আঁচড়াক
‘বাঃ, বিউটিফুল। ঘরের শোভা কী রকম খুলেছে দেখেছ? মনে হচ্ছে বাকিংহাম প্যালেস।’ নব ভারত ফারনিশার্স এই মাত্র ডেলিভারি দিয়ে গেল অলিভ গ্রিন রঙের পুরু ফোম মোড়া সোফাসেট। তলায় গোল গোল গড়গড়ে চাকা ফিট করা। বেশ গায়ে গতরে জিনিস। চাকা ছাড়া সহজে নড়বে না। হর্ষবাবু নতুন সোফায় চেক-চেক লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে, ফোলা-ফোলা মুখে বসে আছেন। ভুঁড়িটা বসে আছে কোলে, সযত্নে লালিত সম্পত্তির মতো। বুকে বুক চিতিয়ে পড়ে আছে সোনার চেনে ঝোলানো গুরু দত্ত রক্ষা কবচ। পায়ে কোলাপুরী চটি। সময়, সকাল। বাইরে থিন অ্যারারুট বিস্কুট রঙের দিন। একেবারে টাটকা, তরতাজা, মুচমুচে। কাক ডাকছে। সাইকেল রিকশা প্যাঁক-প্যাঁক করছে।
হর্ষবাবুর স্ত্রী সোমা দেবী সবে স্নান সেরে, ভিজে চুল এলো করে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আদুরে ভঙ্গিতে। দ্বিতীয় পক্ষ। বয়েসের বেশ ফারাক আছে। প্রথম পক্ষটি ছিলেন গ্রামের মেয়ে। সংসারের উপযোগী, তার বেশি কিছু নয়। কালচারে কিছু কমতি ছিল। তিনি ছিলেন বাঁশের ছাতার মতো। রোদ বৃষ্টির উপযুক্ত। ইনি হলেন জাপানি ফোলডিং। দু-ক্ষেপে খোলেন। তিন ক্ষেপে বন্ধ হন। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি সামলাতে পারেন। তেড়ে এলে অচল। প্রথম পক্ষটিকে গ্রামের বাড়িতে গোয়াল সামলাবার জন্যে রেখে এসেছেন। গোয়ালে আছেন বৃদ্ধা মা। আর আছে ভোঁদকা একটি ছেলে। পোলিও আক্রান্ত একটি মেয়ে। আর আছেন নি:সন্তান বৃদ্ধ জ্যাঠামশাই। যাঁর কাজ হল সারাদিন দাবা খেলা। সদ্য স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে তাই সন্ধের দিকে বাংলা ধরেছেন। রাতে বিদেহী স্ত্রীকে সীতাহরণ পালা শোনান। তারপর জয় রাম, জয় রাম করতে-করতে খাটে দেহ ফেলতে গিয়ে ভুঁয়ে উল্টে পড়েন। সেই অবস্থায় ককিয়ে ককিয়ে বলতে থাকেন, সুধা তুমি আমায় এইভাবে ল্যাং মারলে বাওয়া।
প্রথম পক্ষ বর্তমানে দ্বিতীয় পক্ষ নেওয়া যায় না। আজকাল গ্রামেও আধুনিক পলিটিকস ঢুকেছে। রোজই এ-দলের ও-দলের লাশ পড়ে যাচ্ছে। প্রথম পক্ষের হয়ে বড় একটি দলের পান্ডারা লড়তে চেয়েছিলেন। ব্যাপারটা আর একটু হলেই ‘পলিটিক্যাল ইসু’ হয়ে দাঁড়াত। হর্ষবাবু খেলোয়াড় মানুষ। কায়দা করে ম্যানেজ করে নিয়েছেন। টাকা পয়সার অভাব নেই। বেশ গেছে, আরও যাবে। ধরেই নিয়েছেন, ওরা হল দ্বিতীয় পক্ষটির ভ্রাতৃকুল, সম্পর্কে শ্যালক। বহু জামাইবাবুকেই শ্যালক পুষতে হয়।
স্নানের পর স্টেনলেস স্টিলের গেলাসে সোমা আধ গেলাস পরিমাণ লেবু চা খান। হাতে সেই গেলাস। প্রশ্ন করলেন, ‘কত খসল?’
‘বারো হাজার। টুয়েলভ থাউজন্ড।’
‘বারো হাজার দিয়ে তুমি সোফা কিনলে? পয়সা কামড়াচ্ছিল? বারো হাজারে আমার একটা মুক্তোর মালা হয়ে যেত। একটা হিরের আংটি হত।’
হর্ষ সোমাকে খুব তোয়াজে রাখেন। সুন্দরী। শিক্ষিতা। বয়েস কম। হঠাৎ হাত ছাড়া হয়ে যেতে পারে।
হর্ষ বললে, ‘মুক্তোর মালা, হিরের আংটি। সব হবে। সব হবে। যদ্দিন আমার টিউটোরিয়াল হোম আছে, দেশের এই শিক্ষাব্যবস্থা আছে। মধ্যবিত্ত বাঙালি আছে, কমপিটিটিভ পরীক্ষা আছে, তদ্দিন তোমার ভয় নেই সমু। নোটস আর সাজেশান বেচব আর তোমাকে সোনা দিয়ে মুড়ব। এস, বোসো। বসে দেখো বারো হাজারের কী আরাম! কী স্প্রিং দেখছ।’
হর্ষ নেচে উঠলেন একবার। সোফার স্প্রিং-এ ঢেউ উঠল। হর্ষ দুলছেন ঢেউয়ের তালে যেন বয়া নাচছে। প্রেমালাপ আর এগোবার অবকাশ পেল না। হর্ষবাবুর যোগশিক্ষক সনৎকুমার এসে গেলেন। তিনি যোগী আবার মালিশ বিশেষজ্ঞ। এখুনি হর্ষবাবুকে কম্বলের ওপর ফেলবেন, শরীরটাকে দোমড়াবেন, মোচড়াবেন, ত্রিভঙ্গমুরারি করে রাখবেন, তারপর ঘণ্টাখানেক ভিটামিন তেল দিয়ে দলাইমলাই করে ছেড়ে দেবেন। ভুঁড়ি কমাতেই হবে। যৌবনকে আমলকীর মতো হাতে ধরে রাখতে হবে করতল-আমলক-বৎ।
হর্ষবাবু সপ্তাহে তিন দিন যোগাসন করেন। তিন দিন ব্যায়াম। একদিন রোয়িং। লেক ক্লাবে গিয়ে দাঁড় টানেন। ভাবছেন টেনিসও খেলবেন। দশ বছর আগের হর্ষ সরকার আর নেই। পাঁচ আঙুলে পাঁচখানা আংটি। পাঁচটা বড় গ্রহ, শনি, রাহু, বৃহস্পতি, শুক্র, মঙ্গল এখন ট্যাঁকে । সত্যিই ট্যাঁকে। জ্যোতিষ একেবারে সেন্টপারসেন্ট সায়েনস। শুক্র সোমাকে ছেঁকে তুলেছে। ভাবা যায়, সোমা সুড়সুড় করে চলে আসবে জীবনে। অমন একটা মেয়ে। যে জানলার ধারে দাঁড়ালে লোক গাড়ি চাপা পড়ে রাস্তায়। চরিত্রে সামান্য যা খাবলাখুবলি ছিল সব ভরাট হয়ে গেছে। দেহ আর চরিত্র এক জিনিস। মাংস খুবলে গেলে অটোমেটিক গজায়। শুক্র একেবারে ভোগের চূড়ান্ত করে ছেড়েছে। গোবিন্দভোগ চালের ভাত, কোলের দিকে গাওয়ার স্নেহ। বাটিতে মাছের মুড়ো। রাতে চিকেনের চিকন ঠ্যাং। সকালে কাজু, কিসমিস, কড়াপাক, ফলের রস। বিকেলে মুড়ি, নরমপাক, চিনেবাদাম। সন্ধেবেলা এক সিপ বিলিতি। সপ্তাহে একবার গাড়ি যায় সার্ভিসিং-এ। মাসে একবার দেহ যায় চেকআপে। ওরে ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে।’ মঙ্গল কচাকচ শত্রু নিধন করছে। যে পেছনে লাগতে আসছে সে-ই কাত হয়ে যাচ্ছে। পারিজাত পন্ডা প্রথম পক্ষের পক্ষ নিয়ে জল ঘোলা করার তালে ছিল। ধোলাইয়ের ভয় দেখিয়েছিল। পাঁচ হাজারে আগুনে জল পড়ল। আবার ব্যাটা ধোঁয়াচ্ছিল। গত মাসে খবর এল পন্ডার লাশ পড়ে গেছে। পড়তেই হবে। বৃহস্পতি সহায় হয়েছেন। হর্ষবাবু এখন শিক্ষাগুরু। নোটস আর সাজেশানস কিনছে তিন মাস পড়ছে, ডিগ্রি আর ডিপ্লমা বগলে হাসি মুখে ফাঁসি বরণ করছে। ফাঁসিই তো। শিক্ষার ফাঁস গলায় সেরেস্তায় কোনও রকমে বসছে, বছর না ঘুরতেই প্রেমিকার সঙ্গে রেজিস্ট্রি ম্যারেজ। নাও, এবার দুধের টিন বাজাও। শ্রীমতীর পদসেবা করো। বাঙালির এই তো ফিউচার। কজন আর তার মতো কর্মযোগী আর জ্ঞানযোগী হতে পারে। ছেলেবেলা থেকেই স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর আদর্শ পুরুষ। সংসারে থেকেও হর্ষ প্রেমিক। প্রেমিকই তো। তা না হলে সোমার সঙ্গে পাঁচটা বছর সমানে লড়ে শেষ পর্যন্ত ছিপে গেঁথে ফেললে। স্বামীজী বলেছিলেন জীবে প্রেম। তিনি ব-টাকে শুধু এক অক্ষর ঠেলে ভ-এ নিয়ে গেছেন। জীবে হয়ে গেছে জিভে। কত বড় বৈদান্তিক তিনি। বৃদ্ধ মায়ের কথা, দু:খী প্রথম স্ত্রীর কথা, ছেলে কি বিকলাঙ্গ মেয়ের কথা, কারুর কথাই আর তেমন মনে পড়ে না। খুব মায়া।
তেল দলাইমলাই করে যোগী চলে গেলেন, এইবার হর্ষবাবু আস্ত একটি গাজর খাবেন চিবিয়ে-চিবিয়ে। গাজর হল এনার্জি। গাজর হল দৃষ্টিশক্তি। পৃথিবীতে বাঁচতে হলে তিনটি জিনিসের ভীষণ প্রয়োজন—চোখ, নাক আর কান। চোখ দিয়ে দেখতে হবে প্রতিপক্ষের চাল। অন্যের ব্যাপারে নাক গলাতে হবে যার নাম পলিটিকস। কান খাড়া রাখতে হবে। শুনতে হবে কে কী বলছে। শোনার ওপর নির্ভর করছে সাবধান হওয়া, ব্যবস্থাদি নেওয়া। ছোট ভাই বেগোড়বাঁই করতে পারে, আগে ভাগে শুনেছিল বলেই না, সময় মতো বিশবাঁও জলে ফেলতে পেরেছে। নে ব্যাটা এবার হাবুডুবু খেয়ে মর।
গাজর খাওয়া শেষ করে হর্ষ উঠে দাঁড়ালেন। এইবার বিদেশি সাবান মেখে স্নান। পুজোর আগেই বাথরুমের হাল পালটাতে হবে। পোরসিলেন টাইলস, বাথটাব, জেট শাওয়ার। স্নান সেরে পুজোয় বসলেন। হর্ষ সাকারবাদী নন। নিরাকারের ধ্যান করেন। ঈশ্বর মানে এনারজি। যা কিছু এনারজি দেখ তাই ঈশ্বর। সেই থিওরিতে চা ঈশ্বর। ভিটামিন ক্যাপসুল ঈশ্বর। চিকেন সুপ ঈশ্বর। আসনে বসে মিনিট পাঁচেক প্রাণায়াম করলেন। প্রাণায়াম মানে রক্তে অক্সিজেন মেশানো। অক্সিজেন এনার্জি দেয়। অক্সিজেন ঈশ্বর।
আসন থেকে উঠে খুব মিহি ধুতি পরলেন। আদ্দির গিলে করা পাঞ্জাবি। প্রায় সিকি শিশি সেন্ট স্প্রে করে ফেললেন শরীরে। বাড়ির সামনে কালো গাড়ি অপেক্ষা করছে। খরচ করে গাড়ির ভেতর বাড়তি কিছু ব্যবস্থা করেছেন। গানের ব্যবস্থা। ম্যাগাজিন রাখার ঝোলা। সামনের আসনের সঙ্গে লাগানো ছোট ফোলডিং টেবিল। দুটো হোমিওপ্যাথিক পাখা। মোটা নরম, তুলতুলে গদি। এগারোটার মধ্যেই টিউটোরিয়াল হোমে গিয়ে বসে পড়েন। দূর দূরান্ত থেকে, নোট আর সাজেসানস নেবার জন্যে খদ্দেররা আসতে থাকে। অধ্যাপকরাও আসেন। খুব একটা সোজা রাস্তার ব্যাবসা নয়। বাইরেটা সহজ, সরল, ভেতরটা গোলমেলে। পরীক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, সন্তুষ্ট রাখা, তোয়াজ করা। সাজেসানস না মিললে ব্যাবসা তো লাটে উঠবে, গণ ধোলাইয়েরও সম্ভাবনা আছে। দিনকাল ভালো নয়। হর্ষ সব সময় সঙ্গে একটা রিভলভার রাখেন। তেমন বিপদে পড়লে চালিয়ে দেবেন।
হর্ষবাবু মাসখানেক হল বড় বড় লোমওয়ালা বিলিতি একটা কুকুর পুষেছেন। বেশ ন্যাওটা হয়েছে। পায়ে পায়ে ফুরফুর করে ঘোরে। কুকুরটাকে আদর করে গাড়িতে উঠতে যাবেন, হঠাৎ চোখে পড়ল এক বৃদ্ধা এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে, সামান্য সামনে ঝুঁকে গুটগুট করে এদিকেই আসছে। চেনা চেনা লাগছে। মা না কি? হ্যাঁ, মা-ই তো। মা কোথা থেকে এল। বুড়ি চোখে ভালো দেখে না, কানে কম শোনে, কোমর ভেঙে গেছে। নাও বোঝো ঠ্যালা। এইবার জ্বালিয়ে মারবে।
বৃদ্ধা রাস্তার একটি লোককে জিগ্যেস করলেন, ‘হ্যাঁ বাবা, হর্ষ সরকারের বাড়ি কোনটা?’
লোকটা না থেমে বললে, ‘ওই তো মাল দাঁড়িয়ে আছে।’
হর্ষ মনে মনে বললেন হারামজাদা। গত বছর এই ব্যাটাই পুজোর চাঁদা নিতে এসে খুব গরম গরম বোলচাল ছেড়েছিল। হর্ষকে থানায় ডায়েরি করতে হয়েছিল। তারপর থেকে সুযোগ পেলেই খোঁচায়। যাওয়া আসার পথে দেখা হয়ে গেলে নানারকম আওয়াজ দেয়, সিটি মারে। বলে কার্তিকবাবু। অসহায় হর্ষ। প্রতিবাদের সাহস নেই। ক্ষুরটুর চালিয়ে দেবে। থানায় রিপোর্ট করেও লাভ নেই। প্রতিকার তো হবেই না, উলটে হামলা হবে। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হবে। বুলগ্যানিনকে প্রায় হাত করে ফেলেছে। এইবার একদিন স্রেফ হাওয়া করে দেবে। বুলগার এখন অসীম ক্ষমতা। ওপর মহল, পুলিশ মহল সর্বত্র বুলগার হাত। এ হাত কালো নয়। ঠিক রঙ এই, রাঙানো।
হর্ষ দুপা এগিয়ে গিয়ে মাকে বললেন, ‘কী গো, তুমি আবার কোথা থেকে এলে হঠাৎ। বলা নেই, কওয়া নেই।’
চোখের কাছে হাত এনে রোদ আড়াল করতে-করতে বৃদ্ধা বললেন, ‘ও মা, খোকা। কত দিন তোকে দেখিনি বাবা। আর থাকতে পারলুম না। তাই অশোক যেই গেল, বললুম আমাকে একবার নিয়ে চল। তা ওই মোড়ের মাথায় নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। তা হ্যাঁরে, এই তোর গাড়ি। বা: কী সুন্দর। হ্যাঁরে, এই তোর বাড়ি। বা: কী সুন্দর। ভগবান তোকে খুব দিয়েছে বাবা। মায়ের দয়ার মতো, একেবারে ঢেলে দিয়েছেন। নতুন বউ কোথায় রে। শুনেছি খুব সুন্দরী।’
বিরক্ত মুখে হর্ষ বুড়ির বকবকানি শুনছিল। থামতেই বললেন, ‘অশোক ওখানে কীসের ধান্দায় গিয়েছিল।’ অশোক হল হর্ষর সেই ছোট ভাই, যাকে বেশ মোক্ষম টাইট দিয়েছেন।
বৃদ্ধা বললেন, ‘ও মা, সে কী কথা রে। ছেলে মায়ের কাছে যাবে না। মা ছেলের কাছে আসবে না।’ হর্ষ প্রসঙ্গ পালটে জিগ্যেস করলেন, ‘তুমি কি থাকবে বলে এসেছ?’
‘ও মা, ই কী কথা। থাকব বলেই তো এসেছি। ছেলে আমার মানুষ হয়েছে, বড়লোক হয়েছে, কয়েকদিন আদর যত্নে থেকে যাই।’
‘তোমার কিন্তু অসুবিধে হবে না। এ বাড়ির তেমন বাছবিচার নেই। মুরগি, মাটন সবই চলে।’ দরজার কাছে সোমা এসে দাঁড়িয়েছিল। কেউই লক্ষ করেননি। সোমা বললেন, ‘কোনও অসুবিধে হবে না। আপনি ভেতরে আসুন মা।’
সোমার কথায় হর্ষর অস্বস্তি পঞ্চাশ ভাগ কেটে গেল। এমন একটা মাকে সোমার সামনে কীভাবে হাজির করবেন লজ্জায় মাথা কাটা যাবে, এই সব ভাবছিলেন। সোমা এই প্রথম হর্ষর মাকে দেখছে। বৃদ্ধা চারপাশে তাকাতে তাকাতে ভেতরে ঢুকলেন। ছেলের এই বাড়িতে এই প্রথম আসছে বুড়ি। দেখে শুনে অবাক। বড়-বড় সাজানো, গোছানো ঘর। দেয়ালে, দরজায় জানলায় সুন্দর রঙ। চার দেয়ালে চার রকম রঙ।
হর্ষবাবুর লোমওয়ালা কুকুরটি নতুন কেনা সোফার তলায় ঘাপটি মেরে শুয়েছিল। গুড়গুড় করে বেরিয়ে এসে বৃদ্ধাকে শুঁকতে লাগল। বৃদ্ধা ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়ে বললেন, ‘ও মা এটা আবার কী জন্তু মা?’
সোমা হেসে ফেলেছেন, ‘কোনও ভয় নেই আপনার। এ হল কুকুর। এর নাম জার্মান সিপৎস। কামড়ায় না। শুধু আদর করে আর আদর খায়।’
বৃদ্ধা তবু ভয়ে সিঁটিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। বুড়ির রকম সকম দেখে হর্ষ বললেন, ‘তোমার তো কোনও কালে কুকুরে এত ভয় ছিল না। একে দেখে ভয় পাচ্ছ!’
‘অ্যাঁ, সে তো নেড়ি কুকুর। নেড়িকে আমি ভয় পাই না। এ সব বিলিতি তো। কখন কোন মেজাজে থাকে।’
সোমা বললেন, ‘নেড়িকেই তো ভয় বেশি। কামড়ালেই জলাতঙ্ক। এ সব কুকুরে সে ভয় নেই। ইনজেকশান দেওয়া আছে।’
বৃদ্ধা তবু ভয় পাচ্ছেন দেখে সোমা কুকুরকে আদেশ করলেন, ‘পমপম, যাও শুয়ে পড়ো ওর তলায়।’
ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধা তাকিয়ে তাকিয়ে সব দেখছেন। বই। বইয়ের পর বই। ফ্রেমে বাঁধানো ভালো-ভালো ছবি। ‘ওদেশের মেয়েরা একটু বেহায়া হয় বাপু। সে তোমরা যে যাই বলো। তা না হলে অমন করে গতর দেখাতে পারে।’ বৃদ্ধা ভাবলেন। আরও ভাবলেন, বিয়ের পর-পরই হর্ষর বাপ রাতে বিছানায় শুয়ে আদর করতে করতে বলতেন, ‘তুমি আমায় পাগল করে দেবে। ভগবান তোমাকে কী ক্ষীর দিয়ে ছেনেছেন।’ নিজের শীর্ণ, চামড়া কোঁচকানো, দীর্ঘকালের পুরনো হাতের দিকে তাকালেন। অত ভাবতে পারেন না। তবু মনে হয় সবাই বলে মৃত্যু না কি হঠাৎ আসে। সে যারা দুম করে অকালে মরে তারা বলতে পারে। যারা অনেকদিন বাঁচে, তারা চোখের সামনে দেখতে পায়। কুঁচকে, কুঁচকে, বাঁধাকপি পাতার পোকার মতো, গুটিয়ে পাকিয়ে এগিয়ে আসতে থাকে। ফুটো ফুটো করে দেয়।
‘আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে’, বলে হর্ষ বেরিয়ে এলেন।
হর্ষর একজন দুজন চামচা আছে। চামচার প্রয়োজন হয়। প্রচার করে বেড়ায়, হর্ষ হল ছেলে সরস্বতী। গবেট নিরেট যে যেখানে আছ ছুটে গিয়ে ধরে পড়ো। এমএ, বিএ, লঃ এল এলবি, এম বিবিএস, যার যা ইচ্ছা, সব হয়ে যাবে। তিনটে মাস শুধু পড়তে হবে। উজ্জ্বল সেইরকম একজন চামচা। টুকটুকে দেখতে। থাকে বোকা-বোকা। ভালো মানুষটির মতো, এলিয়ে-এলিয়ে হেলিয়ে-হেলিয়ে কথা বলে, আসলে এক নম্বরের ধুড়িবাজ, ধান্দাবাজ। শাঁসে জলে মানুষ দেখলেই কায়দা করে ভিড়ে যায়। কাজের মধ্যে ঢোল বাজানো। লাভের মধ্যে, গাড়ি চেপে ঘুরে বেড়ানো, ছুটির দিনে লটবহর নিয়ে মাছ ধরতে যাওয়া আর সারা দিন ধরে ভালোমন্দ খাওয়া। চিকেন সুপ, কাজু বরফি, বাদামের সরবত। মুরগির রোস্ট। দু একটা ছাত্র ধরে আনতে পারলে কমিশন। উজ্জ্বল এলিয়ে-এলিয়ে, নিখুঁত নিভাঁজ ভালো মানুষের গলায় নিবু-নিবু প্রদীপের চোখে বললে, ‘হর্ষদা, আজ এখনও বেরোননি।’
‘দেখতেই তো পাচ্ছ, বেরোইনি।’
রূঢ় গলায় বলেই হর্ষর মনে হল উজ্জ্বলকে খাতির করাই উচিত। উজ্জ্বলের চেষ্টাতেই সে সোমাকে পেয়েছে। সোমার জমি উজ্জ্বলই কুপিয়েছে, জল দিয়েছে, সার দিয়েছে, তারপর টুপ করে হর্ষ বীজটিকে ফেলেছে। মাঝে-মাঝে সন্দেহ হয়, সোমা তাকেই বিয়ে করেছে তো, না উজ্জ্বলকে। ভয় হয়। একেবারে ফুটন্ত যৌবন, অমন রূপ, উজ্জ্বলের পাশে সে তো ভূত। আরও সব ব্যাপার আছে। স্ত্রী পুরুষের সম্পর্কে শরীর অবশ্যই একটা ফ্যাক্টার।
হর্ষ হাসি-হাসি মুখে বললে, ‘কী গো, এত দেরি করলে!’
‘হয়ে গেল দাদা।’
‘চলো চলো।’
উজ্জ্বল আর হর্ষ গাড়িতে উঠলেন। গাড়ি ছুটছে কলেজ পাড়ার দিকে।
উজ্জ্বলের মুখে লেগে আছে বোকার হাসি।
‘হর্ষদা, হর্ষদা, যাক এতদিনে তাহলে পেলেন!’
‘কী পেলুম গো’!
‘কাজের লোক। উ: আজকাল কাজের লোক পাওয়া আর ঈশ্বর পাওয়া একই। একই। বয়েস একটু বেশি। তা হোক। তা হোক। বউদির খুব কষ্ট হচ্ছিল। কততে ঠিক হল।’
হর্ষ কাশলেন বিষম খেয়েছেন যেন। ধবধবে রুমালে আলতো করে ঠোঁট মুছে বললেন, ‘হে হে, ওই আর কি। যা হয় হবে আর কি।’
বেশ অস্বস্তি হচ্ছে হর্ষর। লোকে কী বলবে। এ যেন কাছায় লুকিয়ে থাকা অপকর্ম হঠাৎ বেরিয়ে পড়েছে অসাবধানে। ছেলে মোটর চাপছে, মা ট্যানা পরে ঘুরছে। বউ পার্ক স্ট্রিটের সেলুনে চুল বাঁধতে যায়। রাগ নিজের ওপরেই হওয়া উচিত, হল মায়ের ওপর। বুড়ি হাওড়া জেলার হবিবপুর থেকে ছুটে এল, ছেলে আর ছেলের বউ দেখতে। মরে শান্তি দে মা।
রাতে হালকা একটু নেশা নিয়ে হর্ষ বাড়ি ফিরলেন। মোটামুটি মেজাজেই আছেন। মায়ের কথা প্রায় ভুলেই ছিলেন। বাইরের ঘরের সেই বারো হাজারি সোফায় বুড়ি পা তুলে বসে আছে। বসে বসে ঢুলছে, মাথায় ধক করে রক্ত উঠে গেল।
‘এ কী, তুমি পা তুলে এর ওপরে বসে আছ।’
‘বৃদ্ধার চটকা ভেঙে গেল। চমকে উঠে বললেন, ‘কে খোকা এলি। কী বলছিস বাবা! অ বউমা। বউমা।’
‘নেমে বোসো, নেমে বোসো। এখনও কভার লাগানো হয়নি। নষ্ট হয়ে যাবে। দাম জানো? বারো হাজার।’হর্ষ হঠাৎ নীচু হলেন। পুরু ফোমে আঁচড়ের দাগ। কে যেন চিরে দিয়েছে।
মাকে ধমকে উঠলেন, ‘হাতের পায়ের নখগুলো তো কাটতে পারো বসে বসে। দ্যাখোতো এত দামের জিনিসটা দাগরাজি হয়ে গেল।’
বৃদ্ধা মেঝেতে দেয়াল ঘেঁষে বসেছেন। বলে উঠলেন, ‘ও খোকা, বিশ্বাস কর, আমি আঁচড়াইনি বাবা, আঁচড়েছে তোমার কুকুরে।’
বারো হাজারি সোফার তলায় নিশ্চিন্ত আরামে শুয়ে ছিল হর্ষর আদরের কুকুর। হর্ষ ডাকলেন, ‘পমপম’। কুকুর বেরিয়ে এসে, কার্পেটের ওপর একটা ডন মেরে ঘুমের জড়তা কাটিয়ে নেচে কুঁদে আহ্লাদ প্রকাশ করতে লাগল। মেঝেতে সুবিধে হল না। লাফিয়ে সোফায় উঠল।
বৃদ্ধা বললেন, ‘ও খোকা আবার আঁচড়াবে।’
হর্ষ গম্ভীর গলায় বললেন, ‘আঁচড়াক।’