1 of 2

আবছায়া – বুদ্ধদেব বসু

আবছায়া – বুদ্ধদেব বসু

আই. এ. পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেদিন ভর্তি হলাম সেদিন মনে ভারী ফূর্তি হল। বাস্ রে কত বড় বাড়ি। করিডরের এক প্রান্তে দাঁড়ালে অন্য প্রান্ত ধু-ধু করে। ঘরের পর ঘর, জমকালো আপিস, জমজমাট লাইব্রেরি, কমনরুমে ইজিচেয়ার, তাসের টেবিল, পিংপং, দেশ-বিদেশের কত পত্রিকা।— সেখানে ইচ্ছেমতো হল্লা, আড্ডা, ধূমপান সবই চলে, কেউ কিছু বলে না। কী যে ভাল লাগল বলা যায় না। মনে হল এতদিনে মানুষ হলুম, ভদ্রলোক হলুম। এত বড় একখানা ব্যাপার—যেখানে ডীন আছে, প্রভেস্ট আছে, স্টুয়ার্ড আছে, আরো কত কী আছে, যেখানে বেলাশেষে আধ মাইল রাস্তা হেঁটে টিউটোরিয়াল ক্লাশ করতে হয়, তারও পরে মাঠে গিয়ে ডনকুস্তি না-করলে জরিমানা হয়, যেখানে পার্সেন্টেজ রাখতে হয় না, অ্যানুয়েল পরীক্ষা দিতে হয় না, যেখানে আজ নাটক, কাল বক্তৃতা পরশু গান-বাজনা কিছু-না-কিছু লেগেই আছে, রমনার আধখানা জুড়ে যে বিদ্যায়তন ছড়ানো, সেখানে আমারও কিছু অংশ আছে, এ কি কম কথা ! অধ্যাপকরা দেখতে ভাল, ভাল কাপড়চোপড় পরেন, তাঁদের কথাবার্তার চালই অন্যরকম, সংস্কৃত যিনি পড়ান তিনিও বিশুদ্ধ ইংরেজি বলেন—ঘণ্টা বাজলে তাঁরা যখন লম্বা করিডর দিয়ে দিগ্বিদিকে ছোটেন, তাঁদের গম্ভীর মুখ আর গর্বিত চলন দেখে মনে হয় বিশ্ব জগতের সমস্ত দায়িত্বই তাঁদের কাঁধে ন্যস্ত। এ-সব দেখে-শুনে আমারও আত্মসম্মান বাড়লো, এ-সংসারে আমি যে আছি সে-বিষয়ে অতিমাত্রায় সচেতন হয়ে উঠলুম। মন গেলো নিজের চেহারার দিকে, কেশবিন্যাস ও বেশভূষা সম্বন্ধে মনোযোগী হলুম। শার্ট ছেড়ে পাঞ্জাবি ধরলুম, সদ্যোজাত দাড়িগোঁফের উপর অকারণে ঘন-ঘন ক্ষুর চালিয়ে ছ-মাসের মধ্যেই মুখমণ্ডলে এমন শক্ত দাড়ি গজিয়ে তুললুম যে আজ পর্যন্ত কামাতে বসে চোখের জলে সেই স্বকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। তখন অবশ্য ভবিষ্যতের ভাবনা মনে ছিল না, বালকত্বের খোলশ ছেড়ে চটপট যুব বয়সের মূর্তি ধারণ করাই ছিল প্রধান লক্ষ্য।

এর অবশ্য আরও একটু কারণ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটি ছাত্রীও ছিলেন। ওখানকার নানারকম অভিনবত্বের মধ্যে এ-জিনিসটাই ছিল আমার চোখে—প্রায় সব ছেলেরই চোখে—সবচেয়ে অভিনব। যখনকার কথা বলছি, তখনও মেয়েদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার বান ডাকেনি, সারা বিদ্যালয়ে পাঁচটি কি ছ-টি মেয়ে মাত্র ছিল সব সুদ্ধু। আমাদের সঙ্গে অপর্ণা দত্ত নামে একজন ভর্তি হয়েছিল।

পাতলা ছিপছিপে মেয়ে, শ্যামল রং, ফিকে নীল শাড়ি পরে কলেজে আসে। দু-শো ছেলের সঙ্গে বসে একটিমাত্র মেয়ের বিদ্যাভ্যাস ব্যাপারটা বিশেষ সোজা নয়, বিশেষত যখন ক্লাসে ছাড়া আর সবখানেই ছেলেদের থেকে তাকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র করে রাখার আঁটোসাঁটো ব্যাবস্থা থাকে। অপর্ণার কেমন লাগত জানি না, কিন্তু আমার ওর জন্য দুঃখ হত। ছেলেদের মধ্যে ওকে নিয়ে নানারকম আলোচনা শুনতুম, তার সবগুলো বলবার মতো নয়। তাদের ভদ্রতার আদর্শ সমান ছিল না। মনের মধ্যে যে-চাঞ্চল্যটা স্বাভাবিক কারণেই হত, সেটাকে ব্যক্ত করবার উপায়ও ছিল এক-এক জনের এক-এক রকম; বেশির ভাগ শুধু কথা বলেই খুশি থাকত—অর্থাৎ জীবনে যা ঘটবার কোনো সম্ভাবনাই নেই, নিজের মনে সে-সব কল্পনা করে নিয়ে গল্প করতো; কয়েকজন দুঃসাহসী কোনো-না-কোনো অছিলায় মেয়েদের কমনরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে অপর্ণার সঙ্গে আলাপ করে এল; আর কেউ-কেউ ছিল একেবারে চুপ। বলে রাখা ভাল, আমি ছিলুম এই শেষের দলে। ক্লাশে আমি বসতুম সব-শেষের বেঞ্চিতে; অনেকগুলো মাথার ফাঁক দিয়ে হঠাৎ কখনো-কখনো অপর্ণাকে আমার চোখে পড়তো—তার স্বতন্ত্র চেয়ারে বসে খোলা বইয়ের দিকে তাকিয়ে, একটি হাত গালের উপর ন্যস্ত। ফ্রেমে বাঁধানো ছবির মতো সেই মুখ, বসবার সেই ভঙ্গিটা আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল, এখনো মনে করতে পারি। সরু হাতে একটি মাত্র চুড়ি, মাথার কাপড়ের চওড়া পাড় মুখখানাকে ঘিরে আছে। লক্ষ করতুম, অপর্ণা আগাগোড়া বইয়ের উপরেই চোখ রাখে, যেন অত্যন্ত সংকুচিত হয়ে নিজেকে দিয়েই নিজেকে আড়াল করে রাখতে চায়। শুধু মাঝে-মাঝে অতগুলো কালো মাথা ভেদ করে ওর চোখের দৃষ্টি আমারই মুখের উপর যেন এসে পড়ত। তবে এটা খুব সম্ভব আমার কল্পনা।

চার বছর অপর্ণা ছিল আমার সহপাঠিনী, কিন্তু তার মধ্যে এটুকুই আমার সঙ্গে ওর পরিচয়। সে চার বছরে ওর কণ্ঠস্বর পর্যন্ত আমি কোনদিন শুনিনি, মুখোমুখি কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ওকে দেখিনি কখনো। ও-সব পুরস্কারলাভের জন্য আমার চেয়ে যোগ্য অনেকেই ছিল। তার মধ্যে অশোক ছিল পয়লা নম্বর। অশোক কাপ্তেন গোছের ছেলে, বাপের দেদার পয়সা, মাঝে-মাঝে বাড়ির গাড়ি চড়ে কলেজে আসে, শীতকালে ফ্যানেলের পাৎলুন আর বিলেতি শার্ট পরে, সিগারেট নিজে খায় যত, বিলোয় তার বেশি, সমস্ত ইউনিভার্সিটিতে নিঃসন্দেহে সে সবচেয়ে পপুলার। চমৎকার চেহারা, তাছাড়া গুণও তার অনেক। টেনিস খেলতে পারে, অভিনয় করতে পারে, সাইকেল চালাতে অদ্বিতীয় ইত্যাদি ইত্যাদি। হল-এর ড্রামাটিক সেক্রেটারি থেকে আরম্ভ করে ইউনিভার্সিটি ইউনিয়নের সেক্রেটারি পর্যন্ত যেটার জন্যই যখন দাঁড়িয়েছে, অসম্ভবরকম বেশি ভোট পেয়ে অনায়াসে নির্বাচিত হয়েছে। সত্যি বলতে, ওর প্রতিদ্বন্দ্বী হবার মতো ছেলে আর ছিল না।

এই অশোকের কাছে অপর্ণার কথা অনেক শুনতুম। সে তুখোড় ছেলে; কমনরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে দু-মিনিট আলাপ করেই তৃপ্ত হয়নি, গেছে অপর্ণার বাড়িতে, চা খেয়েছে, তার মাকে মাসিমা ডেকেছে তার বাবার সঙ্গে পলিটিক্স চর্চা করেছে, ভাই-বোনেদের সঙ্গে ভাব জমিয়েছে; এক কথায়, যা-যা করা দরকার সবই করেছে সে। এক বছরের মধ্যে এই ভাগ্যবান পুরুষ এমন জমিয়ে তুলল যে অন্য ছেলেরা তাকে মনে-মনে ঈর্ষা ও বাইরে খোশামোদ করতে লাগলো—যদি তার সূত্রে তারাও সেই অমরাবতীর কাছাকাছি পৌঁছতে পারে। কিন্তু অন্য সকলকে অগ্রাহ্য করে অশোক গায়ে পড়েই আমার কাছে শুধু ঘেঁষতো, তার কারণ বোধহয় এই যে আমি ছিলুম আদর্শ শ্রোতা, আমার কাছে মনের সমস্ত কথা উজাড় করে সে ভারি আরাম পেত। কতদিন আমাকে নিয়ে ক্লাশ পালিয়েছে, শীতের সুন্দর দুপুরবেলায় ঘাসের উপর বসে আমাকে শুনিয়েছে অফুরন্ত অপর্ণা-চরিত। এ ধরনের গল্প সাধারণত ক্লান্তিকরই হয়, কিন্তু আমি স্বীকার করবো যে, আর কিছু না হোক, বার-বার ওই অপর্ণা নামটি শুনতেই আমার ভাল লাগত।

সব কথার শেষে অশোক আমাকে প্রায়ই বলত, ‘চলো না তুমি একদিন ওদের বাড়ি।’

আমি বলতুম, ‘পাগল’ ?

‘ও চায় তোমার সঙ্গে আলাপ করতে। ডক্টর করের সঙ্গে ও টিউটরিয়াল করে, তিনি ওকে প্রায়ই বলেন কিনা তোমার কথা !’

এখানে লজ্জার সঙ্গে বলে রাখি যে লেখাপড়ায় বরাবরই আমি একটু ভালোর দিকে। আত্মীয়রা আশা রেখেছিলেন হোমরা-চোমরা মস্ত চাকুরে হব, কিন্তু কিছুই হল না, সামান্য মাস্টারি করে সংসারে টিকে আছি।

অশোকের কথা আমি রাখিনি, একদিনও যাইনি ওর সঙ্গে অপর্ণার বাড়ি। অপর্ণার সঙ্গে আলাপ করার লোভ আমার ছিল না এমন অসম্ভব কথা আপনাদের বিশ্বাস করতে বলছি না। খুবই ছিল। কিন্তু অত্যন্ত লাজুক হলেও ভিতরে-ভিতরে আমি ছিলাম গর্বিত। অশোকের মধ্যস্থতায় আপর্ণার সঙ্গে আলাপিত হওয়া আমার পক্ষে অসম্মান। আমিই বা ওর চেয়ে কম কিসে ! তাছাড়া ছাত্রজীবনের নানারকমের কাজে ও অকাজে, দিন ভরে আড্ডা আর রাত জেগে পড়ায় এত ব্যস্ত ছিলুম যে তার মধ্যে অপর্ণার কথা ভাবার খুব বেশি সময়ও ছিল না।

হু-হু করে কাটতে লাগল দিন, বি. এ. পরীক্ষা হয়ে গেল। আমার বিষয় ছিল দর্শন, আজগুবি রকমের ভালো নম্বর পেয়ে ফার্স্ট ক্লাশে উৎরে গেলুম। অপর্ণা আর অশোক দু-জনেই ছিল পাশ-কোর্সে, এম. এ.-র শেষ বছরে এসে অপর্ণা আমার নিকটতর সহপাঠিনী হল, কারণ সেও দর্শনে এম. এ. নিয়েছিল। মর্ডান ইয়ং ম্যান অশোক নিয়েছিল ইকনমিক্স, কিন্তু অধ্যয়নের ব্যবধান ডিঙিয়ে সে সমীপবর্তিতায় মৌরশিপাট্টার ব্যবস্থা করে এনেছিল। একদিন খুব চুপে-চুপে আমাকে বললে কথাটা। সবই ঠিকঠাক, এম, এ.-টা হয়ে গেলেই হয়।

পাঠ্যবিষয়ের মধ্যে দর্শনের বাজারদর তখন থেকেই নামতে শুরু করেছে। সবসুদু আমরা সাতজন ছিলাম ক্লাশে, ছ-টি ছেলে ও একটি মেয়ে। আলাপ করার সুযোগ ছিল অবারিত। পড়াশুনোয় সাহায্য করার অছিলা ছিল হাতের কাছেই, আর আমার মুখে সেটা ফাঁকা বুলিও শোনাতো না। কিন্তু যখনই কথাটা আমার মনে হত, তখনই আমার ভিতর থেকে কে আর-একজন বলে উঠত—তুমি গিয়ে কারো সঙ্গে যেচে আলাপ করবে—ছি !”

এদিকে অশোক আমাকে বড়ই পীড়াপীড়ি করতে লাগলো অপর্ণার বাড়ি যাবার জন্য। কান্ট দুর্বোধ্য ঠেকছে অপর্ণার, আমার সাহায্য দরকার। আমি হেসে বললুম, ‘বড়-বড় বিদ্বান মাস্টার মশাইদের মুখে শুনে যা সরল হচ্ছে না, তা কি বোঝাতে পারবো আমি !’ আর একদিন অশোকের হুকুম, হেগেল সম্বন্ধে আমার কী কী নোট আছে দিতে হবে। শুনে মনে হল, হায় হায়, কেন অন্য ছেলেদের মতো নোট রাখিনি ! কিন্তু আমার যে কোনো নোটই নেই, একথা অশোক বোধহয় বিশ্বাস করল না; ভাবলো পরীক্ষাসংক্রান্ত আমার সব গোপনীয় তুকতাক ফুশমন্তরে আমি অন্য কাউকে অংশী করতে চাই না। যা-ই হোক, অপর্ণার হয়ে অশোক আমাকে পড়াশুনো বিষয়ে আর-কোনো কথা জিজ্ঞেস করেনি।

অতএব দর্শনের ছোট ক্লাশে দুটো বেঞ্চির ওপারে অপর্ণার দিকে তাকিয়ে-তাকিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বছরটা কাটলো। আমার মনে হত, অপর্ণা আমার দিকে ঘন-ঘনই তাকাচ্ছে, কিন্তু এটা নিশ্চয়ই আমার মনের ভুল।

এম এ পরীক্ষা হয়ে গেল। বিশ্ববিদ্যালয়কে বিদায় দিয়ে বেকারবাহিনীতে ভর্তি হবার সময় যখন ঘনাচ্ছে, এমন সময় অশোক একদিন আমার বাড়ি এসে সুখবর দিয়ে গেল। তারিখ পর্যন্ত ঠিক। আজ সন্ধ্যায় কন্যার আশীর্বাদ উপলক্ষে অপর্ণার বাড়িতে উৎসব, আমি যেন অবশ্য যাই।

আমি তক্ষুনি বললুম, ‘যাবো।’ আমার হঠাৎ মনে হল আজ আর আমার যাবার কোনো বাধা নেই, যদিও এতদিন যে কী বাধা ছিল তাও আমি জানি না।

এই প্রথম আমি অপর্ণাকে কাছাকাছি দেখলুম, তার কথা শুনলুম। কিন্তু সেদিন তার সম্পূর্ণ অন্য মূর্তি, কপালে চন্দন, পরনে খয়েরি রঙের রেশমি শাড়ি, গা ভরা গয়না। চেনাই যায় না। যে-ঘরটায় গিয়ে বসলুম সেখানে অনেক লোক। অধিকাংশই আমার অচেনা, সুতরাং জড়োসড়োভাবে চুপ করে রইলুম।

অশোক এক সময়ে আমার কাছে এসে চুপি চুপি বললে, এখানে তোমার ভাল লাগছে না, বুঝতে পারছি। চলো আমার সঙ্গে।’

নিয়ে গেল আমাকে পাশের একটি ছোট ঘরে, অপর্ণার পড়ার ঘর সেটা। চারদিকে দর্শনের বই দেখে খানিকটা আরাম পেলাম। আমাকে বসিয়েই অশোক যেন কোথায় অন্তর্হিত হল, ভারি ব্যস্ত সে। একা বসে আমি একটি বইয়ের পাতা ওল্টাতে লাগলুম।

মৃদু শব্দ শুনে চমকে তাকিয়ে দেখি অপর্ণা একটু দূরে দাঁড়িয়ে। সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালুম, কী বলবো ভেবে পেলুম না।

অপর্ণাই প্রথমে কথা বললে, ‘এতদিনে আপনি এলেন।’

আমি বললুম, ‘আমার অভিনন্দন আপনাকে জানাই।’

‘এতদিন আসেননি কেন ?

‘আসিনি—আসিনি—তার মানে—আসা হয়নি আরকি।’

‘অশোক আপনাকে বলেনি আসতে ?’

‘বলেছে।’

‘আপনি কি ওর কথা বিশ্বাস করেননি ?’

‘অবিশ্বাস করিনি, তবে—’

‘তবে আমার সঙ্গে আলাপ করার আপনার ইচ্ছে হয়নি, এই তো ?’

‘না—না—ইচ্ছে হবে না কেন।’

অপর্ণা একটু মুচকি হেসে বললে, ‘থাক, এখন আর ভদ্রতার কথা বলে কী লাভ—এখন তো আর সময় নেই।’

শেষের কথাটা শুনে হঠাৎ আমার বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠল। অপর্ণা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললে, ‘এই চার বছরে অশোককে দিয়ে এতবার আপনাকে খবর পাঠালুম,—একবার এলেন না !’ তারপর একটু চুপ করে থেকে ঈষৎ মাথা নেড়ে খুব নিচু গলায় বললে, ‘কিচ্ছু বোঝেন না আপনি !’ সঙ্গে-সঙ্গে শুনতে পেলুম অপর্ণার দীর্ঘশ্বাস, কিন্তু সেটাও বোধহয় আমার কল্পনা।

বাড়ি ফিরে অনেক রাত অবধি ঘুমোতে পারলুম না, হয়তো তার একটা কারণ এই যে অন্যমনস্কভাবে ও-বাড়িতে অত্যন্ত বেশি খেয়ে ফেলেছিলুম। শুয়ে-শুয়ে অনেক কথা মনে হল। অপর্ণার কথাগুলি বিষাক্ত পোকার মতো মগজের মধ্যে যেন কামড়ে ফিরছে। ভাবনাগুলো যেখান থেকেই শুরু হোক, খানিক পরে এক অন্ধ গলির সামনে এসে পড়ে, তারপর আর রাস্তা নেই। আমি যে কত বড়ো বোকা তা উপলব্ধি করে স্তম্ভিত হয়ে গেলুম। অন্ধকারে চোখ মেলে নিজের মনে বার-বার বললুম, ও আমাকেই চেয়েছিল, আমাকেই চেয়েছিল, হয়তো এখনো—না, না, এখন আর সময় নেই, আর সময় নেই।

কয়েকদিন পরেই অপর্ণার বিয়ে হয়ে গেল, আর আমি চলে এলুম কলকাতায় চাকরির চেষ্টায়।

দশ বছর কেটে গেছে। আমি এখনো বিয়ে করিনি, তার কারণ আমার ক্ষীণ আয়ের উপর মা-বাবা ভাই-বোনের নির্ভর, আমি বিয়ে করলেই তাদের ভাগে কম পড়বে, অতএব সে-বিষয়ে আমার উদাসীন থাকাই কর্তব্য। অশোক ঢুকেছিল ইনকাম ট্যাক্সে, এতদিনে নিশ্চয়ই অফিসার হয়েছে, হয়তো রংপুরে, হয়তো বরিশালে, হয়তো চাটগাঁয়ে হাকিমি করছে। আমার জীবন অত্যন্ত শান্ত ও নিয়মিত; কোনো আক্ষেপ, কোনো উচ্চাশা, কোনো কল্পনা নেই। দর্শন পড়ি ও পড়াই, নিছক বুদ্ধিবৃত্তির চর্চাকেই জীবনের একমাত্র সুখ বলে মেনে নিয়েছি। ভালোই আছি।

শুধু মাঝে-মাঝে অনেক রাত্রে সেই একটি করুণ শ্যামল মুখ আমার মনে পড়ে, সরু হাতে একটিমাত্র চুড়ি, নীল শাড়ির পাড় মাথাটিকে ঘিরেছে। অন্ধকারে কে যেন চুপি চুপি কথা বলে—‘এত দেরি করে এলেন—আর তো সময় নেই।’

২৪ মার্চ ১৯৭৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *