1 of 2

অলৌকিক জলযান – ৪৯

।। উনপঞ্চাশ।।

জাহাজ তখন সমুদ্রে ক্রমাগত ভেসে বেড়াচ্ছিল। জ্যোৎস্নার ভেতর জাহাজটাকে আর জাহাজ মনে হচ্ছে না। সত্যি যেন কিংবদন্তীর জাহাজ হয়ে গেছে। অশরীরী আত্মার মতো সে মহাশূন্যে যেন পাড়ি জমিয়েছে।

—স্যার ওরা আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়।

স্যালি হিগিনস কেবিনের ভেতর চুপচাপ বসেছিলেন। টেবিলের লম্ফটা বাতাসে কখন নিভে গেছে, কখন চিফ-মেট ঘরে ঢুকেছে তিনি টের পাননি। তিনি মুখ না তুলে বললেন, কারা দেখা করতে চায়?

—সব জাহাজিরা।

—ওরা দেখা করতে চায়! বল আমি এখন দেখা করতে পারব না। কোয়ার্টার-মাস্টারকে বল লম্ফটা যেন জ্বেলে দিয়ে যায়।

চিফ-মেট বলল, অবস্থা স্যার ভাল না!

—অবস্থা ভাল কে বলেছে!

—ওরা বলছে জাহাজে থাকবে না।

—থাকবে না কোথায় যাবে?

—ওরা বোটে নেমে যেতে চাইছে।

—কতদূর যানে?

—যতদূর সম্ভব।

—যতদূর কি দশ-বিশ মাইল কি পঞ্চাশ-একশ- পাঁচশ মাইল! সহসা উত্তেজিত গলায় বললেন—চিফ-মেট লম্ফটা তোমাকে জ্বেলে দিতে বলেছি না!

চিফ-মেট গলা বের করে ডাকল, কোয়ার্টার মাস্টার। তারপর কেবিনের ভেতর ফের সেই অসহায় অন্ধকার। চোখের ওপর অন্ধকারটা সয়ে গেছিল। বাইরে মুখ বের করতেই সমুদ্রের জ্যোৎস্না ভয়ংকরভাবে চোখের ওপর ঝলমল করে উঠেছিল। এখন কেবিনের ভেতর সে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। কেবল ঘুলঘুলির মতো পোর্ট-হোল দিয়ে সামান্য জ্যোৎস্না নেমে আসছে। আর মনে হচ্ছিল মানুষটা একটা ইজি-চেয়ারে চোখ বুজে পড়ে আছেন। ঠিক লম্ফ না জ্বাললে সে বুঝতে পারবে না। বাইরে সেই ক্রোজ-নেস্টে মশাল জ্বলছে। জাহাজের সামনে পেছনে দু’টো অতিকায় লম্ফ ক্রোজ-নেস্টে ঠিক আগের মতো এবং কোথাও থেকে এতটুকু কোনো গণ্ডগোল ভেসে আসছে না। জাহাজটা সহসা ভারী নিশ্চুপ। সবাই যেন জাহাজ ছেড়ে চলে গেছে।

কোয়ার্টার-মাস্টার লম্ফ জ্বালিয়ে চলে গেল নিচে। স্যালি হিগিনস এবার চিফ-মেটের দিকে তাকালেন। বললেন—বোটে তোমরা কতদূর যেতে চাও?

চিফ-মেটের ফ্যাকাশে মুখ আরও ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে বলল, আমি তো স্যার জানি বেশি দূর বোটে যাওয়া যাবে না!

—যাওয়া যাবে না ঠিক না। যাওয়া যাবে। মোটর-বোট যখন বেশ কিছুদূর যেতে পারবে। তেল ফুরিয়ে গেলে পালে হাওয়া লাগবে। সবই তুমি জান। কিন্তু চিফ-মেট সেটা কতদূর! কতদিনে ডাঙা পাবে যখন কিছুই জানো না অহেতুক জাহাজ থেকে নেমে যাবে কেন?

চিফ-মেট বলল—স্যার আপনি কিছু টের পাচ্ছেন না।

কে বলছে টের পাচ্ছি না! সব টের পাই। স্টোররুম থেকে দু’টো কনডেনসড মিল্ক কে চুরি করেছে তাও বলতে পারি। করড্ বিফের প্যাকেট কে নেকড়ায় জড়িয়ে রেখেছে এবং রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে অন্ধকারে বসে খাচ্ছে তা আমি জানি না তো তুমি জানো চিফ-মেট

চিফ-মেট বলল – কিন্তু স্যার সবাই নিচে জড়ো হয়েছে!

—নিচে মানে বোট-ডেকে?

—ইয়েস স্যার।

—কেন? কেন জড়ো হয়েছে? কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছি না তো।

—ওরা স্যার বলছে জাহাজে থাকবে না। নেমে যাবে। চুপচাপ নিচে বসে আছে।

—নেবে যাবে বললেই নেমে যাওয়া যায়! স্যালি হিগিনস এবার উঠে দাঁড়ালেন।—ইউ হেল, গেট-আউট, আই সে গেট-আউট। তোমরা থাকতে আমার কাছে আসে কেন! তোমরা কি করতে আছো জাহাজে!

চিফ-মেট, ডেবিড এবং ক্রমে রেডিও-অফিসার পর্যন্ত এসে গেল শেষ পর্যন্ত।

—আপনি একবার বলুন। ওদের সঙ্গে কথা বলুন। আপনি বুঝিয়ে বললে ওরা শুনবে। স্যালি হিগিনস পোর্ট-হোলে দাঁড়িয়ে বললেন—তোমরা কিছু শুনবে না ডেবিড। তোমরা সব আগেই ঠিক করে নিয়েছ।

ধরা পড়ে গিয়ে আর মুখ থাকে না। তখন প্রায় ক্ষেপে যাবার মতো ডেবিড অনর্গল বলে যেতে থাকল—না স্যার, বুঝতে পারছেন এভাবে দিনের পর দিন আমরা ভাসতে ভাসতে কোথায় যাচ্ছি! কেবল জল কেবল আকাশ, কেবল জল কেবল আকাশ! কেবল দিগন্ত একই দূরত্ব। যেদিকে তাকাই স্যার সমুদ্র ঠিক একভাবে আমাদের ঘিরে রেখেছে। আমরা স্যার পাগল হয়ে যায়নি এ স্যার আপনার বাবার ভাগ্য। তারপর সে একসকিউজ মি বলে জিভে কামড় দিল এবং রসিকতা পুরো মাত্রায় বিন্দুমাত্র ভয়ডর নেই, সে যে এখন থেকেই জিভ ঝালিয়ে নিচ্ছে বোঝাই যাচ্ছিল। কারণ প্রথমেই তো আর বেজন্মার বাচ্চা বলে আরম্ভ করা যায় না। বাবার ভাগ্য দিয়ে আরম্ভ বেজন্মার বাচ্চা বলে শেষ

স্যালি হিগিনস আর একটা কথা বললেন না ডেবিডের সঙ্গে।

ডেবিড কেমন মরিয়া হয়ে উঠছে—স্যার আপনি আমাদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন। আমরা আপনাকে অসম্মান করতে চাই না। আমরা এতগুলো লোক একদিকে আপনি একা একদিকে। মানুষের জীবন মরণ বলে কথা। আপনার ভাবা উচিত।

বাইরে সেই একইভাবে জাহাজে মশালের আলো জ্বলছে। বোট-ডেকে শান্তশিষ্ট বালকের মতো সব মানুষের মুখ। ওরা বসে আছে বোট-ডেকে। প্রায় হরি-সংকীর্তনের বাতাসা নেবে বলে যেন বসে আছে। একটা কথা কেউ বলছে না। ওপরে সব বাবুরা গেছে। বাবুরা ঠিক হেস্তনেস্ত করে আসবে। মশালের আলোতে আবছা ওদের মুখ দেখা যাচ্ছিল—প্রায় সব ফ্যাকাশে মুখ। ভয়ে চোখ ক্রমে কোটরাগত। দপ দপ করে জ্বলছে চোখ। ওরা স্যালি হিগিনসের কাছে এসেছে। ওরা জানে যেহেতু তিনি জাহাজের সর্বময় কর্তা তিনি ইচ্ছে করলে সব বিদ্রোহ সহজেই দমন করতে পারেন। সবাইকে তিনি জাহাজ থেকে যে কেন নামিয়ে দিচ্ছেন না! কি যে স্বার্থ এতগুলো লোকের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার, এখন যত দ্রুত সম্ভব জাহাজ থেকে নেমে পড়া বাঞ্ছনীয়। অথচ তিনি বেশ যেন সমুদ্রে এক চতুর খেলায় মেতে উঠেছেন—তাঁর বিন্দুমাত্র ভাবনা নেই।

তখন ডেবিড রেলিঙে ঝুঁকে চিৎকার করে বলল—তিনি আপনাদের মোকাবিলা করতে চাইছেন না।

ছোটবাবু ফানেলের গুঁড়িতে ছিল। সে বলল—তুমি শিগগির যাও জ্যাক। রাজী করাও। বুড়ো নিজেও মরবে, আমাদেরও মারবে।

জ্যাক বলল, বাবা ভীষণ একগুঁয়ে। আমার কথায় রাজী হবেন না। তুমি আমার সঙ্গে এস। ছোটবাবু এবং জ্যাক প্রায় লাফিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে লাগল। ডেবিড ওদের দেখে বলল—তিনি কি ভেবেছেন জ্যাক, তিনি কি ভেবেছেন আমরা এভাবে জাহাজে মরে যাই। বড় অসহায় চোখ ডেবিডের। ডেবিড ভেতরে ভেতরে উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে। শুধু ডেবিড কেন, সবাই। ছোটবাবু বলল, ডেবিড মাথা খারাপ করবে না। দেখছি।

সে ঢুকে বলল—স্যার ওদের সঙ্গে আপনি কথা বলুন!

স্যালি হিগিনস কেমন মরিয়া। তিনি বললেন—তোমরা সব ঠিকঠাক করে এসেছ। তোমাদের সঙ্গে আমি কি কথা বলব!

—না স্যার, সব ঠিকঠাক করে আসিনি। আপনি কথা বলুন। কথা না বললে ওরা জাহাজে আগুন ধরিয়ে দেবে। আপনি একা কিছু করতে পারবেন না। আমরা সবাই এবার বোট হারিয়া করে দেব। বোট সমুদ্রে নামিয়ে জাহাজে আগুন ধরিয়ে দেব। জাহাজটা অলৌকিক না আপনি অলৌকিক কিছু, আমাদের এখন তাই দেখা দরকার। অলৌকিক হলে জাহাজ এবং আপনি নিশ্চিত বেঁচে যাবেন। আমরা আপনাদের কিছু করতে পারব না। আগুনে আমরা আপনাদের পুড়িয়ে মারতে পারব না। আমরা হেরে যাব। আপনি কথা বলুন স্যার। ওরা ভারী সরল সহজ মানুষ। এঁদের সংস্কার রয়েছে কিছু। এবং জাহাজে ওঠার পর থেকে এমন সব ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছে, এমন সব কাণ্ড কারখানা একের পর এক যে ওরা উন্মাদের মতো কিছু করে ফেললে আপনি আমাদের বিশ্বাসঘাতক ভাববেন না। আসলে এটা কোনো বিশ্বাসঘাতকতা নয়। ওরা আপনার ওপর সব বিশ্বাস হারিয়ে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে। ওদের কোনো দোষ নেই স্যার। ওদের দিনের পর দিন জাহাজে আটকে রেখেছেন, বোট দিচ্ছেন না, একবার, দোহাই আপনার ঈশ্বরের, একবার কথা বলুন। ছোটবাবুর কথায় স্যালি হিগিনস বোধহয় সামান্য ভয় পেয়ে গেলেন। জোরজার করে বোট নামিয়ে চলে যাবার আগে জাহাজে আগুন ধরিয়ে দিলে কিছু করার থাকবে না। তাঁর চোখ-মুখ ভয়ঙ্কর কঠিন এবং খাবার ক্রমে ফুরিয়ে আসছে বলে ওরা দুর্ভাবনায় আর মানুষ নেই। এখন এরা সবকিছু করতে পারে। তিনি চোখ তুলে অপলক ছোটবাবুকে দেখলেন। ছোটবাবুকে তিনি অবিশ্বাস করছেন। করুন। সে এখন এছাড়া আর কিছু বলতে পারে না। যেন স্যালি হিগিনস ছোটবাবুর আসল চেহারা এতদিনে দেখেতে পেয়েছেন। ছোটবাবু পর্যন্ত হাত মিলিয়েছে।

স্যালি হিগিনস বাইরে দাঁড়ালেন। চিফ-মেট লম্ফটা হাতে নিয়ে আসছে। চার্ট-রুম, মাংকি-আয়ল্যাণ্ড এবং হুইল-রুম সব উড়ে গেছে বলে রেলিং ভারী নড়বড়ে। যে কোনো সময় স্যালি হিগিনস সামান্য অসতর্ক হলে উল্টে নিচে পড়ে যাবেন। তা ছাড়া তাঁকে যেন পথ দেখানো দরকার—চিফ-মেট আগে আগে লম্ফের আলোতে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল। সমুদ্রে সাদা জ্যোৎস্না। এত. জ্যোৎস্নায় আলো লাগে না। তবু নিচে যারা বসে আছে তারা বোধ হয় দেখে আশ্বস্ত হতে পারবে লম্ফের আলোতে সত্যি তিনি মাথার ওপরে দাঁড়িয়ে ওদের সঙ্গে কথা বলছেন। কি বলবেন, ওরা এক বিন্দু বুঝতে পারবে না। ছোটবাবু ওদের বুঝিয়ে দেবে—পাশে ছোটবাবু দাঁড়িয়ে আছে। ওরা ছোটবাবুকে দেখে নিচ থেকে সবাই হাত নাড়ল।

আর ছোটবাবু দেখল, নিচ থেকে দু’টো মশাল জ্বালিয়ে এনেছে ডেক-কশপ। দু’দিকে দুটো মশাল বসিয়ে দিয়েছে সে। জ্যোৎস্নায় অস্পষ্ট মুখগুলি এবার স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ডেক-কশপ বুঝি ভেবেছে এভাবে মশাল জ্বেলে দিলে কাপ্তান সবার মুখ স্পষ্ট দেখতে পাবেন। এতগুলো নিষ্ঠুর অতিশয় ক্রুর মুখ দেখলে তিনি নিজের বিশ্বাসে আর অটল থাকতে পারবেন না। এবং মশালের শিখা পরিব্যাপ্ত হয়ে যাচ্ছে আকাশে বাতাসে। সমুদ্রে এমন যখন বিশালতা আর জাহাজের কিছু নাবিক মৃত্যুর বিভীষিকায় যখন উন্মাদ তখন স্যালি হিগিনস খুব ধীরে ধীরে বললেন—বন্ধুগণ, আমরা এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন। জাহাজ অচল। খাবার শেষ হয়ে আসছে। যা খাবার আছে বড় জোর দু’ হপ্তা। প্রায় তিন হপ্তা আমরা জাহাজে ভেসে বেড়াচ্ছি। এতদিন আপনারা ধৈর্য ধরেছিলেন বলে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

ছোটবাবু তাদের এবার সবটা বাংলায় বুঝিয়ে দিল।

—আমরা বিশ্বাস করি, বিশ্বাস ছাড়া আমাদের এখন আর কি আছে! আমরা বিশ্বাস করি সিউল- ব্যাংক আমাদের ঠিক ডাঙায় পৌঁছে দেবে।

ছোটবাবু বুঝতে পারছে স্যালি হিগিনস বিশ্বাস কথাটার ওপর জোর দিচ্ছেন। বারবার। বিশ্বাস কথাটার ওপর সেও বলার সময় বিশেষ জোর দেবার চেষ্টা করল। কিন্তু আশ্চর্য যতটা জোরের সঙ্গে কাপ্তান বিশ্বাস কথাটা উচ্চারণ করেছেন, সে যেন তেমনভাবে পারছে না। এমন নিরুদ্দিষ্ট যাত্রা প্রায় যেন এক অলৌকিক জলযানে এরা নিরুদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছে। অথবা তার মনে হচ্ছে আসলে যেন কেউ বেঁচে নেই জাহাজে। এক অন্যলোকে ওরা এসে গেছে। ঝড়ের রাতে ওরা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে সমুদ্রের অতলে। ওরা সবাই সেই সব মানুষের প্রেতাত্মা! এবং মানুষের আকাঙ্ক্ষা মরে গেলেও শেষ হয়ে যায় না—সে আবার ফিরে আসে পৃথিবীতে। অথবা এমন দুর্ঘটনায় যখন মৃত্যু অনিবার্য তখন তো সবাই নিজের নিজের ইচ্ছের কথা স্যালি হিগিনসকে জানাবেই! ওরা দেশে ফিরে যেতে চায়—এমন শব্দগন্ধহীন সমুদ্রে তারা ঘুরে বেড়াতে চায় না। সেও যেমন ভাবত আর্চির ওপর প্রতিশোধ নেবে, মরে গিয়ে সে সেই প্রতিশোধের কথা ভেবে থাকে আর ভাবে ঘটনা সত্যি সে আর্চিকে খুন করেছে। আসলে সে কিছুই করেনি। সবই এক অন্যলোকের ঘটনা। সে মিথ্যে বিশ্বাস কথাটার ওপর জোর দিতে চাইছে। আর এভাবে ওর সত্যি কেন যে মনে হল কেউ বেঁচে নেই। এরা সবাই মানুষের ছায়া। মরে গিয়ে ছায়ার মতো জাহাজে সবাই ভেসে রয়েছে। ঠিক যেমন জলের বুদবুদ ভেসে থাকে সমুদ্রে তারপর সময়ে মিশে যায় সমুদ্রে তেমনি তারা এখন দুর্ঘটনা ঘটে যাবার পর বুদবুদের মতো পৃথিবীর বাতাসে ভেসে রয়েছে। সময় হলেই তারা বাতাসে মিশে যাবে। কোনো আর চিহ্ন থাকবে না।

সে কেমন সব গুলিয়ে ফেলেছে। একটা কথাও সঠিক প্রকাশ করতে পারছে না। স্যালি হিগিনস পর পর কি বলে যাচ্ছেন সে বুঝতে পারছে না। এতগুলো মানুষের মুখমণ্ডলে কেমন কঠিন চোখ এবং মশালের আলোতে ওরা যেন সত্যি আর পৃথিবীর কেউ নয়। মাস্তুলে আগুনের প্রজ্বলিত শিখা যেন আকাশ এবং সমুদ্রে ভাসমান। স্থির। নক্ষত্রমন্ডলে তাদের বুঝি এখন প্রতিবিম্ব ভাসছে। সে বলল– আজ আসুন বরং স্যার আমরা কিছু সত্যি কথা বলি। আর্চি কোথায়। সে তো নেই—সে গেল কোথায়!

স্যালি হিগিনস বললেন—ছোটবাবু এটা ফাজলামির জায়গা না। তুমি কিছু বলছ না। একটা কথা বলছ না আজে-বাজে বকছ। বেশি আজে বাজে বকলে জাহাজ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেব। এবং ছোটবাবু কেমন সম্বিত ফিরে আসার মুখে বলল–স্যার আপনার কি মনে হয় না আমরা এক অলৌকিক জলযানে ভেসে যাচ্ছি। মনে হয় না আমরা সত্যিকারের কেউ বেঁচে নেই। মনে হয় না আমাদের যাত্রা অন্য কোনো গ্রহলোকে, আমরা আর পৃথিবীর মানুষ না। মরে গিয়ে পৃথিবীর মানুষ ভেবে সান্ত্বনা পাচ্ছি। সহসা জ্যাক ছুটে এসে বলল তখন, ছোটবাবু প্লিজ! কি তুমি আজে-বাজে বকছ। তুমি কি সবার মাথা খারাপ করে দেবে?

ছোটবাবু কেমন ফ্যাকাশে মুখে বলল—আমি সবার মাথা খারাপ করে দিচ্ছি!

জ্যাক বলল—দিচ্ছ না! তুমি ভাগ্যিস বাবাকে বলেছ। এখন যদি তোমার ভাষায় বলতে, কি হত বলত!

তখন পাঁচ-নম্বর এসে দাঁড়াল। সে স্যালি হিগিনসকে মাথা নুইয়ে বাউ করল। একসকিউজ মি! এমন বলল। লম্ফের আলোতে ডেবিড়, পাঁচ-নম্বরের মুখটা তুলে দেখাল সবাইকে। ডেবিড ওকে ঠেলে পাঠিয়েছে ছোটবাবুর কথাগুলো বাংলায় এখুনি সবাইকে বুঝিয়ে বলতে হবে! এমন মওকা আর পাওয়া যাবে না!

পাঁচ-নম্বর তখন বলছে, ছোটবাবু কি বলছে শুনুন।

ছোটবাবু বলল—ছোটবাবু কি বলছে—ছোটবাবুই বলবে ফাইভার……। — আপনারা শুনুন আমি কি বলছি। পাঁচ নম্বর বলল, ছোটবাবু বলছে…..।—ছোটবাবু বলল—আমার কথা আপনারা আমার কাছ থেকে শুনবেন না ফাইভারের কাছ থেকে শুনবেন?

সবাই হাত তুলে দিল। কেউ বোধ হয় বিরক্ত হয়ে ছুটে আসছে। কে আসছে ওটা! এনজিনকশপ সে এসেই একটা মশাল নিচ থেকে চিৎকার করে ওপরে ছুঁড়ে মাড়ল! ছোটবাবু সেই মশাল ত্বরিতে খপ করে ধরে ফেলল। তারপর ফের ছুঁড়ে দিয়ে বলল—এনজিন-কশপ জায়গারটা জায়গায় রেখে দাও। মাথা গরম করবে না।

ছোটবাবু চিৎকার করে এবার বলল—কাপ্তান সিউল-ব্যাংকের ওপর বিশ্বাস হারাতে আপনাদের বারণ করছেন। বিশ্বাস হারালে আমাদের আর কিছু থাকে না বলছেন। জাহাজ অচল, জাহাজে খাবার ফুরিয়ে এসেছে, আমরা চানের জল পাচ্ছি না, আমাদের এখন নোংরা জামাকাপড়ে থাকতে হচ্ছে। তিনি জল পর্যন্ত রেশন করে দিয়েছেন, সবাই কোনো না কোনো দিন আমরা ডাঙায় ফিরে যাব বলে।

পাঁচ নম্বর বলল—ছোটবাবু তুমি কিন্তু নিজের কথা বললে না।

পাঁচ নম্বর ভারী লম্বা মানুষ। ছোটবাবুকে অরাও লম্বা মনে হচ্ছে। ছোটবাবু কালো প্যান্ট হলদে শার্ট পরে আছে। সামান্য শীত লাগছে। ওর চুল এখনও মনোরম। সে তো কখনও দাড়ি কামায় না। ডেবিড এবং অন্য সবাই দাড়ি কামানো-টামানোর পাট প্রায় তুলে দিয়েছিল। সকালে কাপ্তান পাইকারি হারে সবাইকে দাড়ি কামিয়ে ঘরে হাজিরা দিতে বলেছিলেন। সবাই দাড়ি কামিয়ে মুখ দেখিয়ে গেছে। স্যালি হিগিনস ঠাট্টা করে বলেছিলেন, তোমাদের সবাইকে জামাই জামাই লাগছে হে! বোকার মতো হেসে সবাই বের হয়ে এসেছিল –কি যে বলেন স্যার! আর সেই লোকটার মুখ এখন কি নিষ্ঠুর। প্রায় নিয়তির মতো দাঁড়িয়ে আছেন মাথার ওপর। মনেই হয় না মানুষটা জীবনে কারও সঙ্গে কোনো রসিকতা করেছেন

পাঁচ-নম্বর ফের বলল—তুমি কি বলেছিলে একবার বল।

এনজিন-কশপ ভিড়ের ভেতর থেকে উঠে দাঁড়াল। সে চিৎকার করে বলল—আমরা শুনতে চাই।

এবং পাশাপাশি আর যারা ছিল ছোটবাবু অবাক সবাই বলছে—আমরা শুনতে চাই।

সে এমন কাউকে দেখল না যে বলতে পারে, না শুনতে চাই না! সে সারেঙ-সাবকে খুঁজছে! সব মুখগুলো সে একে একে চিনতে পারছে। যতই বন্য হয়ে যাক যতই তারা অমানুষ হয়ে যাব সে সবাইকে চিনতে পারছে। কেউ উবু হয়ে বসে আছে। কেউ পা ছড়িয়ে দিয়েছে। কেউ সব হারিয়ে গেলে মানুষের যে মুখ যে উদাসীনতা অর্থাৎ মৃত্যু চারপাশে হাত তুলে নৃত্য করে বেড়ালে তখন যেমন লাগে মানুষকে হুবহু সেই সব ছবি! ঠান্ডা বাতাস সমুদ্র থেকে উঠে আসছে। বাতাসে জলের ভেজা গন্ধ। জলে কোনো অতিকায় মাছের ভেসে বেড়ানোর শব্দ। অথবা দূরে রাশি রাশি পাইলট ফিশের ঝাঁক। নিচে জাহাজের অতলে সব জোনাকির মতো জেলি-ফিশেরা সাঁতার কাটছে। এবং র‍্যামোরা মাছের প্রবল আক্রমণে জাহাজের খোল এখন হিজিবিজি আঁসের মাছ যেন একটা। এত বড় খোলের কোথাও আর বিন্দুমাত্র জায়গা নেই যেখানে ফাঁক রয়েছে। র‍্যামোরা মাছ ছোট গুগলির মতো নিজের আশ্রয় ইতিমধ্যে গড়ে তুলেছে এবং ক্রমে সময় পার হয়ে গেলে ছোটবাবুর মনে হল খোলের ইস্পাতে সব শ্যাওলা জমে বড় বড় দাড়ি এবং অতিকায় জলযানটা একসময় জলচর প্রাণী হয়ে যেতে পারে সে কোনো সময়। চারপাশে সাদা জ্যোৎস্নায় মরা সমুদ্রে এমনই মনে হল তার। এবং সঙ্গে সঙ্গে সে হাত তুলে বলল—আমার কখনও এটা কেন যে মনে হয় আমরা যেন এক অলৌকিক জলযানে ভেসে যাচ্ছি। যেন নিয়তির মতো এই যান। আমরা নিজেরা জানি না কোথায় তাকে নিয়ে যাব অথচ কি আশ্চর্য দেখুন ঠিক কোথাও যাবার জন্য আমরা প্রত্যেকে বের হয়ে পড়েছি—সেই কবে থেকে যেন সেই, আচ্ছা, আপনারা কেউ বলতে পারেন সেই কবে থেকে আমরা যানে চড়ে বের হয়ে পড়েছি—কেউ মনে করতে পারছেন না, এই সেদিন লক্ষ কোটি বছর আগে……..।

—ও হো ছোটবাবু তুমি অন্য কথায় চলে যাবে না। ঠিক ঠিক বলে যাও। লম্ফটা এবার পাঁচ নম্বর ছোটবাবুর মুখের সামনে তুলে ধরল।

স্যালি হিগিনস ঠিক ছোটবাবুর পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। লম্বা রেলিং। তার পাশে চিফ-মেট, ডেবিড এবং রেডিও অফিসার। দোমড়ানো ফানেলের গুঁড়িতে বনি তেমনি তাকিয়ে আছে ওপরে। নিচে নেমে ছোটবাবু এবং বাবা তারপর এই জাহাজিরা কিভাবে পরস্পর মোকাবেলা করবে সে বুঝতে পারছে না। সে ভীষণ উদ্বিগ্ন চোখ মুখে প্রত্যাশায় আছে, ছোটবাবু ঠিক সব সামলে দিতে পারবে। কিন্তু কেমন জল ঘোলা করে ফেলেছে ফাইভার। ওরা পরস্পর বচসা করছে মতো! ছোটবাবুকে অপদস্থ করার জন্য বার বার চাপ দিচ্ছে।

আর ছোটবাবু তখন আবার জাহাজিদের উদ্দেশ্য করে কি সব বলে যাচ্ছে। আশা করছে ছোটবাবু ওদের বলে দিয়েই সে ফের এই সব ইংরেজ অফিসারদের বুঝিয়ে বলবে।

ছোটবাবু যা যা বলেছিল সব হুবহু বললে—পাঁচ নম্বর হৈ চৈ বাঁধিয়ে দিল—তবে! ডেবিড বুঝতে পারছ?

ডেবিড বলল—না। কিছু বুঝতে পারছি না।

পাঁচ-নম্বরই ইংরেজীতে বলল—স্যার। সে স্যালি হিগিনসকে উদ্দেশ্য করে বলছে।

—দ্য বাস্টার্ড। স্যালি হিগিনস ক্ষেপে গেলেন। এই ফাইভারের এত রোয়াব। সময় বুঝে বদলা নিচ্ছে। আর ছোটবাবুর কথা শুনে স্যালি হিগিনস একেবারে থরথর করে কাঁপছেন উত্তেজনায়।

—কি কি বলছ! এটা অলৌকিক জলযান! আমরা কেউ বেঁচে নেই। আমাদের যাত্রা অন্য কোন গ্রহলোকে। আমরা আর পৃথিবীর মানুষ না। ননসেন্স। স্যালি হিগিনস আর চুপচাপ থাকতে পারলেন না। মিথ্যে কথা। ছোটবাবু আপনাদের মিথ্যে কথা বলেছে। এটা অলৌকিক জলযান নয় আমি বলছি। আমরা বেঁচে আছি আমি বলছি। আমরা অন্য কোন গ্রহলোকে পাড়ি জমাচ্ছি না। আপনাদের ভয় পাইয়ে দেবার জন্য এসব ছোটবাবুর ষড়যন্ত্র। এরা সবাই আপনাদের ভয় পাইয়ে দিতে চায়। এটা ভুতুড়ে জাহাজ এটার মাথা ঠিক নেই—ঠিক না। এটা আর দশটা জাহাজের মতো জাহাজ, আর দশটা জাহাজের মতো এর কলকব্জা। দশটা জাহাজের মতো এটা পুরানো। পুরানো গন্ধ এর শরীরে আছে। এর ইস্পাত আর দশটা জাহাজের চেয়ে সামান্য আলাদা। কম্পাসে সামান্য গন্ডগোল দেখা দিত মাঝে মাঝে। আসলে জাহাজটা সম্পর্কে এত বেশি প্রচার ছিল, এত পুরোনো সব খবর জাহাজিদের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছিল যে জাহাজে উঠলেই সবাই ভয়ে একটা অস্বস্তিকর পরিবেশে পড়ে যেত। শুধু গুজব গুজব এ জাহাজটাকে এমন একটা অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। ছোটবাবু তুমি কী! তুমিও ছোটবাবু শেষ পর্যন্ত….. তোমার ওপর খুব বেশি নির্ভর করেছিলাম হে। হাতের শেষ তাসটাও কেড়ে নিলে!

ছোটবাবু ততোধিক চিৎকার করে বলল—ক্যাপ্টেন স্যালি হিগিনস আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না। এবং তারপর কাপ্তানের সব কথার বাংলা করে দিলে এনজিন-কশপ, ডেক-সারেঙ সবাই উন্মত্তের মতো লাফাতে থাকল—মানি না। এটা কাপ্তান বাড়িয়ে বলছে। যদি আর দশটা জাহাজের মতো হয় তবে আমাদের এভাবে আটকে রেখে কি লাভ। তিনি কি জাহাজে রেখে সবাইকে মেরে ফেলতে চান। শয়তানির একটা সীমা থাকা উচিত।

ছোটবাবু বলল—স্যার ওরা বলছে আর দশটা জাহাজের মতোই যদি হয় তবে সবাইকে জাহাজে আটকে রেখেছেন কেন? বোট দিচ্ছেন না কেন?

স্যালি হিগিনস এবার ধীরে ধীরে বললেন—বন্ধুগণ, বোটের চেয়ে জাহাজে বেশি আপনারা নিরাপদ।

ছোটবাবু বলল—বোটের চেয়ে জাহাজে আপনারা বেশি নিরাপদ।

ডেবিড বলল—মিথ্যা কথা।

স্যালি হিগিনস ভীষণ ধমকে উঠলেন—ডেবিড!

ডেবিড বলল—আমরা তবে স্যার এভাবে বসে বসে নিয়তির হাতে মার খাব?

—কোনো উপায় নেই। প্লিজ ডিপেনড অন দ্য ফেট।

নিচ থেকে সোরগোল উঠছে। বাংলায় বলুন। বুঝতে পারছি না কি বলছেন।

ছোটবাবু বলল—–ডেবিড বিশ্বাস করছে না জাহাজ বোটের চেয়ে বেশি নিরাপদ জায়গা।

সমস্বরে সবাই চিৎকার করছে, আমরাও বিশ্বাস করছি না। আমরা সমুদ্রে নেমে যেতে চাই। আমরা সমুদ্রের সঙ্গে লড়াই করতে চাই। সমুদ্রের হাতে বসে বসে আর মার খাব না। সমুদ্রের হাতে পুতুল বনে যেতে চাই না।

স্যালি হিগিনস ছোটবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন, কখন ছোটবাবু ওদের কথা সব খুলে বলবে।

ছোটবাবু বলল–স্যার ওরা তো ঠিকই বলছে। ওরা বলছে বসে বসে নিয়তির হাতে মার খাবে না। ওরা বোট নিয়ে ভেসে পড়তে চায়। ওরা লড়তে চায়।

স্যালি হিগিনস দাঁড়িয়ে থাকলেন। তিনি স্লিপিং গাউন পরে আছেন। সোনালী রঙের স্লিপিং গাউন। জ্যোৎস্নায় তার গেরুয়া রং ধরেছে। দাড়ি না কামানোর জন্য বেশ বড় দাড়ি। মাথার চুল সাদা বলে খুবই প্রাজ্ঞ পুরুষ মনে হচ্ছে। তিনি এবার সত্যি সত্যি জাহাজ সমুদ্র এবং এই সব নক্ষত্রমালা সম্পর্কে এমন খবর দেবেন যে সবাই তাজ্জব বনে যাবে। যেন এক্ষুনি বলবেন সমুদ্রকে তোমরা কতটুকু চেন! সিউল-ব্যাংককে তোমরা কতটুকু জান! তোমরা যখন আমার চেয়ে বেশি জান না তখন আমার ওপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় কি! কিন্তু তিনি আর কিছুই বললেন না। শুধু বললেন—আপনাদের কি মনে হচ্ছে না জাহাজ কোথাও যাচ্ছে! আপনারা কি বুঝতে পারছেন না জাহাজ এক জায়গায় নেই। বোটের কম্পাস থেকে আমি বুঝতে পারছি জাহাজ তার কোর্স পাল্টে ফেলেছে। চোখের ওপর অবশ্য মনে হয় জাহাজ স্থির—এত বড় সমুদ্রে এ ছাড়া কিছু বোঝারও উপায় নেই। তবু বলছি জাহাজ আমাদের ওয়েস্ট-নর্থ-ওয়েস্টে উঠে যাচ্ছে। জাহাজ তার কোর্স পাল্টে ফেলেছে যখন আমাদের ভয় নেই। আমরা এবার সামনে অসংখ্য দ্বীপ পেয়ে যাব। পাঁচ সাতশ মাইলের ভেতর এখানে আছে অসংখ্য দ্বীপ। বলা যায় না ফিজিতেও গিয়ে আমরা উপস্থিত হতে পারি। ভাগ্য যদি তেমন সুপ্রসন্ন থাকে ভিতিলেবুতে যেতে পারি। আরও ওপরে ফানফুতি—যদি জাহাজ চোরাস্রোতে কোরাল সীতে ঢুকে যায়, চারপাশে থাকবে নিও-ক্যালেডোনা, নিউ হেবরাইটস রতুম, সান্তাক্রুজ, সালামন দ্বীপপুঞ্জ, এমন কি আর একটু ওপরে উঠে গেলে এলিস। সেখানে খাবার থাকবার এবং ঘরে ফিরে যাবার সব রকমের ব্যবস্থা।

বন্ধু বলল তখন—অ ছোটবাবু, সাহেব এত কি বলছে রে!

জব্বার বলল—অ ছোটবাবু, নাকে নস্যি গুঁজে দাও। নইলে থামবে না।

বাধা পেয়ে স্যালি হিগিনস থেমে ছোটবাবুর দিকে তাকালেন। ছোটবাবু বলল—স্যার আপনি বলে যান। ওদের কথায় কান দেবেন না।

মনে হল সব বুঝতে পারছেন তিনি। এই জাহাজিরা তাকে এখন অপমান করতে চায়। তিনি জানেন তাঁর কাছে যেহেতু একমাত্র আগ্নেয়আস্ত্র আছে এবং তিনি যেহেতু যে কোন জাহাজিকে টেনে এনে বুলেটের সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে পারেন—তিনি বোধ হয় সেজন্য আদৌ বিচলিত হচ্ছেন না। তাঁর গলা মাঝে মাঝে চড়ে গেলেও অধিকাংশ সময় মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করে যাচ্ছেন।

—আর ছোটবাবু তুমিও শালা শেষ পর্যন্ত দালাল হয়ে গেলে। বন্ধু লাফিয়ে রেলিঙের নিচে এগিয়ে এল।—কি বলছে সাহেব। ছোটবাবু ফের সবটা বুঝিয়ে বললে—এবার আর কেউ যেন তেমন চিৎকার চেঁচামেচি করে উঠল না।

ওদের মুখ দেখে স্যালি হিগিনস কিছুটা স্বস্তি বোধ করছেন। তিনি ফের ওদের ভুল ধারণা মন থেকে মুছে ফেলার জন্য বললেন—এসব দ্বীপ আমরা পাঁচ-সাতশ মাইলের ভেতর পেয়ে যাব আশা করছি।

ডেবিড তখন আর ধৈর্য ধরতে পারল না। সে চিৎকার করতে করতে নেমে যাচ্ছে।

—সব ভাঁওতা। আপনারা এর বিন্দু-বিসর্গ বিশ্বাস করবেন না। দোহাই ঈশ্বরের, আপনারা ফাঁদে পা দেবেন না। তিনি মুখে যাই বলুন মনে মনে জাহাজের অলৌকিকত্বে বিশ্বাসী। তাঁর বিশ্বাস জাহাজ ঠিক আমাদের পৌঁছে দেবে। সব ওঁর মনগড়া কথা। জাহাজের তো আর পাখা গজায়নি!

ছোটবাবু এখন কাকে কি বলবে বুঝতে পারছে না।

ডেবিড তখনও তারস্বরে চিৎকার করছে।—এখনও আপনাদের সময় আছে। এই ছোটবাবু তুমি ওদের বোঝাও। বুড়োর কথায় ওরা তো সব বুঝে ফেলেছে। দ্যাখো সবাই মাথা নুয়ে চলে যাচ্ছে মতো। এই এনজিন-কশপ কোথায় যাচ্ছ! জাহাজের খাবার ফুরিয়ে গেলে কি করবে! জল ফুরিয়ে গেলে! চিফ-মেট আপনি একটা কথাও বলবেন না! জাহাজ এক ইঞ্চি নড়ছে না এটাও বলবেন না! এবং এ-সময় যা হয় চোখের ওপর শুধু শহর নদী গাছপালা এবং গমের খেত। আর সেই প্রিয়জনেরা মুখের ওপর মিছিলের মতো সরে সরে যায়! তখনই সে মরিয়া হয়ে বলল—আমি থাকব না, এ জাহাজে থাকব না। সমুদ্র অনেক নিরাপদ জায়গা। জাহাজের অশুভ প্রভাবে থাকলে আমরা কেউ বাঁচব না। বলতে বলতে সে একেবারে বোটের নিচে হামাগুড়ি দিয়ে সত্যি সমুদ্রে লাফিয়ে পড়তে যাচ্ছে। এবং তখন যে যার মতো ছুটছে ডেবিডকে ধরার জন্য। ছোটবাবু তখন বিরক্ত মুখে যেন না বলে পারল না, স্যার কেন এদের আটকে রেখেছেন! এদের বোট দিয়ে দিন। যারা নেমে যেতে চায় নেমে যাক।

স্যালি হিগিনস প্রায় কৈফিয়তের সুরে বললেন—ছোটবাবু জাহাজ ভেসে থাকলে আমাদের চলে যাবার নিয়ম নেই। জাহাজ ডুবে যেতে থাকলে উই ক্যান এবানডান দ্য শিপ। কিন্তু সে তো আমাদের জলে ভাসিয়ে সমুদ্রের অতলে ডুবে যাচ্ছে না। এর জন্য তার প্রতি তোমাদের এতটুকু কৃতজ্ঞতা নেই!

ছোটবাবু কেমন বোবা বনে গেল। কী আন্তরিক কথাবার্তা তাঁর! থার্ড-মেট বলল—স্যার দেশলাই আছে? লম্ফটা নিভে গেছে আবার। ডেবিডের পা কেটে গেছে ছুটতে গিয়ে। বেনজিন লাগাতে হবে।

স্যালি হিগিনস পকেট থেকে দেশলাই বের করে লম্ফটা জ্বালালেন। অল্প অল্প হাওয়া বইছে। থার্ড মেট হাতে হাওয়া বাঁচিয়ে কোনোরকমে নিচে নেমে গেল। বেনজিন তুলো এনে এখন টুইনডেকে জোরজার করে ওষুধ লাগাচ্ছে। ওকে ঘিরে রেখেছে ক’জন জাহাজি। লাফিয়ে সমুদ্রে পড়ে গেলে কেলেঙ্কারি। মাস্তুলে লেডি-অ্যালবাট্রস বসতে পারছে না। তার নিচে এখনও আগুন জ্বলছে। কাছাকাছি কোথাও সে সমুদ্রে ভেসে রয়েছে। ছোটবাবু জ্যোৎস্নায় নিরুপায় হয়ে এখন কেবল পাখিটাকে যেন খুঁজছে। ফানেলের গুঁড়িতে বনি তেমনি শূন্যচোখে তাকিয়ে আছে ওপরে। সে বুঝতে পারছে না, কারা ঠিক। সে বাবার পক্ষে না বিপক্ষে তাও বুঝতে পারছে না বোধহয়।

ডেবিড তখন খোঁড়াতে খোঁড়াতে আবার উঠে আসছে। সে সবার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। একটা মশাল সে নিজের মুখের ওপর ধরে রেখেছে। এবং মশালের আলোতে ওর চোখ-মুখ জ্বলছিল। সে তারপর নিশীথে সবার মুখের ওপর দিয়ে সেই মশালের আলো ভাসিয়ে নিয়ে গেল। এবং নাটকের পাত্র-পাত্রীর মতো সে ঘুরে দাঁড়াল। কোনো যুদ্ধবাজ মানুষের মতো সে জ্বলে উঠছে। যে জানে জীবনে সে আর জাহাজে কাজ পাবে না, যদি কোনো কারণে সবাই রক্ষা পেয়ে যায় সে জানে তার সব রেকর্ড, বিশ্বস্ততার সব ইতিহাস মুছে যাবে।—এমন কি শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে কারাগারে বন্দীজীবন যাপনও করতে হতে পারে। তবু সে এবির মুখ এবং সন্তানের কথা ভেবে কেমন মশাল তুলে নিচ্ছে ওপরে। বলছে, আপনারা ওই লুকেনারের ডামিটাকে শুধু একটা প্রশ্ন করুন। মাত্র একটা প্রশ্ন। তিনি ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলবেন—সামোয়া বন্দরে তিনি কেন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ছোটবাবু তুমি এদের বুঝিয়ে বল। বলে সে খোঁড়াতে খোঁড়াতে সব জাহাজিদের পাশে ওদের সামিল হয়ে দাঁড়াল। ছোটবাবু বলল—ডেবিড আজ না হয় থাক। বুঝতেই পারছ আমরা কেউ ঠিক নেই। দু-একদিনে এমন কিছু হবে না আমাদের! আমাকে তোমরা সময় দাও বুঝিয়ে-সুঝিয়ে যদি মত বদলাতে পারি। সে কিছুতেই বলল না চাবিকাঠি তার হাতে। সে বনিকে দিয়ে কাজটা উদ্ধার করতে পারে বলল না।

ডেবিডের কথায় আবার যেন সবাই সাহস ফিরে পেয়েছে। ওরা আবার আগের মতো গোল হয়ে দাঁড়াল। স্যালি হিগিনস এক পা নড়ছেন না। ঠিক আগের মতো স্থির। গীর্জার কোনো ফাদার সিঁড়িতে যে-ভাবে মানুষের শুভ কামনায় দাঁড়িয়ে থাকেন তেমনি তিনি দাঁড়িয়ে ঈশ্বরের নামে শপথ গ্রহণ করবেন যেন এবার। তিনি সত্যি সত্যি বলতে আরম্ভ করলেন—ডেবিড, আপনি যা ভেবেছেন সত্যি তাই। আপনি সবটা জোর গলায় প্রচার করতে পারেন—আমার কোনো দুঃখ নেই আর। আমি সব মেনে নেব। এবং এই আপনি সম্বোধনে ডেবিড কেমন যেন অস্বস্তির ভেতর পড়ে গেল। একজন কাপ্তানের এ-ভাবে পরাজয় তাকে বোধহয় ক্ষতবিক্ষত করছিল। সে সহসা নতজানু হয়ে গেল, স্যার আমাকে ক্ষমা করুন। বলে সে দূরে সমুদ্রের ভেতর তার মশালটা নিক্ষেপ করে অন্ধকারে নিচে নেমে গেল। সবাই হাঁ। বোট-ডেকে কতগুলো ছায়া মাত্র। তাদের জোর একদম হারিয়ে গেছে। ওপরে মাথা নিচু করে রেখেছেন স্যালি হিগিনস। পাশে ছোটবাবু থার্ড-মেট, চিফ-মেট এবং এইমাত্র তিন-নম্বর মিস্ত্রি ওপরে উঠে কেমন একটা স্তব্ধতার ভেতর পড়ে গিয়ে আর সিঁড়ি ভাঙতে পারল না। সবাই যেন ফ্রিজ হয়ে গেছে মুহূর্তে।

এনজিন-কশপ সেই স্তব্ধতাভঙ্গকারী। সে বলল, ছোটবাবু তিনি কেন ব্যামোতে পড়েছিলেন আমি বলতে পারি।

ছোটবাবু একটা কথা বলল না।

এনজিন-কশপ এবার চারপাশের জাহাজিদের কাছে গলা উঁচিয়ে বলতে থাকল—তার গলার রগ ফুলে যাচ্ছে, সে হাতে একটা মশাল জ্বালিয়ে নিয়েছে। না নিলে সে যেন জোর পাচ্ছে না। সবার সামনে মশাল তুলে বলছে—ইনসে আল্লা অথবা যেন বলছে আল্লার কসম—আপনারা মিঞাভাইরা আমার জানেরা থোড়া মেহেরবানী করে শুনে লেন—জাহাজ দু’-দু’বার পিঁজরাপোলে যাবার কথা!

ফাইভার দেখছে ঠিকমতো লোকটা বলতে পারল না গুছিয়ে। সে মশালটা এবার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। বলল, তুমি থামো মিঞা। বলেই সে তাকাল ওপরে। তারপর বলল, থিও ফ্যাল স্যার দৈব দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। ঠিক?

স্যালি হিগিনস বললেন—ঠিক।

—জাহাজ স্ক্র্যাপ করার দলিলপত্রে সই করার নিমিত্ত গাড়িতে রওনা হয়েছিলেন?

—হয়েছিলেন।

—বজ্রপাতে তিনি রাস্তায় মারা গেলেন!

স্যালি হিগিনস মাথা নুয়ে ক্রস্ টানলেন বুকে

—তারপর রিচার্ড ফ্যালের পালা।

—হ্যাঁ তিনিও জাহাজটা বিক্রি করে দিতে চেয়েছিলেন।

পাঁচ-নম্বর যেন এবার মশালের আলোতে সবাইকে একসঙ্গে দেখতে চায়। সে বলল, শেষ পর্যন্ত পারেন নি। একমাত্র নাবালক পুত্র একমাত্র উত্তরাধিকার তাঁর মরে গেল। দুর্ঘটনায় মারা গেল। রিচার্ড ফ্যাল গাড়ি করে যাচ্ছেন। হস্তান্তরের জন্য কাগজপত্র সব রেডি। যাবার পথে তাঁর বিঘ্ন ঘটল। গাড়িতে পুত্রের মৃতদেহ আবিষ্কার করলেন—ঠিক?

ছোটবাবু এমন একটা ভয়াবহ ঘটনা যেন এই প্রথম শুনছে। আর জ্যোৎস্নায় সমুদ্র জাহাজ আকাশের সব নক্ষত্রমালা এবং চারপাশের সব মানুষ কেমন অজানা অচেনা হয়ে যাচ্ছে। ভীতিকর সব কথাবার্তা। জাহাজটা যেন ফুঁসছে নিরন্তর নিজের ভেতর। জাহাজটাকে আর কিছুতেই দশটা জাহাজের মতো মনে হচ্ছে না। স্যালি হিগিনসকে জ্যোৎস্নায় সেই মৃত, লুকেনারের অবয়ব মনে হচ্ছে। একমাত্র সে বনিকে চিনতে পারছে, ফানেলের গুঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে তেমনিভাবে। সে খুব অসহায় গলায় চিৎকার করে ডাকল, জ্যাক ওপরে এস, ওখানে দাঁড়িয়ে কি করছ তুমি!

পাঁচ-নম্বর সেই সব কথাবার্তা একবার ইংরেজীতে একবার বাংলায় প্রায় ধর্মগ্রন্থ পাঠের মতো বলে যাচ্ছিল। সে এবার খুব সতর্ক গলায় বলল, ফোনে কথা বলতে বলতে পড়ে গেলেন। পাঁচ- নম্বর প্রায় একজন উকিলের মতো জেরা করে যাচ্ছে। আর বিস্ময়ের ব্যাপার ছোটবাবু দেখছে, কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে প্রায় আসামীর মতো তিনি স্বীকারোক্তি করে যাচ্ছেন! বোধহয় পাঁচ-নম্বর এক্ষুনি ঘুরে যাবে, বলবে, হিয়ার ইজ দ্য পয়েন্ট।

স্যালি হিগিনস বললেন, ফাইভার শরীরটা আমার ভাল ছিল না।

–নো নো। ঠিক কথা বলছেন না। ঠিক কথা বলুন। আসল রহস্য খুলে বলুন। এমন দিগন্তব্যাপী সাদা জ্যোৎস্না যখন, আমরা যখন সবাই সমুদ্রের বিভীষিকায় পড়ে গেছি এবং যে কেনো মুহূর্তে জাহাজ সমুদ্রের অতলে ডুবে যেতে পারে, আমরা আশা করব মহামান্য ক্যাপ্টেন আমাদের কাছে কোনো রহস্য আর গোপন রাখবেন না।

স্যালি হিগিনস আর পারলেন না, দু’হাতে মাথার চুল ছেঁড়ার মতো চিৎকারে ফেটে পড়লেন, ফাইভার প্লিজ, প্লিজ আমাকে আর টরচার করবে না।

আর যায় কোথায়! এমন পরাজয়ের মুখে পাঁচ-নম্বর ভীষণ ক্ষিপ্ত গলায় বলে উঠল, আপনি এত সব জেনে কেন কাগজপত্রে সই করলেন জবাব দিন! কেন আপনি এতগুলো মানুষের জীবন নিয়ে ছিমিমিনি খেলছেন জবাব দিন! আপনি যখন জানতেন জাহাজে ক্যাপ্টেন লুকেনারের অশুভ প্রভাব আছে তখন কেন একবার ভাবলেন না, আপনার সই করার বিনিময়ে সব জাহাজির জীবন বিপন্ন হতে পারে। শুধু নিজের কথা আর শ্রীমান জ্যাকের কথা ভাবলেন। আমাদের কথা আপনার একবারও মনে হল না। আপনি স্বার্থপর, আপনি আপনি………।

ছোটবাবু বলল, ফাইভার আপনি কী সব বলছেন!

পাঁচ-নম্বর এবার আরও জোর গলায় যতটা সম্ভব, যেন তার চিৎকার সমুদ্রের দিগন্তে অস্পষ্ট জ্যোৎস্নায় যতদূর সম্ভব পৌঁছে দিতে চায়। তারপর প্রায় নাটকীয় গলায় বলে উঠল, বন্ধুগণ, আমরা এখন বুঝতে পারছি, মহামান্য ক্যাপ্টেনের প্রলোভন আমাদের নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কোম্পানির কর্তাব্যাক্তিরা তাঁকে পরিচালকবর্গের একজন করে নিয়েছেন বিনিময়ে। কতদূর নীচ হীন এই মানুষ, জাহাজের এতদিনের সংস্কার তুচ্ছ করে নিজের জীবন অথবা বলতে পারেন জ্যাকের জীবনের কথা একবার ভাবলেন না—সবচেয়ে অবাক লাগে এই বুড়ো বয়সে তোর কি এমন প্রয়োজন ছিল বলেই কোথায় যেন কথাবার্তায় গাফিলতি থেকে যাচ্ছে—ঠিক ঠিক সবাই যেন এখনও মশাল তুলে ছুটে আসছে না, মশালের আগুনে কাপ্তানকে পুড়িয়ে মারছে না—কিভাবে আর এইসব ঘটনা জোর গলায় বলা যেতে পারে—সে মরিয়া হয়ে ফের বলল, এখন কি দেখতে পাচ্ছি? চারিদিকে শুধু সমুদ্র। শুধু জল। আমরা বুঝতে পারছি না কোথায় আছি। তারপর সে কি ভেবে বলল, দেখুন দেখুন—জাহাজটাকে দেখুন। এর মাস্তুল, আফটার-পিক, ফরোয়ার্ড-পিক, ফানেল, উইন্ডসেল, হ্যাচ-উইনচ সব কেমন যেন কতদিন পর হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। রেস্ট….রেস্ট। নিরুদ্বিগ্ন জীবন। ভাবনা নেই আর। কেউ তাকে আর নাকে দড়ি দিয়ে টেনে নিয়ে যাবে না। সে মুক্ত। শী ইজ ফ্রি নাও।

ছোটবাবু দেখছে সব মানুষগুলোর চোখ মশালের আলোতে প্রায় স্থির। গোল গোল চোখে স্যালি হিগিনসকে দেখছে। কারো পলক পড়ছে না। সে ভয় পেয়ে ডাকল, স্যার আপনি কিছু বলুন। দোহাই। দেখছেন না এরা কি হয়ে যাচ্ছে। স্যার, এ-ভাবে মাথা নুয়ে দাঁড়িয়ে থাকার এখন সময় নয়। আমরা সবাই এখন বুঝতেই পারছেন পাঁচ-নম্বরের হাতে পড়ে গেছি। আমরা কিছু করে ফেললে…..।

পাঁচ-নম্বর এবার সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠে আসছে। আর চিৎকার করছে। যেহেতু সে পরেছিল কালো প্যান্ট এবং খয়েরী রংয়ের গেঞ্জি, জ্যোৎস্নায় সব কালো দেখাচ্ছে, ওর পোশাকে কেউ যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে এমনভাবে হাউ-মাউ করছিল—অর্থাৎ ভয়ে-ভীতিতে যেন সে ভেঙে পড়ছে।—সে চিৎকার করে কি বলছে, সব বোঝা যাচ্ছে না। কিছুটা বোঝা যাচ্ছে। সেই কিছুটাই প্রায় সবার হৃৎকম্প এনে দিয়েছে। সে বলছে, আমরা মরে কাঠ হয়ে যাব। সেই অশুভ প্রভাব—ক্যাপ্টেন লুকেনার আমাদের পাশেই আছে। এ-জাহাজে বহাল তবিয়তে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জাহাজের কলকব্জা সব উপড়ে ফেলেছে। একেবারে নিজের মতো চিরকালের একটা আশ্রয় বানিয়ে ফেলেছে। এতদিন লুকেনার সেই ফিকিরেই ছিল।

ছোটবাবু বলল, স্যার দোহাই আপনার ঈশ্বরের। সব, সবাই পাঁচ নম্বরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু না বললে, আপনাকে স্যার ওরা পুড়িয়ে মেরে ফেলবে। আপনি বলুন, একটাও সত্যি কথা নয়! সব মিথ্যা কথা বলছে ফাইভার! সব বানিয়ে বলছে!

পাঁচ নম্বর তখনও তেমনি চিৎকার করছে, একজন বিজ্ঞাপনদাতার মতো মুখ পাঁচ-নম্বরের। গুজব ছড়াবার পক্ষে যা যা দরকার সব সে এবার বিজ্ঞাপনে হাজির করছে। সে এবার প্রায় লাফাতে থাকল, যেন সারা শরীরের আগুন ওর মাথায় উঠে পড়েছে। সে বলল, এবার থিও ফ্যাল নয়। রিচার্ড ফ্যালের পুত্র নয়—এবারে বন্ধুগণ আমাদের পালা। আপনারা তৈরী হোন। মহামান্য ক্যাপ্টেন এবার আমাদের লুকেনারের হাতে তুলে দিলেন। অজানা সমুদ্রে শুধু ঢুকে গেছি। সমুদ্রে শুধু ভৌতিক অগ্নিকান্ড দেখতে পাব না। এবার লুকেনার ভয়াবহ নৃসংশতার ভেতরে নিয়ে যাবে। সোজা কথায় জাহাজটাতে আমরা সবাই লুকেনারের মতো মরে ভূত হয়ে যাব। লুকেনারের প্রোতাত্মা ভর করা জাহাজটাও এতদিন সেই ফিকিরে ছিল। এতদিন পর সে আমাদের বাগে পেয়েছে। আর তখনই দূরে কক্ কক্ করে ডাকছিল পাখিটা। সে কেমন এবার ফিসফিস গলায় বলতে থাকল, শুনতে পাচ্ছেন? ডাকছে! কেউ ডাকছে, মনে হচ্ছে কেউ হাসছে, কেউ হাসছে! দ্য সী-ডেভিল হাসছে। আমরা কেউ বাঁচব না। আতঙ্কে পাঁচ- নম্বর বলতে বলতে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল।

সমুদ্রের ভয়ংকর স্তব্ধতা তখন কি যে কঠিন শীতল হাহাকারে ভুগছে! কেউ একটা আর কথা বলতে পারছে না।

ছোটবাবু তখন প্রায় পাগলের মতো দু’হাতে নাড়তে থাকল স্যালি হিগিনসকে—জ্যাক নিচে তুমি কি করছ! ওপরে এস! দেখ তিনি কী হয়ে যাচ্ছেন। সে নিরুপায় হয়ে বলল, চিফ-মেট আপনি কিছু বলছেন না—স্যার স্যার! একবার আপনি প্রতিবাদ করুন। তা না হলে সবাই ভয় পেয়ে যাবে। ঘাবড়ে যাবে। আমরা আর আপনার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারব না।

স্যালি হিগিনস শুধু বললেন, ছোটবাবু ওতো ঠিকই বলেছে। ফাইভার তো বানিয়ে কিছু বলে নি!

—স্যার আপনি কী বলছেন! এ-সব আজগুবী কথা স্যার আপনি বিশ্বাস করেন! এতদিনের বিশ্বস্ত জাহাজ! ফাইভার অযথা দুর্নাম দিচ্ছে, আর আপনি সবার সামনে স্বীকার করছেন! আমাদের শেষ বিশ্বাসটুকু এ-ভাবে নষ্ট করে দিচ্ছেন!

স্যালি হিগিনস বিশ্বস্ত কথাটা বার বার উচ্চারণ করতে লাগলেন। সিউল-ব্যাংক ভারী তাঁর অনুগত ছিল। এখনও আছে। জাহাজটার জন্য তাঁর সর্বস্ব বাজি রেখে ভেবেছিলেন, তিনি স্যালি হিগিনস পাঁচ-নম্বর কত সহজে সব কেড়ে নিচ্ছে। তিনি জাহাজটাকে অযথা গুজবের হাতে ছেড়ে দিতে পারেন না। মনের দুর্বলতা প্রশ্রয় পেয়ে যাচ্ছে ভেবে সোজা হতে চাইলেন। তিনি সোজা হয়ে দেখলেন চারপাশে কি নিদারুণ জ্যোৎস্না, কি নীল আকাশ আর অনেক দূরে যেন সেই মহাপ্রাণ–কক্-কক্ করে ডাকছে। তিনি সাহস সঞ্চয় করছেন—কল আপন্ মি ইন দ্য ডে অফ ট্রাবল, আই উইল ডেলিভার দী অ্যাণ্ড দাউ শ্যান্ট গ্লোরিফাই মি। তিনি এবার দ্রুত নেমে গেলেন। আর বলতে থাকলেন, জাহাজটার প্রতি আপনারা কে বিশ্বস্ত বলুন। হু ইজ ফেথফুল টু দ্য শিপ। সবাই আপনারা মাস্তারে দাঁড়ান।

এবং ওপরে কেউ আর থাকল না। সবাই যে যার মতো বোট-ডেকে মাস্তার দিলে তিনি বললেন—ইউ? ইউ? তাঁর আলখাল্লার মতো লম্বা স্লিপিং গাউন পাটাতনে লোটাচ্ছে। তাঁর কপাল ভীষণ ঘামছে। মনে শংকা তাঁর। প্রত্যেকের মুখের সামনে মশাল তুলে বললেন—ইউ? নান্। কেউ তাঁর স্বপক্ষে নেই। তিনি কেমন ভেঙে পড়ছেন! তখন ছোটবাবুর মুখ মশালের আলোতে প্রায় উদ্ভাসিত—তিনি বললেন, তুমি ছোটবাবু?

ছোটবাবু বলল, মি ফেথফুল টু দ্য শিপ স্যার।

—আর, আর কে! তিনি যেন ফের সাহস ফিরে পাচ্ছেন।—জ্যাক তুমি?

জ্যাক হাত তুলে দিল। যেন বলতে চাইল ইয়েস মি ফেথফুল টু দ্য শিপ, টু ইউ অ্যাণ্ড…অ্যাণ্ড কথাটাতে সে বোধহয় ছোটবাবুকে বোঝাতে চাইল। সব মিলে যেন ছোটবাবু বাবার পাশে দাঁড়াবার মতো যথার্থ মানুষ। এবং এভাবে সে আর বিন্দুমাত্র ভয় পাচ্ছে না জাহাজে থাকতে। বাবা ছোটবাবু সে। তার আর কিছু লাগে না।

তিনি তখন মশালের আলোতে বলে বলে যাচ্ছেন, আর, আর কে? এনি মোর? এক হাতে গাউন সামলাচ্ছেন অন্য হাতে মশাল তুলে বলছেন—ইউ? নো ফেথ্! নো…দে…ইউ…ইউ?

—মি সাব ফেথফুল! এনজিন-সারেঙ হাত তুলে দিলেন।

আর কেউ না, তিনি এবার ফিরে যেতে থাকলেন। আর কেউ জাহাজটার প্রতি বিশ্বস্ত নয়। তারা সহজেই তাঁকে পুড়িয়ে মারতে পারে। ভয়ে মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলে তিনি সিঁড়িতে দ্রুত উঠে গেলেন। যেন ওরা ছুটে আসছে পেছনে। ওঁকে ধরবার জন্য হা-হা করে ছুটে আসছে। ওপরে উঠে পেছনে তাকালেন। তিনি কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। কেউ নেই। তিনি একা। একা দাঁড়িয়ে আছেন। জাহাজে একটা কাক-পক্ষী নেই। অন্তহীন সমুদ্র আর আকাশ। জাহাজটা সাঁতার কাটছে সমুদ্রে। তিনি এবার ভীষণ অহঙ্কারী গলায় বলে উঠলেন—আপনাদের ছুটি। কাল সকালে আপনারা সেল করবেন। ঈশ্বর আপনাদের সহায় হোন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *