আমার এখনও অনেক দেওয়ার আছে,ফুরোয়নি সব
তখন-এখন
অনেক কিছু ভেবেছিলাম,
ইচ্ছে ছিল, এই জীবনে ভালো
অনেক বাসব বলে,
ভেবেছিলাম,
থাকব অনেক ভালো ভালো বাসায়
নদীতীরে, বনের ধারে, পাহাড়চূড়ে
বিশ্বজুড়ে,
মনের মতো সঙ্গিনীদের দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে।
ভেবেছিলাম, অনেক-রঙা
ফুল ফোটাব উঁচু-নীচু বাগান করে
নানা-রঙা আবির গুলাল উড়িয়ে দেব
আমার নানান আকাশ ভরে।
মনের মতো সঙ্গিনীদের জড়িয়ে ধরে।
ভেবেছিলাম, অর্কিডের বাহার হবে
নানা রঙের,
নানা নরম জরায়ুতে
বড়ো-আদর করব যখন, পুলকভরে,
হাজার মরণ মরব আমি
তূণ-ভরানো ভুরুর তিরে,
ভেবেছিলাম।
ভেবেছিলাম, বেলা এবং অবেলাতে ধুলোপায়ে,
মেলা থেকে মেলায় যাব,
যাব আলোকঝারির সাতবোশেখির মেলায়।
সেই শেষ গেছিলাম কবে যেন,
ভুলেই গেছি,
প্রথম যৌবনে।
সব মেলাতে ঘুরব আমি মনে মনে।
হাজার পায়ে নূপুর হয়ে বাজব
আমি,
ভেবেছিলাম,
গান গাইব গানের মতো
হাজার হৃদয় ছিঁড়ে-খুঁড়ে
ঠোঁট ছোঁয়াব নানা-রঙা হাজার স্তনে।
ভেবেছিলাম,
হাজার মরণ মরব আমি
তূণ-ভরানো ভুরুর তিরে।
ভেবেছিলাম।
এখন আমার দিন ফুরোল
সব কামনা ঝরে গেল একে একে
চৈত্রদিনের হরজাই-রং পাতার মতো,
ঝুপড়ি ঝুপড়ি ছায়ারা সব দীর্ঘ হল
শীর্ণ নদী উড়াল হল এঁকে বেঁকে,
চমকে উঠে হঠাৎ দেখি,
ডাক পড়েছে, ডাক পড়েছে
কুয়াশাময় সাঁঝবেলাতে
ছায়ায় মোড়া অন্য পারে।
ভাবনাগুলো ধুলোয় লুটোয়
দিকদিশা সব ঠাহর না হয়,
শুকনো ফুলের গালচে জুড়ে
ফিসফিসিয়ে পড়ল ঝরে
গান ভেসে যায় শিহর তুলে, দূরে দূরে
পুরবির কাঁদন সুরে।
ডাক পড়েছে, ডাক পড়েছে সাঁঝবেলাতে
কুয়াশাময় অচিনপুরের সেই দুয়ারে
খেলাধুলো সাঙ্গ হল
কামনাফুল ধুলোয় পড়ে
অনেকই দিন কেটে গেল
আসল বাড়ি যাওয়ার কথা
ছিলেম ভুলে।
গাঢ় সবুজ খড়কে-ডুরে শাড়ি
আর লাল ব্লাউজ পরে
অচিন গাঁয়ের গৃহবধূ
ধান নিয়ে তার কুলোয়,
দিনশেষের নরম আলোয়
‘চই-চই-চই’ ধ্বনি তুলে,
সেই সোনা ধান বিলোয়,
সোঁদর-বধূর ঘামে-ভেজা বগলতলির
গন্ধ ওড়ে শেষবেলাতে।
এবারে অনেক দূরের আসল বাড়ি যেতেই হবে
এই রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ ফেলে
খেলাধুলোয় অনেকদিনই ছিলেম ভুলে।
গাঢ় সবুজ খড়কে-ডুরে শাড়ি
লাল ব্লাউজ আর সিঁদুরে টিপ পরে
অচিন গাঁয়ের গৃহবধূ,
জলজ গন্ধ-ভরা পুকুর-ছাড়া হাঁস-হাঁসিদের
ঘরে ফেরার ডাক দিয়েছে
‘চই-চই-চই’ ধ্বনি তুলে।
তার ঘামে-ভেজা বগলতলির গন্ধ তুলে,
শেষবেলাতে।
অনেকই দিন কেটে গেল
আসল বাড়ি যাওয়ার কথা
খেলাধুলোয় ছিলেম ভুলে।
পাঠক-পাঠিকাদের জন্যই আমাকে বাঁচতে হবে….
লিখতে হবে। লেখকের কোনো রিটায়ারমেন্ট নেই।
অনেকদিন পর আবার আপনি কবিতা লিখলেন। আপনার প্রথম বই-ই কবিতার। ১৯৫৭-তে প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে ছিল গোটা দশেক কবিতা। প্রচ্ছদ-শিল্পী ছিলেন শ্যামল দত্তরায়। আপনি নিজেই বলেছেন, সে-সময় এক গায়িকার প্রেমে পড়েছিলেন আপনি… তাকে নিয়েই লেখা সেসব কবিতা—এখন কবিতা লিখতে ইচ্ছে হয়?
কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে। খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু কবিতা লেখা কি অত সোজা কাজ? একটা কবিতা লিখতে হয়তো আমার তিন দিন লাগবে। এখন অত সময় কই? এত ঘুরে বেড়াব অ-কাজে, ফিতে কাটব ঘন ঘন, সভা-সমিতিতে যাব, উদবোধন করব—তো লিখব কখন?
কবিতা লেখা সাধনার জিনিস, ভালোবাসার জিনিস। কবিতা লেখা কখনো আমি শিখিনি। এক সময় অন্ত্যমিল দিয়ে কবিতা লিখতাম। কতরকমের ছন্দ হয়—এখন কবিতা কতরকমের লেখা হয়।
আপনার গদ্য লেখায়, কবিতা যে বসে থাকে….
অনেকে বলেন, আমার গদ্যে কবিতা নি:শব্দে রয়েছে। কবিতা সত্যিই সিরিয়াস জিনিস। অনেকে বললেও আমি বুঝি না আমার গদ্যের অন্তঃপুরে কবিতা রয়েছে। কবিতা লিখেছি আনন্দের জন্য, এখনও সেজন্যই হয়তো কবিতা লিখতে ইচ্ছে হয়।
লেখা হচ্ছে কি হচ্ছে না—সেটা ক্রিটিকরা বলবেন। যে সৃষ্টি করে সে সৃষ্টির আনন্দের দাবিদার। খুব ভেবেচিন্তে যাঁরা কাজ করেন, লেখেন অনেক কিছুই, তাঁরা কিন্তু লেখক নন। অঙ্ক কষে লেখক হওয়া যায় না—বই বিক্রির জন্য যা-ইচ্ছে তা-ই করলাম, পাঠক কী ‘খাবে’ তা ভেবে নিয়ে কলম চালিয়ে দিলাম—এসব তেলেভাজার মতো। আমি অন্য পথের লেখক—আমার যা লিখতে ইচ্ছে করে আমি তাই-ই লিখেছি, তা-ই লিখি। পাঠকদের চাহিদার দিকে তাকিয়ে লিখিনি। ফরমায়েশের লেখাও নয়। চাহিদা মেনে একটা বইও লিখেছি তা মনে পড়ে না। আই অ্যাম ফরচুনেট এনাফ যে, যা লিখি তা-ই পাঠক-সাধারণের ভালো লাগে। চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর লিখেছি—আমার নিজস্ব কোনো গুণ বা কৃতিত্ব এতে নেই। কলমে সরস্বতী ভর না করলে কিছুই হত না হয়তো।
কবিতা নিয়মিত লিখলেন না কেন?
সময় পাইনি। নিরন্তর গদ্য লেখার চাপ থাকায় এবং পেশার কাজেও অত্যন্ত ব্যস্ত থাকায় হয়ে ওঠেনি।
কবিতা লেখার যোগ্যতা আমার নেই। আমি তো অ্যাকাউন্টেন্ট। কোনোদিনও সাহিত্যর ছাত্র ছিলাম না—ছন্দজ্ঞানও আমার নেই। তাই ভয়েই লিখিনি। অন্য লেখকদের লেখা পড়ে বাংলা ভাষা-সাহিত্যে জ্ঞান অর্জন করেছি। আমার সমসাময়িক লেখকদের বেশিরভাগই এম এ পড়েছেন বাংলায়। গানের বেলাতেও তাই—গ্রামার মেনে শিখিনি। সব কিছুর জন্য গ্রামার অসহ্য মনে হয়। তবে এখন ছবি আঁকার ইচ্ছেরই মতো কবিতা লেখার ইচ্ছেও মাঝে মাঝেই জেগে ওঠে বই কী।
আপনার সমসাময়িক লেখকদের তুলনায় কোনো জায়গায় কি আপনি নিজেকে বঞ্চিতমনে করেন?
আমি বঞ্চিত, কারণ আমাকে তাঁদের তুলনাতে অনেক কম সুযোগ দেওয়া হয়েছে। একমাত্র ব্যতিক্রম রমাপদ চৌধুরী। তিনিই আমাকে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন কিন্তু তৎকালীন সাহিত্যজগতের সম্রাট সাগরময় ঘোষ আমার সঙ্গে শত্রুর মতো আচরণ করে এসেছেন। একটি প্রথম শ্রেণির সংবাদপত্রের মালিকপক্ষ, অধিকাংশ সংবাদপত্রের মালিকদেরই মতো সাহিত্যের কিছুই বোঝেন না, নিজেদের সর্বজ্ঞ ভাবলেও, একথা এক-শো ভাগ সত্যি।
তবে তাতে আমার কোনো ক্ষতি হয়নি। তাঁরা এবং নানা পুরস্কারদাতারা আমাকে পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করেছেন, একথা সত্যি কিন্তু পাঠক-পাঠিকার হৃদয়ের দুর্লভ পুরস্কার থেকে তো বঞ্চিত করতে পারেননি। আর সেই পুরস্কারই তো আসল পুরস্কার।
আমি নিজেকে বঞ্চিত বলে মনে করি না সেইজন্যেই।
ছবি আঁকা আপনাকে কতটা শান্তি দেয়—সুধীর মৈত্র, বিকাশ বা সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায় সম্পর্কে আপনি ইতিমধ্যেই কিছু কথা বলেছেন—কোন কোন চিত্রকর আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছেন?
সুব্রত, বিকাশের ছাত্র, বিকাশ আবার সুধীর মৈত্রর ছাত্র ছিলেন। সুধীরবাবুর ছবির প্রতি আমার বিশেষ দুর্বলতা ছিল এবং থাকবে। রবিবাসরীয়তে আমার প্রথম গল্পটি থেকে শুরু করে আমার অগণ্য উপন্যাসের প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেছেন উনি। বিকাশ তো কখনো এসব কাজ করেননি তিনি চিরদিন ফাইন-আর্টস নিয়েই থেকেছেন। সুব্রত খুব ভালো শিল্পী।
ছবি আঁকার ব্যাপারে আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, গোপাল ঘোষ, ইন্দ্র দুগার প্রমুখ। আমি তো কখনো ছবি আঁকা শিখিনি—শিখতে পারলে ভালো হত। আক্ষেপ হয় এখন। এখন ছবি আঁকতেই সবচেয়ে ভালো লাগে অথচ এ ব্যাপারে আমি আনপড়।
ইদানীং আপনি ছবি আঁকছেন খুব। প্রচ্ছদও করেছেন বেশ কিছু। নিজের উপন্যাস (গামহারডুংরী) যেটি ‘সময়’ শারদীয়ায় প্রকাশিত হয় তার ছবিও আপনি নিজেই এঁকেছিলেন। একাধারে লেখা, গান, ছবি আঁকা—এত কিছু করেন কীভাবে?
একটার সঙ্গে আর একটা জড়িত। একটা সময় ছিল—যিনি লেখেন, তিনি গান শুনতেও ভালোবাসবেন। গাইতে পারলে তো আরও ভালো। তিনি ছবি দেখতে পারেন, ছবি ভালোবাসেন তবে আঁকতে পারলে তো আরও ভালো। এই প্রজন্মেই দেখা যাচ্ছে প্রথম যে, ‘সারস্বত সাধনা’ একটা অর্থ রোজগারের রাস্তা, একটা জীবিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে, এই জীবিকার মধ্যে কোনো সম্মান নেই; একজন রিকশাওয়ালাও জীবন অতিবাহিত করে রিকশা চালিয়ে, ঠেলাওয়ালাও করে। তাদের জীবিকা, কোনো দিক দিয়ে শুধুমাত্র লেখা যাদের জীবিকা তাদের চেয়ে নীচ নয়। নন্দনতত্ত্বে সৃজনশীলতায় কোনো একটি ধারাই আশ্রয় করে কেউ বেঁচে থাকবে এমন কথা বলা নেই।
যাঁরা সত্যিই সৃজনশীল মানুষ তাঁরা চিরদিনই সৃজনের সমস্ত দিকের প্রতি আকৃষ্ট তো ছিলেনই, তাঁদের অল্পবিস্তর পারদর্শিতাও ছিল, কারণ এই সৃষ্টিশীলতা একে অন্যের পরিপূরক এবং অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
আমি লিখি বলে আমি গান গাইব না, ছবি আঁকব না—তাহলে বলতে হবে আমার সৃষ্টিশীলতা অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। আমি ভালো গান গাই কি ভালো আঁকি সেটা অন্য কথা। আমি ভালো লেখক হওয়ার পর আমার এখন অবাক লাগে, এযুগের লেখকরা শুধু লেখেন; গানে কোনো উৎসাহ নেই—ছবিতে কোনো উৎসাহ নেই। দু-একজন দেখাবার জন্যে, দেখানোয় উৎসাহ আছে বলে—তবে অধিকাংশরই নেই। এ কেন হবে? যিনি সরস্বতীর পূজারি, সারস্বত সাধনা করেন তিনি একটা কোনো সাধনা করে ফুরিয়ে যাবেন কেন?
কখনো গান লেখার চেষ্টা করেছেন?
হ্যাঁ করেছি। গেয়েওছি। ক্যালকাটা ক্লাবে। মেম্বাররা বলল, ‘অ্যান্টনি কবিয়াল’-এ ভোলা ময়রার ভূমিকায় অভিনয় করতে হবে। করেছিলাম।
ও-পাড়ায় গিয়ে দেখে এলাম।
একটি ডাগর কালো মেয়ে।
জানলা খুলে বসে আছে, নাগর আসার পথ চেয়ে…..
পাতলা তাহার ঠোঁট দু-খানি
রাঙিয়ে নেছে পানটি খেয়ে
ইচ্ছে করে স্বর্গে যেতে শরমরাঙা বুক বেয়ে….
পাড়া মানে ওই ‘পাড়া’। এটা ভোলা ময়রার গান। আমাকে বলল, তুমি এত ভালো টপ্পা গাও…. একটা টপ্পা যোগ করো। আমি বললাম, ভোলা ময়রা টপ্পা গাইত নাকি? নিজে তখন গান লিখে টপ্পার মতো গাইলাম লোকে ভাবেন নিধুবাবুর গান—আসলে ওটা আমারই লেখা।
তার মানে, আপনি অভিনয় করতেও সমান উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন?
অভিনয় করেছি অনেক আগে থেকে। তবে আমি আদৌ ভালো অভিনেতা ছিলাম না, আজও নই। আমাদের ক্লায়েন্টদের অনুরোধেও অফিস-ক্লাব থাকে না—সেইসব ক্লাবের হয়ে। তখন আমার চেহারা ভালো ছিল। আমাকে ওরা হিরো করত—ভাড়া করা অভিনেত্রীদের সঙ্গে অভিনয় করতাম। অনেক থিয়েটার করেছি।
‘দক্ষিণী’-তে একটা ড্রামা সেকশান ছিল। আমি তার সহ-সচিব ছিলাম এবং তখন ড. কালিদাস নাগের মেয়ে মঞ্জুদি, উনি রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্পগুলির নাট্যরূপ দিতেন, সেই নাট্যরূপ ধরে আমরা রিহার্সাল করে অভিনয় করেছি। তখনকার দিনে তো নিউ এম্পায়ার ছাড়া কোনো থিয়েটার ছিল না—সেখানে করতাম। একমাত্র হল ছিল সেটা—রোববার সকালের শো—তে আমরা নাটক মঞ্চস্থ করতাম। তখন রবীন্দ্রসদন, নন্দন কোথায়? ‘রক্তকরবী’ থেকে আরম্ভ করে যে-কোনো প্রেস্টিজিয়াস নাটক সেখানেই হয়েছে। এক সময় ‘আকাশবাণী’ থেকে করতে বলল। আমি অভিনয় করেছিলাম রবীন্দ্রনাথের ‘রবিবার’।
পরবর্তী জীবনের ঘটনা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ফোন করল আমাকে। তখন ভালো পরিচয় ছিল না। সুনীল বলল, বুদ্ধদেব, স্বাতীরা ‘মুক্তধারা’ করতে চাইছে, কিন্তু ধনঞ্জয় বৈরাগী করার কেউ নেই। তুমি যদি একদিন আসো তাহলে একটু আলোচনা করতে পারি। সেই প্রথম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে আমি যাই। গিয়ে দেখি, সবাই রয়েছে…. দিব্যেন্দুও। দিব্যেন্দুকে ‘আনন্দবাজার’-এ দেখতাম মাঝে মাঝে। শরৎ, বিজয়া সকলের সঙ্গে আলাপ হল। আমাকে আবার অডিশন দিতে হল। রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা দিয়ে বলা হল—‘পড়ুন তো।’ মনে মনে তখন হাসছি। ভাবছি আমি অনেকের চেয়েই ভালো পড়তে পারি। তার পর বললেন ওঁরা, ‘গান শোনান তো’। যাইহোক অডিশনে আমি পাস করলাম। তার পর রিহার্সাল শুরু হল। ‘মুক্তধারা’—ধনঞ্জয় বৈরাগী। এই তো সেদিনও—স্বাতী ফোন করল। বলল, বুদ্ধদেববাবু আমরা আর আগের মতো অভিনয় করতে পারব না। বুড়ো হয়েছি, মোটা হয়েছি। নেচে নেচে তো অভিনয় করতে পারব না। তাই ঠিক করেছি শ্রুতিনাটক করব। ‘ধনঞ্জয় বৈরাগী’ করার জন্য আপনাকে আসতেই হবে। স্বাতী বলল, আমি গেলাম। খুব ভালো হয়েছে সে-উপস্থাপনা। সৌমিত্র (চট্টোপাধ্যায়) পরে বলল, খুব ভালো করেছেন।
আমার অভিনয়ের অভিজ্ঞতা কম নয়। ‘মুক্তধারা’-র অভিনয় বেশ জমে গিয়েছিল। আমি অন্য সাহিত্যিকদের মতো তো অভিনয় করিনি। চারটে কথা বললাম, মঞ্চে এলাম—চলে গেলাম। ধনঞ্জয় বৈরাগীর মতো অমন একটা ইম্পর্টেন্ট রোলে অভিনয় করে আনন্দ পেতাম। অত গান, তার পর নাচ। নেচে গান গাওয়া। ক্যালকাটা ক্লাবে ১৯৭৭-এ ‘চিরকুমার সভা’তে অক্ষয়ের ভূমিকাতে অভিনয় করেছিলাম। পরে রবীন্দ্রসদনেও হয়েছিল সেই নাটক।
গান, নাটক, ছবি আঁকা, শিকার—সবেতেই ছিলাম, আছি। চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হিসেবেও কম কিছু ছিলাম না। ইস্টার্ন ইণ্ডিয়ার বাঙালি হিসেবে যথেষ্ট নাম কুড়িয়েছিলাম। সারাভারতবর্ষে ট্রাইবুনাল ও সেন্ট্রাল বোর্ডে গিয়ে কেস করেছি। আনন্দবাজার, দে’জ মেডিক্যাল, সোনোডাইন, আজকাল, বেঙ্গল ল্যাম্প ইত্যাদির কাজ করেছি। ক্যালকাটা স্টক এক্সচেঞ্জেও আমাদের মক্কেল ছিল। যত বাঙালি বড়ো গ্রূপ ছিল সকলের হয়ে কাজ করেছি।
আপনি একের পর এক লিখেছেন—‘সবিনয় নিবেদন’, ‘চান ঘরে গান’, ‘অবরোহী’, ‘মহুয়াকে’ এবং ‘মহুলসুখার চিঠি’। এসব চিঠিপত্রনির্ভর রচনা উপন্যাস নয়। এটা এক ধরনের এক্সপেরিমেন্ট বলেই পাঠকের মনে হয়। আপনার চিঠিপত্রে উওর দেওয়ার ব্যাপারে পাঠকমহলে সুনাম আছে। এই অভ্যেস থেকেই কি জন্ম নেয় এইসব রচনা?
কেউ চিঠি লিখলে তার উত্তর দেওয়াটা ভদ্রতা বলে মনে করি। বাবা এটা শিখিয়েছিলেন—চিঠির উত্তর না দেওয়াটা অভদ্রতার শামিল।
আমি সারাজীবনে লক্ষ লক্ষ চিঠি লিখেছি। অনেকে নিন্দা করে চিঠি লেখেন। অনেকে ভুল দেখিয়ে লেখেন। আমি সবচেয়ে আগে তাঁদের চিঠির উত্তর দিই। নিন্দুক পাঠককে ভক্ত বানিয়ে তোলার মধ্যে কৃতিত্ব বেশি। এটা আমি বিশ্বাস করি আর পাঠকরাও সেকথা জানেন। যাঁরা নিন্দা করে চিঠি লেখেন, তাঁরাই আমার ভক্ত হয়ে যান। কেন? তার কারণ আমি তাঁদের প্রশ্নের উত্তর দিই, ব্যাখ্যা করি। সে-চিঠির লেখক ক্লাস সেভেন-এর ছাত্রই হোক আর রিটায়ার্ড বৃদ্ধই হোক। এতে ওঁরা খুশি হন—ইম্পর্টেন্ট বোধ করেন।
আপনার এতে অনেক সময় যায় তো?
এত কিছুর মধ্যে নিয়মিত চিঠি লেখা কম পরিশ্রমের কাজ নয়—এই তো সেদিন শান্তিনিকেতনে তিরিশটা চিঠি লিখলাম। তিন দিন চার দিন ধরেও কখনো আমি পাঠকের চিঠির উত্তর দিয়েছি।
সত্যজিৎ রায় চট করে কারোর চিঠির উত্তর দিতেন না। সেটা অবশ্যই তাঁর ব্যাপার। উনি আমাকেও উত্তর দেননি। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায়—এঁরা অসাধারণ প্রতিভার মানুষ ছিলেন। তাই বলে, তাঁদের সব গুণ থাকবে তার কোনো মানে নেই।
আমার বাবা আমাকে শিখিয়েছিলেন চিঠির উত্তর দিতে।
চিঠি লিখতে লিখতে পাঠকদের সঙ্গে আমার গভীর সম্পর্কও গড়ে উঠেছে। এইভাবেই আমার পত্র-সাহিত্যেও অনুরাগ জন্মে। ওই চিঠিগুলিকে ট্রান্সফার করলেই তো সাহিত্য হবে—হয়ে যায়। চিঠিপত্রের মধ্যে দিয়ে সাহিত্য করা যাবে না কেন? আমি করেছি…. এক অর্থে পাঠকরাই আমার গার্জেন। তাঁদের সঙ্গেই আমার আত্মীয়তা। বইমেলায় গেলে পাঠকরা আমার হাতটা ধরতে চান। কেউ কেউ বলেন, আপনার হাতটা একটু দেবেন, কিংবা একটু মাথায় হাত রাখবেন? আমি হেসে বলি—আমি ‘অর্ধনারীশ্বর’।
অকারণে ঈর্ষার শিকার হলে দুঃখ হয় না?
আমার সাফল্যে বাইরের লোকজনই শুধু নন, কাছের মানুষ, বন্ধুবান্ধব, কিছু আত্মীয়রাও জ্বলে যান। ঈর্ষা করেন। প্রথম প্রথম খুব দুঃখ হত। এখন এসব আর গায়ে লাগে না। সয়ে গেছে। আমার এক মক্কেল ছিল। তাকে দেখতাম পনেরো দিন অন্তর গাড়ি বদল করছে। মার্সিডিস। বাড়িতে তার কুড়িটা চাকর বারোটা ড্রাইভার। আমাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করত। আমি তাকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম এর কারণ। মানে, ঘনঘন মার্সিডিস বদলানোর। সে আমাকে বলল, দাদা, এসব তুমি বুঝবে না। এইভাবে গাড়ির মডেল বদল করে আমি আমার বিদ্বেষ প্রকাশ করি। ঘৃণা প্রকাশ করি তাদের বিরুদ্ধে, যারা একদিন আমায় কুকুর ছাগল মনে করেছিল, একদিন থুতু দিয়েছিল, দুঃসময়ে আমার দিকে তাকায়নি পর্যন্ত। দিস ইজ অ্যান এক্সপ্রেশন অফ হেট্রেড।
এইমুহূর্তে আপনার কাছে বন্ধুত্বের সংজ্ঞা কী?
দুজন ইক্যুয়ালি সাকসেসফুল মানুষের মধ্যেই ভালো বন্ধুত্ব হয়—সেটা দীর্ঘদিন থাকেও। এখন এর মানেটা আমার কাছে অন্য। কেউই বন্ধু নয়। একা আমি, একেবারে একা।
জানবে, ঈশ্বর তোমার বন্ধু। ভালো গান, ভালো বই তোমার বন্ধু। আর আত্মীয়? রবীন্দ্রনাথ বলতেন, আত্মার কাছে থাকে যে, সেই আত্মীয়। যেসব মানুষ কোনো স্বার্থ নিয়ে আমার কাছে আসে না—তারাই আমার বন্ধু এবং আত্মীয়। সমান মানসিক উচ্চতায় না হলে কোনো বন্ধুত্বই টেকে না। আমি ভালো আড্ডা দিতে পারি না। দিইওনি কোনোদিন।
দেব কী করে—কাজ যে আমায় গ্রাস করে রেখেছিল। এখন ভাবি, আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথ কি কখনো আড্ডা মেরেছেন? নিশ্চয়ই মারেননি, তাঁর সময় ছিল কই? কাজ যার থাকবে সে সময় নষ্ট করবে কেন? সে তো নিশ্বাস ফেলার সময় পায় না—জীবনের পরিমাপও তেমন দৈর্ঘ্য দিয়ে হয় না। কাজ দিয়েই হয়। বিবেকানন্দ কতদিন বেঁচে ছিলেন? কিন্তু কত বড়ো কাজ করেছেন। আমি এখন নিজের লেখা দিয়ে, গান দিয়ে, ছবি দিয়ে, বাঁচতে চাই। শুনলে আশ্চর্যই হবে যে, এখন আমার কোনো বন্ধু নেই—কোনো আত্মীয় নেই। রক্তের সম্পর্কতে আর আমি বিশ্বাস করি না। দুঃখ ভুলে থাকতে শিখেছি। যাদের মধ্যে স্বার্থের গন্ধমাত্র নেই তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে একটু চলতে চাই। যখন পথে বেরোই—ভাবি কোথায় যাব? যেতে কোথাও খুব ইচ্ছে করে—কিন্তু কার কাছে যাব? কর্মসূত্রেই আমি বন্ধুত্ব অর্জন করতে চেষ্টা করেছি। রবীন্দ্রনাথ? তাঁর কথা ভাবো! এত দুঃখ ছিল মানুষটার। অত বড়ো পরিবারের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও একা ছিলেন একেবারে।
লেখক-বন্ধুদের সম্পর্কে আপনার বর্তমান ধারণা কী? সম্পর্ক কি চিরকালের?
কবি লেখকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার সময় আমার হয়ে ওঠেনি কারণ নিজের পেশার কাজে আমাকে অত্যন্তই ব্যস্ত থাকতে হত এবং সারাভারতবর্ষ তো বটেই, ভারতবর্ষের বাইরেও ঘুরে বেড়াতে হত। আমার অফিস থেকে ‘আনন্দবাজার’-এর সুতারকিন স্ট্রিটের অফিস খুবই কাছে ছিল। দুপুরে লাঞ্চ আওয়ারে সপ্তাহে তিন-চারদিন রমাপদ চৌধুরীর ঘরে যেতাম। আগেই বলেছি যে, রমাপদবাবুই আমাকে লেখক করেছিলেন এবং লেখা সম্বন্ধে অনেক কিছু শিখেওছি ওঁর কাছ থেকে। ওঁর ঘরেই অনেক সাহিত্যিকদের সঙ্গে আলাপিত হয়েছিলাম। পরের দিকে ‘দেশ’-এর ঘরেও যেতাম কখনো-কখনো, ‘আনন্দমেলা’-র ঘরেও, যখন নীরেনদা সম্পাদক ছিলেন।সাহিত্যিকদের মধ্যে শীর্ষেন্দুকেই আমি বন্ধু বলে জানি। অ্যাকোয়েন্টস অনেকই আছে কিন্তু বন্ধু যাকে বলে তা তাঁরা নন। রমাপদবাবুও বন্ধুর মতোই ছিলেন। শিল্পী সুধীর মৈত্রও বন্ধুর মতোই ছিলেন।
বন্ধু বলতে আমার জীবনে আমার বন-পাহাড়ের বন্ধুরাই প্রধান। শুধু লেখক-কবিই বা কেন, শহরে অন্য বন্ধুও আমার নেই-ই বলতে গেলে। এক-দুজন ছিল একটা সময়ে। এখন আর নেই। একা থাকতেই আমি ভালোবাসি, তা ছাড়া সবসময়েই লেখা, গান, ছবি আঁকা এসব নিয়ে খুবই ব্যস্ত থাকি—বন্ধুদের দেওয়ার মতো বা আড্ডা মারার মতো সময় আমার খুব কমই ছিল।
‘কোজাগর’ উৎসর্গ করলেন রমাপদ চৌধুরীকে (অগ্রজ ঔপন্যাসিক, ছোটোগল্পের জাদুকর; বন্ধু এবং হিতৈষীকে—অশেষ কৃতজ্ঞতার সঙ্গে)। ‘মাধুকরী’কে কেন একবিংশ শতাব্দীর নারী ও পুরুষদের জন্য উৎসর্গ করলেন? বিশেষ কোনো কারণ ছিল কি?
‘মাধুকরী’ বেরোয় ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে। তখন অনেকেই বুঝতে পারেননি যে, তরুণ প্রজন্ম এই উপন্যাসকে সাদরে গ্রহণ করবে। বর্তমানের যেকোনো ভালো লেখা তা যদি মহৎ সাহিত্য হয় তা ভাবীকালের হাতেই অর্পণ করতে হয়। বাইশ বছর ধরে বইটা বিক্রি হচ্ছে তো। আমার পুরোনো বেশ কয়েকটি বই এখন ক্লাসিক হয়ে গেছে। বিক্রির কোনো ঘাটতি নেই। বই পাঠক পড়বেন তো ঠেকাবে কে? কে ছাপল না নতুন বই, তাতে আমার আর কিছু যায় আসে না।
আপনার উপন্যাস ও ছায়াছবি নিয়ে কিছু জানতে ইচ্ছে হয়। কেন আপনার উৎকৃষ্ট রচনাগুলি চলচ্চিত্রায়িত হল না? সত্যজিৎ কোনো ছবি করলেন না কেন? ঋত্বিক ঘটক ও তাঁর সমকালীন পরিচালকদের সম্পর্কে কিছু বলুন। ভারতবর্ষের কোন কোন পরিচালকের ছবির কথা আপনার মনে আছে—যা আপনাকে ভাবায়?
আমার অধিকাংশ উপন্যাসের পটভূমিই প্রকৃতি। অগণ্য পরিচালক আমার বিভিন্ন উপন্যাস নিয়ে ছবি করতে চেয়েছেন কিন্তু তাঁরা বাইরে গিয়ে শুটিং করতে রাজি হননি বলেই আমি রাজি হইনি।
সত্যজিৎ রায় কেন আমার উপন্যাস নিয়ে ছবি করেননি তা তিনিই জানতেন। তাতে আমার কিছু যায় আসেনি। আর করলেও তো সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ বা ‘অপুর সংসার’-এর তকমা পড়ত আমার উপন্যাসে, বুদ্ধদেব গুহর তাতে মান বাড়ত না।
ঋত্বিক ঘটক অন্য ঘরানার চিত্রপরিচালক ছিলেন। আমার খুব কম উপন্যাসই তাঁর ছবির বিষয় হতে পারত।
সাহিত্য ও চলচ্চিত্র দুটি ভিন্ন মাধ্যম। অধিকাংশক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, পরিচালকেরা উচ্চম্মন্যতাতে ভোগেন—সাহিত্যিকের উপন্যাস নিয়ে ছবি করে তাঁদের তাঁরা ধন্য করছেন, এমনই একটা ভাব। কেউই আমাকে ধন্য করুন তা আমি চাই না। আমার প্রত্যেকটি উপন্যাসই আমার কন্যার মতো, যার তার হাতে তাকে পাত্রস্থ করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। হাঁড়ি চড়িয়েও আমি সাহিত্য করিনি কোনোদিন। প্রযোজক বা পরিচালকদের অর্থ না হলেও আমার চলে যাবে। তবে কেউ কেউ আমার উপন্যাসের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধা দেখিয়ে ছবি করেছেন। তাঁদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।
সিনেমার স্ক্রিপ্ট লিখতে ইচ্ছে হয় না? বিশেষ করে যখন কোনো পরিচালক আপনার উপন্যাসের ওপর ছবি করতে চাইবেন?
কিছুদিন আগেই বিকাশ মুখার্জি ছবি করলেন তো—‘ভোরের আগে’। টেলিফিলম। তাতে আমার দেওয়া সংলাপের একটাও পরিবর্তন করেননি। তার আগে ‘অবেলায়’। আমার লেখা নিয়ে যাঁরা ছবি করেন তাঁদের ডায়ালগ চেঞ্জ করতে বারণ করি। এইসব ছবির এত সুখ্যাতি কেন? কোনোক্ষেত্রেই ডায়ালগ পরিবর্তন করা হয়নি। সবাই মনে করে ওটা ডিরেক্টরের কাজ। আমার নিরানব্বই শতাংশ লেখার পটভূমি বা প্রেক্ষাপটই কলকাতার বাইরের। অথচ দেখো নব্বুই শতাংশ পরিচালক কম খরচে কাজ করতে চান কলকাতায় বসে। কলকাতার সেটের মধ্যে বসে আমার ছবি করা যাবে না। আমার কাছে কত ছবির অফার এসেছে—আমি টার্ন ডাউন করেছি। কলকাতায় বসে ছবি করা হবে না। মূলপটভূমিতে যেতে হবে। ‘ভোরের আগে’র পটভূমি হাজারিবাগে। পরিচালক বললেন, যদি ঘাটশিলায় করি? বললাম অসুবিধে নেই—করুন। ‘সন্ধের পর’-এর পটভূমি ছিল জব্বলপুর। আমি কলকাতার সেটের মধ্যে কাউকে ছবি করতে দিইনি। সেইজন্য আমার উপন্যাস থেকে কম ছবি হয়েছে। আমি তো বলেছি, আমার দরকার নেই। আমার উপন্যাস থেকে ছবি আমার মতো করে হবে, নইলে করতে হবে না। স্ক্রিপ্ট লেখা অত সোজা নাকি—তাহলে আমরা সারাজীবন করলামটা কী? আমরা তো সারাজীবন স্ক্রিপ্টই লিখেছি।
অর্থাৎ আপনি কমপ্রোমাইস করেননি—
‘কোয়েলের কাছে’ ছবি করার প্রস্তাব তিন বার চার বার করে ফিরে গেছে আমার কাছ থেকে। স্বত্ব বিক্রি করেছি, তার পরও স্ক্রিপ্ট পছন্দ হয়নি—সব ফেরত দিয়ে দিয়েছি। কেসও করতে হয়েছে ঠেকানোর জন্য। এবার খোকাদা স্ক্রিপ্ট করলেন ‘কোয়েলের কাছে’ উপন্যাস-এর। খোকাদার পুরোনাম মনে পড়ছে না। খুব সিনিয়র ডিরেক্টর। আমার বাড়িতে এসেছেন স্ক্রিপ্ট পড়তে। বসলাম ঘরে। শেষে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন লাগল? আমি তাঁকে বললাম, দেখুন একটা গল্প মনে পড়ে গেল—আর্নেস্ট হেমিংওয়ের একটা রচনা—‘লাইফ অ্যাণ্ড ডেথ অব ফ্রানসিস ম্যাকোম্বার’—নিয়ে ছবি করেছিলেন Darryl B. Zanuk।
সেই ছবিটা যখন রিলিজ হবে তখন ওঁকে ডেকেছেন জানাক। ছবিটা দেখানো হয়ে যাওয়ার পর জানাক জিজ্ঞেস করলেন—মিস্টার হেমিংওয়ে—হাউ ডিড ইউ লাইক মাই ফিলম? হেমিংওয়ে তা শুনে বললেন, আই ফিল লাইক মেলটিং অল দি মানি ইউ হ্যাড গিভিন মি ইন্টু এ মোলটেন মাস অ্যাণ্ড ফিল লাইক পোরিং দ্য হোল মাস থ্রু ইয়োর ব্লাডি অ্যানাস। উনি শুনে চলে গেলেন।
কোনো ভালো লেখকের যদি অভিমান না থাকে, গর্ব না থাকে তাঁর লেখা নিয়ে, তাহলে তিনি কীসের লেখক? যেকোনো লোক আসবে, টাকার লোভ দেখাবে, ২০/২৫হাজার টাকা দেবে—আমার বইগুলি আমার মেয়ের মতো, আমি তাদের আজেবাজে পাত্রে দান করি না। তবে আমি স্বীকার করি, যে, ফিলম যেহেতু অন্য মিডিয়ার তাকে কিছু স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। সত্যজিৎ রায়ের ওপর একটা প্রবন্ধে সেকথা লিখেওছি ‘Telegraph’-এ। সিনেমা একটা অডিয়ো ভিসুয়াল মিডিয়া। পরিচালকদের কিছু স্বাধীনতা ‘সার্টেন লিবার্টিজ’, দেওয়া উচিত। আমি লিখে, যে-চিত্রটা এঁকেছি সেটা অডিয়ো ভিসুয়ালে আনার ডিফিকালটি থাকে, লেখকের কলম যা-খুশি লিখতে পারে কিন্তু একজন ডিরেক্টরের অনেক কিছু অসুবিধে থাকে। সে-অসুবিধেগুলি অ্যাপ্রিশিয়েট করে তাঁদের কিছু স্বাধীনতা দেওয়া উচিত। তার মানে এই নয় যে, আমার লেখাটা আমার বলে চেনাই যাবে না। আমি যে-কটা বই দিয়েছি, সে ক-টাতেই ওই কনডিশন—আমার ডায়ালগ একটুও বদলাতে পারবে না। এবং তা রেখেছে বলেই সাফল্য এসেছে।
এই নয় যে, আমার উপন্যাসের ছবি হয় না। কেন হয় না, সেকথা লোকে জানে না। ‘মাধুকরী’ করতে অন্তত পঞ্চাশ জন এসেছেন। আমি বললাম—করতে পারবেন? মুম্বইর টপ র্যাঙ্কিং প্রোডিউসার-ডিরেক্টর ছাড়া ‘মাধুকরী’ কেউ করতে পারবে না। তা-ছাড়া ‘মাধুকরী’র অর্ধেক চরিত্র হিন্দি স্পিকিং। কী করে করবে? গাড়ি ডুবিয়ে দেওয়া আছে—মার্সিডিস গাড়ি ডুবে যাবে। আমি জিজ্ঞেস করতে বললেন একজন, সেটা নাকি কম্পিউটারে করা যাবে। এই যে ‘ভোরের আগে’ ছবির গান দুটো হিট করেছে, সে তো আমি বেছে দিয়েছি। একটা ব্রহ্মসংগীত এবং আর একটি নিধুবাবুর। চন্দ্রাবলীকে দিয়ে গাইয়েছি। চন্দ্রাবলী রুদ্রদত্ত। গান ছবির অনেক বড়ো জিনিস।
সংগীত বোঝাটাও পরিচালকের কৃতিত্বের একটা বিশেষ দিক তাই নয় কি?
সত্যজিৎ রায় গানটা বুঝতেন। গান ভালো বোঝেন এমন পরিচালকের সংখ্যা বরাবরই কম। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’র ওই যে গান—
এ পরবারে রবে কে হায়!কে রবে এ সংশয়ে সন্তাপে শোকে।
এই গানটা একটা হাইটে পৌঁছে দিয়েছিল। সেইজন্য পরিচালকের গানটা বোঝা দরকার, জানা দরকার। তরুণ মজুমদার ‘আলো’ ছবিতে রবীন্দ্রসংগীতের ভালো ব্যবহার করেছেন। গান একটা ছবিকে কীভাবে সমৃদ্ধ করে তা বলে বোঝাবার নয়।
আবার দেখো ‘জলসাঘর’-এ রবিশংকরকে কী সুন্দর ব্যবহার করলেন সত্যজিৎ। কিন্তু সকলে বলল—‘সত্যজিতের জলসাঘর।’ তারাশঙ্করের নাম নেই। ভাবখানা এমন যে, বিভূতিভূষণ তারাশঙ্কর কিছু নয়। অমন লেখা লিখতে পারবেন কে? আমি ছাড়া কখনো কেউ এসবের প্রতিবাদ করেননি। আমি যখন লিখলাম সেই প্রবন্ধ তখন একজন লেখকও আমায় সমর্থন করেননি।
শংকরের ‘জন অরণ্য’ নিয়ে সত্যজিৎ রায় ছবি করলেন। আমাকে লিখলেন, ভুলে যেয়ো না আমি একটা থার্ড গ্রেড উপন্যাসকে নিয়ে গ্রেড ওয়ান ছবি করেছি। আমি সেকথা ‘সারস্বত’-এ লিখেছি। কিন্তু যদি সেটা থার্ড গ্রেড উপন্যাসই হয়—তাহলে ছবি করলেন কেন? আর কেনই বা বললেন সেকথা? এটা কি উচিত হয়েছিল? আমি নিজের কথা বলছি না কল্যাণ। আমি হয়তো কালকে মরে যাব….. মরে যাওয়ার পরে হয়তো বলবে। এখনই লোকে বলতে আরম্ভ করেছে যে, সত্যজিৎ রায়ের পরে এরকম ভার্সেটাইল মানুষ; শান্তিনিকেতনে একজন বললেন রবীন্দ্রনাথের পরে….. আমি বললাম এরকমভাবে শিবে আর বাঁদরে তুলনা করবেন না। একথা শুনলেও পাপ। তবু আমি নিজেকে প্রমাণ করেছি প্রতিমুহূর্তে। এমন কোথাও নেই যে, যেখানে গেলে গান আমায় গাইতে হয় না। ছবিও আঁকতে মন চায়। নিজেকে দিয়ে বুঝি, একজন ক্রিয়েটিভ মানুষের মধ্যে সৃজনশীলতার সব ক-টি দিকই মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, সবচেয়ে বড়ো হল ‘সহমর্মিতা’। দরদ না থাকলে কোনোদিন, বড়ো লেখক হতে পারবে না। মানুষকে ভালো না বাসলে কিছুই হবে না। যতই কায়দা করো, কচকচি করো—কিছু হবে না। হেমিংওয়ে এক জায়গায় বলছেন, যার যত টাকা তার মৃত্যুভয় তত বেশি। খুব সত্যি। আমার টাকা নেই তাই প্রাণের ভয় নেই।
আসলে তো মানুষই সব। মানুষই আপনাকে চাইছে—সে কারণেই আপনার এই তাড়না।
আপনাকে নিয়ে জানার আগ্রহ পাঠকের মধ্যে দিনে দিনে আরও বাড়ছে—তাই আমার প্রশ্নও কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যায় সীমাবদ্ধ নয়—আপনি কি আবার ‘সারস্বত’ লিখবেন? মানে দ্বিতীয় খন্ড? তাহলে আরও অজানা কিছু জানা যায়—
এইমুহূর্তে কোনো পরিকল্পনা নেই। লিখতে ইচ্ছে করে না যে…..
এত মৃত্যুভাবনা কেন আপনাকে এখন আক্রমণ করছে? ইদানীং চলে যাওয়ার সময় হয়েছে বলছেন কেন?
মৃত্যুর মতো অমোঘ তো আর কিছুই নেই। রান্নাঘরের সামনে বেড়ালনির মতো জন্মমুহূর্ত থেকে মৃত্যু আমাদের সামনে থাবা পেতে বসে থাকে। বয়েসে আমার চেয়ে ছোটো অনেক কবি লেখক, অনেক প্রিয়বন্ধু, বিশেষ করে জঙ্গলের বন্ধুরা (শহরে বন্ধু আমার বিশেষ নেই কারণ তাঁদের দেওয়ার মতো সময় আমার কোনোদিনই ছিল না আর সময়ই হচ্ছে বন্ধুত্বের সবচেয়ে বড়ো উপাদান) এক এক করে চলে গেল। তাদের কথা, যখনই একা থাকি তখনই মনে হয় এবং মনে হলেই নিজের যাওয়ার কথা মনে হয়।
তবে সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, মৃত্যুভাবনাও ভাবার মতো উদবৃত্ত সময় আমার নেই। সবসময়ই কাজে ব্যস্ত থাকি। কাজ করতে করতেই যেন একদিন মরতে পারি।
আপনার প্রেমিকারা—কাদের কথা এখন মনে পড়ে—
এখন কীরকম প্রেমিকা পছন্দ? প্রেমে পড়েন এখন?
অনেকের কথাই মনে পড়ে। আমার স্ত্রীও আমার প্রেমিকা এবং সববয়েসি পাঠিকারাই আমার প্রেমিকা। তাঁরা আমার সঙ্গে প্রেম করুন আর নাই করুন তাঁদের সঙ্গে আমার মনে মনে প্রেম করতে তো কোনো অসুবিধে নেই। তা ছাড়া, এ-ব্যাপারে আমি অশেষ ভাগ্যবান। দশ বছর বয়েসি থেকে আশি বছর বয়েসি—সব নারীই আমাকে পছন্দ করেন। কেন করেন তা তাঁরাই বলতে পারবেন। ঈশ্বরের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
শান্তিনিকেতনে ছুটে যান কেন? আজও রবীন্দ্রনাথ আপনাকে কতটা অনুপ্রাণিত করে? আর তাঁর গান?
শান্তিনিকেতনে ছেলেবেলা থেকেই যাচ্ছি তবে সেখানের ছাত্র ছিলাম না। শান্তিনিকেতনের সংস্কৃতির অনেক কিছুই পছন্দ করলেও সব কিছু করি না এবং আমি শান্তিনিকেতনিও নই।
রবীন্দ্রনাথ আমার প্রাণপুরুষ। আমার মানসিকতা, আমার রুচি, আমার সাহিত্য, গান এবং ছবি আঁকার ওপরেও রবীন্দ্রনাথের প্রভাব অনস্বীকার্য। আমাদের প্রজন্মের যাঁরা রবীন্দ্রনাথ দ্বারা প্রভাবিত নন তাঁদের রুচি ও বুদ্ধিবৃত্তি সম্বন্ধে আমার সন্দেহ আছে। এখন কলকাতার বড়োলোক, লেখক, শিল্পী, গায়ক ইত্যাদিরা প্রায় সকলেই শান্তিনিকেতনে বাড়ি করেছেন কিন্তু তাঁদের মধ্যে ক-জন অন্তরে রবীন্দ্রনাথকে তেমনভাবে গ্রহণ করেছেন, সে-বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে।
রবীন্দ্রনাথের গান আমার প্রাণের গান, যদিও শুধুমাত্র পুরাতনি গান গাই বলেই অনেকে জানেন। আবারও বলি যে, আমি গায়ক নই। গায়ক না হয়েও গান ভালোবাসা যায়। তবে আজকাল যেমন বেশ কিছু রবীন্দ্রসংগীত গায়ক-গায়িকা দেখি তাতে রবীন্দ্রসংগীত গাইনি বলে কোনোরকম অনুশোচনাই হয় না।
হেমিংওয়ে আপনার অতিপ্রিয় লেখক—আপনার জীবনের সঙ্গে তাঁর কোথাও মিল আছে কি?
মিল আছে অনেকই। উনি শিকারি ছিলেন। সারাপৃথিবীতে শিকার করেছেন। তিনি খুব রসিক মানুষ ছিলেন এবং আমারই মতো ‘ঠোঁট কাটা’। তাঁর নিজের সম্বন্ধে কোনো দ্বিধা বা সন্দেহ ছিল না। জীবনের কোনোক্ষেত্রেই তা সে শিকারই হোক, কি সমুদ্রে মাছ ধরা, কি বক্সিং, হারতে রাজি ছিলেন না। অত্যন্ত কম্পিটিটিভ ছিল তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি। আমারও তাই। যদিও জানি যে এই দৃষ্টিভঙ্গি ভালো না। তিনি অত্যন্ত স্বাধীনচেতাও ছিলেন।
তবে অমিলও কম নেই। উনি অগণ্য নারীর সঙ্গে সহবাস করেছেন। বিয়েই করেছেন বেশ কয়েকবার। যদিও পুরুষসঙ্গ, বিশেষকরে পৌরুষসম্পন্ন রুক্ষ দুর্দম পুরুষসঙ্গ তাঁর খুবই পছন্দের ছিল। ‘Men without women’ উপন্যাসে এই মানসিকতার প্রতিফলন পড়েছে। আর একটি মস্ত অমিল আমাদের মধ্যে এই যে, ওঁর প্রচুর বন্ধু ছিল—সবসময়েই বন্ধুবেষ্টিত থাকতে ভালোবাসতেন আর আমার বন্ধু বিশেষ নেই, তা ছাড়া একা থাকতেই আমি বেশি ভালোবাসি। জীবনানন্দ, ওয়াল্ট হুইটম্যান, হেনরি ডেভিড থোরো, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, টলস্টয়, চেকভ, ন্যুট হ্যামসুন প্রমুখের লেখার দ্বারা আমি কম-বেশি প্রভাবিত। শরৎবাবু, তারাশঙ্কর এবং মানিকবাবুর দ্বারাও।
আমি কবিতারও খুব ভক্ত, জীবনানন্দ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল, তারাপদ, অমিতাভ দাশগুপ্ত, ইয়েটস, কিটস, রবার্ট ফ্রস্ট, পাস্তারনাক, এবারকম্বি, ল্যাটিন আমেরিকান নানা কবিদের কবিতা। তুষার রায়ের কবিতাও ভালো লাগত। আধুনিক কবিদের মধ্যে জয়, সুবোধ এবং মল্লিকার কবিতা ভালো লাগে।
সকলের নাম উল্লেখ করা গেল না বলে ক্ষমাপ্রার্থী।
ইংরেজিতে লিখতে ইচ্ছে হয় না? সে চেষ্টা করেছেন?
খুবই ইচ্ছে করেছিল একসময়ে কিন্তু বাংলা লেখার চাপ, পেশার কাজের চাপ এতটাই বেশি ছিল যে, সময় একেবারেই বার করতে পারলাম না। পরের জীবনে হবে।
এখন যাঁরা আপনার লেখা অনুবাদ করছেন তাঁদের কাজ পছন্দ হচ্ছে আপনার?
নিশ্চয়ই। ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন এবং তা বই হয়ে প্রকাশিত হয়েছে এমন অনুবাদক ছ-জন। আরও কিছু অনূদিত ম্যানাসক্রিপ্ট আছে অন্যদের কিন্তু তাঁদের প্রকাশক নেই। আজকাল সব কিছুই জানাশোনার ব্যাপার। ব্যক্তিগত গুণের কদর ক্রমশই কমে আসছে। এটা দুঃখজনক।
আমার ছ-জন অনুবাদকের একজন অস্ট্রেলিয়ান, ড. জন উইলিয়াম হুড। মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলার স্নাতক। অন্যজন আমার কলেজের বন্ধু শংকর সেন (সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ), ইঞ্জিনিয়ার এবং ব্যাঙ্কার। খুব ভালো ইংরেজি লেখে। অবসর নেওয়ার পরে আমাকে বলে যে, আমার ক-টি গল্প অনুবাদ করবে। আমি সানন্দে রাজি হই। দিল্লির ইউ বি এস পাবলিশার্স প্রকাশ করেছেন ‘ফার্স্ট লাভ অ্যাণ্ড আদার স্টোরিজ’। জন অনুবাদ করেছে ‘কোজাগর’ এবং ‘বাজা তোরা রাজা যায়’, প্রকাশক ‘রূপা অ্যাণ্ড কোং’।
সাহিত্য পুরস্কার কি সন্দেহজনক? আপনি পাঠককেই আপনার ‘বিচারক’ বলেছেন বিভিন্ন সময়ে—দামি কোনো পুরস্কার পেলেন না কেন? তাতে কোনো আক্ষেপ আছে?
পুরস্কার যে একেবারেই পাইনি তা নয়, পাঁচলাখি নয় দশহাজারি ‘আনন্দ’ পেয়েছি ১৯৭৬-এ। ‘বিদ্যাসাগর’ পেয়েছি গতবছরে কিশোর সাহিত্যের জন্যে। চন্ডীগড় কলাকেন্দ্র থেকে গায়ক হিসেবে পুরস্কার পেয়েছি। সে-বছর শান্তিদেব ঘোষ এবং আমাকে দেওয়া হয়, যুগ্মভাবে নয়, আলাদাভাবে। আরও নানা ছোটোখাটো পুরস্কার পেয়েছি। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রবীন্দ্র-পুরস্কার বা সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পাইনি অথচ আমার চেয়ে ছোটো এবং সমসাময়িক সকলেই পেয়েছে। তার কারণ হিসেবে বলতে হয়, আমি নিশ্চয়ই খারাপ লেখক। তাই পাইনি।
‘মিছিমিছি’র মতো নভেলেট লিখতে দেখলে মনে হয়, আপনি ‘নবযুগ’ ধারার চিন্তাকে স্বাগত জানিয়েছেন। নতুন বিষয় নির্বাচনে আপনি সিদ্ধহস্ত। কিন্তু নিয়মিত এমন বদল এবং আপডেট থাকা সম্ভব হয় কীভাবে?
‘নবযুগ’ ধারার চিন্তা কাকে বলে বলতে পারব না। তবে লেখকমাত্রই তাঁর চোখ-কান খোলা রাখলে নানা নতুন বিষয়, যা-তাঁর পারিপার্শ্ব থেকে, তাঁর পরিবেশ-প্রতিবেশ থেকে উঠে আসে, তা নিয়েই লেখেন। লেখা উচিত অন্তত।
কী মনে হয় সমকালীন সাহিত্য বিষয় নিয়ে?
‘সমকালীন’ সাহিত্য নিয়ে আমি কোনোদিনই ভাবিত ছিলাম না। সমকালীন সাহিত্য যদি চিরকালীন হয়ে উঠতে পারে তবেই তা সার্থক সাহিত্য আর কোন সাহিত্য চিরকালীন হবে, তার বিচার করবে মহাকাল। আমার যেসব বই ত্রিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর আগে লেখা অথচ এখনও প্রথম দিনেরই মতো সমাদৃত, ন্যায্য কারণে সেইসব বই সম্বন্ধে শ্লাঘা বোধ করি। একটি বিশেষ সময়সীমা পেরিয়ে আসার পরই কোনো বই ক্লাসিক, কি নয়, তার বিচার হয়। এবং তাই হয়েছে। সাহিত্যের ইতিহাস তাই-ই বলে।
কী লিখতে চাইলেন? কী লিখলেন?—আর কী লিখতে পারলেন না?
লিখতে চাইলাম অনেক কিছুই তবে যা চাইলাম তার কমই লিখতে পেরেছি। কী লিখেছি তার বিচার করবেন পাঠক-পাঠিকারা। অনেক কিছুই লিখে ওঠা হয়নি।
আপনার কোন লেখাগুলি বেঁচে থাকবে? কোনো উপন্যাস কি নতুন করে লিখতে ইচ্ছে হয়?
আগেই বলেছি, আমার তিন যুগ আগে লেখা অনেক উপন্যাস ও গল্পই বেঁচে আছে এবং আমার বিশ্বাস, তাদের এখনও এমন সমান জনপ্রিয়তা লক্ষ করি যে, ভবিষ্যতেও বেঁচে থাকবে।
না। কোনো উপন্যাসই নতুন করে লিখতে ইচ্ছে করে না। এক এক বয়েসের লেখা এক একরকম—তাই তাদের ঘিরে লেখকের ভালোবাসার বয়েসও আলাদা আলাদা। আমার মনে হয়, সব লেখকই এই কথা বোঝেন।
লেখক হিসেবে বেঁচে থাকার (অন্তত এই বাংলায়) বিড়ম্বনা কী?
প্রশ্নটির মানে বুঝলাম না। লেখক হিসেবে বেঁচে থাকতে তাঁর নিরন্তর লিখতে হয়, তারও পরে লেখার দাবি ক্রমাগত বাড়তেই থাকে। সেই দাবিকে প্রতিহত না করতে পারলে লেখা খারাপ হতে বাধ্য।
বড়োমামা ‘সুনির্মল বসু’কে দিয়ে শুরু করেছিলেন—‘সারস্বত’। ওঁর জীবন থেকে কী শিক্ষা নেন আপনি? আপনার বাবা (শচীন্দ্রনাথ গুহ) চাননি আপনি লেখক হন—এখন আপনি সাফল্যের চূড়ায়—আজ বাবাকে কাছে পেলে কী বলবেন? এই সাফল্যকে আপনি কীভাবে দেখেন?
বড়োমামা সুনির্মল-এর জীবন থেকে শিখেছি যে, লেখা ‘পুজো’ বিশেষ। কোনো প্রকৃত লেখকই অর্থের জন্য বা যশের এবং পুরস্কারের জন্যে তো আদৌ লেখেন না। যাঁরা তা করেন তাঁরা ব্যবসায়ী, লেখক বা কবি নন। অনেকরকম কষ্ট স্বীকার করেও একজন লেখক বা কবিকে তাঁর সেই ‘সত্তা’ বাঁচিয়ে রাখতে হয়।
বাবা চাননি আমি লেখক হই, তার কারণ বাবা চাইতেন যে, আমি প্রফেশনাল কোয়ালিফিকেশন অর্জন করি। কারণ চোখের সামনে তিনি বড়োমামাকে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়তে দেখেছেন। আজকালকার লেখকদের মতো তখনকার দিনের লেখকেরা সচ্ছল ছিলেন না। বাবা তো অনেক দিনই হল চলে গেছেন। তবে লেখক হিসেবে কিছু সাফল্য দেখে গেছেন। আজও বেঁচে থাকলে কী বলতেন জানি না। হয়তো সুখীই হতেন।
লেখকজীবনেরও মাঝে কি রীজনৈতিক জীবন থাকে? বিশেষকরে চাণক্যের মতো কোনো চাল দেওয়া—টিকে থাকার জন্য Compromise করা বা দাবার ঘুঁটি সাজাতে কতটা দরকার? Too good লেখকরা বা আত্মসম্মান নিয়ে যাঁরা লিখেছেন/লিখছেন তাঁদের এবং নিজের সম্পর্কে এই সময়ের ভাবনা কী? আপনি নিজেও তো কম ‘জ্বলে পুড়ে’ গেলেন না, একা উচ্চে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য?
এই জ্বলন এবং যন্ত্রণাকে এড়ানো যায় না। সাফল্য, জীবনের যেকোনো ক্ষেত্রেই আনন্দর সঙ্গে অনেক দুঃখও বয়ে নিয়ে আসে। এই দুই নিয়েই বাঁচতে শিখতে হয়। এই যন্ত্রণার হাত থেকে বাঁচার জন্য রবীন্দ্রনাথ পড়ি, দেশি-বিদেশি অন্যান্য বড়ো লেখকদের জীবনীও পড়ি। অনেক সময় শুধুমাত্র ব্যর্থতাই নয়, সাফল্যও হতাশা বয়ে আনে (Frustration)। উঁচুতে উঠলে ঝড়ঝাপটা সহ্য করতেই হয়। সাফল্যর সঙ্গে এসব অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
‘প্রতিষ্ঠান বিরোধী’ বলে আপনার বদনাম আছে। প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেলেন না। কোনো গোপন ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন কি?
হয়েছিলামই। আবার কিছু ভালো মানুষের সান্নিধ্যও পেয়েছি। যেমন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সন্তোষকুমার ঘোষ। সন্তোষদা মানে ‘আনন্দবাজার’-এর সন্তোষকুমার ঘোষ।
সন্তোষদার কথা মনে পড়ছে। ওঁর তখন গলাতে ক্যান্সার হয়েছে, বড়ো দুঃখ হল। কারণ শেষের দিকে সন্তোষদা আমার সঙ্গের কাঙাল হয়েছিলেন। সেইসময় আমি সন্তোষদাকে বেশ কয়েকটি চিঠি লিখেছিলাম। দেখা হতে একদিন বললেন, তুমি এত ভালো ইংরেজি বলতে পারো?
পরে, সে-সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছিল। উনি ভাবতেন ‘সুটেড-বুটেড বুদ্ধদেব’- দূরের কোনো লোক। আমাকে জানেই বা কে? জানতেন একমাত্র ওঁদের মালিকরা। তখন আমার সঙ্গে বিদেশিদের পরিচয় করানো হত এইভাবে—হি ইজ এ লিডিং চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, লিডিং রাইটার অ্যাণ্ড গুড সিংগার। তখন ভালোবাসা ছিল।
ওপরওয়ালারা আমাকে চিনতেন। কিন্তু বলো, সাহিত্যিকরা আমার সম্পর্কে কী জানতেন? এতকিছুরও পরে এই যে সাকসেস তা অনেকেই পছন্দ করেনি। সকলে মিলে দলবদ্ধভাবে আমাকে আক্রমণ করেছিল। কে করেনি! আজকের প্রথম সারির এক লেখক একবার রিভিউ করলেন আমার বইয়ের—নাম ‘বনবাসর’। তাতে লিখলেন—একজন লেখক এসেছেন তিনি যেখানেই জঙ্গলে যান, একজন করে বাইজি পান। তিনি বাংলা সাহিত্যের ভূগোল বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। নিজের নাম দিয়ে অবশ্য লেখেননি। অথচ আমি জীবনে এমন কাজ করিনি। নতুন প্রতিভাবান লেখকদের উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করেছি। স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ‘চতুষ্পাঠী’ উপন্যাস মনে পড়ছে? আমি তো পড়ে তাজ্জব। খোঁজ করতে শুরু করলাম। কে এমন ক্ষমতাবান লেখক? জানলাম পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, আকাশবাণীতে কাজ করেন। দেবেশ রায়ের ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ আমি বেশ কিছু কিনে পড়িয়েছি অন্যদের। স্বপ্নময়কে আর তো লেখানোই হয় না। সুযোগ পেল কই ছেলেটি? কত বড়ো চক্রান্ত বলো। মহাশ্বেতা দেবীও বলতেন—এবার কেউ লিখতে বলল না, জানিস। অবশ্য কাগজওয়ালারা বলেন, মহাশ্বেতার লেখা তেমন কেউ পড়তে চান না। সত্যি-মিথ্যে জানি না। স্বপ্নময় কিছুদিন পর বদলি হয়ে গেল কেওনঝড়ে। আমি ওকে বললাম—এটা আশীর্বাদ বলতে পারো। ওখানে গিয়ে লেখো। কী আসাধারণ উপন্যাস লিখল তার পর।
বাবা বলতেন, মানুষকে বাদ দিয়ে কিছু হয় না। আমাকে দামি ক্যামেরা কিনে দিয়েছিলেন রোলিফ্লেক্স, কনটাক্স। একটা ভালো ছবি তুলেছি একবার। সমুদ্রপাড়ে। খুব সুন্দর দৃশ্যটা। বাবা দেখে বললেন, প্রকৃতির ছবি—কিন্তু মানুষ কই? জেলে নিয়ে, মাঝি নিয়ে তোলো। আচ্ছা প্রকৃতি আগে না মানুষ? মানুষকে বাদ দিয়ে প্রকৃতি হয় না। বিভূতিভূষণ ‘আরণ্যক’ উপন্যাস যদি শুধু প্রকৃতিকে নিয়ে লিখতেন তাহলে কি এরকম হত?
Jean Stein Vanden Hevrel-এর নেওয়া প্রবাদপ্রতিম লেখক Wiliam Faulkner-এর বিখ্যাত সেই ইন্টারভিউ-এর একটি প্রশ্ন ছিল এইরকম—Is there any possible formula to follow in order to be a good novelist? ফকনার তার উত্তরে বললেন, Ninety-nine percent talent …99 percent work. He must never be satisfied with what he does. আপনি কী মনে করেন এ-প্রসঙ্গে?
আমি বলব, জিনিয়াস ইস নাইনটি-নাইন পারসেন্ট পার্সপিরেশন অ্যাণ্ড ওয়ান পারসেন্ট ইনস্পিরেশন।
পিকাসো জিনিয়াস ছিলেন—ঠিককথা। তবে তিনি কি পরিশ্রম করেননি? কতদিন তাঁর গেছে কাজ করে—না খেয়ে-দেয়ে। কত কষ্ট করেছেন। হুসেনকে দেখো-না। বাঁশের ওপর বসে সিনেমার পোস্টার আঁকতেন। তার পর? কতবড়ো শিল্পী হয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের আজ বড়ো দৈন্য। লেখকদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। জানার ঘরই তো শূন্য। কতটুকু অভিজ্ঞতা আছে একালের লেখকদের? এ-প্রজন্মের লেখকরা এখন ওপর-তলা নিয়ন্ত্রিত। সবরকম বদমাইশির বিরুদ্ধে টিকে আছি কেন? প্রকাশকরা বলছেন, ‘আপনার জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে’ সে তো অভিজ্ঞতার জন্য। জীবনে কী পেলাম, না পেলাম, তা নিয়ে আর ভাবি না। আমাকে ‘আকাদেমি’ পুরস্কার দেয়নি, ‘রবীন্দ্র’ পুরস্কার দেয়নি—তাতে কী গেল এল?
ঈশ্বর চওড়া কাঁধ দিয়ে কাউকে পাঠান, অন্যের ভার বইবার জন্য। জীবনে বরাবর সেটাই বিশ্বাস করে এসেছি।
একজন লেখকের সবচেয়ে আগে দরকার ‘ভালোমানুষ’ হওয়া। তার বেসিক এলিমেন্টগুলি ভালো হওয়া দরকার। তাকে সৎ হতে হবে। যদি কেউ চাঁদে বাস করে তাহলেও একথা সত্যি। সেখানে যদি সে প্রেমের গল্প লেখে তা হলেও তাকে সেই বেসিক ইমোশনগুলির কথা ভাবতে হবে। সেখানেও তার বেসিক এলিমেন্টগুলি একই থাকবে।
আর একটা কথা মনে হয় এখন—হতাশা মানুষের মধ্যে কেবল ব্যর্থতা থেকেই আসে না। সাফল্য থেকেও আসে। আর্থিক সাফল্য যতই থাক, চালাকি করে বড়ো হলে বা পুরস্কার পেলে, পাঁচ কোটি টাকা রোজগার করলে, নেপথ্যে একটা যন্ত্রণা থাকে আর সেখান থেকেই জন্ম নেয় ‘হতাশা’। হেমিংওয়ে বলতেন, প্রতিটি ঘটনাই তোমার জীবনে সত্যি। জীবনকে একটা বড়ো স্ফিয়ারের মধ্যে দেখতে হয়। লেখকের জীবনের কোনো কিছুই, কোনো অভিজ্ঞতাই ব্যর্থ যায় না। যদি কেউ লাথি মারে বা চুমু খায় তাহলে দুটোরই সমান মূল্য আছে। হেমিংওয়ে নোবেল পেলেন, তখন ওঁকে জিজ্ঞেস করা হল, কবে রিটায়ার করছেন। হেমিংওয়ে বললেন, একজন লেখক কখনো রিটায়ার করেন না। তার পর ওঁকে জিজ্ঞেস করা হল, তুমি যা-সব লেখো তা কি সত্যি? চরিত্রগুলি সত্যি? উত্তর দিলেন, কোথাও সত্যি চল্লিশ শতাংশ কোথাও কুড়ি শতাংশ। যেটা ভালো লেখা সেটার পটভূমি কী—তা বড়ো নয়। সেটা ভালো লেখা সেটাই বড়ো কথা যেখানে খুশি লেখো না কেন—যন্ত্রণা-দুঃখ ভালোবাসা হতাশা সব ক-টি একইরকম থাকে।
‘ফর হুম দ্য বেল টোলস’-এর ভূমিকায় আছে,
ফর হুম দ্য বেল টোলস
দ্য বেল টোলস ফর দি
এভরি ডে ডিমিনিসেস মি…
ঘণ্টাটা বাজছে। আমারই জন্য বাজছে।
আমার পাঠক-পাঠিকারা নিরন্তর আমাকে বলছেন—আপনাকে আমাদের জন্য বাঁচতে হবে। কেন আপনার শরীর খারাপ? আমাদের জন্য আরও লিখুন, সুস্থ থাকুন। পাঠক-পাঠিকাদের জন্যই আমাকে বাঁচতে হবে—লিখতে হবে। লেখকের কোনো রিটায়ারমেন্ট নেই। আমি এখনও ফুরিয়ে যাইনি।
সাক্ষাৎকার : কল্যাণ মৈত্র