অলৌকিক জলযান – ৫১

।। একান্ন।।

সিউল-ব্যাংক এগিয়ে যাচ্ছে কি অতিকায় ক্রসটা কাছে ছুটে আসছে বোঝা যাচ্ছে না। সমুদ্র পার হয়ে দিগন্তের নিচ থেকে ক্রমে ওটা আকাশের বুকে বড় হয়ে যাচ্ছিল। যেন কেউ ওটা ঠেলে আকাশের গায়ে তুলে দিচ্ছে। সব বর্ণচ্ছটা ক্রসটার গা থেকে ঠিকরে বের হচ্ছে—কারণ মনে হচ্ছিল এক আলোময় জগত, যেন অনেক সূর্যের দীপ্যমান আলো নিয়ে সে আকাশে জ্বলে উঠেছে। স্যালি হিগিনস দেখতে দেখতে প্রায় বিহ্বল। তিনি বিড়বিড় করে বকছিলেন—মাই টাইম হ্যাজ কাম্। মাই টাইম হ্যাজ কাম্। শী উইল সুন সারাউন্ড মি। অ্যান্ড দিস ইজ মাই ফেট।

ছোটবাবু নিচে দাঁড়িয়ে আছে। সে দেখছিল—বহুদূরে প্রায় দিগন্তে কিছু দেখা যাচ্ছে। বিন্দুর মতো অস্পষ্ট। কখনও অজস্র ঢেউ-এর ভেতর ওটা হারিয়ে যাচ্ছে। সে নিজের চোখকে ভীষণ অবিশ্বাস করছে এখন। ক্রোজ-নেস্ট থেকে সে যা দেখেছিল—ডেকে নেমে সে তার প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। কখনও বিন্দুবৎ কালো কিছু দিগন্তে উঁকি মেরে সমুদ্রগর্ভে অন্তর্হিত হয়ে যাচ্ছে। যা সে এত কাছে দেখেছিল, যা সে ভেবেছিল প্রায় আকাশের মতো অতিকায় কি করে যে সে সহসা অবার বিন্দুবৎ হয়ে গেল। সে বলল, এনি মিরাকল্?

তিনি বললেন, মিরাকল! অল ননসেন্স।

ছোটবাবু বলল, শুধু বিন্দুবৎ কিছু দেখা যাচ্ছে। একটা পাহাড়ের মতো ক্রসটা দেখেছিলাম। এখন কিছু নেই। একেবারে ফাঁকা।

হিগিনস আর একটা কথাও বলছেন না। তিনি দ্রুত নেমে আসছেন। সারেঙ-সাব পাশে দাঁড়িয়ে কি করবে ভেবে পাচ্ছেন না। বনি চিফ-কুকের গ্যালি থেকে মুখ বার করে রেখেছে। সে চাপাটি উল্টে পাল্টে দিচ্ছে। একটু এদিক ওদিক হলে পুড়ে যাবে। সে বের হয়ে আসতে পারছে না। চিৎকার করে কথা বলছে—বাবা ওটা কি! কি দেখলে?

হিগিনস ডেকে লাফ দিয়ে প্রায় নেমে পড়লেন। খুব স্বাভাবিক গলায় বললেন—কিছু না। প্রবালের দ্বীপ-টিপ হবে।

—আমরা ওখানে নামতে পারব বাবা?

ছোটবাবু লাফ দিয়ে তখন ফের দেখার জন্য মাস্তুলের মাথায় উঠতে গেলে খপ করে হিগিনস হাত ধরে ফেললেন। বললেন, ইয়ং ম্যান, প্লিজ লি টু মি। ডোন্ট গো।

ছোটবাবু বলল, কিন্তু স্যার…….

হিগিনস বললেন, প্লিজ ইউ ফলো মি।

সারেঙ-সাব বললেন, আমি একবার উঠে দেখব সাব?

হিগিনস বললেন, কিছু আর দেখার নেই।

বনি দু’হাতে তখন চাপাটি উল্টে-পাল্টে দিচ্ছে। সে কিছুতেই বের হয়ে, কেন ছোটবাবু ক্রোজনেস্ট থেকে চিৎকার করে উঠেছিল—বাবা উঠে গেলেন কেন আবার তিনি নেমেই বা এলেন কেন এবং একটা কথা কেউ বলছে না, বাবা ছোটবাবুকে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন, এসব জিজ্ঞাসা করলে হত। সে একটা পাতলা ফ্রক গায়ে দিয়ে নিয়েছে। দিন যত এগিয়ে যাচ্ছে বাতাসে তত উত্তাপ। শরীরে দু’তিন জায়গায় ইতিমধ্যে গরমে ফোসকা পড়েছে। সারেঙ সাব সব হাতের কাছে এগিয়ে দিচ্ছেন। আগুন ধরিয়ে দিচ্ছেন। এবং সব কাজে সহায়তা না করলে সে কিছু করতে পারত না। অথচ সে যে ছুটে গিয়ে বলবে—ছোটবাবুকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ বাবা? ও কি করেছে? আমাকে কিছু বলছ না কেন—সে না পেরে সব উনুন থেকে নামিয়ে দু’লাফে বাইরে বের হয়ে এল। বলল, বাবা ছোটবাবুকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?

হিগিনস দেখলেন সত্যি তিনি ছোটবাবুকে প্রায় টেনে নিয়ে যাচ্ছেন বোট-ডেকে। যেন কিছুতেই আর তাকে ক্রোজ-নেস্টে উঠতে দেবেন না। তিনি যে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন একেবারে খেয়াল করেন নি। কেমন বিভ্রমের ভেতর সব ঘটে যাচ্ছে। তিনি বনিকে আশ্বস্ত করার জন্য না বলে পারলেন না, বোট-ডেকে আমাদের সামান্য কাজ আছে বনি।

বনি বলল, কি যে দেখলে তোমরা!

—কিছু না তো।

—ছোটবাবু যে চিৎকার করে উঠছিল—কি সব এগিয়ে আসছে?

—কোথায় কি এগিয়ে আসছে! দ্যাখো না। কিছু দেখতে পাচ্ছ? বনি চারপাশে খালি চোখে সত্যি কিছু দেখতে পেল না। বলল, ছোটবাবু তোমার ঠাট্টা করার সময়-অসময় নেই।

ছোটবাবু বোকার মতো তাকিয়ে আছে। সে বলল, স্যার তবে আমি চোখে ভুল দেখেছি।

তিনি শান্ত গলায় বললেন, উই উইল নো লংগার ওয়ানডার ইন দ্য ডারকনেস। তাড়াতাড়ি আমাদের হাতের বাকি কাজ সব সেরে ফেলা ভাল। স্যালি হিগিনস ফের তাঁর পুরানো মরজি পুরোনো স্বভাব পুরোনো ব্যক্তিত্ব ফিরে পাচ্ছেন। ছোটবাবুকে কিছু বলার সময় দিচ্ছেন না। তিনি কি সব অজস্ৰ কথা বলে যাচ্ছেন বিড়বিড় করে। মাথামুন্ডু সে কিছু বুঝতে পারছে না। তিনি তাকে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। এবং জাহাজের ফরোয়ার্ড-পিকে উঠে যাবার মুখে প্রায় লাথি মেরে দরজা খুলে ফেললেন। এবং বললেন, ইয়াংম্যান, প্লিজ গো ইন-সাইড। বলে অন্ধকারে তাকে ঢুকিয়ে বললেন, দ্যাখো কি কি কাঠ আছে। তিন বাই চার এবং যত লম্বা সব কাঠ আছে বের করে ফেল। ছোটবাবু জানে এটা কার্পেন্টারের ঘর। পাশে ডেক-কশপের স্টোর রুম। সে যত লম্বা কাঠ ভারী কাঠ আছে ছোট বড় সব ডেকে টেনে টেনে বের করে আনছে। আর মাঝে মাঝে বলছে, স্যার এত সব ভারী কাঠ দিয়ে কি হবে? তিনি ফিতে গজ দিয়ে মাপছেন। এবং পছন্দমতো সব কাঠ টেনে একপাশে রেখে দিচ্ছেন। তারপর হাঁটু গেড়ে বললেন, কাঠগুলো সব আমার কাঁধে তুলে দাও ছোটবাবু।

ছোটবাবু বিব্রত বোধ করছে।

—রাখুন। আপনাকে নিতে হবে না। কোথায় রেখে আসতে হবে বলুন, রেখে আসছি। ছোটবাবু বিরক্ত গলায় এ-সব বলতে গেলে বুঝতে পারল, স্যালি হিগিনস তার দিকে অপলক তাকিয়ে আছেন। সেই চোখ, যেমন সে জাহাজে উঠে প্রথম দেখেছিল—যা দেখলে ওর বুকের রক্ত হিম হয়ে যেত। সে বলল, এক্সকিউজ মি স্যার। আপনার কষ্ট হবে ভেবে বলেছি। ছোটবাবু বুড়ো মানুষটার কাঁধে সব ক’টা কাঠ তুলে দিলে তিনি সোজা উঠতে পারলেন না। প্রায় টাল খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন। ছোটবাবু এবার ধরে ফেলল। বলল, স্যার আপনি পারবেন না।

তিনি তবু কাঁধে সব ক’টা কাঠ নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। এত ভারী যে তিনি নুয়ে পড়ছিলেন। তবু যেন হার মানবেন না।—বিড়বিড় করে বকছেন। কখনও ঈশ্বরকে অজস্র গালাগাল করছেন—কখনও বোধহয় নতজানু—যেমন তিনি এবার জোরে জোরে বলছেন, লর্ড ব্রিংগ মি আউট অফ অল দিস ট্রাবল, বিকজ্ উই আর ট্রু টু ইউর প্রমিসেজ। অ্যান্ড বিকজ ইউ আর লাভিং অ্যান্ড কাইনড টু মি….. বলতে বলতে চলে যাচ্ছেন। ছোটবাবু পেছনে পেছনে যাচ্ছে—যদি উপুড় হয়ে পড়ে যান—তার আগেই ধরে ফেলতে হবে—এবং আবার তিনি বলছেন—কাট্ অফ অল আওয়ার এনিমিজ অ্যান্ড ডেস্ট্রয় দোজ হু আর ট্রাইং টু হার্ম আস, ফর উই আর ইয়োর সার্ভেন্টস। যেন জপ করছেন, উই আর ইয়োর সার্ভেন্টস।

ছোটবাবু বলল, আমাকে কিছু দিন। পড়ে গেলে হাত-পা ভাঙবে। তিনি একটা কাঠও ওকে দিলেন না। বসলেন। কাঠগুলো এবার সিঁড়ির কাছে রেখে একটা একটা করে বোট ডেকে তুলে নিয়ে গেলেন। সব ক’টা কাঠ তুলে ফের নেমে এলে ছোটবাবু বলল, কোথায় যাচ্ছেন আবার!

—আমার সঙ্গে এস। মুখে যে ছোটবাবুর সামান্য বিরক্তি ফুটে উঠেছিল স্যালি হিগিনসের গলার স্বরে তা মিইয়ে গেল। সে তাঁর পেছনে মন্ত্রঃপূত মানুষের মতো হেঁটে যেতে থাকল। আর একটা প্রশ্ন করতে পারল না।

ছোটবাবুকে নিয়ে তিনি ফের ডেক-কশপের ঘরে ঢুকে তন্ন তন্ন করে খুঁজছেন সব। পেরেক ছোট- বড় মাপের যা পাচ্ছেন ছোটবাবুর হাতে দিয়ে বলছেন, রাখো। কিছু লোহার পাতলা প্লেট এবং স্ক্রু। ত্রিপল টেনে বের করছেন। আর যেন এখন ঘরভর্তি আরশোলা পা বেয়ে মাথা বেয়ে উঠে যাচ্ছে। আবার উড়ে যাচ্ছে কখনো। কত অল্প সময়ে ওদের উপদ্রব বেড়ে যাচ্ছে। এবং রং তেল বার্নিশের গন্ধ। তিনি পাতলা কাঠ যা পাচ্ছেন টেনে বের করছেন। লোহার শিক টেনে বের করছেন। ছোটবাবু একটা কথা বলছে না। ভয় পেয়ে গেছে হয়তো, তিনি এবার টর্চের আলো অন্ধকারে ছোটবাবুর মুখে ফেললেন। সহসা আলো পড়ায় সে মুখের ওপর হাত তুলে দিলে স্যালি হিগিনস কেমন অমানুষের মতো হেসে উঠলেন। বললেন, ছোটবাবু তুমি ভীষণ কাওয়ার্ড। মুখ এমন করে রেখেছ কেন? আরে কিছু হয় নি। এই ছোটবাবু, তুমি ক্রোজ-নেস্টে উঠে গেলে কিছু আর দেখতে পাবে না। কিন্তু আমি জানি আমরা কোথায় এসে গেছি। তোমাকে বলতে পারি কিন্তু তুমি যা একখানা মানুষ! ছোটবাবু শক্ত গলায় বলল, স্যার আমরা কোথায় এসেছি? কোন সমুদ্রে?

—সমুদ্রটার সঠিক কিছু আমি জানি না। তবে এটা বলতে পারি কোরাল-সীর কাছাকাছি জায়গা। এতদিনে অন্তত কোথায় আমরা আছি জানা গেল। একবার এখানে সিউল ব্যাংক কোর্স ভুল করে ফেলেছিল।

—কি বলছেন স্যার!

—ভয় পাচ্ছ কেন? এই দ্যাখো হাত থেকে দু’টো তোমার স্ক্রু পড়ে গেল। তবে তাঁর একান্ত করুণায় ছ’ সাত দিনের ভেতর আমরা আবার কোর্স পেয়ে গেলাম। একেবারে সহজ স্বাভাবিক কথা।

—তখন কিউ-টি-জি চাইলেন না কেন?

—চাইতে পারিনি। ভারী অসম্মানের ব্যাপার। এই তুমি কিন্তু আবার বনিকে বলবে না।

—না স্যার।

—বনিকে বললে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দেব। তিনি টর্চের আলো কাঠের র‍্যাকগুলোতে ফেলে যাচ্ছেন। ছোট ছোট প্যাকেট, সব প্যাকেটে ঠিক পছন্দমতো তিনি ওয়াশার পাচ্ছেন না। দু’টো বড় হাতুড়ি বেছে নিলেন। একটা র্যাদা। করাতের ব্লেড হাতে নিয়ে বাঁকিয়ে দেখলেন কতটা ধকল সইতে পারবে। কাজ করছেন আর অজস্র কথা বলে যাচ্ছেন।—বুঝলে হে, জায়গাটা ভাল না। ক্রোজ-নেস্টে আর উঠবে না। কে কখন ঠেলে ফেলে দেবে ক্রোজ-নেস্ট থেকে!

ছোটবাবু বলল, তা হলে দূরে কিছু দেখতে পেলেন?

—দেখার আর কিছু নেই। সব ঠিক হয়ে গেছে।

—তা হলে স্যার আমরা দু’ একদিনের ভেতর ডাঙা পেয়ে যাব!

—পেতে পার। ছোটবাবুকে সব খুলে বলতে বড় কষ্ট হচ্ছিল। এমন দু’টো তাজা প্রাণ বিনষ্ট হবে! ভাবতেই চিৎকার করে বললেন, হ্যালেলুজা। ছোটবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ডিয়ার ফ্রেণ্ড আই অ্যাম প্রেইং দ্যাট অল ওয়েল উইদ ইউ অ্যাণ্ড দ্যাট য়োর বডি ইজ অ্যাজ হেলদি অ্যাজ আই নো য়োর সোল ইজ…

ছোটবাবু বলল, স্যার আমাকে ভয় পাইয়ে দেবেন না।

তিনি শুধু বললেন, এস।

এবং ওরা দু’জন আরও ভেতরে ঢুকে যেতে থাকল। তারপর তিনি কশপের ঘরে হন্যে হয়ে কি খুঁজতে থাকলেন। এবং পেয়ে গেলে বললেন, টর্চ জ্বালো।

বাইরের আলো ভেতরে এতটুকু ঢুকতে পারছে না। ওরা অন্ধকারে যেন ভীষণ একটা গোপন জায়গায় চলে যাচ্ছে। ছোটবাবু বুঝতে পারছে না হিগিনস তাকে নিয়ে জাহাজের কোথায় নেমে যাচ্ছেন। এতদিন সে জাহাজে আছে কখনও এদিকটায় আসে নি। হিগিনস কি ওকে নিয়ে একেবারে জাহাজের তলায় নেমে যাচ্ছেন! অন্ধকারে ওরা একটা সিঁড়ি পেয়ে গেল। এবং টর্চ জ্বালিয়ে ক্রমে নিচে নেমে যখন ওপরে আলো ফেলল, তখন মাথার ওপরে ছাদ। পাশেই এক নম্বর হ্যাচ। ফসফেটের গন্ধ উঠে আসছে। ছোটবাবু বুঝতে পারছে না তিনি তাকে এত নিচে কেন নিয়ে এসেছেন। ওকে ফেলে তিনি ওপরে উঠে গেলে সে যেন ঠিক পথ চিনে ওপরে উঠতেও পারবে না। হিগিনস আর পার্থিব জগতের কেউ, বিশ্বাস হচ্ছে না। চোখ জ্বলছে। বোধ হয় তিনি লুকেনারের প্রেতাত্মা কোথায় লুকিয়ে আছে অথবা মনে হয় তিনি তাকে বুঝি এখুনি দরজা খুলে দেখাবেন—হিয়ার ইজ দ্য ডেভিল। তার শুকনো অস্থিচর্মসার কংকাল, দ্যাখো এখনও কি যে বহাল তবিয়তে আছে। ছোটবাবু চিৎকার করে উঠল, স্যার আপনি আমাকে কোথায় নিয়ে এলেন, আপনার কি ইচ্ছে?

হিগিনস চক-খড়ি দিয়ে তখন ইস্পাতের দেয়ালে একটা চার্ট এঁকে বললেন, এই হচ্ছে কোরাল সী। অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকুল থেকে প্রায় উত্তরে এর আটশ নটিক্যাল মাইলের ওপর বিস্তৃতি। আমরা আছি তারও ওপরে। অর্থাৎ জাভা সুমাত্রা নিউ-গিনি এখন আমাদের পাশাপাশি অঞ্চল। এখানে আছে অজস্র প্রবাল দ্বীপ। পাঁচ-সাতশ মাইলের ভেতর জনহীন দ্বীপ তোমরা পেয়ে যেতে পার।

প্রায় ভূগোল মাস্টারের মতো ছোট একটা স্টিক দিয়ে তিনি কাছাকাছি দ্বীপের দূরত্ব কি হবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। ঠিক কম্পাসের কাঁটার বরাবর চালাতে পারলে আর পালে বাতাস লাগলে আট- দশ দিনের ভেতর পেয়ে যাবে। যদি কোনো কারণে দ্যাখো পাচ্ছ না, তবে বুঝতে হবে—

—তুমি ঠিক ঠিক বোট চালাতে পার নি। বলেই তিনি থামলেন, দু’টো আরও দ্বীপের নাম লিখলেন—বেশ বড় বড় অক্ষরে যেন বুঝতে ছোটবাবুর অসুবিধা না হয়। এই হচ্ছে সান্তাক্রুজ দ্বীপপুঞ্জ তারপর ফানাফুতি তারপর ওপরে তাকালেন। বোধ হয় গলা ছেড়ে কেউ ডাকছে। ছোটবাবু কান পেতে বুঝতে পারল, ডেকে বনি গলা ফাটিয়ে ডাকছে। বাবা, ছোটবাবু তোমরা কোথায় গেলে? প্রায় ওর গলা কান্নায় বুজে আসছে। সারেঙ-সাবও চেঁচাচ্ছেন—ছোট তোরা কোথায় গেলি? হিগিনস তাড়াতাড়ি দু’হাতে সব মুছে বললেন, ছোটবাবু শিগগির ওপরে চল। উঠতে উঠতে বললেন, তোমাকে একটু শক্ত হতে হবে ছোটবাবু।

ছোটবাবু কেমন জেদি বালকের মতো নিচে দাঁড়িয়ে থাকল।

হিগিনস টর্চের ফোকাসে দেখলেন ছোটবাবু তেমনি দাঁড়িয়ে আছে। উঠে আসছে না। তিনি খুব সতর্ক গলায় বললেন, অন্ধকারে ভয় পাবে ছোটবাবু। শিগগির উঠে এস।

ছোটবাবু বলল, স্যার আপনি আমাকে দিয়ে কি করাতে চাইছেন? আপনি চলে যান।

হিগিনস ফের নিচে নেমে বললেন, পরে বলব। সব তোমাকে বলব ছোটবাবু। তুমি প্লিজ মুখ গোমড়া করে রাখবে না। বনি টের পেলে আমার কিছু আর করার থাকবে না। আমাদের ওরা খুঁজছে।

গলার স্বর এত অসহায়! এত তিনি অসহায় ছোটবাবু যেন এই জাহাজে প্রথম টের পেল। সে আর বিন্দুমাত্র দেরি করল না। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে কশপের ঘরে এসে প্রথম সাড়া দিল, আমরা এখানে বনি। চাচা, আমরা এখানে কাঠ খুঁজছি।

বনি কশপের ঘরে ঢুকে একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাবার ওপরে—কোথায় ছিলে! টেবিলে খাবার কখন সাজিয়ে রেখেছি—তোমাদের কারো পাত্তা নেই।

ছোটবাবুর সকাল থেকে এত বেশি উৎকণ্ঠা ছিল, এত বেশি উত্তেজনা ছিল যে মনেই হয়নি সে মাত্র এক কাপ চা খেয়ে আছে। ক্ষুধায় পেট জ্বলছে, যেন দাবানল এবং সে আর একটা কথা না বলে বের হয়ে এল। কি মুক্ত আকাশ আর সমুদ্র! জাহাজের ভেতর এমন ভয়াবহ সব জায়গা আছে সে কখনও জানত না।

খেতে বসে হিগিনস বললেন, বুঝলে ছোটবাবু গুডমেন ইট টু লিভ ব্যাড মেন লিভ টু ইট। দু’টো চাপাটি দু’টো আলুসেদ্ধ দুপুরের লাঞ্চ। ছোটবাবু জলখাবারের মতো প্রায় গিলে খেয়ে ফেলল। খিদে একেবারে যাচ্ছে না। সে ঢকঢক করে জল খাচ্ছিল—তখন স্যালি হিগিনস তাঁর দু’টো আলুসেদ্ধ এবং একটা চাপাটি ওর পাতে তুলে দিলেন। বললেন, খাও ছোটবাবু। ছোটবাবু বলল, আপনি এ- সব কি আরম্ভ করেছেন স্যার!

সারেঙ-সাব ভেতরে একসঙ্গে খেতে লজ্জা পাচ্ছিলেন। তিনি তাঁর খাবার ডেকে নিয়ে গেছেন। বনি একেবারে এরই মধ্যে যতটা পারা যায় সেজেগুজে এসেছে। সে পাশে বসে খাচ্ছিল। ছোটবাবুর যা শরীর ওরও ইচ্ছে করছে—ছোটবাবুর জন্য কিছু তুলে দেয়—কিন্তু সে জানে ছোটবাবু হয়তো খাবার ফেলে উঠে চলে যাবে। বাবা দিয়েছে বলে ঘাড় গুঁজে খেয়ে উঠেছে। এবং বনি দেখল ছোটবাবুর মুখ কেমন ভারী শুকনো। ছোটবাবু কেন যে বাবা জাহাজে থাকতে এত দুশ্চিন্তা করছে। বাবা ক্রমশ রোগা হয়ে যাচ্ছেন এবং বাবাকে দেখলেই বোঝা যায় আর তিনি আগের মতো নেই। চোখে মুখে যদিও হাসিটুকু তেমনি আছে তবু কোথায় যেন তিনি জোর হারিয়ে ফেলেছেন।

ছোটবাবু বোট-ডেকে উঠে আবার সেই বিন্দুবৎ প্রবাল দ্বীপটিপ যদি চোখে দেখতে পায়—সে এগিয়ে যেতে থাকল, রেলিঙে ঝুঁকে দাঁড়াল—কি কঠিন আর বিভীষিকার সমুদ্র ক্রমে চোখে ইতস্তত পাক খাচ্ছে—কেমন সামনে দুলে উঠছে সবকিছু—সেই প্রবাল দ্বীপ অথবা ক্রস কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সকাল থেকে সব অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছেন কাপ্তান। কেন যে তিনি এ-সব বলছেন—আর থেকে থেকে চিৎকার করে উঠছেন—হ্যালেলুজা অর্থাৎ জয় জগদীশ হরে। কখন বুড়ো মানুষটা চুপি- চুপি সারেঙকে ডেকে নিয়ে গেছেন। আড়ালে কিসব শলাপরামর্শ করেছেন। এবং সারেঙ-সাব যখন বোটডেক থেকে নেমে এলেন মুখ ফ্যাকাশে, যেন ওঁর ফাঁসির হুকুম হয়েছে। চোখ স্থির। অতিশয় চুপচাপ তিনি হেঁটে যাচ্ছিলেন। ছোটবাবু ডাকল, চাচা!

তখন হিগিনস ডাকলেন, ছোটবাবু এদিকে এস।

ছোটবাবু দেখল, তিনি সব কাঠ বিছিয়ে দিচ্ছেন। করাত চালাচ্ছেন। ছোটবাবুকে একটি র্যাঁদা দিয়ে বললেন, চালাও। সারেঙ-সাব বোটে উঠে গেছেন—সব গিয়ার নিচে নামিয়ে রাখছেন। এবং কাঠের লাইনিং সেরে নেওয়া হচ্ছে। আর হিগিনস কাজের ফাঁকে ফাঁকে কথা বলে যাচ্ছেন। একজন বুড়ো মানুষ যেভাবে তার সন্তানসন্ততিকে তীর্থে যাবার আগে বলে থাকে—তেমনি কথা বলে যাচ্ছেন। যেন মানুষটা প্রবাসে যাবার আগে বলে যাচ্ছেন, বুঝলে হে—পাপের প্রতি মানুষের ভারী প্রলোভন। তিনি হাতুড়ির কাঠ ঢিলে হয়ে যাওয়ায় ডেকে বার বার ঠুকছিলেন। ছোটবাবুর র্যাঁদায় খসখস শব্দ হচ্ছে। হিগিনস এবার সোজা হয়ে বললেন, ছোটবাবু তুমি কি কি ধর্মগ্রন্থ পড়েছ?

—রামায়ণ মহাভারত পড়েছি স্যার।

তোমাকে আমি বাইবেল দেব। তুমি পড়বে। প্রত্যেক মানুষের সব ধর্মগ্রন্থগুলো পড়ে ফেলা উচিত।

সে বলল, পড়ব স্যার।

স্যালি হিগিনস খাকি রঙের হাফ-প্যান্ট পরেছেন। গায়ে স্যাণ্ডো গেঞ্জি। এবং ভীষণ লম্বা বলে, আর চোখে গোল চশমা বলে গালে সাদা দাড়ি বলে কখনও কখনও তাঁকে ধার্মিক মানুষ মনে হচ্ছিল। তিনি যখন রাতে স্লিপিং গাউন পরে থাকেন অর্থাৎ সমুদ্রে ঠাণ্ডা বাতাস বইলে তিনি যখন বেশ লম্বা পোশাক পরেন তাঁকে সান্তাক্লজ না ভেবে পারা যায় না। তিনি এখন একটা কাঠ সোজা দাঁড় করিয়ে কতটা উঁচু দেখছেন। দেখতে দেখতে তিনি কিছু পাপ এবং লোভের গল্প বললেন। তার পরিণতির গল্প বললেন। তারপর সামান্য সময় কান থেকে পেনসিল বের করে প্রায় একজন ছুতোর মিস্ত্রির মতো কি সব রেখা টেনে গেলেন, তাকালেন ছোটবাবুর দিকে—এ-সব গল্প শুনে ছোটবাবুর মুখে চোখে কি প্রতিক্রিয়া হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করতে করতে এক সময় বলে ফেললেন, ডিয়ার ফ্রেণ্ড ডোন্ট লেট দিস ব্যাড একজামপল ইনফ্লুয়েন্স ইউ। ফলো ওনলি হোয়াট ইজ গুড। রিমেম্বার দ্যাট দোজ ডু হোয়াট ইজ রাইট প্রুভ দ্যাট দে আর গডস চিলড্রেন; অ্যাণ্ড দোজ হু কনটিনিউ ইন ইভিল প্রুভ দ্যাট. দে আর ফার ফ্রম গড।

ছোটবাবু বুঝতে পারছিল, চরম পরিণতির দিকে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। সে বলল, স্যার আমি ছবিতে বাইবেলের কিছু গল্প দেখেছিলাম। একটা ব্যাপার ভারী আশ্চর্য মনে হল—মাঝে মাঝে এটা আমি স্বপ্নেও দেখি—সেই মরুভূমির ভেতর সব মানুষেরা হেঁটে যাচ্ছে। তাদের পিঠে অতিকায় ক্রস। ছবিতে এটা দেখে কখনও ভুলতে পারিনি ভাল বুঝতেও পারিনি।

তিনি চিৎকার করে উঠলেন ফের—হ্যালেলুজা! তারপর কাঠে পেরেক ঠুকতে ঠুকতে বললেন, সাফারিঙস। সাফারিঙস অফ ম্যানকাইণ্ড। মানুষ তার সবকিছুর জন্য দায়ী সে নিজে। যা কিছু সে বিনিয়োগ করবে লাভালাভ তার ওপর বর্তাবে। সে নিজেই তার ক্রস বহন করে নিয়ে যায়। সে নিজেই রচনা করে তার বধ্যভূমি। শৈশব থেকে যৌবনে এবং যৌবনকাল পার হলে প্রৌঢ় বয়সে সে দেখতে পায় এতদিনের যা কিছু প্রয়াস সব এক সুন্দর নীল উপত্যাকাতে তার নিজের বধ্যভূমি তৈরিতে কেটে গেছে। জনগণেরা এবার হাততালি দিলে গলায় দড়িটা পরে ফেলবে। তারপর সব শেষ—শুধু থাকে নীলবর্ণের এক আলোর ভূখণ্ড। বুঝতে পারছ আমাদের তা হলে কিছুই নেই। এত সুখ এত দুঃখ সবই তাঁর। তিনিই সব। সো প্রেইজ দ্যা লর্ড। হাউ গুড ইট ইজ টু সিং হিজ প্রেইজেস! হাউ ডিলাইটফুল, অ্যাণ্ড হাউ রাইট।

বনি তখন ওপরে উঠে এসেছে।

বাবাকে ভীষণ উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। বাবা কাঠগুলো পালিশ করছেন। সারেঙ ছোট ছোট সব কাঠের লাইনিং মেরে দিচ্ছে বোটে। সব ড্রাই ফুডের প্যাকেট নামিয়ে রেখেছে। পরিচ্ছন্ন নীল আকাশ। গরম নেই তেমন। পরিচ্ছন্ন আকাশের নিচে এখন একটু সময় পেয়ে গেছে বনি। সে চুল আঁচড়াচ্ছে। ওর সুন্দর নীলাভ চুলে ক্রিম ঘষে দিচ্ছে। সামনে সে রেখেছে ছোট্ট আয়না। সে ক্ষণে ক্ষণে পোশাক পাল্টাচ্ছে। বাবাকে, ছোটবাবুকে দূর থেকে দু’টো-একটা কথা বলে আবার চুলে ক্রিম ঘষছে। কেবিনের অন্ধকারে ভালো কিছু দেখা যায় না। বাবা ছোটবাবু সারেঙ সারাদিন কেবল বোট-ডেকে খুট খুট করে কাঠ কাটছে, পেরেক পুঁতে দিচ্ছে কাঠে এবং আশ্চর্য বনি সন্ধ্যায় দেখল বাবা বেশ বড় দু’টো ক্রস বানিয়ে ফেলেছেন। ক্রস দেখে সে কেমন ভয় পেয়ে গেল। বলল, বাবা এ-দিয়ে কি হবে?

তিনি ভয়ে মেয়ের দিকে তাকাতে পারলেন না। তিনি গজ ফিতে সব তুলে রাখছেন। সারেঙের পক্ষে একা কাজ শেষ করা কঠিন। এবার তিনি ছোটবাবুকে নিয়ে বোটের কাছে এসে দাঁড়ালেন। বনিকে তিনি কিছু বললেন না। অথবা কি বললে বনি আপাতত শান্ত থাকবে কি বললে বনি বুঝতে পারবে না দ্য টাইম হ্যাজ কাম্‌—ভেবে ভেবে তিনি যখন দেখলেন বনি কিছুতেই যাচ্ছে না তখন বাধ্য হয়ে বললেন, জায়গাটা ভাল না বনি। খারাপ জায়গা। শয়তানের প্রভাবে পড়ে যেতে পারি। ক্রস দু’টো জাহাজের মাথায় দাঁড় করিয়ে দিলাম। এবার দেখি কার কত সাহস?

ছোটবাবু তখন লোহার সরু জালের ওপর ত্রিপল ফেলে দিচ্ছে। বোটের ওপর হুড খোলা গাড়ির মতো এই ত্রিপল কাজ করবে। ঝড়বৃষ্টিতে হুড টেনে দিলে প্রায় নৌকার ছই, সমুদ্রে বোট ভেসে গেলে ঝড়বৃষ্টিতে সামান্য আশ্রয়। জাহাজ তবে সত্যি অশুভ প্রভাবে পড়ে যেতে পারে—বাবা ক্রস দু’টো বানিয়ে ভাল করেছেন। ক্রস থাকলে জাহাজে অশুভ প্রভাব ভিড়তে সাহস পাবে না। সে খুব নিশ্চিন্তে ঘরে ঘরে আলো জ্বালাবার জন্য নিচে নেমে গেল। সে ঘরে ঘরে লম্ফ জ্বেলে দিয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *