, সাধুসঙ্গে একটি উপকার হয়, সদসৎ বিচার আসে। সৎ কি? না নিত্য পদার্থ অর্থাৎ ঈশ্বর। অসৎ অর্থাৎ অনিত্য। এও বুঝি, অনিত্যের টান খুব বেশি। কারণ সবসময় বিচার কাজ করে না। তখন আপনি আমাকে বলে দিয়েছেন, বিচারের ডাঙশ মারতে। মন মত্তকরী। তার ওপর উপবিষ্ট বিচারক মন-মাহুতটিকে চিনতে হবে। হাতি পরের কলাগাছ খেতে গেলে, শুঁড় বাড়ালে মাহুত ডাঙশ মারে। মনের শুঁড় যেই অনিত্যের দিকে ছুটবে অমনি বিচার দিয়ে তাকে ঠেঙাবে। প্রার্থনা করবে। সাধুসঙ্গ ও সর্বদা প্রার্থনা। তাঁর কাছে কাঁদতে হবে। চোখের জল একমাত্র পথ। হম্বিতম্বি, লাফালাফি, কোস্তাকুস্তিতে কিছু হবে না। বেদ-বেদান্ত, গীতা, উপনিষদ্, ভাগবত পড়লেও কিছু হবে না। আপনার সেই ভাগবত-পাঠকের গল্পটি মনে আছে—
একজন রাজা ছিল। একটি পণ্ডিতের কাছে রাজা রোজ ভাগবত শুনত। প্রত্যহ ভাগবত পড়ার পর পণ্ডিত রাজাকে বলত, রাজা বুঝেছ? রাজাও রোজ বলত, তুমি আগে বোঝ! ভাগবতের পণ্ডিত বাড়ি গিয়ে রোজ ভাবে যে, রাজা রোজ এমন কথা বলে কেন! আমি রোজ এত করে বোঝাই আর রাজা উলটে বলে, তুমি আগে বোঝ! একি হলো! পণ্ডিতটি সাধন-ভজন করত। কিছুদিন পর তাঁর হুঁশ হলো যে, ঈশ্বরই বস্তু আর সব—গৃহ, পরিবার, ধন, জন, মানসম্ভ্রম সব অবস্তু। সংসারের সব মিথ্যা বোধ হওয়াতে সে সংসার ত্যাগ করল। যাবার সময় কেবল একজনকে বলে গেল, রাজাকে বলো যে, এখন আমি বুঝেছি।
এখানে একটি কথা পেলুম ঠাকুর—’হুঁশ’। ঈশ্বরে হুঁশ। বস্তুতে হুঁশ। অবস্তু, সংসারে বেহুঁশ। সার চিনেছি, অসারে আর মন লাগে না। কবীরদাস বলছেন :
“পানী বিচ মীন পিয়াসী,
মোহি সুনসুন আবত হাঁসী।
ঘরমেঁ বস্তু নজর নহি আবত,
বন বন ফিরত উদাসী।
আতকজ্ঞান বিনা ভাগ ঝুঁঠা
ক্যা মথুরা ক্যা কাশী।”
—মাছ তুমি জলে আছ, তাও বলছ তৃষ্ণার্ত। শুনে আমার হাসি আসছে। তোমার নিজের ঘরেই বস্তু রয়েছে, তুমি সেই বস্তুর সন্ধানে উদাসী হয়ে অরণ্যে-অরণ্যে ঘুরছ। শোন, মথুরাতেই যাও আর কাশীতেই, আত্মজ্ঞান না হলে—সব ঝুট হ্যায়। এলে আর গেলে। মাঝখানে পড়ে রইল ছেঁড়া ন্যাকড়ার মতো একটুকরো জৈব বেঁচে থাকা।
ঠাকুর সেই হুঁশটা আপনি লাগিয়ে দিয়েছেন। আপনি খুব সাঙ্ঘাতিক! আপনার কাছে এলেই রঙ ধরে যায় মনে। ভয়ঙ্কর এক চুম্বক! বইপত্র, বেদ- বিচার সব চুলোয় যাক। ব্যাকুল কান্না। কাঁদলে মনের ময়লা ধুয়ে যাবে। পরিষ্কার ছুঁচ। তখন আপনাতে চিরলগ্ন। আমার সংগ্রামের এলাকা কোটা, আমার কুরুক্ষেত্র কোথায় আপনি দেখিয়ে দিয়েছেন। মায়ার ঘেরাটোপে আমার অবস্থান। আপনি বলছেন, সেটাই স্বাভাবিক। বলছেন : “তাঁর মায়াতে বিদ্যাও আছে অবিদ্যাও আছে। অন্ধকারেরও প্রয়োজন আছে, অন্ধকার থাকলে আলোর আরো মহিমা প্রকাশ হয়। কাম, ক্রোধ, লোভ খারাপ জিনিস বটে, তবে তিনি দিয়েছেন কেন? মহৎ লোক তয়ের করবেন বলে।”
এইবার আপনি আমার প্রধান শত্রুকে দেখিয়েছেন। আপনি আমার জীবন- কুরুক্ষেত্রের সখা কৃষ্ণ। আপনি বলছেন : “পার্থ! পশ্যৈতান্ সমবেতান্ কুরূনিতি।”—কার সঙ্গে তোমার সংগ্রাম তাকিয়ে দেখ—তোমার ইন্দ্রিয়। আপনার কথা মনে পড়ছে : “ইন্দ্রিয় জয় করলে মহৎ হয়। জিতেন্দ্রিয় কি না করতে পারে!”
“জ্ঞানবিজ্ঞানতৃপ্তাত্মা কূটস্থো বিজিতেন্দ্রিয়ঃ।
যুক্ত ইত্যুচ্যুতে যোগী সমলোষ্টাশ্মকাঞ্চনঃ।।”
আপনি বললেন : “জ্ঞান-বিজ্ঞানে তৃপ্ত হও।” জ্ঞান কি? তিনি আছেন। বিশেষ জ্ঞান, বিজ্ঞান হলো, তাঁকে দেখেছি। তুমি নির্বিকার হও, জিতেন্দ্রিয় – হও। মাটি, পাথর, সোনা—সব তোমার কাছে এক বস্তু। তখন তুমি যোগারূঢ়। যোগী। তার আগে নও। তোমার সংগ্রাম বাইরের শত্রুর সঙ্গে নয়। তোমার কুরুক্ষেত্র ভিতরে। তোমার সংগ্রাম দুঃশাসন ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে।