আমাকে দেখুন – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
দয়া করে আমাকে একবার দেখুন। এই যে আমি এখানে। একটু আগে আমি বাসের পা-দানিতে ঠেলে-ঠুলে উঠলাম, তারপর নিরেট জমাট ভিড়ের ভিতরে আমি এ-বগল সে-বগলের তলা দিয়ে, এর-ওর পায়ের ফোকর দিয়ে ঠিক ইঁদুরের মতো একটা গর্ত কেটে কেটেএত দূর চলে এসেছি। বাসের রডগুলো বড় উঁচুতে—আমি বেঁটে মানুষ—অত দূর নাগাল পাই না। আমি সিটের পিছন দিক ধরে দাঁড়াই, তারপর গা ছেড়ে দিই। বাসের ঝাঁকুনিতে যখন আমি দোল খাই, আশেপাশের মানুষের গায়ে ভর দিয়ে টাল সামলাই, তখন আমার আশেপাশের লোক কেউ খুব একটা রাগ করে না। কারণ আমার ওজন এত কম যে, কারো গায়ে ঢলে পড়লেও সে আমার ভার বা ধাক্কা টেরই পায় না। হ্যাঁ, এখন আমি বাসের পিছন দিকটায় একটা সিট চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছি। আমার দুধারে পাহাড়ের মতো উঁচু উঁচু সব মানুষ। তারা আমাকে এত ঢেকে আছে যে, বোধ হয় আমাকে দেখাই যাচ্ছে না। কিংবা দেখলেও লক্ষ করছে না কেউ। ঐটাই মুশকিল। আমাকে অনেকেই দেখে, কিন্তু লক্ষ করে না। এখন আমি যার পাশে দাঁড়িয়ে আছি, কিংবা যার মুখোমুখি তারা আমাকে হয়তো দেখছে, কিন্তু নির্লিপ্ত ভাবে। যেন আমি না থাকলেও কোনো ক্ষতি বা লাভ ছিল না। তার কারণ বোধ হয় এই যে আমার চেহারায় এমন কিছু নেই, যাতে আমাকে আলাদা করে চেনা যায়। হ্যাঁ মশাই, আমি মাত্র পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি লম্বা, রোগাই তবে খুব রোগা নয় যেটা চোখে লাগে, কালোই তবে খুব কালো নয় যে আর একবার তাকিয়ে দেখবে কেউ। চল্লিশ বছরের পর আমার মাথা ক্রমে ফাঁকা হয়ে চুল পাতলা হয়ে এসেছে অথচ টাকও পড়েনি—টেকো মানুষকেও কেউ কেউ দেখে। তার ওপর আমার মুখখানা—সেটা না খুব কুচ্ছিত না সুন্দর—আমার নাক থ্যাবড়া নয় চোখাও নয়, চোখ বড়ও নয় আবার কুতকুতেও নয়। কাজেই এই যে এখন ভিড়ের মধ্যে আমি দাঁড়িয়ে আছি—দুধারে উঁচু উঁচু মানুষ—এই ভিড়ের মধ্যে কেউ কি আমাকে দেখছেন? দেখছেন না, কিংবা দেখলেও লক্ষ করছেন না—আমি জানি।
আমার বিয়ের পর একটা খুব মর্মান্তিক মজার ঘটনা ঘটেছিল। বউভাতের দুই-একদিন পর আমি আমার বউকে নিয়ে একটু বাজার করতে বেরিয়েছিলাম। আর কয়েকদিন পরই দ্বিরাগমনে শ্বশুরবাড়ি যাবো, সেই কারণেই কিছু নমস্কারীর কাপড়-চোপড় কেনা দরকার ছিল। রাস্তায় বেরিয়ে আমি আমার বউকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘নিউ মার্কেটে যাবে?’ আমার যা অবস্থা তাতে নিউ মার্কেটে বাজার করার কোনো অর্থ হয় না, বরাবর আমরা বাসার কাছে কাটারায় সস্তায় কাপড়-চোপড় কিনি। তবু যে আমি এই কথা বলেছিলাম, তার এক নম্বর কারণ ছিল যে, আমার বউটি ছিল মফস্বলের মেয়ে, নিউ মার্কেট দেখেনি, আর দুই নম্বর কারণ হল আমার শ্বশুরবাড়ির দিকটা আমাদের তুলনায় বেশ একটু পয়সাওলা। আমি নিউ মার্কেটের কথা বললাম যাতে আমার নতুন বউটি খুশি হবে, আর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা যখন শুনবে কাপড়-চোপড় নিউ মার্কেট থেকে কেনা, তখন তাদের ভ্রূ একটু ঊর্ধ্বগামী হবে। কিন্তু ঐ নিউ মার্কেটের প্রস্তাবটাই একটা মারাত্মক ভুল হয়েছিল। কারণ ওখানে না গেলে ঘটনাটা বোধহয় ঘটতই না। ব্যাপারটা হয়েছিল কি নিউ মার্কেটে ঢোকার পর ঝলমলে দোকান-পশার দেখে আমার বউ মুগ্ধ হয়ে গেল। যে-কোনো দোকানের সামনেই দাঁড়ায়, তারপর শো-কেসে চোখ রেখে এক-পা এক-পা করে হাঁটে। আমার দিকে তাকাতেও ভুলে গেল। তখন আমার নতুন বউ, কাজেই আমার অভিমান হওয়া স্বাভাবিক। আমি তাকে এটা-ওটা দেখিয়ে একটু মাতব্বরির চেষ্টা করলাম বটে, কিন্তু সে বিশেষ কোনো জিনিসের দিকে মনোযোগ না দিয়ে সব কিছুই দেখতে লাগল। অভিমানটা একটু প্রবল হতেই এক সময়ে আমি ইচ্ছে করেই হাঁটার গতি খুব কমিয়ে দিলাম, কিন্তু বউ সেটা লক্ষ না করে নিজের মনে হেঁটে যেতে লাগল। তাই দেখে এক সময়ে আমি একদম থেমে গেলাম। কিন্তু বউ হাঁটতে লাগল। দোকান-পশারের দিকে তার বিহ্বল চোখ, আর গার্ড অফ অনার দেওয়ার সময়ে সোলজাররা যেমন হাঁটে, তেমনি তার হাঁটার ভঙ্গি। আমি দূর থেকে দেখতে লাগলাম আমার বউ সেই ঝলমলে আলোর মধ্যে, লোকজনের ভিড় ঠেলে একা হেঁটে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে সে কথাও বলছিল বটে আমি তার সঙ্গেই আছি ভেবে, কিন্তু সত্যিই আছি কি না তা সে লক্ষ করল না। এইভাবে বেশ কিছু দূর এগিয়ে যাওয়ার পর সে কী একটা জিনিস দেখে খুব উত্তেজিতভাবে আমাকে দেখানোর জন্য মুখ ফিরিয়ে আমাকে খুঁজতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। চারদিকে চেয়ে আকুল হয়ে খুঁজতে লাগল আমাকে। তখনই মজা করার একটা লোভ আমি আর সামলাতে পারলাম না। নিউ মার্কেটে যে গোলকধাঁধার মতো গলিগুলো আছে, তার মধ্যে যেটা আমার সামনে ছিল আমি চট করে তার মধ্যে ঢুকে গেলাম। এবার মফস্বলের মেয়েটা খুঁজুক আমাকে। যেমন সে আমাকে লক্ষ করছিল না, তেমন বুঝুক মজা। আমি আপনমনে হাসলাম, আর উঁকি মেরে দেখলাম আমার বউটা কান্নামুখে চারদিকে চাইতে চাইতে ফিরে আসছে দ্রুত পায়ে। আমার একটু কষ্ট হল ওর মুখ দেখে, তবু আর একটু খেলিয়ে ধরা দেবো বলে আমি গলির মধ্যে ঢুকে গেলাম। আর ও দিশেহারার মতো এদিক-ওদিক অনেকবার হাঁটল, এ-গলি সে-গলিতে খুঁজতে লাগল আমাকে। আমি ওকে চোখে চোখেই রাখছিলাম। এক সময়ে বুঝতে পারলাম যে, এবার আমাকে না পেলে ও কেঁদেই ফেলবে—এমন করুণ হয়ে গেছে ওর মুখশ্রী। চোখ দুটোও ছলছলে আর লাল হয়ে গিয়েছিল। তাই এক সময় ও যে গলিটাতে হেঁটে যাচ্ছিল, আমি পা চালিয়ে অন্য পথে গিয়ে সে গলিটার উল্টো দিক দিয়ে ঢুকলাম। তারপর হাসি-হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। বিপরীত দিক থেকে ও হেঁটে এল, ঠিক মুখোমুখি দেখা হল আমাদের, এমনকি ও আমার এক ফুট দূরত্বের ভিতর দিয়ে হেঁটে গেল, তবু আমাকে চিনতে পারল না। খুব অবাক হলাম আমি—ও কি আমাকে দেখেনি? আবার আমি অন্যপথে তাড়াতাড়ি গিয়ে অন্য এক গলিতে একটা কাঁচের বাসনের দোকানের সামনে কড়া আলোয় দাঁড়ালাম। ঠিক তেমনি ও উল্টোদিক থেকে হেঁটে এল, চার দিকের লোকজনকে লক্ষ করল, আমার চোখে ওর চোখ পড়ল, কিন্তু আবার আমাকে পেরিয়ে গেল ও, এমনকি পেরিয়ে গিয়ে এর পিছু ফিরেও দেখল না। এরকম কয়েকবার আমাদের দেখা হল—কখনো বইয়ের দোকানের সামনে, কখনো ফলের দোকান কিংবা পুতুলের দোকানের সারিতে। কিন্তু ও আমাকে কোনোবারই চিনতে পারল না, উদ্ভ্রান্তভাবে আমাকে খুঁজতে খুঁজতে আমাকেই পেরিয়ে গেল। তখন আমি ভাবলাম মফস্বলের এই মেয়েটা খুব ঘড়েল, আমি ইচ্ছে করে লুকিয়ে ছিলাম বুঝতে পেরে এখন ইচ্ছে করেই চিনতে চাইছে না। কিন্তু ওর মুখের করুণ, এবং ক্রমে করুণতর অবস্থা দেখে সে কথাটা সত্যি বলে মনে হচ্ছিল না। তবু আমি অবশেষে একটা ঘড়ির দোকানের সামনে ওর রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে গেলাম। বললাম—এই যে! ও ভীষণ চমকে গিয়ে অবাক হয়ে আমাকে দেখল। বেশ কিছুক্ষণ দেখে-টেখে তারপর ভীষণ জোরে শ্বাস ফেলে কেঁপে কেঁপে হেসে বলল—তুমি! তুমি! কোথায় ছিলে তুমি! আমি কতক্ষণ তোমাকে খুঁজছি! আশ্চর্য এই যে তখন আমার মনে হল ও সত্যি কথাই বলছে। বাসায় ফেরার সময়ে ওকে আমি বললাম যে, ওর সঙ্গে ঐ লুকোচুরি খেলার সময়ে আমি বারবার ওকে ধরার সুযোগ দিয়েছি, ওর সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। ও প্রথমটায় বিশ্বাস করল না, কিন্তু আমি বারবার বলাতে ও খুব অবাক হয়ে বলল—সত্যি! তাহলে তুমি আর কখনো লুকিও না। এরকম করাটা বিপজ্জনক।
বেঁধে ভাই কণ্ডাক্টর, এইখানেই আমি নেমে যাবো… দেখি দাদা…দেখবেন ভাই, আমার চশমাটা সামলে, ঐ দেখুন, কেউ আমার কথা শুনল না। আমি নামার আগেই কণ্ডাক্টর বাস ছাড়ার ঘণ্টি দিয়ে দিল, গেট আটকে ধুমসোমতো লোকটা অনড় হয়েই রইল, আর হাওয়াই শার্ট পরা ছোকরাটা কনুইয়ের গুঁতোয় চশমাটা দিলে বেঁকিয়ে। তাই বলছিলাম যে, কেউই আমাকে লক্ষ করে না, বাসে-ট্রামে না, রাস্তায়-ঘাটে না।
আজকের দিনটা বেশ ভালই। ফুরফুরে হাওয়া আর রোদ দিয়ে মাখামাখি একটা আদুরে আদুরে গা-ঘেঁষা দিন। শরৎকাল বলে গরমটা খুবই নিস্তেজ। এখন এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে আমার বেশ ভালই লাগছে। ঐ তো একটু দূরেই একটা ক্রসিং, আর তারপরেই আমার অফিস। এই দেখ, আমি ক্রসিংটার কাছে এসে রাস্তা পেরোবার জন্য পা বাড়াতেই ট্রাফিক পুলিশ হাত নামিয়ে নিল, আমার পার হওয়ার রাস্তাটা আটকে এখন চলন্ত গাড়ি আর গাড়ি। কেন ভাই ট্রাফিক পুলিশ, আমি যে রাস্তা পেরোচ্ছি, তা কি দেখতে পাওনি? আর একটু হাতখানা তুলে রাখলে কি হাতখানা ভেরে যেত?
যে লিফটে দাঁড়িয়ে আমি দোতলায় উঠছি এই লিফটটা বোধ হয় এক শো বছরের পুরনো। এর চারদিকে কালো লোহার গ্রিল—ঠিক একখানা খোলামেলা খাঁচার মতো, মাঝে মাঝে একটু কাঁপে, আর খুব ধীরে ধীরে ওঠে। গত তেরো বছর ধরে আমি, এই লিফট বেয়ে উঠছি, এই তেরো বছর ধরে আমাকে সপ্তাহে দুদিন লিফটম্যান রামস্বরূপ আভোগী ওপরে তুলছে। কী বলো ভাই রামস্বরূপ, তুমি তো আমাকে বেশ ছোটোটিই দেখেছিলে—যখন আমার বয়স ছাব্বিশ কি সাতাশ, যখন আমার ভাল করে বুড়োটে ছাপ পড়েনি মুখে! এখন বলো তো আমার নামটা কী! যদি সত্যিই জিজ্ঞেস করি, তাহলে এক্ষুনি রামস্বরূপ হাঁ-হাঁ করে হেসে উঠে বলবে—আরে জরুর, আপনি তো অরবিন্দবাবু। কিন্তু মোটেই তা নয়। কোনোকালেই আমি অরবিন্দ ছিলাম না। আমি চিরকাল—সেই ছেলেবেলা থেকেই অরিন্দম বসু।
আমার চাকরি ব্যাঙ্কে। দোতলায় আমার অফিস। আগে আমি অন্যান্য ডিপার্টমেন্টে ছিলাম, গত দশ বছর ধরে আমি বসছি ক্যাশ-এ। আমি খুব চটপট টাকা গুনতে পারি, হিসেবেও আমি খুব পাকা। তাই ক্যাশ থেকে আমাকে অন্য কোথাও দেওয়া হয় না। হলেও আবার ফিরিয়ে আনা হয়। দশ বছর ধরে আমি খুবই দক্ষতার সঙ্গে ক্যাশের কাজ করছি। কখনো পেমেন্টে, কখনো রিসিভিঙে। পেমেণ্টেই বেশি, কারণ ওখানেই সবচেয়ে সতর্ক লোকের দরকার হয়। একটা তারের খাঁচার মধ্যে আমি বসি, আমার বুকের কাছে থাকে অনেক খোপওলা একটা ড্রয়ার। তার কোনটায় কত টাকার নোট, আর কোনটায় কোন্ খুচরো পয়সা রয়েছে, তা আমি নির্ভুলভাবে চোখ বুজে বলে দিতে পারি। পেমেণ্টের সময়ে আমি ড্রয়ার খুলে গুনে টাকা বের করি, তারপর ড্রয়ার বন্ধ করি, তারপর আবার গুনি, আবার… তারপর টাকা দিয়ে পরের পেমেণ্টের জন্য হাত বাড়াই, টোকেন নিয়ে আবার ড্রয়ার খুলি, টাকা বের করি গুনে…তারপর একইভাবে চলতে থাকে। সামনের ঘুলঘুলিটা দিয়ে যারা আমাকে দেখে তাদের সম্ভবত খুবই ক্লান্তিকর লাগে আমার ব্যবহার—ইস্ লোকটা কী একঘেয়েভাবে কাজ করছে—কী একঘেয়ে! ঘুলঘুলি দিয়ে তারা আমাকে দেখে, কিন্তু মনে রাখে না। রামবাবু আমাদের পুরনো বড় খদ্দের—প্রকাণ্ড কারখানা আছে, এজেন্টও তাকে খাতির করে। খুব খুঁতখুঁতে লোক, বেশিরভাগ সময়েই লোক না পাঠিয়ে নিজেই এসে চেক ভাঙিয়ে নিয়ে যান। আমি কতবার তাঁকে পেমেন্ট দিয়েছি, তিনি ঘুলঘুলি দিয়ে প্রসন্ন হাসিমুখে ধন্যবাদ দিয়েছেন। একবার আমার বড় শালা কলকাতায় বেড়াতে এসে অনেক টাকা উড়িয়েছিল। সেবার সে আমাকে নিয়ে যায় পার্ক স্ট্রিটের বড় একটা রেস্তরাঁয়। সেখানে গিয়ে দেখি রামবাবু! একা বসে আছেন হাতে সাদা স্বচ্ছ জিন্, খুব স্বপ্নালু চোখ। সত্যি বলতে কী, আমি ভাগ্যোন্নতির কথা বড় একটা ভাবি না। অন্তত সে কারণে রামবাবুর সঙ্গে দেখা করার কথা আমার মনেই হয়নি। আমি পুরনো চেনা লোক দেখে এগিয়ে গিয়েছিলাম। রামবাবু ভ্রূ তুলে বললেন— কোথায় দেখেছি বলুন তো! মনেই পড়ছে না। তখন আমার শালার সামনে ভীষণ লজ্জা করছিল আমার। লোকটা যদি সত্যিই চিনতে না পারে, যদি সত্যিই তেমন অহংকারী হয়ে থাকে লোকটা—তবে আমার বেইজ্জতি হয়ে যাবে। তখন আমি মরিয়া হয়ে আমার ব্যাঙ্কের নাম বললাম, বললাম যে আমি ক্যাশ-এ… সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার জিন্-এর মতোই স্বচ্ছ হয়ে গেল তাঁর মুখ, প্রসন্ন হেসে বললেন—চিনেছি। কী জানেন, ঐ ঘুলঘুলি আর ঐ খাঁচা, ওর মধ্যে দেখতে দেখতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি, তাই হঠাৎ এ জায়গায়… বুঝলেন না! আসল কথা হল ঐ পারসপেকটিভ—ওটা ছাড়া মানুষের আর আছেটা কী যে তাকে চেনা যাবে? ঐ খাঁচার মধ্যে ঘুলঘুলির ভিতর দিয়ে যেমন আপনি, তেমনি দেখুন এই কোট-প্যান্ট-টাই আর টাক মাথা—এর মধ্যে দিয়ে আমি। এসব থেকে যদি আলাদা করে নেন, তবে দেখবেন আপনি আর আমি—আমাদের কোনো সত্যিকারের পরিচয়ই নেই। এই দেখুন না, একটু আগেই আমি পারসপেকটিভের কথাই ভাবছিলাম। ছেলেবেলায় আমরা থাকতাম রেলকলোনিতে। আমার বাবার ছিল টালিক্লার্কের চাকরি। কাটিহারে আমাদের রেল কোয়ার্টারে প্রায়ই পাশের বাড়ি থেকে একটি মেয়ে আসত, তার সৎমা বলে বাসায় আদর ছিল না। আমাদের বাসায় রান্নাঘরে উনুনের ধারে আমার মায়ের পাশটিতে সে এসে মাঝে মাঝে বসত। জড়োসড়ো হয়ে, ছেড়া ফ্রকে হাঁটু ঢেকে পরোটা বেলে দিত, কখনো আমার কাঁদুনে ছোটো বোনটাকে কোলে করে ঘুরে ঘুরে ঘুম পাড়াতো। মা আমাকে বলত—ওর সঙ্গে তোর বিয়ে দেবো। সেই শুনে সেই মেয়েটাকে আমি ভাল করে দেখতাম—আর কী যে নেশা লেগে যেত। কী করুণ, কৃশ, খড়িওঠা মুখখানা—আর কী তিরতিরে সুন্দর। যেন পৃথিবীতে বেশিদিন থাকবে বলে ও আসে নি। রামবাবু এটুকু বলেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন, আর আমি ব্যগ্র হয়ে জিজ্ঞেস করলাম—তারপর কী হল, সে কি মরে গেল? রামবাবু মাথা নাড়লেন—না, না, মরবে কেন! তাকে আমি বিয়ে করেছি বড় হয়ে। সে এখনো আমার বউ। ইয়া পেল্লায় মোটা হয়ে গেছে, বদমেজাজী, আমাকে খুব শাসনে রাখে। কিন্তু যখন দেখি ফ্রিজ খুলছে, গয়না হাঁটকাচ্ছে, চাকরদের বকছে কিংবা শোফারকে বলছে গাড়ি বের করতে, তখন কিছুতেই বিশ্বাস হয় না যে এ সেই। সেই বেলী—যার অসুখের সময় মা দুটো কমলালেবু দিয়ে এসেছিল বলে এক গাল হেসেছিল। আজ দেখুন, খুব ঝগড়া করে বেরিয়েছি ওর সঙ্গে। মনটা খিঁচড়ে ছিল—সেই ভালবাসা কোথায় উবে গেছে এখন। কিন্তু এখানে নির্জনে বসে সেই পুরনো দিন, উনুনের ধারে বসে থাকা, ছেঁড়া ফ্রকে হাঁটু ঢেকে ওর বসার ভঙ্গি মনে পড়ে গেল। মনে পড়ল আমার মায়ের মুখ—সে মুখ বড় মায়া-মমতায় ওর বসার দীন ভঙ্গিটুকু চেয়ে দেখছে। অমনি আবার এখন ভালবাসায় আমার মন ভরে উঠেছে। বাসায় ফিরে গিয়েই এখন ওর রাগ ভাঙাবো। বুঝলেন না… বলে রামবাবু সেই সাদা স্বচ্ছ জিন্ মুখে নিয়ে হাসলেন, বললেন—ঐ যে ঘুলঘুলিটা—যেটার ভিতর দিয়ে আপনাকে দেখি সেটাই আসল—ঐ ঘুলঘুলিটা…
এই যে তেইশ-চব্বিশ বছর বয়সের ছেলেটা এখন পেমেন্টের জন্য দাঁড়িয়ে আছে, পিতলের টোকেনটা ঠুক টুক করে অন্যমনস্ক ভাবে ঠুকছে কাউণ্টারের কাঠ, ও আমাকে চেনে। ওর বাবার আছে পুরনো গাড়ি কেনাবেচার ব্যবসা। আগে ওর বাবা আসত আজকাল ও আসছে ব্যাঙ্কে। মাঝেমধ্যে চোখে চোখ পড়লে আমি হেসে জিজ্ঞেস করি—কী, বাবা ভাল তো! ও খুশি হয়ে ঘাড় কাত করে বলে—হ্যাঁ—। কিন্তু আমার সন্দেহ হয় যে, একদিন যদি হঠাৎ করে এখান থেকে আমাকে সরিয়ে নেওয়া হয়, এবং মোটামুটি সাধারণ চেহারার কোনো লোককে বসিয়ে দেওয়া হয় এ জায়গায়, তবে ও বুঝতেই পারবে না তফাতটা। তখনো ও অন্যমনস্কভাবে পিতলের টোকেনটা ঠুকবে কাঠের কাউণ্টারে, অন্যমনস্কভাবে চেয়ে থাকবে, চোখে চোখ পড়লে সেই নতুন লোকটার দিকে চেয়ে পরিচিতের মতো একটু হাসবে। ভুলটা ধরা পড়তে একটু সময় লাগবে ওর। কারণ, ও তো সত্যিই কখনো আমাকে দেখে না। ও হয়তো ওর নতুন প্রেমিকাটির কথা ভাবছে এখন, ভাবছে শিগগিরই ও একটা স্কুটার কিনবে। ও ঘাড় ফিরিয়ে রিসেপশনের মেয়েটির দিকে কয়েক পলক তাকাল, তারপর ঘড়ি দেখল। একবার টোকেনটার নম্বর দেখে নিল, ঘুলঘুলির ভিতর দিয়ে দেখল আমার দু’খানা হাত ক্লান্তিকরভাবে মোটা একগোছা টাকা গুনছে। ও আমার মুখটা একপলক দেখেই চোখটা ফিরিয়ে নিল। কিন্তু আমি জানি যে ও আমাকে দেখল না। আর পনেরো মিনিট পরেই দুটো বাজবে। তখন আমি ক্যাশ বন্ধ করে নিচে যাবো টিফিন করতে। তখন যদি ও আমাকে রাস্তায় দেখতে পায়, আমি ফুটপাথের দোকানে দাঁড়িয়ে থিন অ্যারারুট আর ভাঁড়ের চা খাচ্ছি, তখন কি আমাকে চিনবে ও।
কলা কত করে হে? চল্লিশ পয়সা জোড়া—বলো কী? হ্যাঁ, হ্যাঁ, মর্তমান যে তা আমি জানি, মর্তমান কি আমি চিনি না? ঐ সুন্দর হলুদ রঙ, মসৃণ গা, প্রকাণ্ড চেহারা—মর্তমান দেখলেই চেনা যায়। তা আজ অবশ্য আমার কলা খাওয়ার তারিখ নয়। গতকালই তো খেয়েছি। আমি দু-দিন পর পর কলা খাই। দাও একটা। না, না ঐ একটাই—এই যে কুড়ি পয়সা ভাই। আহা বেশ কলা। চমৎকার। খাওয়া হয়ে যাওয়ার পরও আমি অনেকক্ষণ খোসাটা হাতের মুঠোয় ধরে রইলাম স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে। দশ-পনেরো মিনিট একটু এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ালাম। কলার খোসাটা আমার হাতেই ধরা। আমার চারপাশেই নিরুত্তেজিতভাবে লোকজন হেঁটে যাচ্ছে। খুবই নির্বিকার তাদের মুখচোখ। এরা কখনো যুদ্ধবিগ্রহ করেনি, দেশ বা জাতির জন্য প্রাণ দিতে হয়নি এদের, এমনকি খুব কঠিন কোনো কাজও এরা সমাধা করেনি সবাই মিলে। জাতটা মরে আসছে আস্তে আস্তে, অন্তর্ভাবনায় মগ্ন হয়ে হাঁটছে চলছে—একে অন্যের সম্পর্কে নিস্পৃহ থেকে। এদের সময়ের জ্ঞান নেই—উনিশ শো উনসত্তর বলতে এরা একটা সংখ্যা মাত্র বোঝে, দু’ হাজার বছরের ইতিহাস বোঝে না। এদের কাছে ‘টেলিপ্যাথি’ কিংবা ‘ক্রীক রো’ যেমন শব্দ, ‘ভারতবর্ষ’ও ঠিক তেমনি একটা শব্দ।
দয়া করে আমাকে দেখুন। এই যে আমি—অরিন্দম বসু—অরিন্দম বসু—এই যে না-লম্বা না-রোগা না-ফর্সা একজন লোক। আমি টেলিপ্যাথি নই, ক্রীক রো নই, ভারতবর্ষও নই—ঐ শব্দগুলোর সঙ্গে অরিন্দম বসু—এই শব্দটার একটু তফাত আছে, কিন্তু তা কি আপনি কখনো ধরতে পারবেন?
যাকগে সেসব কথা। মাঝে মাঝে আমারও সন্দেহ হয়—আমি কি সত্যিই আছি? না কি, নেই? ব্যাঙ্কের ঐ ঘুলঘুলি দিয়ে লোকে হাত এগিয়ে টাকা গুনে নেয়, কেউ কেউ মৃদু হেসে ধন্যবাদ দিয়ে যায়। কিন্তু লোক বদল হলেও তারা অবিকল ঐভাবে হাত বাড়িয়ে টাকা গুনে নেবে আর কেউ কেউ ধন্যবাদ দিয়ে যাবে, খেয়ালই করবে না ঘুলঘুলির ওপাশে এক বিশাল পরিবর্তন ঘটে গেছে। সেই নিউ মার্কেটের ঘটনাটার কথাই ধরুন না—আমার বউ হেঁটে হেঁটে আমাকে খুঁজছে—আমাকে সামনে দেখে, চোখে চোখ রেখেও পেরিয়ে যাচ্ছে আমাকে, ভাবছে—কী আশ্চর্য, লোকটা গেল কোথায়!
খুব যত্নের সঙ্গে কলার খোসাটা আমি ফুটপাথের মাঝখানে রেখে দিলাম। উদাসীন মশাইরা, যদি এর ওপর কেউ পা দেন তাহলে পিছলে পড়ে যেতে যেতে আপনি হঠাৎ চমকে উঠে আপনার সম্বিৎ ফিরে পাবেন। যদি খুব বেশি চোট না পান আপনি, যদি পড়ো-পড়ো হয়েও সামলে যান, তাহলে দেখবেন আপনার মস্ত লাভ হবে। আপনি চারপাশে চেয়ে দেখবেন—কোথায় কোন্ রাস্তা দিয়ে আপনি হাঁটছেন তা মনে পড়ে যাবে—দুর্ঘটনা গুরুতর হলে আপনার হাত-পা কিংবা মাথা ভাঙতে পারত ভেবে আপনি খুব সতর্ক হয়ে যাবেন আপনার বিপজ্জনক চারপাশটার সম্বন্ধে—হয়তো আপনার ভিতরকার ঘুমন্ত আমিটা জেগে উঠে ভাববে ‘বেঁচে থাকা কত ভাল’—তখন হয়তো মানুষের সম্বন্ধে আপনি আর একটু সচেতন হয়ে উঠবেন—এবং বলা যায় না আপনার হয়তো এ কথাও মনে পড়ে যেতে পারে যে, আজ হচ্ছে উনিশ শো উনসত্তর সালের ষোলোই জুলাই—আপনার বিয়ের তারিখ, যেটা আপনি একদম ভুলে গিয়েছিলেন—এবং এই সালে আপনার বয়স চল্লিশ পার হল। তখন মশাই, ভেবে দেখবেন এই যুদ্ধ এবং বিপ্লবহীন ভারতবর্ষে একটি নিস্তেজ দুপুরে রাস্তায় কলার খোসা ফেলে রেখে আমি আপনার খুব অপকার করি নি।
আপনি কি এখন চাঁদের কথা ভাবছেন! আর তিনজন দুঃসাহসী মানুষের কথা! ভাববেন না, মশাই, ওসব ভাববেন না। কী কাজ আমাদের ওসব ভেবে! খামোখা মানুষ ওতে ভয়ঙ্কর উত্তেজিত হয়ে পড়ে আর তারপর ভীষণ অবসাদ আসে এক সময়ে! ওদের খুব ভাল যন্ত্র আছে, ওরা ঠিক চাঁদে নেমে যাবে, তারপর আবার ঠিকঠাক ফিরেও আসবে। কিন্তু সেটা ভেবে আপনি অযথা উত্তেজিত এবং অন্যমনস্ক হবেন না। রাস্তা দেখে চলুন। রাজভবনের সামনে বাঁকটা ঘুরতেই দেখুন কী সুন্দর খোলা প্রকাণ্ড ময়দান, উদোম আকাশ। কাছাকাছি যেসব মানুষগুলো হাঁটছে তাদের দেখে নিন, চিনে রাখুন যত দূর সম্ভব অন্যের মুখ—যেন যে-কোনো জায়গায় দেখা হলে আবার চিনতে পারেন। এই সুন্দর বিকেলে ময়দানের কাছাকাছি আমি আপনার পাশেই হাঁটছি—আমাকে দেখুন। এই তো আমি আমার অফিস থেকে বেরিয়েছি। একটু আগেই বেরিয়েছি আজ খেলা দেখতে যাবো বলে। মনে হচ্ছে আপনিও ঐদিকে—না?
দেখুন কী আহাম্মক ছেলেটা—অফ্সাইডে দাঁড়িয়ে সুন্দর চান্সটা নষ্ট করে দিল। আর মাত্র দশ মিনিট আছে, এখনো গোল হয়নি। আর ঐ ছেলেটা—হায়, ঈশ্বর, কে ওকে ঐ লাল-সোনালি জার্সি পরিয়েছে! ওকে বের করে দিক মাঠ থেকে। দিন তো মশাই, আপনারা চোস্ত গালাগালিতে ওর ভূত ভাগিয়ে। আমার জিভে আবার খারাপ কথাগুলো আসে না। কিন্তু দেখুন, রাগে আমারও হাত-পা কাঁপছে। আজ সকাল থেকেই চাঁদ আর তিনজন দুঃসাহসী মানুষের কথা ভেবে ভেবে আমার নার্ভগুলো অসাড় হয়ে আছে। তার ওপর দেখুন এই ফালতু টিমটা আমার দলের কাছ থেকে নিয়ে নিচ্ছে এক পয়েণ্ট। একটা পয়েণ্ট—কী সাংঘাতিক! ওদিকে আর আট কি ন’ মিনিট সময় আছে মাত্র। কী বলেন দাদা, গোল হবে? কী করে হবে! ক্ষুদে টিমটার সব খেলোয়াড় পিছিয়ে এসে দেয়াল তৈরি করছে গোলের সামনে। আর এরা খেলছে দেখুন, কে বলবে যে গোল দেওয়ার ইচ্ছে আছে? ঐ যে ছেলেটা—অফ্সাইডে দাঁড়িয়ে দিনের সবচেয়ে সহজ চান্সটাকে মাটি করে দিল—আমার ইচ্ছে করছে ওর সামনে গিয়ে বলি—এই আমাকে দেখ, আমি অরিন্দম বসু, এই টিমটাকে আমি ছেলেবেলা থেকে সাপোর্ট করে আসছি। জিতলে ঠাকুরকে ভোগ দিয়েছি, হারলে সুইসাইডের কথা ভেবেছি। তা বাপু, তুমি কি বোঝে সে সব? তুমি তো জানই না যে আমি—এই ভিড়ের মধ্যে বিশেষ একজন—কীরকম দুঃখ নিয়ে ছলছলে চোখে ঘড়ি দেখছি। অবশ্য তাতে কার কী যায় আসে! আমি কাঁদি কিংবা হাসি—কিংবা যাই করি—কেউ তো আর আমাকে দেখছে না।
না মশাই, গোল হল না। রেফারি ঐ লম্বা টানা বাঁশি বাজিয়ে দিল। খেলা শেষ। এখন দয়া করে আমাকে একবার দেখুন কীরকম অবসাদগ্রস্ত আমি,কাঁধ ভেঙে আসছে। দেখুন, আমার টিমটাকে আমি কত ভালবাসি, কিন্তু তাতে টিমের কিছু যায় আসে না। ওরা চেনেই না আমাকে। অথচ আমি প্রতিটি হারজিতের পর কত হেসেছি লাফিয়েছি কেঁদেছি চাপড়ে দিয়েছি অচেনা লোকের পিঠ। খামোখা। তাতে কারো কিছু এসে যায় না। এই যে আমি সকাল থেকে চাঁদ আর তিনজন মানুষের কথা ভেবে চিন্তান্বিত—ভাল করে ভাত খেতে পারিনি উত্তেজনায়—এতেই বা কার কী এসে যায়!
দয়া করে আমাকে একবার দেখুন। না, আমি জানি আপনি লীগ-টেবিলে আপনার টিমের অবস্থান ভেবে বিব্রত। তার ওপর চাঁদ আর সেই তিনজন মানুষের কথাও ভাবতে হচ্ছে আপনাকে! কত কিছু ঘটে যাচ্ছে পৃথিবীতে! সাড়ে উনত্রিশ ফুট লং জাম্প দিচ্ছে মানুষ, গুলিতে মারা যাচ্ছে প্রেসিডেন্ট, ভোটে হেরে যাচ্ছে আপনার দল, বিপ্লব আসতে বড় দেরি করছে। তাই আমি—অরিন্দম বসু, ব্যাঙ্কের ক্যাশ ক্লার্ক—আপনার এত কাছে থাকা সত্ত্বেও আপনি আমাকে দেখতে পাচ্ছেন না।
ঐ যে দোতলার বারান্দায় রেলিঙের ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে আমার চার বছর বয়সের ছোটো ছেলেটা—হাপু। বড় দুরন্ত ছেলে। সকাল থেকে বায়না—ধরেছে রথের মেলায় যাবো বাবা, তুমি তাড়াতাড়ি ফিরো। ঐ যে এখন দাঁড়িয়ে আছে আমার জন্য। ঝাঁকড়া চুলের নিচে জ্বলজ্বল করছে দু’খানা চোখ, আমি এত দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি।
আমি সিঁড়িতে পা দিয়েছি মাত্র, ও ওপর থেকে দুড়দাড় করে নেমে এল—ওর মা ওপর থেকে চেঁচাচ্ছে—হাপু-উ, কোথায় গেলি, ও হাপু-উ-উ। এক গাল হেসে হাপু ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রায়—কত দেরি করলে বাবা, যাবে না? হ্যাঁ মশাই, বাইরে থেকে ফিরে এলে এই আপনজনদের মধ্যে আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। কচি ছেলেটাকে আমি কোলে তুলে নিলাম। ওর গায়ে মিষ্টি একটা ঘামের গন্ধ, শীতের রোদের মতো কবোষ্ণ ওর নরম গা। মুখ ডুবিয়ে দিলে মনে হয় একটা অদৃশ্য স্নান করে নিচ্ছি যেন। বললাম—যাবো বাবা, বড় খিদে পেয়েছে, একটু বিশ্রাম করে খেয়ে নিই।
যতক্ষণ আমি বিশ্রাম করলাম ততক্ষণ হাপু আমার গায়ের সঙ্গে লেগে রইল, উত্তেজনায় বলল—শিগগির করো। ওর মা ধমক দিতেই বড় মায়ায় বললাম—আহা বোকো না, ছেলেমানুষ! আসলে ওর ঐ নেই-আঁকড়ে ভাবটুকু বড় ভাল লাগে আমার।
বড় দুরন্ত ছেলে। মেলায় পা দিয়েই হাত ছাড়িয়ে ছুটে যেতে চায়। বললাম—ওরকম করে না, হাপু, হাত ধরে থাকো, আমার হাত ধরেই তুমি ঠিকমতো মেলা দেখতে পাবে। ও কেবল এদিক-ওদিক তাকায়, তারপর ভীষণ জোরে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করে—ওটা কি বাবা! আর ওটা! আর ঐখানে! আমি ওকে দেখিয়ে দিই—ওটা নাগরদোলা। ঐটা সার্কাসের তাঁবু। আর ওটা মৃত্যুকূপ।
আস্ত একটা পাঁপড়ভাজা হাতে নাগরদোলায় উঠে গেল হাপু। ঐ যে দেখা যাচ্ছে তাকে—আকাশের কাছাকাছি উঠে হি-হি করে হেসে হাত নাড়ছে—সাঁই করে নেমে আসছে আবার—আবার উঠে যাচ্ছে—সারাক্ষণ আমার দিকে চেয়ে হাসছে হাপু। দেখে মন ভরে যায়।
মৃত্যুকূপের উঁচু প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ওকে দেখালাম দেয়াল বেয়ে ভীষণ শব্দে ঘুরে ঘুরে উঠে নেমে যাচ্ছে তীব্রবেগ মোটরসাইকেল। ও আমাকে আঁকড়ে ধরে থেকে দেখল।
তারপর আধঘণ্টার সার্কাস দেখলাম দু’জন। দুই মাথাওলা মানুষ, সিংগিং ডল, আট ফুট লম্বা লোক। হাপুর কথাবার্তা থেমে গেল। ঝলমল করতে লাগল চোখ।
বাইরে এনে ওকে ছেড়ে দিলাম। আমার পাশে পাশে ও হাঁটতে লাগল। ওর হাতে ধরা হাতটা ঘেমে গিয়েছিল বলে আমি ওর হাত ছেড়ে দিলাম।
ঐ তো ও এগিয়ে যাচ্ছে আমার হাত ছেড়ে। দোকানে সাজানো একগাদা হুইস্ল দেখছে ঝুঁকে, আবার এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় আর একটা দোকানে যেখানে এরোপ্লেনের দৌড় হচ্ছে। তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে ও এয়ারগান, আর রঙচঙে বল দেখতে দেখতে… আস্তে আস্তে পা ফেলছে…ক্রমে ভিড়ের মধ্যে চলে যাচ্ছে হাপু…আমি তখন আমার টিমটার কথা ভাবছিলাম—খামোখা একটা পয়েণ্ট নষ্ট হয়ে গেল আজ। চাঁদের দিকে চলেছে তিনজন মানুষ—ওরা কি পৌঁছুতে পারবে?
হঠাৎ খেয়াল হল, হাপুকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। ভিড়ের মধ্যে এক সেকেণ্ড আগেও ওর নীল রঙের শার্টটা আমি দেখেছি। তক্ষুনি সেটা টুপ্ করে আড়াল হয়ে গেল। ‘হাপু-উ’ বলে ডাক দিয়ে আমি ছুটে গেলাম…
হ্যাঁ মশাই, আপনারা কেউ দেখেছেন নীল জামা পরা চার বছর বয়সের একটা ছেলেকে? তার নাম হাপু, বড় দুরন্ত ছেলে। দেখেননি? ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, জুলজুলে দুটো দুষ্টু চোখ…না, না ঐ পুতুলের দোকানের সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে নয়—যদিও অনেকটা একই রকম দেখতে। না, তার চেহারার কোনো বিশেষ কিছু চিহ্ন আমার মনে পড়ছে না—খুবই সাধারণ চেহারা, অনেকটা আমার মতোই। কেবল বলতে পারি যে তার বয়স চার বছর। আর গায়ে নীল জামা। তা নীল জামা পরা অনেক ছেলে এখানে রয়েছে, চার বছর বয়সেরও অনেক। না মশাই, আমার পক্ষে ঠিকঠাক বলা সম্ভব নয় এত—এই হাজার হাজার ছেলে-মেয়ের মধ্যে ঠিক কোন্ জন—ঠিক কোন্ জন আমার হাপু—আর বোধ হয় হাপুর পক্ষেও বলা সম্ভব নয় এত জনের মধ্যে কোন্ জন—ঠিক কোন জন—বুঝলেন না, ওর মাও একবার ঠিক করতে পারেনি—। যদি হাপুকে দেখতে পান তবে ওকে একবার দয়া করে বলে দেবেন যে, এই যে আমি—এই আমিই ওর বাবা—। এই আমাকে একটু দেখে রাখুন দয়া করে—কাইন্ডলি, ভুলে যাবেন না—
১৩৭৬ (১৯৬৯)