1 of 2

অলৌকিক জলযান – ৪৪

।। চুয়াল্লিশ।।

—স্যার!

স্যালি হিগিনস পাশে চোখ ফেরালেন।

—ওপরে চলুন স্যার।

—ওপরে? আচ্ছা।

—স্যার!

—যাচ্ছি।

বনি একটা কথা বলছে না। চোখে মুখে তার ভারী দুর্ভাবনা। সে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ছোটবাবু বনিকে নানাভাবে বোঝাচ্ছিল। সামান্য সাহসী হতে বলছে। বনি যেন ছোটবাবুর একটা কথাও বুঝতে পারছে না।

ডেবিড এবং চিফ-মেট বুঝতে পারছে না কি করবে। আবার বলল, স্যার আপনি সেই কখন থেকে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন। ওরা তো চলে গেছে। আর দেখা যাচ্ছে না। ওপরে চলুন এবার। শরীর আপনার ভাল নেই।

স্যালি হিগিনস বললেন, চল।

ওরা পোর্ট-সাইড ধরে এবার হেঁটে যেতে থাকল। সোজা ছোটবাবুর কেবিনের ও-পাশে হেঁটে গেল।

তিনি ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভাঙতে থাকলেন। খুব সতেজ এবং কিছু হয় নি মতো উঠে যাচ্ছিলেন। কেউ আর একটা কথা বলতে সাহস পাচ্ছে না। লোক দু’টো কে, ওরা কেন এসেছিল—বেঁটে মতো লোকটা ভারী অদ্ভুত—অকারণ যেখানে সেখানে হাতুড়ি ঠুকছিল!

ডেবিড, চিফ-মেটের কানের কাছে মুখ এনে বলল, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে স্যার।

—কি ঘটবে মনে হয়? চিফ-মেট সিঁড়ি ধরে ওঠার সময় এমন বলল।

ডেবিড ফিস্ ফিস্ গলায় কথা বলছিল।

—কিছু একটা ঘটবে। ঠিক ঘটবে। ওর মুখ দেখে আপনি বুঝতে পারছেন না স্যার!

—কি ঘটবে? কি ঘটতে পারে!

ওরা ততক্ষণে দু’জনই বোট-ডেকে উঠে এসেছে।

চিফ-মেট সামান্য কি ভেবে বলল, কিন্তু এটা ঠিক না। এমন শরীরে জাহাজের অতলে নেমে যাওয়া ঠিক না। এতটা ওঠা-নামা করা তাঁর উচিত হয় নি। কিছু একটা সত্যি ঘটে গেলেও ঘটে যেতে পারে।

স্যালি হিগিনস সিঁড়ি ধরে আরও ওপরে উঠে যাচ্ছেন তখন। মনে হচ্ছে না গতকাল তিনি অসুস্থ ছিলেন, সংজ্ঞা হারিয়েছিলেন। বেশ স্বাভাবিক গলায় না তাকিয়ে ডাকলেন—চিফ-মেট।

চিফ-মেট, ডেবিডকে বোট-ডেকে ফেলে ওপরে প্রায় দু-লাফে উঠে গেল।

বনি আর ছোটবাবু আরও পেছনে আসছে। বনি দেখল বাবা চিফ-মেটকে নিয়ে চার্ট-রুমে ঢুকে যাচ্ছেন।

ডেবিড জ্যাককে পেছনে আসতে দেখে বলল, তুমি জানো জ্যাক, এরা কারা?

—না ডেবিড। এরা কারা জানি না।

জাহাজে তেমনি ফসফেটের গুঁড়ো উড়ছে। টাগ-বোট সব আসছে যাচ্ছে। টাগ-বোট থেকে তেমনি বড় বড় ফসফেটের পিপে সব হাড়িয়া হাফিজ হচ্ছে। তেমনি কোলাহল জাহাজে। উইনচের প্রচণ্ড শব্দ। তেল কালি বার্নিশের গন্ধ। আকাশে খণ্ড খণ্ড মেঘ। ঠিক বাংলাদেশের গ্রীষ্মের রোদ আর বাতাসের মতো আবহাওয়া। দড়িদড়া, রঙের টব, জাহাজ সমুদ্র এবং দ্বীপমালার ভেতর তেমনি আছে তার ছোটবাবু। তবু সব কেমন তার বর্ণহীন। সে কিছুতেই কেন জানি ভাল করে সাড়া দিতে পারছে না। এই তো পাশে তার ছোটবাবু হাঁটছে—তবু কি যে এক ভয়!

ছোটবাবুর কাজ পড়ে আছে উইনচে। সে এক্ষুনি হয়তো নেমে যাবে। ডেবিডও থাকবে না। সে তখন এই বোট-ডেকে আরও একা হয়ে যাবে। বাবার কাছ থেকে সবটা না জানতে পারলে বনি নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। চিফ-মেট এখনও কেবিন থেকে বের হচ্ছে না। বাবা আর চিফ-মেট এত কী যে পরামর্শ করছে! বের হলে সে ঠিক দেখতে পাবে। এবং যখন বের হয়ে এল চিফ-মেট এক দণ্ড বনি আর নিচে দাঁড়াল না। লাফিয়ে ওপরে উঠে গেল। ভেতরে ঢুকে ডাকল, বাবা!

স্যালি হিগিনস মাত্র টেবিলে মাথা রেখেছেন। বনি জাহাজে আছে তার যেন মনেই ছিল না। মাথার ভেতরে সোরগোল উঠে উঠে জট পাকিয়ে যাচ্ছে—ঘূর্ণির মতো অথবা রথের চাকার মতো বন্ বন্ কেবল ঘুরছে। তিনি তখন আর চারপাশে কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। বনি এই যে তাঁকে এসে ডাকল কতদূর থেকে যেন সেই ডাক, বাবা তুমি এমন হয়ে যাচ্ছ কেন! যেন চিনতে সময় লেগে যাচ্ছে তাঁর—বনি তাঁর আত্মজা, রক্তে মাংসে বনি তাঁর। আত্মার চেয়ে প্রবল অস্তিত্বে বেঁচে আছে—কিছুই মনে করতে পারছিলেন না এতক্ষণ। বনিকে চিনতে কত যে সময় লেগে যাচ্ছে তাঁর।

বাবা কেবল তাকে দেখছেন। একটা কথা বলছেন না। সে ভয় পেয়ে ফের ডেকে উঠল, বাবা তোমার কি হয়েছে?

তিনি খুবই নিস্তেজ গলায় বললেন, কিছু হয় নি তো!

—লোক দু’টোর সঙ্গে তুমি এনজিন-রুমে নেমে গেলে কেন?

—ওরা জাহাজটা দেখতে এসেছিল।

—চিফ-মেটকে পাঠালে পারতে। ডেবিড ছিল, তুমি নেমে গেলে কেন?

—তাতে কি হয়েছে! সেই সরল বালকের মতো, অথবা বনির এমন যে সুন্দর লাবণ্যময় শরীর, যেন প্রায় তাঁর মতো, অথবা বোধহয় কৈশোরে তিনি এমনই ছিলেন দেখতে—এবং সঙ্গে সঙ্গে যেন প্রবল বেঁচে থাকার ইচ্ছে সারা শরীরে—তিনি সাহসী বালকের মতো উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, তোমার সঙ্গে আমি আজ খাব বনি। তারপর ঠিক আগের মতো দরজার বাইরে গলা বাড়িয়ে হাঁকলেন কোয়া…র্টা…র মা-স্টা…র।

কোয়ার্টার-মাস্টার এলে বললেন, কাপ্তান-বয়।

কাপ্তান-বয় এলে বললেন, জ্যাকের কেবিনে আমি খাব। ডাইনিং-হলে জানিয়ে দেবে। তারপর রনির বড় বড় চুল এলোমেলো করে দিয়ে বললেন, তাহলে আমরা একসঙ্গে খাচ্ছি।

বাবাকে সহসা এত খুশী দেখে সে কেমন অবাক হয়ে গেল। ঠিক সেই চিরদিনের এক স্নেহময় পিতার মুখ, সে কি আর বলবে, সে যে ভেবেছিল অনেক কিছু বলবে, বাবা, তুমি এত ভাবো কেন? তোমার তো বাবা বেঁচে থাকার মতো সব আছে। একটা ভাঙা জাহাজ নিয়ে তোমার এত কি দায়! তুমি কেন বলতে পার না, জাহাজ আর চলবে না। তোমার এমন কি দাসখত দেয়া আছে ভাঙা জাহাজ চালিয়ে নিতেই হবে! কিন্তু বাবার হাসিখুশী মুখে কখনও এত বেশি ছেলেমানুষী থাকে যে সে আর রাগ করতে পারে না।

সে আর কিছু বলতে পারল না। নিচে নেমে গেল। বাবা নিমেষে তার সব দুর্ভাবনা ঝড়ো বাতাসের মতো উড়িয়ে নিয়ে গেলেন। সে সহজেই নিচে নেমে বাথরুমে ঢুকে গেল। এবং বাথরুমের সাদা টবে সব দামী সুগন্ধ ছড়িয়ে জলের ভেতরে একটা সোনালী মাছ হয়ে ভেসে থাকল চুপচাপ। ছোটবাবুর কথা ভেবে বার বার জলের ভেতরে ডুবে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে।

খাবার টেবিলে বনি বলল, বাবা ওরা জাহাজটার কি দেখতে এসেছিল?

—ওরা জাহাজটার সব ইস্পাত দেখতে এসেছিল।

—ইস্পাত!

—জাহাজটা ওরা কিনতে চায়!

—এই পুরেনো ভাঙা অচল জাহাজ ওরা কিনে কি করবে।

—এখনও এর যা আছে বনি…যেন জাহাজটা ভাঙা পুরোনো বললেই তিনি ক্ষেপে যান ভেতরে ভেতরে! তিনি কফি খাচ্ছিলেন, আর চুরি করে বনির মুখ দেখছিলেন। বনি জাহাজটাকে পুরোনো ভাঙা বলছে, বনির এমন কথাবার্তা তাঁর একেবারে পছন্দ না। বনির কাছে তিনি কিছুতেই মুখ ভার করতে পারেন না। এই যে তিনি বনির সঙ্গে খেলেন, বনিকে নানাভাবে উৎসাহ দিচ্ছেন—যেন বনি কিছুতেই তাঁর দুর্ভাবনার কথা টের না পেয়ে যায়, পেয়ে গেলে তিনি জানেন মেয়েটা সারাক্ষণ জাহাজে মুখ গোমড়া করে রাখবে। তিনি সারাক্ষণ ভাবতে চেষ্টা করছেন, গতকাল এমন কিছু তাঁর হয় নি। এবং দুর্ভাবনা এত বেশি প্রবল যে বার বার মুখের ওপর একটা ঘন কালো ছায়ায় ঢেকে গেলে তিনি প্রায় জোরে হেসে দেবার চেষ্টা করছেন, আর তখন কিনা বনি বলছে, ভাঙা পুরোনো জাহাজ—যেন তিনি এখন জোরে চিৎকার করে উঠতে পারতেন, বনি পৃথিবীতে সবাই জাহাজটাকে নিয়ে উপহাস করেছে, আমি সহ্য করে গেছি। কিন্তু তুমি কর না। তুমি জাহাজটাকে ভাঙা অচল বললে আমি আমার সব সাহস হারিয়ে ফেলব।

বনি দেখল, বাবা মুখ মুছে ধীরে ধীরে বের হয়ে যাচ্ছেন। জাহাজটা অচল বললে বাবা ভীষণ ক্ষেপে যান। সে কেন যে এমন বলতে গেল! দরজার বাইরে মুখ বাড়িয়ে দেখল, ওপরে তিনি চুপচাপ ব্রীজে দাঁড়িয়ে আছেন। কাঁচের ভেতর অষ্পষ্ট ছায়া দেখা যাচ্ছে। বনির মনটা আবার ভার হয়ে গেল।

তখন স্যালি হিগিনস যেন এই সামনে যা কিছু আছে কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। কেবল দেখতে পাচ্ছেন একটা জাহাজ। সেই কবে থেকে তিনি তার যাত্রী, জাহাজটা তাঁকে নিয়ে নিরবধিকাল সমুদ্রে ভেসে চলেছে। আর তখনই তাঁর সদর্পে বলতে ইচ্ছে হয়, আসলে বনি, জাহাজটা লুকেনারের হাড় দিয়ে তৈরি। সমুদ্রে সে কখনো ডুবে যেতে পারে না। তারপর তাঁর কি যে হয়ে যায়, দু-হাত ওপরে তুলে আকাশ ছুঁয়ে দেবার মতো ইচ্ছে। বলার ইচ্ছে চিৎকার করে—সি…জা…রা। জাহাজের আসল নাম সি…জা…রা। প্রায় আর্কেমেডিসের সূত্র আবিষ্কারের মতো তিনি যেন কতদিন পর, প্রায় দীর্ঘকাল বলা চলে এবং এই শেষ সফরে জেনে ফেলেছেন—অতি প্রাচীন জাহাজ এই সিউল-ব্যাংক। তার বয়স-কাল নির্ণয় করা অর্থহীন। এবং এখন আর যা তাঁর মনে হয়, জাহাজের ভেতরেই আছে সেই এক ঐশী শক্তি। বনি তুমি সব অবহেলা করতে পার, কিন্তু তাঁকে তুমি পার না। দোহাই বনি, এসব বলে তুমি তার কোপে পড়ে যেও না।

আর সঙ্গে সঙ্গে সেই কঠিন দুর্ভাবনা। জাহাজের গিলোটিন হয়ে গেল। কিংবদন্তীর মতো যে ছিল তাঁর কাছে অজয় অমর, কলমের এক খোঁচায় সে শেষ হয়ে গেল। এখন তাঁর ইচ্ছে করছে যদি পারতেন জাহাজ নিয়ে সমুদ্রে পালিয়ে বেড়াতেন। গিলোটিনের হাত থেকে বাঁচবার তাঁর কাছে আর কোনো পথ নেই। তারপর বুঝতে পারেন সব অর্থহীন—মি. ফ্যালের ব্যক্তিগত চিঠি এবং কিছু তার বাক্যাংশ মাথা কুরে কুরে খাচ্ছে। দুর্বলতা ভেবে যত চেয়েছেন সবকিছু ভুলে থাকবেন, তত সেই বাক্যাংশ কঠিন সংশয়ের ভেতর নিক্ষেপ করছে। তিনি কিছুতেই এই অতিশয় অভিনয়ের ভেতর আর নিজেকে গোপন রাখতে পারছেন না। মূর্ছা যাবার ভয়ে কেবিনে ঢুকে টেবিলে মাথা রেখে ফের বসে পড়লেন। বিকেলে সবাই দেখল, ব্রীজের ডেক-চেয়ারে স্যালি হিগিনস মাথা এলিয়ে দিয়েছেন। বাইবেল ওল্টাচ্ছেন। পাতার পর পাতায় কি যেন কেবল খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তিনি পড়লেন, হ্যাভ কনফিডেন্স ইন দ্য লর্ড, ইন অল দাই ওয়েজ থিংক অন হিম, অ্যাণ্ড হি উইল ডাইরেকট দাই স্টেপস। ঈশ্বর আর কোথায় কি বাইবেলের পাতায় নির্দেশ রেখেছেন বসে বসে দেখছেন। পাগলের মতো পাতার পর পাতা উল্টে যাচ্ছেন। এবং এখন দেখে মনে হয় একজন আত্মমগ্ন মানুষ তিনি। ভীষণ ঝুঁকে পড়েছেন বাইবেলের ওপর। এত যে জাহাজের চারপাশে ব্যস্ততা, ঘড় ঘড় শব্দ এবং অতিকায় শব্দের ভেতর সব কর্মপ্রণালী ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে তিনি যেন তা একেবারে শুনতে পাচ্ছেন না। বাইবেলের পাতায় শব্দের ভেতর বার বার তিনি ভিকটিম শব্দটি আবিষ্কার করে অতিশয় মর্মান্তিক চোখ মুখ করে রেখেছেন। এবং এ-ভাবে বার বার শেষবার, শেষবারে তিনি নিজে তার শিকার। মি. ফ্যালের ধুর্ততা চোখের ওপর চশমার কাঁচে জ্বল জ্বল করছে।

—আপনি আমাদের আজীবন সহযোগী। মি. হিগিনস, আপনার ওপর আমরা নানা কারণে নির্ভরশীল। বোর্ড আপনাকে পরিচালকবর্গের অন্যতম করে নিয়েছেন। এতে আমরা সম্মানিত বোধ করছি। আপনার অধিকারের ভেতরেই আছে সে। অধিকার শব্দটির দ্বারা কিছু অর্জন করা বোঝায়। অর্জন করেছেন তিনি, জাহাজের বিশ্বাস অর্জন করেছেন। আর বিশ্বাস শব্দটির সঙ্গে গিলোটিন শব্দটি বার বার চোখের ওপর আগুনের রিং হয়ে যেতে থাকল। তিনি চোখ মুছে ফের চশমা পরে নিলেন। চোখের ওপর তিনি কি যে সব ভেসে উঠতে দেখলেন! এবং মনের এ দুর্বলতা তিনি কিছুতেই পরিহার করতে পারছেন না কেন? আর তখনই বাইবেলের ভেতর সেই সব শব্দ, যেন কোনো দেবদূত পাথরের গায়ে বড় বড় শাবলে রোপণ করে যাচ্ছেন—নাথিং ক্যান বি কমপেয়ার্ড টু এ ফেথ ফুল ফ্রেণ্ড, অ্যাণ্ড নো ওয়েট অফ গোল্ড অ্যাণ্ড সিলভার ইজ এবল টু কাউন্টারভেল দ্য গুডনেস অফ হিজ ফাইডেলিটি। তিনি ভীষণ ঘামছেন। খালি গা তাঁর। সাদা রংয়ের হাফ-প্যান্ট। মুখ চোখ ক্রমশ আবার লাল হয়ে যাচ্ছে—সেই সব শব্দ পাহাড়ের গায়ে এত বেশী বড় হয়ে যাচ্ছে। এত বেশী কাঁপছে এবং ক্রমে এগিয়ে আসছে যে তিনি আর বসে থাকতে পারছেন না। যেন বার বার সেই সব শব্দ বিশ্বাসভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত করছে তাঁকে। সহসা আবার পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা লেখা সব মুছে গেল! যেন সেখানে ডেভিল তার শাবলে বড় বড় অক্ষরে ফের রোপণ করে যাচ্ছে নতুন সব শব্দ—বাই দ্য এনভি অফ দ্য ডেভিল, ডেথ কেম ইনটু দ্য ওয়ালর্ড। ডেথ, একাকী গোপনে দু-বার উচ্চারণ করার সময় তিনি কেঁদে ফেললেন। দোহাই আপনার, তিনি যেন বাতাসে তাঁকে ছুঁতে চাইলেন। বনিকে ছাড়া আমি আর কিছু ভাবতে পারি না। দোহাই আপনি তাকে রক্ষা করুন।

তারপর আর যা মনে হয়, তিনি পাগল হয়ে যাচ্ছেন না তো! নিজেকে অকারণ কেন বারবার বিশ্বাসভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত করছেন! সাধারণ একটা জাহাজকে কেন বার বার ভাবছেন তার প্রতিটি রি রক্ত-মাংসের। কেন ভাবছেন এক্ষুনি জাহাজের হাড়-পাঁজরে বিদ্যুৎ খেলে যাবে! আর তিনি এ- সব কি দেখছেন চোখের ওপর।

—সত্যি সারা ডেকে বিদ্যুৎপ্রবাহ, সেই কোনো মরুভূমির মরীচিকার মতো তিনি দেখতে পাচ্ছেন বনি আতঙ্কে চিৎকার করছে, লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। তিনি ব্রীজে যেন ঝুঁকে পড়েছেন। চিৎকার করে ডাকছেন, বনি ওদিকে না। এদিকে চলে এস। হায়! বনি কিছুতেই এদিকে চলে আসতে পারছে না। অক্টোপাসের মতো বিদ্যুৎপ্রবাহের বেড়াজালে আটকা পড়েছে। মেয়েটা সোনালী লতায় ক্রমশ ঢেকে যাচ্ছিল। আর সঙ্গে সঙ্গে তিনি ফের বোধহয় না পেরে হাতের বাইবেল ছুঁড়ে দিতেন; ছুঁড়ে দিলেই সব বিদ্যুৎপ্রবাহ ঈশ্বরের অমোঘ বাণীতে ছাই হয়ে যাবে, তখনই মনে হল অনেক দূরে সমুদ্রে অথবা বাতাসের গায়ে কেউ রোপণ করে যাচ্ছে আশ্চর্য সব অভয় বাণী—কল্ আপন্ মি ইন দ্য ডে অফ ট্রাবল, আই উইল ডেলিভার দী, অ্যাণ্ড দাউ শ্যালট গ্লোরিফাই মি।

তারপর সব আবার ঠিকঠাক। জাহাজটা যেন একেবারে আর দশটা জাহাজের মতো। এতক্ষণ তিনি কেবল জাহাজটা দেখতে পাচ্ছিলেন, আর কিছু দেখতে পাচ্ছিলেন না। বনি ডেকে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে, আর কিছু দেখতে পাচ্ছিলেন না। তিনি নিজে ব্রীজে দাঁড়িয়ে আছেন—আর কিছু দেখতে পাচ্ছিলেন না। এখন তিনি আবার সব দেখতে পাচ্ছেন। চারপাশে টাগ-বোটে মাল খালাস করে চলে যাচ্ছে। একজন খালাসি রং করে ফিরছে। ফলঞ্চা খুলে পাশে রেখে গোপনে সিগারেট খাচ্ছে। বড় বড় কাঠে নাবিকেরা ফল্কা ঢেকে দিচ্ছে। ডেরিকের দড়িদড়া তুলে নিয়ে যাচ্ছে ডেক-কশপ। ছোটবাবু উইনচের নিচ থেকে মাথা বের করে রেখেছে। এবারে সে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে আসবে। বনি বোট- ডেকে দাঁড়িয়ে ডেবিডের সঙ্গে গল্প করছে।

আবার এ-ভাবে পৃথিবীতে আর একটা দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। সূর্য অস্ত যাচ্ছে পাহাড়ের মাথায়। সমুদ্রে সব পাখিদের ছায়া। ওরা দ্বীপে ফিরে আসছে। লেডি-অ্যালবাট্রস কোথাও হয়তো আছে, অথবা সমুদ্রের গভীরে নীল জলে এখন মাছ ধরে খাচ্ছে। সে বোধহয় তার পুরুষ-পাখিটার কথা একেবারে ভুলে গেছে। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার সময় কত স্মৃতি, কত ছবি। এবং এইসব ছবির শব্দমালা আর শোনা যায় না, পৃথিবীর অন্ধকারে অথবা সৌরজগতের সেই প্রবহমান ধারায় মিশে গেলে কত ক্ষুদ্র, কত সামান্য এ-সব মনে হয়। স্যালি হিগিনস এ-সব ভেবে বোধহয় মনের দুর্বলতা পরিহার করতে চাইছেন। শক্ত হতে না পারলে তিনি ডুবে যাবেন। পাগল হয়ে যাবেন।

কোয়ার্টার-মাস্টার জাহাজের সব আলো জ্বেলে দিচ্ছে তখন। ফোর-মাস্টের আলো জ্বেলে, দু- পাশের সব আলো জ্বালতে জ্বালতে সে ছুটছে। মেন-মাস্টে তাকে আলো জ্বালতে হবে। জাহাজের যেখানে যা কিছু অন্ধকার সে দু-হাতে এখন সরিয়ে দিচ্ছে। সব আলো জ্বেলে, সব পতাকা ঘরে নিয়ে যাবে সে। তারপর হয়তো মাদুর বিছিয়ে খোলা ডেকে উদার আকাশের নিচে সারাদিন কেটে গেলে পৃথিবীর সেই মহিমময়ের কাছে সামান্য নতজানু হওয়া। বাই দ্য এনভি অফ দ্য ডেভিল, ডেথ কেম ইনটু দ্য ওয়ালর্ড। মানুষের নতজানু না হয়ে উপায় নেই। পাপ এবং বিশ্বাসভঙ্গের জন্য মানুষের নতজানু না হয়ে উপায় নেই। এবং এ-সব মনে হলেই তিনি কেমন ভেতরে দুর্বল হয়ে পড়েন। তাঁর সব সাহস নিমেষে উবে যায়। তিনি তখন কি যে করবেন ঠিক করতে পারেন না। কখনও তিনি পাতার পর পাতা না দেখে বাইবেলের সব স্তবক আবৃত্তি কার যান। অথবা কখনও তিনি কোনো স্পিরিচুয়াল সঙ গলা ছেড়ে গাইতে চান—পারেন না। হাত তুলে দু-হাতে করুণা ভিক্ষার মত গলা ছেড়ে তাঁর ভীষণ ভাল লাগে ভাবতে তিনি গাইছেন—আই অ্যাম অন্ মাই ওয়ে। অথবা কখনও আই অ্যাম অন মাই ওয়ে টু ক্যানানা-ল্যাণ্ড। তারপরই মনে হয় নাভির ভেতর থেকে গলার স্বরে ভেসে আসবে সেই ঈশ্বরের জন্য প্রতীক্ষা—গ্লোরি হ্যালেলুজা, আই অ্যাম অন্ মাই ওয়ে। আমি আপনার কাছেই যাচ্ছি। কোনো উপত্যকার পথে, অথবা কোনো দ্বীপমালার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে, অথবা সব সবুজ গাছের ছায়ায়, দূরবর্তী নক্ষত্রের মতো ঘুরে ঘুরে দু-হাতে করুণা ভিক্ষার মতো তিনি যেন গেয়ে যাচ্ছেন, গ্লোরি হ্যালেলুজা, আই অ্যাম অন্ মাই ওয়ে।

—স্যার!

স্যালি হিগিনস মুখ তুলে তাকালেন।

—ডাক্তার নিচে দাঁড়িয়ে আছে।

–ডাক্তার আবার কেন! আমি তো ভালো আছি। বেশ ভালো। এখানে তাকে নিয়ে এস।

—ভিতরে গেলে ভাল হত না স্যার!

—তোমরা ভারী জ্বালাতন কর চিফ। আমাকে নিয়ে হঠাৎ তোমাদের কেন যে এত দুর্ভাবনা বুঝি না। বলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। সমুদ্র থেকে জোর হাওয়া উঠে আসছে। তিনি ইচ্ছে করলে তাঁর পোশাক পুরোপুরি পরে নিতে পারেন। আর স্বভাবে তিনি প্রায় এ-রকমের। ধড়াচূড়া পরে তিনি একেবারে এখন ক্যাপ্টেন স্যালি হিগিনস। ভেতরে ডাক্তার এলে হাত বাড়িয়ে হ্যাণ্ড-শেক করলেন। বললেন, তোমার কি মনে হয় ডাক্তার, এ-বয়সে তুমি আর আমার কিছু ভাল করতে পার?

—না স্যার।

—তবে এসেছ কেন!

ডাক্তার এর ওর মুখের দিকে তাকাতে থাকল। তখন বনি বলল, তুমি শুয়ে পড়তো বাবা। আর একটা কথা বলতে পারলেন না। একেবারে ভীতু বালকের মতো শুয়ে পড়লেন। বনি যতক্ষণ পায়ের কাছে আছে আর বোধহয় তিনি একটা কথাও বলতে পারবেন না। সামান্য দুষ্টুমি করার ইচ্ছে ছিল ডাক্তারের সঙ্গে। বনির জন্য তাও হল না। চুরি করে মাঝে মাঝে মেয়ের মুখ দেখছেন। বনি ডাক্তারের মুখ দেখছে। ডেবিড ডাক্তারকে নানাভাবে সাহায্য করছে। কতটা রক্তচাপ শরীরের দেখছে এবং কানে নল লাগিয়ে বুক দেখছে। বনি প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ডাক্তার কি বলবে শোনার জন্য চোখের পলক পড়ছে না।

ডাক্তার সব ব্যাগের ভেতরে ভরে নেবার আগে, জিভ দেখল, চোখ দেখল, পেট টিপে দেখল। দু’টো-একটা প্রশ্ন। বনি অথবা চিফ-মেট কখনও ডেবিড জবাব দিচ্ছে। এবং সকালে জাহাজের এনজিন- রুমে নেমে গেছিলেন এ-সবও যখন বলা বাদ গেল না আর যখন ডাক্তার বলল, ভাল আছেন, কোনো ভয় নেই, তখন স্যালি হিগিনস হা হা করে হেসে দিলেন।

—তবে! বলেই স্যালি হিগিনস একেবারে সোজা উঠে বসেছিলেন।

—তবে আপনি এ-বয়সে যত বিশ্রাম নেবেন তত ভাল।

স্যালি হিগিনস সহসা গলা ছেড়ে গান গেয়ে উঠেছিলেন বুঝি—হাত তুলে বলার ইচ্ছে—আই অ্যাম অন্ মাই ওয়ে, আই অ্যাম এ ফলিং অ্যাণ্ড এ রাইজিং, বাট আই অ্যাম অন্ মাই ওয়ে।

স্যালি হিগিনস সহসা বললেন, ডাক্তার তুমি গান জানো?

ডাক্তার মানুষটি সামান্য না হেসে পারল না। কাপ্তান সত্যি মজার মানুষ। অথচ সে দেখছে, অফিসাররা কেমন ভীতু মুখ করে সবাই দাঁড়িয়ে আছে পাশে। যমদূতের মতো ভয় স্যালি হিগিনসকে। সে এবারে বলল, জানি স্যার।

—তোমরা?

চিফ-মেট অবাক। স্যালি হিগিনস রাশভারী কর্তব্যপরায়ণ এবং স্থির ধীর কাপ্তান। কিংবদন্তীর মতো তাঁর জীবন। এবং যেহেতু দীর্ঘদিন একটা অচল জাহাজ চালিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন, তিনি আর দশজন কাপ্তানের মতো একেবারে শুধু কলকব্জার ওপর নির্ভরশীল নন, এবং জাহাজ চালাতে গেলে একটা স্থির বিশ্বাস থাকা বাঞ্ছনীয়, মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করা যত মঙ্গলজনক এবং তিনি যখন এ-ভাবে একজন সফল কাপ্তান তখন গলা ছেড়ে গান গাওয়া খুব একটা অমর্যাদার ব্যাপার নয়—কিন্তু কি বলবে সে! কাপ্তান ওর দিকে এখনও তাকিয়ে আছেন। সে বলল, গলা মেলাতে পারব।

—তা হলেই চলবে। তুমি ডেবিড?

ডেবিড মাথা ঝাঁকাল।

—ছোটবাবু কোথায়? ছোটবাবুকে ডাকো। আমরা সবাই এখন গলা ছেড়ে গাইব, গ্লোরি হ্যালেলুজা, আই অ্যাম অন্ মাই ওয়ে। আই হ্যাভ হ্যাড টাইম বাট্ আই অ্যাম অন্ মাই ওয়ে। হ্যাড এ মাইটি হার্ড টাইম, গ্লোরি হ্যালেলুজা, আই অ্যাম অন্ মাই ওয়ে। ডাক্তার এবং সবাই মিলে পায়ে তাল দিয়ে গাইছে। যেন জাহাজে এখন পিয়ানো থাকলে, বনি পিয়ানো বাজাতে পারত। অথচ ছোটবাবু বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। সে কোনোদিন কোনো গানের সঙ্গে ঠিকমতো গলা মেলাতে পারে না। আর এ তো বিদেশী গান, এবং গলা চিরে যাচ্ছে—এ-ভাবে অসুস্থ কাপ্তানের কি যে মরজি, হয়তো ভেতরে একটা গণ্ডগোল ঘটে গেছে সবার, সবাই এখন এইসব স্পিরিচুয়ালের ভেতর সামান্য অবলম্বন খুঁজছে। মানুষ এ-ভাবে দীর্ঘদিন সমুদ্রে ভেসে বেড়ালে মাথা ঠিক রাখতে পারে না।

স্যালি হিগিনস খুশীর চোটে ডাক্তারকে পরদিন লাঞ্চে নেমন্তন্ন করে ফেললেন, তুমি বেশ গাও হে ছোকরা। তোমার গলা ভারী দরাজ। আমিও এক সময় খুব গলা ছেড়ে গাইতে পারতাম। এখন পারি না।

বনির ভয় লাগছিল, বাবা হয়তো এবার বলবেন, আর একটা। সে তাড়াতাড়ি বাবাকে বলল, বাবা, তুমি আমার রেকর্ডগুলো শুনবে?

স্যালি হিগিনসের যেন সহসা বাঁধ ভেঙে গেছে। তিনি বনির কথা একেবারে শুনতে পেলেন না। বুড়োমানুষটা বাঁধানো দাঁতের জন্য ভাল গাইতেও পারেন না—অথচ ডাক্তারের গলায় এবং সকলের গলায় গানটা আশ্চর্য এক স্বর, কখনও উঁচু লয়ে, কখনও নিচু লয়ে, কখনও ফিস্ ফিস্ গলায় আবার কখনও লম্বা যেন সরল রেখার মতো। ক্রমে জাহাজের বাঁশি বেজে উঠেছে। তিনি ফের বললেন, ধরো, হাত তুলে এই ছোট্ট কেবিনের ভেতর, ঠিক ছোট কেবিনে কুলোচ্ছে না বলে তিনি প্রায় হাত তুলে গাইতে গাইতে ব্রীজে উঠে যাচ্ছেন—হোললার, হে ওম্যান হে গার্ল ডোনচ্ ইউ হিয়ার মি, কলিং ইউ, মাই ওম্যান সো সুইট সো সুইট!

বনি ডাকল, বাবা। তুমি এত জোরে গাইবে না!

স্যালি হিগিনস হাত সরিয়ে দিয়ে একেবারে স্থির হয়ে গেছেন

সবাই এ-ভাবে স্থির। আর মনে হচ্ছিল বাবা সারাদিন এ-ভাবে কি যে সব করে যাচ্ছেন! কোনো মাথামুণ্ডু নেই। সে ডাকল, বাবা! বাবা! বাবাকে ধরে ফেল্ল।—তুমি থামো বাবা। তারপর কেমন চিৎকার করে বলল, আপনারা থামুন। বাবা বাবা!

স্যালি হিগিনস তারপর ধপাস করে বসে পড়লেন। খুব জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন। তারপর ঢোক গিলে বললেন, বুঝলে এখন আর সত্যি পারি না। আমার খুব প্রিয় গান এটা। পারি না আর পারি না।

বনি এবার বাবার পাশে বসে বলল, বাবা আবার যদি তুমি গাও, আমি কিন্তু ভীষণ কাণ্ড করব!

স্যালি হিগিনসের মনে হল, মেয়েটা তাহলে এখনও তাঁর বেঁচে আছে। তিনি বললেন, আর গাইব না। আমার আর কি গাইবার আছে!

আর তখন আর্চি জাহাজের অন্ধকারে পায়চারি করছিল। কতদিন সে ডাঙায় নামতে পারে নি। ডাঙায় নামতে পারলে তার ভেতরের অসুখটা নিরাময় হত। সাময়িক নিরাময় তাকে হয়তো ক্রমে এ-ভাবে এক কঠিন নিয়তির দিকে এত সহজে ঠেলে দিত না। সে ডাঙায় নামতে পারলে কোনও সুন্দরী রমণী, অথবা কি যে হচ্ছে ডাঙ্গাথেকে সে প্রায় আছে নির্বাসনের মতো এবং যে কোনো বন্দরে নেমে গেলেই যুবতীরা যেন তার কাছ থেকে আত্মরক্ষার্থে পালাতে চায়। কোথাও সে দেখেছে, শিশুরা তাকে নিয়ে তামাশা করতে ভালবাসছে। ভয়ে সে আর জাহাজ থেকে নামতে পারছে না। আয়নায় যত নিজের মুখ দেখছে তত ক্ৰমে সে ভয় পেয়ে যাচ্ছে নিজেকে। এবং অন্ধকারে সে এখন বেশি থাকতে ভালবাসছে। ডাইনিং হলে সে যাচ্ছে না। মেস-রুম-বয় তার খাবার কেবিনে দিয়ে আসছে। এ-ভাবে সে ঠিক বড়-মিস্ত্রির মতো ক্রমে অন্ধকারের জীব হয়ে যাচ্ছিল। আর তখন জাহাজে বালিকা যুবতী হচ্ছে। জাহাজে বালিকা….বালিকা, প্রায় রেকর্ডের বাজনার মতো বালিকা যুবতী হচ্ছে।

এবং এ-ভাবে আর্চি দেখছে, বরং সে এখন আলো দেখলে ভয় পেয়ে যায়। কেউ তার মুখ দেখুক তা সে চায় না। যতটা পারে সে মুখ লুকিয়ে রাখে। জ্যাককে দেখলে সে আর আগের মতো দৌড়ে যেতে পারে না। কারণ জ্যাক এমন কদর্য মুখ দেখলে ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। ক্যাপ্টেনের ঘরে গতরাতে সে কিছুক্ষণ বসেছিল, উঠতে ইচ্ছে করছিল না, জ্যাক ওর দিকে একবারও ভয়ে তাকাচ্ছিল না। সে লোভের ভেতরে পড়ে যাচ্ছিল, রক্তপ্রবাহ সারা মুখে এবং সে ভেতরে ভেতরে নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছিল। সে কেবিনে ফিরে দু-হাতে কদর্য ডোরা কাটা কাটা দাগ মুছে দিতে চেয়েছে, যতবার মুছে দিতে চেয়েছে, ততবার দেখেছে দাগ-গুলো আরও প্রকট, আর গভীর—কি যে কালো আর কুৎসিত হয়ে যাচ্ছে এবং আশেপাশে সাপের মতো নীলাভ সাদা রং স্বাভাবিক চামড়ায়—সে যেন উইচ, আফ্রিকার ঘন অরণ্যের ভেতর কোনো অরণ্য সর্দারের যুবতী কন্যার চামড়া তুলে নিচ্ছে। সে একটা উইচ, সে একটা উইচ।

আসলে এ-জাহাজে যত রাত বাড়ছিল তত সে ঘুমোতে পারছিল না। মাঝে মাঝে সে ক্ষেপে যায়—শরীরে আশ্চর্য লোভ লালসা, কোনো বালিকা যুবতী হবার মুখে শুয়ে আছে, তার চুলে সমুদ্রের গন্ধ, শরীরে কি যে নরম আস্বাদন, মাংস খুবলে নিতে ইচ্ছে করছে বার বার, জংঘায় তার রয়েছে চমৎকারিত্ব—যেন হাতের পেশী সেই চমৎকারিত্ব সব লুণ্ঠন করে নেবে। সে এ-ভাবে ক্রমে যখন অমানুষ হয়ে যায় আর পারে না, চুপি চুপি একটা শ্বাপদের মতো উঠে যায়। গভীর রাতে সে দেখেছে কখনও কেউ না কেউ বালিকার মাথার ওপরে সতর্ক পাহারায় থাকে—কখনও লুকেনারের প্রেতাত্মা, কখনও লেডি-অ্যালবাট্রস, কখনও সমুদ্রের অগ্নিকাণ্ড, কখনও বজ্রপাতের মতো কিছু আধিভৌতিক শব্দ আকাশের অভ্যন্তরে বাজতে থাকে। বার বার সে ভয়ে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে আসছে। এবং যা হয়ে থাকে, আবার দু’রাত পার হয় না, কেবল জ্যাকের কেবিনের চারপাশে খাঁচায় পোরা বাঘের মতো এ-পাশ ও-পাশ শুঁকে শুঁকে যাওয়া, জ্যাক যেখানে বসেছিল, যেখানে দাঁড়িয়ে গল্প করেছিল সেখানে শুঁকে শুঁকে সে কুকুরের মতো ঘ্রাণ নিতে নিতে অমানুষ হয়ে যায়। তখন ঘুম আসে না, মদ খেতে ভাল লাগে না, ভাঙা আয়না আরও ভেঙে দুমড়ে সে একটা অতিকায় মনস্টার যেন। আর অন্ধকার তার বড় প্রিয়। সে সলাপরামর্শ করে থাকে—যেমন কখনও ডেক-সারেঙ কখনও এনজিন- কশপ অন্য সবাই যারা জাহাজের আধিভৌতিক ঘটনায় ম্রিয়মাণ তাদের সহজেই সে উসকে দিতে পারে। এখন একমাত্র সম্বল এইসব নিরীহ গোবেচারা জাহাজিরা। সবাই তার হাতে এসে গেলে, জাহাজে বিজয় লাভ করতে সময় লাগবে না। তখন সে যুবতী হবার মুখে বালিকার সবকিছু চমৎকারিত্ব লুণ্ঠন করে নেবে।

অন্ধকারে দাঁড়িয়ে তার মনে হল সব মিছিলের মতো কারা অন্ধকারে এগিয়ে আসছে। যেন বাতাসে ভর করে প্রথমেই এসে দাঁড়াচ্ছে ছোটবাবু। সে সজোরে ছোটবাবুর পেটে ঘুষি বসিয়ে দিল এবং দেখা গেল ডেক-সারেঙ দাঁড়িয়ে আছে মেন-মাস্টের নিচে। সে ছোটবাবুর গলায় দড়ি পরিয়ে দিচ্ছে। এবং উইনচে চালিয়ে সোজা মাস্তুলে লটকে দেওয়া হচ্ছে। আ—হাততালি। তার ক্রুরতা ক্রমে এভাবে কবে যে সফল হবে!

আর্চি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে শুধু পায়চারি করছে। এদিকটায় কেউ আসে না। কারণ এখানে বড়-মিস্ত্রি থাকতে একবার ভূত দেখেছিল। অথবা কেউ কেউ জাহাজে রাতের গভীরে কোনো যুবতীর ছায়া দেখেছে। আর কি যেন আছে এদিকটায়, নানা কারণেই সব সময় এ জায়গাটায় কেউ আলো জ্বালিয়ে দেয় না—অথবা মনে হয় যতবার আলো জ্বালানো হয়েছিল, ক্যাপ্টেন কোথাও অন্ধকার রাখতে যত বারণ করেছেন তত সে মাঝে মাঝে এদিকটার লাইন অকেজো করে রাখে। এবং যেহেতু তার হাতে মেরামতের দায়-দায়িত্ব কে আর ভাবে—কোথায় আলো কিভাবে জ্বলবে। এবং এই অন্ধকারে সে দেখতে পেল, বাতাসে ভর করে এসে দাঁড়িয়েছিল স্যালি হিগিনস। আর্চি হা হা করে হেসে উঠল। বলল, স্যার আপনাকে আমরা কিছু করব না। সামনের দ্বীপটাতে আপনাকে আমরা রেখে চলে যাব। আলেকজাণ্ডার সেলকার্ক। হা-হা-হা!

জ্যাক তুমি কি দেখছ! তোমার কিছু অনিষ্ট করব না। তোমার শুধু চমৎকারিত্ব লুণ্ঠন করে নেব। তোমার অস্থিমজ্জায় আমি প্রবেশ করে যাব জ্যাক। তোমার একটা সুন্দর নাম রাখব। পুরুষের নাম তোমার খাতা থেকে কেটে দেব। আর কিছু করব না। সত্যি বলছি, আর কিছু করব না।

তখন স্যালি হিগিনস সিঁড়ি ধরে নামছিলেন। তিনি চার্ট-রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। কিছু কাজকাম বাকি। গতকাল থেকে অদ্ভুত একটা দুর্ভাবনায় সময় কেটেছে। কোনও কাজ করতে পারেন নি। কেবল মনে হয়েছে যে-কোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। ভবিতব্য ভেবে মাথা পেতে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।

এখন সময় যত চলে যাচ্ছে তত তিনি হাল্কা বোধ করছেন। বার বার দু’বারের মতো তিনবারের মাথায় কিছু ঠিক ঘটবে, এবং ভয়ংকর সেই ঘটনার মুখোমুখি হতে ভয় পাচ্ছিলেন—প্রথমবার থিও ফ্যাল নিজে, দ্বিতীয়বার রিচার্ড ফ্যালের একমাত্র জাতক উইলিয়াম ফ্যাল। তখন রিচার্ড ফ্যাল গাড়ি ঘুরিয়ে নিচ্ছিলেন। হুডখোলা গাড়ি। বারান্দার পাশ থেকে সেই প্রাসাদের মতো বাড়ির রাস্তায় চলন্ত গাড়িতে ধপাস করে কিছু এসে পড়েছিল। সবকিছু ঠিকঠাক। কেবল কাগজপত্রে সইসাবুদ—তারপর সিউল-ব্যাংককে আর দশটা পুরোনো ভাঙা জাহাজের মতো নাকে দড়ি দিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে—তারপরই ঠিক ছিল উৎসব প্রাসাদে, এতবড় একটা আজীবন উদ্বেগ শেষ হয়ে গেল বলে যখন উৎসবের আয়োজন ঠিকঠাক তখন হুডখোলা গাড়িতে একমাত্র জাতকের মৃতদেহ। দোতলার রেলিং টপকে কেউ তার বালকপুত্রকে নিচে ঠেলে ফেলে দিয়েছে। রিচার্ড ফ্যাল দেখলেন ঘাড়টা বেঁকে গেছে, মনে হয় ঘাড় মটকে ছুঁড়ে দিয়েছে নিচে। এবং রিচার্ড ফ্যাল পাগলের মতো নেমে গেছিলেন। উন্মাদের মতো চিৎকার করেছিলেন সিঁড়ি ধরে ওপরে ছুটে যাওয়ার সময়—সব শেষ। তারপর তাঁর গলার স্বর ভয়ংকরভাবে তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছিল।—দ্য সী-ডেভিল। যেন খবর পাঠাবেন, মাঝ সমুদ্রে নিয়ে সিউল- ব্যাংকে পুড়িয়ে দাও। পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দাও। সে আমাদের সব কেড়ে নিচ্ছে। তিনি তারপর কিছুতেই তৃতীয়বার জাহাজ স্ক্র্যাপ করার আদেশপত্রে একটা কথা লিখতে সাহস পান নি।

আসলে দৈব-দুর্ঘটনার সঙ্গে যদি অকারণ কিছু হয়ে যায় তবে তার কি দোষ! অযথা সিউল-ব্যাংককে দোষারোপ করার অর্থ হয় না।

সামান্য জড় পদার্থ এই জাহাজ। শুধু কলকব্জায় চলে। কোনো অনুভূতি থাকতে পারে না। অথচ বার বার একে দোষারোপ করে অতিকায় ভীতির ভেতর পড়ে যাচ্ছে সবাই। কাল রাতে সেই পুনরাবৃত্তিব কথা ভেবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, অথচ মুখে বলা যায় না, ভারী হাস্যকর ব্যাপার—এবং কেউ গুলগল্প ভেবে একজন বনেদী কাপ্তানের এতদিনের ঐতিহ্যে কলঙ্ক লেপে দেবে বলে স্থির করেছিলেন, সব তিনি ঠাণ্ডা মাথায় করে যাবেন। যতই ভাবুন সবকিছু ঠাণ্ডা মাথায় করে যাবেন, শেষ পর্যন্ত আর তিনি খুব ঠাণ্ডা মাথায় ছিলেন না। তিনি সারাক্ষণ বনিকে ভুলে থাকার জন্য একটা না একটা অস্বাভাবিক কিছু করে গেছেন। এসব মনে হলেই বুঝতে পারেন দীর্ঘ দিনের অতীব এক বিশ্বাস ভেতরে বাসা বেঁধে আছে। তার হাত থেকে তিনি কিছুতেই নিষ্কৃতি পাচ্ছেন না। এবং মাঝে মাঝে এই যে বনিকে ডেকে পাঠাচ্ছেন, ডেকে বলছেন, আচ্ছা বনি তোমার শরীর ভাল তো। এবং এ-সব প্রশ্নে তিনি দেখেছেন, বনি বড় বড় চোখে ওঁর দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছু বলে না। বড় বেশি অবাক হয়ে যায়। তিনি তখন নিজের দুর্বলতা ধরতে পেরে কেমন শুকনো গলায় বলেন, জাহাজ তো খুব একটা ভালো জায়গা নয়। সাবধান থাকলে ক্ষতি কি?

তখনই আবার মনে হয় সেই ভয়াবহ বজ্রপাতে কেউ মারা যাচ্ছে। পৃথিবীতে কত লোক বজ্ৰপাতে মারা গেছে অথচ সেই নির্দিষ্ট খবরে তিনি স্থির থাকতে পারবেন না কেন! এটা তিনি কাকতালীয় ভাবতে পারছেন না কেন। এবং সেটা কাকতালীয় ব্যাপার ভাবলেই তাঁর বেশি ভাল লাগার কথা। রিচার্ড ফ্যালের শ্রীমান তো ভীষণ চঞ্চল ছিল স্বভাবে। পরিচারকদের সব সময় দুর্ভাবনায় অস্থির করে রাখত। সে যে সহজ পথ ভেবে রেলিং টপকে পালাতে চায়নি এবং নিচে পড়ে যায় নি কে বলবে! তিনি মাথা থেকে অহেতুক দুর্ভাবনা সরিয়ে দেবার জন্য হাজার রকম ব্যাখ্যা করতে থাকলেন সবকিছুর। নতুন করে আবার সব ভাবছেন। না ভাবলে তিনি পাগল হয়ে যাবেন

তবু রক্ষে দুর্ঘটনা ঘটে যাবার আগেই কাগজপত্র সব ঠিকঠাক করে দিয়েছেন। এটা একটা তাঁর বড় রকমের জয়লাভ। তিনি সিঁড়ি ধরে এক ধাপ নামলেন, আর হিজিবিজি সব চিন্তা তাঁর মাথায়। সহজে তরতর করে নিচে নেমে যেতে পারছেন না। অনেক উঁচু থেকে তিনি দেখতে পাচ্ছেন রাজমহিষীর মতো সিউল-ব্যাংক ভেসে আছে সমুদ্রের জলে। আর দু’টো বড় মাস্তুলে তেমনি লম্ফ জ্বলছে। হাওয়ায় তার দড়ি-দড়া তেমনি বাতাসে দোল খাচ্ছে। কোনো কিছুতে যেন তার আসে যায় না। শুধু মনে হল বনিকে বলে দিতে হবে, বনি তুমি কিন্তু রেলিং ঘেঁষে কখনও দাঁড়াবে না। নিচে ঠেলে ফেলে দিলে তো কিছু করার থাকবে না। তখন যত দোষ হবে সিউল-ব্যাংকের। মনে হবে সত্যি কিছু একটা অশুভ প্রভাব এ-জাহাজে আছে।

স্যালি হিগিনস চার্ট-রুমে ঢুকে বললেন, তোমার ঘড়িতে কটা বাজে চিফ-মেট?

চিফ-মেট ভারি অবাক। মাস্টার তাকে জিজ্ঞেস করছেন কটা বাজে! সময় মেলাচ্ছেন ঘড়িতে। সময় তো তাঁর ভুল হবার কথা না। সময় ঠিকঠাক থাকার কথা। চিফ-মেট বলল, ন’টা বাজে স্যার।

—আমার ঘড়িতেও ঠিক ন’টা। ভীষণ কারেক্ট সময়। দ্যাখো দ্যাখো সেকেণ্ড এবং মিনিটের কাঁটা ঠিক দু’জনের একজায়গায় দেখে স্যালি হিগিনস খুবই পুলকিত হয়ে পড়লেন। তাঁর হাতের ঘড়ি কোনো অশুভ প্রভাবে পড়ে যেতে পারে। কিন্তু চিফ-মেটের ঘড়ি এবং যেখানে যত রকমের সময় নির্ধারণের ব্যাপার আছে সর্বত্র দেখে দেখে বুঝতে পারলেন কোনো ভুল-ত্রুটির ভয় নেই—সময় ঠিক –বারো ঘণ্টা পার হয়ে ছত্রিশ মিনিট। এবং এভাবে তিনি বসে বসে কেবল দণ্ড পল দেখে যাচ্ছেন। মিনিটের কাঁটা একবার ঘুরে গেলেই সেই শৈশবের মতো প্রায় লাফিয়ে উঠছেন—এক দুই তিন গুণে যাচ্ছেন। যত সময় পার হয়ে যাবে তত তার রোষ কমে আসবে। রোষের মুখে একরকম, সময় পার হয়ে গেলে অন্যরকম।

সারারাত তিনি ঘড়ির পেণ্ডুলামের মতো এভাবে চিন্তাভাবনায় দুলেছেন। পায়চারি করেছেন। ঘুমোতে পারেন নি। মাঝে মাঝে পোর্ট-হোলে দাঁড়িয়ে দেখেছেন, সর্বত্র শুধু নক্ষত্রেরা ভেসে যাচ্ছে আকাশে। কখনও তিনি সিঁড়ি ধরে নেমে এসেছেন নিচে। বনি দরজা খুলে যদি কোথাও চলে যায়? কোনো অশুভ শক্তি তাকে যদি আকর্ষণ করে, মাথায় তো তখন কিছু থাকে না। বোকার মত দরজা খুলে হেঁটে যেতে পারে। বার বার এভাবে নিচে ওপরে, কখনও মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, কখনও ঠিক বনির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভেবেছেন, কেবিনের ভেতর বনি নেই, ফাঁকা ঘর তিনি পাহারা দিচ্ছেন, তখনই বুকটা কেঁপে ওঠে, মুহূর্তপ্রায় তাঁর আর অপেক্ষা করার সময় থাকে না—বনি বনি, তুমি কি করছ! বনি!

বনি দরজা খুলে মুখ বাড়িয়ে বলছে, কি হল বাবা? এত রাতে? তুমি এখনও ঘুমোও নি! চল ওপরে!

—আরে না। তুমি ঘুমোও। আমি ঠিক উঠে যেতে পারব। আচ্ছা শোনো, দরজা খুলবে না। কেমন? জাহাজ তো ভাল জায়গা না! কেউ ডাকলে দরজা খুলবে না। দরজাটা ভাল করে লক করে দাও। কি দিয়েছ?

—হ্যাঁ দিয়েছি। তবু ঠেলে দেখলেন একবার। রাতটা কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। সেই এলিসের মৃত্যুর . দিনের মতো। প্রত্যেকটা মিনিট ঘণ্টার চেয়েও বেশি লম্বা হয়ে যাচ্ছে। আর তাঁর ঘুম আসছে না। ঘুম এলেও তিনি ঘুমোতে যাচ্ছেন না। ক্রমে রাত এভাবে বাড়ছে। তিনি আর কেবিনের ভেতরও থাকতে পারছেন না। যেন কেউ বনিকে অসতর্ক মুহূর্তে বের করে নিয়ে যাবে। তিন চার্ট-রুমের রেলিঙে চলে এলেন। এখানে দাঁড়ালে বনির দরজা দেখা যায়। উইংসের আলো এসে পড়েছে দরজায়। সামান্য শব্দ হলে তিনি ঠিক টের পাবেন। এবং সমুদ্র থেকেযত প্রবল হাওয়া আসুক, দরজা খোলার শব্দ ঠিক শুনতে পাবেন। বনি কোথাও দরজা খুলে চলে যেতে চাইলে তিনি ঠিক টের পাবেন।

নিশীথে নক্ষত্রেরা তখনও তেমনি আকাশে এবং দিগন্তে পারাপারহীন অসীমতায় কিরণ দিচ্ছে। সামনে শহরের সব আলো ঘর বাতি। কোথাও বাড়িঘরের ছায়া। জাহাজে কোথাও কোনো এতটুকু শব্দ নেই। একেবারে শব্দহীন অন্তহীন যাত্রার মতো তিনি দাঁড়িয়ে আছেন ওপরে। গোপনে পাহারা দিচ্ছেন। কোনোরকমে রাতটা পার করে দিতে পারলেই দুর্ভাবনার অনেকটা লাঘব। তখন সহসা যেন দূরে কিছু দেখতে পাচ্ছেন! ঠিক মেন-মাস্টের গোড়ায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে। তার ছায়া বড় হয়ে যাচ্ছে ক্রমে এবং ক্রমে ছায়াটা লম্বা হয়ে যাচ্ছে। লম্বা হতে হতে প্রায় বনির কেবিনের কাছাকাছি চলে আসছে। তিনি কাঠ হয়ে গেছেন দেখতে দেখতে। ভারি সন্তর্পণে সে এগিয়ে আসছে। জাহাজের অস্পষ্ট আলোতে তিনি বুঝতে পারছেন না, এভাবে টলতে টলতে গভীর রাতে বোটডেকে কে উঠে আসছে। তিনি কিছুতেই আর স্থির থাকতে পারলেন না। রেলিঙে ঝুঁকে চিৎকার করে উঠলেন, কে? কে ওখানটায়! ঠিক বনির দরজার কাছে এসে গেছিল। এখন পালাচ্ছে। মুখটা ভীষণ নিচু করে রেখেছে। ওপর থেকে দেখা যাচ্ছে না। তিনি বললেন, কে? কে আপনি? সঙ্গে সঙ্গে চোখের ওপর থেকে ছায়াটা টুপ করে ডুবে গেল। বনির দরজার সামনে ঠিক নিচে নামার সিঁড়ি। সিঁড়িতে ছায়াটা অদৃশ্য হয়ে গেল। তখন সেই মধ্য যামিনীতে হাহাকার শব্দে স্যালি হিগিনসের কণ্ঠস্বর গমগম করে বেজে উঠল, কে? কে আপনি! আপনি কি জাহাজের সেই অশুভ প্রভাব। আপনি কি ক্রমে আবার প্রতিহিসংসাপরায়ণ হয়ে উঠছেন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *