1 of 2

অলৌকিক জলযান – ৫

।। পাঁচ।।

ঠিক এ-সময়ে জাহাজে নানা জায়গায় নানা কাজ। যেমন, মৈত্র বৌকে চিঠি লিখছে, শেফালি আমরা কলম্বো বন্দরে আজ পৌঁছেছি। কাল আবার নোঙর তুলব। জাহাজে রসদ উঠলেই আমাদের কাজ শেষ। এখানে আশা করেছিলাম তোমার চিঠি পাব, কিন্তু কেন যে পেলাম না। চিঠি না পেলে ভীষণ খারাপ লাগে। ভাল লাগে না। আমরা লরেঞ্জু-মরকুইসে যাচ্ছি। ঠিকানা দেওয়া থাকল। গিয়ে যেন তোমার অন্ততঃ তিনটে চারটে…..তুমি তো বলতে, রোজ একটা করে আমাকে চিঠি লিখবে। কেন যে তুমি চিঠি লেখ না। কি করে যে চিঠি না লিখে থাকতে পার। তারপরই মৈত্র সেই এক কথায় চিঠি শেষ করবে—আমার ভাল লাগে না শেফালি। তোমাকে ছেড়ে আমার কোথাও থাকতে ভাল লাগে না।

রাত বাড়ছে। সকালে এজেন্ট অফিসের লোক আসবে। যে যার চিঠি ফোকসালে লিখতে বসে গেছে। ছোটবাবুর কাছে লাইন দিয়েছে কেউ কেউ। ছোট-টিণ্ডাল দুবার ঘুরে গেছে। এখনও বেশ ভিড়। ভিড় না কমলে সে ঠিক ঠিক লেখাতে পারবে না। চিঠি লেখার সময় কেউ পাশে থাকুক সে চায় না। ছোট-টিণ্ডাল বাদশা মিঞার কপালে সেজন্য ঘাম। তাকে খুব উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। সে চিঠি এখন লিখিয়ে না রাখাতে পারলে সকালে আর সময় পাবে না। দরজার গোড়ায় খুব ভালো মানুষের মতো সে দাঁড়িয়ে আছে এখন।

সবার হলে ছোটবাবু ডাকল, আসুন চাচা।

বাদশা মিঞা ওকে হাতের ইসারায় ডাকল। ছোট বলল, কি ব্যাপার!

—আস না!

সে, ছোট-টিণ্ডালের পিছু পিছু উঠে গেল। টিণ্ডাল, ফোকসালে ঢুকে বলল, দরজাটা বন্ধ কইরা দেই।

ছোটবাবু বলল, কেন? দরজা বন্ধ করার কি আছে।

—তোমারে কই নাই, একটা কথা কমু, কেউ জানে না। তুমি জানবা কেবল। আমার বিবির কাছে একটা খত লিখা দেও।

—সেটা তো সবাই জানে।

–কেডা জানে?

—সবাই জানে চাচা। আমি তো জানি, জাহাজে উঠেই জানি, তুমি তোমার চার নম্বর বিবির কাছে খতটত লেখাতে চাও।

—এডা মনু মিঞার কাজ।

—মনু কেন হবে!

—না, ওডা আমার দ্যাশের লোক।

—মনু বলে নি।

—তবে কেডা কইছে কও। তারে একবার মোকাবেলা করি।

—সে যেই বলুক। এতে লজ্জার কি আছে।

—নারে বাজান, জাহাজে তুমি মানুষ চিন না। শালারা সব ইবলিশের বাচ্চা। কথা নাই বার্তা নাই, পিছনে লাগে।

—কেউ লাগবে না।

—তা তোমার শরীরডা ভাল না। দু’লাইনে লিখা দ্যাও। ভাল আছি। ডারবানের ঘাটে, বড় কইরা একটা খত লিখা দিয়। বিবির বড় খত না পাইলে মন ভরে না। আর শোন তুমি লিখা দিয়, তোমার শরীরটা ভাল না বইলা বেশি কিছু লিখতে পারলাম না।

ছোটবাবু হেসে বলল, ঠিক আছে লিখে দেব। এবং খুব সংগোপনে প্রায় ফিস ফিস গলায় অজস্র কথা বলে গেল ছোট-টিণ্ডাল। মৈত্রকে ছোট-টিণ্ডাল ভীষণ ভয় পায়। এখনই হয়ত মৈত্র এসে ছোটবাবুকে ডেকে নিয়ে যাবে। এবং ধমক দেবে, তোমার আক্কেল নেই মিঞা। একটা অসুস্থ মানুষকে নিয়ে তুমি টানাটানি করছ।

ছোটবাবু তাড়াতাড়ি খতটা লিখে দিতেই ছোট-টিণ্ডাল দাঁত বের করে হাসল। ছোটবাবু দেখল, দু’পাশের চার-চারটা দাঁত ওর সোনায় বাঁধানো। হাঁ করলে জিভটা বের হয়ে আসে। ওর মুখে নানা রকমের দাগ। এবং দেখলে বোঝাই যায়, সমুদ্রে সে ঘুরে ঘুরে নোনা জলের স্বাদ ঠিক ধরতে পেরেছে। সে একটার পর একটা নিকা করেছে। সে কাউকে তাড়ায় নি। সে চিঠিতে সবার খবর নিয়েছে।

বাদশা মিঞাকে ছোটবাবুর খারাপ লাগল না। ছোটখাট মানুষ। চল খুব ছোট করে ছাঁটা। দাড়ি নেই, গোঁফ নেই। বোধ হয় এটা ওর এ-বয়েসেও ওঠে নি। বয়স ষাটের ওপর হবে। নলিতেও কারচুপি—বয়স কমিয়ে রেখেছে। সমুদ্রের ঝড়ে-জলে মানুষটা ভীষণ দক্ষ। ওর চার নম্বর বিবির বয়স খুব যে কম এবং প্রায় বালিকা, এটা চিঠির সব কথাবার্তা থেকে ছোটবাবু ধরে ফেলেছে। সে বলল, চার নম্বর চাচি আপনাকে খুব ভালোবাসে?

বাদশা মিঞা কেমন ছেলেমানুষের মতো মুখ নীচু করে রাখল। যেন এটা বলে ছোটবাবু ওকে ভীষণ লজ্জা দিচ্ছে। ভালবাসার কথা মুখে বলে ছোট করতে চায় না বিবিকে।

ছোটবাবু বলল, আমি ঠিক লিখে দেব। আপনার কোন ভাবনা নেই। এবং এই বলে সে বের হয়ে এসেই দেখল, ফোকসালে অমিয় নেই। কোথাও সে পালিয়ে সেই ছবিগুলো বোধ হয় দেখছে। এ সব ছবি কোথায় যে পাওয়া যায় ছোটবাবু জানে না। বীভৎস সব ছবি যোগাড় করেছে বন্ধু। সে একবার অমিয়কে দেখাবে বলে এসেও ছিল। ছোটবাবু কাছে ছিল বলে অমিয় আমতা আমতা করেছে। এবং যখন গিয়ে দেখল, অমিয় নেই তখন সে ঠিক ভেবে নিল, বন্ধু ওকে নিয়ে গেছে। ওরা একসঙ্গে লুকিয়ে সেই সব ছবি দেখছে। উলঙ্গ এবং নগ্ন সেই সব ছবির ভেতর অমিয় বেশ আছে। ছোটবাবু ফোকসালে ঢুকে এবার শুয়ে পড়ল। মৈত্র বলল, এলি।

ছোটবাবু বলল, হ্যাঁ।

—কি লিখাল রে বাদশা মিঞা।

—জাহাজের খবর-টবর দিল।

—ওর চার নম্বর বিবির কথা তোকে কিছু বলে নি!

—বলেছে। ওকেই তো চিঠি।

–তোকে বলে নি, কাউকে বলবে না।

—তা বলেছে।

—ওর এই কারবার। সবাইকে বলবে। এখন ওর দুটো কাজ এমন বলবে। একটা কাজ বড় বেটার সাদি, দু নম্বর কাজ, চার নম্বর বিবির পেটে একটা বাচ্চা—এই হলে তার হয়ে গেল।

—সে আর কিছু চায় না!

—না। বলেই বলবে, কাউকে বলবে না, অথচ ও নিজেই বলে বেড়ায়।

—এমন স্বভাব কেন!

—ওর ধারণা, এই বয়সে চার নম্বর বিবি ঘরে এনে একজন সাচ্চা মরদের মতো কাজ করে ফেলেছে। সেটা ও জাহির করতে চায়।

—কিন্তু আমাকে যে বলল, জাহাজের সব শালা ইবলিশের বাচ্চা।

—ও ওমনি বলে। আসলে একটা আস্ত শয়তান। না হলে কেউ এমন বয়সে তার নাতনির বয়সী একটা মেয়েকে সাদি করতে পারে!

ছোটবাবুর হাই উঠছিল। ওর ঘুম পাচ্ছে। জলের ছলাত ছলাত শব্দ আসছে। জলের ঢেউ মাঝে মাঝে ধাক্কা মারছে বলে হালটা নড়ছে। এবং সেজন্য স্টিয়ারিং এনজিনের শব্দ আসছে। পাশাপাশি ফোকশালগুলোতে জাহাজিরা গল্প করছে। সবই দেশ-বাড়ির গল্প। মাছের গল্প। কেউ কেউ সময় পেয়ে গল্প করতে করতে জাল বুনছে। কেউ হয়তো এখন ওপরে কোরান শরিফের ব্যাখ্যা শুনছে, অথবা ইমানদার মানুষ হবার জন্য এ-সফরে কোরান শরিফ পড়াটা রপ্ত করে ফেলা ভাল। সময় পেলেই মাদুর বিছিয়ে ডেক-সারেঙের সামনে তারা বসে থাকছে।

তখনই ছোটবাবুর মনে হল, মাকে সে একটা চিঠি লিখতে পারে। সে সবার মতো লিখল না, আমার ভাল লাগছে না, কবে যে দেশে ফিরব জানি না। সে লিখল, মা আমি ভালো আছি। আমার টাকা হয়তো পেয়েছ। ভাইদের পড়া বন্ধ করে দিও না। জ্যাঠিমাকে বলবে যেন আমার জন্য চিন্তা না করে। বড়দা মেজদার খবর দিও। আমি মা যাচ্ছি দক্ষিণ আমেরিকা। কলম্বো থেকে জাহাজ কাল ছাড়ছে। কত বড় সমুদ্র মা, কত বড়, সমুদ্রে না এলে বোঝা যায় না। বাবা করে বাড়ি এসেছিল জানিও। জ্যাঠামশাইর জন্য খুব খারাপ লাগে মা। জ্যাঠামশাইর শরীর কেমন আছে জানিও। জাহাজে আমার মৈত্রদা আছে। অমিয়, বন্ধু, সারেঙসাব, মেজ-মালোম সবাই আমাকে খুব ভালবাসে। আমার জন্য তুমি একেবারে চিন্তা করবে না। সফর শেষে যখন ফিরব ওঃ কি যে ভাল লাগবে না। শেষ করল এই বলে, মা আমি এখন জাহাজি।

এ-ভাবেই জাহাজে জাহাজিরা চিঠি লিখে থাকে। সকালের দিকে নৌকায় সব কাঠের হাতি, ময়ূরের পালখ কিনার থেকে এল। মৈত্র ভেবেছিল নেবে, কিন্তু সে যে একটা সঙ্গে ভীষণ দরকারী জিনিস নিয়ে যাচ্ছে। এটা সে জাহাজে উঠলেই লুকিয়ে নিয়ে যায়। এবারও গোপনে নিয়েছে। কাঠের হাতি, ময়ূরের পালখ নিয়ে কি আর হবে! সে কিছু নিল না। অন্য জাহাজিরা সব নিতে গিয়ে দেখল, রসদ আসছে। রসদ উঠছে জাহাজ-ডেকে। মেজ-মালোম ছুটোছুটি করছে। ঠিক রোজকার ঘটনা, অর্থাৎ ডেক- টিণ্ডাল যাচ্ছে আগিলে। কশপ যাচ্ছে, হাতে রঙের টব নিয়ে। বন্ধুর কি কাজ জানে না। সে মেসরুমে বসে রঙের টব ঢোলের মতো বাজাচ্ছে।

আর গান গাইছে অমিয়। যেন এখন ওদের এই জাহাজে এ-সব ঘটনা রোজ ঘটবে। নামাজ পড়ছে দু’নম্বর ‘পরী’র মানুষেরা। ওরা সকালে চাপাটি খেয়েই নামাজ পড়তে বসে গেছে।

তখন দেখা যাবে নেমে আসছে জ্যাক। সে এদিকে পাখিগুলোর খাঁচায় মাংস দিয়ে যাচ্ছে। রসদ তোলা হলে, মেজ-মালোম বোট-ডেকে সেই দুরবীন চোখে বসে গেল। তারপর জাহাজ ছাড়লে এক নিত্য দিনের ঘটনা! কবেতক যে আবার জাহাজ বন্দর পাবে কেউ জানে না। জাহাজ সমুদ্রে চলছে তো চলছেই।

তখন জাহাজ গভীর সমুদ্রে। দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। মৈত্র ওয়াচ শেষ করে ফিরেছে। অমিয় এসে চুপি চুপি ওর লকারে কি যেন রাখছে। আজকাল অমিয়র এটা হয়েছে। সে সবার সামনে লকার খোলে না। কিন্তু রবিবার ইন্সপেকসনের দিন থাকে। কাপ্তান, মেজ-মালোম, বড়-মালোম সবাই সার বেঁধে নেমে আসে। সব সাফসোফ আছে কিনা ঠিক আছে কি না দেখে। তাছাড়া কোথায় কি আবার ভাঙছে, ঘুরে ঘুরে এটাও কাপ্তান দেখতে চান। ইন্সপেকসনের সময় লকার খুলে রাখার নিয়ম। অমিয় লকার খুলতে চায় না। সে সারেঙকে বলেছে, চাবি পাচ্ছে না। আসলে চাবিটা ওর কাছেই ছিল। অমিয় যে কেন এমন একটা মিথ্যা কথা বলল সে ভেবে পায় না।

ছোটবাবু দেখল, অমিয় কি সব ভিতরে রেখে দিচ্ছে। কি রাখছে সে টের পেল না। ছোটবাবু বলল, কি রাখলি অমিয়?

—কৈ কিছু নাতো।

ছোটবাবু আর কিছু বলল না। অমিয় পাশের ঘরে ওয়াচের নোংরা জামা প্যান্ট ছেড়ে স্নান করতে গেলে মৈত্রকে বলল, অমিয় কি নিয়ে আসে সঙ্গে?

—কি আবার নিয়ে আসে! বাংকারে কি এমন আছে, শুধু তো কয়লা।

—কিছু নিয়ে আসে।

মৈত্র বলল, মরুক গে। জাহাজে উঠলেই নানারকম অসুখে ভোগে মানুষ। এ-নিয়ে তোমার মাথা ঘামাতে হবে না ছোটবাবু। ওপরে যাও। কাল থেকে তো তোমার আবার ওয়াচ।

ছোটবাবু এবার ওপরে উঠে গেল। থালা-বাসন ধুয়ে ভাণ্ডারীর কাছ থেকে ‘বিশু’র মাংস নিয়ে নিল। কফি ভাজা, ডাল আর ভাত। মাংস নেবার সময় সে বলল, চাচা বিফ না মটন?

ভাণ্ডারী গলা বাড়িয়ে দেখল ছোটবাবুকে। মেসরুমের সঙ্গে গ্যালির একটা জানলা থাকে। তার ফাঁকে গলা বাড়িয়ে বলল, বিফ। তারপর ফের কচ্ছপের মতো সে গলা ভেতরে নিলে ছোটবাবুর কেমন রাগ হল। রোজ রোজ বিফ। সে বলল, চাচা আমাদের জন্য মটন নিতে পার না। কি দিয়ে খাই বলতো!

—দেয় না। ভাণ্ডারী সারেঙের চায়ের জল গরম করছে। পাশের উনুনে সে আর এক ডেকচি ভাত সেদ্ধ করছে। তামার বড় ডেকচি। ছোটবাবু কি বলছে, ঠিক মতো শুনতে পাচ্ছে না। সে ফের গলা বের করে বলল, কি বললে?

—আমাদের জন্য মটন নিতে পার না?

এবার ভাণ্ডারী কেমন রেগে গেল। বলল, আমারে কিছু কইবা না। সারেঙ-সাব কিছু করতে পারে না! তোমরা যাও, মাস্তার দ্যাও। কও, মটন না দিলে চলব না।

—চলব না তো বলিনি। তুমি তো জানো বিফ আমি খেতে পারি না, অমিয় খায় না। কেবল মৈত্রদা খায়।

—থাকতে থাকতে তুমিও খাবে। তারপর ভাণ্ডারী আর কোন কথা বলল না। সে এত রোগা মানুষ আর সে এত বেশি রগচটা যে কথা বলা দায়। এখনই হয়ত কিছু বললে ক্ষেপে যাবো, ছোটবাবু ভয়ে ভয়ে মাংসের ডেকচিটা নীচে রাখল। তিনটে থালায় সে ভাত নিল, ডাল নিল, কফি ভাজা নিল। সে কফি ভাজা ডাল এই দিয়ে ঠিক খেয়ে নেবে।

মৈত্র এসে আজ আবার ক্ষেপে গেল ছোটবাবুর ওপর। আমাকে তোরা কি পেয়েছিস? ছোটবাবু বুঝতে না পারে তাকিয়ে থাকল।

—আমি কি মানুষ না! এতটা গোস্ত আমার জন্য রেখেছিস।

ছোটবাবু বলল, কে খাবে। তুমি না খেলে কে খাবে। আমি খাই না,অমিয় খায় না!

—কেন অমিয় খায় না, কেন তুই খাবি না!

—আমার ভাল লাগে না। এবং এখনই হয়তো ফের মৈত্র মেসরুমে হৈ-চৈ বাধিয়ে দিতে পারে। সারেঙের সাত পুরুষ উদ্ধার করতে পারে। এবং মৈত্র ক্ষেপে গেলে সারেঙসাব একবারে কোন রা করেন না। সারেঙসাব ইচ্ছে করলেই এদের জন্য আলাদা মটনের ব্যবস্থা করতে পারে। হিন্দু পোলাদের জাত মারতে চান তিনি। বিফ খাওয়াবার এমন একটা সুযোগ তিনি ছাড়তে চান না। অর্থাৎ এমন সব কথা মৈত্র তখন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলবে। সারেঙসাব রেলিংয়ে ভর করে তখন সমুদ্র দেখেন। তিনি মনে করেন, মৈত্র ভীষণ গোঁয়ার,ওর সঙ্গে কথায় পারা যাবে না। তিনি যে ভীষণভাবে চেষ্টা করেছেন, কলম্বোতে রসদ নেবার সময় বার বার বলেছেন, জাহাজে যখন হিন্দু নাবিক আছে, তখন কিছু অন্তত মটন নেওয়া হোক। একেবারে যে না নেওয়া হয়েছে তা না, তবু ডারবান পর্যন্ত এই রসদেই চালিয়ে নিতে হবে। বিফ সস্তা বলে, কোম্পানি রেশনে বেশি বিফ দেওয়া পছন্দ করে। সারেঙের কথায় কি হবে! আর্টিকেল বদলাতে না পারলে কিছু হবে না।

সারেঙসাব এই নিয়ে মৈত্রের সঙ্গে ঝগড়া করতে পারেন। বয়স মানুষকে নানাভাবে ধার্মিক করে রাখে। অযথা চিল্লাচিল্লি তাঁর পছন্দ না। ছোটবাবু এ-সব বোঝে। বোঝে বলেই বলল, তুমি মৈত্রদা এ নিয়ে ঝামেলা কর না। তোমার অযথা ঝামেলা করার স্বভাব।

—আমার অযথা ঝামেলা করার স্বভাব!

—তাই তো।

—আমার কচু। জাহাজে এয়েছিস, মরবি। বলে দিলাম, মরবি। কেউ রক্ষা করতে পারবে না।

ছোটবাবু বুঝতে পারে না, এই কথায় এত উত্তেজনা হয় কি করে! মৈত্রদা এখন ভীষণ গোগ্রাসে খাচ্ছে। বড় বড় মাংসের টুকরো দিয়ে চটকে ভাত খাচ্ছে। সবটা মাংস সে খুব সহজেই খেয়ে বলল, এই ছোটবাবু, আমি হিন্দুর পোলা না। আমি বামুন না, আমার জাত নেই। সঙ্গে সঙ্গে এমন বিষম খেল যে মুখের সমস্ত ভাত চারপাশে ছড়াতে থাকল। অমিয় বলল, তোমার মৈত্রদা ব্লাড প্রেসার আছে। মাংসটা কম খাও।

এত কাসছে, তবু কথা থামছে না মৈত্রের।—বিফ না খেলে জাহাজ চালানো যায় না। আমি, আমি হিন্দুর পোলা বলচি, বিফ না খেয়ে কয়লার জাহাজে কাজ করা যায় না। মটন, মটন চাই! কেন দেবে মটন! কেন দেবে। যখনকার যা, তোমাকে তাই খেতে হবে।

এবার ছোটবাবু যেন না বলে পারল না, আচ্ছা খাব, কাল থেকে খাব। তুমি চোচমেচি করবে না তো। জলটা খাও। ছোটবাবু জল এগিয়ে দিল। তারপর মৈত্র একেবারে চুপ। সে আর কোন কথা বলতে পারল না। সে নিচেও গেল না। ছোটবাবু রেলিঙে ঝুঁকে আছে। আর সেই সমুদ্র, নীল আকাশ এবং যেমন মনে হয়ে থাকে অনেকদূর থেকে সারি সারি তিমি মাছের ঝাঁক জাহাজের পেছনে ছুটে আসছে, তেমনি সব ঠিকঠাক থাকলে ছোটবাবুর পাশে খোলা ডেকে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছা করে তার। মৈত্র ছোটবাবুর পাশে দাঁড়াতেই দেখতে পেল, অতিকায় সব সমুদ্রপাখি জাহাজটার পেছনে ছুটে আসছে। এ অঞ্চলে এদিক-ওদিক সব দ্বীপ,পাহাড় ছড়ানো। কি করে জাহাজের খবর পেয়েছে পাখিগুলো, খাবারের জন্য ওরা জাহাজটার পেছন নিয়েছে।

সমুদ্র থেকে ঠাণ্ডা বাতাস উঠে আসছিল। চারপাশে সমুদ্র নীল জলের ভিতর যেন খেলা করে বেড়াচ্ছে। দূরে ওরা দেখতে পেল, ভেড়ার পালের মতো ডলফিন ভেসে বেড়াচ্ছে। ছোটবাবুর ইচ্ছা একটা তিমি মাছ যদি এ-সময় সমুদ্রে ভেসে ভেসে দিগন্তের দিকে চলে যেত, বেশ মজা হত তবে। এখন মনে হচ্ছে কোথাও কেউ রেকর্ড-প্লেয়ার বাজাচ্ছে। জ্যাক মাঝে মাঝে যখন একঘেয়েমি ঠেকে, বোট-ডেকে বসে বেহালা বাজায়। আসলে বেহালাটা কাপ্তানের। তিনি মাঝে মাঝে তাঁর ঘরে বসে বাজান। সবারই এই দূর সমুদ্র যাত্রায় কিছু না কিছু নেশা আছে। যেমন জ্যাক ভাল নাচতে পারে। একদিন জ্যাক বোট-ডেকে পায়ে খড়খড়ি লাগিয়ে নেচেছে। আজ জ্যাক, বোট ডেকে বসে আছে। জাহাজ জিরো ডিগ্রী পার হয়ে এসেছে। গরমটা এখন তেমন নেই। জ্যাক, একটা কালো রঙের প্যান্ট পরেছে। লতাপাতা আঁকা জামা গায়ে দিয়েছে। টাইটা বেশ লম্বা। জ্যাক এখন খুব সেজেগুজে থাকতে ভালবাসে। আর কেউ জানে না, জ্যাক বোট-ডেকে দাঁড়িয়ে থাকতে ভীষণ ভালবাসে। সে সেখানে দাঁড়ালেই ছোটকে দেখতে পায়। সে ছোটকে আজকাল নানারকম ফরমাস করতে ভালবাসে।

জ্যাক ডাকল, হাই।

ছোট বুঝতে পারল, জ্যাক তাকে ডাকছে। সে দৌড়ে বোট-ডেকে উঠে গেল। বলল, জ্যাক আমাকে ডাকছ!

—তুমি কি দেখছিলে?

—কিচ্ছু না।

—এটা ধরো বলে একটা রেকর্ড তার হাতে ধরিয়ে দিল। তারপর জ্যাক নুয়ে কি একটা সুন্দর আই লাভ-টাব গোছের গান তুলে অন্য একটা রেকর্ড খুঁজে বেড়াল। তিন চারদিন আগেও এমনি হঠাৎ তাকে হাই করে ডেকেছিল। বলেছিল, তুমি দূরবীনে কি দেখেছিলে?

—কিচ্ছু না।

—কিচ্ছু দেখতে পাওনি?

–না। একটা কুকুর দেখেছিলাম।

—আর দেখবে না।

—আমি ঠিক দেখতে চাই না। কিন্তু মেজ বললে…

—মেজ বললেও দেখবে না।

ছোট খুব ভাল ছেলের মতো ঘাড় কাৎ করে বলেছিল, আচ্ছা।

আজ আবার কি জন্য ডেকেছে ছোট বুঝতে পারে না। বেশ শীত শীত করছে। সে হাতে একটা রেকর্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাপ্তান ব্রীজে পায়চারি করছেন। দুটো একটা নক্ষত্র আকাশে উঠছে। আকাশে বিন্দুমাত্র মেঘ নেই। এমন নির্মল আকাশ অনেকদিন দেখা যায়নি সমুদ্রে। এমন কি সমুদ্র এত শান্ত যে এখন ইচ্ছা করলে কাপ্তান, এক রবিবারে, ছোটখাটো একটা নাটক অভিনয় করিয়ে নিতে পারেন। ছোটখাটো স্ক্রীন টানিয়ে, ম্যাকবেথের কোন সিন, জ্যাক তো মুখস্থ বলতে পারে সবটা অথবা ও-নিলের কোন সমুদ্রবিষয়ক নাটক, তখন কাপ্তান বেহালা বাজাতে পারবেন, এটাই তাঁর লাভ। তিনি, উইংসের আড়ালে দাঁড়িয়ে বেহালা বাজাবেন এবং সমুদ্রের চারপাশের এক নীলাভ জ্যোতি তাঁকে কেমন গ্রাস করতে থাকবে তখন।

জ্যাক আর একটা রেকর্ড পাল্টাল। খুব দ্রুত তালে বাজছে। গমগম করে উঠছে সারা জাহাজটা। নিচে এঞ্জিনের শব্দটা পর্যন্ত এমন একটা গানের সুরে ছন্দ মিলিয়ে চলছে। জ্যাক, পায়ে তাল দিচ্ছে। জ্যাক বলছে, গাও, গাও। জোরে। ছোটবাবু একেবারে হাঁ। সে বলল, আমি পারি না।

—গাও,গাও না।

ছোটবাবু বলল, আমি পারি না জ্যাক।

—গাও, গাও না……..উই আর ইন দি সেম বোট, গাও, গাও না।

ছোটবাবু বেশ গলা মিলিয়ে গাইবার চেষ্টা করল, উই আর ইন…

জ্যাক বলল, বেশ সুন্দর হচ্ছে। আরও জোরে। গাও, আরও জোরে….।

কাপ্তান আর থার্ড অফিসার তাড়াতাড়ি উঁকি দিল ব্রীজ থেকে। কাপ্তান বয় যেতে যেতে দেখল, জাহাজের সবচেয়ে কমবয়সী নাবিকটির সঙ্গে জ্যাকের ভারি বন্ধুত্ব। সে কফি আর আইসক্রীম রেখে গেছে।

ছোটবাবু বলল, তুমি খেয়ে নাও জ্যাক।

জ্যাক বলল, ছোটবাবু মনে থাকে যেন, আর কখনও স্যার-টার বলবে না।

—না বলছি না।

—আমার খারাপ লাগে স্যার শুনতে।

‘ছোটবাবু বলল, জ্যাক, তুমি মেয়েদের মতো দেখতে। বলেই জিভ কেটে ফেলল। সে ভুলে যায় সব। এটা ঠিক না। জ্যাকের অহংকারে লাগতে পারে। বেটাছেলেকে মেয়েছেলে বললে কার না রাগ হয়। সে তাড়াতাড়ি জ্যাককে অন্যমনস্ক করার জন্য বলল, জ্যাক ঐ দেখ কত বড় পাখি! কি বড় ডানায় যেন সমস্ত আকাশ ঢেকে দিয়েছে।

জ্যাক দেখল ওদের মাথার ওপর, হাত দশেক ওপর হবে, পাখিটা প্রকাণ্ড ডানা মেলে স্থির হয়ে ভেসে যাচ্ছে। জাহাজের সঙ্গে চলছে।

জ্যাক বলল, সর্বনাশ।

—কি হল!

—ওটা এখন ছোঁ মারবে!

—তার মানে!

—আমার সব খাবার ছোঁ মেরে নেবে।

ছোটবাবু তাড়াতাড়ি খাবারটার ওপর ঝুঁকে দাঁড়াল।

—তোমার চোখ তুলে নেবে ছোটবাবু। শিগগির বোটের নিচে চলে এস।

ছোট আর দেরি করল না। সে কফির কাপ এবং আইসক্রিমের প্লেট নিয়ে ছুটে বোটের নিচে চলে গেল। তারপর সে দেখল, জ্যাক সুন্দর দু’পা বিছিয়ে দিয়েছে। বোট-ডেকের ভিতর দিয়ে, উপুড় হয়ে পড়ে আছে। ছোটবাবু উবু হয়ে বসে আছে। খুব তাড়াতাড়ি খেতে কষ্ট। রেকর্ডটা শেষ হয়ে আসছে। যেন ওর’খাওয়াটা একটু দ্রুত সমাধান করার জন্য, সে কিছুটা ছোটকে দিয়েছে। ভাগ করে দিয়ে সে একটা কথাও ছোটকে বলতে দিল না। সে আবার রেকর্ড-প্লেয়ারের পাশে উবু হয়ে বসে পড়ল।

ছোটবাবুর সাহস হল না বলে, আমি খাব না জ্যাক। ছোটবাবু খেয়ে জামায় মুখ মুছে ফেলল। যেন সে খায়নি। সে খেল কিনা তাও বলল না জ্যাককে। বেশ পরিপাটি করে দু’পা ছড়িয়ে সহজ হয়ে বসে পড়ল। জ্যাককে সে যে খুব ভয় পেত, এখন এমন বলতে ইচ্ছা হচ্ছে। কিন্তু জ্যাক একবারও তাকাচ্ছে না। সে রেকর্ডের গাদা থেকে একটা ভাল রেকর্ড খুঁজছে। যা শুনলে ছোটবাবু বুঝবে, জ্যাকের সংগ্রহে কত সুন্দর গান আছে।

কাপ্তান ব্রীজে পায়চারি করতে করতে ভাবছিলেন যাক, জ্যাক সমুদ্রে একজন সমবয়সী সঙ্গী পেয়ে গেছে। ঠিক সমবয়সী নয়, তবু বয়সে ওরা কাছাকাছি। স্বাভাবিকভাবেই ওরা দুজন জাহাজে একটা টান বোধ করবে। আর নেটিভরা খুব বিনীত, ভদ্র, এবং ভীতু হয়। ছেলেটার ভিতর সব গুণগুলোই আছে। তিনি মনে মনে জ্যাকের জন্য যতটা উদ্বিগ্ন ছিলেন, এখন আর ততটা নেই। যেমন শিকারী তার দুষ্টু মেয়ের হাতে কখনও কখনও বাঘের ছানা দিয়ে দেয়, এবং তাকে ভুলিয়ে রাখে, অথবা পোষা বেড়াল, ছোটবাবু যেন জ্যাকের তাই। কাপ্তান বলল, বুঝলে থার্ড, জ্যাক আমার স্বভাব পেয়েছে। সমুদ্রে ঘুরে বেড়াতে ওর কখনও খারাপ লাগে না। স্কুলেটুলে কিছু হয় না। তার চেয়ে একজন মানুষ সমুদ্রে ঘুরে বেড়ালে বেশি শিখতে পারে। জ্যাক আমার কত কম বয়সে কত বেশি জানে। কেমন আত্ম-তৃপ্তিতে কাপ্তান চোখ বুজে ফেললেন।

এভাবে জাহাজ আবার ক্রমে এগিয়ে চলে। কখনও কখনও ছোটবাবু জ্যাকের সঙ্গে পাখিদের মাংস খাওয়ায়। ডারবান পর্যন্ত ছোটবাবুর শেষ পর্যন্ত ওয়াচ থাকল না। সে ফালতু হয়ে থাকল। ফালতু মানে কাজ কম। ডেকের ওপর উইনচে শুধু কাজ করা। ডেকের ওপর মাঝে মাঝে পাখিদের মাংস দেবার সময় বড় বড় সব এ্যালবাট্রস পাখি ডানা মেলে মাথার ওপর ভেসে থাকে। জ্যাক আর সে মাঝে মাঝে মাংস ছুড়ে দেয়। বেশ একটা খেলা। ডেকে ওদের ভারি আশ্চর্য খেলা জমে ওঠে। একে একে অনেক পাখি, প্রায় সারাটা ডেক তখন ছেয়ে যায়, দলে দলে ওরা মাংস খাবার লোভে জাহাজের চারপাশ ঘিরে ফেলে—তারপর উড়তে উড়তে ভাসতে ভাসতে সমুদ্রযাত্রার সঙ্গী হয়। মাংস ছুড়ে দিলেই হাওয়ায় ক্লপ করে ধরে ফেলে। ডেকে পর্যন্ত পড়তে দেয় না। পাখিগুলো মাংস খাবার লোভে কোথায় যে ভেসে চলেছে নিজেরাও জানে না। কারণ ওরা এভাবে জাহাজের পিছু পিছু শুধু উড়তেই থাকবে। সামনে যতক্ষণ কোনও ডাঙ্গা না পাচ্ছে ওরা আর থামবে না।

জাহাজিরা অবসর পেলেই পাখিদের স্নান, খাওয়া এসব দেখত। কখনও সবাই দেখত বেশ সামান্য ঢেউয়ের ওপর ওরা ভেসে রয়েছে। ডুবে ডুবে সাঁতার কাটছে। অথবা প্রপেলার যেখানে জল ভেঙ্গে চলে আসছে সেখানটায় ওরা ডুবে গভীর নীল জলে, সাদা ডানা মেলে মাছ খুঁজছে। প্রপেলারের ঝাপটায় কত সব ছোট মাছ, মরে যায়। ওগুলো জলে ভাসলে অথবা জলে ডুবে গেলে ওরা তুলে খায়। কখনও ভাণ্ডারিরা উচ্ছিষ্ট খাবার ফেলে দেয় জলে। ওরা সে-সবও খায়। জাহাজিদের কাছে, সমুদ্রের মতো, আকাশের নক্ষত্রের মতো এই সব পাখিদেরও একটা দাম আছে। মাস্তুলে কোনও পাখি এসে বসলে ওরা তাড়িয়ে দেয় না। ওদের সময় ভাল যাচ্ছে, এমন ভেবে থাকে।

বন্দরে ঢোকার মুখে মৈত্র ভাবল এ-বন্দরে শেফালির ঠিক চিঠি আসবে। এখানে শুধু বাংকার নেওয়া হবে। রাতে রাতে জাহাজ, দুটো পাহাড়ের ভিতর দিয়ে বন্দরে ঢুকে যাচ্ছে।

শেফালী বন্দরে বন্দরে এক চিঠি লেখে। সেই এক অপেক্ষার কথা চিঠিতে। তুমি কবে ফিরবে। মৈত্রকে ছেড়ে শেফালীর এক দণ্ড ভাল লাগে না। লিখবে জাহাজ তারপর কোথায় যাচ্ছে। ঠিকানা স্পষ্ট করে লিখ। গতবার এজেন্ট অফিসের কি যে ঠিকানা দিলে কিছু বুঝতে পারিনি।

বন্দরে ঢোকার মুখেই ঠিক চিঠি হাজির। পাইলট জাহাজে উঠে এসেছে। পাইলটের সঙ্গে সব চিঠি এসেছে। সারেঙ ডেকে ডেকে চিঠি দিচ্ছে সকলকে। মৈত্র চিঠি পেয়ে একটু গোপনে পড়বে বলে, বোট ডেকে উঠে গেছে। তা না হলে অমিয়টা গিদরের মতো করবে। কি লিখল দাদা। চুমুটুমু খাবার কথা লেখেনি! অমিয়র জিভ খুব আল্পা।

এবারের চিঠিতে শেফালী নতুন একটা উপসর্গের কথা লিখেছে। মৈত্র নুয়ে দেখল, অস্পষ্ট অক্ষরে লেখা, তবু হাতের লেখা বুঝতে কষ্ট হয় না, এতবার এই লেখা পড়েছে যে সে শেফালীর সামান্য আঁচড়ে ধরে ফেলে সব। শেফালী লিখেছে, আমার বড় বমি পায়। তোমার জন্য রাতে আমার ঘুম আসে না। তারপর লিখেছে, শেফালীর ভাল থাকছে না শরীর। ক্রমশ বমি বাড়ছে। শরীর দুর্বল। কেবল দুঃস্বপ্ন দেখি। তারপর নিচের প্যারায় শেফালী- সে তার স্বপ্নের কথা লিখেছে।

আচ্ছা তোমার জাহাজে লম্বা বড় একটা বাঁশ আছে? বাঁশের মাথায় কি কোন কঙ্কাল বাঁধা আছে? প্রায় একটা বড় তিমি মাছের ছবি সমুদ্রে ভেসে যেতে দেখি। প্রায়ই মনে হয় মাছটা তোমাকে গিলে ফেলার জন্য অপেক্ষায় আছে। তুমি সেটা বুঝতে পারছ না। তুমি ক্রমশ মাছটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছ। মাঝে মাঝে তোমাকে আমি সেই ঝোলানো কঙ্কালের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। ভয়ে তখন আমার মুখ শুকিয়ে যায়। মনে হয় আর সমুদ্রে গিয়ে কাজ নেই। বরং এবার এসে এই কলকাতা শহরে কিছু দেখে নাও। তুমি লক্ষ্মীটি আমার, দস্যুর মতো কোনও গোঁয়ার্তুমি কর না। ঝড়ের সময় ডেকের ওপর দিয়ে হাঁটবে না। মনে থাকে যেন লক্ষ্মীটি। জাহাজে উঠলেই এভাবে শেফালী ভীষণ সংশয়ে ভোগে।

দস্যু কথাটা বলে শেফালী যেন অদ্ভুত এক সুখ পায়। দস্যু কথাটা ওর সম্পর্কে একটা ভীষণ উপমার মতো। দু’হাত তুলে মৈত্র এখন সেই সব দৃশ্যের ভিতর ডুবে যেতে চাইছে। দস্যুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়া, দস্যুর মতো সহবাস এসব হামেশা শেফালী তাকে বলে থাকে। মৈত্রের চিঠি পড়তে পড়তে ভীষণ জল তেষ্টা পাচ্ছে। সে আর ডেকে দাঁড়াতে পারছে না। নিচে নেমে সে ঢকঢক করে জল খেল।

আজকাল অমিয়র সঙ্গে মৈত্রের তুই তুকারিতে এসে দাঁড়িয়েছে। অমিয় এখন জাহাজে বেশ সাবালক জাহাজি। সে দেখল মৈত্র জল খাচ্ছে। বেশ ঠাণ্ডা। শীত লাগছে ভীষণ। এই শীতে কি করে যে ওর তেষ্টা পায়! সে বলল, কার চিঠি?

মৈত্র বলল, আর কার?

—শেফালী বৌদির?

মৈত্র বলল, তাইতো মনে হয়।

মাঝে মাঝে ওরা যখন ওয়াচ শেষ করে বাথরুমে ঢুকে যায়, তখন স্নানের ভেতর ওরা কেমন নিজেদের উলঙ্গ ছবি দেখে ফেলে। ভারি মজা এই স্নানে। সাবানের ফেনা সারা শরীরে। মৈত্রের চেহারা তখন বড় ভয়ঙ্কর। ওর চুল কোঁকড়ানো। হাত-পায়ের পেশী ভীষণ শক্ত। সে হাতে একটা তামার বালা পরে থাকে। এমন একটা শক্ত মানুষের চেহারা দেখলেই অমিয়র কেন জানি মৈত্রের বৌর কথা মনে হয়। সে তখন বলতে থাকে, তোর বৌটাকে এবার দেশে গেলে দেখাস মৈত্র।

—কেন কেন! এত লোভ কেন আমার বৌকে দেখার।

—আমার লোভ না। লোভ তোমার। তোর এমন শরীর, বৌয়ের কষ্ট হয় না!

–কষ্ট! কিসের কষ্ট! মৈত্রের মুখ একেবারে নাবালকের মতো। যেন সে কিছু বোঝেনি।

-–কষ্ট, কষ্ট, এত ব্যাখ্যা করতে পারব না। আশেপাশে ছোটবাবু থাকতে পারে—ছোটবাবুর সামনে মৈত্র চায় না খিস্তিখেউড় করে। অমিয় একটা ধারি, সে যা কিছু বলতে পারে। ওরা এদিক ওদিক খুঁজে দেখলে ছোট নেই। হয়ত সে মেজ-মালোমের পাশে বসে আছে। ওকে খুঁজে দেখা দরকার। ওর চিঠি আসেনি। চিঠি না এলে জাহাজিরা খুব বেজার মুখে ঘুরে বেড়ায়। একা একা থাকে। এবং নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হয়।

মৈত্র ছোটবাবুকে বন্ধুর ফোকসালে শেষ পর্যন্ত পেল। বন্ধুর বাংকে চুপচাপ শুয়ে আছে। চারপাশে যখন বন্দরের আলো, পাহাড়ের মাথায় বাতিঘর তখন ছোট এভাবে নিচে বসে আছে ভাবতেই মৈত্রের কেমন খারাপ লাগল। সে কোন চিঠি পায়নি। সে নিজে সবার চিঠি লিখে দিয়েছে, সবার চিঠির জবাব এসেছে,তার চিঠি নেই।

মৈত্র পাশের বাংকে বসে বলল, ঠিকানা ভুল লিখেছিস?

—না, ঠিকানা ঠিকই লিখেছি। তবে আমার যা মনে হয় বাবা-মা, আগের জায়গায় নেই।

—কোথায় গেছে?

—কোথায় যাবে, তাও জানি না। বাবা বারবারই জায়গা বদল করতে চাইছেন। নবদ্বীপের দিকে থাকার খুব ইচ্ছে। ওখানে কিছু যজমানি পাবেন কথা আছে। তবে ওখানে যদি যান, চিঠি একদিন না একদিন পাবেন। আমি ঠিক বুয়েন্স এয়ার্সে মার চিঠি পাব আশা করছি।

—তা হলে পেয়ে যাবি

—নাও পেতে পারি। আমাদের পরিবার এখনও ঠিক করতে পারছে না কোথায় থাকবে।

—কেন, কলকাতার দিকে চলে এলেই হয়।

—কলকাতাকে বাবার ভীষণ ভয়। জ্যাঠামশাই তো কিছুতেই আসবেন না। গাঁয়ের দিকে বাড়িটাড়ি করে কিছু জমিজমা কিনে বাঁচার একটা চেষ্টা চলছিল। কিন্তু বাবা, জ্যাঠামশাই এত আনাড়ি শেষ পর্যন্ত কিছু ঠিক করে উঠতে পারেন না। একটা রেশনের দোকান জ্যাঠামশাই করলেন। টাকা কম ছিল বলে পার্টনার নিলেন। পরে কি করে যে সেই মালিক হয়ে গেল বুঝলাম না। জ্যাঠামশাই একদিন ক্ষোভে দুঃখে সব ছেড়ে চলে এলেন। তারপর কেমন খুব দুঃখ থেকে বলার মতো সে বলল আসলে আমাদের পরিবার জানে না, একবার ছিন্নমূল হলে ফের কিভাবে বাঁচতে হয়। সে যেন বেশ দামী কথা বলে ফেলেছে। এমনভাবে বললে, বড় কথা শোনাবে তবু এটাই ঠিক। বাবা কেমন হাল ছেড়ে দিয়েছেন।

মৈত্র বলল, সব ঠিক হয়ে যাবে। একটু থেমে বলল, আসার সময় তুই জেনে আসিসনি সব।

—সে তো আটমাস আগে, আটমাস আগে বাড়ি ছেড়েছি।

—বাড়িতে আর যাসনি?

–না।

—জাহাজে ওঠার আগে একবার দেখা করে এলি না!

—তাহলে আমার জাহাজে আসাই হত না। সে বলতে চাইল আপাতত আমি নামগোত্রহীন। বাবা মার সঙ্গে সম্পর্কহীন! কিন্তু বলতে পারল না। বুয়েন-এয়ার্সে যদি না আসে তবে ভাগ্যের সন্ধানে ওরাও বের হয়েছে ভেবে নিতে হবে। ভাগ্যের সন্ধানে মৈত্রদা আমিও বের হয়েছি। টাকা মা পাবে না। অফিসে আবার ফেরত চলে আসবে।

মৈত্র এবার কেমন ঠাট্টা করে বলল, বাড়ি থেকে রাগ টাগ করে পালিয়েছিস বুঝি!

—রাগ, না রাগ ঠিক না। তবে সবাইকে না জানিয়ে ভাগ্যের সন্ধানে বের হয়ে পড়েছি। কেউ জানত না, আমি কোথায়। আমার চিঠি পেলে মা যে কি খুশী হতেন।

—তোর এটা ঠিক হয়নি ছোট। মাকে এভাবে চিন্তায় ফেলে দেওয়া তোর ঠিক হয়নি।

ছোট এবার দেয়ালের দিকে মুখ ঘোরালো। ছোট কি মায়ের জন্য কাঁদছে। ছোট কিছুতেই এদিকে মুখ ঘোরাচ্ছে না। মৈত্র ভীষণ বিব্রত বোধ করছে। এ-ভাবে ছোটকে মুখ ঘুরিয়ে থাকতে দেখলে সে ভীষণ ক্ষেপে যায়। সে বলল, বুঝলি ছোট তোর বৌদি চিঠি লিখেছে।

ছোট কোন আগ্রহ দেখাল না! তবু মৈত্র বলে চলেছে, বুঝলি তোর বৌদির কি ভয় রে! ও নাকি ডেকের মাস্তুলে একটা তিমি মাছ স্বপ্নে ঝুলতে দেখে। কখনও তিমি মাছের কঙ্কাল। এ আবার কি রকম স্বপ্ন রে বাবা!

ছোট উঠে বসল এবার। সে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে এখনও। সে তেমনিভাবে বলল, সত্যি আজগুবি স্বপ্ন মৈত্রদা। না হলে শেফালী বৌদি হবে কেন। তোমরা দুজনেই দুজনকে ছেড়ে থাকতে পারছ না। বলে ছোট্ট রসিকতা করে নিজেই নিজেকে হাল্কা করে দিল। এবং বড্ড ছেলেমানুষী করে ফেলেছে ভেবে সে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি ধরে মৈত্রের নাগালের বাইরে চলে গেল।

মৈত্র বলল, বেচারা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *