আইজাক নিউটন (১৬৪২–১৭২৭) – মাধ্যাকর্ষন শক্তির আবিষ্কারক
প্রশ্নটা ছিল ভারি মজার, গাছ থেকে আপেল কেন মাটিতে পড়ে? ওটা শূন্যে উড়ে যায় না কেন?
আর এই মজার প্রশ্ন থেকেই বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ যে বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেছিলেন মহাবিশ্বের এতদিনকার অজানা এক গভীরতার রহস্য মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে, তাঁর নাম স্যার আইজাক নিউটন (Sir Isaac Newton)। শুধু মাধ্যাকর্ষণ নয়, তিনি আরও অনেক নতুন নতুন আবিষ্কার করে মানব-সভ্যতাকে আরও বহুদূর এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন।
বিজ্ঞানী আইজাক নিউটনের জন্ম ইংল্যান্ডের এক ছোট্ট গ্রামের খামারবাড়িতে, ১৬৪২ সালের ২৫ ডিসেম্বর।
নিউটনের জীবনের আরেকটি মজার ব্যাপার হলো, তাঁর বাবার নামও ছিল আইজাক নিউটন। এই মজার ব্যাপারটা আসলে ঘটেছিল একটা শোকাবহ ঘটনার ফলে। আর তা হলো, তাঁর জন্ম হওয়ার কয়েক মাস আগেই তাঁর বাবা আইজাক নিউটনের মৃত্যু হয়। তাই তাঁর মা হ্যানা নিউটন স্বামীর স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য নিজের ছেলের নামও রাখেন আইজাক নিউটন।
নিউটনের বযস যখন মাত্র দুবছর, তখন তাঁর মায়ের আবার বিয়ে হয় তাঁদের গ্রাম থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরবর্তী এক গির্জার পাদরি বার্নাবাস স্মিথ-এর সঙ্গে।
তবে হ্যানা দ্বিতীয় বিয়ে করার সময় তাঁর সন্তানের মানুষ হওয়ার পথে যাতে কোনো রকম অসুবিধা না হয়, তার জন্য তাঁর নিজের সমুদয় সম্পত্তি ছেলের নামে লিখে দেন। ফলে তিনি রিক্তহাতে গিয়ে ওঠে দ্বিতীয় স্বামীর ঘরে। শুধু ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই তিনি এটা করেছিলেন। নিউটন উথপ গ্রামে তার দিদিমার কাছে থেকে মানুষ হতে থাকেন। এই গ্রামের একটি স্কুলেই প্রথমে হাতেখড়ি হয় নিউটনের। বারো বছর বয়স পর্যন্ত তিনি এই স্কুলেই পড়াশোনা করেন। গ্রামের পড়া শেষ হলে তাঁকে পাঠানো হয় গ্যানথাম শহরে। সেখানে তিনি কিংস স্কুলে ভর্তি হন। গ্যানথাম শহরের স্কুলটা ছিল বেশ দূরে। নিউটনকে তাই প্রতিদিনই অনেকটা পথ পায়ে হেঁটে গিয়ে স্কুল করতে হতো। ফলে তাঁর খুবই কষ্ট হতো, দিদিমা তাই তাঁকে শহরে রেখেই স্কুলে পড়াবার ব্যবস্থা করেন। ছেলের শহরে থাকার সব ব্যবস্থাও মা হ্যানা নিজেই করে দেন। অবশেষে ক্লার্ক নামের এক ওষুধের দোকানদারের বাড়িতে লজিং থেকে তাঁর পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হলো। দোকানি ক্লার্কের স্ত্রী নিউটনের মায়ের বান্ধবী ছিলেন।
এদিকে হ্যানার দ্বিতীয় বিয়েও খুব সুখের হলো না। নিউটনের যখন ১৫ বছর বয়স, তখন তাঁর মা তাঁর দ্বিতীয় স্বামী স্মিথকেও হারালেন। ফলে কী আর করা, দ্বিতীয় পক্ষের এক ছেলে বেঞ্জামিন এবং দুটো মেয়ে মেরি ও হ্যানাকে নিয়ে মা আবার ফিরে এলেন বড় ছেলে আইজাকের কাছে।
ছোটবেলা থেকেই নিউটন ছিলেন খুবই চিন্তাশীল। বন্ধুবান্ধব নিয়ে হইচই করতে তাঁর মন চাইত না। নির্জনে বসে চিন্তা করতেই তাঁর বেশি ভালো লাগত। স্কুলে গিয়েও সহপাঠীদের সঙ্গে তিনি খুব একটা মেলামেশা করতেন না।
মায়ের ইচ্ছে ছেলে তাঁর চাষী হবে। তাই তিনি ছেলেকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে এনে লাগিয়ে দিলেন চাষাবাদের কাজে। পড়াশোনা ছেড়ে নিউটনকে প্রত্যেক শনিবার হাটের দিন চাকরদের সাথে যেতে হতো সবজি বিক্রি করতে।
কিন্তু নিউটনের ছিল অন্য খেয়াল। মন তাঁর পড়ে থাকত পড়াশোনার দিকে। যেখানে হাট বসত, তার কাছেই ছিল নিউটনের এক বন্ধুর বাড়ি। ওদের বাড়িতে ছিল প্রচুর বইপত্র। তাই নিউটন হাট থেকে পালিয়ে চুপিচুপি চলে যেতেন বন্ধু ক্লার্কদের বাড়িতে। লাইব্রেরিতে বসে ডুবে যেতেন গভীর পড়াশোনায়।
বই পড়ার পাশাপাশি তিনি যন্ত্রপাতি দিয়ে টুকটাক কাজও করতেন। তাঁর ঘরের বই সাজাবার তাকগুলোও তাঁর নিজের হাতেই তৈরি। ওখানে বই ছাড়াও রাখা হতো ছুরি, হাতুড়ি, করাত, বাটালি, পেরেক, কাঠের টুকরো, পিন, টিন এবং আরও কত কী!
পড়াশোনা আর যন্ত্রপাতি নিয়ে নাড়াচাড়া করা ছাড়াও তাঁর ছিল ছবি আঁকার শখ। পাখির ছবি, জীবজন্তুর ছবি, মানুষের ছবি এবং বড় বড় সামুদ্রিক জাহাজের ছবি এঁকে টাঙিয়ে রাখতেন নিজের শোবার ঘরের দেয়ালে। আবার যে ছবিটা নিজের কাছেই খুব চমৎকার বলে মনে হতো সেটা তিনি নিজেই ফ্রেম তৈরি করে বাঁধিয়ে রাখতেন।
এ ছাড়াও নানা জিনিসের প্রতি ছিল তাঁর প্রচণ্ড কৌতূহল। নতুন কোনো কিছু দেখলেই তাঁর আগ্রহ বেড়ে যেত। জিনিসটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন, কীভাবে ওটা হলো।
যেমন, একদিন শুনলেন, তাঁদের গ্যানথাম শহরে বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের পরিবর্তে এসেছে হাওয়াচালিত এক নতুন ধরনের ইঞ্জিন। অমনি ছুটে গেলেন ব্যাপারটি কেমন করে ঘটছে, সেটা দেখার জন্য। তিনি ইঞ্জিনটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে অল্পক্ষণের মধ্যেই এর কারিগরি কৌশল ধরে ফেললেন। তারপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে কয়েকদিনের চেষ্টায় নিজেই অমন একটি হাওয়াকল বা বায়ুচালিত ইঞ্জিন তৈরি করে ফেললেন।
ব্যাপারটা তিনি শুধু নকল করেননি। এই ইঞ্জিন তৈরিতে তিনি তাঁর নিজের উদ্ভাবনী-শক্তিরও পরিচয় দেন। তিনি একটু মজা করার জন্য কলের ভেতর একটি ইঁদুর ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। ইঁদুরের লেজটাকে সুতো দিয়ে কলের চাকার সাথে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। ইঁদুরটা সামনে এগিয়ে গেলেই চাকায় সুতোর টান পড়ত। ফলে চাকা ঘুরত। চাকা ঘুরলে কলও চলত। তিনি ইঁদুরের সামনে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন শস্যদানা। ইঁদুরটা শস্যদানা খাবার জন্য বারবার সামনে যেত আর অমনি লেজে বাঁধা সুতোয় টান পড়ত আর কলটা চলতে শুরু করত। তিনি মজা করে ইঁদুরটার নাম দিয়েছিলেন ড্রাইভার।
এমনি করে কিশোর বয়সেই নানারকমের উদ্ভাবনীশক্তির প্রকাশ ঘটেছিল তাঁর মধ্যে।
তিনি কিশোর বয়সেই একটি জলঘড়িও তৈরি করেছিলেন।
এদিকে নানা জনের মুখ থেকে মা ছেলের এই উদ্ভাবনীশক্তির কথা জানতে পারলেন। তিনি অবশ্য ছেলের ওপর রাগ করলেন না। ভাবলেন, এই ছেলেকে দিয়ে চাষাবাদের কাজ হবে না। মন যখন ওর পড়াশোনার দিকে, তখন ওটাই ও ভালো করে করুক। ফলে ১৬৬০ সালে নিউটনকে আবার ভর্তি করিয়ে দেওয়া হলো স্কুলে।
প্রথম দিকে অবশ্য খুব ভালো ছাত্র ছিলেন না নিউটন। শিক্ষকরাও তাঁর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো ভালো মন্তব্য করতেন না। এর কারণও ছিল। কিশোর নিউটন পড়াশোনার চেয়ে কলকব্জা তৈরির দিকেই বেশি সময় ব্যয় করতেন। যন্ত্রপাতি তৈরি করার নেশায় পড়া তৈরি করার দিকে তেমন মনোযোগ দিতে পারতেন না।
কিন্তু এরই মধ্যে একদিন হঠাৎ করেই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে গেল একটি বিশেষ ঘটনার ভেতর দিয়ে।
সেদিন তিনি তাঁর ক্লাসের এক সহপাঠী বন্ধুর সাথে মারামারি করতে গিয়ে তার নাক মুখ ফাটিয়ে দিলেন। কিন্তু পরক্ষণেই শুরু হলো অনুশোচনা। ভাবতে লাগলেন, সহপাঠী বন্ধুকে তিনি গায়ের জোরে অনায়াসে হারিয়ে দিলেন ঠিকই কিন্তু সে তো ক্লাসে তাঁর চেয়ে অনেক বেশি নম্বর পায়। পড়াশোনায় সে বরাবরই তাঁকে হারিয়ে দিচ্ছে। তিনি ভাবতে লাগলেন, তিনি যদি ছেলেটাকে গায়ের জোরে হারাতে পারেন, তবে পড়াশোনায় হারাতে পারবেন না কেন? ভয়ানক জেদ চেপে গেল নিউটনের।
তিনি এবার থেকে যন্ত্রপাতি তৈরির কাজ কমিয়ে দিয়ে পড়াশোনার দিকে নজর দিলেন। যেমন করেই হোক সহপাঠী বন্ধুকে পড়াশোনাতেও হারাতে হবে।
তারপর সত্যি সত্যি তা-ই হলো। বছর খানেকের মধ্যেই নিউটন ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবী ছেলেটির চাইতেও বেশি নম্বর পেয়ে গেলেন।
স্কুল পাস করে আঠারো বছর বয়সে নিউটন ভর্তি হলেন কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে। কলেজজীবনেও অত্যন্ত মেধার পরিচয় দিয়েছিলেন নিউটন। ফলে কলেজের প্রত্যেকটি অধ্যাপকের সঙ্গে তাঁর গড়ে ওঠে সুসম্পর্ক। তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে কলেজের অধ্যাপক এবং তখনকার ইংল্যান্ডের অন্যতম খ্যাতনামা বিজ্ঞানী ড. আইজাক ব্যারো বলেছিলেন, ভাল অঙ্ক জানি বলে এতদিন একটা অহঙ্কার ছিল আমার মনে, কিন্তু এখন দেখছি নিউটনের কাছে আমিও শিশুতুল্য। তারপর ঊনত্রিশ বছর বয়সে লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির সভ্য হয়ে নিউটন সবাইকে আরও অবাক করে দেন।
বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করলেও খেয়ালের বশে তাঁর মাথায় রাজনীতির পোকা ঢুকে পড়ে। তিনি সব ছেড়ে নেমে পড়েন রাজনীতিতে। অবশ্য তাঁর রাজনীতি ছিল একটু ভিন্ন প্রকৃতির। মন্ত্রী হবার রাজনীতি ছিল না। তিনি রাজনীতিতে নেমেছিলেন শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য। দেশে শিক্ষার অগ্রগতি ও তার প্রসারের জন্য। এরই ধারাবাহিকতায় ১৬৯৬ সালে তিনি সরকারি টাঁকশালের ওয়ার্ডেন, পরে এর সর্বাধিনায়ক পর্যন্ত হয়েছিলেন। ১৭০৩ সালে তিনি রয়্যাল সোসাইটির সভাপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু এসব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলেও নিউটনের মূল লক্ষ্য ছিল বিজ্ঞান গবেষণা।
বিজ্ঞানের সব শাখাতেই রয়েছে তাঁর অতীব তাৎপর্যপূর্ণ অবদান। তাই তাঁর সম্পর্কে বলা হয়, সপ্তদশ শতক পর্যন্ত বিজ্ঞানের যা কিছু নতুন তত্ত্ব বা সূত্রের আবিষ্কার, তার প্রায় অর্ধেকেরও বেশি নিউটনের মেধা ও মননের ফসল। তাঁর প্রধান আবিষ্কারগুলোর মধ্যে রয়েছে—মহাকর্ষ ও অভিকর্ষ, গণিতের ইনটিগ্র্যাল ও ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস, গতির সূত্র, দোলন সূত্র, শীতলীকরণ সূত্র ইত্যাদি।
নিউটনের প্রথম প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক নিবন্ধের নাম ‘আলোকবিজ্ঞান’। এটি প্রকাশিত হয় ১৬৭২ সালে। এসময় তাঁর বয়স ছিল ৩০/৩১ বছর। ওই বয়সেই তিনি বিশ্বের বিজ্ঞানীসমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন।
১৬৮৪ সালের দিকে জ্যোতির্বিজ্ঞানী অ্যাডমন্ড হ্যালি নিউটনকে জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করার অনুরোধ জানান। হ্যালির অনুরোধ এবং অনুপ্রেরণাতেই তিনি ১৬৮৪ সাল থেকে ১৬৮৬ সালের মধ্যে রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ফিলোসোফিয়া ন্যাচারলিজ প্রিন্সিপিয়া ম্যাথামেটিকা’ (Philosophiae Naturalis Principia Mathematica), সংক্ষেপে ‘প্রিন্সিপিয়া’ (Principia)। নিউটন গ্রন্থটি রচনা করেছেন ল্যাটিন ভাষায়। তিন খণ্ডে সমাপ্ত এই গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে তিনি আলোচনা করেছিলেন গতির সূত্র সম্পর্কে। পদার্থবিজ্ঞানের শুরুতেই আছে নিউটনের সূত্রসমূহ, যার নাম ‘নিউটনস ল’।
এর প্রথম সূত্র হলো, যে বস্তু স্থির থাকে, তা বল প্রয়োগ না করা পর্যন্ত স্থিরই থাকে। বস্তু গতিময় হলে তা একই গতিতে চলতে থাকবে, যতক্ষণ না তার ওপর শক্তি প্রয়োগ করে গতির পরিবর্তন ঘটানো হয়। গতির দ্বিতীয় সূত্র হলো, গতির পরিবর্তনের হারের মাধ্যমে শক্তির পরিমাণ পরিমাপ করা সম্ভব। গতির পরিবর্তনের হারকে বলা হয় ত্বরণ। এটা বেগ হ্রাসবৃদ্ধির সাথে সম্পৃক্ত। গতির তৃতীয় সূত্র হলো, প্রত্যেকটি ক্রিয়ার একটি প্রতিক্রিয়া রয়েছে এবং এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সমানুপাতিক ও বিরুদ্ধমুখীন হয়ে থাকে।
‘প্রিন্সিপিয়া’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডের প্রথম অধ্যায়েই উল্লিখিত সূত্রসমূহের বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এ ছাড়া এতে বর্ণনা করা হয়েছে দোলকের দোলন এবং বিভিন্ন রকমের তরল পদার্থের গতি সম্পর্কেও।
গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে তিনি পৃথিবীমুখীন বস্তুসমূহ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে গতি ও মাধ্যাকর্ষণের নীতিসমূহ উদ্ভাবন করেছেন। পৃথিবী এবং সূর্য সম্পর্কেও তিনি এ খণ্ডে আলোচনা করেছেন।
আইজাক নিউটনের গবেষণার প্রতি নিষ্ঠা, ধৈর্য এবং একগ্রতা ছিল প্রায় অবিশ্বাস্য রকমের। তাঁর ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা সম্পর্কে যেসব গল্প প্রচলিত, আজও তা রূপকথার মতোই।
দীর্ঘ কয়েক বছরের পরিশ্রমে তাঁর আবিষ্কৃত ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাসের থিওরি সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন একটি গবেষণাগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তাঁর পোষা কুকুরটি একদিন টেবিলের ওপর লাফ দিয়ে উঠে টেবিল-ল্যাম্পটি উলটে ফেলে দেয়, আর তাতেই তার ওপর রাখা পাণ্ডুলিপিটিতে আগুন ধরে যায়। ফলে পুড়ে ছাই হয়ে যায় তাঁর দীর্ঘদিনের সাধনায়র ফসল।
কুকুরের কাণ্ড দেখে তো নিউটনের মাথায় হাত। শুধু বললেন, হে নির্বোধ, তুমি জানো না, তুমি আমার কী ক্ষতি করলে!
এত বড় ক্ষতি হওয়ার পরও তিনি দমলেন না। আবার শুরু করলেন থিসিস লেখার কাজ। এবং দীর্ঘ কয়েক বছর খেটে আবার তৈরি করলেন পুড়ে যাওয়া গনেষণাগ্রন্থটির পাণ্ডুলিপি। এমনই ছিল তাঁর নিষ্ঠা আর ধৈর্য।
তাঁর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আবিষ্কার নিয়েও আছে এমনই এক মজার গল্প। সেদিন সন্ধেবেলা তিনি বাগানে বসে ছিলেন। ঠিক এ-সময় সামনের গাছ থেকে ঝরে পড়ল একটি আপেল। তখনই তাঁর মনে প্রশ্ন দেখা দিল, আপেলটি বোঁটা থেকে খসে মাটিতে পড়ল কেন?
কারণ, এর আগে আবিষ্কৃত হয়েছে, পৃথিবী গোল, পৃথিবী তার নিজের বিন্দুতে ঘুরছে। তাই যদি হয়, তা হলে এই সন্ধেবেলা তিনি রয়েছেন পৃথিবীর নিচের দিকে উলটো হয়ে। গাছটিও উলটো হয়ে আছে। তা হলে তো আপেলটির মাটিতে না পড়ে শূন্যে উড়ে যাবার কথা।
নিশ্চয়ই আপেলটি আপনা থেকে পড়েনি। ওটাকে কোনো শক্তি টেনে নামিয়েছে। কী সেই মহাশক্তি? এই চিন্তা থেকেই তিনি আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানজগতের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার ‘মাধ্যাকর্ষণ শক্তি’।
এত বড় বিজ্ঞানী আইজাক নিউটন, এত তার নামডাক। তারপরও তিনি বিয়েথা করে সংসার পাতেননি। তিনি কেন বিয়ে করেননি, তা নিয়েও এক সুন্দর গল্প প্রচলিত আছে।
তিনি নাকি একবার একটি মেয়েকে ভালোবেসেছিলেন। তাঁকে বিয়ে করবেন বলে ঠিকও করে রেখেছিলেন। মেয়েটিও তাঁকে ভালবাসতেন। কিন্তু তবু সেই বিয়ে আর হয়নি। কেন হয়নি, সেও এক মজার গল্প। গল্পটা এ-রকমের : তিনি মেয়েটিকে বিয়ে করবেন বলে একদিন তাঁর কাছে গিয়ে হাজির হন। তারপর বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার জন্য মেয়েটির একটি হাত টেনে নিলেন নিজের হাতে।
ঠিক তক্ষুনি বিজ্ঞানের একটা গভীর তত্ত্ব তাঁর মনে ঝলক দিয়ে উঠতেই তিনি মগ্ন হয়ে গেলেন গভীর চিন্তায়। মগ্ন তো মগ্ন, এমনই মগ্ন হয়ে গেলেন যে, হাত-ধরা মেয়েটির কথাই তাঁর আর মনেই রইল না।
কোনো গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেই তাঁকে সিগারেট খেতে হতো। এ-রকম চিন্তার ঘোরেই তিনি মেয়েটির আঙুলগুলোকেই মনে করলেন সিগারেট বলে। ভুলে তার আঙুলে ধরিয়ে দিলেন আগুন। মেয়েটি যন্ত্রণায় চিৎকার দিয়ে উঠল। এই ঘটনার পর পরই মেয়েটির সঙ্গে তাঁর বিয়ে ভেঙে গেল।
কিন্তু মেয়েটির কথা তিনি জীবনে কোনোদিন ভুলতে পারেননি। পরে মনের মতো কোনো মেয়ে না পেয়ে তাঁর আর বিয়ে করাও হয়ে ওঠেনি।
এই মহান বিজ্ঞানীর মৃত্যু হয় ১৭২৭ সালের ২০ মার্চ। তাঁকে ওয়েস্ট-মিনস্টার অ্যাবেতে সমাহিত করা হয়।