2 of 2

আঁধারে সাপ চলে – বিমল সাহা

আঁধারে সাপ চলে – বিমল সাহা

সাধারণত ছোটগল্পের কোনও ভূমিকা থাকে না। সে নিজেই স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বয়ংপ্রকাশ। কিন্তু এ-কাহিনি কোনও তথাকথিত নিয়ন্ত্রিত আঙ্গিকে বাঁধা গল্প নয়। তাই সামান্য দু-একটা কথা বলার দরকার। বছর-দুই আগে দিল্লিতে মামাতো বোনের বাড়িতে বিনতা প্যাটেলের সঙ্গে আলাপ হয়। এটি তারই জীবনের ঘটনা। কিছু তার মুখে শোনা, কিছু তার ইংরেজিতে লেখা ডায়েরির মর্মানুসরণ। সত্যি কথা বলতে গেলে, আমার ভূমিকা এই কাহিনিতে অনেকটা অনুলেখকের। —লেখক

৪ ডিসেম্বর

এ আমি কী ভাবছি? না, না, এ হতে পারে না। তাড়াতাড়ি চোখ দুটো ভালো করে মুছে নিলাম। আমি তো ঘুমিয়ে নেই। তাহলে এ আমি কী ভাবছি? ভাবছি, না দেখছি? স্পষ্ট যেন আমার চোখের সামনে চলচ্চিত্রের মতো কতগুলো ঘটনা ঘটে গেল।

অলকাও এখন কলকাতায়, ওর স্বামী ওখানে বড় ডাক্তার। ওদের বিয়েতে বছর-দুয়েক আগে কলকাতায় গিয়েছিলাম। দে আর হ্যাপিলি ম্যারেড। তবে এ আমি কী ভাবছি! আমার মনে হঠাৎ ওদের কথাই বা ভাসছে কেন? ভালো লাগছে না, কিছুই ভালো লাগছে না। তাড়াতাড়ি উঠে রেডিয়োটা চালিয়ে দিলাম। আবার বন্ধ করলাম। স্টিরিয়োটা চালু করলাম। গমগম করে উঠল ঘর জ্যাজ-এর ঝমঝম আওয়াজে। নিজেও একটু টিউনের সাথে নাচলাম। ধুস! তবুও ছবিটা মন থেকে মুছছে না।

এক প্রচণ্ড অস্থিরতা পেয়ে বসেছিল বিনতা প্যাটেলকে। আসল কথা, হঠাৎ একটা ফ্ল্যাশ, অর্থাৎ, বিদ্যুতের ঝিলিকের মতো যে-ঘটনা ওর মানসিক পরদায় ছায়া ফেলেছিল, তাই ওকে অস্থির করে তুলছিল।

আশ্চর্য! ডক্টর ভর্মা ইজিচেয়ারে শুয়ে নিজের ঘরে কাগজ পড়ছেন, পাশেই বসে অলকা। হালকা নাইটগাউন পরা। চুলগুলো এলোমেলো। হঠাৎ একটানে ডক্টরের হাত থেকে কাগজটা কেড়ে নিয়ে কী যেন বলতে লাগল। এমনসময়ে ঘরে এল সুন্দর, ফিটফাট চেহারার এক ভদ্রলোক। এসেই অলকার হাত ধরে কাছে টেনে তার স্বামীর সামনেই সজোরে আলিঙ্গন করল। ডক্টর উঠে কী যেন বলতে গেলেন। হঠাৎ তিনি পড়ে গেলেন উপুড় হয়ে। তারপরই মেঝে ভেসে গেল লাল রক্তে। খুন! খুন!

চেঁচিয়ে উঠলাম আমি, পাশের ঘর থেকে মা ছুটে এলেন। বললেন, কী হয়েছে বিনী?

কিছু না মা, স্বপ্ন দেখছিলাম।

মা তো অবাক। দিনেরবেলায় জেগে-জেগে স্বপ্ন দেখছে মেয়ে! বললেন, কীরে, আজ স্কুলে যাবি না? তুই তো একদিন না গেলেই তোর টিচার-ব্রাদাররা দল বেঁধে এসে হাজির হবে!

ঠিক বলেছ, মা। ক’টা বাজে?

৫ ডিসেম্বর

এ-ব্যাপারটা কাল স্কুলে কাউকে কিছুই বলিনি। শুনলে একদল হাসবে। আবার লতিকা, জহিরা, সুমনারা শুনলে বলবে, আমার বোধহয় মেন্টাল ডিজঅর্ডার হতে চলেছে।

কী যে করি! আজও ব্যাপারটা কিছুতেই বুঝতে পারছি না। বিশেষ করে অলকার ঘরে আসা ওই আগন্তুক লোকটার কথা। তার চোখ-মুখ-চাউনি এত তীব্রভাবে মনে পড়ছে যে, আমি যদি শিল্পী হতাম তবে এক্ষুনি তার ছবি এঁকে ফেলতে পারতাম।

চওড়া কপাল, ফরসা সুন্দর রং, উজ্জ্বল চোখ, কেবল ডান গালে জুলপির নীচে বেশ বড় একটা জড়ুল। ওই লোকটি কে? ওই কি খুন করল অলকার স্বামীকে? অলকাই বা ও-লোকটার কাছে অত ঘনিষ্ঠ হয়েছিল কেন?

এ তো মহা জ্বালা! অলকা এখন কত দূরে। হয়তো সব ব্যাপারটাই একটা মিথ্যে কল্পনা। সত্যিই তো, মানুষ তার নিজের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেই, এ-ধরনের হ্যালিউসিনেশন দ্যাখে। তবে কি আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি?

৬ ডিসেম্বর

কতদিন অলকাদের খবর রাখি না। কী করব, ওদের একটা টেলিগ্রাম করে দিই—’কেমন আছ তোমরা?’ সে-ই ভালো।

আজ এখানে প্রচণ্ড শীত। তারই ভিতর আবার টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। গ্রেটার কৈলাস এলাকায় বোধহয় আমিই এত সকালে উঠেছি। চারদিক কেমন ধোঁয়াটে। সূর্যের আলোর কোনও আভাসই নেই। এ-সময়টা কলকাতাকে মনে হয় সুইজারল্যান্ড। ইউনেস্কোর ট্রেনিং-এ তিনমাস ছিলাম সুইজারল্যান্ডে। তখন ওখানে গ্রীষ্মকাল। ঠিক যেন কলকাতার ডিসেম্বর।

এই সুযোগে অলকার খোঁজ নিতে কলকাতায় গেলে কেমন হয়?

মা শুনলে বলবে, নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু কী করব! আমি যে খেতে পারছি না, ঘুমোতে পারছি না। মনের ভিতর একটা যন্ত্রণার ঢেউ উথাল-পাথাল। অকারণে গা-শিরশির ভয়! বিশেষ করে ওই আগন্তুকের চেহারাটা কিছুতেই ভুলতে পারছি না।

আজই অলকাকে টেলিগ্রাম করব।

৯ ডিসেম্বর

‘আমরা সবাই ভালো আছি। তুই একবার এখানে আয়।’

একইসঙ্গে উদ্বেগের অবসান আর কলকাতা দেখার নিমন্ত্রণ। টেলিগ্রামে অলকার জবাব পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম। অলকা কোনওদিনই আমার ‘মোস্ট ইন্টিমেট ফ্রেন্ড’ ছিল না, তবে অনেকের মধ্যেই একজন বিশিষ্টা। দু-বছর পরে তার খবর পেয়ে আনন্দ হওয়ার চেয়ে আমার ওই উদ্বেগটা যে কেটে গেল, তাতেই আনন্দ হচ্ছে বেশি। আজই স্কুলে দু-একজনকে সব বলেছি। তারা তো হেসেই আকুল। বলল, তুই তো বেশি মিস্টিক, সুপারন্যাচারাল বই পড়িস, তাই যত সব বাজে ভাবনা এসে ভিড় করে।

বাথরুমে ঢুকে কোনওদিন যা করিনি, আজ তাই করলাম। আনন্দে শাওয়ারের নীচে দু-একবার ‘শেক’ নাচলাম। অকারণেই সাবানটা নিয়ে খানিকটা লোফালুফি করলাম। আর দু-দিন পরেই স্কুল ছুটি হচ্ছে। আজই টেলিগ্রাম করে দেব : ‘কলকাতায় যাচ্ছি!’

মনের সমস্ত মেঘ কেটে গেছে মনে হয়েছিল বিনতার। কিন্তু আশ্চর্য, কলকাতায় যাওয়ার আগের দিন থেকে আবার সেই কল্পনায় দেখা লোকটার চেহারা মনের পরদায় ভেসে উঠল। মনে পড়তে লাগল অলকার লোকটাকে জড়িয়ে ধরার দৃশ্য। ওর ডাক্তার স্বামী মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে গোটা ঘরের মেঝে!

বুকের ভেতরটা মাঝে-মাঝে ফাঁকা হয়ে যেতে লাগল। একটা করুণ নিশ্বাস কেঁদে-কেঁদে গলে যাচ্ছে বর্ষার মতো। আর তারই সাথে ভয়, ভয়, ভয়, ভয়। কীসের ভয়? মনকে শক্ত করার চেষ্টা করে বিনতা। কন্টিনেন্ট-ঘোরা মেয়ে! একলা-একলা কত দেশ ঘুরেছে সে। আজ এ কী এক বিশ্রী ভয়ের চাবুক তাকে এমন করে মারছে?

না। কলকাতায় তাকে যেতেই হবে। রাজধানী এক্সপ্রেসের টিকিট কাটা হয়ে গেছে। আর পেছুলে চলবে না। কাল বিকেল পাঁচটায় গাড়িতে উঠলে পরদিন বেলা এগারোটা নাগাদ হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে যাবে। অলকা আসবে স্টেশনে গাড়ি নিয়ে।

অতএব আর কোনও ভাবনা নয়। কালই বিনতা রওনা হবে কলকাতা।

১৩ ডিসেম্বর

আমার সিটটা জানলার ধার ঘেঁষে। পাশের পর-পর দুটো সিটেই এসে বসলেন দুজন গুজরাটি ভদ্রমহিলা। কে একজন বলল, ফিল্ম স্টার সঞ্জীবকুমারের আত্মীয়। মনে-মনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম! কারণ রাজধানী এক্সপ্রেসে এই এক মজা। পাশে হয়তো কালো হোঁতকা কোনও দুর্গন্ধওয়ালা জাঁদরেল লোক এসে বসলেও করার কিছু নেই! ঠিক আমার পেছনের সারিটায় মাত্র একজন মাদ্রাজি ভদ্রলোক। গাড়ি চলতে শুরু করল, সুন্দর স্বাগত সম্ভাষণ দিয়ে লাইট মিউজিক বাজতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই চা সার্ভ করল। দু-একটা ম্যাগাজিন কিনে সামনে রেখে দিলাম। তারপর সামনের খাওয়ার ট্রে-টা টেনে তার ওপর রেখে ডায়েরির পাতা লিখছি, হঠাৎ বেশ একটু গম্ভীর গলায় ইংরেজিতে পেছন থেকে আওয়াজ এল। অনুরোধ ‘আপনার ”ফেমিনা”টা একটু পেতে পারি?’ পেছন দিকে একবার না তাকিয়েই বাঁ-হাতে ‘ফেমিনা’টা ভদ্রলোককে দিলাম।

তারপর কিছুক্ষণ কেটে গেছে। ডিনার এসে গেল। রাজধানীর খাবার চমৎকার! খিদেও পেয়েছিল। খাওয়া শেষ করে ন্যাপকিনে হাত মুছে মনে পড়ল ‘ফেমিনা’টার কথা। পেছন ফিরে দেখি, আমার পেছনের রো-টার ঠিক পেছনের সিটে ‘ফেমিনা’টা পেটের ওপর উলটে রেখে ভদ্রলোক ঘুমিয়ে পড়েছেন। কিন্তু, এ কী! এ যে অবিশ্বাস্য! সেই কপাল, সেই চোখ, সেই মুখ, হ্যাঁ—হ্যাঁ—ওই—তো…গালের ডান দিকে জুলপির নীচে বেশ বড় একটা জড়ুল! নাইটগাউন-পরা অলকাকে ইনিই তো জড়িয়ে ধরেছিলেন। ডক্টর ভর্মাকে তো এই লোকটাই খুন করেছিল!

ভয়ে আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। ধুত্তোর! ওটা একটা বাজে কল্পনা। অলকা টেলিগ্রামে জানিয়েছে, সবাই ভালো আছে। ডক্টর ভর্মার কিছু হয়ে থাকলে ও কি আমাকে এভাবে নিমন্ত্রণ জানাত!

১৪ ডিসেম্বর

ভদ্রলোককে আজ আবার দেখলাম। বেশ ফিটফাট। চমৎকার চেহারা। আলাপ করতে সাহস হল না। কী জানি কী ব্যাপার। আর কিছুক্ষণ পরই হাওড়া স্টেশন। অলকার সাথে দেখা হলেই সব রহস্য পরিষ্কার হয়ে যাবে।

হাওড়া স্টেশন। লোকে লোকারণ্য। হাতের ব্যাগটা নিয়ে সোজা বিনতা এসে দাঁড়াল ফার্স্ট ক্লাস ওয়েটিংরুমের সামনে। সে-ভদ্রলোককে আর ও লক্ষ করেনি। কোনদিকে গেছে কে জানে! দূরে বিনতা দৃষ্টি মেলে দিল। কই, অলকা তো আসছে না। ঠিকানাটা অবশ্য মনে আছে। না এলে নিজেই একটা ট্যাক্সি নিয়ে ওখানে যাবে। না, ওই তো অলকাই আসছে। বিনতা এগিয়ে গেল। অলকাও ছুটতে-ছুটতে এল।

বড্ড দেরি হয়ে গেছে।—অলকা এসে ওকে জড়িয়ে ধরল।

না, তোর দেরি হয়নি। রাজধানী এক্সপ্রেস একটু আর্লি এসেছে।—তারপর অলকাকে দেখতে-দেখতে বলল, বেশ সুন্দর হয়েছিস। গায়ে সামান্য একটু ফ্যাটও হয়েছে। ডক্টর ভর্মা কেমন আছেন?

ভালো আছে। খু-উ-ব ভালো আছে।—টেনে-টেনে বলল অলকা।

হাঁফ ছেড়ে বাঁচল বিনতা।

চল, তাড়াতাড়ি চল। আমাদের নতুন বাড়ি দেখবি।

নতুন বাড়ি? কেন, তোরা এখন কনভেন্ট রোডে থাকিস না?

মাস-ছয়েক হল ছেড়ে দিয়েছি। এই ফ্ল্যাটটা নিউ আলিপুরের কাছে। ফার্স্ট ক্লাস জায়গা। চারদিক খোলামেলা। প্রচুর আলো-বাতাস। ফ্ল্যাটটা কিনেই নিয়েছি।

তুই আমার টেলিগ্রাম কী করে পেলি? সেটা তো পুরোনো ঠিকানায় পাঠিয়েছিলাম।—বিনতা অবাক হয়।

ওই বাড়ির লোকেরা রি-ডায়রেক্ট করে এ-ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছিল।

ডক্টর ভর্মা এখন কোন হাসপাতালে অ্যাটাচড? আমার চোখটা একটু দেখাব।

ডক্টর ভর্মার সঙ্গে তোর দেখা হবে না। কারণ, উনি ক’দিনের ট্যুরে বাইরে গেছেন। তুই তো থাকবি সাতদিন।

ডক্টর ভর্মা নেই! বিনতার মনে কে যেন সপাং করে একটা চাবুক মারল। বাড়ি পালটেছে এরা! নতুন জায়গা, নতুন ফ্ল্যাট। ব্যাপারটা কী? আবার সেই পুরোনো চলচ্চিত্র পর-পর ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল। ডক্টর ভর্মা ইজিচেয়ারে শুয়ে। অলকা দাঁড়িয়ে। প্রবেশ করল সেই অচেনা ভদ্রলোক। ডক্টর মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে গেলেন। রক্তে ভেসে গেল গোটা মেঝে। খুন! খুন! গলা পর্যন্ত আওয়াজটা উঠেই আবার নীচে নেমে গেল স্বর। কীরকম তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল অলকার গাড়ির মধ্যে। চেতনা ফিরে এল অলকার বাড়িতে।

গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছিলি বলে তোকে আর ডিসটার্ব করিনি। শরীর খারাপ নাকি?—কাছে এসে অলকা বিনতার কপালে, গালে, হাত রাখল।

না, সেরকম কিছু না।

চল, আমরা স্নান, খাওয়া-দাওয়া, সেরে একটু বিশ্রাম নিই। পরে বিকেলে বেরোব কলকাতা দেখাতে।—অলকা উঠে পড়ে স্নানের জোগাড় করতে গেল।

১৫ ডিসেম্বর

আজ বিকেলে বেরোনোর মুখেই দেখা হয়ে গেল সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে। আবার সেই মুখ, চোখ, নাক আর ডান গালের জুলপির নীচে জড়ুল। একেবারে সামনা-সামনি। এ কী করে হয়! মনের ভিতর হঠাৎ দেখা দৃশ্যটি এমনভাবে মিলে যাচ্ছে!

কী রে! দাঁড়িয়ে পড়লি যে! ভদ্রলোককে চিনিস নাকি?—হাসতে-হাসতে অলকা বলল।

আমি ওঁকে চিনেছি। রাজধানী এক্সপ্রেসে আপনার কাছ থেকেই তো আমি ‘ফেমিনা’টা নিলাম। এইবার চিনতে পারছেন তো?

ও! তোমরা বুঝি একই ট্রেনে এসেছ? কিন্তু আমি তো হাওড়া স্টেশনে বিনতাকে আনতে গিয়েছিলাম। তোমাকে তো দেখলাম না!—অলকার গলার স্বরে অভিমান যেন। ব্যাপার কী? তবে কি ওরা আমার মনে ছবি দেখার মতো ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত?

এইবার আমি বললাম, অলকা, তুই এঁকে চিনিস নাকি?

কেন চিনবে না! আমি তো ওদের সামনের ফ্ল্যাটেই থাকি। ডক্টর ভর্মার অনুপস্থিতিতে আমিই তো অলকার ফ্রেন্ড, ফিলসফার, গাইড। কী বলো, অলকা?—ভদ্রলোকের সেই হাসি! সেই চাউনি! সেই—!

আমরা একটু বাইরে যাচ্ছি। তুমি ফ্ল্যাটটার দিকে নজর রেখো।—বেশ অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে কথাগুলো বলল অলকা। আর এটাও লক্ষ করলাম, ভদ্রলোক অলকাকে নাম ধরে ডাকল, কোনওরকম ‘মিসেস’ সম্বোধন যোগ না করেই। অলকাও ওকে ‘তুমি’ বলল। ডক্টর ভর্মা জেনেশুনে চুপ করে আছেন!

১৬ ডিসেম্বর : দুপুর

আজ সকালে চায়ের টেবিলে অলকাকে হঠাৎ সব বলে ফেললাম। মনের ভিতর হঠাৎ কীভাবে স্বপ্নের মতো ঘটনাটা দেখেছিলাম। আমার উদ্বেগ, দুশ্চিন্তার কথা, সবই বললাম। অলকা তো শুনে হেসেই অস্থির। বলল, তোর সন্দেহ কাটানোর জন্যে ডক্টরকে কালই টেলিগ্রাম করে দিচ্ছি। দেখবি, আমার স্বামী তোর মতো সুন্দরীকে দেখলে হয়তো আমাকে ভুলে যাবে! বিয়ের আগে বা পরে ডক্টরের জন্যে আমার এত উদ্বেগ কোনওদিনই হয়নি।

বা-ব্বা! বাঁচলাম। ডক্টর ভর্মাকে একবার দেখলেই আমার সব ভাবনা মিথ্যে হয়ে যাবে। আমিও নিরুদ্বেগ মন নিয়ে দিল্লি ফিরে যাব। সত্যি কথা বলতে গেলে, এইজন্যেই তো কলকাতায় আসা।

ভদ্রলোকের নাম মণিকুন্তল সেন। বাঙালি। ওকেও আজ ডিনারে নেমন্তন্ন করেছে অলকা। তবে অবশ্য কথা দিয়েছে, আমার এইসব বাজে ভাবনার কথা কিছু বলবে না। দেখা যাক।

১৬ ডিসেম্বর : রাত আটটা

এই অংশটি অনেক পরে ডায়েরিতে লেখা হয়েছিল

ডাইনিং হলে ঢুকতে যাওয়ার আগে অপরিচিত গলার আওয়াজে থমকে দাঁড়ালাম। মাঝের ঘরের ঝোলানো পরদার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিতেই দেখি মণিকুন্তল সেন আর অলকা পাশাপাশি চেয়ারে বসে। টেবিলের ওপর আমাদের তিনজনের প্লেট, কাঁটা-চামচ, খাবার সাজানো। শুধু আমি গিয়ে বসলেই ‘ডিনার’ শুরু করা যাবে। মণিকুন্তলবাবু অলকার কাঁধে হাত রেখে বলছে, তুমি ভয় পেয়েছ নাকি? এসব কখনও হয়? আমাকে তোমার বন্ধু জীবনে দেখেনি, সে কী করে আমার মুখ দেখল স্বপ্নে?

না, না, স্বপ্ন নয়।—অলকার স্বরে আতঙ্ক। বলল, বিনতা জেগে-জেগেই চোখের সামনে দেখেছে ডক্টর ভর্মার খুনের দৃশ্য। আমি তো সত্যিই সেদিন নাইটগাউন পরে তোমাকে জড়িয়ে ছিলাম। তোমার চেহারা, এমনকী তোমার ডান গালে জুলপির নীচে জড়ুলটার কথাও বলেছে! আমার ভীষণ ভয় করছে। শেষকালে ধরা পড়ে ফাঁসি হবে না তো?—বলতে-বলতে অলকা নিবিড় হয়ে গেল মণিকুন্তলের কাছে।

তোমারও দেখছি মাথা খারাপ হল! আমি যে খুন করেছি, তা প্রমাণ করতে হবে না? কোন পাগলে এসে কী বলল, তাই বুঝি আইন অমনিই মেনে নেয়? তার ওপর এ-কেস তো পুলিশ সুইসাইড কেস ধরে নিয়ে ইতিমধ্যেই ক্লোজ করেছে। তবে, তোমার বন্ধুকে যাতে আর ফিরতে না হয়, তার ব্যবস্থাও আজ করব। এই দ্যাখো।—বলেই মণিকুন্তল সাইলেন্সার লাগানো রিভলভারটি দেখাল।

আর একমুহূর্তও নয়। পা থেকে মাথা অবধি গা-শিরশির করে উঠল। কপাল, চোখ-মুখ ঘেমে নেয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে এসে কিছু টাকা আর দু-একটা জরুরি জিনিস নিয়ে ওদের শোওয়ার ঘরে ঢুকলাম। ওই তো টেলিফোন। পাশেই টেলিফোন গাইড। টেলিফোনের রিসিভার তুললাম লালবাজার হেড কোয়াটার্সে ফোন করার জন্যে। এ কী! কোনরকম ‘রিঙিং টোন’ই তো বাজছে না! তবে? নীচের দিকে তাকিয়ে দেখি, টেলিফোনের তার কাটা। তবে? এখন কী করব? কী করে ঘরের বাইরে যাব? ফ্ল্যাট থেকে বাইরে যাওয়ার একটাই তো পথ!

স্পষ্ট বুঝতে পারছি অলকা-মণিকুন্তল দুজনে মিলে সমস্ত প্ল্যানই তৈরি করে ফেলেছে। ওরা কোনও দায়িত্ব নিতে চায় না। ডক্টর ভর্মার খুনের একমাত্র মানসিক সাক্ষীকে চিরতরেই ওরা সরিয়ে দেবে। তারপর আমার লাশ গুম করে দিলেই সব শেষ! আসার সময়ে বাড়ির কাউকে অলকার ঠিকানাও দিয়ে আসিনি। না, না, যে করেই হোক, পালাতে হবে।

বিনতা! বি…ন…তা!—অলকা ডাকছে।

পাগলের মতো ঘরের মধ্যেই ছুটোছুটি করতে লাগলাম। ডাইনিং হলে ওরা আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। হঠাৎ বারান্দার এককোণে লাইটের মেন সুইচটা নজরে পড়ল। ভগবানের নাম নিয়ে দিলাম সুইচটা অফ করে! সঙ্গে-সঙ্গে গোটা বাড়ি অন্ধকার। ভালুক-অন্ধকার। পা টিপে-টিপে মেন দরজার কাছে এসে গোদরেজের ল্যাচটা আস্তে-আস্তে খুলেই সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে এলাম সদর রাস্তায়। কানে বাজতে লাগল অলকা-মণিকুন্তলের ছুটোছুটি আর আমার নাম ধরে ডাকাডাকি!

এরপরের ঘটনা জলের মতো সহজ গতিতে এগিয়ে গেছে। লালবাজারে বিনতা প্যাটেলের পরিচিতি আর সমস্ত ঘটনার আদ্যোপান্ত বিবরণ নথিভুক্ত হল। পুলিশি তদন্তে শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হল, মণিকুন্তল সেনই ডক্টর ভর্মার হত্যাকারী! আর সেই নৃশংস ব্যাপারে সাহায্য করেছে নিহত ডক্টরেরই সহধর্মিণী অলকা ভর্মা।

কিন্তু এই ঘটনার আসল জিজ্ঞাসা হল, তবে কি মানুষের সাধারণ জ্ঞানের বাইরেও মানসিক জগতের বিস্ময়কর প্রতিক্রিয়া রয়েছে? চেতনের গভীরে অবচেতনের আঁধারে কোনও-কোনও ইচ্ছা মানুষের মনকে ছোবল মারে বিষাক্ত সাপের মতো। সেই ইচ্ছাই হয়তো তার মানসিক পটে চলচ্চিত্রের জীবন্ত ছায়া হয়ে অজানা জগতের এক নতুন ইশারা দেয়।

মাসিক গোয়েন্দা

পুজো সংখ্যা, ১৯৭৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *