1 of 2

অলৌকিক জলযান – ৫০

।। পঞ্চাশ ॥

জাহাজ তেমনি সমুদ্রে ভাসমান। মাস্তুলে তেমনি জ্বলছে মশাল। ভারী নিভৃতে যেন জাহাজটা অজানা সমুদ্রে পালিয়ে আছে। পৃথিবীর সব সংযোগ হারিয়ে চুপচাপ নিশিদিন বেশ আছে সে—মনের সুখে সমুদ্রে ভেসে বেড়াচ্ছে। ক্রমে জ্যোৎস্না আরও মনোহারিণী। নক্ষত্রে অধীর কুহেলিকা। এবং আকাশ সমুদ্র কোনো মরুভূমির মতো দায়দায়িত্বহীন। এতগুলো মহাপ্রাণ এই মহাসমুদ্রে এবং মহাকাশের ভেতর অবরুদ্ধ—তাদের কিছু আসে যায় না।

ছোটবাবু বোটের নিচে শুয়ে ছিল। ওপরে যে বিস্তৃত আকাশ এবং নক্ষত্রমালা সেখানে ওর মতো কেউ যদি শুয়ে থাকে তবে দেখতে পাবে মাথার ওপরে আকাশের মতো স্থির সমুদ্র। জলরাশি নীল নীহারিকার সামিল। জাহাজ কাগজের নৌকোর মতো ভেসে ভেসে যাচ্ছে। কি যে হয়, মনে হয় দু’হাতে আকাশ ফাঁক করে কেউ যেন এক্ষুনি উঁকি দেবে—কি ছোটবাবু তুমি শুয়ে আছ? এবং যতবার চেষ্টা করছে, সেই আকাশ ছিঁড়ে যার মুখ দেখতে পাবে সে বনি। যেন বনি ক্রমে দূরবর্তী কোনো নীহারিকা- পুঞ্জের মতো অস্পষ্ট। অবিরাম সে আকাশ ছিঁড়ে ছিঁড়ে নেমে আসতে চাইছে তার কাছে। সে কিছুতেই আর বাঁধা দিতে পারছে না।

জাহাজে সবাই যে যার ফোকসালে অথবা কেবিনে, কেউ কেউ বাংকে, কেউ ফল্কায় মাদুর পেতে শুয়ে আছে; অতীব এক কঠিন নিশুতি রাত। কলকল ছলছল শব্দ শুধু জলের। ছোট ছোট সব ঢেউ জাহাজটাকে নিয়ে বুঝি এখন খেলা করছে। সামান্য বাতাস উঠে আসছে সমুদ্র থেকে। আর সেই মশালের আলো প্রায় কখনও স্থির কখনও তির্-তির্ করে কাঁপছে। নিচে দু’একজন মানুষ ফল্কায় ঘুমোচ্ছে কি জেগে আছে সে বুঝতে পারছে না। আগামীকাল সেল করতে হবে। কাপ্তান সবাইকে ছুটি দিয়ে দিয়েছেন। যেহেতু কাল সবাইকে অজানা এক সমুদ্রে নেমে যেতে হবে, বোটে যেহেতু ঘুমোবার কোনো তেমন বন্দোবস্ত থাকবে না, যতটা পারা যায় এক্ষুনি ঘুমিয়ে নেয়া দরকার—এবং এসব ভেবে তিনি কড়া হুকুম জারি করেছেন—যার যার সামান সকালে ঠিক করে নেবেন, শুধু যতটুকু পারা যায় শেষবারের মতো ঘুমিয়ে নিন। যেন বলতে চেয়েছিলেন, নির্ভর করার মতো এই শেষ আশ্রয়। তাও আপনারা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন!

ছোটবাবু এখন বোটের নিচে শুয়ে আছে। কড়া হুকুম সত্ত্বেও অন্ধকারে পালিয়ে এসেছিল বন্ধু, জব্বার মনু এবং এভাবে প্রায় অনেকে খুব নিচু গলায় ওরা অন্ধকারে বসে বলেছিল, ছোটবাবু তুই এমন আহাম্মক! তুই কি রে! তোর কি ভয়ডর বলে কিছু নেই। সবাই জাহাজ ছেড়ে দিচ্ছে—আর তুই কাপ্তানের শয়তানিতে ভুলে গেলি! তুই কি বলতে চাস—খুব বিশ্বাসী তুই। তুই কি বলতে চাস বড়-মালোম মেজ-মালোম তোর চেয়ে কম বোঝে! এভাবে যারা তার প্রিয় সবাই প্রায় অন্ধকারে লুকিয়ে ওর কেবিনে দেখা করতে এসেছিল। ওরা ওকে বলতে এসেছিল- —একজন মাথা খারাপ কাপ্তানের সঙ্গে থেকে যাওয়া ঠিক না। কিন্তু সবাইকে সে বুঝিয়েছিল সে যা করেছে ঠিকই করেছে। কেবল ডেবিডকে সে পারেনি। ডেবিড নিজেও ঘুমোচ্ছিল না। ক্ষণে ক্ষণে অন্ধকারে এসে ডাকছে, ছোটবাবু তুমি আমার কথা রাখো। তোমার মা-বাবার কথা ভাবো। ভাইবোনদের মুখ মনে পড়ছে না! ওরা তোমার আশায় রয়েছে—একদিন না একদিন তুমি দেশে ফিরবে।

ছোটবাবু হেসেছিল। সে বলতে পারত ডেবিডকে, সঠিক আমি কিছু জানি না। তবু আমি এটুকু বুঝি তিনি সবচেয়ে বেশি প্রাজ্ঞ। একজন প্রাজ্ঞ মানুষের সঙ্গে থেকে যাওয়া অনেক বেশি বুদ্ধিমানের কাজ।

সে শুধু বলেছিল, ডেবিড তুমি ঘুমোতে যাও। খুব সকালে আবার তোমাদের উঠতে হবে। ডেবিড বারবার ছুটে এসেছিল, ছোটবাবু তোমাকে ফেলে যাই কি করে বলত। তারপর দু’ হাত ধরে বলেছিল, ছোটবাবু তোমাকে ফেলে গেলে আমি শান্তি পাব না। আমার খুব কষ্ট হবে ছোটবাবু। অন্ধকারে ওরা দু’জনে চুপচাপ বসে থেকেছিল। ডেবিড কিছুতেই ঘুমোতে যাচ্ছে না। সে বাধ্য হয়ে বলেছিল, আমার কাজ আছে ওপরে। আমি যাচ্ছি। এখন ওপরে যা কিছু কাজ দরকার হলে রাতে আমাকেই করতে হবে। এবং এভাবে কাপ্তানের নাম করে সে ওপরে উঠে এসেছে। ডেবিড ওপরে আসতে সাহস পাচ্ছে না। কাপ্তানের কাছে সে ফের মুখ দেখাবে কি করে—এবং এমন সব প্রতিকূল চিন্তাভাবনা ডেবিডের ভেতর আছে সে জানত। প্রায় আত্মগোপনের মতো আছে সে। ডেবিড নিজেও ঘুমোচ্ছিল না। ওকেও ঘুমোতে দিচ্ছিল না। সে এখানে চুপচাপ শুয়ে ঘুমোবে ভেবেছিল। কিন্তু ঘুম আসছে না। চোখের ওপর আকাশ আর নক্ষত্র কেবল দুলছে। আকাশ দুলে উঠলেই বুঝতে পারে সমুদ্র সামান্য মাতাল হয়েছে। সুতরাং আকাশ এবং নক্ষত্রমালা তার চোখের ওপর দুলছে। পাশে বনির কেবিন। অন্ধকার কেবিনে বনি শুয়ে আছে। যেন কান পাতলে সে বনির নিঃশ্বাসের শব্দ পাবে। সে কিছুতেই ঘুমোতে পারছে না। জাহাজে কেউ ঘুমোতে পারছে না—সকালে নেমে যাবে সবাই। সব লম্ফ স্যালি হিগিনস জমা নিয়েছেন। কেউ যে লম্ফ জ্বালিয়ে কি কি নেবে সঙ্গে রাত জেগে খুঁজবে তারও উপায় নেই। সামান্য যে তেল অবশিষ্ট তা তিনি সীল করে দিয়েছেন। সন্ধ্যার পর থেকে যে যার খুশিমতো মশাল জ্বালিয়েছে—প্রায় উপদ্রবের সামিল উচ্ছৃঙ্খল আচার-আচরণ এবং ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সবাই আর একটা কথা বলেনি। ডেক খালি করে নিচে নেমে গেছে। আর মনে হচ্ছে অন্ধকারে সবাই হাতড়াচ্ছে কোথায় কে কি রেখেছে। কেউ ঘুমোতে পারছে না। ছোটবাবু এখানে পালিয়ে এসেছে একটু ঘুমোবে বলে তারও ঘুম আসছিল না। তারপর ভোর রাতের দিকে কখন সে ঘুমিয়ে পড়েছিল টের পায় নি।

সকালে জাহাজিদের দেখে মনে হল না ওরা কোনো বিভীষিকার ভেতর আছে। যেন খুব কাছে বন্দর। জাহাজ বন্দরে লাগবে—বন্দরে ওরা নেমে যাবে। অথবা মনে হয় জাহাজ হোমে ফিরে যাচ্ছে। বোটে ভেসে গেলেই সেই মাঠ এবং শস্যক্ষেত্র দেখতে পাবে তারা। সবাই যে যার পেটি এবং বাসো সকাল থেকে গোছাচ্ছে। নামার আগে সবার রেশন একসঙ্গে করে নেয়া হয়েছে। জাহাজে দু’টো র‍্যাফট আছে। চিফ-মেট র‍্যাফট দু’টোর জন্য স্যালি হিগিনসকে অনুরোধ জানিয়েছে এবং কথা আছে তিনটে বোট যাবে। স্যালি হিগিনস নিজের জন্য একটা রেখেছেন। যদিও তিনি এক-নম্বর বোট রাখতে পারতেন ওটা তাঁর বোট এবং যেহেতু বোট মোটরে চলে, রেখে দিলে স্বার্থপরের মতো দেখাবে। তিনি তাঁর বোট দিয়ে চার-নম্বর বোট পরিবর্তে চেয়ে নিলেন। একটা বোট কাপ্তানের জন্য রাখা দরকার। যাক সব ক’টা বোটই যে তিনি শেষ পর্যন্ত দিয়ে দেননি—এবং চিফ-মেট যেন একটু নিশ্চিন্ত—সে দৌড়ে দৌড়ে কোথায় কি লাগবে দেখছে। র‍্যাফট দু’টো মোটর-বোটের পেছনে বেঁধে নেওয়া হবে। তবে কাঠের পাটাতন বলে জল কেটে ঠিক ভেসে যেতে পারবে না, সেন্টার-বোর্ড লাগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। কারপেন্টার সকাল থেকে কাঠ কেটে সেণ্টার-বোর্ড লাগিয়ে দিচ্ছে। দু’পাশে ঠিক জল কেটে তবে র‍্যাফট দু’টো বোটের সঙ্গে সমান তালে চলতে পারবে। র‍্যাফট দু’টোকে টানতে বোটের অসুবিধা হবে না। বোধহয় ছোটবাবুর করাতে কাঠ কাটার শব্দে ঘুম ভেঙে গেছিল। বেশ বেলা হয়ে গেছে। ঘুম থেকে উঠে ওর কেন যেন মনে হচ্ছিল—সব স্বাভাবিক হয়ে গেছে। ডেকে সবাই ঠিক আগের মতো ছুটোছুটি করছে, তেমনি তেল বার্নিশের গন্ধ। তেমনি মনে হচ্ছিল ডেক-জাহাজিরা রঙের টব হাতে নিয়ে রং করতে যাচ্ছে জাহাজে। ওয়াচে যাচ্ছে মৈত্রদা, সে উইনচের নিচে কাজ করছে। বন্দর আসছে ডাঙা দেখা যাচ্ছে এমন যেন কেউ হাত তুলে বলছে। জাহাজটা ভাঙা অচল, এক অজানা সমুদ্রে তারা ভেসে বেড়াচ্ছে ছোটবাবুর যেন ঘুম থেকে উঠে একেবারেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। বুঝি বনি এই মাত্র ডাকবে, ছোটবাবু কিনারায় যাবে? ডেবিড তুমি আমি। জাহাজের মানুষগুলো কি যে স্বাভাবিক হয়ে গেছে মুহূর্তের জন্যে।

কেবল চিফ-মেট জানে, ডেবিড এবং থার্ড-মেট বুঝতে পারে কি ভীষণ দুঃসাহসিক এই অভিযান। এখন একে অভিযান ভাবাই ঠিক হবে। এবং কে কি নিতে পারবে তার লিস্ট স্যালি হিগিনস নিচে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এবং তিনি জাহাজের সর্বত্র এই যেমন বোট খালি করে দেখে নিতে বলছেন অর্থাৎ বোট নামিয়ে দেখা দরকার কোথাও কোনো ফুটোফাটা আছে কিনা। শুকনো খাবার সব ঠিকঠাক আছে কিনা। র‍্যাফট দু’টোতে ওরা বোঝাই করছে এখন ওদের বাকি রেশন। কাপ্তান স্টোর-রুমে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে যার যা রেশন সমান ভাগে দিয়ে দিচ্ছেন। এগুলো দড়ি দিয়ে এখন নিচে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। র‍্যাফটের চারপাশে কাঠ লাগিয়ে নেওয়া হয়েছে। একটা চৌকোনা বড় ভাসমান বাসোর মতো দেখতে এবং যেহেতু সেন্টার-বোর্ড লাগিয়ে নেওয়া হয়েছে সেজন্য জলের ওপর কাৎ হয়ে যাচ্ছে না। বরং দুলে দুলে দু’টো র‍্যাফট যেন জলের ওপর মাতালের মতো টলছে।

সকালে শেষ চর্বি ভাজা রুটির গন্ধ পাওয়া গেল। দুপুরে শেষ চাল ডাল সেদ্ধ খিচুড়ির গন্ধ পাওয়া গেল। সবাই ডেকের ওপর বসে গেছে। যেহেতু চাল ডাল শুকনো এবং পচে যায় না, জাহাজে শুধু চাল ডাল অবশিষ্ট। রেশন বলতে এখন এই চাল ডাল কিছু টিন ফুড। টিন-ফুড অফিসারদের রেশন। জ্যাম জেলি কিছু আছে। পচা খাবার শেষ পর্যন্ত পচতে পারেনি। স্যালি হিগিনসের হুকুমে সবাই এতদিন জাহাজে শুধু মাংস খেয়ে জীবনধারণ করেছে। তারপর ফলমুল। এবং এই চাল ডাল যেহেতু শেষদিনের সম্বল তিনি খুব কিপটের মতো টিপে টিপে খরচ করেছেন। আজ সেই মানুষ খুব অমায়িক। পেট-ভরে খাবার। অর্থাৎ যাবার আগে কতদিন পর পেট ভরে খাবার যেন। চাল- ডাল সেদ্ধ পাতলা প্রায় স্যুপের সামিল করে দেওয়া হয়েছে সাহেবদের—যেন সবাই সমুদ্রে ছুটির দিন কাটাতে এসেছে—কথাবার্তায় ছোটবাবুর এমনই মনে হচ্ছে। বনির জন্য ছোটবাবু আরও এক বাটি স্যুপ চেয়ে নিয়েছে। কেন জানি অন্যদিনের চেয়ে পাতলা খিচুড়িটা খেতে আজ বেশি মনোরম। সামান্য এলাচ দানা ফেলে দেওয়া হয়েছে। ছোটবাবু একটা পোড়া শুকনো লংকা পেয়ে গেল। আরে, একটুকরো আলু। মেপে দেওয়া হচ্ছে না। যার যত লাগে খাও। ভাবা যায় না। ষাট-পঁয়ষট্টি জন জাহাজি ডেকের ওপর পাত পেতে খাচ্ছে। বন্ধু একটা বড় রকমের ঢেকুর তুলছে। ওর যেমন স্বভাব খেয়ে-দেয়ে হাত চাটা, আজ আবার অনেক দিন পর সে হাত চাটছে। পিছিলে হাত ধোওয়া যাচ্ছে না। জল পরিমাপ মতো আছে। এনজিন-সারেঙ সবাইকে এক মগ করে জল দিচ্ছে—হাত ধোওয়া এবং খাওয়া, একবিন্দু বেশি চাইলে পাওয়া যাবে না।

স্যালি হিগিনস, চিফ-মেট স্যামুয়েল, সেকেন্ড-মেট ডেবিড এবং থার্ড-মেট, তাছাড়া এনজিনিয়ার তিনজন এবং ছোটবাবু সবার সঙ্গে আজ এক লপ্তে বসে খেয়েছে। সবকিছু স্যালি হিগিনসের নির্দেশমতো হচ্ছে। কে বলবে গতকাল এই মানুষ ভীষণ অহংকারী ছিলেন, ভয়ে ওপরে উঠে কেউ কথা বলতে পর্যন্ত সাহস পায় নি। আজ এই মুহূর্তে মানুষটা একেবারে অন্যরকম। চিফ-মেটকে এক দন্ড ফুরসৎ দিচ্ছেন না। সারাক্ষণ একজন পরিবারের অভিভাবকের মতো তিনি। কে কি নিতে ভুল করেছে, বোটে কি আছে, আর কি লাগবে? সামান কি কি যাবে, কি কি যাবে না? যতটা পারা যায় খাবার আর জল। কিন্তু ইচ্ছে করলেই খাবার আর জল প্রচুর দেওয়া যাচ্ছে না। তবু বড় বড় চারটে ড্রাম ভর্তি করে জল নিচে নামানো হচ্ছে! বলতে গেলে দুটো র‍্যাফটের একটাতে খাবার, অন্যটাতে জল। প্রথম বোট আগে দু’নম্বর বোট পেছনে, তার পেছনে তিন-নম্বর বোট এবং একেবারে শেষে র‍্যাফট দু’টো। হাসিলে বাঁধা থাকবে একের পর এক। ঝড়ে-ঝঞ্ঝায় অথবা যখন খাবার, জল সব ফুরিয়ে আসবে- কেবল উত্তপ্ত জলরাশি আর সমুদ্রের মরীচিকা বাদে কিছু দেখা যাবে না, তখন যেন চিফ-মেট স্যামুয়েল অন্তত চিৎকার করে সবাইকে বলতে পারেন—দ্য লর্ড ইজ আওয়ার স্ট্রেংথ অ্যান্ড আওয়ার প্রেইজ। কারণ এতগুলো মানুষকে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব এখন থেকে তার। তাদের ভরসা-নির্ভর বলতে সে। ঈশ্বরের নামে সব ভেঙে-পড়া জাহাজিদের প্রাণে সাহস সঞ্চার করতে না পারলে পরস্পর মাংস খুবলে খাবে। তিনি স্যামুয়েলকে শেষ পর্যন্ত নিভৃতে ঘরে ডেকে নিলেন। সবাই দাঁড়িয়ে বোট-ডেকে। তিনটে বোট নিচে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। সূর্য সমুদ্রে হেলে পড়েছে। সঙ্গে কেউ বিশেষ কিছু নিতে পারছে না। সামান ছোটবাবুর জিম্মায় রেখে ঠিকানা রেখে গেছে সবাই। ছোটবাবু দেশে ফিরে গেলে সব সামান যেন নিয়ে যায়। ডেবিড একটা কথা বলছে না। ছোটবাবুর দিকে তাকাচ্ছে না ডেবিড। সে রেলিঙে একাকী চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ওকে খুব দুঃখী এবং বিষণ্ন দেখাচ্ছে।

স্যামুয়েল আগে নেমে আসছে। পেছনে স্যালি হিগিনস। ছোটখাটো একটা বক্তৃতা করবেন বোধহয়। এতক্ষণ ওরা ভেতরে কি যে করছিল! সময় হাতে কম। স্যামুয়েল বার বার শেষবার অনুরোধ করেছিল, স্যার সবার হয়ে আমার অনুরোধ, একবার যদি ভেবে দেখতেন জাহাজে এভাবে থেকে যাওয়া আপনাদের উচিত হচ্ছে কিনা। স্যামুয়েলের কথায় তিনি বিন্দুমাত্র দুঃখ অথবা রাগ প্রকাশ করেননি। স্বার্থপরের মত ওরা নেমে যাচ্ছে। এখন তাঁকেও অনুরোধ করছে ছোটবাবু, জ্যাক, এনজিন-সারেঙকে নিয়ে নেমে যেতে। তিনি স্যামুয়েলকে ভীষণ অমায়িক গলায় এতক্ষণ বুঝিয়েছেন। স্যামুয়েল মনে কোন দুঃখ রাখবে না এমন বলছেন। আমি তো ওকে ছেড়ে যেতে পারি না। এত দিনের বিশ্বস্ত জাহাজ এমন বলতে পারতেন অথচ সে-রকম কিছু তিনি বলেননি। স্যামুয়েল বুঝেছিল নিরর্থক। সে শেষ পর্যন্ত নেমে এসেছে। পেছনে স্যালি হিগিনস নেমে এলে ফাইলে সবাই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকল। তিনি সবার সঙ্গে হ্যান্ড-শেক করলেন। কথা বললেন দু’টো-একটা। তোমরা তাহলে সবাই অন্ ইওর ওন হয়ে।

স্যালি হিগিনসের গায়ে পুরো কাপ্তানের পোশাক। সাদা হাফ-শার্ট, সাদা হাফ-প্যান্ট, সাদা মোজা, সাদা জুতো, নীল রঙের এংকারের টুপি। সোনালী স্ট্রাইপ কাঁধে ঝকঝক করছে তেমনি। মুখে সাদা দাড়ি। তিনি ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছিলেন। বলছিলেন, এখন আপনাদের আমি শুধু একটা কথাই বলতে পারি—ঈশ্বর মঙ্গলময়। তাঁর করুণার শেষ নেই। সব হারালেও তাঁর ওপর আপনারা বিশ্বাস হারাবেন না। এইটুকু বলে হাত তুলে দিলেন। যেন সেই বলা—হাই। বিদায়। বিদায় বন্ধুগণ।

তারপরের দৃশ্য দেখা যায় না। নেমে যাবার আগে ডেবিড ছোটবাবুর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতে এসে একেবারে ভেঙে পড়ল। সে ছোটবাবুকে জড়িয়ে কাঁদছে। ছোটবাবু তুমি কোথাকার ছোটবাবু জানি না, তুমি যদি বেঁচে থাক যদি আমি বেঁচে থাকি দেখা হবে। ঠিক দেখা হবে ছোটবাবু। দেশের অনেক কিছু ভুলে ছিলাম হে ছোটবাবু! তুমি আমার পাশে ছিলে এতদিন। এখন আমার তাও থাকল না। এবং বঙ্কু আর যারা যেখানে ছিল সবাই এনজিন-সারেঙ ও ছোটবাবুর সঙ্গে আলিঙ্গন করে গেল। ওরা নেমে গেল বোটে। স্যালি হিগিনসও দড়ি ধরে নেমে গেলেন। কেন যে বুড়ো মানুষটা এমনভাবে নেমে যাচ্ছেন! তিনি তিনটি বোটেই লাফিয়ে লাফিয়ে এ-মাথা ও-মাথায় হাঁটাহাঁটি করছেন। বোট দুলছে। সমুদ্রের জলে বোট ভীষণ দুলে উঠছে। কোথায় কি রাখা হয়েছে, ঠিকমতো রাখা হয়েছে কিনা, আচ্ছা স্যামুয়েল—সব গীয়ার তুমি এদিকটায় রেখেছ কেন? ভাগ ভাগ করে দাও, তা হলে তোমাদের বসতে সুবিধা হবে।

দু’নম্বর বোটে গিয়ে বললেন, ডেবিড়, কি মন খারাপ কেন? আরে আমরা দেখবে তোমাদের আগে পৌঁছে যাব। দ্যাখো না কে আগে যায়। তুমি ভাবছ আমাদের সমুদ্রে ফেলে যাচ্ছ। একদম এসব ভাববে না। ডেবিড নতজানু হয়ে গেল স্যালি হিগিনসের সামনে। মাথা নিচু করে বসে থাকলে স্যালি হিগিনস বললেন, তোমাদের বিশ্বস্ততার শেষ নেই ডেবিড। শেষ নেই। আবার আমাদের ব্যারি স্ট্রীটে দেখা হবে। তখন যদি তুমি মুখগোমড়া করে রাখ ত একদম তাড়িয়ে দেব।

ডেবিডের দু’চোখ বেয়ে শুধু জল ঝরছে। মহান ঐতিহ্যবাহী এই মানুষ। মানুষের সব বিশ্বস্ততার প্রতীক তিনি। তাঁকে সে গতকাল কি যে অপমান করেছিল! সে বলল, স্যার আমার মাথা ঠিক ছিল না।

তিনি বললেন, কারো থাকে না। তোমরা এভাবে বসেছ কেন? পাশাপাশি বস। দ্যাখো কত জায়গা। হিগিনস নিজ হাতে সব গুছিয়ে দিতে দিতে বললেন, আরে লণ্ঠনটা এত নিচে রেখেছ কেন? ওটা কাছে রাখো! হাতের কাছে দরকারের সময় খুঁজে পাবে না। দু’টো বাকেট। একটার ভেতরে আর একটা ভরে রাখো।

তারপর তিন-নম্বর বোটে উঠে গেলেন। সবাই উঠে দাঁড়ালে বললেন, বোস। আচ্ছা থার্ডমেট, তোমার অয়েল-ব্যাগ ঠিক আছে তো? খুব সাবধান। কেরোসিনের ফাইল?

—স্যার সব ঠিক আছে।

–ঠেলেঠুলে নিচে ঢুকিয়ে নাও। ওপরে কিছু রাখবে না। শেষে তিনি দড়ির সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলেন। ওরা চারজন—জ্যাক, ছোটবাবু, এনজিন-সারেঙ, স্যালি হিগিনস এবার সমুদ্রে আকাশের নিচে হাত তুলে দিলেন—দড়ি ফেলে দেওয়া হল নিচে। ওরা দড়ি লুফে তুলে নিল। মোটর-বোট দু’টোই গর্জে উঠল। জলের ভেতর সাদা ফেনা তুলে ধীরে ধীরে যেন একটা কনভয় গভীর সমুদ্রে ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। ওরা চারজন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। ওরা ক্রমে ছোট হয়ে যেতে থাকল। এবং বিন্দুবৎ হয়ে আসার মুখে ছোটবাবু দেখছে দূরে আবার একটা বিন্দু ক্রমশ এগিয়ে আসছে। ক্রমশ বড় হয়ে যাচ্ছে। সকাল হলেই এলবা কোথায় চলে যায়। সারাদিন পর সন্ধ্যা হলে এলবা ফিরে আসে। ছোটবাবু বুঝতে পারছে বিন্দুবৎ যে ভেসে আসছে বাতাসে সে এলবা, আর কেউ নয়। এলবা ক্রমশ আকাশের ওপর সেই অতিকায় পাখি হয়ে যাচ্ছে। ওরা চলে যাওয়ায় যে নিঃসঙ্গতা জাহাজে চেপে বসেছিল, এলবা যেন কক্-কক্ করে ডেকে মুহূর্তে সব দূরে সরিয়ে দিল। এলবার খাবার সে রেখে দিয়েছে। এলবাকে দেখেই নিচ থেকে খাবার ছোটবাবু নিয়ে এসে ডাকল, এল…বা। খেতে এস। এলবা দু-পাখা ছড়িয়ে এই প্রথম বোট-ডেকে একেবারে পায়ের কাছে উপুড় হয়ে পড়ল। আর গর্ গর্ করে সব খাবার গিলে ফেলতে থাকল।

এত কাছে থেকে ছোটবাবু এলবাকে যেন আর কখনো দেখে নি। কোনো ভয়ডর নেই এলবার। বনি আর সে দাঁড়িয়ে আছে। নিচে বড় একটা মাটির পাত্রে পাখিটার খাবার। পাখিটা আজ পেট ভরে খাবার পেয়েছে। কিছু পাতে পড়েছিলো কারো কারো। ছোটবাবু তাও তুলে রেখেছিল এলবার জন্য। এলবা খেতে খেতে দু’বার ঘাড় বাঁকিয়ে দেখেছে ওদের। পাখা ছড়িয়ে বসলে প্রায় বারো চোদ্দ ফিট লম্বা পাখা, এখন গুটিয়ে রেখেছে। গুটিয়ে রাখলে বোঝা যায় না বাতাসে ডানা মেলে দিলে কখনও এমন অতিকায় দেখাতে পারে। হাঁসের মতো ওর হলুদ রঙের পা পেটের দিকটা কি সাদা আর হাঁসের মতো নরম এবং যেন হাত দিলেই পাখিটা একটা ডিম পারবে। সোনালী রঙ সারা পিঠে ঠোঁট প্রায় কবুতরের মতো—আর কী গভীর নীল চোখ! ছোটবাবু আর বনির প্রতিবিম্ব চোখের মণিতে প্রায় এখন নাচানাচি করছে।

বনি বলল, কী পেট ভরেছে?

এলবা ঘাড় বাঁকিয়ে বনিকে দেখল। যেন বলছে, খুব। খুব খেলাম।

ছোটবাবু বলল, ওদের সঙ্গে গেলে না কেন?

এলবা খেতে গিয়ে যা আশে পাশে ছড়িয়ে পড়েছিল এখন ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে। ছোটবাবুর দিকে তাকাল না। ছোটবাবুর সঙ্গে কোন কথা বলল না।

বনি এবার ছোটবাবুকে জড়িয়ে ধরল আনন্দে, এলবা আমাকে বেশি ভালবাসে। এলবা তোমাকে ভালবাসে না।

ছোটবাবু বলল, বনি। প্লিজ। নিচে বুড়ো দাঁড়িয়ে আছে।

বনি তাড়াতাড়ি সরে দাঁড়াল। ওর মনেই থাকে না কেউ পাশে থাকতে পারে। এনজিন-সারেঙ আসছেন। স্যালি-হিগিনস উঠে আসছেন। পাখিটার খাওয়া শেষ। সে উড়ে যাচ্ছে। ছোটবাবু ডেক সাফ করে রাখছে। আর তখন সূর্য অস্ত যাবে। বোট অথবা কোনো কিছু আর সমুদ্রে ভেসে নেই। সেই একঘেয়ে আকাশ আর নক্ষত্র। সমুদ্রে জ্যোৎস্না। ঝাঁক ঝাঁক সব সামুদ্রিক মাছ। অতিকায় হাঙ্গর ছুটে যাচ্ছে, আর পেছনে সব পাইলট মাছ অথবা সেই সব র‍্যামোরা মাছের আস্তানা এখন জাহাজের পুরো খোলটা। জাহাজের খোলে বোধহয় ধীরে ধীরে শ্যাওলা গজাতে শুরু করেছে। কারণ জাহাজ থেমে থাকলে শ্যাওলায় ঢেকে যাবে খোলটা। ছোটবাবু বনির দিকে ভয়ে তাকাতে পারছে না।

আর তখন স্যালি হিগিনস বললেন, ছোটবাবু এদিকে এস। বনি এদিকে এস। বলে তিনি ওদের নিয়ে গোল হয়ে বসলেন। চুপচাপ। সমুদ্রে নিঃসঙ্গ চাঁদ, তার ছায়া জলে ভেসে যাচ্ছে।

ছোটবাবু বলল, স্যার ক্রোজ-নেস্টে আলো দিয়ে আসছি। ক্রোজ-নেস্টে মশালে আগুন দিয়ে আসছি সে বলতে পারত। কিন্তু আগুন দিয়ে আসছি কথাটার ভেতর কেমন অমঙ্গলজনক কথাবার্তা থাকে। বরং আলো দিয়ে আসছি কথাটা ভারী পবিত্রতায় ভরা। সেই সন্ধ্যার সময় শীতের মাঠে দাঁড়িয়ে শঙ্খের শব্দের মতো অথবা দূরে খুব দূরে কোনো মন্দিরে ঘন্টাধ্বনি হলে যা হয়ে থাকে—সেই এক সুদূর পবিত্রতা মনে মনে ছোটবাবু অনুভব করছিল। সে মাস্তুলে আলো জ্বেলে ফিরে এল। মাথার ওপরে চাঁদ আর সমুদ্রের ঘন নীল কুয়াশা ক্রমে অস্পষ্ট হয়ে আসছে। কেমন সেই অস্পষ্ট কুয়াশায় ওরা ঢেকে যাচ্ছিল। ছোটবাবু ফিরে না আসা পর্যন্ত স্যালি হিগিনস আরম্ভ করতে পারছিলেন না। সে এসে পাশে দাঁড়াতেই বললেন, বোস।

ডেক-চেয়ারে বসেছিলেন তিনি। প্রাচীনকালের কোনো মানুষের মতো, প্রফেট যেন তিনি। অর্থাৎ এমন মুখ গম্ভীর যেন এক্ষুনি তিনি বলবেন, ছোটবাবু কাল আমরা ডাঙা পাচ্ছি। কাল আমরা বন্দর পাব। সেখানে আমাদের জন্য থাকবে প্রচুর সুস্বাদু খাবার, থাকবে ঠান্ডা পানীয় এবং সুপেয় জলের হ্রদ। তুমি বনি সেই ঠান্ডা জলে সাঁতার কেটে দারুণ আরাম পাবে। এবং গভীর পাইনের বন। ইচ্ছে করলে সবুজ পাইনের বনে তুমি বনিকে নিয়ে সামান্য ঘুরেও আসতে পার।

স্যালি হিগিনস বললেন, এনজিন-সারেঙ তোমার কি মনে হয়।

—কী স্যার!

—থেকে ভাল করলাম তো।

—খারাপ কিছু তো বুঝতে পারছি না।

—কবে ডাঙা পাব কেউ যখন জানে না….!

বনির মুখ দুশ্চিন্তায় কেমন কালো হয়ে গেল। বলল, বাবা আমরা আর ডাঙা পাব না?

—ঠিক পাব। কোনো ভয় নেই। ছোটবাবু এখন আর বসে থাকা আমাদের কাজ নয়। ছোটবাবু তোমাকে একটু বেশি সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের ওয়াচ ভাগ করে নাও। কে কি করবে ঠিক করে নাও।

ছোটবাবুকে সহসা কেমন সমস্যার ভেতর ফেলে দিয়েছেন কাপ্তান। সে বিন্দুমাত্র বিচলিত বোধ করল না। সে খুব দৃঢ় গলায় বলল, স্যার সন্ধ্যা ছ’টা থেকে রাত বারোটা আপনার ওয়াচ। রাত বারোটা থেকে সকাল ছ’টা, চাচা আপনার ওয়াচ। আর সকাল ছ’টা থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত আমার।

সে আর দাঁড়াল না। পকেটে টর্চ নিয়ে নেমে গেল। তারপর সিঁড়ি বেয়ে সোজা মাস্তুলের ডগায় ক্রোজ-নেস্টে উঠে দেখল কিভাবে এখানে সামান্য বসার জায়গা করে নেয়া যায়। দিনমানে মাস্তুলে মশাল জ্বলে না। সকাল হলেই উঠে আগুন নিভিয়ে দিতে হয়। সে পাশে আর একটু জায়গা পেলে বসার জায়গা করতে পারত। মাস্তুলের ডগায় বসে দূরবীনে চারপাশটা লক্ষ্য রাখতে তবে অসুবিধা হয় না। সে বুঝতে পারল হাত-পা মুড়ে সারাদিন এখানে বসে থাকা যাবে না। তার চেয়ে ফলঞ্চা বেঁধে নিলে সুবিধা হবে। প্রায় আকাশের নিচে দোল খাবার মতো একটা তক্তা ঝুলিয়ে নিলে সময়ে অসময়ে বনি এখানে উঠে পাহারা দিতে পারবে।

ছোটবাবু মাস্তুলের গোড়ায় নেমে দেখল বনি মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার স্বভাব ভারি অদ্ভুত। কি এমন হল, সে বুঝতে না পেরে চিৎকার করে উঠল, কি হয়েছে বনি। মুখ ভার করার কি হল?

বনি কেমন অভিমানের গলায় বলল, আমি বুঝি কেউ না জাহাজে!

—তা তো বলি নি।

—আমাকে কি করতে হবে? সবাই তোমরা কাজের, আমি বুঝি কোনো কাজের না!

সে বুঝতে পেরে হেসে দিল। বলল, বনি তোমার অনেক কাজ। তোমাকে আমাদের খাওয়ানোর দায়িত্ব। কি ভাবে কি করবে সব দেখে নাও। আমাকে যখন তখন ডাকবে না। বলে সে স্টোররুমের চাবি কাপ্তানের কাছ থেকে চেয়ে নিতে বলল।

এবং ছোটবাবু আর দাঁড়াল না। রাতের ভেতর সে মাস্তুলের ডগায় ফলঞ্চা বাঁধার জন্য কাঠ সংগ্রহ করতে এনজিন-রুমে নেমে যাবে ভাবল। এনজিন-কশপের স্টোর রুম থেকে দড়ি-দড়া বের করতে হবে। একটা লম্বা তক্তা বের করতে হবে। সে এলি-ওয়ের অন্ধকারে ঢুকতেই কেমন গা ছমছম করতে থাকল। সব খালি কেবিন। এবং অন্ধকারে টর্চ ফেলে সে এগুচ্ছে। সে যতটা পারছে অন্ধকারে নামার চেষ্টা করছে। কোথাও থেকে কোনো বিদঘুটে শব্দ ভেসে এলে টর্চ জ্বালছে। আর আশ্চর্য মনে হচ্ছে সর্বত্র নড়বড়ে জাহাজ—ক্যাঁ কোঁ এমন শব্দ যেন ঝিঁঝিঁ পোকার মতো ডাক। কখনও দরজা ঠাস করে কে বন্ধ করছে। আর্চির সেই ফেটে বের হয়ে আসা চোখ যেন তার পেছনে পেছনে আসছে। এ-সব মনের দুর্বলতা, এমন কি নিঃশ্বাসের শব্দ আর মনে হচ্ছে দৌড়ে কে পালাচ্ছে—সে মুহূর্তে টর্চ জ্বাললেই দেখতে পেল পাঁচ-নম্বরের দরজা খোলা। দু-চারটে ইঁদুর দৌড়ে পালাচ্ছে, দু’টো একটা আরশোলা দেয়াল বেয়ে নেমে আসছে—যেন এক পরিত্যক্ত বাসভূমি—সে সহজে নিচে নেমে যেতে পারল না। দরজা লক্ করে পরিত্যক্ত কেবিন এবং এলিওয়ের অন্ধকারে ঘুরে বেড়াবে ভাবল। অন্ধকারে ঘুরে সাহস সঞ্চয় করবে। কোনো অশুভ প্রভাবকে সে আমল দেবে না। দিলে মনের দুর্বলতা প্রশ্রয় পেয়ে যাবে।

তখন কাপ্তান এনজিন সারেঙকে বললেন, তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি। এখন ভাবছি বলা উচিত। জাহাজে এখন আমরা চারজন। একটা গোপন খবর আছে জাহাজে, খবরটা তুমি জান না। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তোমার জানা উচিত। তুমি জানলে এ-জাহাজে সে মুক্ত হয়ে যাবে। তার আর কোনো বাধা থাকবে না।

এনজিন-সারেঙ সামনে সোজা দাঁড়িয়ে আছেন। কাপ্তানের মুখোমুখি বসতে তাঁর ভারি সংকোচ। যেন তিনি সামনে হাঁটু মুড়ে বসে কথা বললে এত বড় মানুষটাকে অপমান করা হবে। তিনি দাঁড়িয়ে থেকে দু একটা কথা ভাঙা ইংরেজীতে বলছিলেন। স্যালি হিগনিস খুব ধীরে ধীরে কথা বলছেন। সারেঙের বুঝতে যেন এতটুকু অসুবিধা না হয়। তবু মুখ দেখে বুঝতে পেরেছেন তিনি সব কথা তাঁর বুঝতে পারেন নি। তিনি এবার আরও সহজ করে বললেন, জ্যাক ছেলে নয়। মেয়ে। ওকে আমি জাহাজে ছেলে সাজিয়ে রেখেছি। জ্যাক মাঝে মাঝে ছেলের পোশাকে হাঁপিয়ে উঠলে গোপনে বোধহয় মেয়ের পোশাক পরে গভীর রাতে ডেকে ঘুরে বেড়াতো। কেউ কেউ পরী দেখতে পেত। বলে তিনি থামলেন।

সারেঙ-সাব বললেন, ওম্যান স্যার।

—ইয়েস ওম্যান। শী ইজ ওম্যান নাউ।

সারেঙ-সাব বললেন, জী, ছোটবাবু তো সাব ম্যান হয়ে গেছে। যেন বলতে চাইলেন বনি ওম্যান হলে ছোটবাবু ম্যান। ছোটবাবু টের পেলে যদি কেলেঙ্কারী করে ফেলে কিছু—তবে অসম্মান তাঁর। ছোটবাবু কোনো খারাপ কাজ করে ফেললে তাঁর আর মুখ দেখাবার জায়গা থাকবে না।

স্যালি হিগিনস বললেন, ছেলে খুব সেয়ানা। সে আগেই টের পেয়ে গেছে। তার জন্য তোমাকে ভাবতে হবে না।

ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার মতো সারেঙ-সাব হাল্কা হয়ে গেলেন। জেনেও যখন কিছু করে নি, কাপ্তানের যখন বিশ্বাস আছে ছোটবাবুর ওপর তখন তিনি আর কিছু বলতে পারলেন না।

স্যালি হিগিনস বললেন, আমি ভাবছি বনি এবার থেকে জাহাজে আর যে ক’দিন আছে মেয়ের পোশাক পরবে। তুমি কি বল?

—জী সাব, পরবে বৈকি। সারেঙ-সাবের নামাজের সময় হয়ে যাচ্ছে। তিনি বললেন, আমি যাই সাব।

—দাঁড়াও। তিনি জোরে ডাকলেন, বনি। বনি এদিকে এস। এই প্রথম বাবা তাকে জাহাজে বনি বলে জোরে ডাকছেন। বনির ভেতরটা তোলপাড় করে উঠল। সে বলল, যাই বাবা।

কাছে গেলে তিনি বললেন, তোমার কথা সারেঙকে জানিয়ে দিলাম। তুমি গাউন পরে এস। আমরা তোমাকে দেখি।

বনির হাত-পা ভীষণ কাঁপছিল। সে যেন কেবিন পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারবে না। এতদিন ছেলের মতো জাহাজে তার বেশ দিন কেটে গেছে। সে মেয়ের মতো এবার থাকবে। মেয়েরা কিভাবে হেঁটে যায়—অথবা লজ্জা-সংকোচ এবং সুষমা বলতে যা-কিছু সব সে ঠিক ঠিক আয়ত্তে রাখতে পেরেছে কিনা, এসব চিন্তায় সে কেমন সব গুলিয়ে ফেলছে।

স্যালি হিগিনস বললেন, কী দাঁড়িয়ে থাকলে কেন? যাও। পকেট থেকে টর্চ বের করে দিলেন। বললেন, লম্ফ জ্বালিয়ে নাও। তুমি জাহাজে কত বড় হয়ে গেছ আমরা দেখব না?

বনি টর্চ নিয়ে প্রায় ছুটে পালিয়ে গেল। সে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। আলো ফেলে সে লকারের চাবি খুঁজছে। আর ভীষণ ঘামছিল। এই প্রথম সে টের পাচ্ছে সবার সামনে তার প্রিয় পোশাক পরে দাঁড়াতে ভারী সংকোচ। সে তবু লকার খুলে সবচেয়ে দামী গাউন বের করল। পোর্ট-হোল থেকে গলে পড়ছে সাদা জ্যোৎস্না। আলো জ্বালতেই জ্যোৎস্না সরে গেল। আলোতে নিজেকে ভারী মহার্ঘ ভেবে আয়নায় নিজেকে দেখতে থাকল। খুব বেশি উগ্র দেখাচ্ছে সবকিছু। তাড়াতাড়ি পোশাক পাল্টে ফেলল, এবং সাধারণ একটা নীল রঙের গাউন পরে দাঁড়িয়ে থাকল। দরজা পর্যন্ত সে কোনরকমে হেঁটে এসেছে। আর তার পা সরছে না। দু’জন বুড়ো মানুষ তাকে দেখবেন বলে ডেকে অপেক্ষা করছেন। সে অতদূরে হেঁটে কিছুতেই যেন আর যেতে পারবে না। তার আগেই হাঁটু মুড়ে বসে পড়বে অথবা পড়ে যাবে।

স্যালি হিগিনস তখন ডাকছেন—বনি, এত দেরি কেন? তাড়াতাড়ি এস।

কোনো জবাব নেই। সমুদ্রে ছোট ছোট ঢেউ। উঠছে। ভেঙে যাচ্ছে। ভোঁস করে ভেসে উঠছে কোনো সামুদ্রিক প্রাণী। তাদের নিশ্বাস ফেলার শব্দ শোনা যাচ্ছে। তিনি ফের ডাকলেন, বনি এস সারেঙের নামাজের সময় পার হয়ে যাচ্ছে।

সারেঙ-সাব বললেন, সরম লাগছে সাব। সারাটা সফর জাহাজে দুষ্টুমী করেছে, এখন মেয়ে হয়ে গেলে দুষ্টুমী করতে পারবে না। খুব বিপাকে পড়ে গেছে।

স্যালি হিগিনস বললেন, কি ব্যাপার? কোনো সাড়াশব্দ নেই? এস তো সারেঙ। দেখি ও কি করছে? তারপর দারজার সামনে এসে থামতেই কেমন অবাক। বনি দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। ওর মুখ দেখা যাচ্ছে না। হিগিনস বললেন, লাইট। যেন জোরে হেঁকে উঠতেন—মোর লাইট, সারেঙ লম্ফটা নিয়ে এলে প্রায় ওরা দুই ফেরেস্তার সামিল যেন, লম্ফের আলোতে যুবতীর মুখ দেখছেন। মুখে কপালে যুবতীর বিন্দু-বিন্দু ঘাম। লজ্জায় চোখ বুজে আছে। সারেঙ-সাব তখন ডাকলেন, ছোট্‌সাব আপনি কি খুবসুরত!

স্যালি হিগিনস নুয়ে মুখের কাছে প্রায় মুখ নিয়ে ডাকলেন, বনি, আমার বনি, বনি তাকাও।

বনি কিছুতেই বাবার দিকে তাকাতে পারছে না। যেন বনির এতবড় গোপন ঐশ্বর্যের খবর পৃথিবীতে এবার প্রচার হয়ে গেল। বনি সেদিনও ভারী ছোট্ট, জাহাজে থেকে থেকে সে কখন যুবতী হয়ে গেছে। যুবতী হয়ে গেলেই সুন্দর সব দৃশ্যমালা—কোনো মনোরম উপত্যকায় ফুল ফোটার মতো। স্যালি হিগিনস এত ঝুঁকে মেয়েকে দেখছিলেন যেন মনে হয় উপত্যকায় ফুল সত্যি যথাযথ এবার ফুটেছে, না এখনও ফুল ফুটতে সময় লেগে যাবে।

সারেঙ-সাব বললেন, কি মনে হয় সাব?

হিগিনস বললেন, ভাল। খুব ভালো।

আর এই সমুদ্রে দুই বুড়োর হাতে লম্ফ সামনে রূপবতী কন্যা। হাজার হাজার মাইল ব্যাপ্ত আকাশের নিচে, সমুদ্রে অথবা কঠিন বিভীষিকার ভেতর যুবতী ইহকাল পরকালের মতো। আর এক অপোগন্ড তখন ডেকে কাঠ চিরে যাচ্ছে। মাস্তুলে ফলঞ্চা বাঁধতে না পারলে সারা দিনমান পাহারায় থাকা যাবে না। যেন প্রায় শপথের সামিল। স্যালি হিগিনস তখন জোরে হাঁকলেন, ছোট বা……!

ছোটবাবু বহুদূর থেকে যেন জবাব দিচ্ছে—যাই স্যার।

—স্কাউড্রেল, এখানে দেখে যাও। তুমি অপোগণ্ড কত সেয়ানা দেখি।

ছোটবাবু কাছে এসে ঘাবড়ে গেল। বনি মেয়ের পোশাক পরে আছে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। দরজায় দু’বুড়োর হাতে লম্ফ। ঠিক মুখের ওপর ওরা লম্ফ ঝুলিয়ে রেখেছে। দূর নীহারিকার কোনো গ্রহনক্ষত্রের দরজায় দাঁড়িয়ে যেন তারা বনিকে সন্তর্পণে দেখছে।

তখনই স্যালি হিগিনস বললেন, কী চিনতে পারো?

ছোটবাবু বলতে পারল না, হাঁ চিনি। সে সমুদ্র দেখতে থাকল।

হিগিনস কেমন ক্ষেপে গেছেন মতো। বললেন, চিনতে পারছো না?

ছোটবাবু সমুদ্র দেখতে দেখতেই যেন খুব অন্যমনস্ক গলায় বলল, হ্যাঁ চিনি স্যার।

—হিগিনস পরিবারের শেষ নোঙর।

ছোটবাবু বলল, জানি স্যার।

তারপর সহসা স্যালি হিগিনস ফু দিয়ে দু’টো লম্ফই নিভিয়ে দিলেন। আবার সেই মরা জ্যোৎস্না সমুদ্রে, ডেকে জ্যোৎস্না, মাস্তুলের ছায়া ডেকে লম্বা হয়ে পড়েছে, কিছুটা সমুদ্রে ভেসে গেছে। আর ওরা চারজন কেমন এক রহস্যময় সমুদ্রে দাঁড়িয়ে চুপচাপ অনেক দূরে এক দল নিরীহ ডলফিনের আর্তনাদ শুনতে পেল। বোধহয় ভেড়ার পালে বাঘ পড়ার মতো অতিশয় হিংস্র হাঙরেরা পেছনে লেগেছে। কাছাকাছি এলে ঠিক দেখা যেত সমুদ্রের জল আর নীল থাকছে না। ধীরে ধীরে রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে সবকিছু।

তারপর স্যালি হিগিনস ওপরে উঠে গেলেন। তাঁর ডিউটির সময় পার হয়ে যাচ্ছে। শুধু এখন চুপচাপ জ্যোৎস্নায় দাঁড়িয়ে থাকা। বারোটার পর আসবে সারেঙ। ঠিক ব্রীজে উঠে যাবার জায়গায় সে থাকবে। অন্তত বুড়ো মানুষের পক্ষে এর চেয়ে উঁচুতে দাঁড়াবার আর জাহাজে জায়গা নেই। দূরে কোথাও যদি কোনো আলোর বিন্দু দেখা দেয়। কতবার যে সমুদ্রে সব নক্ষত্রেরা কুহেলিকা তৈরি করেছে—ঠিক ঠিক আলোর বিন্দুর মতো যেন এগিয়ে আসছে, আসছে—স্যালি হিগিনস ঝুঁকে থেকেছেন—তারপর চমকে গেছেন—এতো দিগন্তে ঝুলে থাকা একটি সামান্য নক্ষত্র! দূরবর্তী মাস্তুলের কোনও আলো নয়। অথচ চোখের ওপর স্বপ্নের মতো আশা কুহকিনী, চোখ মুছে বার বার অবিশ্বাস করেছেন নিজেকে। কিছুতেই আর এ-সব গ্রহ-নক্ষত্রের ছলনায় পড়ে যাবেন না। তিনি পায়চারি করছেন আর দেখছেন—যদি কোথাও কিছু, না—কিছু না, কেবল ধূসর ঠান্ডা মরুভূমির মতো চারপাশে মৃত্যুর আতঙ্ক।

তখন দেখলেন বনি টুইন-ডেকে নেমে যাচ্ছে। হাতে লম্ফ। সে বোধ হয় কিছু আনতে যাচ্ছে নিচে। ফল্কায় মাদুর বিছিয়ে নামাজ পড়ছেন এনজিন-সারেঙ। ছোটবাবু মাস্তুলের ওপর উঠে ঠুকে ঠুকে সেই থেকে কি সব করছে। বনি আবার ওপরে উঠে আসছে। হাতে লম্ফ নিয়ে সে বোধ হয় কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছে। ছোটবাবু বনিকে যা-হোক একটা কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। বনি ওদের জন্য রাতের খাবার তৈরী করছে বোধ হয়। খাবারের নামে তাঁর জিভে জল এসে গেল।

আর যখন ওরা ডেকের ওপর গোল হয়ে খেতে বসল—তখন হিগিনস অবাক, বনি বেশ চারটে কেক বানিয়েছে। চিনি নেই, ডিম নেই, সামান্য জেলি আর ময়দা গুলে বেশ রাতের মতো চারটে কেক। এবং মনে হল, ছোটবাবুর পাতে বনি সব চেয়ে বড়টা দিয়েছে। হিগিনস মুখ গোমড়া করে খাচ্ছিলেন আর ছোটবাবুর পাতের দিকে বার বার তাকাচ্ছিলেন। সারেঙ একটু দূরে বসে খাচ্ছেন। তাঁর কাছে একটা লম্ফ দরকার। ছোটবাবু কেমন ধমকের গলায় বলল, বনি, চাচা অন্ধকারে বসে খাচ্ছেন।

সারেঙ-সাব বললেন, তোর ব্যস্ত হতে হবে না। তুই খা। আমি ঠিক দেখতে পাচ্ছি।

হিগিনস কফি খাচ্ছিলেন। কফি বলা যাবে না, গরম জলে সামান্য কফির গন্ধ। খুব যেন কষ্ট হচ্ছে খেতে। পানসে। বনি একটু চিনি হবে না! এই একটু হলেই হয়ে যেত।

ভাঁড়ার খালি হয়ে গেছে প্রায়। খুব সতর্ক না থাকলে বিশ-পঁচিশ দিনও যাবে না। সে ছোটবাবুর দিকে তাকালে, কি বলবে ছোটবাবু বুঝতে পারল না। বুড়ো মানুষটা কেমন শিশুর মতো আবদার করছে। সে শক্ত হতে পারলে ভাল করত। কিন্তু বুড়ো মানুষটা এভাবে তাকিয়ে আছেন যেন কতদিন তিনি সুস্বাদু কফি খান নি। ছোটবাবু বলল, দাও। বুড়ো মানুষেরা সময়ে সময়ে কি যে হয়ে যান।

বনি একটা জেলির কৌটা থেকে আধ-চামচ বের করে দিল। হিগিনস চামচটা দিয়ে খুব জোড়ে নাড়তে থাকলেন। তারপর পা দুলিয়ে দুলিয়ে খেতে থাকলেন। কি যে সুন্দর লাগছে এখন বনিকে। ছোটবাবুকে সামান্য খোশামোদ করলে তিনি যদি সামান্য বেশী সুযোগ-সুবিধা পান—তাঁর কথাবার্তা শুনে এখন এমনই মনে হচ্ছিল।

স্যালি হিগিনস কফি খেতে খেতে বললেন, বুঝলে ছোটবাবু তোমাকে একটা কথা বলে রাখি, বেশি রাত জাগবে না। সকালে উঠে আবার করবে। মাস্তুলে বসে সারারাত খুট খুট করলে দিনের বেলা ভীষণ ঘুম পাবে

বনি তখন তার অ্যাপ্ৰনে হাত মুছে নিল। সে কাজের জন্য খাটো স্কার্ট পরে নিয়েছে। পা হাঁটু পর্যন্ত খালি। আর মোমের মতো এত মসৃণ পা যে ছোটবাবু খেতে খেতে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল ভীষণ। সে তাড়াতাড়ি উঠে কাজে চলে গেল। যত রাত হোক শেষ করে ফেলতে হবে। নেমে যাবার সময় বলল, এলবা আফটার-পিকে আছে। তুমি ওর খাবারটা নিচে রেখে এস।

এখন দেখলে কে বলবে, জাহাজটা ভাঙা, জাহাজ অনন্ত সমুদ্রে কাঠের গুড়ির মতো ভাসছে। যেন এরা যাযাবর মানুষ, কিছুদিন এখানে আছে আবার সময় হলেই অন্য কোথাও চলে যাবে। কেউ এতটুকু যেন বিচলিত নয়। খুব স্বাভাবিক। বনি তার কাজে এতটুকু খুঁত রাখে নি। যা স্বভাব মানুষটার—যখন তখন যার তার সামনে অপমান করতে পারলে যেন বাঁচে।

এভাবে জাহাজে ক্রমে আর একটা রাত কেটে গেল। সকালে সবাই দেখল ছোটবাবু ক্রোজনেস্টে বসে থাকার মতো ছোট্ট একটা ঘর বানিয়ে চলেছে। ওপরে ত্রিপল দিয়ে কোনো আদিবাসী মানুষের মতো ঘর বানিয়ে ছোটবাবু বসে আছে। চারপাশটা ফাঁকা। মাথার ওপরে ছাদের মতো ত্রিপলের ছাউনি। সে ছাউনির নিচে বসে আছে। চোখে দূরবীন। সে এক মুহূর্ত অন্যমনস্ক হচ্ছে না। বার বার মনে হচ্ছে ঠিক কিছু দেখে ফেলবে। মাস্তুলের নিচে দাঁড়িয়ে খবর নিচ্ছেন স্যালি হিগিনস—কিছু দেখতে পাচ্ছ ছোটবাবু? কোনো মাছ অন্তত! এই তিমি মাছটাছ!

ছোটবাবু বলেছিল, না স্যার। কেবল চারপাশে সমুদ্র আমাদের যেন গিলতে আসছে। আমরা বাদে এ-সমুদ্রে আর কোনো প্রাণী আছে দেখে বিশ্বাস হচ্ছে না। চারপাশে এত পারপয়েজের ঝাঁক থাকে—তাও নেই। র‍্যামোরা মাছ আর একটাও ভেসে আসছে না।

স্যালি হিগিনস বললেন, দ্যাখো তো কোথাও নীল হাঙ্গর দেখতে পাচ্ছ কিনা। ওরা কাছাকাছি ঘুরে বেড়ালে কোনো মাছ থাকবে না। ভয়ংকার হিংস্র এরা।

সে বলল, না স্যার। জলের নিচে কিছু দেখা যাচ্ছে না। মাছের কোনো ফুটকরি পর্যন্ত নেই।

ক্রমশ সূর্যের উত্তাপ বাড়ছে। প্রখর উত্তাপে ঘামছে ছোটবাবু। বনি একটা তোয়ালে রেখে গেছে। সে বার বার ঘাম মুছছিল। তোয়ালে ভিজে গেছে। খালি গা। আর সে পরেছে সাদা হাফ-প্যান্ট। শরীরে কিছু রাখা যাচ্ছে না গরমে। সকালে চিনি ছাড়া চা মিলেছে শুধু। তারপর কি করে সময় যে কেটে যাচ্ছে। স্যালি হিগিনস ফের বললেন, চারপাশে কোথাও কিছু দেখতে পাচ্ছ না।

—না স্যার।

—অন্তত এক ঝাঁক ডলফিন?

—না স্যার।

—সমুদ্র তো এমন হয় না। তিনি বললেন, জলের গভীরে কাছাকাছি যদি…….

সে বলল, গভীরে শুধু নীল কাঁচের মতো জল ঝকঝক করছে। একেবারে পরিষ্কার, সাত-আট ফেদম্ নিচে কি আছে দেখা যাচ্ছে।

—এত স্বচ্ছ!

—হ্যাঁ স্যার।

—তবু কিছু চোখে পড়ছে না। স্ট্রেঞ্জ!

এতদিন জাহাজটার চারপাশে কত সব বিচিত্র মাছের ভিড় ছিল। সিউল-ব্যাংক অদ্ভুত প্রকৃতির এক আগন্তুক তাদের কাছে! ওরা নাক ভাসিয়ে পিঠ ভাসিয়ে দেখে গেছে। এবং ছোটবাবু প্রায় সব রকমের মাছ দেখলে চিনতে পারে। কোনটা কি মাছ। সমুদ্রের প্রাণীতত্ত্ব সম্পর্কে ডেবিড কিছু খোঁজ- খবর রাখত। স্যালি হিগিনসও সব মাছের এবং প্রাণীদের নাম বলে দিতে পারেন। ওর এখন মনে হচ্ছিল, আসলে এ-সমুদ্রে বুঝি কোনো অতিকায় মনস্টার এসে গেছে—ভয়ে একটা মাছ আর নেই। রাতারাতি সব ভেগেছে। এবং যেন সব দিগন্ত জুড়ে সে ভেসে উঠবে—তারপর এই ছোট্ট জাহাজটাকে টেনে নেবে জলের নিচে। আর থাকবে অতিকায় লেজ, মুখ ড্রাগনের মতো। সে ডুবে ডুবে বোধ হয় আসছে।

স্যালি হিগিনস মাথায় টুপি পরে রোদে দাঁড়িয়ে আছেন। খুবই চিন্তিত দেখাচ্ছে তাঁকে। অন্য সময়ে তিনি নীল হাঙ্গরের কথায় এলে অন্য সব হাঙ্গরের কথা সঙ্গে না বলে পারতেন না। তাদের স্বভাব কি রকমের—কতটা ধূর্ত, কোন মাছ সমুদ্রে সবচেয়ে বোকা এ-সব বলে তিনি বেশ সময় কাটিয়ে দিতে পারতেন। হিংস্র অক্টোপাসেরা জ্যোৎস্না রাতে প্রবালের পাহাড়ে উঠে বসে থাকে। চাঁদের আলো ওদের বড়ই প্রিয়। এবং প্রবালের নিচে যে সব জলজ ঘাস, সেখানে সে যে ধূসর রঙের লালা ছড়িয়ে রাখে শিকার ধরার আশায়, যাবতীয় তথ্য দিয়ে বোধ হয় বুঝিয়ে দিতেন। এখন তিনি মাস্তুলের নিচে চুপচাপ। রোদে কেন যে এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন! ছোটবাবু বলল, কিছু দেখলে ঠিক ডাকব; রোদে দাঁড়িয়ে থাকবেন না।

স্যালি হিগিনস সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠে আসছেন কেন? ছোটবাবু ঝুঁকে বলল, সাবধানে উঠবেন, ওপরের সিঁড়ি ভাল নয়। হিগিনস প্রায় ঝুলে ঝুলে ওপরে উঠে এলেন। তিনি ছোটবাবুকে সরিয়ে দূরবীনে কি দেখতে থাকলেন। এমন নির্বোধ উদাসীন সমুদ্র কখনও দেখেন নি। সত্যি কিছু নেই কোথাও। কোনো মাছ, অথবা স্কুইড দেখলেও তিনি যেন আশ্বস্ত হতে পারতেন। এতটা ঘাবড়ে যেতেন না। তাঁর মুখ চোখ কালো হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। তিনি নেমে যাবার সময় বললেন, কিছু দেখলেই ডাকবে। এতটুকু দেরি করবে না। যেন হিগিনস বুঝিয়ে গেলেন—তিনি আবার জাহাজে স্যালি হিগিনস হয়ে গেছেন।

হিগিনস ক্রোজ-নেস্ট থেকে নেমে ডেকে পা ফেলতে না ফেলতেই ছোটবাবু চিৎকার করে উঠল, স্যার সামথিং ভিজিবল্। দূরে কিছু দেখা যাচ্ছে। নর্থ-ওয়েস্ট-নর্থে সে ভেসে উঠেছে। সে দিগন্তের ওপর প্রায় আকাশ ছুঁয়ে দিচ্ছে মতো। ক্রসের মতো—অথচ মনে হয় প্রতিহিংসাপরায়ণ। জাহাজ এক আশ্চর্য স্রোতের মুখে পড়ে গেছে। দেখুন সে গতি পেয়ে গেছে। কোথায় যাচ্ছি আমরা স্যার কিছু জানি না। সমুদ্রের ও-পাশে ক্রসটা মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *