1 of 2

অলৌকিক জলযান – ৪৫

।। পয়তাল্লিশ।।

ছোটবাবু ফিস্ ফিস্ গলায় ডাকল, বনি।

বনি বলল, বাবা আমাকে জাহাজ থেকে আর নামতে দেবে না ছোটবাবু।

ছোটবাবু বলল, কেন নামতে দেবে না! ডেবিড যাচ্ছে।

—বাবা কিছুতেই রাজী হচ্ছে না।

ছোটবাবু সুন্দর পোশাক পরে ওপরে উঠে এসেছে। সারাদিন ভীষণ খাটুনি গেছে। সে তাড়াতাড়ি কাজ সেরে স্নান করেছে ভাল করে। এ ক’দিন মন ভাল ছিল না। মৈত্রদার মৃত্যুর পর সে কেমন নিঃসঙ্গ বোধ করছিল। বিকেলে তার কোনদিন জাহাজ থেকে নামতে ইচ্ছে হয়নি। সকাল থেকে আজ ডেবিড বারবার ওর কাছে এসেছে। তাকে নিয়ে কিনারায় নেমে যাবে। শহরে ঘুরবে। কোনো পাবে বসে সামান্য ড্রিংকস। এভাবে একটু উৎফুল্ল হওয়া। তখনই মনে হয়েছে গেলে মন্দ হয় না। সে, বনি আর ডেবিড। বনির সঙ্গে কতদিন যেন একা একা শহরের রাস্তায় অথবা সমুদ্রের ধারে সে হেঁটে যায়নি। সে বলেছিল বনিকে, আমরা বিকেলে কিনারায় যাব।

বনি বলেছিল, আমিও যাব।

কিন্তু এখন বনি কেমন নিস্পৃহ, তার কোনো ইচ্ছে নেই যাবার। সে চুপচাপ জাহাজের ডেক চেয়ারে বসে আছে। কিছু বই একটা টিপয়ের ওপর। খুশিমতো যে কোনো বই তুলে দু’টো-একটা পাতা ওল্টে দেখছে আবার রেখে দিচ্ছে। আসলে তার কিছু ভাল লাগছে না। বাবা দিন দিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছেন। সে বলল, জানো ছোটবাবু বাবা রাতে একেবারে ঘুমোয় না।

ছোটবাবু পা ছড়িয়ে পাশে বসে পড়ল। বলল, কেন কি হয়েছে?

—বাবা মাঝে মাঝে আমার দরজায় নেমে আসেন।

—কেন নেমে আসেন? কি করে টের পাও তিনিই নেমে আসছেন!

—আমি বুঝতে পারি ছোটবাবু। বাবা সিঁড়ি ধরে নেমে এলেই বুঝতে পারি। মাঝে মাঝে বাবা নেমে এসেও নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন না। ডাকেন। আমি জেগে থাকলে সাড়া দেই। বাবা কেন যে এমন হয়ে যাচ্ছেন!

ছোটবাবু বলল, বুড়োর শেষ সফর। আর সমুদ্রে আসতে পারবেন না। সমুদ্রের জন্য বুড়োর শোক উথলে উঠছে।

—তা এভাবে আমার কেবিনের দরজায় সেজন্য দাঁড়িয়ে থাকবেন কেন?

—ভাল লাগে না ঘুম আসে না। নিজের বলতে পৃথিবীতে এখন শুধু তুমি। সারাক্ষণ তোমাকে কাছে কাছে রাখতে চান।

—আরে না। তা ঠিক না। পরশু রাতে কি হল তুমি তো জান না!

—কী হয়েছে!

—আমার ঘুম আসছিল না। কেন যে ছোটবাবু ঘুম আসে না! যখন আর পারছিলাম না, ভাবলাম গোপনে তোমার কেবিনে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকব। জাহাজে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। কে টের পাবে বল! দরজা খুলে দেখি বাবা ওপরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছেন। একা। ব্রীজের সব আলো নিভিয়ে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছেন। কার সঙ্গে কথা বলছেন যেন। বাবাকে আমি এভাবে কখনও দেখিনি! সন্তর্পণে দরজা খুলেছিলাম। সামান্য গলা বাড়াতেই দেখেছি বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। মনে হল বাবা টের পান নি, দরজা বন্ধ করে দেব ভেবে আবার যেই না সরে গেছি তখনই বাবা ডাকলেন, ভাল করে দরজা লক করে দাও। এত রাতে আবার উঠেছ কেন?

ছোটবাবু বলল, ঠিক একটা কেলেঙ্কারী করবে বনি। তুমি কেন এত রাতে দরজা খুলতে গেলে! মাথায় তোমার কি চাপে!

