1 of 2

অ্যাবারক্রোম্বি – লীলা মজুমদার

অ্যাবারক্রোম্বি – লীলা মজুমদার

খোদমামা বললেন, “কলকাতা শহরে বাড়ি খোঁজা যে কী ব্যাপার, সে ত তোরা জানিসই। কিন্তু গত বছর ওই নিয়ে আমাকে যে কী ধান্দার মধ্যে পড়তে হয়েছিল, নানান কারণে সে-কথা আর তোদের কাছে বলা হয়নি। বুঝলি, এ-ঘটনাটা যখন ঘটল, তার বহু আগেই কিন্তু বাড়ি পাবার আশা আমি একেবারে ছেড়েই দিয়েছিলাম। কলকাতা কেন, কলকাতাকে কেন্দ্র করে পাঁচ মাইলের মধ্যে একটা মাথা গোঁজার জায়গা পাওয়া যে একেবারে অসম্ভব, সে-বিষয়ে আমার মনে কোন সন্দেহ ছিল না। এই সময় অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটনাটা ঘটল।”

খোদনমামা এইখানে একটু থেমে কী যেন ভেবে নিলেন; তারপর বললেন, “নাঃ। নিজের মনে মিছিমিছি আক্ষেপ জমিয়ে রেখে কোন লাভ নেই, বরং এর থেকে নানারকম মানসিক বিকৃতির সূত্রপাত হতে পারে। অতএব একটা কথা, পাঁচজনের কাছে এ-বিষয়ে আলোচনা করে বেড়াস না যেন।”

আমরা বিরক্ত হয়ে বললাম, “বাঃ আমাদের কি একটা আক্কেল নেই?”

“বেশ, তবে শোন। আচ্ছা, ড্যালহৌসি স্কোয়ার অঞ্চলটা কত ভাল চিনিস তোরা? সন্ধ্যার পর গিয়েছিস কখনও ওদিকে? গোরস্থানের সঙ্গে কোন তফাত নেই, গাড়িঘোড়া যানবাহন একরকম থাকে না বললেই হয়, অনেকক্ষণ পর পর একটা করে ট্রাম যদি বা যায়, তাও যে-লাইনের দরকার সে-দিককার নয়। উপরন্তু অত আলো থাকা সত্ত্বেও পথঘাটগুলোর কেমন একটা থমথমে ভাব। তবু মাঝে মাঝে আপিশে হঠাৎ কাজ জমে গেলে, আমাকে আটকা পড়ে যেতে হয়, বাড়ি ফেরবার সময় কষ্টের আর শেষ থাকে না।

“গত বছর একদিন ওইরকম বেশি দেরি হয়ে গেছে, মেজাজটাও তেমন ভাল নেই। আপিশে যেমন হয়ে থাকে, ছোট একটা ব্যাপার নিয়ে বিরাট এক মহাভারত। তার উপর মনে পড়ে গেল, সকালে বাড়িওলার সঙ্গেও মোক্ষম খেঁচাখেঁচি হয়ে গেছে। ব্যাটা একে ছোটলোকের একশেষ, তায় রাজনীতির কিচ্ছু বোঝে না। নতুন একটা বাড়ি না দেখে নিলেই নয়।

“পুকুরের দক্ষিণ-পুব কোণটায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে থেকে যখন হাঁটুতে খিল ধরে যাবার জোগাড়, তখন আস্তে আস্তে বড় পোস্টাপিশের দিকে হাঁটতে শুরু করে দিলাম। আর অমনি, শীতকালে এক এক সময় যেমন হয়, ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ করল, আর সেই সঙ্গে কোথেকে যে হু হু করে একটা হাড়কাঁপুনি হাওয়া বইতে লাগল সে আর বলবার নয়। পা চালিয়ে চলেছি, পোস্টাপিশের বারান্দার কাছাকাছি পৌঁছেও গেছি, এমনি সময় অবাক হয়ে দেখি, গঙ্গার দিক থেকে মোড় ঘুরে বিরাট দুটো লাল-চাকাওয়ালা এক টমটম গাড়ি এসে পোস্টাপিশের পিছনেই একটা গলির মধ্যে ঢুকে গেল। প্রকাণ্ড তেজী ঘোড়াটাকে এক ঝলকের মত মুখোমুখি দেখতে পেলাম; চোখের পাশটাতে চামড়ার ঢাকনি, ঠোঁটের কোণে ফেনা, একবার ঘাড়টা ঝাঁকাল, লাগাম চেন সাজসজ্জা রনন-ঝনন করে উঠল, তারপর মুহূর্তের মধ্যে গলির বাঁক ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল।

“এখানে গলিটলি ত আগে অতটা লক্ষ করিনি, কাজেই একটু আশ্চর্য না হয়ে পারলাম না। কেমন একটা ঝোঁকও চেপে গেল, পনেরো-কুড়ি মিনিট বাদে বৃষ্টিটা ধরে আসতেই, বাড়ি ফেরার চেষ্টনা দেখে গলিটার মধ্যে ঢুকে পড়লাম।

“কমসে কম হাজার বার ওই পথ দিয়ে গিয়েছি, কিন্তু এমনি অন্ধ আমাদের চোখ যে, অমন সুন্দর গলিটা কখনও লক্ষ্য করিনি। দুধারে বড় বড় পাতাওয়ালা কী যেন গাছ, মাথার উপর দিয়ে ছায়া করে রেখেছে। বেশি লম্বা নয়, দুধারে অন্য বাড়ির পেছন দিককার উঁচু পাঁচিল, আর সামনে দিয়ে গজ শতেক এগিয়েই গলিটা শেষ হয়ে গেছে, আর ঠিক সেইখানেই, মাথাটুকু জুড়ে একটা পুরনো সবুজ কাঠের গেট, তার উপর দিয়ে কী একটা লতা উঠে গেছে, তাতে থোপা থোপা কমলা রঙের ফুল ধরে রয়েছে, আর নাকে আসছে সোঁদা সোঁদা মিষ্টি একটা গন্ধ।

“মানুষের সাড়াও পেলাম, ঘোড়ার পায়ের শব্দ শুনলাম। ঢুকেই উঠোন, তার পরে উঁচু ছাদের দোতলা একটা বাড়ি। বিরাট বিরাট জানলায় খড়-খড়ির ফাঁক দিয়ে একটু আলো বেরুচ্ছে। কানে যেন অস্পষ্ট একটু টুংটাং পিয়ানোর শব্দও এল।

“গলিতে একটাও আলো নেই, ফিরে সে-দিকে তাকাতেই মনে হল যেন কতখানি পথ পার হয়ে এসেছি, অথচ ভাল করেই জানি একশ গজেরও বেশি হবে কি না সন্দেহ।

“পুরনো গেটটা একটু ঝুলে গেছে, তার ডান দিককার থাম্বাটাতে ইংরেজিতে লেখা ‘অ্যাবারক্রোম্বি’, আর তার নীচে একটা প্যাকিং কেসের তক্তায় কালি দিয়ে লেখা ‘টু লেট’। পুরনো বাড়ি, ভাড়াটাড়া হয়তো সুবিধার হতেও পারে। বুকটা ধড়াস করে উঠল, এমন যোগাযোগ ত সচরাচর হয় না। সাহস করে গেটটাতে একটু ঠেলা দিতেই খুলে গেল।

“সামনেই বড় বড় অসমান পাথর দিয়ে বাঁধান উঠোন। এক ধারে এক সারি চাকরদের ঘর, অন্য ধারে বড় বড় দুটি আস্তাবল। লাল চাকাওয়ালা টমটমটাকেও দেখলাম। ঘোড়াটাকে খুলে, একটা গোল কাঠের টবে তার সামনের একটা পা ডুবিয়ে ধরে, একটা সইস ক্ষুর সাফ করে দিচ্ছে। আর ঘোড়াটা দারুণ আপত্তি করছে, পা টেনে নিচ্ছে, ওর ঘাড়ে গরম নিশ্বাস ফেলছে, ওর পিঠে মুখ থেকে নালঝোল ফেলছে, ওর কান কামড়াবার চেষ্টা করছে। আমার সাড়া পেয়েই কান খাড়া করে আমার দিকে চেয়ে রইল। দেয়ালে লটকান একটা বড় লণ্ঠনের আলোতে দেখতে পেলাম ওর চোখের জ্বলজ্বলে মণি-দুটোর চার পাশে অনেকখানি সাদা দেখা যাচ্ছে।

“সইসটাও অস্পষ্ট সুরে কী যেন বলল, ভাল করে বুঝলাম না। ঠিক সেই সময় সামনের রেলিং দেওয়া বারান্দার একটা দরজা খুলে গেল, এক ঝলক আলো বেরিয়ে এল, দেখলাম একজন অপরূপ সুন্দরী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

“সত্যি কথা বলব তোদের? তোরা যাদের সুন্দরী বলিস, কালোচোখ, তেল-চকচকে চুল, শাড়ি-পরা সেই বাঙালি মেয়েদের আমার চোখে একটুও সুন্দর লাগে না। সুন্দর বটে এই মেয়ে, এক রাশ পাটকিলে চুল দিয়ে এই মোটা একটা বিনুনি বেঁধেছে। চোখে সুর্মা, হাতের নখে মেদী পাতার রং, গায়ে একটা চুমকি বসান ওড়না জড়ান, পায়ে জরির নাগরা, এনতার গয়নাগাটি পরা। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই বুকের ভেতরটা কেমন হয়ে গেল। সে ভাঙা-ভাঙা বাংলায় কথা বললে। বাংলা যে কত বেশি মিষ্টি শুনতে লাগে, তোদের মত বাক্যবাগীশরা আর সে কী বুঝবি? সে বললে, ‘বাড়ি ভাড়া নেবে বাবু?’ কী যে মিষ্টি তার গলার স্বর। আস্তে শাঁখ বাজানর মত, পাতার মর্মরের মত, সমুদ্রের ফিসফিসের মত। ‘উপরতলাটা খালি আছে। এস দেখবে এস। দাঁড়াও। আলো নিই সঙ্গে।’

“গলির মধ্যে পুরনো বাড়ি, অবস্থা এদের নিশ্চয়ই পড়ে গেছে, ইলেকট্রিক আলো পর্যন্ত নেয়নি। এ-বাড়ির অসুবিধা অনেক থাকবে, তবে ভাড়াটা যদি কম হয়, মন্দ কী? সে-বাড়িওলা তিন দিন বাদে একদিন করে দাড়ি কামায়, তার কাছে এই মেয়ে! এর চারদিকে ভুরভুর করছে বাসী গোলাপের গন্ধ।

“বারান্দায় দুটি দরজা, তার মাঝখানে পুরনো কাঠের সিঁড়ি, তার রেলিং সবগুলি নেই, খুব যে পরিষ্কার তাও বলতে পারিনে, একটু ইঁদুর-ইঁদুর গন্ধও নাকে এল। কিন্তু সব ত আর হয় না। মেয়েটি আমার কাছে ঘেঁষে এল; বলল, ‘চল, বাবু। আমার নাম সোফিয়া বিবি, বাড়ি ভাড়ার লেখাপড়া আমার সঙ্গে হবে কিন্তু।’

“একটু অবাক হয়ে গেলাম, তবে কি আরও ওয়ারিশ আছে নাকি। শেষটা মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়তে হবে না ত? সোফিয়া আমার চোখের দিকে চেয়ে ছিল, হাতে মোটা বেঁটে হলদে রঙের একটা মোমবাতি, তার শিখাটি কাঁপছে, আর সোফিয়ার চোখের রং বদলাচ্ছে—নীল ছাই, ধূসর, সোনালী। আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল।

“সোফিয়া বিবি সিঁড়ির একটি ধাপে পা দিয়েছে, এমনি সময় বারান্দার অন্য পাশের দরজাটি খুট করে খুলে গেল, কী বলব তোদের, দেখলাম সেখানে দাঁড়িয়ে সাক্ষাৎ স্বর্গের পরী। আগাগোড়া সাদা পরনে, মনে হল একেবারে পাকা মেম। সোনালী চুল, নীল চোখ, তাই দিয়ে আগুন ছুটছে, উঃ, নীল আগুন। দেখেছ নিশ্চয়? দাঁতে দাঁতে ঘষে সে বললে, চীট! ঠগ। জোচ্চোর! এখনও তোমার স্বভাব গেল না। বাবু, ওর কথায় ভুলো না, তুমি আমার বাড়ি ভাড়া নাও, আমার সঙ্গে লেখাপড়া কর। আমি মিসেস অ্যাবারক্রোম্বি।’

“তাই শুনে সোফিয়া হেসেই কুটিপাটি, ‘তুমি মিসেস অ্যাবারক্রোম্বি! বিলাইতের সে কী বলে শুনো একবার! না বাবু,—তাই যদি বল, আমিই তা হলে মিসেস অ্যাবারক্রোম্বি! ওর নাকের ডগা থেকে ওর সাহেব ভাগিয়ে এনেছি, তা আমি মিসেস অ্যাবারক্রোম্বি না ত কি!’

“ভাবছি এ-সব কেলেঙ্কারির মধ্যে না থাকাই ভাল,কী কাজ রে বাপু, পরিবার নিয়ে বাস করি। এমন সময় মেম সিঁড়ির রেলিংএ ঠেস দিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। এই বড় বড় ফোঁটা চোখের জল ওর গাল বেয়ে একটার পর একটা গড়িয়ে পড়তে লাগল, রং পাউডার ধুয়ে সাদা সাদা দাগ হয়ে যেতে লাগল। কী যে করব ভেবে পাচ্ছি না, এর চাইতে সেই বাড়িওয়ালাই যে ছিল ভাল, এমন বুকের মধ্যে তোলপাড় করে দেয় না। সোফিয়া আমার হাতে মোমবাতি গুঁজে দিয়ে, মেমকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে বললে, ‘আরে তুমিও যেমন, সে-ব্যাটা বদমাইসের জন্য আবার চোখের জল! ওরা কখনও এদেশের মেয়ে বিয়ে করে শুনেছ? গেছে, আপদ গেছে! পাজির একশেষ। নইলে দেয় কেউ দুজনকে একটা বাড়ি, একটা গাড়ি, একটা ঘোড়া—?’

“মেম ভুলবার পাত্রী নয়, সোফিয়াকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে চাপা গলায় বলল, ‘আমার গায়ে হাত দিও না বলছি, আমি ইয়োররাপিয়ান—’

“ওঃ! কত আমার ইয়োরোপিয়ান রে! তাও যদি চামেলী আয়ার মেয়ে না হতিস্। চল বাবু, ঘর দেখবে চল।’

“তখন মেম ধৈর্য হারিয়ে সোফিয়ার গালে ঠাস করে এক চড় কষিয়ে দিল, আর সোফিয়াও খিলখিল করে হেসে ওর সোনালী চুলের গোছা ধরল। কী বলব তোদের, তবু তাদের সুন্দর দেখাতে লাগল। সইতে না পেরে ছুটে গিয়ে দুজনার মধ্যে পড়লাম। মনে হল যেন মেঘের রাশির মধ্যে পড়েছি, হাত বাড়িয়ে কিছু পেলাম না রে, চোখে ধোঁয়া দেখতে লাগলাম। যেটুকু শক্তি ছিল তাই দিয়ে কোন রকমে সিঁড়ির তিনটে ধাপ নেমে—বিশ্বাস কর, ওরই মধ্যে ভাঙা ধাপটাতে হোঁচট পর্যন্ত খেলাম—তারপর ধুপ্‌ধাপ্ করে প্রাণপণে ছুটে উঠোন পার হয়ে গেট দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, লতাগাছটার ভিজে ফুল মুখে এসে লাগল, সইসটা ঘোড়ার ক্ষুর ধোয়া থামিয়ে অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে রইল, ঘোড়াটার চোখের মণি বিস্ফারিত হয়ে উঠল, গেটের সবুজ পাল্লাটা দুলে উঠল, আরেকবার দেখতে পেলাম থাম্বায় লেখা ‘অ্যাবারক্রোম্বি’, আর তার নীচে প্যাকিং কেসের কাছে ‘টু লেট’। বড় রাস্তায় পৌঁছে আরেকবার ফিরে দেখলাম, গঙ্গা থেকে কুয়াশা উঠেছে, সব অস্পষ্ট হয়ে গেছে। গলিটাকে আর খুঁজে পাইনি।”

১৬ জুন ১৯৫৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *