1 of 2

আমার কান্না – মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

আমার কান্না – মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

সম্পাদকমশাই,

ছেলেবেলা থেকেই বড়দের মুখে শুনে আসছি যে, আমি ভীষণ বোকা। আর বড়রা যেহেতু নাকি গুরুজন, তাই ওই গুরুগম্ভীর গুরুজনদের অবশ্য দোষ দিই না আমি, কেননা ইস্কুলে যত পরীক্ষায় ফেল করা সম্ভব তার একটিতেও কখনও আমি পাশ করিনি। ফেল করতে-করতে আমি ছ’ফিট লম্বা হলাম, আমার গলার আওয়াজ বড়দের মতোই মোটা হয়ে উঠল, ঠোঁটের ওপরে নাকের তলায় গোঁফ গজাল, আর মাঝে-মাঝে, কোনওই কারণ নেই অথচ, খামকা বেজায় মনখারাপ হতে লাগল—ইজের-পরা বাচ্চাদের সঙ্গে এক ক্লাসে বসতে আর ভালো লাগল না—তাই একদিন কারু কোনও কথা কানে না-দিয়ে ইস্কুল ছেড়ে দিলাম।

বাবা গম্ভীর গলায় জিগ্যেস করলেন, যেহেতু তাঁরই নাকি সবচেয়ে গুরুদায়িত্ব, ‘এখন তবে কী করবে ভাবছ?’

কিছু না-ভেবেই ধাঁ করে আমি জবাব দিলাম, ‘ব্যবসা করব।’

তারপর তো, আপনি জানেন, বাবার দেওয়া সামান্য মূলধন নিয়ে আমি যখন ব্যবসা চিনতে শিখেছি, ঠিক তখনই লাগল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, এবং বলা বাহুল্য, কী করে যে আমি ভাগ্যের ঘোড়াকে জোর কদমে একরকম লাফাতে-লাফাতে এগিয়ে নিয়ে চলেছি, তা আপনার আর অজানা নয়। এখন আমার যা রোজগার, আমার বয়েসের কোনও বি.এ.-এম.এ. পাশ ছেলেও তা ভাবতে পারে না। বেশ একটু মোটাসোটা আর ভারিক্কি হয়েছি। আমার সঙ্গে-সঙ্গে বাড়ির চেহারাও ফিরেছে, চালচলনই এখন আলাদা, মণীশের কথায় বলতে গেলে ‘রীতিমতো ফাটাফাটি ব্যাপার’, আর এ-কথাও আপনি জানেন যে, বাড়ির লোকেরা এখন আমার সম্বন্ধে যা বলে তা শুনতে মোটেই খারাপ লাগে না। গুরুজনদের কথার তালেও বেশ একটা লঘু সুর এসেছে আজকাল।

কিন্তু বড়-সম্প্রতি আমি এক বিষম বিপদে পড়েছি। এবং সেই কারণেই আপনাকে সমস্ত খবর জানিয়ে এই চিঠি দিচ্ছি। কী-যে করা কর্তব্য আমার, আপনি তা জানালে, মিথ্যে বলছি না জানবেন, আমার প্রাণ বাঁচবে। আপনার হয়তো হেঁয়ালির মতো মনে হচ্ছে, তাই পুরো ব্যাপারটা খুলেই বলি।

অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, আমি ঠিকানা পালটেছি। আরও স্পষ্ট করে বলাই ভালো—আমি এখন আর কলকাতায় নেই। ঠিকানাটা আমার জানানো উচিত, এ-কথা অস্বীকার করি না, কিন্তু আমার এখানকার বাসস্থান পাঁচকান হলে আমাকে আর এই ধরাধামে আপনারা কেউ দেখবেন না। একটা প্যাঁচা কিংবা সোনালি চিল হয়ে হয়তো আপনাদের আশপাশে ঘুরব, আপনারা আমাকে চিনতেই পারবেন না।

আমি কী বলছি, তা বোধহয় এখনও আপনার কাছে স্পষ্ট হয়নি। হয়তো বুঝতে পারছেন না আমার কথা। যদি বুঝতে চান, তবে আসুন একবার আমার সঙ্গে আমার মাসতুতো ভাই মণীশের কাছে। আপনারা হয়তো মণীশকে চেনেন না, সে-ও আপনাদের কাউকে চেনে বলে মনে হয় না। কিন্তু মণীশ পৃথিবীর সমস্ত পাখিদের চেনে। আর পাখিরাও নাকি মণীশকে চেনে। এই বিষয়টিই, অতি সংক্ষেপে বলতে গেলে, হয়েছে আমার অতর্কিতে এমনিভাবে উধাও হয়ে যাওয়ার আসল কারণ।

গোটা ব্যাপারটা খুলে বলার আগে মণীশের একটু পরিচয় দিয়ে নেওয়া ভালো। মণীশের বয়েস আমারই মতো এবং আমার মাসতুতো ভাই হলেও আপনার হয়তো অবাক লাগবে শুনে যদি বলি পড়াশোনায় ও চিরকালই দুর্দান্ত ভালো। পরীক্ষায় কখনও ওকে দ্বিতীয় হতে দেখিনি। আমাদের বাড়ির সকলেই চিরকালই ওকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত। ছেলেবেলায় তো যখন-তখন ওকে উদাহরণ হিসেবে জাহির করে আমাকে যা-তা কথা বলত আমার গুরুজনেরা। এ-হেন যে মণীশ, সে সম্প্রতি ডাক্তারি পাশ করে মাসকয়েক হল ডাক্তারখানা খুলে বসেছে। প্রথম-প্রথম উৎসাহ থাকলেও মাসতিনেকের মধ্যে যখন একটিও রুগি ওর হাতে মরতে এল না, তখন থেকেই ওর উৎসাহে ভাটা পড়তে শুরু করেছিল। ও অবশ্য নিজের পাড়ায় ডাক্তারখানা খুলে বসেনি, কেননা ও তো আর আমার মতো বোকা নয় এবং ওর চোখ-কানও চিরকাল খোলামেলা থাকে। ও তো জানে যে, গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না। যদি-বা পায় কখনও-সখনও সে-ভিক্ষায় পুষ্টির চাইতে বিষই বেশি থাকে। দু-বেলা ক্ষিতীশের অবস্থা দেখেছে তো! ক্ষিতীশ মণীশের আগে ডাক্তারি পাশ করেছে, পাড়াতেই ডাক্তারখানা খুলেছে। রুগি আসে তার বেশ, কিন্তু টাকা আসে না, পকেট থাকে গড়ের মাঠ। অমুক-জেঠা ডেকে নিয়ে যান ব্যস্তসমস্ত হয়ে, ‘শিগগির চলো একবার, ক্ষিতীশ, তোমার জেঠাইমার শরীর বড় খারাপ।’ রুগি দেখা হয়, ওষুধ দেওয়া হয় রীতিমতো। আর অমুক-জেঠা পিঠ থাবড়ে বলেন, ‘তুমি তো আমার ছেলের মতো। হেঁ-হেঁ-হেঁ, তোমার বাবা আমার প্রাণের বন্ধু ছিল হে, একেবারে হরিহর-আত্মা।’ ক্ষিতীশ শূন্য পকেটে হাত ঢুকিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। এবং ক্ষিতীশের এ-হেন বিচ্ছিরি হাল দেখেই পাড়া থেকে অনেক দূরে ডাক্তারখানা খুলল মণীশ, বড়সড় রংচঙে এক সাইনবোর্ড দিব্যি উৎসাহে টাঙাল, কিন্তু তবু তার রুগি আর আসে না। সকালে খবরকাগজ পড়ে, পথের দিকে হাঁ করে চেয়ে বসে থাকে। এই নিয়মমাফিক চলেছে গত তিন-তিনটে মাস। কিন্তু তারপরও যখন কোনও রুগিই এল না, তখন ‘ধুত্তোর ছাই’ বলে বাড়িতেই প্রায়দিনই বসে-বসে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে তাস পেটে বা আড্ডা মারে সবসময়, আর ফাঁক পেলেই আমাকে পক্ষী-চরিত্র সম্পর্কে জ্ঞান দান করে।

মণীশ আজকাল আমাকে প্রায়ই বলে, মানুষের আত্মা অমর। আর মানুষ মরলেই পাখি হয়ে বেঁচে ওঠে। প্রত্যেকটি পাখিই আসলে একেকজন ফউৎ-হওয়া মানুষ।

বেড়াতে-বেড়াতে হঠাৎ একদিন বলে ওঠে, ‘দ্যাখ-দ্যাখ, ওই, পাখিটাকে দ্যাখ। আহা-হা, তাড়িয়ে দিস না, নমস্কার কর,’ বলতে-বলতে নিজেই নমস্কার করে।

আমি হাঁদার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকাই ওর দিকে, আর শুধোই, ‘কেন? খামকা একটা পাখিকে সেলাম ঠুকতে যাব কেন?’

বিরক্ত গলায় মণীশ উত্তর দেয়, ‘তোর মতো উজবুক আর দ্বিতীয় দেখিনি। উনি আর-জন্মে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন।’

প্রথম-প্রথম, সত্যি বলছি সম্পাদকমশাই—ওর এই অদ্ভুত ধরনের পাগলামিতে হাসতুম, আর আদ্ধেক কথাই বিশ্বাস করতুম না, এবং ভাবতুম গল্প লিখতে জানলে কোনও পত্রিকায় ওর কথা লিখে পাঠানো যায় ‘বিচিত্র এক বাতিক’ এই শিরোনামায়। মণীশ অবশ্য চুপ করে থাকত, কোনও কথা বলত না। ছাদে দাঁড়িয়ে চুপ করে একদৃষ্টে পাখিদের দিকে তাকিয়ে থাকত, আর নীচের চলমান জনস্রোতের দিকে তাকিয়ে ভাবত, ওদের মধ্যে কে আবার ওই বিশাল খোলা আকাশের প্রজা হয়ে তার হৃদয় অধিকার করবে!

বুঝতে পারছি আপনি হাসছেন, হয়তো ভাবছেন, লোকটা আগে শুধু গাড়ল ছিল, এখন আবার পাগলও হল। বিশ্বাস করুন, যদি আমার কথা মিথ্যে হত তবে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি খুশি আমিই হতুম এবং আমিই হো-হো করে অট্টহাসি হেসে উঠতুম।

সেদিন বিকেলবেলা আমি আর মণীশ ছাদের ওপরে বসে চা খাচ্ছি, হঠাৎ মণীশের বুক ঠেলে একটা বেজায় করুণ দীর্ঘশ্বাস বেরুল, ‘আহা!’

ওর মুখের দিকে তাকাতেই একটা শালিখ দেখিয়ে বললে, ‘বেচারির বড় কষ্ট, আহা, একা-একা ঘুরে বেড়াচ্ছে! সঙ্গী-সাথী কিচ্ছু নেই বেচারার!’

আমার ভয়ানক হাসি পেল, কিন্তু তা সত্ত্বেও হাসি চাপবার ব্যর্থ চেষ্টা করে জীবনানন্দ দাশ আওড়ালাম, ‘এ-জীবনে আমি ঢের শালিখ দেখেছি, তবু সেই তিনজন শালিখ কোথায়?’

মণীশ ভীষণ রেগে গিয়ে বিদঘুটে মুখ করে বলল, ‘ঠাট্টা করছিস!’ তারপর আবার গম্ভীরভাবে বসে থাকল, ওর সামনে চায়ের পেয়ালার সোনালি চায়ে উষ্ণ ধোঁয়া মিলিয়ে গিয়ে চায়ের ওপর সরের মতো একটা পাতলা পরদা পড়ল। তারপর হঠাৎ মুখ-চোখ ঝকমকিয়ে উঠল ওর, বলল, ‘আচ্ছা, সত্যনারায়ণবাবু তো বড় একা-একা থাকেন, না? ওঁরও তো তিনকুলে কেউ নেই।’

আমি মাথা নাড়তেই বলল, ‘ওঁরও তো তবে ভয়ানক কষ্ট। আহা, বেচারি!’ তারপর এক চুমুকে সেই ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চা নিঃশেষ করে বললে, ‘আচ্ছা, আমি একটু সিনেমা দেখে আসি। ”শহর থেকে দূরে” ছবিটা নাকি তোফা হয়েছে!’

মণীশ চলে গেল। রাত্রে কখন বাড়ি ফিরেছে জানিনে, কেননা রাত্রে ওর সঙ্গে আমার দেখাই হয়নি। সকালবেলায় খবরকাগজ খুলেই চমকে উঠলুম। লেখা আছে, বিখ্যাত স্বদেশী নেতা সত্যনারায়ণ লাহিড়ীর রহস্যজনক মৃত্যু। মণীশকে কাগজটা দেখালুম। প্রথমটা ভয়ানক গম্ভীর হয়ে গেল ও, তারপর বলল, ‘চল তো, একটু ছাদ থেকে ঘুরে আসি।’

ছাদে গিয়ে দেখি, আজ বসে আছে একটি না—দুটি শালিখ। আমাদের দেখে একটা শালিখ ভয়ে উড়ে গেল, আর-একটা আনন্দে চিৎকার করতে-করতে তার পিছু নিল।

মণীশ হাসিখুশি গলায় বললে, ‘দেখেছিস শালিখটার কী আনন্দ? আগে একটা একাচোরা গোছের শালিখ কীরকম মনমরা হয়ে থাকত।’

শুনে প্রথমটা আমার বুকের রক্ত কীরকম যেন ছলকে উঠল। আমি ইচ্ছে করেই শালিখদের থেকে চোখ ফিরিয়ে আনলুম। অন্যদিকে তখন কত-কত পায়রা বুক ফুলিয়ে বকবকম করছে। দেখতে পেলুম, আমাদের বাড়ির সামনের দিকে গম্বুজের মতো করা, তাতে খোপ-খোপ আছে, পায়রারা তার মধ্যে থেকে যাওয়া-আসা করছে। চারদিকে একটা পায়রা-পায়রা গন্ধ। ওপরে আকাশে একঝাঁক পায়রা দেখা গেল। শুনতে পেলুম, ওরা নানান সুরে কখনও রেগে চেঁচিয়ে, কখনও নরম সুরে ফুসলিয়ে আমাকে ডাকছে।

আমি সে-ডাকের কাছ থেকে যত দূরে পারি সরে গিয়ে একেবারে খোপওয়ালা গম্বুজের পাশে এসে দাঁড়ালুম। কতগুলো কচি-কচি লালমুখো পায়রার ছানা আমাকে অবাক হয়ে দেখছে, আর তাদের মায়েরা চ্যাঁ-চ্যাঁ লাগিয়ে দিয়েছে। সারি-সারি খোপে অনেক পায়রার বাসা। চারদিকে পায়রার পালক, পায়ের নীচে পায়রার পালকের নরম গালচে তৈরি হয়েছে। আর কেমন একটা বিচ্ছিরি গন্ধ আছে—পায়রার গুয়ের।

হঠাৎ তাকিয়ে দেখি, সব খোপে পায়রার বাসা, কেবল এককোণে দুটি খোপ ছাড়া। মণীশও আমার মতো ওই খালি খোপদুটির দিকে তাকিয়েছিল। ওর চোখে চোখ পড়তেই বললে, ‘বাড়িতে এত পাখি, কিন্তু দুটো চড়ুই না-হলে ভালো দেখায় না।’

সেই দিনই মণীশ গেল গঙ্গায় স্নান করতে। বাড়িতে ফিরে এসে বললে, ‘দেখেছিস, কী সুন্দর দুটো চড়ুই!’

জিগ্যেস করলুম, ‘কিনলি বুঝি?’

ও জবাব দিলে, ‘না, এমনিই উড়ে এসে বসেছে।’

পরদিন খবরকাগজে দেখি, ‘গঙ্গাবক্ষে দুইটি বালক-বালিকার আকস্মিক জলনিমগ্ন হইয়া মৃত্যু’। মণীশের গঙ্গাস্নান, দুটি বালক-বালিকার অপঘাত মৃত্যু এবং তারপরেই দুটো চড়ুই—নাঃ, এ যে বড়ই ভাবনার কথা! ব্যাপার খুব সহজ ঠেকল না আমার চোখে।

এখন কেন যেন মণীশকে দেখলেই একটু ভয়-ভয় করে। ও আবার এখন মাঝে-মাঝে আমাকে নিয়ে বেড়াতে যেতে চায়, কিন্তু আমার সাহসে কুলোয় না। হাঁদা হলেও এটুকু বেশ বুঝতে পারি, পাখিদের জন্যে সমবেদনায় মণীশের প্রাণ অভিভূত হয়ে ওঠার পরেই কোনো-না-কোনো রহস্যজনক দুর্ঘটনার সংবাদ পাওয়া যায় এবং তাদের সঙ্গে মণীশের যোগাযোগ, প্রত্যক্ষভাবে যদি না-ও বা হয়, পরোক্ষভাবে একটু-না-একটু থাকেই—এ-সন্দেহ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা ভারী কঠিন হয়ে ওঠে।

তারপর একদিন দেখা গেল, আমাদের অত-জোড়া পায়রার মধ্যে একটি মারা গেছে। এবং বিজোড় হওয়ার দরুন একটি পায়রাকে খুব আকুলি-বিকুলি করে ডানা ঝাপটাতেও দেখা গেল। অবশ্য সত্যি-বলতে-কী, আমি পায়রা-চরিত্র কিছুই বুঝি না। কোথাকার কোন নূহ বন্যার সময় পায়রা উড়িয়েছিল, তাদের জাতভাই ঘুঘুরা চড়ে বেড়ায় কারু-কারু ভিটেয়, কোন কবি নাকি সব প্লাবনের মধ্যেই একটি মাত্র পায়রাকে শোনেন—এসব উটকো অসংলগ্ন কথা ছাড়া কিছুই আমার জানা নেই পায়রাদের বিষয়ে। মণীশই আমাকে বার্তাটা দিলে, বললে, ‘দেখেছিস, ওই পায়রাটার কী কষ্ট!’

সঙ্গে-সঙ্গে আমার শরীরের ভেতর দিয়ে রক্ত-চলাচল যেন বন্ধ হয়ে গেল। কাল খবরকাগজে কী দেখব ভাবতেও শিউরে উঠলুম। যেমন ভাবেই হোক, আজ আর মণীশকে বাইরে বেরুতে দেব না।

সন্ধের মুখোমুখি মণীশকে বাইরে যেতে দেখে বললুম, ‘মণীশ, আজ আর বাইরে যাসনি। আয়, লোক জোগাড় করে ব্রিজ খেলতে বসি।’

মণীশ বললে, ‘আজ যে একটু বাইরে না-গেলেই চলবে না।’ এবং আমাকে আর কোনও কথা বলার সুযোগ পর্যন্ত দিলে না ও, সাঁ করে চলে গেল—চলে গেল নয়, কেটেই পড়ল বলা যায়।

পরদিন খবরকাগজে প্রকাশ বিখ্যাত দানবীর শিশিরকুমার ভট্টাচার্যর রহস্যজনক আত্মহত্যা। ছুটে গেলাম ছাদে—দেখি আর-একটা নতুন পায়রা কোত্থেকে উড়ে এসে ওই পায়রাদের সঙ্গে জুটেছে।

ভাবলুম এভাবে আর থাকা উচিত না, এর একটা প্রতিকার করতেই হবে। পুলিশকে একটা খবর দেওয়া উচিত—অন্তত আরও পাঁচজন নির্ভয়ে বাঁচুক, শান্তিতে থাকুক। জামা পরে বেরুতে যাব, দেখি মণীশ বাড়ি ঢুকল। একটা বাচ্চা পাখি দেখিয়ে বললে, ‘একটা প্যাঁচার বাচ্চা। আহা, এর মা মরে গেছে! একে দেখার জন্যে একটা বড়ো ধাড়িমতো প্যাঁচা না-পেলে এর বড় কষ্ট হবে।’

তারপরেই আমার দিকে তাকিয়ে বললে, ‘তোর তো দোকান আজ বন্ধ। রোববার না!’ আমি মাথা নাড়তেই বললে, ‘তুই বড় ঘরকুনো, বড় একা-একা থাকিস। এত একা-একা থাকা মোটেই ভালো দেখায় না। আহা, প্যাঁচাটাও বড্ড একা—।’

কী যেন বলবার চেষ্টা করলুম, কিন্তু গলা দিয়ে একটা কথাও বের হল না, আতঙ্কে চোখদুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে এল। ভয়ে, অস্বস্তিতে এই শীতের দিনেও সারা শরীর ঘামে ভিজে গেল। এবার ওই প্যাঁচার সঙ্গী আর-একটি প্যাঁচা হতে কি আমাকে এই সাধের মনুষ্যজীবন ছেড়ে যেতে হবে? বিশেষত ঠিক যখন আমি ব্যবসায় দেদার পয়সা লুটছি! পুলিশে খবর দেওয়ার সাহসও হল না। একটু সময় নষ্ট করলেই হয়তো একটা বিপত্তি হয়ে যাবে। সোজা ছুটলুম স্টেশনে, তারপর এখানে।

এখানকার ঠিকানা আপনাকে আর দিলুম না। দয়া করে খবরকাগজ ভালো করে পড়বেন। প্যাঁচার সঙ্গী হওয়ার মতো অন্য লোক না-পেলে মণীশ নিজেই হয়তো আত্মহত্যা করে বসতে পারে—অন্তত এইটেই আমি বিশ্বাস করি। ওই খবরটা কাগজে বেরুলেই আপনাদের কাগজে প্রকাশ করবেন। এখন এই মফস্বলে ছোট্ট স্টেশনের ওয়েটিংরুমে বসে চিঠি লিখতে-লিখতে জানলা দিয়ে সামনের হুইলারের স্টল দেখতে পাচ্ছি, সেখানে না কি আপনাদের মাসিক পত্রিকাটি নিয়মিত আসে।

প্রীতি ইত্যাদি। আশা করি, আপনারা সকলে কুশলেই আছেন। ইতি—।*

* সূর্য মিত্র ছদ্মনামে প্রকাশিত

মাসিক রোমাঞ্চ

মার্চ-এপ্রিল, ১৯৫৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *