1 of 2

অশোক ষষ্ঠীর কথা

অশোক ষষ্ঠীর কথা

কোনও অশোকবনে এক মুনি বাস করতেন। চারিদিকে অশোক ফুলের গাছ, মাঝখানে মুনির কুঁড়েঘর। একদিন মুনি সকালে উঠে দেখেন, তাঁর কুঁড়েঘরের সামনে অশোক তলায় একটি পদ্মফুলের মতো মেয়ে পড়ে পড়ে কাঁদছে। মুনি ধ্যান করে দেখলেন, একটি বুনো হরিণী ওই মেয়েটি প্রসব করে ফেলে গেছে। মেয়েটিকে দেখে মুনির বড়ো মায়া হল, তিনি সেটিকে ঘরে এনে লালন-পালন করতে লাগলেন। মেয়েটি একলা শুয়ে থাকলে হরিণী এসে মাঝে মাঝে দুধ দিয়ে যেত। ক্রমে মেয়েটি বড়ো হল; মুনি ভাবেন—এমন সুন্দরী মেয়ে কুঁড়েঘরে রেখে আমি কোথাও গিয়ে স্থির থাকতে পারি না। মেয়েটিকে একটি সৎপাত্রে দিতে পারলে নিশ্চিন্ত হই। মুনি কোথাও যাবার সময় মেয়েটিকে বলে যান, ‘মা অশোকা! আমি যতক্ষণ না আসি ততক্ষণ তুমি কুটিরের বাহিরে যেও না।’ মেয়েটি তাই ঘরের ভিতরেই থাকে।

মুনি আর মনের মতো পাত্র পান না। তখন প্রতিজ্ঞা করলেন, কাল সকালে উঠে যার মুখ দেখব তার সঙ্গেই মেয়ের বিয়ে দেব। দৈবের কর্ম, সকালে উঠে দেখেন, এক রাজপুত্র মুনির কুটিরের দরজায় লোক-লস্কর নিয়ে উপস্থিত। মুনি বললেন, ‘তুমি কে? এখানে কেন?’ রাজপুত্র বললেন, ‘আমি রাজার ছেলে, মৃগয়া করতে এসেছিলাম, সন্ধ্যা থেকে সমস্ত রাত্রি ঝড়-বৃষ্টি হওয়াতে আমি আপনার এই কুটির-দ্বারে আশ্রয় নিয়েছি।’ মুনি বললেন, ‘তা ভালোই হয়েছে, আমার একটি মেয়ে আছে, সেটি তোমায় দান করব।’ এই বলে তিনি অশোকাকে এনে হাতটি ধরে রাজপুত্রের হাতে সঁপে দিলেন। আর মেয়েটির আঁচলে কতকগুলি অশোক ফুল ও বিচি দিয়ে বললেন, ‘মা! এই ফুলগুলি শুকিয়ে রেখ, চৈত্রমাসে অশোক ষষ্ঠীর দিনে খাবে; আর এই অশোক দানাগুলি দুহাতে ছড়াতে ছড়াতে যেও। আমার কুটির থেকে রাজপুত্রের বাড়ি পর্যন্ত অশোকফুলের গাছ হবে। যদি তোমার কখনও বিপদ ঘটে, তবে ওই গাছের সার ধরে ধরে আমার কুটিরে এসো। আর অশোক ষষ্ঠীর দিন কখনও অন্ন আহার করো না।’ তখন রাজপুত্র ও অশোকা দুজনে মুনিকে প্রণাম করে যেতে লাগলেন। অশোকা দুহাতে অশোক ফুলের বিচি ছড়াতে ছড়াতে শ্বশুরবাড়ি গেল। রাজা রানি আদর করে বউ-বেটাকে ঘরে তুললেন।

কিছুদিন পরে অশোকার একটি ছেলে হল। তারপর ক্রমে ক্রমে সাতটি ছেলে ও একটি মেয়ে হল। ছেলেদের বিয়ে থা হল। তারপর শ্বশুর শাশুড়ি যথাসময়ে স্বর্গে গেলেন। চৈত্রমাসে অশোক ষষ্ঠীর দিন শ্বশুরের শ্রাদ্ধ; সমস্ত দিন গোলমালে গেল। সন্ধ্যার সময় অশোকার বউয়েরা বললে, ‘ওমা, ভাত খাবে এস।’ অশোকা বললে, ‘আমার মনে ছিল না মা! আজ যে আমার অশোক ষষ্ঠী।’ তখন বউয়েরা তাড়াতাড়ি মুগ কলাই সিদ্ধ করে এনে দিলে। রাত্রে ছেলেরা বউয়েরা ঘরে ঘরে শুয়ে রইল। সকালে কেউ আর ওঠে না। এক প্রহর বেলা হয়ে গেল, কেউ ঘরের দরজা খোলে না! অশোকা এ ঘরে ধাক্কা মারে, ও ঘরে ধাক্কা মারে, কেউ সাড়া দেয় না। তখন রাজা কামার ডেকে দরজা ভেঙে দেখেন, বউ, বেটা নাতি, নাতনি সব মরে আড়ষ্ট হয়ে পড়ে আছে। এই দেখে রাজা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আশোকা, কী হবে?’ তখন অশোকার সেই মুনির কথা মনে পড়ল। অমনি কাঁদতে কাঁদতে অশোকফুলের গাছ ধরে বরাবর সেই মুনির কুটিরে গিয়ে, মুনির পায়ে পড়ে কাঁদতে লাগল, বললে ‘বাবা! আমার সর্বনাশ হয়েছে; ছেলেপুলে সব মরে গেছে!’

মুনি তখন ধ্যানে সব জানতে পারলেন। মেয়েকে সান্ত্বনা করে বললেন, ‘তুমি অশোক ষষ্ঠীর দিন যে মুগ কলাই সিদ্ধ করে খেয়েছিলে, সেই মুগ ঘুঁটের জ্বালে সিদ্ধ হয়েছিল, সেই ঘুঁটের সঙ্গে ধান ছিল, সেই ধান আগুন-তাতে ফুটে খই হয়ে মুগসিদ্ধর হাঁড়িতে পড়েছিল। সেই মুগসিদ্ধ খেয়ে তোমার এই সর্বনাশ হয়েছে। ভয় নাই, আমার এই কমন্ডলুর জল নিয়ে যাও, সকলের গায়ে ছিটিয়ে দাও, তাহলে সকলেই বেঁচে উঠবে। আর কখনও এমন কাজ করো না। বছর বছর অশোক ষষ্ঠীর দিন মা ষষ্ঠীর পুজো দিয়ে কথা শুনে ছয়টি অশোক কলি, ছয়টি মুগ কলাই দইয়ের সঙ্গে খেয়ে তবে অন্য কিছু খাবে।’ অশোকা তখন মুনিকে প্রণাম করে নিজের বাড়ি গেলেন। কমন্ডলুর জল সকলের গায়ে ছিটিয়ে দিবা মাত্র সকলে উঠে বসল! কেউ বলে, এত ঘুমিয়ে পড়েছি; কেউ বলে, আমাদের ডাকনি কেন মা? এত বেলা হয়েছে। অশোকা বললে ‘তোরা কেউ কি বেঁচেছিলি বাছা? অশোক ষষ্ঠীর দিন মুগ কলাই সিদ্ধর সঙ্গে খই পড়েছিল, সেই মুগসিদ্ধ খেয়ে আমার সর্বনাশ হয়েছিল, তোমরা সব মরে গিয়েছিলে। এখন তোমরা খুব সাবধানে অশোক ষষ্ঠী করো। বছর বছর চৈত্রমাসে শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীর দিনে মা ষষ্ঠীর পুজো দিয়ে মুগ কলাইয়ের সঙ্গে অশোক ফুলের কলি নিয়ে আমার এই বিপদভঞ্জনের কথা বলবে, তাহলে কখনও শোক পাবে না। এই বলে অশোকা ছেলে, বউ, নাতি, নাতনি নিয়ে রাজার সঙ্গে সুখে স্বচ্ছন্দে ঘরকন্না করতে লাগল।

রাজা মা ষষ্ঠীর এই আশ্চর্য মাহাত্ম্য দেখে তাঁর রাজ্যের সমস্ত প্রজাদের এই অশোক ষষ্ঠীর ব্রত করাতে লাগলেন। সেই অবধি চারিদিকে অশোক ষষ্ঠীর পুজো প্রচার হল।

অশোক ষষ্ঠীর কথা সমাপ্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *