1 of 2

অলৌকিক জলযান – ৯

॥ নয় ॥

জাহাজ ছাড়ার আগে মৈত্র ছোটবাবুকে ওয়াচে নিয়ে নিল। সারেঙের ইচ্ছে ছিল না। কি দরকার, যখন চলে যাচ্ছে। এখন তো সমুদ্রে তেমন ঝড় উঠছে না। আর সামনে যে সমুদ্র পাড়ি দিতে হবে, খুব ভয়াবহ হবে না। শীতের সমুদ্র। শান্ত নিরিবিলি। নানা বর্ণের সমুদ্র-পাখীরা ঘোরাফেরা করবে কেবল। এখন ছোট যেভাবে আছে সে-ভাবেই থাক না। ওকে আর কে ঘাটাচ্ছে।

তবু মৈত্র বলল, না। ওর শক্ত হওয়ার দরকার আছে। সব জাহাজে আপনি আমি থাকব না।

—ছোট কি বলে?

—ওর আবার বলার কি আছে! ওর ইচ্ছায় তো আর কাজ হবে না।

সারেঙ বললেন, ঠিক আছে, যা ভাল মনে করেন, করবেন

সারেঙের এ নিয়ে কোনও দ্বিধা থাকল না। ছোটবাবুর জন্য মৈত্রমশায় ভেবে থাকেন। এটা সারেঙসাব নিজেও চান, ছোট শক্ত হোক। অনেকটা হয়েছে। জাহাজের স্মোক-বকসে খুব ভালভাবে কাজ করেছে। কয়লা লেভেলিং-এর দিন, সে তো সবচেয়ে বেশি খেটেছে। এভাবে একজন জাহাজি জাহাজে ঠিকঠাক কাজ করতে না পারলে পদে পদে অপদস্থ হতে হয়। সুতরাং ছোটবাবুর ফালতু থাকা আর হল না। এখন সেও অন্য জাহাজির মতো ‘পরিদার’। তার ‘পরি’ মৈত্রদার সঙ্গে। বারোটা- চারটা ওয়াচ। এক বাংকারে সে কাজ করবে, অন্য বাংকারে অমিয়। অমিয় ইতিমধ্যেই বেশ ‘পরি’ শেষে শিস দিতে দিতে উঠে আসে। একদিন ছোট দেখেছিল, অমিয় ‘পরি’ শেষ করে বোট-ডেকে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে কবিতা আবৃত্তি করছে। বোধ হয় কোন ইংরেজ কবির সমুদ্রবিষয়ক কবিতা। সে শুনতে পায় নি। ওর হাত পা নাড়া দেখে ভেবেছিল, অমিয় বোট-ডেকে পাগলামি করছে। সে ওপরে যেতে পারে নি। কারণ সে উইন্‌চে কাজ করছিল। ফাইবার ওকে দিয়ে কাজ করাচ্ছিল। ওকে সে জিজ্ঞাসা করলে বলেছিল, কবিতা আবৃত্তি করলাম। কি শান্ত আকাশ, কি অসীম সমুদ্র, ইচ্ছে হয় না হাত পা ছুঁড়ে কবিতা আবৃত্তি করতে! ইচ্ছে হয় না ধনধন্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা গানটা গেয়ে ফেলি!

এ-ভাবে প্রথম যে জাহাজ মনে হয় নিদারুণ, সমুদ্র-যাত্রা মনে হয় কঠিন সফর, জীবনযাপনে বিশ্বস্ততা থাকে না, মনে হয় সবাই ভিন্ন ভিন্ন গ্রহ থেকে নেমে এসেছে, ক্রমে তা আর মনে হয় না। মনে হয় এরা সবাই মিলে একই গুষ্ঠিভুক্ত জীব। এখানে ঠিক সবাই একইভাবে, যেমন সারেঙ বলতে পারেন কবে বাড়িয়ালা মাসতার ডেকে বলবেন, নাটক, যাত্রা, কবিগান, যার যা খুশি কর। শান্ত সমুদ্রে ডেকের ওপর নাটক, আবৃত্তি গান-বাজনা লাগাও। বেশ তো বের হয়েছি সেই ডাঙ্গা ছেড়ে এভাবে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে কেন। তখন মনেই হয় না কাপ্তান খুব বুড়ো, মনে হয় না অথর্ব, মনে হয় না খিটখিটে তাঁর মেজাজ, বরং মনে হয় মানুষটা জীবনের চারপাশটা যেন শেষদিন পর্যন্ত দ্যাখোরে বাহার। চুপি চুপি বলবেন, আমার জন্য কিন্তু একটা প্রোগ্রাম রাখবে। এখনও একেবারে খারাপ হাত না।

সবাই তখন হেসে ফেলবে। এই যখন জাহাজের নিয়তি, অর্থাৎ যেখানেই জাহাজ যাক, জাহাজের একঘেয়েমি থাকবে, নিশিদিন তো শুধু নীল জল, নীল আকাশ, মাঝে মাঝে সমুদ্র পাখিদের ওড়া অথবা ডলফিনের ঝাঁক ভেড়ার পালের মতো সমুদ্রে দেখা আর তো বৈচিত্র্য বলতে কিছু নেই। যখন ঝড় সাইক্লোন দেখা দেয়, তখন বোধ হয় একটা বৈচিত্র্য আসে। একেবারে সব মানুষগুলোকে পাগলা করে দেয়। অথবা কুয়াশার ভেতর ঢুকে গেলে কিংবা কোন হিমশৈল, এটা সহজে ঘটে না। কাপ্তান সারাজীবনে দুবার সংকেত পেয়েছিলেন, নেমে আসছে, নেমে আসছে। পালাও পালাও। জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে দাও। ভয়ঙ্কর সমুদ্রের অতলে মৃত্যুর বিভীষিকা। যেন এক অতিকায় সমুদ্র জুড়ে হিমশৈল এক প্রাগৈতিহাসিক জীব হয়ে যায়। আর তো কিছু নেই। কেবল কাজ, চার্ট দেখা, চার্ট মতো জাহাজ চলছে কিনা দেখা, সকাল-সন্ধ্যায় গ্রহ-নক্ষত্র দেখে জাহাজের অবস্থান বোঝা। কখনও কখনও দেখা, দিক ঠিক আছে কিনা, অথবা দিক নির্ণয়। অথবা মার্কনি সাব অর্থাৎ রেডিও অফিসার সকাল হলে জাহাজের খবর জানিয়ে দিচ্ছেন এরিয়া স্টেশনকে। প্রতি সকালে তার এটা কাজ!—হ্যাঁ হ্যাঁ, সিউল ব্যাঙ্ক। তারপর প্রায় মুখস্থ বলার মতো বলে যাওয়া, কত এন. আর. টি., কত জি. আর. টি., কোন কোর্সে জাহাজ যাচ্ছে এবং নেক্স্ট পোর্ট অফ কল কি! অথবা পজিশান জাহাজের ভুল হলে চেয়ে নেন রেডিও বিয়ারিঙ। তা হলেই সব ঠিকঠাক। আর ভয় থাকে না। এভাবে সব কাজের ভাগবাটোয়ারা করে বাকি সময়টা কাপ্তান হুইল ঘরে বসে থাকেন। অথবা খোলা ডেকে বসে এই যে, পৃথিবী, সমুদ্র এবং গ্রহ-নক্ষত্র এবং সৌরলোক সব মিলে ঈশ্বরের কি অপার মহিমা এমন ভাবেন। তখন কাপ্তানের চোখ বুজে আসে, তারপরই কেমন একটা দুঃস্বপ্ন ভেতরে নাড়া দেয়, যেন কেউ পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার গাউন এবং চুলের গন্ধ পর্যন্ত পাচ্ছেন তিনি! যত বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন তত সে পাশে দাঁড়িয়ে কেমন হা-হা করে পাগলের মতো হাসে। তারপরই এক পতনের শব্দ হয়। নিশীথে কেউ শুনতে পায় না, খোলা-ডেক থেকে কে কাকে যেন ঠেলে ফেলে দিচ্ছে। আর কোন শব্দ নেই। প্রপেলারটা ঝিক্ ঝিক্ শব্দ তুলে কেবল যাচ্ছে। তখন কেমন ভয়ে কাপ্তানের বুক গলা শুকিয়ে যায়। তিনি হাঁকতে থাকেন, জ্যাক, জ্যাক, দ্যাখ তো কেউ আমার ঘরে ঢুকেছে কিনা!

—না তো। কে ঢুকবে।

—মনে হল কেউ আমার ঘরে ঢুকেছে!

জ্যাক এতে কিছু মনে করে না। সে এটা বাড়িতেও দেখেছে। বাবার হাতে কাজকর্ম না থাকলে এমন হয়। একা চুপচাপ বসে থাকলে, কেন জানি বাবা ভীষণ ঘাবড়ে যান। সে বাবাকে এ জন্যও ছেড়ে থাকতে পারে না।

বাড়িটা ওদের পোর্টের কাছাকাছি। একদিকে বড় মাঠ, শহরের ভেতরে রাস্তা চলে গেছে। রাস্তা পার হলে, কিছু লোহা-লক্কড়ের কারখানা। তারপরই নির্জন গাছপালা, ঘেরা একটা ফোর্টের মতো বাড়ি। সামনে লাইটহাউস। অর্থাৎ রাস্তা সামনে, তারপর ড্রাই-ডকের জেটি। কিছু লম্বা ক্রেন। ড্রাই- ডক করা সব জাহাজের খোল ওদের বারান্দায় দাঁড়ালে চোখে পড়ে। আর আছে আরও দূরে সব যুদ্ধজাহাজের ঘাঁটি। সারি সারি ডেস্ট্রয়ার সমুদ্রের জলে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। বাবা বোধহয় বাড়িটা ইচ্ছে করেই এমন একটি জায়গায় করেছিলেন। সারাদিন ব্যালকনিতে বসে থাকলে সমুদ্রে সব ছোট ছোট জাহাজ, বড় জাহাজ, টাগ-বোট এবং যুদ্ধ জাহাজের নীল জলে ঘোরাফেরা ভাল লাগে দেখতে। আর বাড়িটা গাছপালায় ঘেরা। বেশ-জায়গা নিয়ে। নানাবর্ণের সব গাছ বাবা পৃথিবীর সব বন্দর থেকে সংগ্রহ করেছেন। কেউ বেঁচেছে, কেউ বাঁচেনি। তবু বাড়িটাকে দেখলে মনেই হয় না, ওয়েলসে এমন আর একটা বাড়ি আছে।

মাঝে মাঝে বাবা ঠিক এমনি চিৎকার করে ওঠেন, দেখ তো ভেতরে কে গেল?

—কে বাবা!

—মনে হয় কেউ।

—না তো।

—ভালো করে দ্যাখ।

জ্যাক ভিতরে ঢুকে ভাল করে দেখে আসে। পরিচারিকা মেয়েটিও ছুটে আসে। সফরে বের হলে একজন পাহারাদার থাকে বাড়িতে। মাঝে মাঝে পরিচারিকার সঙ্গে বাজারের হিসাবপত্র নিয়ে বসে। এমন শুনতে পেলে সেও ছুটে আসে। কি হয়েছে স্যার।

—চোখ বুজে ছিলাম, মনে হল কেউ এসে দাঁড়াল, কি বলল, তারপর কোন তোয়াক্কা না করে ভেতরে ঢুকে গেল।

এ নিয়ে প্রথম প্রথম সবাই খুব চিন্তিত হয়ে পড়ত। ওদের ভাবনা হত। সমুদ্রে ঘুরে বেড়ালে, এমন হওয়া স্বাভাবিক। সারাক্ষণ জল আর জল, কখনও ডাঙ্গা, মানুষের কাছে ডাঙ্গা যে কত মধুর, একজন নাবিকের চোখ দেখলে তা টের পাওয়া যায়। এবং বোধ হয় কাপ্তান আর সফরে যেতে চান না। কিন্তু পরে এত স্বাভাবিক হয়ে যান যে তখন আর কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না।—ও এটা আমার হয়। ওটা কিছু না, শোন তো বনি। কাছে গেলে বলবে, বেহালাটা আন তো একটু বাজাই।

তখন হয়তো সমুদ্রে সূর্যাস্ত হচ্ছে অথবা জ্যোৎস্না রাত থাকলে এ ভাবে কতক্ষণ যে বাজান! যত বয়স হয়ে যাচ্ছে, তত বাবা বেহালা বাজাতে বেশি ভালবাসেন। বনি এটা দেখে বুঝেছে, বাবার ভেতরে অসীম দুঃখ। তাকে তিনি কিছুই বলতে চান না। তখন তার ভীষণ অভিমান। সে পাশেই দাঁড়িয়ে থাকে। কোন কথা বলে না। বাবা তাকে যেন দেখছে না। সেও বাবাকে দেখছে না। সামনের রাস্তায় কিছু গাড়ি-ঘোড়ার শব্দ। রাত হলে তাও থাকে না। বাড়িটা পোর্টের পিছন দিকে বলে খুব নির্জনতা আছে। ছাদে উঠলে, শহরের ভেতরে যে ক্যাসেল আছে তার চূড়ো দেখা যায়। আর এই যে লাইট-হাউস, এবং সব রঙ-বেরঙের বাড়ি, জাহাজের ভোঁ এ-সবের ভেতর বাবা এবং সে মাঝে মাঝে এমন নীরব হয়ে যায় যে কেউ বুঝতেই পারে না, বাড়িতে কেউ আছে।

বনি সমুদ্রে এলে শরীর ওর ভাল হয়ে যায়। প্রায় নাবিকের জীবনেই এটা ঘটে। কিন্তু বনি যতটুকু বড় হয়েছে, যা কিছু শিখেছে, অথবা জীবনযাপনে সে যে মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখতে শিখে গেছে, সেটাও এই জাহাজে। এই রাতের বেলাতে বাবা হুইল ঘরে একটা ডেক-চেয়ারে বসে আছেন। এনজিন – ঘর থেকে ঝিক ঝিক শব্দটা উঠে আসছে। সমুদ্রের বাতাসে আর তেমন জলকণা নেই। বাতাস ক্ৰমশঃ শুকনো হয়ে উঠছে। বেশ ঠান্ডা বাতাস। বাবার মাথার চুল গত সফরেও দুটো একটা সে কালো দেখেছে। কিন্তু সে এ-সফরে দেখল, বাবা তার ভীষণ বুড়ো, চুলগুলো ভীষণ সাদা। বিশেষ করে বাবা যখন একা একা চুপচাপ উইংসে দাঁড়িয়ে থাকেন, তখন বাবাকে ভীষণ দুঃখী মনে হয়। উইংসের সবুজ আলো দুলতে থাকে। জাহাজ ক্রমাগত সমুদ্রে ভেসে যায়। জ্যোৎস্নায় কেমন চারপাশের সমুদ্র অলৌকিক এক জগৎ নিয়ে বেঁচে থাকে। সে শুনতে পায় বাবা সমুদ্রকে উদ্দেশ্য করে কি যেন বলছেন, অথবা মনে হয় কিছুটা গানের মতো, অর্থাৎ সারাটা জীবন বাবা সমুদ্রে কাটিয়েছেন, ওর বয়স যদিও কম, তবু সে সমুদ্রে এসেই বুঝতে পেরেছে, বাবা এই সমুদ্রেই থেকে যেতে চান। বাড়িটা যে তিনি সমুদ্রের ধারে করেছেন সেও তো মৃত্যুর আগে তিনি জানালা দিয়ে সমুদ্র দেখতে পাবেন বলে।

আসলে মানুষের এই হয়। যত বয়স বাড়ে, তত ঈশ্বর সম্পর্কে বিচিত্র অনুভূতি অথবা মৃত্যুচেতনা, এবং কখনও গভীরে কি যেন বাজে। বনি বাবাকে অবসর সময়ে এখন দুটো কাজ করতে দেখে। সে দেখে বাবা, ঈশ্বর সম্পর্কে সব রকমের বই, বিশেষ করে জেরুজালেমের প্রাচীন ইতিহাস পড়তে খুব ভালবাসেন। কখনও কখনও তিনি বালকের মতো পড়ে যান ট্রেজার আইল্যান্ড অথবা ফরাসী দেশের সেই ছোট্ট রাজপুত্রের গল্প। যে থাকত ছোট্ট একটা গ্রহাণুতে। বাবা আর এখন ডিকেন্সের বই পড়েন না। অথচ লাইব্রেরিতে তার সব বই আছে। তিনি এখন বেছে বেছে সব ছোটদের বই সঙ্গে নেন। অথবা কোনও বন্দরে গেলেই তিনি ছোটদের বই কি ভাল আছে খোঁজ করবেন। এ- সব দেখে মনে হত সব তিনি বনির জন্য কিনছেন। তার কোন এতে উৎসাহ নেই। কিন্তু বই কিনে কিছুতেই না পড়ে বনিকে দেবেন না। বনি তখন না হেসে পারে না। অথবা কখনও কখনও তাঁর যখন ঘুম আসে না, যখন সারা রাত্রি সাহসা খুব দীর্ঘ হয়ে যায়, তিনি-বোট-ডেকে একাকী বেহালা বাজান। রাতের জাহাজ এমনিতেই ভীষণ মায়াবী। নীল রঙের ভেতর সাদা জাহাজের চলা, কেবল ঢেউ ভেঙে অন্তহীন গভীর সমুদ্রে চলা, আর অন্তহীন নক্ষত্রের ছায়া সমুদ্রে, তখন বাবার ভীষণ আবিষ্ট হয়ে বেহালা বাজানো বনির কি যে খারাপ লাগে! সেও নেমে যায় বোট ডেকে। বাবাকে সে ডাকে, বাবা!

—কে!

—আমি বাবা।

—অঃ। তোমার আবার এখানে আসার কি হল?

—এমন ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে থাকলে তোমার অসুখ হবে।

—কোথায় ঠান্ডা!

—ঠান্ডা নয়! আমার ভীষণ যে শীত করছে বাবা!

—যা! তুমি ছেলেমানুষ, তোমার তো আরও গরম লাগার কথা! বলেই তিনি জামার নিচে বুকের কাছে বনির হাতটা নিয়ে যেতেন। দ্যাখো তো ঠান্ডা লাগছে?

বনি দেখেছে, ঘামছেন বাবা। কেমন ভিজে ভিজে।

বাবা না বলে যেন পারেন না, আমি যে বেহালা বাজাচ্ছি। কি যে ভাল লাগে না। মনেই হয় না, পৃথিবীতে শীত আছে।

বনি টের পেত বাবার বুকটা কেমন ধীরে ধীরে ছোট হয়ে যাচ্ছে। ঠিক সে এমন আর একটা বুকের কাছে হাত রাখলে টের পাবে, তাজা, গভীর। সে যেন বলতে পারত, বাবা, ছোটবাবুর বুকটা তোমার মত না। ওর বোধ হয় খুব চওড়া। তোমার মত বয়সে ওর বুকে হাত দিলেও বুঝি এমন ছোট মনে হবে।

বনির এ-ভাবে কত যে ভাবনা! তার বয়স বাড়ে! বুঝতে পারে, সে নানাভাবে বুঝতে পারে, সে বয়স অনুযায়ী বেশী বুঝতে পারে। সে যখন এ-ভাবে ভাবে, তখনই কখনও দেখতে পায়, ছোটবাবু স্মোক-বকস পরিষ্কার করে পুপ-ডেকে ফিরে যাচ্ছে, কখনও দেখতে পায়, নীল রঙের পোশাক পরে বোট-ডেক পার হয়ে সোজা তরতর পরে ফানেলের গুঁড়িতে। তারপর সিঁড়ি ধরে স্টোক হোলডে নেমে যাচ্ছে। আবার কখনও সে দেখতে পায় পুপ-ডেকের রেলিঙে দাঁড়িয়ে চর্বি ভাজা রুটি খাচ্ছে, চা খাচ্ছে, আর অনবরত সমুদ্র দেখতে দেখতে কেমন তন্ময় হয়ে যাচ্ছে।

তখন কেন যে বনি জোরে না ডেকে পারে না–ছো….ট….বা….বু।

.

সেদিনও পোর্ট এলিজাবেথ বন্দর ছেড়ে যাবার মুখে বনি ডেকেছিল, ছোটবাবু এভাবে কোথায় ছুটে যাচ্ছ।

—সেকেন্ডের কাছে।

—কি ব্যাপার!

—মেয়ে। জাহাজে ওম্যান এসে গেছে।

—যাঃ

—হ্যাঁ। ওকে খবরটা দিতে হবে। বেচারা কাজের চাপে বন্দরে একবারও নামতে পারেনি। ফাঁক পেলেই বোট-ডেকে দাঁড়িয়ে দেখেছে। অথচ ৭ত কাছে বন্দর, বার বার দেখেও তার-আশ মেটেনি। খবরটা দিয়ে আসছি।

বনি লাল রঙের জাহাজী টুপি মাথায় পরেছে। পায়ে পরেছে কেড্স সাদা রঙের। চুল কাটা হয়নি অনেকদিন। চুল বড় হয়ে গেছে। চুল বড় হলেই ছোটবাবুর ইচ্ছে হয় আর একটু দাঁড়িয়ে থাকে জ্যাকের পাশে। জ্যাক সুন্দর একটা ডোরাকাটা পুল-ওভার পরেছে। পিছনে পকেট, সামনে পকেট, সবুজ রঙের প্যান্ট পরেছে। জ্যাকের কাছে এ শীতটা মনোরম। ছোটবাবুর কাছে শীতটা প্রচন্ড। সে সেকেন্ড-হ্যান্ড মার্কেট থেকে দুটো সস্তায় সোয়েটার কিনেছে, একটা ফুলহাতা, একটা হাতকাটা। সে লেদার জ্যাকেট কিনেছে একটা। মাথায় পরার জন্য উলের টুপি। একটা পুরোনো ওভারকোট কিনবে ভেবেছিল। কিন্তু মৈত্র বলেছে, বুনোসাইরিসে পুরোনো জিনিস খুব সস্তা। আর আমেরিকা অথবা ইউরোপের বন্দরে গেলে তো কথাই নেই। যা না হলে নয় এমন কিছু কিনে নিতে বলেছে।

জ্যাক ছোটবাবুর পোশাক দেখে হেসে ফেলল। ছোটবাবুর পুরোনো পোশাক তার ওপর যা যা কিনেছে, শীতের জন্য সব পরে ফেলেছে। ছোটবাবু পোশাকের ভেতর আটকে গেছে। হাতে দস্তানা। একটু শীতকাতুরে ছোটবাবু। পেছনে পড়ে থাকছে বন্দর। একেবারে সমুদ্রের গায়ে সিঁড়ির মতো ধাপে ধাপে পাহাড়। তার কোলে ঘর বাড়ি, লাল, নীল কাঠের বাড়ি। পাহাড়ের ওপরে ট্রেন লাইন, জাহাজ থেকে পাহাড়ের মাথায় রাতে বনি আর ছোটবাবু গাড়ির এনজিন ছুটে যেতে দেখেছে। কেমন ঘুরে ঘুরে অদৃশ্য হয়ে যায়, এনজিনের আলো। পাহাড়ের গাছপালার ভেতর একটা এমন আলোর বন্যা দেখতে ওদের অনেকক্ষণ ভাল লাগছিল। ওটা গাড়ির এনজিনের মতো মনে হয়েছে। আসলে ছোটবাবু জানে না ওটা কি!

এখন সকাল বলে, এবং শীতের মরসুমে সবাই জামাকাপড় সেঁটে বেশ হাহা হিহি করতে করতে এনজিন রুমে নেমে যাচ্ছে অথবা ডেকে জল মারছে অথবা ফলঞ্চা বেঁধে মাস্তুল রঙ করছে। ইন্ডিয়ানদের পোশাক একেবারে বেঢপ। ছোটবাবুকে কিছুতেই আর আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না। বনি বলল, ছোটবাবু যেভাবে তুমি ভাল্লুকের মতো ছুটছ—ঠিক উলটে পড়বে। একটু আস্তে যাও। ডেবিড অনেক মেয়ে দেখেছে, আলাদা করে তোমার না দেখালেও চলবে।

আসলে বনি ছোটবাবুর সব পছন্দ করে। কিন্তু যখন দূরবীনে মেয়ে খুঁজে বেড়ায় বন্দরে তখন কেমন ক্ষেপে যায় বনি। সে কখনও কখনও ছোটবাবুকে এ নিয়ে ছোট বড় কথা বলে ফেলে। ছোটবাবু জানে ক্যাপ্টেনের আদুরে ছেলে—তার সঙ্গে ভাব করে থাকাই ভাল। তাকে রাগালে জাহাজে থাকা চলে না। তাছাড়া বড়মানুষের ছেলেরা একটু বাঁদর গোছের হয়, সে দিক থেকে তো জ্যাক ভীষণ ভালো। কোনও অহংকার নেই মনে হয়। আবার যখন মনে হয় জ্যাক ভীষণ অহংকারী তখন সে আর বোট-ডেক দিয়ে নিচে নামে না। ওর নামতে ভয় হয়।

যেমন জ্যাক আর দাঁড়াল না। রাশভারি তার কথাবার্তা। গলার স্বর কিছুটা মেয়েলি। রাশভারি গলায় কথা বলতে চাইলে সেটা আরও বেশি মেয়েলি হয়। ছোটবাবু সেজন্য মাঝে মাঝে হেসে ফেলে। হেসে ফেললে জ্যাক আরও রেগে যায়। দুদিন তিনদিন তখন আর কথা বলে না। এ কদিনেই সে বুঝেছে, জ্যাক তাকে এ-জাহাজে নানাভাবে জ্বালাবে। এই যে সামনে পড়ে গেল, কেন যে বলতে যাওয়া, ওম্যান। না বললেই যেন ভাল ছিল, মেয়েদের কথা বলতে গেলে জ্যাকের চোখ মুখ কেমন হয়ে যায়। জ্যাক কি ওকে সাধুসন্ত বানিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। সে তো তা নয়। এভাবে সে শৈশবের কথা মনে করতে পারে—কবে কোথায় কে যেন প্রাচীন শ্যাওলাধরা একটা ইঁটের ঘরে তাকে নিয়ে কি করেছিল। সে সেই থেকে ভয় পায়। অবশ্য এখন সে আর তেমন ভয় পায় না। সে তো ডেবিডের সঙ্গে বের হয়ে ডারবানে শিস পর্যন্ত দিয়েছে। ডেবিড খুব খুশী সে জন্য।

এবং কেন যে এমন হয়, জ্যাক তাকে ভাল্লুক বলেছে। এখন শীতের রোদ ডেকে। জাহাজ সোজা এবার আটলান্টিকে পড়বে। তেত্রিশ ডিগ্রি বরাবর জাহাজ যাচ্ছে। শহর বন্দর ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে। ফানেলের ধোঁয়া সমুদ্রের জলে যেন এক মহামায়ার মতো, অথবা মনে হয় কেউ মোহিনী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই বিশ্বে এবং তার চুলের বাহার, উড়ছে অনবরত, সমুদ্রে, বাতাসে উড়ে যাচ্ছে।

ভাল্লুক কথাটা মোটামুটি খারাপ। এমন খারাপ কথা এই প্রথম বলেছে জ্যাক। ছোটবাবুর মনে হল, জ্যাকের সঙ্গে সে কোন সম্পর্কই রাখবে না। জ্যাক তো ওদের ফোকসালে আসে না। এলেও খুব কম। যেন না আসারই নিয়ম। রবিবারে সবাই যখন সাফাই দেখতে বের হয়, ঠিক তখনও জ্যাক বোট-ডেকে দাঁড়িয়ে থাকে।

তারপর মনে হল, ভাল্লুক কথাটা গালাগাল। ইংরেজিতে গালাগাল তেমন গায়ে লাগে না। একটা কথা অবশ্য ছেলেবেলা থেকেই সে শুনলে ক্ষেপে যায়। ব্লাডি কথাটা ওর কেন জানি সহ্য হয় না। সোয়াইন, বাস্টার, রাসকেল এসব কথা শালা শূয়োরের বাচ্চার মতো তত পাজি শব্দ নয়। সে ভাল্লুক কথাটাকে শালা শুয়োরের বাচ্চার মতো ভাবতে গিয়ে মুখ গোমড়া করে ফেলল। মুখ গোমড়া হলেই ভেতরে ভেতরে সে বেপরোয়া হয়ে যায়। সে তখন আর কিছু ভাবতে পারে না।

সে ফের ছুটতে থাকল। তা না হলে ডেবিড হুইল-ঘরে চলে যেতে পারে। সে অফিসারস গ্যালি পার হয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। তারপর দরজায় কড়া নাড়ল, সেকেন্ড সেকন্ড প্লিজ।

ডেবিড দরজা খুলে বলল, কি ব্যাপার?

—ওম্যান।

—কোথায়?

—এনজিন-রুমে।

–বলছ কি!

আর তখনই ছোটবাবু দেখল ওর প্রতিবিম্ব দর্পণে। একেবারে চেনা যাচ্ছে না তাকে। সে পোশাকের ভেতর হারিয়ে গেছে। শুধু মুখটা দেখা যাচ্ছে। মাংকি ক্যাপের জন্য সে কেমন ভুতুড়ে হয়ে গেছে। এমন মুখ এবং চেহারা হয় পোশাকের ভেতর আটকা পড়লে সে জানত না। বেশ মজা লাগছে দেখতে নিজেকে। সে নিজেই হেসে ফেলল, বলল, ছোটবাবু তুমি ভাল্লুক নও, একেবারে জাম্বুবান বলেই সে হাঁকল।—ওম্যান স্যার।

—ইয়েস স্যার ও–ম্যা…….ন।

ডেবিড ছুটছে, ছোটবাবু ছুটছে। ছোট চিৎকার করে বলছে, জাহাজে ওম্যান। ওরা ছুটে এসে এনজিন ঘরে ঢুকে গেল। আর চিৎকার করে বলতে থাকল ওম্যান। ওম্যান।

—কোথায়।

—আসুন না। দেখাচ্ছি। ওরা সিঁড়ি ধরে নিচে নেমে গেল।

জাহাজে তখন খবর রটে গেল, যেমন খবর রটে যায় মৈত্রমশাই যাবেন সাগরসঙ্গমে, এণ্ড জাহাজিদের কাছে সাগরসঙ্গম, না হলে সামান্য দুটো চড়াই পাখির পাশে দাঁড়িয়ে ছোটবাবু বলবে কেন, স্যার মিসেস স্পেরো।

—ইয়েস। ইয়েস।

—স্যার, মিঃ স্পেরো।

—ফাইন।

ছোটবাবু বলল, স্যার নেমে যাচ্ছি, দেখছি, কিচ-কিচ করছে। কে কিচ কিচ করে! ওমা দুটো পাখি। ওদের আমি জানি, এই যে ছাই রঙের দেখছেন এটা মিসেস স্পেরো, আর এই যে দেখছেন, গলার কাছে সাদা রঙ ওটা মিঃ স্পেরো।

তখন ডেবিড বলে উঠল, হ্যালো মিঃ এন্ড মিসেস হাউ ডু ইউ ডু।

—খুব ভালো আছে সেকেন্ড। ছোটবাবু কখন যে কি বলে! সেকেন্ড, স্যার, যখন যা খুশি। আসলে সে খুব অন্তরঙ্গ হয়ে গেলে—সেকেন্ড বলে ফেলে। যখন অফিসার ভেবে ফেলে, তখন স্যার। সে বলল, শীতে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিল, এনজিনের গরমে বেশ আছে এখন। দেখছেন না কেমন পাখা ঝাড়ছে। আবার আমাকে আপনাকে দেখছে ঘাড় বাঁকিয়ে।

—আমরা ওদের ডিস্টার্ব করছি না তো? সেকেন্ড বলল।

—না, না। দেখছেন না আমাদের ভয় পাচ্ছে না।

তারপর একে একে অনেকেই ছুটে এসেছিল। এসেই অবাক। দেখল মেজ-মালোম আর ছোটবাবু অতিকায় সার্কুলেটিঙ ফ্যানটার নিচে দাঁড়িয়ে আছে। তার নিচে মেন স্টিম-পাইপ, পাশে লম্বা রেলিঙ। রেলিঙে দুটো চড়ুই পাখি বসে পাখা ঝাড়ছে। উড়ছে। নাচছে গাইছে। মাঝে মাঝে কিচ কিচ করছে।

পাগল যেমন ছোট তেমনি মেজ-মালোম। পাগল না হলে দুটো পাখি নিয়ে এরকম একটা হৈ- চৈ বাধিয়ে দিতে পারে! আর তখন মৈত্র ‘পরি’তে ছোটকে খুঁজছে। ওরা সারেঙকে বলে আটটা বারোটা ওয়াচ চেয়ে নিয়েছে। এটা সাধারণত সারেঙের ওয়াচ, কিন্তু সারেঙ মৈত্রের কথা ভেবেই হোক অথবা ছোটবাবুর কথা ভেবেই হোক ওয়াচ বদলে নিয়েছেন। আটটা বেজে গেছে। মৈত্র দেখল, ছোট নামেনি। সকালের চারটা-আটটার পরীদারেরা উঠে যাচ্ছে। মৈত্র এসেই স্টিম দেখে নিয়েছে। এখন স্টিম তর-তর করে নেমে যাবে। ফার্ণেসের ছাই ঝেড়ে দিতে হবে। র‍্যাগ মারতে হবে। অমিয় চুপচাপ উইন্ড-সেলের নিচে বালতি হাতে দাঁড়িয়ে আছে, ওদিকে ছোটবাবুর দাঁড়িয়ে থাকার কথা। কিন্তু সে নেই। এ বেশ ঝামেলা। বেশ বাবুটি বের হয়ে কোথায় যে চলে গেল। কেউ তো দাঁড়িয়ে থাকবে না। আগয়ালারা তিনটে বয়লার থেকে একেবারে সোজা সব আগুন টেনে ফেলে দিচ্ছে, এবং পর পর সাত আট বেলচা কয়লা হাকড়ে বালব্ খুলে দিচ্ছে। পায়ের কাছে আগুন ধক্ ধক্ করে জুলছে। স্টোক-হোলড লাল হয়ে গেছে তাপে। কেউ নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। একা অমিয় জল মেরে আগুন আয়ত্তে আনতে পারছে না। মৈত্রকে ছোটাছুটি করতে হচ্ছে। সে এখন ছোটবাবুর হয়ে ক্রমান্বয়ে বালতি বালতি জল মেরে যাচ্ছে। ছাই টেনে জড় করছে। আর মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছে রাগে। কোথায় যে গেল! সে যেতেও পারছিল না। মোটামুটি সব ঠিকঠাক না করে স্টোক-হোলড ছেড়ে যেতে পারছে না। তাহলে স্টিম তর তর করে নেমে যাবে। স্টিম নেমে গেলে কেলেঙ্কারী। সে কোনরকমে মাথা ঠান্ডা রেখে যখন দেখল বেশ হাওয়ায় ফার্নেসের আগুন একবারে লাল, স্টিম- গেজের কাঁটা লাল দাগটা বরাবর থর থর করে কাঁপছে, তখনই সে দু-লাফে এঞ্জিনরুমে ঢুকে গেল। ছোটবাবুকে যেখান থেকে হোক ঘাড় ধরে নামাতে হবে। না হলে লজ্জা হবে না।

সে ওপরে উঠে অবাক। মেজ-মালোম আর ছোট দুই বন্ধুর মতো কথা বলছে। তিন নম্বর মিস্ত্রি নিচে দাঁড়িয়ে গজ গজ করছেন। হেল, এমন বলছেন। তিন নম্বর মিস্ত্রির কাছে টিন্ডালের বদনাম হবে। সে এটা দেখে আরও রেগে গিয়েছিল, কিন্তু কাছে গিয়ে মেজ-মালোমের সঙ্গে ওর এমন অন্তরঙ্গ কথাবার্তা শুনে আর ঘাড় ধরতে ইচ্ছে হল না। দুজন অসমবয়সী মানুষ জাহাজে এসে কেমন ছেলেমানুষ হয়ে গেছে।

মৈত্র ডাকল, ছোট।

ছোট পেছন ফিরে তাকিয়ে জিভ লম্বা করে দিল, একেবারে ভুলে গেছি। বলেই আর দাঁড়াল না। এক দৌড়ে সে ওপরে উঠে গেল, টুইন ডেক পার হয়ে গেল। কিনার অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শহর বন্দর দেখা যাচ্ছে না। সমুদ্র সামান্য ফের অশান্ত হয়ে উঠছে।

মৈত্র ওকে একটাও চড়া কথা শোনাতে পারল না। সে নেমে এসে বলল, এই অমিয় হাত লাগা।

—ছোটকে পেলি না?

—পেয়েছি।

—কি করছে?

—বাবু ওম্যান, আবিষ্কার করে মেজ-মালোমের সঙ্গে ওম্যান সম্পর্কে একটা বড় লেকচার দিচ্ছে। স্টোক-হোলড, খোলের সব চেয়ে নিচুতে বলে, ওপরে কি ঘটে, খবর রাখা ঠিক হয়ে ওঠে না। এখন এই যে এত বড় একটা খবর জাহাজে রটে গেল, অমিয় তার বিন্দুবিসর্গ জানে না। সে কেমন অবাক হয়ে বলল, মৈত্র, বলিস্ কি!

—ঠিকই বলছি, ওম্যান!

—তার মানে মেয়েছেলে!

—হ্যাঁরে বাবা, ওম্যানের বাংলা মানে মেয়েছেলে, শালা তোর বাবাতো তোকে ইংরেজি স্কুলে পড়িয়েছিল রে। সাহেব করার ইচ্ছা ছিল, তা এখন ওম্যানের বাংলা মানেটা গুলিয়ে ফেলছ! কয়লায়ালা আর কাকে বলে!

—সত্যি বলছিস?

—মিথ্যা বলতে যাব কেন।

–কে ধরে এনেছে?

—কেউ না। নিজেই জাহাজে উঠে এসেছে।

—কোথায় নেমে যাবে?

—সে জানি না।

—মাইরি। আমি মরে যাব মৈত্র। বল, সব খুলে।

আগয়ালারা এসে জড় হয়েছে। মৈত্র ওদের সঙ্গে একটু রাশভারি কথাবার্তা বলে থাকে। এই যে মিঞারা কাম কর, খাড়ইয়া থাইক না। স্টিমের অবস্থা ভাল না। ওরা স্টিম দেখতে সরে গেলে মৈত্র বলল, চালা, হাত চালা। সে অমিয়র কথারও জবাব দিল না। এ্যাস রিজেক্টারে সে বেলচে মেরে ছাই তুলতে থাকল।

এবং তখনই দেখা গেল ছোটবাবু নেমে আসছে। নীল পোশাক সে পরেছে। যা পরে সে পরি দেয়, সেই পোশাক। মাথায় নীল রঙের টুপি। নিচে নেমে একটু যেন লজ্জায় পড়ে গেল। বেলচেটা নিতে গেলে মৈত্র বলল, যা, ওপরে যা। অমিয়, তুইও উঠে যা। কয়লা যা খাচ্ছে।

বাকি কাজটা মৈত্র করবে। আগয়ালাদের নিয়ে সে ফাঁকে ফাঁকে হাতে হাতে কাজটা সেরে ফেলবে। আগয়ালারা এটা করে থাকে। কারণ মৈত্রর মুখের ওপর তারা কথা বলতে পারে না। আগে কয়লায়ালাদের কাজ ছিল, সব কাজ কামের পর তাদের চানের জল তোলা। এবারে সারেঙসাব তাও বন্ধ করে দিয়েছেন। এ ভাবে কয়লায়ালারা বেশ মজা পেয়ে যাচ্ছে। ওরা মৈত্রের সামনে কিছু না বললেও নিজেরা ভেতরে ভেতরে সমালোচনা করতে ছাড়ছে না। কখনও কখনও এটা যে সারেঙসাবের কানে না গেছে এমন না। তিনি তখন বলেছেন, কেন করবে? তোমাদের চানের জল কয়লায়ালারা কেন গরম করবে। আগে করত, তোমরা ওদের বয়লারে কয়লা মারা শেখাতে, অসুখে বিসুখে অথবা কেউ কোন বন্দরে, নেমে গেলে, কাজের লোক হয়ে যেত কয়লায়ালা। বাড়িয়ালা খুশি হয়ে লিখে দিতেন সফরে কে কি কাজ করেছে। এখন তো বাপজানেরা তা আর হচ্ছে না। একটা সফর সেরে যেতে পারলেই আগয়ালা। তারপর কাজ দেখানোর পালা। সেটা তোমাদের হাতে না, সেটা সাহেবদের হাতে।

সুতরাং আর এ-নিয়ে বাড়াবাড়ি হয়নি। অমিয় বেলচে কাঁধে ওর, বাংকারে চলে যাচ্ছে। উঠে যাবার সময় সে লারে, লা লা বলে গান গাইছিল। অমিয়র চুল খাটো করে ছেঁটে দিয়েছে মৈত্র। চুল কাঁটার লোক না থাকলে যা হয়, মৈত্র ওদের চুল ছেঁটে দেয়। থ্যাবড়া ছাঁট। অমিয় মাথায় হাত দিয়ে মাঝে মাঝে বলতে ছাড়ে না, শালা চুল কাটতে কাটতে বউএর কথা ঠিক ভাবছিল।—দ্যাখ চুলটা পেছনে কি করে দিয়েছে!

ছোটবাবু দেখল, সত্যি চুলটার ভীষণ বাজে ছাঁট হয়েছে। এ-নিয়ে অমিয় তিন চারবার বলেছে। এখন বলছে, এজন্য যে, সে ছোটর কাছে কিছু জানতে চায়। সে বলল, ছোটবাবু কে এসেছে রে জাহাজে।

—কে আসবে!

—খুব র‍্যালা মারছিস!

—র‍্যালা মানে।

—ঐ খুব মেয়েছেলে নিয়ে ড ডট্। আমার যে কি হবে না! মাথার চুলটা এমন বাজে হেঁটে দিল। কে জানত বল, জাহাজে মেয়েছেলে উঠে আসবে। তারপর একটু থেমে বলল, কোথায় যাবে, সেন্টিস, মন্টিভিডিও না বুনোসাইরিস!

ছোটবাবু হেসে দিল। ধুস্, তুই যে কি না! তোকে কে বলেছে জাহাজে মেয়েছেলে প্যাসেঞ্জার যাচ্ছে! কেপটাউনে গেলে তবু হয়তো দেখা যেত মেয়েটেয়ে, পোর্ট এলিজাবেথ থেকে কে আর উঠবে! আমাদের নসিব খারাপ, জাহাজ সোজা আটলান্টিকে পড়ছে।

এদিকে তখন সুট থেকে গড় গড় করে কয়লা আগয়ালারা টেনে নিচ্ছে তো নিচ্ছেই। মৈত্র খেয়াল করছে না। মাথার ওপরে বাবুরা দাঁড়িয়ে গল্প করছে। সে এ্যাস-রিজেকটারে ছাই ফেলে দিচ্ছে। হঠাৎ মনে হল, ঠিক মাথার ওপর প্রায় ফুট বিশেক উঁচুতে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে গল্প করছে তারা। এবার সে চিৎকার না করে পারল না, এই হারামজাদা, রাসকেল, তোরা ভেবেছিস কি! আর সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল সব ফাঁকা। সঙ্গে সঙ্গে দুটো ছায়া দু’দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

মৈত্র ওপরে মুখ তুলে তখনও চিৎকার করে যাচ্ছে, আমি কিছু করতে পারব না। ভেবেছিসটা কি! সুট ভরতে না পারলে, ওয়াচের পর খেটে যেতে হবে। রোজ রোজ আমি পারব না। পরির বদনাম তোমাদের জন্য কেন নেব!

ছোটবাবু ঢুকে দেখল, কয়লা একেবারে অতলে। সে লম্ফটা হাতে নিয়ে সুটের পাশে দাঁড়াল। চারপাশটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঠিক খাদের নিচে, মানুষ একা অন্ধকারে লম্ফ হাতে দাঁড়ালে যেমন দেখায়, তেমনি ভুতুড়ে। সে আর দাঁড়াল না। ডারবান থেকেও কিছু কয়লা নেওয়া হয়েছে। টুইন-ডেকের দু’দিকে কয়লার ডাই। এখন এক নাগাড়ে চব্বিশ-পঁচিশ দিন সমুদ্রে ভেসে যেতে হবে। যত ওরা দক্ষিণে নেমে যাবে তত শীত বাড়বে। ডেকের কয়লা মাঝ দরিয়ায় না গেলে ফেলা হবে না হয়তো নিচে। সে এবার বুঝতে পারল ঠিক এক নাগাড়ে ঘন্টা চারেকের মতো কয়লা ফেলতে না পারলে সুট সে ভরতে পারবে না।

এবং এ-ভাবে এক সংগ্রামের মতো, কখনও কখনও ভয়ে রাতে ঘুম আসে না, সকাল হলেই ওয়াচ, অথবা রাত আটটা বাজলেই ওয়াচ। বাংকে শুয়ে থাকলেও মনে হয়, কেউ যেন অনেক দূরে হেঁকে যাচ্ছে, যোয়ানলোগ টান্টু। এই এক শব্দ, অনেকটা টেনি টরেন্টো শব্দের মতো। গর্ভিনী তিমি শিকার করে ফেরার সময়, সমুদ্রে এমন একটা শব্দ শিকারীরা শুনতে পায়। গর্ভিনী তিমিরা কত যে অবলীলায় ভেসে ভেসে বেড়ায় সমুদ্রে। ছোটবাবুও বাংকে শুয়ে থাকলে এমন সব শব্দ শুনতে পায়। বুক তার ধুকপুক করতে থাকে সে নিজের এই আতঙ্কের কথা কাউকে বলে না। যেন গ্রাহ্য করছে না, সে অন্য সবার মতো কাজ করতে পারছে এটা প্রমাণের জন্য আর এক মুহূর্ত নষ্ট করল না। দরজার কাছে সে লম্ফটা রেখে এল। মেডিসিন কারটা সে ঠেলে নিয়ে গেল সামনে। সুট থেকে কয়লা দূরে সরে যাচ্ছে ক্রমশ। সে নুয়ে দ্রুত বেলচা দিয়ে গাড়ি ভরে ফেলল। তারপর দু হাতে সামনে ঠেলে দিল গাড়িটা। এখন আর ভারি গাড়িটা মাঝে মাঝে কাত হয়ে পড়ে যায় না। সে ঠিক ঠিক সুটের মুখের কাছে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে, ঢেলে দিতে পারে, সে গাড়ি টানছে, কয়লা তুলছে, সুটে এনে ফেলছে। লম্ফটা দপ দপ করে জ্বলছে, আবার কখনও ঘন অন্ধকার, ওকে ছায়ার মতো মনে হয় তখন। সে ঘেমে নেয়ে যাচ্ছে। ওর জামা প্যান্ট ভিজে গেছে।

বাংকারে বুটের শব্দ, ঝম ঝম কয়লা ভরার শব্দ, থপ থপ করে হেঁটে যাবার শব্দ, গড় গড় করে কয়লা সুটে ফেলে দেবার শব্দ। এ-ভাবে সব নানা রকমের অতিকায় শব্দ ক্রমে গড়াগড়ি খেতে থাকলে, একসময় মৈত্র এসে দেখল, ছোট এক মুহূর্ত বিশ্রাম নিচ্ছে না। মৈত্র বলল, আমি ভরছি, তুই ফেল।

—না, তুমি যাও। আমি ঠিক পারব।

—ওয়াচের লোকেরা নেমে গেছে।

—আর ক’গাড়ি ফেললেই হয়ে যাবে। তুমি চলে যাও। পেটে আগুন জ্বলছে। খেতে বসে দেরী করতে পারব না।

অমিয় এবং মৈত্র উঠে গেল। ছোটবাবু এখানেই ছোটবাবু। সে কারও সাহায্য না নিয়ে কখনও কখনও খুবই যে সে দায়িত্বশীল বুঝিয়ে দিতে চায়।

মৈত্র এবং অমিয় সিঁড়িতে পা রাখার সময় শুনল, অনেকটা হিসাব রাখার মত, ছোটবাবু গাড়ি টেনে নিচ্ছে, আর হরে রাম বলছে, এক, দুই হরে রাম, হরে হরে এক দুই, গাড়ি ফেলে দিলে তিন, চার পাঁচ এবং শেষে একসময় যখন দেখল কয়লায় ভরে উঠছে সুটের মুখ সে একেবারে ছাদের দিকে বেলচে ছুঁড়ে দিয়ে, গাড়িটা কয়লার কাছে লাথি মেরে উল্টে সোজা দৌড়ে বোট-ডেক পার হয়ে গেল।

আসলে রোজ রোজ সে এভাবেই কাজের শেষে যেন কিছু আবিষ্কারের মতো চিৎকার করে ওঠে, সাবাস ছোটবাবু, সুট ভরে মাথা কিনে নিলে!

কারণ কাজটা তার কাছে প্রায় দুর্গম গিরি প্রান্তর পার হয়ে যাওয়ার মতো। সে রোজ রোজ এভাবে ভরে ফেলে সাংঘাতিক কিছু করে যাচ্ছে। সে জীবনের কাছে হেরে যাচ্ছে না। যত এমন ভাবে, তত বেঁচে থাকার আকাঙ্খা বাড়ে। সে ভাল করে স্নান করে। সে ওয়াচের জামা প্যান্ট পাল্টে বাথরুমে একেবারে উলঙ্গ হয়ে যায় এবং গরম জল ঢেলে সে যখন স্নান করে তখন মুখে শরীরে সাবানের ফেনা। সারা শরীরে অজস্র সাবানের ফেনা এবং বুদবুদ, সে মাঝে মাঝে হাত পা ঘসতে ঘসতে টের পায়, পেশী শক্ত হয়ে যাচ্ছে, সমুদ্রের বাতাসে শরীরের রঙ ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে যাচ্ছে। জল ঢেলে দিলে শরীরে বিন্দু বিন্দু ফোঁটা সারা শরীরে আর শরীরময় আকাঙ্খা। সে চুপচাপ তখন কেমন শুধু দাঁড়িয়ে থাকে। তার কিছু ভাল লাগে না তখন। মার চিঠি এল না, কেউ তাকে চিঠি দেয় না। সে নিরুদ্দেশে, সবাই হয়তো ভেবেছে, ছেলেটা বেঁচে নেই।

তখন অমিয় ডাকল, কিরে কতক্ষণ ধরে চান করছিস। তোর ক্ষিদে পায় না?

সে সত্যি খুব ক্ষুধার্ত। সে এক মুহূর্ত আর দেরি করতে পারল না। এতক্ষণ যে শরীর অবশ অবশ মনে হচ্ছিল, সে যেন জোর করে তা অস্বীকার করতে চেয়েছে। সে আর দেরি করতে পারছে না। পাজামা পরে নিল। জামা, গরম পুল-ওভার পরে সে সোজা মেসরুমে ঢুকে বলল, দে।

টেবিলে যে যার মতো খাচ্ছে। কেউ নিচে বসে খাচ্ছে, কেউ টেবিলে বসে খাচ্ছে। বড় টিনের ভেতর ডাল। কাঠের হাতা, ডেকচিতে ভাত। ডাল যে যার মতো তুলে নিচ্ছে। ‘বিশু’র সবাই গোল হয়ে বসে গেছে খেতে। যাদের খাওয়া হয়ে গেছে তারা এখন ডেকে মাদুর পেতে নামাজ পড়ার আগে দাঁত খুঁটছে। রুপোর খড়কে। গলায় ঝুলানো। ছোটবাবু এসব কিছুই দেখছিল না। সে আসলে মুখ বুজে খাচ্ছে। আলুভাজা, ডাল, মাংস হয়নি। মটন হলে সে খায়, না হলে খায় না। বাঁধাকপির সঙ্গে মাংসের ছোট ছোট টুকরো দিয়ে বেশ একটা সুস্বাদু খাবার ভান্ডারি তৈরি করেছে। খেতে ভাল হয়েছে বলে সে গলা পর্যন্ত খেয়ে যাচ্ছে। আর মাঝে মাঝে অমিয়, মৈত্র দেখছে, ছোটবাবুকে। কিছু বলছে না। বেশ খেয়ে গেল ছোটবাবু। খাওয়া হলে মৈত্র বললে, বাঁধাকপি দিয়ে গোস্ত হয়েছে। কেমন লাগল রে?

—খুব ভাল হয়েছে। ভান্ডারি জ্যাঠা বেশ রেঁধেছে। জ্যাঠার হাত যা খোলে মাঝে মাঝে! ভান্ডারি তখন গ্যালি থেকে গলা বের করে হঠাৎ জিভে কামড় দিয়ে ফেলেছে।—তুমি খাইলা জ্যাঠা!

—হ খাইলাম। ভান্ডারি বুড়ো মানুষ, রোগা রোঁয়া রোঁয়া চুল মাথায়। তাকে খেতে শুনে এমন জিভ বের করে দিয়েছে কেন সে তার কিছুই বুঝতে পারল না।

সে বলল, না খাইলে পারতা।

—ক্যান এমন কথা কন!

ভান্ডারি কিছু না বললেও সে বুঝতে পারল, সে আজ বিফ খেয়েছে। সে তো কিছু বোঝেনি, সে তো বুঝতে পারেনি, বিফ কি মটন! তা ছাড়া ইদানিং ওদের জন্য ভান্ডারী আলাদা মটন বাটলারের কাছ থেকে বলে কয়ে নিত। কিন্তু আজকে নানা কারণে এটা হয়তো সম্ভব হয়নি। ভান্ডারিকে চারপাশ সামলাতে হয়। সব কিছু এক হাতে করতে হয় মানুষটাকে। খেয়াল না থাকার কথাই! তা ছাড়া ওর তো কিছু হচ্ছে না, বমি হচ্ছে না, না বমি একেবারেই পাচ্ছে না। তবে কি এটা জুজুর ভয়! সে যেন কেমন সাংঘাতিকভাবে বলে ফেলল, খেতে তো জ্যাঠা খারাপ লাগল না। বেশ লাগে খেতে।

মৈত্র বলল, সহসা চিৎকার করে বলল, থ্রি চিয়ার্স ফর ছোটবাবু।

ছোট উঠে পড়ল। তবু মনের ভেতর এক আশ্চর্য অহমিকা আছে, কিংবা দীর্ঘ দিনের সংস্কার, সে একেবারে তার সবকিছু উড়িয়ে দিতে পারে না। যত এমন ভাবছে, মনে হচ্ছে, না এটা ঠিক না, কাল আবার হয়তো আগে জানতে পারলে গা ঘিন ঘিন করবে। সে ভাবল, আর কখনও মাংসের ব্যাপারে কোন কথাবার্তা বলবে না। যেমন সবাই খায় মুখ বুজে খেয়ে উঠবে।

তখন ভদ্রা জাহাজের স্মৃতি তাকে কেন যে তাড়া করে—কে যেন ডেকের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, আর কে যেন বলছে, বিফ খানে সাক্‌তা! তোমকো বিফ্ জরুর খানে হোগা।

গোটা ব্যাপারটা তার কাছে এখন হাস্যকর। এমন সুন্দর দিন যেন হয় না। জাহাজ এখন কোথায়? বোধহয় ভারতবর্ষের শেষ সংযোগটুকু আজ মুছে যাবে। কথা আছে জাহাজ দুটোর ভেতর আটলান্টিকে পড়বে। ঠিক সময়টা কেউ জানে না। আবার আটটায় ওয়াচ। এখন আর গিয়ে ফোসকালে চিৎপাত হয়ে শুয়ে লাভ নেই। সেই যে দূরবর্তী এক উপকূলে তার বাসভূমি ফেলে এসেছে, সেই যে ক্ৰমান্বয়ে জাহাজের প্রপেলার কেবল ঘুরতে থাকল, সেই যে সে দিনরাত জাহাজ ডেকে পায়চারি করতে করতে দেখল, সমুদ্র উত্তাল, ভয়াবহ, ওর শেষ বাসভূমির গাছপালা ছায়া ছায়া হয়ে যাচ্ছে, ক্রমে সেটা মেঘের মতো দিগন্ত রেখায়, তারপর মিশে গেছে আকাশের সঙ্গে, তারপর সেই অসীম যাত্রা, সমুদ্রে সমুদ্রে ওরা ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে চলেছে, আজ ওরা শেষবারের মতো তাও পার হয়ে যাবে। সে এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে। নিচে এখন নামবে না। ডেকের ওপর দাঁড়িয়ে থাকবে শুধু। দাঁড়িয়ে থাকতে তার ভাল লাগবে। রেলিঙে দাঁড়িয়ে মেজ-মালোমকে ডেকে বলবে, স্যার বলবেন, কখন জাহাজ আটলান্টিকে পড়ছে।

সে এ-ভাবে যখন দাঁড়িয়েছিল, কেমন যেন একাকী, নিঃসঙ্গ। সে শীতের জন্য বেশ গরম পোশাক, পোশাক বলতে পুরোনো বাজার থেকে কেনা পোশাক। সে তাই সাদা প্যান্টের ওপর পরেছে। ঘন চুল সমুদ্রের হাওয়ায় নীল দেখাচ্ছে। আকাশ পরিচ্ছন্ন। তবু সমুদ্রে বেশ ঢেউ আছে। সে সোজা দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। জাহাজে সামান্য পিচিং, সে এখন আর এ-সব আমল দেয় না। এই পিচিং তার ভাল লাগে। ওর কেমন তখন চোখে ঘুম জড়িয়ে আসে। দূরে, দিগন্তরেখায় সব পাখিরা যায়, কোথায় যে যায়, উড়ে উড়ে কোন মহাসমুদ্রে যায় সে জানে না। সে তখন কেবল ওদের অবাক হয়ে দেখে।

মৈত্র ফোসকালে ছোটবাবুকে দেখতে না পেয়ে ওপরে উঠে এল। ওপরে উঠে দেখল, টুইনডেকে রেলিঙে দাঁড়িয়ে ছোটবাবু সমুদ্র দেখছে। ওর মনে হল বিফ খেয়ে বোধ হয় ছোটবাবুর মন ভাল নেই। কাছে গিয়ে সে দাঁড়াল। কিছু বলতে প্রথমে সে সংকোচ করল। তারপর যেন আর না বলে পারল না। কিরে বিফ খেয়েছিস বলে মন খারাপ!

তখন মেজ-মালোম, ডেবিড চিৎকার করে ছোটকে বলচে, সামনে আটলান্টিক ছোট। ভালো করে দ্যাখো। আটলান্টিক কি বিশাল, মহান সমুদ্র। দ্যাখো। দেখলে তোমার আর দুঃখ থাকবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *