আমরা সবাই বাম
আমি রাজনীতির কথা বলছি না, আমি সাধারণ জীবনের প্রসঙ্গে বেশ একটা ধন্দে পড়ে গেছি। রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থী আর বামপন্থীর বিভাজনে তেমন কোনও জটিলতা নেই। সংজ্ঞাটি শিশুরও বোধগম্য। কেন্দ্রে যাঁরা ক্ষমতাসীন তাঁরা দক্ষিণপন্থী। সেই ক্ষমতা থেকে যাঁরা টাল খাইয়ে ফেলে দিতে চান তাঁরা বামপন্থী। বামপন্থা মানে, প্রতিবাদ, মিছিল, ধর্মঘট, দেয়াললিখন, পথসভা, উগ্রভাষণ, কেন্দ্রের সমালোচনা। বামপন্থী মানে ক্রোধী ও উগ্রস্বভাবের একদল মানুষ, যাঁদের স্লোগান হল ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও। বামপন্থা মানে বিপ্লবহীন বিপ্লব। এক ধরনের রোমান্টিকতা। মধ্যবিত্ত অথবা উচ্চবিত্ত মানুষের ভাবনা—’আমরা সর্বহারা, আমরা শোষিত, নিপীড়িত, নিরন্ন।’ ক্ষমতার আসনে হয়তো বসে আছি। গাড়ি চাপছি। রম্য বাসস্থানে স্ত্রী, পুত্র, পরিজন নিয়ে ঈর্ষণীয়ভাবে ভালোই আছি। ছেলেমেয়েরা ভালো স্কুলে পড়ছে। সবই আছে, কিন্তু সুখ নেই মনে। এ বৈভবটুকু নিতান্তই বাইরের। মায়া। ভেতরে বসে আছে তৈলহীন, রুক্ষ এক সত্তা। সে বসে আছে ফুটপাথে, ঝুপড়িতে, শ্রমিকের ধূমলাঞ্ছিত খুপরিতে। সে দাঁড়িয়ে আছে ক্ষেতমজুরের খোলসে। সুকোমল শয্যায়, সুবাসিত স্ত্রীর পাশে শুয়েও তার মনে হচ্ছে, শুয়ে আছে চটে, কঙ্কালসার স্ত্রী খুকখুক কাশছে, এক গাদা ন্যাংলা-ন্যাংলা ছেলেমেয়ে চারপাশে উদ্যোম হয়ে পড়ে আছে। তিনটে রাস্তার ঘেয়ো কুকুর গায়ে গা লাগিয়ে ঘ্যাঁসোর-ঘ্যাঁসোর গা চুলকোচ্ছে। ঘরের ও মাথায় ফ্রিজের মটোর পর্যায়ক্রমে জাগছে আর ঘুমোচ্ছে, জানালার সুদৃশ্য পাতলা পর্দা বাতাসে উড়ছে। তবু মনে হচ্ছে কাল সকালে হাঁড়ি চড়বে তো। যদিও সাত-সকালে হাতে আসবে ফ্লেভারঅলা ভুরভুরে চা, আসবে হালকেতার ব্রেকফাস্ট। মাছের ঝোল ভাত বা চিকেন কারি। ভেতরের সত্তা সে সব গ্রহণ করবে না। সে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি নিয়ে উপবাসীই থেকে যাবে। এই আত্মিক হাহাকারই হল বামপন্থা। এই হাহাকারই তাকে রাগী করবে, উগ্র করবে, অসহিষ্ণু করবে। প্রচলিত ব্যবস্থার সমস্ত সুযোগ-সুবিধার মধ্যে থেকে, সেই ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলার কল্পনাই হল বামপন্থা। এই মনোভাব থেকেই জাগ্রত হবে বিদ্রোহী চেতনা। প্রতিষ্ঠিত সমস্ত মানুষকে মনে হবে সুবিধাভোগী শয়তান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে মনে হবে ক্রীতদাস তৈরির আখড়া। ধর্মকে মনে হবে দরিদ্রের আফিং। শ্রমপ্রতিষ্ঠানকে মনে হবে শোষণের যন্ত্র।
এই প্রেক্ষিতে কোনও দলের সক্রিয় সভ্য না হয়েও প্রায় সমস্ত যুবকই একেবারে পালটে গেছে। ‘গুডি গুডি বয়’রা আর নেই। পারিবারিক সমস্ত প্রকার শাসন একালে অচল। কোনও কিছুর কাছে নতি স্বীকার করাটা অগৌরবের, অপমানের। একালের প্রবীণ পিতামাতারা সেই কারণে পুরাকালের দাপট একেবারেই হারিয়ে ফেলেছেন। সংসারে, সমাজে তাঁরা এখন ঘৃণিত দক্ষিণপন্থী। তাঁরা হলেন সদাসমালোচিত কেন্দ্রের মতো। পুত্ররা হলেন পুরোপুরি বামপন্থী। বাইরেটা ভাঙতে না পারলেও, ভেতরটা তাঁরা সাফল্যের সঙ্গেই ভেঙে ফেলেছেন। প্রকৃত-বিপ্লব পরিবারে-পরিবারেই ঘটে গেছে। ধীরে। সবার অলক্ষ্যে। একালের যুবকদের কোনও অভিভাবক নেই। কারও কাছে কোনও রকমের বশ্যতা স্বীকারের মানসিকতাও তাঁরা হারিয়ে ফেলেছেন। পরিবারও এক ইনস্টিউটিশান। প্রতিষ্ঠানের দাসত্বে তাঁদের অপরিসীম ঘৃণা। গুরুজনরা তাঁদের চোখে পেটমোটা, হলহলে বুর্জোয়ার মতো। ভোগী, লম্পট, মাথামোটার দল। পাপাচারে আসক্ত একদল শাসক-শাসক প্রতিনিধি। অকারণে ক্ষমতার ছড়ি ঘোরাচ্ছে পদাধিকারবলে। আদেশ, কি উপদেশ, দুটো শব্দই একালে এক ধরনের গর্ভশূন্য, বাঁজা বাতুলতা। ব্যবলিং ফুলস-এর দল। পেটের ওপর লুঙ্গি বেঁধে, দিবারাত্র পানের পিকের মতো উপদেশের পিচকিরি মারছে। সেকালের যুবকদের একটা চক্ষুলজ্জা ছিল। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না আসা পর্যন্ত তাঁরা পরিবারের প্রভুত্ব মেনে নিতেন। ‘ভাসাল স্টেট’-এর মতো। তাঁদের প্রায়ই এই রকম কথা শুনতে হত, ‘আগে লেখাপড়া শিখে, চাকরি-বাকরি করো, নিজের পায়ে দাঁড়াও, তারপর নিজের মত খাটাতে এস।’ একালের যুবকেরা সরাসরি বলে বসবেন, ‘ফূর্তির সময় মনে ছিল না যে আমরা আসতে পারি। আমরা নিজের ইচ্ছায় যখন আসিনি, তখন আমাদের ম্যাও সামলাতেই হবে।’ স্টেট আর ফ্যামিলি এখন এক হয়ে গেছে। স্টেটের কারবার বহুকে নিয়ে, ফ্যামিলির কারবার কয়েকজনকে নিয়ে। ‘প্রাোডাকটিভ’, ‘নন-প্রাোডাকটিভ’ সমস্ত নাগরিককে পালনের দায়িত্ব যেন সরকারের, সেই রকম বিনীত, দুর্বিনীত, বাধ্য, অবাধ্য সমস্ত সন্তানের প্রতিপালনের দায়িত্ব পরিবারের কর্তার। প্রতিপালন মানে সন্ন্যাস আশ্রমের কায়দায় নয়। ছাত্রাণাম অধ্যয়নং তপ: বলে, মোটা জামা, মোটা কাপড়, ডাল ভাতের ব্যবস্থা নয়। তোমারও যদি সিল্কের পাঞ্জাবি, সোনার বোতাম হয়, তাহলে আমারও ওই একই ব্যবস্থা করতে হবে। তুমি ছাত্র, তুমি বেকার বলে, কোনও দুই দুই চলবে না। আগে ছিল কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। একালে কর্তা নেই, সবাই কমরেড। এই হল আমার দাবি, আমাদের ‘মাঙ্গ’। কাঁদুনি গেয়ে পার পাবার উপায় নেই।
রাজনীতির বামপন্থায় আমরা কী দেখেছি! শ্রদ্ধেয়কে অশ্রদ্ধা করা। মুখে প্রকাশ না করলেও, মনে-মনে বলা, কে হে তুমি হরিদাস পাল। যে সময় সরকারি, বেসরকারি, প্রতিষ্ঠানে কথায়-কথায় ঘেরাও চলছে, তখন এ দৃশ্য আমার চোখে পড়েছে, সম্মানিত, সুপণ্ডিত, কর্মপটু দফতর অধিকর্তা ঘেরাও হয়ে বসে আছেন। বিপরীত দিকের চেয়ারে বসে আছেন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা। জুতোসুদ্ধু ঠ্যাং তুলে দিয়েছেন টেবিলে। মুখে সিগারেট। সেই ঠ্যাং আবার নাচছে? পেছনে একদল দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁরা পালা করে মাথায় চাঁটি মারছেন। গালে ঠোনা। আর চতুর্দিক থেকে বর্ষিত হচ্ছে অশ্লীল বাক্য।
এই মডেলটিই পরে গৃহীত হল যুবকদের দ্বারা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঘন-ঘন ঘটতে লাগল অনুরূপ ঘটনা। অধ্যক্ষের কাছা খোলা, চশমা কেড়ে নেওয়া, উপাচার্যকে ল্যাং মারা। এই সব উপাদেয় ঘটনাই হয়ে দাঁড়াল যৌবনের প্রতীক। অর্থাৎ বামমার্গী না হতে পারলে যৌবনের গ্ল্যামার থাকে না। এক লাল রঙের যেমন একাধিক দায় থাকে, ফিকে লাল, গোলাপি, সিঁদুরে লাল, আগুনে লাল, মেটে লাল, গাঢ় লাল, বামপন্থারও সেই রকম অনেক ভেদ আছে বাম, মৃদু বাম, বিপ্লবী বাম, অতিবাম। অতিবামমার্গীরা এক সময় স্মরণীয় পুরুষদের মূর্তি প্রভৃতির শিরশ্ছেদ করেছিলেন। ইংরেজ আমলের মহাপুরুষরা আসলে ছিলেন কাপুরুষ ম্যানিপুলেটার, ভাঁওতাবাজ। এই ছিল তাঁদের বক্তব্য বা মতবাদ। সমস্ত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ছিল তাঁদের প্রচণ্ড বিদ্বেষ। শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী, জোতদার, মজুতদারদের তাঁরা ধড় থেকে মুন্ডু খুলে নিতে চেয়েছিলেন, কবর দিতে চেয়েছিলেন প্রতিষ্ঠানের দালালদের। আন্দোলন ফুরিয়ে গেলেও, মতবাদের পলি পড়ে আছে যুবকদের মনে। প্রশাসন বৃদ্ধ, জরদগব হয়ে গেছে, নির্বাচনের মাধ্যমে ঘুঘুর বাসা ভাঙা যাবে না। এই হতাশা থেকে এসেছে এক ধরনের অশ্রদ্ধা, বিতৃষ্ণা। কিছু মানছি না, কিছু মানব না। প্রায় সমস্ত যুবকেরই এই উগ্র মনোভাব। আর এই মনোভাবই হল বামপন্থী ভাব। কেন্দ্রের ঘুঘুর বাসা ভাঙতে না পারলে, অর্থনীতির আমূল সংস্কার না করতে পারলে, দেশের যখন কিছুই করা সম্ভব নয়, তখন রেগে-রেগে চিৎকার করাই ভালো। থেকে-থেকে বনধ ডাকাই ভালো। পথ হল, প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ। এই ক্রোধ শুধু কেন্দ্রের প্রতি নয়, জনগণের প্রতিও। প্রশাসনের তরফ থেকে যে কোনও গলতিরই এক উত্তর—কী হয়েছে কী! ওই রকমই হবে, এই মানসিকতা হিন্দি ছায়াছবির পর্দা ঘুরে প্রতিফলিত হয়েছে যুব মানসে। আর সেই মন থেকে প্রতিফলন হচ্ছে একটি শব্দে—আবে চল। চল, আর ফোট, এই হল একালের যুবকদের বেদবাক্য। বাম রাজনীতিকরা যেমন তাদের কাজের কোনও জবাবদিহি করতে প্রস্তুত নন, তেমনি যুবকরাও। শিক্ষা আর পরিবার অনুসারে, তাঁদের মুখে তিনটি ধাক্কা-মারা উদ্ধত শব্দ,—বেশ করেছি, সো হোয়াট, চল ফোট। প্রায় প্রতিটি পরিবারেই যুবক ও অভিভাবকে সম্পর্ক, কেন্দ্র-রাজ্যের সম্পর্কের মতো হয়ে পড়ছে। পিতাপুত্র বা মাতাপুত্রে সম্পর্ক হয়ে দাঁড়াচ্ছে দুই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ শত্রুর মতো। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রাচীনপন্থীরা সরে আসছেন। ভাবছেন এই বয়সেই তো বানপ্রস্থের বিধান। বন নেই, তবে মনের বনে চুপচাপ সরে যাওয়া।
বামমার্গীরা একটি কথা প্রায়ই বলেন, দুর্গ দখল। গৃহদুর্গ চলে গেছে যুবকদের দখলে। অর্থাৎ বিপ্লবের প্রথম পর্ব শেষ। বাপ-মা নামক অবুঝ প্রতিবন্ধী দুজন নির্বাসিত ডিকটেটারের মতো ‘সেন্ট হেলেনা’ দ্বীপের অধিবাসী। ফলে অধিকাংশ মধ্যবিত্ত বাঙালি গৃহ আর নানা নিয়মের শৃঙ্খলে বাঁধা গৃহ নয়, ক্লাব। ছাত্রদের কোনও রুটিন নেই। যখন খুশি ঘুম থেকে ওঠ। ইচ্ছে হল পড়, না ইচ্ছে হলে রেখে দাও ও ঝামেলা। আপকা পসন্দ! যখন খুশি টি ভি দ্যাখ। টেপ রেকর্ডারে গান শোন। বন্ধুবান্ধব নিয়ে আড্ডা মার। যা খুশি তাই করার ঢালাও স্বাধীনতা। শাসনের কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আপকা মর্জি। ডিকটেটারের দিন শেষ। গণতন্ত্রেও বিশ্বাস নেই। যে লেখাপড়া জীবিকার নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি দিতে পারে না, সে লেখাপড়ার জন্যে কে সময় নষ্ট করবে! পণ্ডিত হবার জন্যে পড়া। পণ্ডিত আর পাণ্ডিত্য দুটোই বুর্জোয়া দুনিয়ার ব্যাপার। বামমার্গী চিন্তায় যন্ত্রে আর মানবে কোনও তফাত থাকা উচিত নয়। যন্ত্র কি ভাবে? না ভাবা উচিত! যন্ত্রের অতীত নেই। যন্ত্রের ভবিষ্যৎ নেই। যন্ত্রের শুধু বর্তমানটাই থাকা উচিত। সকাল, সন্ধে ঘুরে চল। ভবিষ্যৎ একটাই, বিকল হয়ে স্ক্র্যাপ হয়ে যাওয়া। যন্ত্রের সহবত নেই। এটিকেট নেই। ম্যানারস জানে না। যুবকরা নিজেদের দেহযন্ত্র ছাড়া আর কিছুই ভাবে না। বিনয় হল মেয়েলিপনা। দয়া করে সরে বসুন। অনুগ্রহ করে পথ দিন। এইসব অনুরোধ হল দুর্বলতা। এক ধরনের ন্যাকামি। আমরা ‘মাসলম্যান’। মারব এক ধাক্কা আপসে সব সরে যাবে। যানবাহনে নিয়ত এই খেলাটি চলছে। রাস্তার মাঝখানে দুই যুবকে গল্প হচ্ছে। পেছনে সামনে একের পর এক গাড়ি থমকে আছে। জোর করে সরাবার উপায় নেই। রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে। দুজন সামনাসামনি হেঁটে আসছে। একজন যুবক একজন প্রবীণ। প্রবীণকেই পাশে সরতে হবে। এই মনোভাবও বামপন্থা। বাম দুনিয়ায় হৃতশক্তি প্রবীণ আর দুগ্ধহীন গাভীতে তফাত নেই। সেকেন্ড গ্রেড সিটিজেন। পেনসানে বেঁচে থাকা। গেলেই হয়। মরছে না যখন তখন বিনীত নতজানু হয়েই বেঁচে থাকা। শ্রদ্ধা, ভক্তি, দয়া, মায়া, মানবতা এই সব শব্দ বাম অভিধানে নেই। যুবকরাও এই সব বাতিল করে দিয়েছে। স্লোগান হয়েছে—বাঁচতে গেলে লড়তে হবে, লড়াই করে বাঁচতে হবে।
ধর্মের কথা তো কথারম্ভে বলেছি। বামপন্থীরা ধর্ম মানেন না। ধর্ম হল বিষ্ঠাবৎ পরিত্যাজনীয়। ধার্মিক মানে ভণ্ড। জীবনবিমুখ। পলায়নী মনোবৃত্তির মানুষ। ধর্মগুরু হলেন পরস্বাপহারী, অলস এক মানুষ। যুবকরা ধর্ম মানেন না। অর্থাৎ বামপন্থী। ধর্ম হল মানব-ধর্ম; অর্থাৎ আহার, নিদ্রা, মৈথুন। শতকরা নব্বইজন ব্রাহ্মণ যুবকের গলায় পইতে নেই। প্রাচীনপন্থী, অ্যাবসার্ড, ভীরু পিতামাতারা উপযুক্ত বয়সে, ঘটা করে, বৈদিক নিয়মে উপনয়ন করিয়েছিলেন। কিশোর বাধ্য হয়েই মেনে নিয়েছিল। যৌবন সমাগমে তিনি সেই যজ্ঞোপবীতটিকে ধোবার বাড়ি পাঠিয়ে শান্তি লাভ করেছেন। ধর্মের দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করেছেন। গঙ্গা-তীরবর্তী সুরম্য মন্দির-প্রাঙ্গণ এখন প্রেমকুঞ্জ। তীর্থে বাজছে ট্রানজিস্টার—ববি, আই লাভ ইউ। যুবক-যুবতীর মেলামেশাতেই বামপন্থী বাতাস বইছে। বৈদিক বিবাহ সময় নষ্ট। দেখা হয়েছে, ভালো লেগেছে, শুয়ে পড়েছি। মিটে গেছে ল্যাঠা। পরে যা হয় একটা রেজিস্ট্রি মেজিস্ট্রি করিয়ে নিলেই হবে। যদিদং হৃদয়ং মৃদয়ং সব বোগাস ব্যাপার। মনোবাদের স্থান নেই। দেহবাদ। পয়লা নম্বর, আমি ফ্লেশ অ্যান্ড ব্লাড। দোসরা নম্বর আমার প্রয়োজন। তিসরা নম্বর, জিও-জিও। একালে সেই কারণে ঝগড়া মানে কথা কাটাকাটি নয়, পয়লা চোটেই মারামারি। বোম চালাচালি। পেটোপটকা। লাশের পতন। প্রথম কথাই হল—লাশ ফেলে দাও। তারপর ভাবা যাবে।
যে-সব যুবক শিক্ষিত, জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত, চিন্তায় ভাবনায় তাঁরাও বাম; তাঁদের পরিবারে যে বাতাস বয় তা অনেক খোলামেলা। প্রাচীন পরিবারের তাবৎ বন্ধন, তাঁরা ছিন্ন করেছেন। অষ্টপাশ মুক্ত। সর্বধর্মের সমন্বয়। আগে ছিল, তালের বড়া খাইয়া নন্দ নাচিতে লাগিল। এখন বড়দিনে—হুইস্কি খেয়ে গোপাল আমার ঘাড়েতে পড়িল। পিঠে, পুলি, নকশি কাঁথা, কালীঘাটের পট হল ইন্টেলেকচুয়ালদের সংস্কৃতি সচেতনতা। বঙ্গসংস্কৃতি সম্মেলনের স্পেশ্যাল দোকানে আলোকিতা মহিলা সংগঠন পুলি পিঠের আয়োজন করেছেন। কালীঘাটের পটের আলাদা স্টল। বড়ি আর কাসুন্দির সেলস কাউন্টার। সাদা খদ্দর দক্ষিণপন্থী। তার ওপর কল্কার প্রিন্ট পড়লেই বামপন্থী। কালো ট্রাউজার, বোতামহীন বেঁড়ে হাইকলার, থ্রিফোর্থ হাতা, মুখে পাইপ, সঙ্গে কমরেড শ্রীমতী, বেরিয়ে পড়েছেন সংস্কৃতি শিকারে। কেঁদুলি মেলার বাউলরা অবাক। হলটা কী! বাপের জন্মে এত পপুলারিটি তো ছিল না, ভোলামন। জিনস পরা ছেলেমেয়েরা ছেঁকে-ছেঁকে ধরছে। এদিক থেকে স্পিকার, ওদিক থেকে স্পিকার। খসখস নোট। থেকে-থেকে প্রশ্ন—’মহাজন, ওই লাইনটা আর একবার, ড্যাং ড্যাং ড্যাং ডেঙ্গায় ডিঙ্গে চালায় আবার সে কোনও জন।’ এত সব সুগন্ধী সৌখিন ছেলেমেয়েরা অচিন পাখির খোঁজে চলে এসেছে। মার টান। কলকে ফাটা।
পুরনো আটাত্তর, আর পি এম রেকর্ড, প্রাচীন কলকাতা, লোক-সংস্কৃতি এই তিন মিলে যে আঁতেল তাতে বামগন্ধ। অনেকে আবার একতারা কিনে আনেন কিউরিও হিসেবে। ছুটির দিন দেয়ালে ঝোলানো ছৌ নাচের মুখোশে গাল ফুলিয়ে ফুঁ মারেন ধুলো তাড়াতে। দেয়ালে ড্রইং পিন দিয়ে মাদুর সাঁটেন। খোঁজ করেন, তারাপীঠে অ্যাটাচড-বাথরুম আছে কি না। সন্ধ্যার শাক, এঁটোকাঁটা, অভক্ষ্য আহারের বাছবিচার নেই। কিন্তু তন্ত্র একটি বাম সাবজেক্ট। বামাচার আছে। তার খোঁজে তারাপীঠ, কামরূপ, কামাখ্যা।
এই সব বিচারে আমিও বাম। বিশ্বাস নেই, নিষ্ঠা নেই, শ্রম নেই। আছে ওপরচালাকি। দেখার চেয়ে দেখাতে চাই। বিশ্বনিন্দুক, বিশ্বসমালোচক। সবার উপরে পার্টি সত্যের মতো, সবার উপরে আমি আর—আমার পরিবার, আর আমার উপদেশ সত্য। নিজেকে যতটা সম্ভব ধোঁয়াশার মধ্যে রাখাটাই হল বামমার্গ। পৃথিবীর এতকালের দক্ষিণপন্থী ইতি-ইতি ব্যবস্থায় আমাদের ঘোড়ার ডিম হয়েছে। আয় বাড়েনি দেনা বেড়েছে। দেহ বাড়েনি দেমাক বেড়েছে। ধনকুবের ব্যবসায়ীরা বিশাল-বিশাল বাড়ি তুলেছে। রঙবেরঙের গাড়ি ঢুকছে আর বেরোচ্ছে। গায়ে-গতরে মেয়েরা ঠান্ডা বাজারে ঢুকে ঐশ্বর্যের অশ্লীল প্রদর্শনী করছে। ফুচকা খেয়ে এঁটোপাতা রাস্তায় ছুঁড়ে দিচ্ছে। আর আমরা ট্যাঁক খালির রাজারা সেই ধনগর্বের পদতলে আঁতলামো করছি। শ্রদ্ধেয় যাঁরা তাঁরা আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে কখনও বলেছেন, ফরওয়ার্ড মার্চ, কখনও বলেছেন ব্যাকওয়ার্ড মার্চ। আমাদের মার্চ করিয়ে তাঁরা সব দিকপাল হচ্ছেন। যে-ই লঙ্কায় যাচ্ছেন, তিনিই রাবণ হয়ে অট্টহাসি ছাড়ছেন। সিন্নি দেখে এগোনো, মোল্লা দেখে পেছনো, এই নীতি আর কতকাল চলবে! স্বদেশি আমলেও দেখা গেছে, বাবা ইংরেজের খয়ের খাঁ, ছেলে বিপ্লবী, বোমা ছুঁড়ছে। একালেও তাই একই পরিবারের প্রথম পুরুষ এসটাবলিশমেন্টের দাস, দ্বিতীয় পুরুষ বিদ্রোহী। পরিব্যাপ্ত একটা ক্রোধ, একটা হতাশায় চারপাশ ছেয়ে গেছে। ক্রোধ হল বামপন্থা। আমরা আজ সবাই ক্রোধী।