আত্মজ – আশাপূর্ণা দেবী
ট্রেন থেকে নেমে প্ল্যাটফর্মে পা দিতেই নতুন করে বুকটা আর একবার তোলপাড় করে উঠল। যেমন তোলপাড় করে উঠেছিল গতকাল অনাথ আশ্রমের অধ্যক্ষর চিঠিখানা পেয়ে।
আশা আর আনন্দ, সন্দেহ আর বেদনায় উদ্বেল হয়ে ওঠা বুকটাকে স্থির করে নিতে শরীরটাকে টানটান করে আস্তে আস্তে অনেকক্ষণ ধরে একটা বড় নিশ্বাস ফেলল অমিতা, তার পর হাতের বটুয়াটা থেকে টেনে বার করল বহু বহুবার পঠিত সেই চিঠিখানা। টেনে বার করে ফের আর একবার চোখের সামনে মেলে ধরল।
সেই অদ্ভুত রোমাঞ্চকর চিঠি।
যে চিঠিতে মেদিনীপুর জেলার একটি অখ্যাত গ্রামের এক ছোট্ট অনাথ আশ্রমের অধ্যক্ষ অমিতাকে জানিয়েছেন—হ্যাঁ, কলকাতার করুণা নার্সিং হোমের সেই পাঁচ বছর আগে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের ফলে বিপর্যস্ত ‘হোম’ হতে এদিক-ওদিক ছিটকে যাওয়া সদ্যোজাত শিশুগুলির থেকে একটি শিশু তাঁর আশ্রমে পালিত হচ্ছে। ইচ্ছে করলে অমিতা পরিচয় প্রমাণ দিয়ে নিজের সন্তানকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে পারে। আর ইচ্ছে না করলে, শিশুটির খরচ বাবদ যদি আশ্রমে কিছু সাহায্য দেওয়া হয়, সে সাহায্য সাদরে গৃহীত হবে।
‘ইচ্ছে না করলে !’
অমিতা অনেকবারের পর আরও এক বার একটু বিস্ময়ের হাসি হাসল ! ইচ্ছে না করার প্রশ্ন আবার উঠতে পারে না কি ?
নার্সিং হোমের সেই অগ্নিকাণ্ডের দিনের কথা আর একবার স্মরণ করল অমিতা, করে লক্ষ লক্ষ বারের পর এই আরও একবার শিউরে উঠল। না, শিউরে ওঠাটা পুরনো হয়নি, এই পাঁচ বছর ধরে সেই দৃশ্য কল্পনা করেছে আর নতুন করে শিউরেছে অমিতা। আর এই পাঁচ বছর ধরে কীভাবে অমিতা পৃথিবীর ঝড়ের মুখে হারিয়ে যাওয়া একটি সদ্যোজাত শিশুকে খুঁজে বেড়িয়েছে, সে এক আশ্চর্য বিরাট কাহিনী।
কিন্তু সে কাহিনী থাক, আজকের কাহিনী হচ্ছে নার্সিং হোম থেকে হারিয়ে যাওয়া সেই ছোট্ট মাংসপিণ্ডটুকুর সন্ধান এতদিনে পেয়েছে অমিতা। যে-মাংসটুকু তার নিজের দেহেরই একাংশ। আর যার অস্থিতে, মজ্জাতে, অবয়বে আকৃতিতে প্রণবেন্দুর অস্তিত্বের স্বাক্ষর।
প্রণবেন্দু !
বুকটা মুচড়ে আর একটা নিশ্বাস পড়ল অমিতার ! চৈত্রের দুপুরের উদ্দাম বাতাস অমিতার সাদা ধবধবে সরু কানলোপাড়ের শাড়ির আঁচলটা দুলিয়ে দিয়ে গেল। সে বাতাসে সামনের ওই রুক্ষ কাঁকুরে সরু পথটার মতোই তার রুক্ষ সিঁথিটার দু পাশের চুল ক’টা উড়ল এলোমেলো, চিঠিখানা ফের ভাঁজ করে বটুয়ার মধ্যে পুরে নিল অমিতা।
প্রথম দু বছর তারা দুজনে মিলে খুঁজেছে। প্রণবেন্দু আর অমিতা। সম্ভব অসম্ভব অজস্র জায়গায় অমিতা পাঠিয়েছে প্রণবেন্দুকে, চিঠি লিখিয়েছে কোথায় না কোথায়। তারপর একদিন শেষ হয়েছে সে অধ্যায় !
পরবর্তী তিন বছর ধরে চলছে অমিতার একক সাধনা।
তুচ্ছ একজনের তুচ্ছ একটি কথার উপর নির্ভর !
নার্সিংহোমের একটা জমাদারনী বলেছিল অমিতাকে, বাচ্চাদের ঘরের সেই আকস্মিক অগ্নিকাণ্ডের সময় সে যখন দিশেহারা হয়ে ছুটোছুটি করছিল, তখন নিজের চক্ষে দেখেছে নার্স মিসেস বিশ্বাসকে ছুটে পালাতে—একটি বাচ্চাকে নিয়ে ! বাচ্চাটা অমিতারই—জমাদারনী জানে।
কিন্তু অমিতারা যখন খোঁজ পেল, তখন নার্স মিসেস বিশ্বাস তো মারাই গেছেন। আগুনে ঝলসে যাওয়ার ফলেই মারা গেছেন হাসপাতালে।
বাচ্চাটা ?
কেউ তার সন্ধান জানে না।
মিসেস বিশ্বাস জগতের এই জনারণ্যের মাঝখানে তাকে কোন নিরাপদ আশ্রয়ে গচ্ছিত রেখে গেছেন, অথবা কোথায় ছড়িয়ে ফেলে দিয়ে মৃত্যুর আহ্বানে দিশেহারা হয়ে ছুটে চলে গেছেন, কে বলবে ?
তবু সাধনার সিদ্ধি থাকে, আপ্রাণ চেষ্টার পুরস্কার থাকে।
তাই আজ আমি এখানে বুক টান করে এসে দাঁড়িয়েছে দাবির দলিল হাতে নিয়ে।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে খানিকটা যেতেই আশ্রমের অধ্যক্ষ-নির্দেশিত লাল রঙের বাড়িখানা চোখে পড়ল। আর আরও একটু এগোতেই তার সাদা রঙের কাঠের গেটটা।
গেটের ভিতরে ফুলের বাগান।
রোদে খাঁ খাঁ করছে, তবু বোঝা যাচ্ছে, সবটা মিলিয়ে যেন আঁকা ছবির মতো মনোরম পরিবেশ ! প্রিয়-পরিজনবিহীন অনাথ শিশুদের জন্য এটুকু বাড়তি আয়োজন দেখে বুঝি মানুষের মানবিকতার প্রতি নতুন করে শ্রদ্ধা আসে।
গেটের ফাঁকে হাত গলিয়ে ছিটকিনিটা খুলে ফেলে গেট ঠেলে ঢুকে পড়ল অমিতা। আর ঢুকেই বুঝি একটু থতমত খেল। মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা কি একটু কমেই গেল তবে অমিতার ? মনে হল কি—অনাথ ছেলেদের জন্যে মনোরম পরিবেশ সৃষ্টির ব্যাপারে যতটা যত্ন নেওয়া হয়, ছেলেগুলোর প্রতি বুঝি ততটা নয়।
যত্ন থাকলে এই চৈত্রের দুপুরের খাঁ খাঁ রোদে অতটুকু একটা ছেলে একা-একা অনবরত একটা ‘স্লিপে’ ওঠানামা করতে পারে ? চারদিকে তো জনমানুষের চিহ্নমাত্র নেই। ছেলেটাকে দেখেই মমতায় মনটা ভরে উঠল যেন। দ্রুতপায়ে ওর দিকে এগিয়ে গেল অমিতা।
কত বয়েস হবে ওর ?
পাঁচ বছরের বেশি কি ?
মুখের আদলে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাওয়া একটা মানুষের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যাবে না কি ? মাতৃদৃষ্টির মহিমা কীর্তন করে করে জগতের কত কাব্য, কত সঙ্গীত, কত তত্ত্বকথার সৃষ্টি, সে সমস্তই কি ভুয়ো হয়ে যাবে ? অমিতা কি বিশ্ব ভুবনের মাতৃসমাজের কাছে হেয় হবে ? চিনতে পারবে না আপন আত্মজকে ?
কেমন একটা স্খলিত অসহায় দৃষ্টিতে ওই রোদে লাল হয়ে যাওয়া দুর্বুদ্ধিওলা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকে অমিতা। তাকিয়ে তাকিয়ে বুঝি পাঁচ-পাঁচটা বছরের ঝোড়ো হাওয়ার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া একখানা ছবি মনে মনে হাতড়ে মরে।
কিন্তু কোথায় সে ছবি ?
তুলোর পুঁটুলিতে ঢাকা একটা মাংসপিণ্ড পাঁচ বছর ধরে পৃথিবীর আলোবাতাস শীততাপ আর অন্ন জলে পুষ্ট হয়ে কোনরূপে রূপান্তরিত হতে পারে, সে-কথা কে বলে দেবে অমিতাকে ?
আচ্ছা সে-দিন নার্সিং হোমে অমিতাকে দেখতে এসে কারা কারা যেন বলেছিল না—‘চাঁদের মতো ছেলে হয়েছে তোমার অমিতা !”
‘চাঁদের মতো’ মানে কি ?
খুব ফর্সা ? এ ছেলেটাকে কি চাঁদের মতো বলা যায় ? শ্যামলা রং তবে কাকে বলে ?
কতক্ষণ যে বোকার মতো দাঁড়িয়েছিল অমিত সময়ের জ্ঞান হারিয়ে কে জানে। ইত্যবসরে ছেলেটা তার উদ্দাম খেলায় ক্ষান্ত দিয়ে এদিকে সরে এসেছে।
“কাকে খুঁজছেন আপনি ?”
পরিষ্কার সপ্রতিভ গলায় প্রশ্ন করে ছেলেটি বিজ্ঞের ভঙ্গিতে দুই কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে শ্যামলা-শ্যামলা গোল গোল গাল দুটি ফুলিয়ে।
না বছর পাঁচেকের বেশি বয়েস ওর নয়।
‘কাকে খুঁজছি ?’ অমিতা অস্ফুট গলায় বলে, ‘এই তোমাদের একজনকে।’
‘আমাদের একজনকে ?’ ছেলেটার মুখে চোখে বুদ্ধিব বিদ্যুৎ-দীপ্তি, বাচনভঙ্গিতে চূড়ান্ত সপ্রতিভতা। ‘একজনকে মানে কি ? নাম নেই তার ?’
‘নাম ?’ অমিতা আরও অসহায়ভাবে চারদিকে দৃষ্টি মেলে মেলে ভাবতে চেষ্টা করে, অধ্যক্ষের পত্রে নামের উল্লেখ আছে কিনা।
কিন্তু কই ? শুধু ‘বালকটি’ বলেই উল্লেখ আছে।
‘আমি তার নাম জানি না।’
‘নাম জানেন না’, ছেলেটি হঠাৎ হো হো করে হেসে ওঠে, ‘কী বোকা, কী বোকা ! খুঁজতে এসেছে নাম জানে না ! সে আপনার কে হয় শুনি ?’
‘আমার ছেলে, আমার ছেলে হয় সে !’ ব্যাকুলভাবে ছেলেটির কাঁধে হাত রাখে অমিতা, আমি তার মা হই।’
‘ধ্যেৎ !’ ছেলেটা অবিশ্বাসের হাসি হাসে, ‘আমরা তো অরফ্যানস, আমাদের বুঝি মা বাপ থাকে ?’
‘থাকে। কারো কারো থাকে। এখানে যে একটি ফর্সা ছেলে থাকে, আমি তার মা হই। চেন না তাকে ? খু—ব ফর্সা !’
‘খু—ব ফর্সা ?’ ছেলেটা বিচিত্র ভঙ্গিতে হেসে ওঠে, ‘খু—ব তো বিজয়।’
বিজয় !
নামটা মনের সঙ্গে খাপ খায় না কেন ? অমিতা বুঝি ভুলে যায়—এখানে একটা অফিসঘর আছে, সেখানে ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তিও অবশ্যই কেউ না কেউ আছে। তাই এই ছোট্ট ছেলেটার কাছেই তথ্য সংগ্রহ করতে চায়। ‘বিজয় কি ? মানে পদবী কি ?’
‘পদবী ! ছেলেটা তার সেই বিদ্যুৎ ছিটকানো মুখে বিস্ময়ের কুঞ্চনরেখা আনে, ‘পদবী মানে কি ?’
‘মানে আর কি বুঝছ না ? এই যেমন তোমাদের ‘ফাদারের’ নাম চক্রবর্তী। জীবনকৃষ্ণ চক্রবর্তী, তাই না ?’
‘হতে পারে’। ছেলেটা এবার ঘনঘন চঞ্চল চোখে রোদেপোড়া স্লিপটার দিকে তাকাতে থাকে। ভাবটা যেন ‘ছুট মারতে পারলেই বাঁচি বাবা !’ তবু ভদ্রতাবোধের শিক্ষা আছে, তাই দ্রুতগলায় বলে ‘আমরা সবাই দাস, অরফ্যানদের তাই হওয়াই নিয়ম। আপনি ওই বাড়ির মধ্যে ঢুকে যান না, ওখানে বিজয় আছে।’
অমিতার কেন ওকে ছাড়তে ইচ্ছে করে না ? কেন দুটি ব্যগ্র বাহুর মধ্যে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয় ওকে ? সাহস হয় না, তাই জড়াতে চায় কথার পাকে।
কথার জালে কি ধরা যাবে কোন অজ্ঞাত রহস্য ?
আচ্ছা, অনাথ-আশ্রমে মানুষ হলে চাঁদের মতো ছেলে কি আর চাঁদের মতোই থাকে ? সত্যিই কি সেদিন কারো কারো চোখে সদ্যোজাত শিশুটাকে চাঁদের মতো লেগেছিল, না অমিতাকে তারা মিথ্যা আদর করেছিল, ‘চাঁদের মতো ছেলে হয়েছে তোর’ বলে ?
‘এত রোদে খেলা করছো কেন তুমি ?’
‘রোদে না হলে স্লিপ চড়ব কি করে শুনি ? তুমি যেমন বোকা ! বিকেল হলে ওরা সবাই মিলে চড়তে আসবে না ? কি করে তাহলে পঞ্চাশবার ‘ওঠ নাম’ করা হবে আমার ?
বিরক্তই হয় প্রায় ছেলেটা।
‘পঞ্চাশবার ?’ অমিতা হেসে ওঠে, ‘কেন, পঞ্চাশবার ওঠানামা করবে কেন তুমি ?’
‘করব না ? বেশ মজা তো—আহ্লাদ নাকি ? হেরে যাব বুঝি ? বিমল করেনি কালকে ?’
কথার খাঁজে খাঁজে চোখেমুখে ঠিকরে ঠিকরে ওঠে প্রাণের প্রাচুর্য, বুদ্ধির দীপ্তি।
কিন্তু এমুখে প্রণবেন্দুর মুখের সাদৃশ্য কোথায় ?
অমিতা সচেতন করে নেয় নিজেকে। বলে, ‘পঞ্চাশবার হতে কত বাকি আছে আর ?’
‘আর তেরোবার !’
‘গুণতে পার তুমি ?’
‘না পারলে ছাড়বে বুঝি ? সিস্টার মাথা ঠুকে দেবে না ?’
‘মাথা ঠুকে দেবে, সে কী ?’
‘বাঃ তা দেবে না কেন। আমি পড়া পারব না—আর সিস্টার আদর করবে, কেমন ? নাঃ তুমি বড্ড বোকা। যাও না বাড়ির মধ্যে। তোমার ছেলে তো ওখানেই আছে। শুধু শুধু আমার খেলা খারাপ করে দিলে !’
‘আপনি’র ক্লেশ স্বীকার করতে আর পেরে ওঠে না ছেলেটা।
“তোমার নাম কি বলতো ?’ অমিতা পরম আগ্রহে বলে।
‘আমার নাম তো অরুণ। আমি যাই।’
‘আচ্ছা যাবে যাবে, শোন না তুমিও চল না বাড়ির মধ্যে, বিজয়কে চিনিয়ে দেবে। আমি তো চিনি না।’
‘চেন না মানে ? চালাকি বুঝি ? বললে যে—তুমি বিজয়ের মা হও ?’
‘আহা, না তো হই, কিন্তু চিনি না যে। এমনও তো হতে পারে হয়তো বিজয়ের মা নই আমি, তোমারই মা।’
‘ব্যস ! আমনি বললেই হলো। খালি বাজে কথা। তোমার যা কথা বলবার ইচ্ছে ফাদারকে বলগে না।’
এবার ছুট মারে ছেলেটা, আর ছুটে গিয়েই শুরু করে দেয় পুরনো খেলা। উঁচু জায়গাটায় উঠে পড়ে সরসবিয়ে নামা।
অমিতা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ছেলেটার লাল হয়ে ওঠা শ্যামলা-শ্যামলা গোল গোল মুখখানার দিকে।
প্রণবেন্দুও এমনিই মুখ লাল করে ফিরত না ব্যায়াম করে ?
‘তোমাদের এইসব নাম কে দিল ? এই বিজয়, অরুণ !’
নাম কে দিল !
অরুণ একবার অমিতাকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে হো হো করে হেসে ওঠে, ‘ওঃ, তুমি বুঝি পাগল ? নাম আবার দেবে কে ? নাম বুঝি দেবার জিনিস ? নাম তো নিজেরই থাকে।’
‘ওঃ তাও তো বটে !’ অমিতা মৃদু হেসে বলে, ‘তোমাদের ফাদার কোথায় থাকেন ?’
‘কোথায় আবার থাকেন, আপিস ঘরেই থাকেন। যাও না তুমি, ওঁকে জ্বালাতন করগে না।’
‘তাই যাই। উনি বকবেন না তো ?’
‘বকতেও পারেন, সবাইকেই তো বকেন ?’
‘সবাইকে বকেন ? তোমাকেও বকেন !’
‘বাঃ বাঃ, কী বুদ্ধি। দুষ্টুমি করলে ছেড়ে দেবেন আমাকে ? আমি একেবারে আহ্লাদের রাজা বুঝি ? আর বকতে পারি না তোমার সঙ্গে, যাও।’
‘কিন্তু লক্ষ্মীছেলে, সোনাছেলে—এত বাদে থেকো না, এসো বাড়ির মধ্যে।’
অরুণ এবার খেলা ফেলে বীর বালকের ভঙ্গীতে সোজা হয়ে দাঁড়ায়, ভুরু কুঁচকে বলে, ‘আমি রোদে থাকলে তোমার কি ? তুমি তো বিজয়ের মা।ֹ’
দেহের মধ্যে কি ভূমিকম্প হয় না ?
অমিতা এই মুহূর্তে অনুভব করল, হয়।
সুদীর্ঘকালের সঞ্চিত বাৎসল্যের স্নেহ সুধারস উছলে উঠতে চায় সেই ভূমিকম্পের দোলায়।
নিশ্চয় ! নিশ্চয় এই সে। নইলে কেন এমন হবে ? আচ্ছা থাক আর দেরি নয়। দাবীর পত্র পেশ করে এই মুহূর্তে লুঠে নিয়ে যাবে অমিতা নিজের সম্পত্তি।
ভাঁজপড়া ময়লা হয়ে যাওয়া একখানা কাগজ এগিয়ে দিলেন অধ্যক্ষ। ‘এই সেই চিঠি মিসেস দত্ত।’ যে-চিঠি নার্স মিসেস বিশ্বাসের পাশের ফ্ল্যাটের এক ভদ্রমহিলা লিখেছিলেন আশ্রমের অধ্যক্ষকে।
মাস কয়েক পর্যন্ত শিশুটিকে পালন করেছিলেন তিনি, তারপর আপন অক্ষমতা জানিয়ে অনাথ-আশ্রমের শরণাপন্ন হয়েছেন। ছেলেটির পরিচয় তিনি জানেন না; তবে করুণাময়ী নার্সিং হোমের অগ্নিকাণ্ডের কথা উল্লেখ আছে। উল্লেখ আছে নার্স মিসেস বিশ্বাসের।
‘আপনি কি এখনই নিয়ে যেতে চান ? আমাদের গেস্ট হাউস আছে কিন্তু।’
অমিতা দৃঢ়কণ্ঠে বলে, ‘থাকবার জো নেই, এখুনি ফিরতে হবে।’
‘আচ্ছা তাহলে আনাই ছেলেটিকে। আপনার ছেলেটিই, বুঝলেন আমার এই ‘হোমের’ সেরা ছেলে।’
বুকের মধ্যে এ কী তোলপাড় অমিতার ?
জগতের মাতৃসমাজের কাছে মুখরক্ষা হবার আনন্দে ?
‘ছেলেটা বোধহয় বাইরে বাগানে খেলা করছে।’
কম্পিত কণ্ঠে আস্তে উচ্চারিত হয়। ‘বাইরে ? বাগানে ?’
অধ্যক্ষ চক্রবর্তী ভুরু কুঁচকে একবার জানালা দিয়ে বাইরের রোদের পরিমাণটা পরিমাপ করলেন, তারপর জোরের সঙ্গে বলেন, ‘এখন বাগানে ? না না, সে ছেলে মোটেই এরকম ‘নটি’ নয়। বললাম তো, ভেরি গুড বয়। এই যে ডাকাচ্ছি তাকে।’
অধ্যক্ষের পিছন ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার দিকে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অমিতা।
কাগজের মতো সাদা রংকেই কি চাঁদের মতো বলে ?
লেশমাত্র বুদ্ধির ছাপহীন মুখের মধ্যে একটা আঙুল পুরে ভীতু ভীতু চোখে তাকিয়ে আছে ছেলেটা, তার মাথা বড় আর রোগা দেহটার গায়ে সেই কাগজ-সাদা রংটা চড়িয়ে।
‘এই যে বিজয়, ইনিই তোমার মা, বুঝলে ? ইনি তোমাকে নিয়ে যাবেন ওঁর কাছে। কেমন যাবে তো ?
ভাবলেশ শূন্য মুখে সম্মতিসূচক একবার ঘাড় নাড়ে ছেলেটা।
‘দেখলেন তো বলেছিলাম কিনা ?’ উৎফুল্ল চক্রবর্তী সগৌরবে বলেন, ‘এর মতো বাধ্য ছেলে আর দুটি নেই আমার। সেই যে—সাত চড়ে রা নেই বলে না, ঠিক তেমনি। নিয়ে গিয়ে দেখবেন, এর জন্যে ট্রাবল বলে কিচ্ছুটি পাবেন না।’
কিন্তু এতবড় আশ্বাসেও অমিতার মুখে কথা নেই কেন ? ও কি বুঝতে পারছে না এই দীর্ঘদিনের সাধনার সিদ্ধি আজ হাতে পেয়েছে ও ? না কি—কি পেল আর কি পেল না তার হিসেব কষতে ভুল করছে ? নইলে এমন পরম প্রাপ্তির মুহূর্তে অমন ‘লোকসান লোকসান’ মুখে জড়ের মতো বসে আছে কেন ?
অমিতার নিরুত্তাপে উদ্বিগ্ন চক্রবর্তী বলে ওঠেন, ‘ডাকুন মিসেস দত্ত, কাছে ডাকুন একে। যাও বিজয়, তোমার মাকে একটু আদর দাও গে। তুমি আজ একটি শ্রেষ্ঠ ভাগ্যবান ব্যক্তি।’
বোধকরি নিজের শ্রেষ্ঠ ভাগ্যের স্পর্শ নিতেই কলের পুতুলের মতো এগিয়ে আসে বিজয়, আর দমদেওয়া যন্ত্রের মতোই অমিতার হাতের উপর একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নিশ্চল হয়ে।
কিন্তু অমিতাও কি হঠাৎ কলের পুতুল হয়ে গেল ? তাই অমন ভাবশূন্য মুখে দুই হাত তুলে নমস্কার করছে কেন চক্রবর্তীকে ? কেন অমন ঠাণ্ডা গলায় মামুলি ধন্যবাদ জানাচ্ছে তাঁকে, ‘আচ্ছা নমস্কার, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। কথা হচ্ছে, একে স্টেশন অবধি পৌঁছে দেবার জন্যে একজন লোক চাই।’
হ্যাঁ, অন্তত একটা লোক চাই অমিতার, তার এই দুর্লভের ভার বহন করতে। অঙ্কের প্রশ্নটা বারবার মস্তিষ্কের কোষে আঘাত হানছে—সন্তানকে যে মানুষ ভালবাসে সে কি শুধু তার আত্মজ বলেই, আপন দেহের একাংশ বলেই ? না সে শুধু অভ্যাসের ফল ? সঙ্গ-সান্নিধ্যের প্রতিক্রিয়া ?
১৭ এপ্রিল ১৯৬০