1 of 2

অ্যালবাম – শ্রীপার্থ

অ্যালবাম – শ্রীপার্থ

দুটি ঠোঁট সেই যে এক হল আর খুলল না। লিপিকা নীরব হল।

এমন একটা যে কিছু ঘটবে কিংবা ঘটতে চলেছে, আন্দাজের সিঁড়ি বেয়ে এতদিন যারা লিপিকাকে জানার স্তর পেরিয়ে ছাদে ওঠার চেষ্টা করছিল, তারা খবরটা শোনামাত্র বলে দিল, এ ছাড়া লিপিকার অন্য কোনও পথ ছিল না। লিপিকা নীরব হওয়াতে ওর পরিচিতরা এমন ভাব দেখাল যেন এক অস্বস্তিকর ক্রিকেট ইনিংসের পরিসমাপ্তি ঘটাতে তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

লিপিকার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী পর্ণা সেনকে দেখে অন্তত তাই মনে হল। অথচ এই পর্ণা সেনের এমনও এক-একটা দিন গেছে যখন দুই বান্ধবীতে দেখা না হওয়ার জের চলেছে পরের দিন নিজেদের অভিমানের আড়ালে ঢেকে রাখার মধ্যে দিয়ে। সেই পর্ণা সেন কেমন সহজ এবং স্বাভাবিকভাবে কথাটা বলল টালিগঞ্জ থানার ও. সি.-র প্রশ্নের উত্তরে, ওই যে দেখছেন লিপিকার চোখ-মুখ, হ্যাঁ, এখনও ভালো করে তাকিয়ে দেখলে বুঝতে পারবেন চোখ-মুখের চিহ্ন লিপিকার জীবনে অশুভ ইঙ্গিতের খবর বহন করে এনেছে। তবে সে একদিনে নয়, দুদিনে নয়, অশুভ ইঙ্গিতের প্রথম দিকের সেই অস্পষ্ট রেখাটা ছোট থেকে বড় হয়েছে ক্রমশ। অবশেষে তার চরম প্রকাশ ঘটল আজ। এবং সেই সঙ্গে লিপিকা নীরব হল।

লিপিকার দিকে এখন আর তাকানো যায় না। চোখে-মুখে পাপের চিহ্ন, বিচিত্র সব অপরাধের বিজ্ঞাপন। এখন যে দেখছে সে-ই বলছে, এ-মেয়ের এ-ধরনের পরিণতি তার পাপের প্রায়শ্চিত্তের একটা সহজতম সুযোগ। বলতে গেলে সুযোগটা লিপিকার কাছে হঠাৎই এসেছিল এবং বলা বাহুল্য ওর অজান্তেই! তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না লিপিকা। সুযোগটা আসার আগে পর্যন্ত ভাবতেও পারেনি লিপিকা যে, ওর এতদিনের স্তূপীকৃত পাপের বোঝা হালকা করতে, এবং জীবনের সঞ্চিত সমস্ত গ্লানি মুছে ফেলতে ওকে এত ব্যাকুল হতে হবে। প্রায়শ্চিত্ত জিনিসটা যে কী তা অনুভব করার অনুভূতি না থাকলেও তার নিষ্ঠুর পরিণতির কথা জানত লিপিকা। অবশ্য তা সত্ত্বেও একান্ত প্রয়োজন মনে করে লিপিকা সহজ ও স্বাভাবিকভাবেই বরণ করে নিল সেই প্রায়শ্চিত্তের উপকরণ। তবে আশ্চর্য এই, এতদিন যারা ওকে এই নিষ্ঠুর পরিণতির দিকে একটু-একটু করে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্ররোচিত করেছিল ওর এই প্রায়শ্চিত্ত বরণের মুহূর্তটিতে তারাই দূরে সরে রইল। লিপিকার জীবনে এই প্রথম এবং শেষ ট্র্যাজেডি। লিপিকার মৃত্যুবরণ স্বেচ্ছায় কি না, জানল না কেউ!

অথচ লিপিকার সেইসব বিচিত্র অপরাধের যারা এতদিন সাক্ষী ছিল, যারা সেই অপরাধ-অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা ছিল, যারা তার পাপাচারকে অনুমোদন করেছিল তাদের সেই তথাকথিত সমাজে একটি প্রধান অঙ্গ হিসেবে—আশ্চর্য, তারাই এখন ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিতে চাইল। এমনকী নীরব হয়ে যাওয়া লিপিকার পাপমূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে থাকাও অন্যায় মনে করল। এই প্রথম তাদের মনে হল, লিপিকা যে-পথটা আজ বেছে নিল সেটা লিপিকার অস্বস্তিকর জীবন-ইনিংসের লজ্জিত পরিণতি হলেও তাদের জীবনে যে-অবাঞ্ছিত ঘটনাটা ওত পেতে বসে ছিল এখন সেটা আস্তে-আস্তে সক্রিয় হতে পারে। অর্থাৎ, লিপিকা নিজে মরে বাঁচলেও তার পরিচিতদের নাম-মাত্র বাঁচার অনুমতি দিয়ে মুখ্যত একরকম মেরেই রেখে গেল বলতে হয়।

ঘটনাটা যে সুখের নয় বলা বাহুল্য। তবে এই দুর্ঘটনার জন্য এত শিগগির কেউ প্রস্তুত হতে চায়নি। ঠিক ছিল, একটা সুযোগ অন্তত লিপিকাকে দেওয়া যেতে পারে। সে-সুযোগ নিশ্চয়ই বাঁচার। এবং সে-বাঁচার পথ ঠিক হত তাদেরই নির্বাচনে।

কিন্তু এসবের বোধহয় কোনও প্রয়োজন মনে করেনি লিপিকা। মনে করেনি এইজন্য, কারণ, ও জানত ওর সেই বাঁচার আয়ু দীর্ঘ হলেও সুখের হতে পারে না। এবং সুখ নামক পাখিটা ওর চেনা আকাশ থেকে অনেক আগেই বিদায় নিয়েছিল।

কোনও নির্দিষ্ট দিনকে লিপিকা ওর জীবনে একটিমাত্র অশুভ মুহূর্ত বলে চিহ্নিত করতে পারে না। কেননা লিপিকার জীবনের অশুভ দিন মাত্র একটি অঙ্কে সীমাবদ্ধ ছিল না। লিপিকা জানত ওর জীবনের নিকষ কালো রং একদিনেই এত গভীর হয়নি। গোড়ার দিকে ফিকে রংটা গাঢ় করার তাগিদ যে লিপিকার একেবারে ছিল না তা নয়, তবে সেই রং ফিকে থাকতে-থাকতে লিপিকা রং বদলাতে চেয়েছিল। সেইসঙ্গে নিজেকেও। কিন্তু ওর জীবনে নতুন রঙের সমস্ত রকম উপকরণ থাকলেও কে সেই নতুন রঙে তুলি বোলাতে আসবে সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল লিপিকার সামনে। অনেক তুলির ভিড়ে নিজেকে বড্ড অসহায় ভেবেছে লিপিকা। শেষে হাঁপিয়ে উঠেছে। তারপর একসময় যখন ও পরিশ্রান্ত ক্লান্ত দেহের দিকে তাকাতে গিয়েছে, শিউরে উঠেছে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে।

পাপের চিহ্ন! অপরাধের বিজ্ঞাপন! দেহের স্তরে-স্তরে। লিপিকা জানত এরপর কোনও পুরুষ আর ওর ধারেকাছে আসবে না—আসতে পারে না। আসতে না পারার কারণ সেই একটাই লিপিকা একটু আগেও যে-দেহটাকে বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে সে ওর অতীত ছায়া মাত্র। একটা সুউচ্চ পাহাড়চূড়া যেভাবে বাধ্য হয়ে মাথা নুইয়ে নেয় যন্ত্রদানবের কাছে, লিপিকা ওর দলিত বক্ষযুগলের দিকে তাকাতে গিয়ে ভেবেছে এদের অবস্থাও কতকটা তাই।

কথাটা ঠিক। তবে পদ্ধতিটি আলাদা! যন্ত্রদানব আর মানবযন্ত্রের মধ্যে তফাত শুধু…।

অথচ…।

গোড়ার দিকের কথায় ফিরে গেলে এ-ধারণা করে নিলে ভুল হবে না, লিপিকার এই নিশ্চেতন দেহটার আগে কতই না কদর ছিল।

সেইসঙ্গে পুরুষদের কাছে দেহটাকে কামাতুর করে তোলার মধ্যে একটা উৎসাহ পেত লিপিকা। সেসব উৎসাহ ভোগ করতে গিয়ে একবারও লিপিকার মনে হয়নি সেসব অন্যায়, সেসব পাপ। এবং তার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে।

লিপিকাকে তখন যেন কী এক নেশায় পেয়ে বসেছে। ও আরও, আরও স্বাদ পেতে চায় জীবনের। ভিন্ন-ভিন্ন। নানান রঙের। গাঢ়, আরও গাঢ়। এমনি করেই লিপিকার জীবনের রং হল নিকষ কালো। যার অপর নাম অন্ধকার।

ওর সেই অন্ধকার জীবন থেকে ওকে আলোয় ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল এক তরুণ লেখক। নামসর্বস্ব লিপিকার নামগোত্রহীন বন্ধু-লেখক। কাল পর্যন্ত লিপিকা তার কথা ভেবেছে। সন্ধের সময় একসঙ্গে বসে গল্প করেছে। হেসেছে। স্বাভাবিকভাবেই। সে-হাসির মধ্যে আজকের এই আকস্মিক দুর্ঘটনার কোনও পদধ্বনি ছিল না। অন্তত লেখক তার আভাস পায়নি।

লেখকের আসল নাম লিপিকা জানত না। ছদ্মনাম ‘সন্ধানী’-র সঙ্গেই তার পরিচয় ছিল জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত। লেখকের নাম না জানলেও যদি কেউ তাকে দেখিয়ে দিত দূর থেকে, লিপিকা চিনতে ভুল করত না। কেননা সে-মুখ ভোলার নয়। একবার দেখলে আর ভোলা যায় না। আর তাকে তো লিপিকা দিনের মধ্যে কতবার যে দেখেছে তার ঠিক নেই।

মনে আছে, লেখকের মনে আছে আজও, কোনও দিন যদি দেখা না হত ওদের, বিশেষ করে সেই দেখা না হওয়ার জন্য লেখক যদি দায়ী হত, তাহলে লিপিকা প্রতিশোধ নিত দুদিন কথা না বলে। কিন্তু তৃতীয় দিনে লিপিকা পুষিয়ে দিত সুদে-আসলে।

লেখক তাই হাসতে-হাসতে এক-একদিন বলত, এ-রাগের কোনও অর্থ হয় না। এ যেন…।

কী!—লিপিকা মুখ তুলে তাকাত।

—এ যেন,—লেখক একটু থেমে আবার বলত, এ যেন বেশি করে কথা বলার জন্যেই রাগ করা।

—বয়ে গেছে আমার কথা বলতে।—লিপিকা কপট রাগ দেখাত : বেশ, এই তাহলে শেষ কথা বললাম।

—উঁহু, তুমি তা পারবে না।—লেখক তাড়াতাড়ি কাছে আসত লিপিকার। দু-বাহুর বন্ধনে আবদ্ধ রেখেই বলত, নতুন করে কথা শুরু করার এ এক নতুন মতলব করছ। বলো, ঠিক কী না?

—বেশ করছি।—লিপিকা লেখকের বুকে মুখ ঘষতে-ঘষতে কপট রাগ দেখাত এবং ঠোঁট ফোলাত।

—তোমার এই বেশ করা ভাব কিন্তু ভালো নয়, লিপিকা।

—তোমার কাছ থেকে উপদেশ শুনতে চাই না। আমার যা খুশি তাই করব।—এরপর ও যা-খুশি করার মতো যা করত সেটা প্রকাশ পেত লেখকের লেখার মধ্যে দিয়ে।

লেখা পড়ে লিপিকা অনুযোগ করেছিল, কেন এসব লিখতে গেলে?

—কীসব?—না-জানার ভান করে লেখক। ইচ্ছে লিপিকার মুখ থেকেই শোনে।

লিপিকাকে চুপ করে থাকতে দেখে লেখক নিজেই জিগ্যেস করে, কী হল? কই, কী বলবে বলছিলে, বললে না?

—আমি যা নই তা কেন লিখলে?

—তোমার বাইরের যে-রং সেটা তো কল্পনা। কিন্তু ভেতরের রং! সে তো আমার মনেরই প্রতিলিপি, তা তুমি বুঝতে পারো না, লিপি?

লিপিকা বোঝে। কিন্তু বোঝাতে পারে না তার প্রিয় বন্ধু ও লেখককে। কী করে সে বোঝাবে, যে-অন্ধকার জগতের মধ্যে ওর বাস সেখানকার মোহ থাকলেও দু-দিন যেতে না যেতেই হাঁপিয়ে উঠবে লেখক।

তার পরের কথা জানে লিপিকা। প্রথমে ফিরিয়ে দিয়েছিল লেখককে। লেখককে ফিরিয়ে দিতে গিয়ে লিপিকাকে অনেক অশ্রু ব্যয় করতে হয়েছে। সেসব অশ্রুর কথা লেখক কিন্তু জানতে পারেনি।

টালিগঞ্জ থানার ও. সি. প্রশান্ত ব্যানার্জি কিন্তু বিশ্বাস করতে চাননি লেখকের বক্তব্য। জবানবন্দি নিতে গিয়ে প্রশান্ত জিগ্যেস করলেন, আপনার সঙ্গে শেষ কখন দেখা হয়েছিল লিপিকা দেবীর?

—গতকাল সন্ধের সময়।

—মিথ্যে কথা!

—কী বলতে চান আপনি?

—যা আপনি ঢাকতে চাইছেন—।

—থামুন!

লেখকও কম নয়। ভেবেছিল লেখার মধ্যে দিয়ে আজকের এই আকস্মিক দুর্ঘটনার প্রতিবাদ করবে, কিন্তু সে শেষপর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারল না। তার আগেই প্রতিবাদ করল মুখর হয়ে, থামুন। আপনাদের কাজই হচ্ছে গোড়ার দিকে ইচ্ছে করে ভুল পথে চলে আসল অপরাধীদের গা-ঢাকা দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া।

—বেশ তো। প্রকৃত অপরাধীকে খুঁজে বের করার জন্যে দয়া করে আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করুন না কেন!

—সহযোগিতার মনোভাব যে আমি পোষণ করছি না, এ-ধারণা আপনার হল কেন?

—এই যে ডায়েরিটা দেখছেন,—প্রশান্ত হাতের মুঠোর মধ্যে ধরে রাখা ডায়েরিটা লেখকের সামনে তুলে ধরেন : এই যে ডায়েরিটা দেখছেন, মিস্টার সন্ধানী, এটাই আপনার অসহযোগিতার কারণ।

—এ-ডায়েরিটা তো আমার! এ আপনি কোত্থেকে পেলেন?

—কোত্থেকে পেয়েছি সে-প্রসঙ্গে পরে আসছি। —প্রশান্ত রহস্যের জাল বোনেন তার আগে বলুন শেষ কখন এই ডায়েরিতে লেখেন?

—তা তখন রাত দশটা হবে।

—ইয়েস, ইউ আর রাইট। ডায়েরিতেও তাই লেখা আছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, ডক্টর মিত্রের মতে লিপিকা দেবীর মৃত্যু হয় ঠিক ওই একই সময়।

—তা আমার ডায়েরি লেখার সঙ্গে এর কি সম্পর্ক আছে?

—হ্যাঁ, আছে। আর আছে বলেই তো জানতে চাইছি কাল রাত্রি এগারোটার পর কেন, কেন এই বাড়িতে এসেছিলেন?

—ডায়েরিটা ফেলে গিয়েছিলাম, সেটা নিয়ে যেতে এসেছিলাম।

—ওয়েল মিস্টার সন্ধানী, আপনার কথা ঠিক বলে ধরে নিলে এটা কি মনে করতে নেই যে, কাল এগারোটার পর আপনি এ-বাড়িতে আসেন এবং লিপিকা দেবীর বান্ধবী পর্ণা সেনের কাছে তাঁর খোঁজ করেন?

—হ্যাঁ, করেছিলাম।

—বেশ, তাহলে এ-খবরটা নিশ্চয় পেয়েছিলেন, লিপিকা দেবী মৃত!

—না!

—তার মানে আপনি বলতে চান লিপিকা দেবী তখন জীবিত?

—না, তাও নয়।

—তাহলে?

—লিপিকার খোঁজ আমি ঠিকই করেছিলাম মিস সেনের কাছে। তবে তখনও পর্যন্ত কোনও দুঃসংবাদ আমি পাইনি। মিস সেন বলেছিলেন, লিপিকার সঙ্গে আজ আর দেখা হতে পারে না। লিপিকা ঘুমুচ্ছে।

—তারপরেই কি আপনি ওখান থেকে—?

প্রশান্তর কথা শেষ হল না। পর্ণা সেন ঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়ায়। আক্রোশে, ঘৃণায় তার মুখখানা যেন ফেটে পড়ছে। থরথর করে সমস্ত শরীরটা কাঁপছে পর্ণার। বলে ওঠে সে, ছিঃ তুমি এত নিষ্ঠুর! এত হীন! এর পরেও তোমার লজ্জা করল না! নিজের সাফাই গাইতে এসেছ?

লেখক সন্ধানী কী যেন বলতে যাচ্ছিল, পর্ণা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলতে থাকে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমিই তো লিপিকাকে…।

ঘরের সবাই স্তব্ধ, বিমূঢ়, নির্বাক। প্রত্যেকের দৃষ্টি এখন পর্ণা সেনের ওপর।

লেখক দ্রুতপায়ে এগিয়ে যায় পর্ণার দিকে। কাছে গিয়ে ডাকে, পর্ণা।

লেখকের কথায় পর্ণা কর্ণপাত করে না। বরং আগের চেয়ে আরও বেশি কঠোর হয় সে। লেখকের উপস্থিতি সে যে সহ্য করতে পারছে না, সেটা প্রমাণ করার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম করে।

লেখক পর্ণার হাত দুটো ধরে ফেলে বলে ওঠে, এ তুমি কী বললে! তুমি, তুমি আমার সম্বন্ধে কতটুকু জানো?

—যেটুকু জেনেছি, তার থেকে বলতে পারি, তুমি সব পারো! তোমার ওই হাত দিয়ে চমক লাগানো তোমার লেখা বেরুতে পারে, আবার ওই হাত দিয়ে তুমি খুনও করতে পারো।

—পর্ণা!—লেখক চিৎকার করে ওঠে, ভেবে দেখেছ পর্ণা, তোমার এই জবানবন্দিতে আমার কী পরিণতি হতে পারে?

—হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি ভেবেই বলছি, এবং…।

—এবং কী!

—তোমার পাপের পরিণতি আমি দেখতে চাই।

—পাপ!—লেখক এবার প্রতিবাদ করে ওঠে, পাপ তুমি কাকে বলতে চাও?

—লিপিকার অসহায়তার সুযোগ নেওয়াটা কি পাপ নয়?—পালটা প্রশ্ন করে পর্ণা।

লেখকের চোখে আগুন জ্বলে ওঠে : পাপ! আর তুমি যা গোপন করছ সেটা পাপ নয়?

—মিথ্যে কথা। আমি কিছুই গোপন করিনি।—পর্ণা প্রতিবাদ করে।

—তাই নাকি!—বিদ্রপ ঝরে লেখকের কণ্ঠে : আমি যা জিগ্যেস করব তার জবাব দেবে?

—বলো, কী জানতে চাও?

পর্ণাকে ঠিক এই মুহূর্তে একটু ম্লান মনে হল। একটু আগের সেই দৃঢ়তা এখন আর নেই। ও যেন একেবারে বোবা হয়ে গেছে।

সকলের দৃষ্টি এখন লেখক সন্ধানীর ওপর নিবদ্ধ। লেখক কী বলবে, কী বলতে চায় তা জানার কৌতূহল যেমন একটু-একটু করে বাড়ছে তেমনই ধৈর্যের শেষ সীমায় দাঁড়িয়ে সবাই কেমন যেন অস্বস্তি অনুভব করছিল।

ও. সি. প্রশান্ত ব্যানার্জি বললেন, একটু সংক্ষেপে, সন্ধানী।

—চেষ্টা করব।—কথাটা বলে লেখক আবার তাকাল পর্ণার দিকে।

জিগ্যেস করে, লিপিকা তোমার কে?

—বান্ধবী।

—শুধুই বান্ধবী, আর কিছু নয়?—লেখকের চোখে অবিশ্বাসের ছায়া।

—না।—পর্ণা নিজের কথার সমর্থন করে।

—মিথ্যে কথা!—লেখক তখনই প্রতিবাদ করে ওঠে : লিপিকা তোমার বোন!

—কী বলছ? তুমি কি শেষে পাগল হয়ে গেলে না কি?

—পাগল বলে লেখকদের বদনাম থাকলেও এ ক্ষেত্রে আমি একজন সুস্থ-স্বাভাবিক লোক।

—প্রমাণ?

—প্রমাণ!—মুখে বিদ্রপের হাসি লেখক সন্ধানীর। হাতে ধরে রাখা একটা অ্যালবাম ও. সি. প্রশান্ত ব্যানার্জির দিকে এগিয়ে দিয়ে লেখক বলে, এই অ্যালবামটার ভেতরেই সব প্রমাণ খুঁজে পাবেন, মিঃ ব্যানার্জি।

প্রশান্ত অ্যালবামের পাতা ওলটান দ্রুতগতিতে। তারপর একটা পাতায় এসে ওঁর দুচোখ নিবদ্ধ হয়। চোখ ফেরাতে পারেন না।

অদ্ভুত সিমিলারিটি দুটি মুখের মধ্যে। চোখ, মুখ, নাক, এমনকী চিবুকের নিচে তিলটি পর্যন্ত দুজনের একই জায়গায়। এ কী করে সম্ভব!

ফটো দু-খানার ওপর স্থির দৃষ্টি রেখে প্রশান্ত বিশ্লেষণ করতে চেষ্টা করেন। একজন নিশ্চয় লিপিকা। কিন্তু অপরজন?

—দীপিকা!—লেখক পরিচয় দেয় : ওরা যমজ বোন।—তারপর ওদের পরিবারের একটা গ্রুপ ফটো বের করে লেখক বলে, লুক, ভালো করে তাকিয়ে দেখুন, এর নীচে কী লেখা আছে।

প্রশান্ত দেখলেন অনেকক্ষণ ধরে এবং জানলেন পর্ণা ওদের বড় বোন।

—কিন্তু লিপিকা দেবীর খুনের সঙ্গে এর কী সম্পর্ক থাকতে পারে?—লেখক সন্ধানীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন প্রশান্ত ব্যানার্জি।

—সে-প্রসঙ্গে পরে আসছি। আগের কথা আগে বলে নিই।

ঠিক সেই সময় পর্ণা কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। লেখক ছুটে গিয়ে ওকে বাধা দেয়, দাঁড়াও! আমার কথা এখনও শেষ হয়নি। টেক ইয়োর সিট। স্থির হয়ে বোসো।

পর্ণা তখন কাঁপছিল থরথর করে। কাঁপতে-কাঁপতে দু-হাতে মুখ ঢেকে একটা চেয়ারে বসে পড়ল। তারপর হঠাৎ মুখ তুলল এবং বলতে শুরু করল, হ্যাঁ-হ্যাঁ, লিপিকা আমার বোন। ওর পরিচয় দেওয়ার মতো নয়, তাই দিইনি আপনাদের কাছে। ও একটা…।

পর্ণার শেষের কথাগুলো কেমন জড়িয়ে আসতে লাগল। সেই সঙ্গে কান্নাও থেমে আসতে লাগল ধীরে-ধীরে। সব শেষে পর্ণার সমস্ত শরীরটা শিথিল হয়ে গেল, অবশ দেহটা মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।

লেখক কাছেই ছিল পর্ণার। ঝুঁকে পড়ে পর্ণার অবশ দেহটা যখন দু-হাতে তুলে ধরল, তখন আর কিছুই করার নেই।

চোখ দুটো বুজে আসছে পর্ণার।

পর্ণার কানের কাছে ঝুঁকে পড়ে লেখক সন্ধানী ডাকে, পর্ণা!

চোখ জড়িয়ে আসছে। কষ্ট হচ্ছে তাকাতে। তবু লেখকের ডাকে পর্ণা শেষবারের মতো চোখ মেলে তাকাল। খুব ক্ষীণ গলায় বলল, লিপিকাকে সরিয়ে বুঝতে পারছি তোমার দুঃখটা বাড়িয়েই গেলাম। কিন্তু কী করব। লিপিকাকে আমি নিজের হাতে বিষ খাইয়ে হত্যা করেছিলাম বাধ্য হয়েই।

এর পর পর্ণা নীরব হল। দুটি ঠোঁট এক হল।

অদূরে লিপিকার অবশ দেহটাও পড়ে রয়েছে। ওর ঠোঁট দুটোও এক হয়ে আছে। লিপিকাও নীরব পর্ণার মতো।

লিপিকার মৃত্যুর তদন্ত করতে এসে এত তাড়াতাড়ি ওর মৃত্যু-রহস্যের ওপরে যবনিকাপাত হয়ে যাবে তা আশা করেননি টালিগঞ্জ থানার ও. সি. প্রশান্ত ব্যানার্জি। কিন্তু তবু প্রশ্ন থেকে যায়, লিপিকাকে পর্ণা কেন হত্যা করল? আর নিজেই বা কেন সে আত্মহত্যা করল?

তার উত্তরও লেখক সন্ধানী দিল।

বেশ চলছিল লিপিকা দেবীর জীবন। আনন্দে ও অর্থের প্রাচুর্যে দিনগুলো ভালোই কাটছিল তিন বোনের।

পর্ণার রূপ নেই। তাই লিপিকার মতো সোসাইটি গার্ল হওয়ার যোগ্যতা নেই। তাই বলে লিপিকা তাকে কোনওদিন অবজ্ঞা করেনি। বরং সংসারের সমস্ত কর্তৃত্ব তার ওপরেই ছেড়ে দিয়েছিল লিপিকা। ও শুধু টাকা দিয়ে খালাস থাকত। তা ছাড়া সংসারের কথা ভাববার সময় কোথায় লিপিকার! হাই সোসাইটির মনোরঞ্জন করে টাকা লুটবে, না একঘেয়ে গতানুগতিক সংসারের খাতায় নাম লেখাবে!

আশ্চর্য, সেই লিপিকাই তার মত পালটাল শেষপর্যন্ত। অবশ্য ওর মত বদলানোর মূলে লেখক সন্ধানী ও তার লেখাগুলো। লিপিকা প্রথমে লেখকের লেখার প্রেমে পড়ল, তারপর লেখকের।

এবং সব প্রেমের যা পরিণতি হয়ে থাকে, ওদের জীবনেও তাই ঘটতে চলেছিল। অর্থাৎ, ওরা বিয়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। বলা বাহুল্য পর্ণার অজান্তে।

কিন্তু শেষপর্যন্ত ব্যাপারটা চাপা থাকেনি। আর যখন পর্ণা জানল, তখন থেকেই দ্বন্দ্ব শুরু হল দু-বোনের মধ্যে। পর্ণার ভয় লিপিকাকে হারানোর। আর লিপিকাকে হারানো মানেই সুখ নামক পাখিটা তাদের সংসার থেকে উড়ে যাওয়া।

লেখক সন্ধানীকে বিয়ে না করার জন্য লিপিকাকে অনেক বুঝিয়েছে পর্ণা। কিন্তু লিপিকা সিদ্ধান্তে অটল।

বিয়ের দিনও ঠিক করে ফেলেছিল লিপিকা। কিন্তু সে-বিয়ে একেবারে চিরকালের জন্য বন্ধ করে দিল পর্ণা—লিপিকার খাবার জলে বিষ মিশিয়ে।

কিন্তু কথা হচ্ছে লিপিকাকে সরিয়ে পর্ণার কী লাভ? যদি ধরা যায়, পর্ণা নির্দোষ প্রমাণিত হত, তাহলে লিপিকাকে সরানোর পর সে কী করত!

তারও একটা যুৎসই যুক্তি দেখাল লেখক।

দীপিকা বিদেশে এতদিন লেখাপড়া শিখছিল। বিদেশেই সে বরাবর মানুষ হয়ে আসছিল। এ পর্যন্ত কেউ তাকে কলকাতায় দেখেনি। লেখক অ্যালবামের রহস্যটা ফাঁস না করে দিলে কেউ জানত না, লিপিকার কোনও যমজ বোন আছে। স্বভাবতই এ ক্ষেত্রে পর্ণা একটি পরিকল্পনা করে নিয়েছিল। সামনের মাসে দীপিকা দেশে ফিরছে। সুতরাং এক ঢিলে দুটো পাখি মারা যাবে।

লেখককেও নিরাশ করা যাবে। সেইসঙ্গে দীপিকা ফিরে এলে ওকে অনায়াসে তাদের সেই তথাকথিত ঘৃণিত সমাজে লিপিকার ভূমিকায় চালিয়ে দেওয়া যাবে।

অদ্ভুত পরিকল্পনা!

তদন্ত

জুন-জুলাই, ১৯৬৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *