ঊনপঞ্চাশ
ঠাকুরানিকে বাসে তুলে দেয়ার পর পঞ্চম ঠাকুর অন্ধকার মুখে ফিরেছিল। মুখের অন্ধকারময়তা পরের দিনও ছিল। তারপর আস্তে আস্তে সে মেঘ কেটে গেছে। স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে ঠাকুর। ঠাকুরানি নাকি কাঁথির কোনো হোটেলে কাজ পাবে। দীঘার কাজটা হলো না, থাকার জায়গা নেই বলে। কাঁথির হোটেল প্রায় সমস্ত রাতই খোলা থাকে। ডিউটিটা ওখেনে খুব কষ্টের। তবে টাকা বেশি। এই বৃত্তান্ত শেষ করে ঠাকুর বলছে, পাক না পাক, তার কী? পথের মেয়েমানুষ, কাজের খোঁজে ঘুরছিল দীঘায়, প্রায় কুড়িয়ে এনে তাকে এই হোটেলে কাজ দিয়েছিল সে। এই কাজ না পেলে কোথায় দাঁড়াত? কাজটা রাখতে পারল না যখন ঠাকুর কী করবে? কাজ রাখতে জানতে হয়। মেয়েমানুষ, শুধু কাজে হয়! কতদিন বলেছে সে বাবুর দেখভাল করতে, হাত-পা টিপে দিতে, যায়নি। ফলটা হলো।
বিনবিন করছে পঞ্চম ঠাকুর সমুদ্রের ধারে বসে। ভানু একা বসে ছিল, তার পাশে এসে বসেছে পঞ্চম ঠাকুর। হাসছে, বলছে, বাবুর মনে হয়েছে অই হোটেলে সময় দিচ্ছে বেশি আর এই যে মেয়েছেলেটা এসেছে ভীমাপুর থেকে, সুভদ্রা, সে নাকি খুব কাজের, বাবুর পছন্দ হয়েছে।
ভানু চুপ করে আছে। পঞ্চম ঠাকুর তাকে দিয়ে কথা বলাতে চাইছে। ভানু কথা বলছে না। বলতে ভালো লাগছে না। পঞ্চম ঠাকুর এসেছে বাজার করতে। বাজার করে ভানুকে নিয়ে ফিরবে। ভানুকেও খুঁজছে বাবু।
ভানু বলল, ঠাকুরানি যে তোমার বিয়ে করা বউ না, তা তো জানতাম না।
পঞ্চম ঠাকুর বলে, ওই তো মেয়েছেলেটার দোষ, ঠাকুরানি নামটা ও নিজি নিইছিলা, ও নিজিই ইসব কহি বেড়াত, মু কি কহিছি কখুনো, কভু কহি নাই, বাবুর অ কানে গিইছিলা কথাটা, তাই ওর কাম গেল, চালচলন ঠিক নাই, মাগি পয়সাও সরাত, গেছে ভালো হইছে।
ভানু মনে মনে হাসে। ঠাকুরানিকে নিয়ে কিচেনের দরজা বন্ধ করত পঞ্চম ঠাকুর রাতের বেলায়, এ তো তার নিজের দেখা। এতদিন ধরে দেখেছে ঠাকুর- ঠাকুরানি স্বামী-স্ত্রী। সম্পর্কটা মিথ্যে ভাবার কোনো উপায়ই ছিল না। এমনকি হোটেলে যদি মাইতিবাবু না থাকত, কোনো ঘর ফাঁকা থাকত, ঠাকুর-ঠাকুরানি সেই রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করত, তাও তো দেখেছে ভানু। তারা যেন সুখী দম্পত্তি। ঠাকুর কীরকমভাবে শাসনে রাখত ঠাকুরানিকে। মাথার কাপড় ফেলতে দিত না। ঠাকুরকে খুব ভয় পেত মেয়েমানুষটা। আর ঠাকুরের জন্য তার কত উদ্বেগই না ছিল। এখন ঠাকুর বলছে পথের মেয়েমানুষ। বলছে ঠাকুরানি কেন মাইতিবাবুর সেবা করেনি। এই কথার মানে কী? ঠাকুর কি অন্য কথা বলতে চাইছে? ঠাকুর যে কতটা বদলে গেছে ঠাকুরানির বিদায়ে তা আজ সকালে দেখেছে ভানু। ঠাকুরের গলার স্বরই বদলে গেছে। ঠাকুর ক্রমে ক্রমে ভানুর দিকে চলে আসতে চাইছে। ভানুর গা ঘেঁষে থাকতে চাইছে। সুভদ্রার সঙ্গে যেভাবে, যে ভাষায় কথা বলছে ঠাকুর, তা ঠাকুরানি কল্পনাও করতে পারবে না। ঠাকুরানির বিদায় এবং সুভদ্রার প্রবেশ স্থির হয়ে গেলে ঠাকুর তার নিজের ভূমিকা টের পেয়ে গেছে।
ঠাকুর বলল, বাবু রহিছে ঘরে, বাবুর নার্স মেয়েমানুষটার কপাল পুড়ল, সি নাকি বদলি ইঁই যাবে, বাবুর মনও বদলি হুঁই গিছে।
ভানু বলল, এসব থাক।
ঠাকুর নিঃশব্দে হাসে, ঠাকুরের ঠোঁটের কোণে চোরা হাসি ফুটে ওঠে, বিনবিন করে বলে, মাইতিবাবুর মন যে কখন কুন দিকে ধায় বুঝারও উপায় নি, ধরারও উপায় নি, ঠাকুরানি যদি সেবা কঁইরত তবু কি রহিতে পারত, এক মেয়েমানুষের সেবা কতদিন পছন্দ হয় কহ।
ভানু বলল, তুমি থামবে!
কেনে শুনতে ভালো লাগছেনি?
না, ওসব আমাকে বোলো না।
কিন্তু ইটাই তো সত্য, দ্যাখো না কেনে একদিনেই বাবুর মেজাজ কত ঠাণ্ডা, নোতন দাসীর হাতের চুড়ির টুনঠুন শুনা যাচ্ছে, উয়ার পায়ে আবার নূপুর আছে, ইটা কি জানো?
ভানু ঘুরে তাকায়। ঠাকুর কীসব বলছে? কেন বলছে? তাকে শোনানোর উদ্দেশ্য কী? রামচন্দ্র কিনে দিয়েছিল পায়ের নূপুর। রামচন্দ্র নাকি ওর পায়ে নূপুর পরিয়েছিল যাওয়ার আগের দিন সন্ধেয়। ঠাকুর নিজের চোখে দেখেছিল তা। ঠাকুর হাসছে, রামচন্দ্রটা দামড়া ও পরাল নূপুর, সেই নূপুরের শব্দ শুনছে রামচন্দ্রর মালিক মাইতিবাবু। শুধুই ডাকাডাকি করছে সুভদ্রা, সুভদ্রা বলে।
ভানু বলল, আমায় বসে থাকতে দাও, তুমি তোমার কাজে যাও ঠাকুর!
ঠাকুর খি খি করে হাসে, তুমারে যে বাবু স্মরণ করিছে, মোরে কহি দিল তুমারে ডাকি দিতে, তবে টুকুন পরে যেও, সুভদ্রা দাসীর সহিত বাবু আলাপ কইরছে, তুমি গিয়া কী কঁইরবে কহ।
ভানু কঠিন দৃষ্টিতে তাকায় ঠাকুরের চোখে। ঠাকুরের চোখের মণি তাতে কাঁপেও না। ঠাকুর বলছে, সুভদ্রার হাতের রান্না ভালো, কাজ ভালো, ঠাকুরানি ছিল পথের, আর ই মেয়্যামানুষটা কাছারিবাড়ি থিকে আমদানি, ভালো তো হবেই, ইখন সব শান্ত থাকবে, ভানুবাবু, তুমি যদি ফির অশ্ব চুঁড়তে যাও বাবু টঙ্কা দিবে, বাবুর দিল খুলি যাবে।
ভানু চুপ করে থাকে। সমুদ্রে তাকিয়ে থাকে। সমুদ্রের নীল ধীরে ধীরে শূন্যে পরিব্যাপ্ত হয়ে যাচ্ছে। অন্ধকার নেমে এলো প্রায়। সে ঝপ করে উঠে দাঁড়ায়। পঞ্চম ঠাকুর হলো বিষধর। তার মুখ দিয়ে কোনো একটা কথা বের করে তা পৌঁছে দেবে শ্রীপতি মাইতির কানে। পঞ্চম ঠাকুরের শিরদাঁড়া ভেঙে গেছে। তা জোড়া লাগিয়ে উঠে দাঁড়াতে চাইছে আধবুড়ো লোকটা। ভানু ওকে সুযোগ করে দেবে না। পঞ্চম ঠাকুরকে ফেলে রেখে সে দ্রুত পা চালায়। কিন্তু ঠাকুর তাকে ছাড়ে না। আসতে থাকে গায়ে গায়ে। ভানু আকাশে ঘাড় উঁচিয়ে হাঁটছিল। মাইতিবাবু যখন ডেকেছে সে হোটেলেই ফিরবে এখন, ঘুরে পঞ্চম ঠাকুরকে বলল, তুমি আমার পিছনে আসছ কেন, যাও তো, কাজে যাও।
ঠাকুর বলল, ভানুবাবু, ঠাকরানি হইছে উচ্ছিষ্ট, উচ্ছিষ্ট তাই বাবু উয়ারে তাড়াই দিল, ইয়ারে যখন তা কঁইরবে তখন ই ঠাকুর আশরয়।
ভানু রাস্তার অন্যদিকে চলে যায় ঠাকুরকে এড়াতে। ঠাকুরের কথা সত্য, মিথ্যা সে জানে না, তবে এটা বোঝে সুভদ্রাকে রেখে দেয়া ঠিক হয়নি মাইতিবাবুর। আবার ঠিক যে হয়নি, সে কথাও বা বলে কী করে? ভানু দেখছে সমুদ্রের নীল এখন গভীর শূন্যতায় ছেয়ে যাচ্ছে। গোধূলিবেলা ফুরিয়ে গিয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো প্রায়। আলো নেই। এখন প্রায়ই আলো যাচ্ছে, কখন আলো যায় আর কখন থাকে ঠিক নেই। আবছা অন্ধকারে ভানুর মন খারাপ হয়। মনে পড়ে যাচ্ছে ভাদ্র মাসের সেই রাতটির কথা। ঘুমঘুম জ্যোৎস্না। সে দেখেছিল সুভদ্রা বউকে। তার অঙ্গে অঙ্গে বেদনার চিহ্ন। চিহ্নগুলো মিলিয়েছে কি? মাইতিবাবু কি সব কথা শুনেছে? বলেছে কি সুভদ্রা দাসী? এখন এই অন্ধকারে বসে বলছে কি জমিজমা, সংসার, স্বামী যাওয়ার সেই দীর্ঘ বৃত্তান্ত। তা যদি শোনাতে পারে মাইতিবাবুর মন ঘুরতে পারে। ভানু ভাবল, আর কী? এসব তো রামচন্দ্র, সুভদ্রা আর শ্রীপতি মাইতির ব্যাপার। সে কে? ভালোমন্দর বোঝেই বা কী সে? সুভদ্রাকে রেখে হয়তো বাঁচিয়ে দিল মাইতিবাবু। এ জায়গায় কাজ আছে, খেয়ে-পরে বাঁচার উপায় আছে, ভীমাপুরে কি তা আছে? রামচন্দ্র কি বাঁচাতে পারত ওকে? কাছারিবাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যেত যদি সুভদ্রাকে, রামচন্দ্রর কিছু করার থাকত? সেই হুমকি তো আসছিল। তাই ছুটে এসেছিল বিয়ে করার অনুমতি নিতে। আর রামচন্দ্র, সুভদ্রার জন্য কাছারিবাড়িতে যদি হামলা হতো, শ্রীপতির দীর্ঘদিনের তালুক, জমিজমা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ত। বালিমুণ্ডা-ভীমাপুরের বিষয় সম্পত্তি, চাষবাস চলছে একটা নিয়মে, সেই নিয়মের উৎস যে কাছারিবাড়ি সেখান থেকে যদি মেয়েছেলে লুট হয়ে যায়, নিয়ম ভেঙে পড়বে হুড়মুড় করে। চাষারা তো কেউই সুখে নেই, চাষারা তো কাছারির নায়েব, নায়েবের মালিকের হাতে সুবিচার পায় না। ভানু হাঁটতে হাঁটতে হোটেলে পৌঁছে দেখে বারান্দায় হারিকেন জ্বলছে। সামনের কিচেন-ডাইনিংয়ের ভিতরে অন্ধকার নিঝুম হয়ে ভেসে আছে। ভানু গলা খাঁকারি দিল, আরও আলো জ্বালাবে না? বাবু এবার জেনারেটর আনবে, এবার তো ট্যুরিস্ট আসার টায়েম, ঠাণ্ডা পড়ছে।
বারান্দার অন্ধকার থেকে অন্য কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ভানুদাদা! ছন্দক!
কে, কোকিলা?
গৌরমোহন অন্ধকারে উঠে দাঁড়িয়েছে, ভানুবাবু, মোরা এসে বসে আছি, মোরা পা দিলাম, আলো নিভল।
সুভদ্রা কই, সুভদ্রা বউ? ভানুর গলায় উদ্বেগ।
তুমাদের ঠাকরানি, অন্ধকারে বসে আছে রান্নাশালে।
অস্ফুট নূপুরের শব্দ তুলে সুভদ্রা বেরিয়ে এলো কিচেন-ডাইনিং থেকে। বারান্দা আর কিচেন-ডাইনিংয়ের মধ্যবর্তী একফালি আকাশতলে দাঁড়িয়ে গোধূলিসন্ধ্যায় মুখ দেখাল, বলল, এনারা তুমার নিকট—!
বাবু কোথায়?
বাবু নিদ যাইছে, ঘরে রহিছে।
ভানু বারান্দায় বসল বেঞ্চে, গৌরমোহনকে জিজ্ঞেস করতে যাবে তো সে-ই বলল কেন এসেছে। মদরঞ্জি বোনা শেষ। নিয়ে এসেছে। শুনে ভানু উঠে অন্ধকার ঘরের ভেজানো দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকে। বিলম্বিত লয়ে শ্বাস নেয়ার শব্দ শুনল দাঁড়িয়ে। ডাকবে কি ডাকবে না ঠিক করতে না পেরে বেরিয়ে এসে দরজা আবার ঠেলে দিয়ে বলল, শরীর খারাপ নাকি?
কী জানি, মু তো চা দিলাম, চা নিলা।
ভরসন্ধেয় ঘুমোচ্ছে কেন?
মু তো জানিনি।
ভানু বসল, আবার বলল, আঁকা হয়ে গেছে! দেখাবে?
আলো আসুক, কোকিলা বলে।
আলো যদি দেরিতে আসে, ফিরতে হবে তো, গৌরমোহন বলল।
অন্ধকারে কি ধরা যাবে, হেরিকেনের আলোয়?
ভানু বলল, এখন তো যেতে পারবে না, বাবু কিনবে, বাবু তো দেখবে, ঘুম ভাঙুক বাবুর, খোলো আমি দেখি।
গৌরমোহন বলে, কোকিলার মাথায় যে কী ঢুকল, কেমন আঁকা করিছে দ্যাখো।
ভানু ডাকল সুভদ্রাকে। বারান্দার কোণ থেকে পাকানো মাদুর নিয়ে এলো কোকিলা। আলোটা উসকে দিল ভানু। বারান্দার ধারে সরে গেল বেঞ্চিটা টেনে। কোকিলা মাদুরের পাক খুলতে থাকে। দেয়ালে কোকিলার অন্ধকার ছায়া কাঁপছে। গৌরমোহন হাত লাগাল কোকিলার কাজে। দুজনে মাদুরটি খুলে দেখাতে থাকে। মাদুর মানে মাদুরে বন্দি কন্থক। ভানু দেখল ঘোড়াটা মুখ বাড়াচ্ছে। এক ঝটকায় মাদুরটা টেনে খুলে দিয়ে কোকিলা বলে ওঠে, দ্যাখো ভানুদাদা, কেমন আঁকা করিছি, ধরিত্তি ফেটে আকাশ পর্যন্ত কারও ধুঁয়া উঠে যাচ্ছে, কন্থক পালাচ্ছে, তুমার অশ্ব যেমনভাবে পলাইছিল ঘুড়াউয়ালা, তেমনিভাবে পালাচ্ছে, এই দ্যাখো।
হারিকেনের গাঢ় অথচ অপ্রতুল আলোয় ভানু দেখল বারান্দাটি যেন পেয়ে গেছে মরুভূমির হলুদ রং। সেই হলুদ রঙের জমি ফেটে ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছেয়ে ফেলছে নীল আকাশ, নীল শূন্যতা, নীল জ্যোৎস্না, নীল রঙের পৃথিবী। বাতাসে ভেসে যাচ্ছে তেজস্ক্রিয় মারণ বিষ। ভানু দেখছে ঘোড়াটির চোখ বিস্ফারিত, নাসারন্ধ্র ফুলে উঠেছে, কেশরপুঞ্জ ঘাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে গেছে, আতঙ্কে ঘোড়াটির গায়ের সমস্ত রোম খাড়া হয়ে গেছে। মরুভূমির বালিতে ঢেউ। সেই ঢেউয়ে পক্ষিরাজের পা ডুবে গেছে। অস্ফুট আর্তনাদ করে ওঠে সুভদ্রা, এটি কী!
ঘুড়াউয়ালার ঘুড়া।
ভানু বলল, তুমি এ কী আঁকলে?
তুমি যে বলে এলে! বিড়বিড় করে কোকিলা।
আমি কি এই বলে এসেছিলাম?
কহ নাই! কোকিলা মাদুরের ওপর ঝুঁকে পড়েছে, পখরানের কথা কহিলে মোরে, পুন্নিমার দিনে মরুভূমিতে কী হলো, তার পরেও কী হলো।
ভানু দরজায় গিয়ে ধাক্কা মারে, ডেকে ওঠে, বাবু, ও মাইতিমশায়।
ঠিক তখনই জেগে উঠল শ্রীপতি। সে নিজে জাগছিল একটি দুঃস্বপ্ন থেকে। ভানুর ডাকে দুঃস্বপ্নটি হারিয়ে গেল মন থেকে। অন্ধকারে জেগেই ভানুর গলা শুনে ধড়ফড় করে নেমে এলাম খাট থেকে, কী হলো, নতুন ঠাকরানির কী হলো?
কিছু না, বাবু, আপনার পঙ্খিরাজ এঁকে এনেছে কোকিলা।
কোকিলা! শ্রীপতি দরজা দিয়ে বাইরে তাকায়। বারান্দায়। বারান্দা থেকে দরজার মাপের আলো ঘরে ঢুকে খাট পর্যন্ত এসে বিস্তৃত হয়ে ঘরের অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। শ্রীপতি দেখছিল বারান্দার আলোর খণ্ড থেকে আতঙ্কগ্রস্ত একটি সাদা ঘোড়া ঘরের অন্ধকারে যেন ছুটে আসতে চাইছে। আর তার পিছনে কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া। এই ধোঁয়াই কি তার স্বপ্নে ঢুকে পড়েছিল। ভানু দেখছিল ঘরের বাইরেই মরুভূমির হলুদ রং ছড়িয়ে গেছে। ওই তো বসে আছে ভীমাপুরের বউটি। বউটি বড় চুপচাপ! শ্রীপতি ডাকছে বটে, কিন্তু তার নিজের কণ্ঠ থেকে দার্ঢ্য হারিয়ে গেছে যেন। সমস্ত দিন কতবার ডাকতে চেষ্টা করেছে শ্রীপতি, বোঝাতে চেয়েছে, কিন্তু পারেনি। সে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো, খুঁটিয়ে দেখল মদরঞ্জিটা, তারপর জিজ্ঞেস করে, এমন কেন?
ওই দিন যে মরুভূমি ফেটে গিয়েছিল দুফরে, বলল কোকিলা।
তার সঙ্গে পঙ্খিরাজ কেন?
এমনভাবে পালাচ্ছে ও।
কে আঁকতে বলেছে এমন করে?
কেহ না, মুর মনে হলো, আঁকলাম।
এমন মনে হলো কেন?
জানিনে বাবু, তবে এটাই সত্য।
না সত্য নয়। শ্রীপতি বলল, মাদুর গোটাও।
নিবে না? কোকিলা উঠে এলো।
শ্রীপতির বলার আগে সুভদ্রা বলে ওঠে, ইটাই সত্য মু জানি।
চমকে ওঠে শ্রীপতি। দেখল ভীমাপুরের বউটি ঘাড় ঘুরিয়ে তার চোখে চোখ রেখেছে, বলছে, ইটাই সত্য, ইমনই হইছিলা বাবু!
তুমি জানলে কী করে?
মু তো জানি। ইয়ার ভিতরে যা আছে সবু মুর জানা, দিখা।
এ মাদুরে আমি কী করব, এতে শোয়া যাবে না।
দেয়ালে টাঙাই দিয়ো। বলল কোকিলা।
শ্রীপতি দেখল কোকিলাকে। সেই কোকিলা, ভানু দাসের কোকিলা বধূ। এর মায়ায় পড়ে ভারতী চৌধুরী ধুলো হয়ে গেল তার মনে। কিন্তু এখন যে মনে হচ্ছে এ তো মায়াবতী নয়। কোনো মায়াই তো জাগাচ্ছে না। ওই যে সুভদ্রা বউ। তার টানে পড়ে আজ সমস্ত দিন শুধু হাঁপিয়েছে শ্ৰীপতি।
কোকিলা বলল, ঘুড়া না পাও ঘুড়াউয়ালা, ঘুড়াটা কেন পলাল সি খবরটা তো জানবে, লকে তো তুমাদের কাছে শুনবে, তাই এমন আঁকা হলো।
শ্রীপতি এবার ঝুঁকে পড়ল মদরঞ্জির পর। মরুভূমির ওপর। মরুভূমির হলুদ বালির ওপর। ঝুঁকে পড়ে টের পেল বালির তাত ছড়িয়ে যাচ্ছে তার মুখমণ্ডলে। মুখের ওপর ছড়িয়ে যাচ্ছে কালো ধোঁয়া। সে মুখ তুলে বলল, এমন করে আঁকা ঠিক হয় নাই, এ মাদুর রাখা যাবে না।
কেনে? সুভদ্রা গ্রীবা বাঁকিয়ে তাকিয়েছে।
শ্রীপতি নুয়ে গেল সুভদ্রার দৃষ্টিতে, বলল, আমার ভয় করছে!
সত্যি কি? কোকিলা জিজ্ঞেস করে, সত্যি ডর লাগিছে?
হাঁ সত্যি, মদরঞ্জিওয়ালা তুমি নিয়ে যাও, এ মাদুর ঘরে রাখলে ঝামেলা করতে পারে কেউ কেউ, আমার পঙ্খিরাজ যাক। শ্রীপতির কণ্ঠস্বর স্তিমিত হয়ে গেল।
সেকি! ভানু আর্তনাদ করে ওঠে, কী বলছেন বাবু, এ যে আমার কন্থক।
যা বলছি, ঠিক বলছি, তুমি বুঝছ না। শ্রীপতি ঘরের অন্ধকারে গিয়ে ঢোকে, বাতাস দেখছ না তুমি, কানে শোনো না!
কোকিলা মাদুর গোটাতে থাকে। গোটাতে গোটাতে বলে, ঠিক আছে এটি লিয়ে তুমার গৌরদাদা হাটে হাটে ঘুরবে, না বিকোক, লকে তো জানবে কেন পলাইছিল পঙ্খিরাজ।
অন্ধকার থেকে শ্রীপতি বলল, আমার উপায় নাই, এটি ঘরে রাখা যাবে না।
ঠিক আছে বাবু, ঠিক আছে। মদরঞ্জিওয়ালি পাকিয়ে নিল মাদুর। মরুভূমি, বিস্ফোরণ, ছুটন্ত ঘোড়া সব অদৃশ্য হয়ে গেল।
সুভদ্রা বউ নেমে গেল অন্ধকারে। অন্ধকারে নেমে হাঁটতে লাগল। পরদিন সকালে উঠে ভানু শুনল নতুন কাজের মেয়েমানুষটা চলে গেছে একা একা।
ভানু বুঝল সাহস পেয়েছিল মদরঞ্জির ওপর আঁকা দেখে। ভানুর মাথার ভিতরে মদরঞ্জিওয়ালির আঁকা ছবিটা গেঁথে গেছে। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছিল কন্থক পালাচ্ছে। কিন্তু কোন দিকে? কোন দিকে যাবে সে? যেদিকে যাবে সেদিক থেকেই তো পালাতে হবে ঘোড়াটাকে।
ভানু সমুদ্রের ধারে ঝাউবনে বসে থাকল সমস্ত দিন। তার চোখ খুঁজছিল একটি শূন্য নৌকোকে। শূন্য নৌকো যেন ফিরে আসবে একা একা, মাঝি তাকে ছেড়ে চলে গেছে। ভানুর মনে হচ্ছিল সে নিজেই যেন সেই শূন্য নৌকোটি। সেই যেন সেই শূন্যপৃষ্ঠ অশ্ব, যে কুমারকে রেখে দিয়ে একা একা বিষণ্ন মনে ফিরল রাজধানীতে। কুমার গেছেন মৃত্যুকে জয় করতে। রোগ, জরা, মৃত্যুর শাসন থেকে মানুষের মুক্ত করতে। মানুষের মনে আলো জ্বালাতে কপিলাবস্তুর রাজপুত্র গৌতম সর্বস্ব ত্যাগ করে প্রবেশ করলেন তপোবনে। তাঁর প্রিয় অশ্ব, প্রিয় সারথি ফিরেছিল ঘাড় হেঁট করে। তারপর অশ্বটি চলে গেছে সারথি ছন্দককে ফেলে। ভানু দাস কাঁপছিল, অশ্বটি কি যাত্রা করল রাজপুত্রের খোঁজে? রাজপুত্র যে বুদ্ধ হয়েছিলেন তা তো অজানা নয় কন্থকের। কন্থক কি বুদ্ধের কাছে ছুটে গেল? এ ছাড়া আর কোথায় যেতে পারে সে এই মরণগন্ধি পৃথিবীতে?