বনি ভীষণ দমে গেল। ছোটবাবু পর্যন্ত তিরস্কার করছে। কেউ তাকে বুঝতে পারছে না। সে আর একটা কথাও বলল না। বইয়ের পাতা উল্টাতে থাকল।

ছোটবাবু তখন আরও ক্ষেপে যায়। না, না, বনি এটা তুমি ঠিক করনি। তুমি বুঝতে পারছ না কেন তোমার এভাবে বের হওয়া ঠিক না।

—আমি কি করব ছোটবাবু। পারি না, দু’বার তোমার দরজায় পর্যন্ত অন্ধকারে নেমে গেছিলাম। তুমি বকবে বলে দরজায় গিয়েও ডাকতে পারি নি। আবার ফিরে এসেছি। তুমি ভারি নিষ্ঠুর ছোটবাবু।

ছোটবাবুর মাথায় এখন কিছু শব্দ বার বার ঘুরপাক খাচ্ছে—স্যালি হিগিনস ঠিক অনুমান করেছেন, বনি পালিয়ে কোথায় যেতে চায়। বনি পালিয়ে ছোটবাবুর কেবিনে যেতে চায়। সে কেমন এবার শাসনের গলায় বলল, পোর্ট মেলবোর্নে তোমাকে ঠিক নামিয়ে দিতে বলব।

বনি বলল, কেউ আমাকে নামাতে পারবে না ছোটবাবু।

–কেউ দেখে ফেললে কি হবে বলতো! বুড়ো মানুষটাকে আমরা মুখ দেখাব কি করে বল তো। আর ভাবছ সবাই চুপচাপ থাকবে! আর্চি তখন পেয়ে বসেব না তোমাকে! বনি, দোহাই ছেলেমানুষী কর না।

বনি তাকাল না পর্যন্ত। খুবই গম্ভীর মুখ। বয়সী যুবতীর মতো মুখ গম্ভীর করে রেখেছে। বই-এর পাতা উল্টে যাচ্ছে। মুখ তুলে ছোটবাবুকে একবারও দেখছে না। ছোটবাবু পাশে বসে আছে, থাকুক। ছোটবাবুর তো কেবল এখন তিরস্কার করার স্বভাব। ছোটবাবু, তুমি এত স্বার্থপর কেন—যেন ছোটবাবুর এই স্বার্থপরতাকে কিছুতেই সে সহ্য করতে পারছে না। পারলে সে এখন উঠে চলে যেত। কিন্তু ছোটবাবু যা একখানা মানুষ! অপমানজ্ঞান এত, হয়তো তারপর দিনের পর দিন কথা বলবে না। যেন বনি বলে সে কাউকে কখনও চেনে না। তার বলার ইচ্ছে হল, ছোটবাবু তুমি নিজেকে ছাড়া আর কারও কথা ভাব না। কিন্তু কিছু বলতে পারল না। তোমার তো ছোটবাবু খুশী হওয়ার কথা। আমি তোমার জন্য এত করতে পারি, তুমি আমার জন্য এটুকু সহ্য করতে পারবে না!

ছোটবাবু কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। বনি কথা না বললে তার মাথায় এখন আরও বেশি রক্ত উঠে যায়। সে বলল, নামিয়ে না দিলে তোমার ঠিক শাস্তি হবে না।

—বললাম তো কেউ পারবে না ছোটবাবু। মরে যাব, তবু কেউ তোমরা পারবে না।

ছোটবাবু সহসা খুবই দমে গেল। চোখ তুলে বনির মুখ দেখল। ভীষণ থমথম করছে। সারা মুখে রক্তচাপ। বোধহয় মেয়েটার অপমানে চোখ জ্বালা করছে। ছোটবাবু বলল, বনি, আমি তোমার ভালোর জন্য বলছি। তোমাকে নিয়ে বনি আমার ভারী ভয়।

সহসা বনি এবার জ্বলে উঠল। ওর দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে বলল, কেন তুমি জাহাজে উঠে এলে ছোটবাবু! তোমার সঙ্গে আমার দেখা না হলে কি ক্ষতি ছিল! তুমি কেন আমার সব এভাবে চুরি করে নিয়েছ! কেন কেন? এখন তুমি তামাশা দেখছ। কিছু হলে তোমার কলঙ্ক হবে বলছ। তুমি এত ছোট, তুমি এত স্বার্থপর ছোটবাবু। তুমি ভাল না, তুমি খারাপ। বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ল!

ছোটবাবু বলল, এই বনি, ছিঃ কি হচ্ছে! বনি প্লিজ এমন করে না। শোনো! বনি প্লিজ, ডেবিড উঠে আসছে।

বনি তাড়াতাড়ি বই দিয়ে মুখ ঢেকে দিল।

ডেবিড কাছে এসেই হৈ-চৈ বাধিয়ে দিয়েছে।—কি ব্যাপার তোমরা এখানে! সেজেগুজে বসে আছি, পাত্তা নেই তোমাদের, এই জ্যাক চল। তুমি যাবে বলেছ। তা চল! দুষ্টুমি করবে না। আরে তুমি চলে যাচ্ছো কেন! যাবে না!

ছোটবাবু দেখল, বনি মুখ আড়াল করে কেবিনের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। সে তাকিয়ে থাকল, তারপর কেবিনের ওপাশে চলে গেলে বলল, জ্যাক যাবে না। ওর শরীর ভাল নেই বলছে।

—কি হল আবার?

—কি জানি কে জানে! ছোটবাবু বলতে বলতে ভারী অন্যমনস্ক হয়ে গেল। সে কিছু দেখছে না মতো হেঁটে যাচ্ছে ডেক ধরে। ডেবিড পেছনে পেছনে যাচ্ছে। ছোটবাবু বোটে উঠেও একটা কথা বলল না ডেবিডের সঙ্গে। ডেবিড দড়ি খুলে দিল। ছোটবাবু তেমনি দাঁড়িয়ে আছে। ও পরেছে কালো প্যান্ট হাওয়াইন শার্ট—পায়ে সাদা মোজা আর কালো জুতো। ওর দিন দিন চুল ঠিক জ্যাকের মতো বড় হয়ে যাচ্ছে। এবং কি যে সুমহান চোখমুখ হয়ে যাচ্ছে ক্রমে! দাড়ি সেই নীলাভ রঙের পাতলা, ক্রমে ঘন হচ্ছে। চোয়াল ভীষণ ভারী। এবং নাকের কিছুটা অংশ এখন দেখা যাচ্ছে—শরীরে সবুজ ঘাসের মতো কখনও রঙ, কখনও মনে হয় ঘাড়ে মসৃণতা অত্যধিক। হাতের পেশী শক্ত, ডেবিড়ের কেমন ভয় ভয় করতে থাকল। বলল, ছোটবাবু তুমি এমন গুম মেরে আছ কেন!

ছোটবাবু বলল, কই না তো!

—তোমার কিছু হয়েছে ছোটবাবু?

—কি হবে?

—কি হয়েছে জানি না। কিছু হয়েছে এটুকু বলতে পারি।

—আরে না। কিচ্ছু হয়নি। ছোটবাবু বোটে উঠে ডেবিডের পেছনে চলে এল। দাঁড় টানবে বলে বসে পড়ল। ওর মুখে অজস্র রেখা তৈরি হচ্ছে—নানারকমের সংশয়।—আর্চি সারারাত আবার জাহাজে জেগে থাকছে!

সে নুয়ে দাঁড় টানছে। ক্রমশ আর্চি চারপাশে নেচে বেড়াচ্ছিল। স্যালি হিগিনস, আর্চি, পুরনো জাহাজ, এই যুবতী মেয়ে আর সব নানারকম সংশয় ক্রমে ছোটবাবুকে অস্থির করে ফেলছে। সে একটা কথা বলতে পারছে না। মনে হচ্ছে জাহাজ সমুদ্রে ভেসে গেলেই ভয়ঙ্কর কিছু ঘটবে। এসব ভাবনার ভেতর জ্যাকের মুখ বড় বেশি হারিয়ে যাচ্ছিল। তখন ইচ্ছে হচ্ছিল, একবার গোপনে পেছনে তাকায়। যদি জ্যাক জাহাজে দাঁড়িয়ে থাকে, তাকে সে বোট থেকে দেখবে।

এবং তখনই কি যে হয়ে যায়, সে দেখতে পায় পোর্ট-হোলে সেই মুখ। সে ফিরে তাকাতেই ধীরে ধীরে হাত নাড়ছে—আমি আছি ছোটবাবু ভয় নেই। আমি পোর্টহোলে দাঁড়িয়ে তোমাকে দেখছি। তুমি যত দূরেই যাও আমি আছি সঙ্গে! ছোটবাবু মনে মনে বলল, আমিও আছি বনি। সে দাঁড়িয়ে হাত নাড়তে থাকল। বনি হাত নাড়ছে। সহসা এক আশ্চর্য সুখানুভূতিতে ছোটবাবুর মনটা ভরে গেল। চোখ ঝাপসা হয়ে গেল বনির কথা ভেবে।

ছোটবাবু বলল, ডেবিড আমি কিন্তু বেশি খাব না। আমাকে তাড়াতাড়ি জাহাজে ফিরতে হবে। বনিকে জাহাজে একা ফেলে সে একদণ্ড কোথাও আর থাকতে পারছে না।

আর যা মনে হল ছোটবাবুর, বনি জাহাজে না থাকলে সেও ঠিকঠাক যেন জাহাজে বেঁচে থাকবে না। ডেবিডকে নিয়ে সে বেশি সময় কিনারায় থাকল না। বালিয়াড়িতে সে এবং ডেবিড কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াল। সন্ধ্যা হয়ে গেলে ওরা দু’জন পাশাপাশি বসল। আভা ঘাসের মদ খেল দু’জনে। কিছু খাবার। ডেবিড ওর সঙ্গে ফিরে এল না। সে একা ফিরে এল জাহাজে।

এবং এভাবে আর কখনও ছোটবাবুকে নেমে যেতে দেখা গেল না। সারাদিন কাজের পর সে বোট- ডেকে জ্যাকের সঙ্গে বসে থাকত। গল্প করত। ডেবিড বার বার এসে ফিরে গেছে। ওকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেনি। সূর্যাস্তের সময় ছোটবাবু রেলিঙে দাঁড়িয়ে থাকলে ডেবিড বুঝতে পারত, যেভাবে ছোটবাবু জাহাজে উঠে এসেছিল এখন আর সেভাবে ছোটবাবু বেঁচে নেই। কেমন ধীরস্থির এবং চরিত্রের দৃঢ়তা ছোটবাবু জাহাজে বড় হতে হতে পেয়ে গেছে। ছোটবাবু কথা বললে মনে হয়, অনেক দূর থেকে কথা বলছে। ছোটবাবুকে আর আগের ছোটবাবু কিছুতেই ভাবা যাচ্ছে না।

মাসাধিককাল জাহাজ এ-বন্দরে থেকে গেল। ফসফেট ডেরিকে বোঝাই হচ্ছে। ক্রেনে যত সহজে একটা জাহাজ বোঝাই হতে পারে ডেরিকে তত সহজে হয় না। সময় লেগে যায়। এখন জাহাজ বোজাই হয়ে গেলে ফের যাত্রা। জাহাজ আপাতত যাবে জিলঙে। পোট-মেলবোর্ন পার হয়ে মাইল চল্লিশ

দূরে ছোট্ট বন্দর। সব মাল সেখানে খালাস করা হবে। স্যালি হিগিনসের কাজকর্ম এবং অফিসারদের সব দেখাশোনা শেষ। বন্দর ছাড়ার আগে সেই এক নিশান উড়িয়ে দেওয়া। সবাইকে বলে দেওয়া চব্বিশ ঘণ্টার ভেতর জাহাজ আবার ছাড়ছে। বয়লার-রুমে সব বয়লারের স্মোক-বক্স একেবারে পরিষ্কার করে নেয়া হয়েছে। ক্রস-বাংকারে কয়লা লেভেলিং হচ্ছে। কোনো কারণে উঁচু নিচু পড়ে থাকা কয়লায় গ্যাস হতে পারে। আগুন লেগে যেতে পারে জাহাজে। কোথাও কোনো কারণে গাফিলতি থেকে না যায়। প্রায় বিশদিনের মতো জাহাজ ফের সমুদ্রে ভেসে চলবে। মে মাসের মাজামাঝি সফর। দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ুর গতিবেগ ক্রমশ এখন বাড়ছে। সমুদ্রের আবহাওয়া খুবই খারাপ থাকার কথা। ঝড় বৃষ্টিতে জাহাজটা ভেসে চলবে সমুদ্রে। ফল্কার ওপরে কাঠ, কাঠে ত্রিপল এবং চারপাশে কিল্ এঁটে সবকিছু ধোয়ামোছা শেষ। কোথাও কিছু পড়ে নেই ডেকে। ঝড়ের দরিয়ায় পড়ে গেলেও কিছু ভাসিয়ে নিতে পারবে না। কোথায় কি রঙ চটে গেছে, খুঁজে খুঁজে দেখছে ডেক-টিণ্ডাল। রং-এর টব কোমরে ঝুলিয়ে জাহাজিরা ছোটাছুটি করছে। নিচে ওপরে ভেতরে বাইরে এভাবে রঙ করে নেয়া হচ্ছে—সব ডেরিক নামিয়ে দেয়া হচ্ছে। এবং মজবুত সব গিঁটের সাহায্যে বাঁধাছাঁদা শেষ। উইন্‌চগুলোতে ত্রিপলের ঢাকনা পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। জাহাজের লাব্বাস-লাইন আবার জলে পড়ে আছে। জাহাজ চলতে আরম্ভ করলেই দড়ি-রিঙে ছোট্ট একটা ডালিমের মতো গুলি ঘুরতে থাকবে অনবরত। জাহাজের গতি মাপার জন্য এটা ঠিকঠাক করে নেয়া দরকার!

জলের ট্যাংকগুলোতে কত জল আছে, জাহাজের ড্রাফট ঠিক থাকল কিনা, ভাঙা জাহাজ বলে খুশিমতো দু-এক ফুট ড্রাফট এদিক-ওদিক হওয়ার উপায় নেই। কম হলে ক্ষতি নেই। বেশি হলে বোধহয় জল এবং কয়লার ওপর দিয়ে যাবে। জল কম হলে রেশনিং করে দেয়া যেতে পারে। কাজেই সব চার্ট, সব স্টক, জাহাজের কোথায় কি কতটা আছে সব এক এক করে বুঝে নিচ্ছেন স্যালি হিগিনস। তিনি সবাইকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখছেন, যেমন প্রত্যেকবার জাহাজ ছাড়ার আগে দেখে নেন। বন্দরে তিনি দু’বার বোট-মাস্টার করিয়েছেন—যদিও বন্দরে বোট-মাস্টার করা কোনো জরুরী ব্যাপার থাকে না। জাহাজের লাইফ-বয়াগুলো সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নিচ্ছেন। শেষ সফরে তিনি ভীষণ সতর্ক। লাইফ-বয়া, লাইফ-জ্যাকেট, দু’টো বড় বড় কাঠের পাটাতন, সবই যেখানে যেভাবে থাকে ঠিকঠাক আছে দেখতে পেলেন। লাইফ-বোটের শুকনো খাবার, জল, তেল, লণ্ঠন, সী-অ্যাংকার সব ঠিকঠাক আছে। বোটের ওপরে ত্রিপলে ঢাকা। পুরানো বলে কোথাও ফুটাফাটা। দু’টো মোটর বোটেই দেখলেন লাইফ- বোটে ট্র্যানমিটার সেট নেই। ও দু’টো চার্ট-রুমে থাকে। বোট-মাস্টারের সময় রেডিও-অফিসার হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে এসেছিল, আবার তুলে রেখেছে বোঁধহয় চার্ট-রুমে। ঝড়জলে ও দু’টো আবার সময়-কালে যদি নষ্ট হয়ে যায়। রেডিও-অফিসার তবে বুঝতে পারছে, স্যালি হিগিনসের কাছে ফাঁকি দেবার উপায় নেই। দরকার মতো হাতের কাছে আসল ত্রাণকর্তা। ট্র্যান্‌সমিটার সেটটি বিকল—তখন মাথা চাপড়ানো ছাড়া অন্য উপায় আর থাকবে না। চার্ট-রুমে রেখে ভালই করেছে।

এভাবে জাহাজে পর পর সব কাজ হয়ে গেলে, গ্যাঙ-ওয়ে থেকে সিঁড়ি টেনে তোলা হতে থাকল। এটাই সবার শেষের কাজ। জাহাজের সঙ্গে ডাঙ্গার শেষ যোগসূত্র এভাবে উঠে এলেই মনে হবে চারপাশে সর্বত্র যেন কেউ সেই বিউগিল বাজিয়ে দিচ্ছে ফের। সমুদ্রে, অসীম অনন্ত সমুদ্রে জাহাজ সিউল- ব্যাংক তার বিশ্বাস অবিশ্বাস আর কিংবদন্তী নিয়ে ভেসে চলেছে। মনের ভেতরে তখন যার যত দুর্বলতা সব এক এক করে দেখা দিতে থাকে। মৃত্যু এবং বেঁচে থাকা দুইই পরম আত্মীয়ের মতো মনে হয়। শেষ চিঠি তারা পৌঁছে দেয় এজেন্টের হাতে। আমরা যাচ্ছি জিলঙ। বেঁচে থাকলে সেখানে আমরা তোমাদের চিঠি পাব।

ঠিক একই দৃশ্য আবার, জাহাজ যত সমুদ্রে এগিয়ে যায় ডাঙা যত দূরে সরে যায়, জাহাজিদের মন তত খারাপ হতে থাকে। স্বভাব যে কি মানুষের—ডাঙা যতক্ষণ দেখা যাবে কেউ নড়বে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে সেই দ্বীপ এবং দ্বীপের বর্ণমালা দেখতে দেখতে ঠিক স্বদেশের মতো কষ্ট বুকে। যে-কোনো ডাঙাই তখন তাদের দেশ মনে হয়। ঐ দ্বীপটাতেই যেন বেঁচে রয়েছে তার স্ত্রী পুত্র অথবা মা এবং মনে হয় কোনো সবুজ শস্যক্ষেত্র পার হলেই সে তার ছোট্ট কুটির দেখতে পাবে। যুবতী স্ত্রী দরজায়। চোখ তুলে বলছে, তাহলে এলে! সফরে বের হলে ঘরে ফেরার নিশ্চিন্ত সম্ভাবনা বুঝি মানুষের থাকে না।

ওরা সেই দ্বীপটার পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। মৈত্রকে এ দ্বীপটায় রাখা হয়েছে। এখনও কাঠ-কয়লা কিছু পোড়া কাঠের অংশ ভাঙা হাঁড়ি দেখা যাচ্ছে। সমুদ্রের এই দ্বীপে যেন বেশ তাকে মানিয়ে গেছে। অশান্ত তরঙ্গমালার ভেতর আশ্চর্য দ্বীপটা। নির্জনতা প্রবল। হা হা করে বাতাস সারাক্ষণ বয়ে যাচ্ছে আর দ্বীপে মৈত্রের সব অস্তিত্ব ছড়িয়ে আছে। দ্বীপটা এখন মৈত্রদার। বোধ হয় কোন সফরে যদি আবার সে ফিরে আসে দেখতে পাবে বসন্তনিবাসের নামে কেউ এখানে একটা স্মৃতিসৌধ গড়ে দিয়ে গেছে। ছোটবাব; দ্বীপটার কোথায় কিভাবে মৈত্রদাকে পুড়িয়ে দিয়েছিল এক এক করে বনিকে বলে যাচ্ছে—এবং সেই যে জাহাজে ওঠার সময় তার সব ভরসা ছিল মৈত্রদা, সেই মানুষ তার নাম দিয়েছিল জাহাজে ছোটবাবু এসব বলতে বলতে শেফালীবৌদির গল্প এবং কখনও যে মৈত্রদা স্বপ্ন দেখত একটা বড় পাইন গাছে কেউ ঝুলিয়ে রেখেছে বড় একটা তিমি মাছের কংকাল, নিচে মৈত্রদা দাঁড়িয়ে আছে—এসব কথা সে বলতে বলতে দেখল বনি হাঁ করে তাকে দেখছে। ছোটবাবু বলল, বনি, তুমি কি দেখছ! দ্বীপে মনে হচ্ছে না মৈত্রদা আমাদের হাত তুলে টা টা করছে!

বনি বলল, শুনছ?

—কী!

—তুমি শুনতে পাচ্ছ না!

—না।

—বাবা আবার সেই গানটা বাজাচ্ছেন।

ছোটবাবু ওপরে তাকাল। ব্রীজে ডেবিড পায়চারি করছে। পাশে হুইলের সামনে তিন-নম্বর কোয়ার্টার- মাস্টার। মাথায় টুপি। মুখ প্রায় টুপিতে ঢাকা। সে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে আদিগন্ত সমুদ্রের জলরাশি খেলাচ্ছলে যেন অসীমে ভেসে যাচ্ছে অথচ সেই সঙ্গীত ঠিক সঙ্গীত বলা যাবে না, আশ্চর্য এক মেলোডি বোধ হয়। যখন কোনো জাহাজি সমুদ্রে থেকে যায় স্যালি হিগিনসের দুঃখবোধ বাড়ে। কিংবা স্যালি হিগিনস এখন কোথায়? সে বলল, তিনি তো কোথাও নেই বনি?

বনি বলল, বাবা ঠিক ঘরে বসে বাজাচ্ছেন। এবং বনি ঠিক বুঝতে পারছে না বাবা আবার এত দুঃখের ভেতর ডুবে যাচ্ছেন কেন। বাবা যখন সবকিছুর ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন, এমন কি তাঁর ঈশ্বরের ওপর তখন তিনি এ গানের ভেতর, এমন একটা সুরের ভেতর ডুবে যান। বাবা, মা চলে যাবার পর, এভাবে গান বাজিয়ে বাঁচার মতো আশ্রয় খুঁজেছিলেন। আবার কি বাবা এমন একটা আশঙ্কার ভেতর পড়ে গেছেন, যেন কোনো তাঁর অতীব আপন কিছু শেষ অবলম্বন হারিয়ে ফেলছেন। শেষ অবলম্বন বলতে বনি জানে সে নিজে এবং বাবাকে এভাবে ভায়োলিন বাজাতে শুনে কেমন শঙ্কা বোধ করল।

ওরা দু’জনই ভীষণ ঝুঁকে ছিল সমুদ্রে। ছোটবাবু দ্বীপটা দেখছে দূরে সরে যাচ্ছে। দ্বীপটা দেখতে দেখতে লেডি-অ্যালবাট্রসের কথা মনে পড়ছে। এখনও দিগন্তে ওকে দেখা যাচ্ছে না। যত জাহাজ সমুদ্রে ঢুকে যাচ্ছে তত ভাবছিল পাখিটা দিগন্তে কোথাও উড়ে উড়ে আসছে দেখতে পাবে। কাছে এলে সে ঠিক চিনে ফেলবে। অথচ পাখিটা নেই, দ্বীপটা দূরে সরে যাচ্ছে; বনি এখন বোটে হেলান দিয়ে বসে আছে। ওর চোখ কেমন স্থির। সে খুব নিবিষ্ট হয়ে যাচ্ছে যেন। একটা পা সে তুলে দিয়েছে রেলিঙে। প্যান্ট গোটানো হাঁটুর কাছাকাছি। পায়ে পাতলা চাঁদমালার জুতো। খালি পা, মোজা পরেনি বলে ভারী মনোরম। ছোটবাবু বোধ হয় চুরি করে বনির খালি পা এবং আরও কিছু, এভাবে কি সব ভাবছিল—লেডি-অ্যালবাট্রসের কথা মনে আসছে। প্রিয় পাখিটার কথা পর্যন্ত সে বনির খালি পা এবং সৌন্দর্য দেখতে দেখতে ভুলে যাচ্ছে—আর এ সময়ে বনির কি দরকার ছিল এমন একটা উদ্ভট পোশাকে নেমে আসার। মাথায় তালপাতার টুপির ভেতর জাফরিকাটা হলুদ রং, বাঁ-হাত ঘাড়ের কাছে, আর ডান-হাত বুকের কাছে। লাল রঙের জ্যাকেট পরেছে। মোটা বেল্ট আর পোশাকের আঁটসাট শক্ত আবরণের ভেতর শরীরের ভাঁজ যেন ফুটে বের হচ্ছে! এত সাহস বনির কি করে হচ্ছে! সে জানে খুব কাছে তার কেবিন, সে বুকের ওপর ইচ্ছে করলে ন্যাপকিন ফেলে সব একেবারে গোপন করে ফেলতে পারে—কিন্তু এখানে যদি এখন ডেবিড চলে আসে! যে কেউ এলেই সামনাসামনি দাঁড়ালে টের পাবে, যেন জ্যাক মেয়ে। অথচ সে জানে এমন করে ওকে কেউ দেখে ফেললেও বিশ্বাস করবে না সে মেয়ে। কারণ সে জানে, এটা একটা আজগুবি কথা কার্গো-শিপে মেয়ে! কারণ এ তো আর যাত্রী বহন করে না, অথবা কোনো কার্গো-শিপে দশ-বারোজন যাত্রীর ব্যবস্থা কখনও কখনও থেকে যায়। কিন্তু সিউল-ব্যাংক যাত্রী নেবে দূরে থাক দামী কার্গো পর্যন্ত সে পায় না। আর সেখানে মেয়ে-যাত্রী, মেয়ে! ভাবাই যায় না যতই তুমি মেয়ে মেয়ের মতো থাকো। কেউ ভাববে না তুমি মেয়ে! তুমি মেয়ে সেজে সবাইকে লোভে ফেলে দিচ্ছ এমন ভেব না! আর তখনই মনে হল, কেবল আর্চি, আর্চি জানে, আর্চি জানে জ্যাক বনি। আর্চি জ্যাককে কেবিনে টেনে নিতে চেয়েছিল। সে কেমন ভেতরে ভেতরে গণ্ডগোলের ভেতর পড়ে যাচ্ছে। সে বনিকে কি বলবে বুঝতে পারল না। তখনও ভায়োলিন বাজাচ্ছেন স্যালি হিগিনস। সে বলল, জ্যাক দিন দিন তোমার খুব সাহস বাড়ছে।

—সাহস?

—হ্যাঁ। তুমি কি পরেছ!

—কেন পুরুষের পোশাক।

—ভাল দেখাচ্ছে না। সব বোঝা যাচ্ছে। এত আঁট, বিশ্রি দেখাচ্ছে।

—যা!

—হ্যাঁ সত্যি বলছি।

—তুমি জানো বলে বুঝতে পারছ।

—আচ্ছা বনি, ছোটবাবু পাশে বসল, আর্চি তবে টের পেল কি করে?

জ্যাক সব বলল। ‘ইউ নটি গার্ল’ থেকে সে যে একদিন কেবিনে ব্যালেরিনার মতো পোশাক পরে নাচছিল এবং এমন কি সে যে একদিন ডেকে মাতাল ছোটবাবুকে গভীর রাতে কেবিনে দিয়ে আসার নামে বারবার গোপনে চুমো খেয়েছিল সব বলে গেল। সে আর মাথা উঁচু করে যেন কথা বলতে পারছে না। সে বলল, আমি আর্চির কাছে নিজের দোষে ধরা পড়ে গেছি ছোটবাবু!

—আর্চি সবাইকে যদি বলে দেয়?

—দিতে পারে।

—দিলে কি হবে বুঝতে পারছ?

—জানি ছোটবাবু। বাবাও বোধ হয় অনুমান করতে পারছেন সব

—তুমি অহেতুক বুড়ো মানুষটাকে ভাবনার ভেতরে ফেলে দিয়েছে।

—কি করব ছোটবাবু। আমার কপাল।

—ছোটবাবু বলল, আর্চি এখনও কিছু বলছে না।

—বলছে না কি করে জানো?

—ঠিক খবর চলে আসবে।। বন্ধু অনিমেষ জব্বার এখনও আছে জাহাজে।

—আর্চি ধূর্ত ছোটবাবু। সে একা মজা লুটতে চায়। সে কাউকে সহজে বলবে না।

তারপর ওরা কেউ আর কথা বলতে পারল না। চুপচাপ পাশাপাশি বসে থাকল। সূর্য অস্ত গেছে। সমুদ্রে অন্ধকার। এবং অনেক রাতে চাঁদ উঠবে আকাশে। ফ্যাকাশে সমুদ্রে তখন জাহাজের শুধু কলকব্জার শব্দ। আর হয়তো সারারাত স্যালি হিগিনস ভায়োলিন বাজাবেন। ছোটবাবু বলল, কি তিনি বাজাচ্ছেন বনি?

বনি বলল,

নোবডি নোজ দি ট্রাবল আই সি
নোবডি নোজ বাট জেসাস।
নোবডি নোজ দি ট্রাবল আই সি
গ্লোরি হ্যালেলুজা।

ছোটবাবু বলল, সত্যি আমরা জানি না কি ঘটবে। এনজিন-কশপ মাঝে মাঝে আজকাল আর্চির কেবিনে খুব আসছে।

এবং রাতে কেউ ঘুমোতে পারল না। ছোটবাবু বারবার বোট-ডেকে উঠে এসেছে। যতবার সে বোট- ডেকে উঠে এসেছে সেই গান—সেই গান—নোবডি নোজ দি ট্রাবল আই সি! স্যালি হিগিনস বারবার একই গান বাজিয়ে যাচ্ছেন। এবং সে বুঝতে পারছে না—কিভাবে জাহাজে তিনি আছেন, সামটাইমস আই অ্যাম আপ, সামটাইমস আই অ্যাম ডাউন ও ইয়েস লর্ড, আরও কি যেন আছে—তিনি গোপনে ভাঙা জাহাজ নিয়ে ফ্যাকাশে সমুদ্রে ভেসে চলেছেন। চারপাশে সমুদ্রের হাহাকারের ভেতর তিনি ক্রমে ঢুকে যাচ্ছেন। ভেতরে তাঁর অতীব যাতনা। কি এখন করণীয় ছোটবাবু বুঝতে পারছে না। নিরিবিলি আকাশ আর সমুদ্রে তিনি ফ্যাকাশে এক অন্তহীন করুণা ঈশ্বরের ধরতে পেরে কেমন বিচলিত। এবং সে তখন বুঝতে পারছিল এলবা জাহাজের পাশাপাশি কোথাও আছে। ওর পাখার শব্দ এইমাত্র কোথাও যেন দ্রুত ভেসে আসছে। সে বোট-ডেক ধরে নিচে নেমে গেল। আলোগুলো জাহাজের বিরামহীন জ্বলে যাচ্ছে। ফ্যাকাশে সমুদ্রের ভেতর চাঁদের নিভৃত আলো বড় বেশি ভীতিময়। ছায়া ছায়া এক বিশ্বচরাচবে ওরা ভেসে বেড়াচ্ছে। এলবা মাস্তুলের ওপর বসে আছে সে দেখতে পেল। পাখিটাও বুঝি বুঝতে পারছে সব। ঠোঁট গুঁজে যতবার সে ঘুমোবে ভেবেছিল ততবার সে কি এক আতঙ্কে জেগে যাচ্ছে। আর বাতাসে পাখা মেলে সমস্ত হতাশা সরিয়ে দিতে চাইছে বুঝি। সে দাঁড়িয়ে থাকল মেন-মাস্টের নিচে। পাখিটাকে ফিফিস্ করে ডাকল, এলবা তুমি তো সমুদ্রে আবহমানকাল এভাবে বেঁচে আছো। তুমি কি বুঝতে পারছ, আমরা এ ভাঙা জাহাজে কোথায় যাচ্ছি!

তখনও স্যালি হিগিনস বাজাচ্ছেন—ওভার মাই হেড আই হিয়ার ট্রাবল ইন দ্য এয়ার, দেয়ার ইজ এ হেভেন সাম হোয়েয়ার—আপ এবাভ মাই হেড, অ্যাণ্ড আই নো, ইয়েস আই নো দেয়ার ইজ এ হেভেন সাম হোয়েয়ার…।

তারপর গম গম করে বাজছে—ভায়োলিনে তিনি দ্রুত ছড় টেনে যাচ্ছেন বুঝি

জেরি;

টিমবার, টিমবার!

লর্ড দিস টিমবার গটা রোল।

টিমবার টিমবার…।

বনি শুয়ে শুয়ে সব শুনতে পাচ্ছিল। ওপরে উঠে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। বাবাকে নিরস্ত করা দরকার। কিন্তু দরজা খুলতে সে সাহস পাচ্ছে না। দরজার কাছে সে এখন দাঁড়িয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে বাবার সব গান তাঁর ঈশ্বরের কাছে লিপি পাঠানোর মতো। এখন তিনিই তাঁর সব। তাঁর উদ্দেশ্য এবং বিধেয়। অর্থাৎ তিনি নিমিত্ত মাত্র। বাবা তাঁর জীবনের সব সুখ-দুঃখ করুণাময় ঈশ্বরের পায়ে সমর্পণ করছেন। বনি বুঝতে পারছে বাবার আর কোনো অবলম্বন নেই। বাবা এখন বিধ্বস্ত মানুষের প্রতিচ্ছবি। সে এখন কি করবে ঠিক বুঝতে পারছে না। ওর কেবল বাবার জন্য কান্না পাচ্ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *