আবগারীশ্বরী
০১. স্থায়ী
বঙ্গীয় কুলীন কায়স্থ বংশে, একটি প্রাচীন রক্ষণশীল পরিবারে শ্রীযুক্ত সনাতন মিত্রের জন্ম।
কিন্তু নিতান্ত দুঃখের বিষয় এই যে সনাতনবাবু মানুষটি যাকে ধার্মিক বা ধর্মপরায়ণ লোক বলে ঠিক সেই ধরনের নন। পুজো-আর্চায় তাঁর মোটেই মন নেই। দেবদ্বিজে বিগ্রহে-প্রতিমায় তাঁর ভক্তি অচলা নয়।
তবে এসবের জন্যে একটা বয়েস লাগে। সে বয়েসে পৌঁছাতে এখনও সনাতনবাবুর ঢের দেরি আছে। সনাতন নামটি ঊনবিংশ শতকীয় হলেও তার বাহক মোটেই ঊনবিংশ শতকের নয়। এই নামটি শুনে যার মনে যাই হোক, ভুল ধারণা পোষণ করে লাভ নেই। আমাদের এই অকিঞ্চিৎকর আখ্যানের প্রাণপুরুষ উক্ত শ্রীযুক্ত সনাতন মিত্রের বয়েস এখন সদ্য বিশের ধাপ গুটি গুটি পার হয়ে তিরিশাভিমুখী, উচ্ছল কুড়ি আর উজ্জ্বল তিরিশের মধ্যের দরজায় তিনি দাঁড়িয়ে।
বলা বাহুল্য, এই সনাতন নামকরণটির পিছনে একটি ক্ষুদ্র ইতিহাস রয়েছে।
স্বর্গীয় নিত্যপ্রসাদ মিত্র ছিলেন সনাতনবাবুর পিতামহ। তিনি কর্মজীবনে পুলিশ কোর্টের দারোগা বা কোর্ট ইনসপেক্টর ছিলেন কিন্তু অনেক পুলিশ দারোগার মতোই তিনি খুব ধার্মিক প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। সনাতন সঙ্কীর্তন সঙ্ঘ-এর তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা এবং আমৃত্যু সভাপতি।
যে বছর সনাতন সঙ্কীর্তন সঙঘ এক কথায় স-সস প্রতিষ্ঠিত হয় ঠিক তার আগের বছর সনাতন জন্মান। এবং অনিবার্যভাবেই সনাতন নামটি তার কাঁধে পড়ে।
চাকুরি জীবনের শেষভাগে নিত্যপ্রসাদের মূল কাজ ছিল বিভিন্ন ধরনের ফৌজদারি মামলার আসামিকে আদালতে সোপর্দ করা।
এখানে বলা রাখা উচিত যে নিত্যপ্রসাদ অত্যন্ত ন্যায়নিষ্ঠ অফিসার ছিলেন। নিজের কাজ খুব মন দিয়ে করতেন। উৎকোচে তাঁর যে খুব অনীহা ছিল তা নয়। কিন্তু তাঁর নিজস্ব একটা বিচারবুদ্ধি ছিল। তিনি নিজে যে মামলাটা খারাপ মনে করতেন, সে মামলার আসামি তার বিচারে গর্হিত অসামাজিক কর্ম করেছে বলে তিনি ভাবতেন সেখানে খুবই কঠোর হতেন। তাঁর তদ্বির তদারকিতে অসংখ্য প্রতারক-জোচ্চোর, মদ্যপ-লম্পট শ্রীঘরবাসী হয়েছে।
আসল কথা এই যে কোর্ট ইনসপেক্টর এন পি মিত্র প্রতারণা, লাম্পট্য, ব্যভিচার ইত্যাদি সহ্য করতেন পারতেন না। তার হাতে পড়লে এদের নিস্তার ছিল না। কিন্তু সাধারণ চুরি-ডাকাতি, রাগের মাথায় খুন এই সব ধর্তব্যের মধ্যে নিতেন না। সুতরাং এদের কাছ থেকে ঘুষ নিতে তার বিবেক দংশন হত না।
পুলিশের দারোগার বিবেক দংশন এই কথাটা হয়তো কারও কারও কাছে গোলমেলে ঠেকতে পারে। তাদের অবগতির জন্যে জানাই যে পুরুষানুক্রমে ধর্মপরায়ণ বংশের সন্তান শ্রীযুক্ত নিত্যগোপাল মিত্র নিজেও চিরকালই খুব ধর্মপ্রাণ ছিলেন। প্রথম যৌবনে সেই যুদ্ধের বাজারে যখন চিনি ও চিনিজাত সব দ্রব্য অদৃশ্য হয়ে গেছে তিনি সখেরবাজারে বাতাসাপট্টি ঘুরে ঘুরে তার উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত গৃহদেবতা গোপালঠাকুরের জন্যে সাদা বাতাসা কিনে আনতেন। প্রতিবার কাজে বা অকাজে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় অষ্টধাতু নির্মিত গৃহদেবতার মুখে একটি সাদা বাতাসা গুঁজে দিয়ে বেরোতেন।
বেশি বয়েসে রিটায়ার করার মুখে এন পি মিত্র অতিশয় ধর্মপ্রবণ হয়ে পড়েন। গঙ্গার ঘাটের হিন্দুস্থানি কুলিদের আখড়ার বজরং ব্যায়ামগার থেকে শুরু করে আট হাজার আটশত আটবার অবিরাম হরিনাম সমিতির সঙ্গে তিনি যুক্ত হন।
রিটায়ার করার পর এন পি মিত্র নিজ উদ্যোগে অবিরাম হরিনাম সমিতির নাম বদল করে সনাতন সঙ্কীর্তন সঙঘ নামে রেজিস্ট্রি করেন এবং নিজে তার সভাপতিত্ব গ্রহণ করেন।
সেই সময় সনাতন নিতান্ত শিশু। পিতামহের অতি আদরের পৌত্র। আদরের আতিশয্যে এখন আজীবন সনাতনকে নামের বোঝাটি বহন করে যেতে হচ্ছে।
০২. অন্তরা
আসানসোল থেকে একটু এগিয়ে ধানবাদের পথে বঙ্গ-বিহার সীমান্তের কিঞ্চিৎ আগে একটি সদাব্যস্ত অঞ্চলের অনতিখ্যাত কিন্তু সুচালু কারখানার সহকারী ফোরম্যানের কাজ করেন সনাতন। তার ভাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি নেই। একটি ডিপ্লোমা আছে কিন্তু কাজ জানেন, নিজের কাজটা খুব ভালভাবেই জানেন। সেখানে তার যোগ্যতা অনস্বীকার্য। তা ছাড়া শক্ত সমর্থ যুবক, লোহাপেটা শরীর। কোম্পানিতে সনাতন মিত্রের সুনাম ও কদর দুই-ই আছে।
সনাতন মিত্র যে কোম্পানিতে কাজ করেন, সেটি খুব বড় না হলেও পুরনো এবং ভাল। কোনও উটকো, কাঁচা টাকায় হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ব্যাঙ্ক ঠকানো কারখানা নয়।
কারখানার কর্মচারিদের জন্যে একটা পুরনো আবাসন ব্যবস্থা আছে। কিন্তু ব্যাচেলারদের কোয়ার্টার দেয়া হয় না। তাদের জন্যে তিন কিলোমিটার দূরে কোলিয়ারি গঞ্জে একটা দোতলা বাড়ি ভাড়া নেয়া আছে। সেটাই হল ব্যাচেলারস মেস।
এই মেসেরই একটা ঘরে সনাতন মিত্র থাকেন। কলকাতার সখের বাজারে তাদের সাবেকি বাড়িতে সনাতনবাবুর দাদা-বউদি, বাবা-মা, অনূঢ়া দিদি রয়েছেন। সনাতনবাবু আর তার এই অনূঢ়া দিদিটি পিঠোপিঠি ভাইবোন।
দিদিটির নাম অনুরাধা। পিতামহ প্রদত্ত নাম ছিল নিতান্তই রাধা। সেকেন্ডারি পরীক্ষার ফর্ম পূরণ করার সময় বড়দিমণি মানে প্রধান শিক্ষিকা মহোদয়ার হাতে পায়ে ধরে রাধা অনুরাধা হয়েছিল। তবে রাধা নামটা আজও বহাল আছে, সেটা ডাকনাম হিসেবে।
সেই রাধা কিংবা অনুরাধার বিয়েতে একদম মন নেই। কিন্তু ভালবাসার দিকে খুব ঝোঁক। আজ পর্যন্ত তিরিশ-চল্লিশ বার তিনি প্রেমে পড়েছেন, এমনকি একই ব্যক্তির সঙ্গে পাঁচ-সাতবার। তবে পুরো ব্যাপারটাই মানসিক, মৌখিক, ওই সেই যে রজকিনী প্রেম, কীসের গন্ধ যেন তাতে নেই। সেই ব্যাপার আর কী!
দিদির বিয়ে না হলে সনাতন বিয়ে করেন কী করে? তাই তাঁরও বিয়ে হয়নি। দিদির যা মনোভাব দেখা যাচ্ছে তাতে সদ্য সদ্য সেরকম কোনও সম্ভাবনাও নেই।
সে যা হোক, অনুরাধাদির কাহিনি এখানে প্রক্ষিপ্ত। সনাতন মিত্রের কথা বলি। গল্পের প্রথমেই তাকে অধার্মিক বলেছি। ভাবনাটা ব্যাখ্যা করা দরকার।
সনাতন মিত্রের মতো একজন পঁচিশ-তিরিশ বছর বয়েসের যুবকের আবার ধর্মান্ধতা কী? এ বয়েসে আজকাল কেউ টিকিও রাখে না, তিলকও কাটে না, ত্রিসন্ধ্যা জপ-আহ্নিক করার করার প্রশ্নও আসে না।
আর একবারও অস্বীকার করার উপায় নেই যে আর দশটি স্কুল কলেজের ছেলের মতোই সনাতন পরীক্ষার সময় কপালে দইয়ের ফোঁটা দিয়ে ঠাকুর প্রণাম করে পরীক্ষার হলে যেতেন। কলকাতায় থাকতে রাস্তাঘাটে যাতায়াতের পথে মন্দির পড়লে আর দশজনের মতোই চোখ বুজে হাত জোড়া করে কপালে ঠেকাতেন।
আসানসোলের এই কাঠখোট্টা, খরা অঞ্চলে এসে ধর্মভাবটা কী করে যেন বিদায় নিয়েছে সনাতন মিত্রের কাছ থেকে। সনাতনবাবুও ব্যাচেলারস মেস থেকে কারখানার পথটুকু কাজে ঢুকে প্রথম প্রথম হেঁটেই চালিয়ে দিচ্ছিলেন। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসে এ অঞ্চলে গরম সাংঘাতিক। বেলা উঠতে না উঠতে চারদিক তেতে ওঠে। রোদ্দুর ঝাঁঝ করে। তখন রাস্তায় হাঁটা খুব কষ্ট। যাতায়াতের সুবিধের জন্যে কিছুদিন পরে একটা সাইকেল কিনেছিলেন।
তা সাইকেলেই হোক অথবা পায়ে হেঁটেই হোক, মেস থেকে কারখানা যাতায়াতের রাস্তা একটাই। সেই পথে কারখানা থেকে একটু এগিয়ে ঠিক কারখানায় ঢোকার পথের মুখে একটা হনুমানজির মন্দির আছে। খুবই জাগ্রত মন্দির। তার সামনের উঠোনে কারখানার দারোয়ানরা সকাল সন্ধে জয় বজরঙ্গবলী বলে ঊরুতে থাপ্পড় দিয়ে কুস্তি লড়ে।
কারখানার সমস্ত কুলি কামিন, বাবু-অফিসার এই হনুমানজির মন্দির পেরোবার সময় প্রণাম করে। কেউ যেতে যেতে কপালে হাত ঠেকিয়ে কেউ মনে মনে, কেউ বা গড় হয়ে আবার অতি ভক্তিমানরা সাষ্টাঙ্গে প্রণতি জানায়।
তা ছাড়া বড় রাস্তার মোড়ে রয়েছে নবগ্রহ মন্দির। শিল্পাঞ্চলের গরিব মানুষদের মনে ভাগ্য, তুকতাক এই সব নিয়ে, তন্ত্রে-জ্যোতিষীতে খুবই বিশ্বাস। নবগ্রহ মন্দিরেও দিনরাত ভিড় লেগেই আছে। এমনকী সনাতনবাবুর বন্ধুদের, সহকর্মীদের মধ্যে এমন অনেকে আছেন যাঁরা নবগ্রহ মন্দিরের দেয়ালে পরপর তিনবার মাথা না ঠুকে কারখানায় যান না। তার জন্যে তাদের কারখানায় ঢুকতে লেট হলেও তারা সেটা মেনে নেন।
কিন্তু মাথা ঠোকা বা কপাল ছোঁয়ানো তো দূরের কথা সনাতনবাবু পায়ে হেঁটে বা সাইকেলে যাতায়াতের পথে হনুমানজির বা নবগ্রহ মন্দিরে কখনও প্রণাম জানান না। অনেকে এসব জায়গায় থেমে, সাইকেল বা হাঁটার গতি কমিয়ে মনে মনে কিংবা ঠোঁট বিড় বিড় করে দেবতাকে নমো করেন।
সনাতনবাবু এসব কখনওই করেননি। এমনকী কাছেই বিহার বর্ডারে আন্তরাজ্য একসাইজ চেকপোস্টের পাশে এক জাগ্রত দেবী রয়েছেন। দূর দূরান্ত থেকে লোকজন, দেহাতি মানুষ সেখানে পুজো দিতে আসে।
দেবীর নাম আবগারীশ্বরী। কলকাতা হাইকোর্টে যেমন এক শিবলিঙ্গ আছে। লর্ড হাইকোর্টেশ্বর; কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরানো বটতলায় ছিল বিশ্বেশ্বরী, ঠিক তেমনই আবগারীশ্বরী।
এই রাস্তায় আবগারির মানে একসাইজের বাবুদের বড় অত্যাচার। এই চেকপোস্টে নজরানা না দিয়ে এ রাস্তা দিয়ে যাওয়া কঠিন। সরকারি নীতির সঙ্গে সঙ্গে আবগারির থাবা ক্রমশ বড় হচ্ছে, বিশেষ করে বিহার এলাকায় শুধু গাঁজা-ভাং, মদ বা মাদকদ্রব্য নয়, আবগারির আওতায় ওষুধ থেকে দেশলাই, প্রসাধনী থেকে বিলাস দ্রব্য অনেক কিছুই এসে গেছে।
রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখা বিশাল বিশাল হিন্দি ফর্ম পূরণ করতে দেওয়া। মালপত্তর কিছু লোপাট করা তদুপরি নগদ অর্থ-আবগারির বাবুদের খাই বড় বেশি।
স্বাভাবিক কারণেই পাঞ্জাবি ধাওয়া, ভাতের হোটেল, পানের দোকান এবং এই বড় মন্দিরটি গড়ে উঠেছে। এই মন্দিরের জাগ্রত দেবী আবগারীশ্বরীর পুজো দিলে চেকপোস্ট থেকে তাড়াতাড়ি পরিত্রাণ পাওয়া যায়। শোনা যায়, আবগারীশ্বরীর প্রধান পুরোহিত চেকপোস্টের দারোগাবাবুর যমজ ভাই। দুজনে নাকি একইরকম দেখতে।
দুষ্ট লোকে বলে, এই দুজনে নাকি একই লোক। কারণ দারোগাবাবুকে আর পুরোহিতমশায়কে কখনও নাকি একসঙ্গে পাশাপাশি বা মুখোমুখি দেখা যায়নি। তা ছাড়া একজনের পরনে খাকি ইউনিফর্ম, বুট জুতো, মাথায় বারান্দা টুপি। অন্য জনের খালি গা, কপালে সিঁদুরের ফোঁটা, পায়ে খড়ম, মাথায় টিকি। দুজনের মধ্যে চট করে মিল খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।
যেমন হয় বিভিন্নরকম গাড়ি ড্রাইভারের মারফত আবগারীশ্বরী এই এলাকার চারদিকে বিখ্যাত হয়ে পড়েছে। যথারীতি তার কিছু মহিমা ও বিভূতির কথাও শোনা যাচ্ছে। শুধু ড্রাইভাররা নয়, সাধারণ মানুষ যাদের আবগারির চেকপোস্টে কোনও কাজ নেই, তারাও যাচ্ছে দেবীকে প্রণাম করতে। প্রতি অমাবস্যার রাতে মেলা বসছে দেবীমন্দির ঘিরে। পাঁঠা বলি হচ্ছে, ঢাক বাজছে, রাস্তায় হাইপাওয়ার লাইন থেকে তার টেনে বিদ্যুতের আলোয় চারপাশ ঝলমল করছে। এইসব রাত আবগারি মুক্ত। একসাইজ ফ্রি। মদের ফোয়ারায়, গাঁজার কুণ্ডলিতে আচ্ছন্ন হয়ে যায় মেলা প্রাঙ্গণ।
এদিকে আরেকটা খ্যাতি হয়েছে আবগারীশ্বরীর। ড্রাইবারদের কল্যাণেই সেটা হয়েছে। নতুন গাড়ি কিনলে, লাইসেন্স নিলে, পারমিট নিলে আবগারীশ্বরীর পুজো বাঁধা। প্রতিমার পায়ে ছুঁইয়ে লাল জবা ফুলের মালা গাড়িতে লাগাতে হবে। দৈব দুর্ঘটনা থেকে প্রতিকারের এটাই অমোঘ উপায়।
সনাতন বাবুর সহকর্মীরা, মেসবাসীরা অনেকেই অনেকবার আবগারীশ্বরীকে পুজো দিয়ে এসেছেন। প্রণাম করে এসেছেন। অমাবস্যার রাতে গিয়ে হইহুল্লোড় করে এসেছেন, কিন্তু সনাতনবাবু তাদের সঙ্গে যাননি। পুরো ব্যাপারটা তাঁর বাজে মনে হয়েছে।
০৩. সঞ্চারী
সনাতনবাবুদের কারখানার উলটোদিকে সারি সারি কর্মচারিদের কোয়ার্টার। পুরনো আমলের লাল ইটের বাংলো ধরনের ছোট ছোট বাড়ি।
ঢুকবার মুখে সবচেয়ে প্রথম বাড়িটায় থাকেন কারখানার বড়বাবু অনিল দাস। অনিলবাবুর মেয়ের নাম সঞ্চারী। বছর কুড়ি-একুশ বয়েস হবে। গোলগাল, বেঁটেখাটো, একটু মোটাসোটা, ফরসা, আহ্লাদি গোছের মেয়ে। আসানসোলের কলেজে পড়ে।
সকালবেলা কারখানার জিপে করে আরও অনেকের সঙ্গে সে কলেজে যায়। বিকেলে একা একাই বাসে ফেরে। অনেকের সঙ্গে আলাপ আছে সঞ্চারীর। কিন্তু কাউকেই বিশেষ পাত্তা দিতে চায় না।
সঞ্চারী সনাতন মিত্রকেও চেনে, ভালই চেনে। মুখোমুখি দেখা হলে মুচকি হাসে। কখনও সম্বোধন করার প্রয়োজন হলে সনাতনদা বলে। খুচরো কথাবার্তাও হয়।
ঠিক এই পর্যন্তই সনাতনের সঙ্গে তার সম্পর্ক। এর চেয়ে একটুও বেশি নয়। সঞ্চারীর মনের কথা বলা যাবে না, কথাবার্তা তো একটু বেশি হলে সনাতনের আপত্তি ছিল না।
এর মধ্যে একটা কাণ্ড ঘটল। নিজের পুরনো সাইকেলটা বেচে দিয়ে অফিস থেকে স্কুটার অ্যাডভান্স নিয়ে তিনি একটা টু-হুইলার কিনে ফেললেন।
এই টু-হুইলার কেনার পর কারখানায় বা মেসে না হলেও সঞ্চারীর কাছে সনাতনের গুরুত্ব খুব বেড়ে গেল। টু-হুঁইলারে দু তিনদিন সনাতন মিত্রকে দেখার পর সঞ্চারী আর লোভ সামলাতে পারল না। সনাতনকে বলেই বসল, সনাতনদা আমাকে একটু পিলিয়নে চড়াবেন।
পেছনের বসার জায়গাটা যে পিলিয়ন বলে সেটা সনাতন মিত্র সঞ্চারীর কাছে শিখলেন এবং পিলিয়নে সঞ্চারীকে নিয়ে আসানসোল শহর একপাক ঘুরে নিয়ে পরে পথে নেমে সঞ্চারীকে আলুকাবলি, লস্যি খাওয়ালেন।
এসবের চেয়ে বড় কথা সঞ্চারীকে বসিয়ে অভূতপূর্ব এক শিহরণ বোধ করলেন সনাতনবাবু। এরকম অভিজ্ঞতা এই সামান্য জীবনে আর কখনও হয়নি বিশেষ করে যখন উঁচুনিচু এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় টু-হুইলার ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে উঠছিল। এস্তা সঞ্চারীর বাহুবন্ধন কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। সেই স্পর্শ, সেই সুখানুভূতি সনাতন মিত্রকে আবিষ্ট করে ফেলল।
কিন্তু সনাতন মিত্র একটা মহাপাপ করেছিলেন। নতুন গাড়ি কেনার পর প্রথামত আবগারীশ্বরীর মন্দিরে পুজো দিয়ে জবাফুলের মালা পরাতে হয়, নিজের কপালে এবং গাড়ির কপালে সিঁদুরের ফোঁটা দিতে হয়, সনাতন সেসব কিছুই করেননি। দোকান থেকে কিনে এনে সরাসরি চালানো শুরু করেছেন।
শুভানুধ্যায়ী বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী বন্ধুরা বারণ করেছিলেন, পরামর্শ দিয়েছিলেন আবগারীশ্বরীর মন্দিরে পুজো দিয়ে দ্বিচক্রযানটিকে বিশুদ্ধ করে নিতে। কোনওরকম ফঁড়া বা দুর্ঘটনার যোগ থাকলে তা হলে নিশ্চয় কেটে যেত।
কিন্তু অধার্মিক সনাতনবাবু সেসব কথা মান্য করেননি। সুতরাং যা হওয়ার তাই হল।
টু-হুইলার কেনার সাতদিনের মধ্যে পরপর দুটো দুর্ঘটনায় পড়ে গেলেন সনাতন মিত্র। সন্ধ্যাবেলা চালাতে গিয়ে রাস্তায় বাম্প ছিল খেয়াল করেননি, একদম গাড়ি সুদ্ধ ছিটকিয়ে রাস্তার মধ্যিখানে চিত হয়ে পড়ে গেলেন তিনি।
আরেকদিন একটা লরির পাশ কাটাতে গিয়ে উলটোদিকের একটা দ্রুতগামী ম্যাটাডোরের মুখে পড়ে গেলেন তিনি, কী করে যে সেদিন প্রাণ রক্ষা হয়েছিল ভাবতে গেলে এখনও সনাতনবাবুর হৃৎকম্প হয়।
এই দ্বিতীয় দিনে আবার সনাতনবাবুর পিলিয়নে ছিলেন তাঁরই মেসের এক বন্ধু জগৎলাল।
জগৎলাল সনাতনবাবুকে চেপে ধরলেন, অবিলম্বে আবগারীশ্বরীর পুজো দিয়ে বাহনটিকে বিপদমুক্ত করতে হবে। না হলে সমূহ সর্বনাশ হবে।
সুতরাং অনেক কিছু ভেবেচিন্তে পরের অমাবস্যার সন্ধ্যায় টু-হুইলারটি নিয়ে সনাতনবাবু। আবগারীশ্বরীর মন্দিরে গেলেন। একাই গেলেন, তার এই ধর্মকর্মের তিনি কোনও সাক্ষী রাখতে চান না।
গেঁজেল মাতালদের ভিড় রাতের দিকে বাড়ে, তাই সূর্যাস্তের পরে পরেই ভাল করে অন্ধকার। হওয়ার আগেই তিনি মন্দিরে পৌঁছে গেলেন। মন্দিরের মুখে অনেকগুলো টু-হুইলার, ট্রাক, লরি, এমনকী নতুন সাইকেল এসে গেছে, পুজো দেওয়ার জন্যে। সনাতনবাবু দেখলেন তাদের কোম্পানির জিপটাও তার মধ্যে রয়েছে।
টু-হুইলারটা ঠিকমতো রেখে সনাতন মন্দিরের মধ্যে ঢুকতে যাবেন এমন সময় দেখেন সঞ্চারী মন্দির থেকে বেরোচ্ছে, তার হাতে জবার মালা, শালপাতার ঠোঙা ভর্তি প্যাঁড়া, সঙ্গে বেশ কয়েকজন বন্ধুবান্ধবী। তাদেরও কারও কারও হাতে ওইরকম ঠোঙা, জবাফুলের প্রসাদী মালা।
হঠাৎ এমন জায়গায় সনাতনকে দেখে খুবই খুশি হল সঞ্চারী, ওমা, সনাতনদা আপনি এখানে। খুব লুকিয়ে লুকিয়ে পুজো দেন, তাই না। আজ ধরা পড়ে গেছেন। নিশ্চয়ই আপনার গাড়ির পুজো দিতে এসেছেন।
সত্যিই তো, এই তো সেদিনই পিলিয়নবাহিনী সঞ্চারীকে সনাতন বুঝিয়েছেন, সবাই যা করে তা আমি করি না। কোনও রকম পুজো না দিয়েই আমি আমার টু-হুইলার চালাচ্ছি। এসব ব্যাপারে আমার কোনও সংস্কার নেই।
ভাগ্যিস অন্যান্য স্কুটার ও গাড়ি ইত্যাদির ভিড়ে এখন সনাতনবাবুর টু-হুইলারটি চোখের আড়ালে পড়ে গেছে, তাই যে মুহূর্তে সঞ্চারী তার বন্ধুদের বলল, তোমরা চলে যাও, আমি সনাতনদার সঙ্গে ফিরব। সনাতন বলে বসলেন, সে কী করে হবে? আমার গাড়ি তো সঙ্গে আনিনি। আমি বাসে ফিরব।
ব্যাপারটা কিন্তু আরও বেকায়দা হয়ে গেল। সনাতনবাবুর এই কথায় সঞ্চারী তাকে জোর করতে লাগল, আমাদের জিপ থাকতে আপনি বাসে ফিরবেন কেন? আপনি আমাদের সঙ্গে জিপে উঠে আসুন।
সনাতনকে সঞ্চারী প্রায় হাত ধরে টেনে জিপে তুলল। জিপের পিছনের সিটের শেষপ্রান্তে সঞ্চারীর উষ্ণ শরীর ঘেঁষে বসে হাইওয়ের উদ্দাম হাওয়ার মধ্যেও তিনি ঘামতে লাগলেন।
সঞ্চারীর সঙ্গে তাদের বাড়িতে যেতে হল। আবগারীশ্বরীর পুজোর প্রসাদী প্যাঁড়া খেতে হল। কিন্তু এদিকে সারাক্ষণ সনাতনবাবুর মনটা খুঁত খুঁত করছিল নতুন টু-হুইলারটা মন্দিরের ওখানে পড়ে রইল। চুরি-টুরি না হয়ে যায়। তবু এই মুহর্তে তার পক্ষে আর কিছু করার ছিল না। সঞ্চারীদের বাড়ি থেকে বেরোতে বেরোতে রাত দশটা বেজে গেল। তখন লাস্ট বাসটাও চলে গেছে। এই রাতে দশ-এগারো মাইল রাস্তা উজিয়ে আবগারীশ্বরীর মন্দিরে যাওয়া অসম্ভব।
কোনওরকমে একটা রিকশা ধরে মেসে ফিরে এলেন সনাতনবাবু।
০৪. আভোগ
সারারাত সনাতন মিত্রের ঘুম হল না। মেসের বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করলেন, অত শখের নতুন টু-হুইলারটা নিশ্চয় চুরি হয়ে গেল। একটা পুরো রাত কি সেটা মন্দিরের সামনে পড়ে থাকবে?
ভোর হতে না হতে আলো ফোঁটার আগেই মেস থেকে বেরিয়ে বাস রাস্তায় এলেন সনাতনবাবু। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর ভোরের প্রথম বাসের দেখা মিলল।
আধঘণ্টার মাথায় চেকপোস্ট স্টপে নেমে আবগারীশ্বরীর মন্দির। উৎকণ্ঠা ভরা হৃদয়ে দ্রুত হেঁটে মন্দিরের সামনে গিয়ে সনাতন দেখলেন মন্দিরের ফাঁকা উঠোনে শুধু তার বাহনটি কাত হয়ে পড়ে রয়েছে। দুবার চোখ কচলিয়ে বুঝতে পারলেন ঠিকই দেখছেন।
কাল রাতে বিছানায় শুয়ে মনে মনে আবগারীশ্বরীর কাছে সনাতন প্রার্থনা করেছিলেন যে যদি কোনও কারণে তিনি টু-হুইলারটি ফেরত পান একান্ন টাকার পুজো দেবেন।
তার সে প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন দেবী। এবার একান্ন টাকা মানতের পুজোর ব্যবস্থা করতে হয়।
তখন সদ্য মন্দিরের দরজা খুলেছে। কিন্তু বেশ ভিড়। রাস্তার ধারে সারারাত আটকিয়ে থাকা সারবন্দি ট্রাক-লরির ড্রাইভারের পুজো দিতে এসেছে।
কোনওরকমে ধাক্কাধাক্কি করে ঘণ্টাখানেক পরে একান্ন টাকার পুজো দিয়ে এক হাতে জবাফুলের মালা আর অন্য হাতে এক চাঙারি পাড়া, ঠিক কাল সন্ধ্যার সঞ্চারীর মতো সনাতন মিত্র বেরিয়ে এলেন মন্দির থেকে।
বেরোনোর মুখে মন্দিরের দেয়ালে কপাল ঠেকিয়ে জোর প্রণাম করলেন। মনে মনে ঠিক করলেন আজ বিকেলেই সঞ্চারীকে পিলিয়নে বসিয়ে একেবারে বরাকর পর্যন্ত ঘুরে আসবেন। কাল রাতের উষ্ণ সান্নিধ্যের স্বাদ এখনও শরীরে লেগে আছে।
কিন্তু মন্দির থেকে বেরিয়ে স্বপ্নভঙ্গ হল সনাতনবাবুর। কোথায় তার টু-হুইলার। এই এক ঘণ্টায় সেটা হাওয়া হয়ে গেছে। সকালবেলার রোদে আবগারীশ্বরী মন্দিরের সামনের ফাঁকা উঠোন ঝকঝক করছে। টু-হুইলার কেন, কোনও কিছুই সেখানে নেই। শূন্য উঠোনটার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন সনাতন মিত্র।