1 of 2

অলৌকিক জলযান – ৪২

।। বিয়াল্লিশ।।

ছোটবাবু সারারাত ঘুমোতে পারল না। আবার মাথার ভেতর সেই ঘণ্টাধ্বনি। ঘণ্টাধ্বনি হলে ভীষণ অস্বস্তি। জলতেষ্টা পায়, হাত পা এবং শরীরে কেমন অস্থিরতা, যেন এক অসহ্য দাহ নিয়ত মাথার ভেতরে কখনও ঘণ্টাধ্বনির মতো, কখনও রেলগাড়ির চাকার মতো ঘড় ঘড় করে আকাশ- বাতাস কাঁপিয়ে চলে যাচ্ছে।

ছোটবাবু চুপচাপ বোট-ডেকে দাঁড়িয়েছিল। পাশে ডেবিড। ডেবিডের যা স্বভাব, সে নানাভাবে ছোটবাবুকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। ছোটবাবু ডেবিডের একটা কথাও শুনতে পাচ্ছে না। এত জোরে মাথার ভেতর ঘণ্টাধ্বনি হলে কিছু শোনা যায় না। ছোটবাবু দু’হাতে রেলিং চেপে দাঁড়িয়ে আছে। দেখলে মনে হবে, ওর দু’হাতের পেশিতে এত বেশি শক্তি প্রায় মড়মড় করে লোহার রেলিং গুঁড়ো গুঁড়ো করে ফেলবে যেন। সে দূরের সমুদ্রে কেবল গর্জন শুনতে পাচ্ছে। জোয়ারের জল বোধ হয় ধীরে ধীরে নামছে। এবং এ-কারণে যা হয়ে থাকে, কখনও কখনও মৈত্রদার মুখ সমুদ্রের গভীরে নীল জলের ভেতরে দেখে ফেলে। যেন মানুষটা গভীর নীল জলে এখন একটা মাছ হয়ে সাঁতার কাটছে। এবং পাশে কোনো দ্বীপটিপ আছে কিনা খুঁজছে। তারপর যা হয়ে যায়, সে দেখতে পায় দূরে দাঁড়িয়ে দ্বীপের মাথায় মৈত্রদা ডাকছে।—এই ছোটবাবু আমাকে ফেলে তোরা চলে যাচ্ছিস, আমাকে নিবি না! সঙ্গে সঙ্গে মনে হয় মৈত্রদা সাঁতার কেটে জাহাজে উঠে আসার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কেউ তাকে নিতে চাইছে না। তারপর আশ্চর্য সে দেখতে পাচ্ছে মৈত্রদা ডুবে যাচ্ছিল। সমুদ্র আর তার অতিকায় সব ঢেউ মিলে মৈত্রদাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। আর্চি যেন জাহাজে তখন বিউগল বাজাচ্ছে। ছোটবাবু তখন কেমন ভ্যাবাচাকা খেয়ে সামান্য অবলম্বন ডেবিড, ডেবিডকে বলে ফেলল, ডেবিড তোমার কী মনে হয়?

ডেবিড বুঝতে পারল না ছোটবাবু কী বলতে চাইছে।

ছোটবাবু বলল, তুমি কী বিশ্বাস কর জাহাজ কোনো অশুভ প্রভাবে আছে?

ডেবিড বলল, সে তো ছোটবাবু জাহাজটার আজন্ম একটা রোগ। এ-নিয়ে তুমি এখন ভাবছ কেন!

—আচ্ছা ডেবিড, তোমার কি সত্যি মনে হয় মৈত্রদা সমুদ্রে ভেসে গেছে। সমুদ্রে ডুবে গেছে। আসলে কেউ তো ঠিক ঠিক দেখেনি।

—কিছু তো বলা যাবে না। হয়তো দেখা যাবে সকালে বাঁশি বাজাতে বাজাতে জাহাজটায় বড়- টিণ্ডাল ফিরে আসছে! সে যা একখানা মানুষ!

ছোটবাবু বলল, ডেবিড তোমাকে তবে পেট ভরে মদ খাওয়াব।

—ঠিক!

—ঠিক ডেবিড।

তারপর আবার ছোটবাবু কেন যে দেখে ফেলে আর্চি ক্রমে তার দলবল ভারী করে এগিয়ে আসছে। প্রথমে আর্চি পরে পাঁচ-নম্বর এবং পরে এভাবে ডেক-সারেঙ, এনজিন-কশপ মার্চ করে যাচ্ছে বোট- ডেকে। ওরা প্রথমে বিউগল বাজাচ্ছিল। তারপর সবাই কেমন বন্দুকের নল উঁচু করে দাঁড়ায়। এবং ক্রমে সে দেখতে পায় সার সার ওরা তিনজন—কাপ্তান স্যালি হিগিনস, বনি এবং সে। অর্থাৎ একটা রহস্য জড়িয়ে আছে জাহাজে। এটা পাপ, কার্গো-শিপে মেয়েমানুষ রাখা পাপ। এবং একটা উন্মত্ততা তখন চারপাশে নেচে বেড়াচ্ছিল। প্রায় উলঙ্গ করে দেবার মতো বনিকে আর্চি সবার সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। এই আপনাদের জ্যাক। কাপ্তানের শয়তান ছেলে। ছেলে না মেয়ে? বলুন। জ্যাকের শরীর মাস্তুলে ঝুলিয়ে রেখে এমন বলছে যেন আর্চি।

আর ছোটবাবু দেখতে পায় তখন কি হুল্লোড় জাহাজে। সবাই এগিয়ে আসছে গন্ধ শুঁকে। যেন সবাই গিরগিটি হয়ে যাচ্ছে। আসছে। মাথা উঁচিয়ে দেখছে সবাই। আবার ছুটে আসছে। মুহূর্তে প্রায় সেই হুল্লোড় বনিকে বগলদাবা করে তুলে নিচ্ছে যেন। এবং ছোট ছোট মাখনের স্লাইস মুখে পুরে জিভ দিয়ে চেটে চেটে খাচ্ছে। বনি চিৎকার করছে, ছোটবাবু বাঁচাও।

মাথায় এভাবে ঘণ্টাধ্বনি হলে সে যে কি করে! সে ডেবিডের সঙ্গে আর একটা কথা বলতে পারছে না। ওর চোখ জ্বলছে। আর্চির দলবল সহজেই ভারী হয়ে যেতে পারে—সে শুধু বলে দেবে মিড়-সীতে তোমাদের আমি জাদু দেখাব হে নাবিকগণ। তোমরা তো জানো জাহাজ পুরানো ভাঙা—এক বছরের নাম করে এনে তোমাদের ছলেবলে স্যালি হিগিনস দু’বছর রেখে দিচ্ছে। তারপর আরও কত বছর রাখবে কে জানে—দেশে ফেরার কথা ভেবে তোমরা পাগল হয়ে যাবে। কিন্তু আমি তোমাদিগকে দেখাতে পারি এক আশ্চর্য নারী সুধা-পারাবার। জিভ চেটে চেটে সে প্রায় ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো বনির পোশাক খুলে নেবে। সবার সামনে বনিকে উলঙ্গ করে ফেলবে।

জ্যাক তখন বাইরে এসে বলল, ছোটবাবু তুমি এখনও জেগে আছ?

ডেবিড বলল, কিছুতেই নিয়ে যেতে পারছি না।

ছোটবাবু জ্যাককে দেখে ক্ষেপে গেল। বলল, এত রাতে তোমার এখানে কি দরকার! তুমি কি করতে বের হয়েছ? ভেতরে যাও।

জ্যাক বলল, তোমরা কথাবার্তা বলছ, আমার ঘুম আসে?

ছোটবাবুর তারপর মনে হল সে আর বনিকে আগের মতো মর্যাদা দিচ্ছে না। বনিকে বরং ভারী অসহায় এবং দুঃখী মনে হচ্ছে। বনির জন্য এভাবে তার যেন কি আশ্চর্য মায়া। একই টুকুতেই সে খুব বেশী বিচলিত হয়ে পড়ছে! সে বলল, যাচ্ছি।

বনি বলল, যাচ্ছি না। এক্ষুনি যাবে।

ছোটবাবু আর দাঁড়িয়ে থাকার সাহস পেল না। দূরে শহর, শহরের আলো। বাতাস তেমনি বইছে এবং সবকিছু ঠিকঠাক কেবল একজন জাহাজি এখনও জাহাজে ফেরেনি। অথবা সমুদ্রের গভীরে সে শুয়ে আছে। সে কিছুতেই ডেবিডের মতো ভাবতে পারছিল না সকাল হলে সে মৈত্রদাকে দেখতে পাবে পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাতার বাঁশি বাজাচ্ছে।

বনি বলল, ডেবিড তুমি ওকে নিয়ে যাও।

ডেবিড বলল, সেই কখন থেকে তো বলছি।

ছোটবাবু বুঝতে পারল, ওর জন্য সবাই বিব্রত হয়ে পড়েছে। সে ডেবিডকে বলল, চল।

বনি দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকল। ছোটবাবু নিচে নেমে না গেলে সে এভাবে যেন দাঁড়িয়ে থাকবে। দরজা থেকে নড়বে না। ডেবিড আগে আগে নামছে। ছোটবাবু পেছনে পেছনে নেমে যাবার সময় সিঁড়ির মুখে দেখল বনি তখনও দাঁড়িয়ে আছে। সে বলল, দাঁড়িয়ে থাকলে কেন। ভেতরে যাও।

বনি এবার আর দাঁড়াতে পারল না। সে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ না করলে যেন নিশ্চিন্ত হতে পারছে না ছোটবাবু। সে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

ছোটবাবু তখন নামছে। নিচে নেমে দরজা খুলে চুপচাপ বিছানায় বসে থাকল। পোর্ট-হোল খোলা। গরম পড়েছে ভীষণ। সে জোরে পাখা চালিয়ে দিল। মৈত্রদার দু’টো একটা কথা তার মনে হচ্ছে—তাহলে তুমি জাহাজের ছোটবাবু। মৈত্রদা জাহাজের কোল-বয়দের ছোটবাবু বলে ডাকত। ছোটবাবু নামটা মৈত্রদার দেওয়া। সে যে অতীশ দীপঙ্কর ভৌমিক যেন গলা চেঁচিয়ে বললেও কেউ আর বিশ্বাস করবে না। দেশভাগের আগে সে ছিল সোনা, জাহাজে উঠে সে হয়ে গেল ছোটবাবু। মৈত্রদা তাকে এ-জাহাজে ছোটবাবু বানিয়ে নিজে বেশ সরে পড়ল। আর যা হয়, এ-সব কথা মনে হলেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। বিশ্বাসই করতে পারে না, মৈত্রদার সঙ্গে তার আলাপ পুরো এক বছরও হয়নি অথচ মানুষটা ছিল তার সব যেন। এবং রাগে দুঃখে সে বলল, কাল যদি তোমাকে না দেখি সকালে পাড়ে দাঁড়িয়ে পাতার বাঁশি বাজাচ্ছ তবে কাপ্তানের মতো আমিও তোমাকে আগাপাশতলা চাপকাব। তুমি ভেবেছ কি!

ডেবিড বেশ ভেবে খুশী তখন—বড়-টিণ্ডাল যা একখানা মানুষ এত সহজে ভেসে যাবে বিশ্বাস করা যায় না। হয়তো সত্যি সে সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখবে তার দলবল নিয়ে জেটিতে বেলুন উড়াচ্ছে বাঁশি বাজাচ্ছে তখন বিকেলে সে ছোটবাবুর পয়সায় আকণ্ঠ মদ খাবে! সকাল হলে সে আর ছোটবাবু সঙ্গে না হয় বড়-টিণ্ডালকে নেওয়া যাবে। তারপর মদ্যপান। লারে লারে গান গলায়। ওরা যে অন্য গ্রহে তাদের সবকিছু রেখে এসেছে তখন আর মনেই হবে না। ডেবিড আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। ছোটবাবু সহজে শুয়ে পড়তে পারল না। আলো নেভাতে ইচ্ছে হল না। পোর্ট-হোলে দাঁড়িয়ে থাকল।

ওপরে এভাবে বনিও দাঁড়িয়ে আছে। তারও ঘুম আসছিল না। ছোটবাবুর সঙ্গে এনজিন-কশপের কিছু একটা হয়েছে। এনজিন-কশপের কথা ছিল ছ’নম্বর হবার। কিন্তু সে হতে পারেনি। ওর রাগ স্বাভাবিকভাবে ছোটবাবুর ওপর থাকবে। ছোটবাবু এনজিন-কশপের সঙ্গে বাংলায় কথাবার্তা বলছিল। সে কিছুই বুঝতে পারেনি। ছোটবাবুকে সে বলেছিল, কি হয়েছে! ছোটবাবু বলেছিল, কিছু না। এই পর্যন্ত! তারপর সেও ছোটবাবুকে কেন জানি দ্বিতীয়বার…আর কিছু বলতে সাহস পায়নি। ছোটবাবুর মুখ ভীষণ থমথম করছিল। অস্পষ্ট জ্যোৎস্নায় যতই ছোটবাবু গোপন করুক সব সে বুঝতে পেরেছে। ছোটবাবুর মাথায় আবার সেই ঘণ্টাধ্বনি হচ্ছে। বাবা তাকে ঠিকই বলেছিলেন, বনি ছোটবাবুর মাথায় কিছু হচ্ছে না তো! সেই যে ক্রোজ-নেস্ট থেকে পড়ে ছোটবাবুর মাথায় পেরেক ঢুকে গেছিল এবং পর পর সব দৃশ্য মনে হলে সে স্থির থাকতে পারে না। সে কিছুতেই আজ বলতে পারেনি, যতই অস্বীকার কর তোমার কিছু হচ্ছে না, আমি কিন্তু বলছি মাথায় তোমার কিছু হচ্ছে। তুমি আমাকে সব গোপন করছ।

আর বনি আশ্চর্য হয়ে গেছে আগের মতো ছোটবাবু নেই। কেমন ক্রমে রাশভারী হয়ে যাচ্ছে। আগের মতো সহজেই জেদ বজায় রাখতে পারে না বনি। অন্য সময় হলে সে কি করত জানে না কিন্তু আজ যখন ‘কিছু না’ বলে এড়িয়ে গেল তখন অপমানে দিনের পর দিন কথা না বলে থাকতে পারত। অথচ সে মনে মনে ভারি খুশী। ছোটবাবুকে তার সমীহ করতে ভাল লাগছে। ছোটবাবু তাকে সব বললেই বোধহয় খাটো হয়ে যেত।

ছোটবাবু তখন নিচে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারছে বনি ঘুমোয়নি। মাথার ওপর বনির কেবিন। হাঁটাহাঁটি করলে টের পাওয়া যায়। জাহাজ নোঙর ফেলে রাখলে এত বেশি নির্জনতা যে বনি কাঠের পাটাতনে নেমে কার্পেটের ওপর কিভাবে কোনদিকে হেঁটে যাচ্ছে তা পর্যন্ত ধরা যায়। বনি এইমাত্র পোর্ট-হোলে দাঁড়িয়েছিল এখন হেঁটে সে তার বাংকে এসে বসেছে। আর কোন শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। বোধহয় বনি এবার শুয়ে পড়ল।

ছোটবাবু এভাবে পোর্ট-হোলে দাঁড়িয়ে দূরের শহর দেখছে। আর নক্ষত্রমালার মত ঝিকমিক করছে শহরের আলো যেন হাজার জোনাকি-পোকা আকাশের গায়ে স্থির হয়ে আছে। আর দূরে তেমনি সমুদ্রগর্জন। সমুদ্র অবিরাম দ্বীপটার চারপাশে ফুঁসছে। জ্যোৎস্নায় দ্বীপের উঁচু পাহাড় অথবা টিলাতে ঘরবাড়িগুলো দেখা যাচ্ছে না। রাস্তার আলো ঘুরে ঘুরে ওঠে গেছে। আর কি বিস্ময় কখনও মিনারের মতো অথবা গম্বুজের মতো মনে হচ্ছে ছোট ছোট পাহাড়গুলোকে। আলোগুলো গম্বুজের গায়ে মীনা- করা মণি-মুক্তার মতো। এমন সব সুন্দর পৃথিবী ফেলে মানুষের চলে যেতে ইচ্ছে হয় কেন সে বুঝতে পারে না।

আবার মনে হল মাথার ওপর কাঠের পাঠাতনে কেউ হাঁটছে। বনি তবে ঘুমোতে পারছে না। বনি আবার পোর্ট-হোলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ওর ইচ্ছে হচ্ছে এক্ষুনি ওপরে উঠে দরজায় দাঁড়িয়ে বলে, বনি কী হচ্ছে! তোমার জন্য আমি ঘুমোতে পারব না! এভাবে দাপাদাপি করলে নিচে কারো ঘুম হয়।

আর তখনই মনে হল কোথায় যেন বনির ওপর সে অধিকার পেয়ে গেছে। বনি হয়তো নিজেই অধিকারটুকু অজান্তে তাকে দিয়ে দিয়েছে। অথবা বোধহয় এমনই হবার কথা। সে তো বনির পায়ের শব্দ প্রথম থেকেই মাথার ওপর শুনতে পেত। সে তো কখনও এভাবে ভাবেনি বরং বনির পায়ের শব্দ মাথার ওপর না হলে ওর ঘুম আসত না। কাপ্তানের ছেলে সামান্য দাপাদাপি হুল্লোড় করবে না তো কে করবে! তার তখন মনেই হত না ওপরে কেউ হেঁটে বেড়াচ্ছে। তার ঘুম ঠিক চলে আসত। আর এখন সে শুনতে পাচ্ছে বনি খুট-খুট করে কিছু কাটছে। বনি তারপর খুব জোরে পোর্ট-হোলের কাঁচ ঠেলে দিচ্ছে এবং স্ক্রু এঁটে দিচ্ছে। তার শব্দ পর্যন্ত কান পাতলে শোনা যাচ্ছে। বনি কি সারারাত ঘুমোবে না।

সে এবার দরজা খুলে ওপরে উঠে ডাকল, বনি।

বনি দরজা খুলে বলল, কী?

—ঘুমোচ্ছ না কেন? কেবল খুটখাট শব্দ করছ!

বনির শরীরে রাতের পোশাক। বনি কী বলেই চোখ নামিয়ে নিয়েছে। আর যেন ছোটবাবু এক অধিকারের সাম্রাজ্য পেয়ে গেছে। এখানে সে খুশিমতো বিচরণ করবে। তার চোখেমুখে অতীব অহংকার। সে বলল, ঘুমোচ্ছ না কেন?

—ঘুম আসছে না ছোটবাবু।

ছোটবাবু বলল, তুমি না ঘুমালে আমার ঘুম আসবে না বনি। আমাকে তোমরা সবাই এত কষ্ট দাও কেন!

বনি বলল, যাচ্ছি। বনি আর কিছু বলল না। বনি অধীরতায় ডুবে যাচ্ছে। সে কিছুতেই সোজাসুজি ছোটবাবুর দিকে তাকাতে পারল না। ছোটবাবু আজ সারাদিন তাকে ধমকের ওপর রেখেছে। অভিমানে তার কান্না পাচ্ছিল। সে দরজা বন্ধ করে দেবার সময় বলল, ছোটবাবু আমি আর খুটখাট শব্দ করব না। আমি ঠিক এবার ঘুমিয়ে পড়ব।

ছোটবাবু নিচে এসে আর ওপরে কোন শব্দ শুনতে পেল না। ওপরের কেবিনটা নিথর। এতটা নিথর যেন ভয়ের। কেবল এখন কেন জানি মনে হচ্ছিল, বেশ তো ছিল বনি। যেন সে এবং বনি পৃথিবীতে শুধু জেগে ছিল। বনি ঘুমিয়ে পড়েছে কি চুপচাপ শুয়ে পড়েছে, পাশ ফিরছে না, শ্বাস জোরে ফেলছে না—পাছে তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে, বুঝতে পারছে না। এতটা সে না করলেই পারত। ওপরে উঠে ওকে ভৎর্সনা না করলেও চলত। ভৎসনা শব্দটাই মনে আসছিল ঘুরে ফিরে।

এই জাহাজ, বনি, পাশে দ্বীপমালা এবং আরও ওপরে আছেন স্যালি হিগিনস, তিনি কি করছেন! আর্চি কি করছে! কারা যেন ওর এলি-ওয়ে ধরে ছুটে গেল। এবং ডানপাশের এলি-ওয়েতে কয়েকজন মানুষ এক সঙ্গে সন্তর্পণে হেঁটে গেলে যেমন একটা রহস্য থেকে যায় তেমনি রহস্য। অর্চি কি জেগে রয়েছে? অথবা জাহাজের কোনো অন্ধকারে সবাইকে নিয়ে সলাপরামর্শ করছে? ওর কিছুতেই ঘুম আসছিল না। একবার সে দরজা খুলে ডেক-ফল্কা সব ঘুরেও দেখে এল! কেউ জেগে নেই। গ্যাং- ওয়েতে কোয়ার্টার-মাস্টার ঝিমুচ্ছে। গভীর রাতে সে একা আবার ফিরে এল কেবিনে। দরজা বন্ধ করে ফের শুয়ে পড়ল।

খুব ভোরে জাহাজে সোরগোল উঠে গেল।

ছোটবাবু দরজা খুলেই শুনল, বড়-টিণ্ডালের লাশ পাওয়া গেছে।

ছোটবাবু যেন কথাটা আগ্রহের সঙ্গে শুনছে। তা হলে সকালে পাড়ে দাঁড়িয়ে মৈত্রদা পাতার বাঁশি বাজাচ্ছে না! সে কেমন বিহুলপ্রায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এক পা নড়তে পারল না। মনে হল ওর কিছু আর করণীয় নেই। কোথায় কে কিভাবে বসন্তনিবাসের মৃতদেহ আবিষ্কার করেছে তার জানার যেন কোন আগ্রহ নেই। কেবিনের দরজায় চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। ওর সামনে দিয়ে হেঁটে গেল বাটলার, মেস-রুম-বয়, থার্ড-অফিসার। ওরা সবাই ডেকে ছুটে যাচ্ছে। সে যাচ্ছে না। সে পোর্ট-হোলে গিয়ে পর্যন্ত দাঁড়াচ্ছে না। সে যেন এখন চুপচাপ হাতমুখ ধুয়ে এক কাপ চা খাবে, কাজের পোশাক পরে তেলের টব, বাকেট নিয়ে যেমন রোজ উইনচে চলে যায় তেমনি যাবার কথা। বড়-টিণ্ডাল কে, সে তাকে যেন চেনে না! চোখমুখ দেখলে বিশ্বাসই হবে না সে বড়-টিণ্ডাল বলে কাউকে চিনত।

ডেবিড এসে দেখল ছোটবাবু চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। ডেবিডকে দেখে একটা কথা বলছে না।

এনজিন-সারেঙ ছুটে এসেছেন।

–কোথায়।

–ছোট তুই যাবি না?

বড়-টিণ্ডালের লাশ পাওয়া গেছে।

ছোটবাবু বলল, তোমরা যাও, আমি যাব না।

ডেবিড এবং রেডিও-অফিসার যাবে। স্যালি হিগিনস, বনি গ্যাঙ-ওয়েতে চলে গেছে। মোটরবোট সিঁড়ির কাছাকাছি অপেক্ষা করছে।

সারেঙ বললেন, তুই না হলে হবে কেন?

–আমার কি দরকার! আপনারা যান।

–কি বলছিস ছোট! ওর কাজ-কামে কি দরকার হবে আমরা কি করে জানব!

–আমি তো কিছু জানি না কি কি করতে হবে।

ডেবিড এবার যেন ধৈর্য হারিয়ে ফেলছে।–ছোটবাবু, সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। স্যালি হিগিনস, আর্চি, চিফ-মেট সবাই। ছোটবাবু তবু কথা বলছে না। সে ভেতরে ঢুকে গেল। তারপর ছোটবাবু পোশাক পাল্টে বের হয়ে এল। সারারাত সে ঘুমোয় নি বলে চোখ লাল। সে বাইরে এসে দেখল নিচে বোটে সবাই উঠে গেছে। ওর জন্য বোট ছাড়ছে না। ওকে ধরে-বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

সে বোটে উঠে গেল। সে সমুদ্রের দিকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। ওকে কেউ দেখুক সে যেন চায় না। দূরে সেই বেলাভূমিতে শহর ভেঙে সব লোক নেমে এসেছে। সেই বিচিত্র মানুষটি জোয়ারের জলে ভেসে গেছিল আবার সমুদ্র তাকে ঠেলে দিয়ে গেছে কিনারায় এবং শহরের সর্বত্র তখন একই খবর। জাহাজের সেই বিচিত্র বসন্তনিবাস মারা গেছে। তখন সকালের রেডিওতে আবহবার্তা, তখন রেডিওতে এ-ছোট খবরটাও ছিল বেলাভূমিতে একজন বিদেশী মানুষের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। জাহাজ সিউল-ব্যাংকের নাবিক। মানুষজন ছুটছে সেই বিদেশী মানুষের মৃতদেহ দেখতে।

ওরাও সবাই সেই পাহাড়-ছাদের নিচে চলে এসেছে। কে বলবে গতকাল রাতে জল ছিল এখানে ছাদের সমান। এখন বেলাভূমি শুকনো। যারা শঙ্খ, ঝিনুক সংগ্রহ করতে এসেছিল তারা দেখেছে একজন মানুষ উপুড় হয়ে পড়ে আছে। একটা বড় মাপের জনি-ওয়াকারের বোতল বগলে। সন্তানকে আদর করার মতো বুকের কাছে জড়িয়ে রেখেছে। এই সব মানুষেরা ছুটে ছুটে খবর দিয়েছে সব শহরবাসীদের, সেই লোকটা, বিকেলে যে লোকটা মেলায় ঘুরে বেড়িয়েছিল বেলুন উড়িয়েছিল বাতাসে, লজেন্স চকোলেট সব শিশুদের বিতরণ করেছিল—যে সারাক্ষণ পাতার বাঁশি বাজিয়ে বলেছিল, মি বসন্তনিবাস সেলর—মারা গেছে। সমুদ্রের জলে ডুবে মারা গেছে।

সবাই মিলে পথ করে দিলে ওরা ভেতরে ঢুকে গেল। ছোটবাবু বাচ্চা ছেলের মতো পাশে বসে পড়েছে। সে যে কাঁদছে কাউকে বুঝতে দিচ্ছে না।

স্যালি হিগিনস লাঠিতে ভর করে মাথার দিকে দাঁড়িয়ে আছেন। ঝুঁকে দেখছেন। দেখতে দেখতে বললেন, তুমি আমার ভারি বদনাম করলে হে ছোকরা। তিনি চিফ-মেটকে বললেন, চিফ জলদি বোট আনো। বোটে করে ওকে জাহাজে নিয়ে যেতে হবে। অনেক কাজ। আপনারা এখান থেকে সরে যান মা-মাসিরা। এই যে ছেলে-ছোকরারা তোমরা যাও বাপু। সঙ্গে সঙ্গে পুলিসের লোকেরা ভিড়টা সরিয়ে দিচ্ছে। স্যালি হিগিনস বললেন, আমি আপনাদের বড়কর্তার সঙ্গে একটু কথা বলব। বলে পুলিসের কাছ থেকে ঠিকানা নিলেন। তারপর ডাকলেন, ছোটবাবু, তুমি আবার ঝুঁকে বসে আছ কেন? ওঠো ওঠো।

হঠাৎ স্যালি হিগিনস ভারি চটপটে এবং ব্যবহারে জাদুকরের মতো মুখ, একজন জাহাজি এভাবে বেলাভূমিতে শুয়ে আছে, তিনি যেন লাঠি উঁচিয়ে বলবেন, এক দুই তিন ওঠো, জাহাজে চলো। তারপরই বড়-টিণ্ডাল উঠে দাঁড়াবে। জাহাজের দিকে হাঁটতে আরম্ভ করবে। এমনই মনে হচ্ছিল স্যালি হিগিনসকে দেখে।

–এই ছোটবাবু, এখনও তুমি ঝুঁকে আছ। ওঠো। ওকে তুলে নাও। দেখছ না জলে সব ভিজে যাচ্ছে আমাদের।

সকালের সমুদ্র তেমনি শান্ত এবং প্রবহমান। ছোট ছোট ব্রেকার এসে ওদের সবার জুতো মোজা ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। জলে ডাঙায় পড়ে থাকার মতো বড়-টিণ্ডাল শুয়ে আছে। ছোট ছোট ব্রেকার এলে জল ওর চারপাশে ছড়িয়ে যাচ্ছে। ছোটবাবু এবার মৈত্রদাকে দু’হাতে পাঁজাকোলে তুলে বলল, কোথায় নিয়ে যেতে হবে স্যার?

—ওপরে নিয়ে যাও। জলে ভিজে তো ঢোল হয়ে যাচ্ছে।

মৈত্রদা ভীষণ ভারী। এমন জবরদস্ত মানুষটাকে সে সহজেই কাঁধে ফেলে নিতে পেরেছিল। প্রথম পাঁজাকোলে তারপর কাঁধে ফেলে নিলে জল বমি করেছে হড়-হড় করে। এবং প্রায় হাল্কা হয়ে গেলে ছোটবাবু দেখল সবাই ওকে অবাক চোখে দেখছে। এত বড় লাশটাকে কত সহজে কাঁধে ফেলে নিতে পারছে ছোটবাবু, প্রায় দৈত্যের সামিল। আর্চির গলা শুকিয়ে কাঠ। সে বলল, স্যার আমরা জাহাজে ফিরে যাচ্ছি।

স্যালি হিগিনস বললেন, নো।

আর্চি বোধ হয় অপমানে ফেটে পড়েছিল। সে দাঁড়িয়ে গেল—বোট আসতে দাও। স্যালি হিগিনস এমন বলে দেখলেন ছোটবাবু তখনও দাঁড়িয়ে আছে। কাঁধে মৈত্রের মৃতদেহ। তিনি কিছু বলছেন না তিনি অন্য অনেক কথা বলছেন—এই যে ডেবিড তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন! দ্যাখো বোট আসছে কিনা! —সারেঙ, এনজিন-সারেঙ!

এনজিন-সারেঙ ছুটে এলেন।—তুমি কি করছ?

এনজিন-সারেঙ বললেন, ওদের তো দাহ করার নিয়ম। ওরা তো স্যার লাশ কবর দেবে না।

–তা হলে কি কি করতে হবে ঠিকঠাক করে ফেল। আমরা দেরি করব না।

স্যালি হিগিনস দেখছেন, ছোটবাবু লাশ কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সবার চেয়ে ছোটবাবু দীর্ঘকায় এক মানুষ, আত্মপ্রত্যয়ের অভাব সামান্য। সব ঠিক হয়ে যাবে। দাঁড়িয়ে থাকতে দাও। এই যে ডেক- সারেঙ, বলতেই ডেক-সারেঙ লাফিয়ে লাফিয়ে কাছে চলে গেল। বলল, আদাব স্যার।

স্যালি হিগিনস বললেন; আদাব। বড়-টিণ্ডাল কেন মরল বল তো?

–জানি না স্যার।

—তুমি ডেক-টিণ্ডাল?

–জানি না স্যার!

–তুমি তুমি

বনি বলল, কতক্ষণ লাশ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। ওকে নামাও।

স্যালি হিগিনস ডাকলেন, দ্যাখো তো বোট আসছে কিনা জ্যাক!

আর্চি বলল, ঐ যে আসছে স্যার। আসছে। সে আর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না, বোটের কাছে ছুটে গেল। স্যালি হিগিনস সামান্য হাসলেন। বললেন, ছোটবাবু এবার ওকে নামাও।

ছোটবাবু বলল, নামিয়ে কি হবে? বরং স্যার বোটে তুলে দি।

বোট কিছুটা দূরে। ডেবিড বলল, ছোটবাবু ওকে নিচে রাখ। আমরা লাশ ধরাধরি করে নিয়ে যাচ্ছি।

ছোটবাবু কিছু বলল না। এগিয়ে যেতে থাকল। বোটে সে একেবারে মৈত্রদাকে শুইয়ে দেবে। বোধহয় ছোটবাবুর ভীষণ ঘাম হচ্ছিল এবং এত ভারী ওজনের মানুষটাকে কাঁধে ফেলে রাখা যাচ্ছে না। এক হাতে দু’পা, কাঁধে শরীর এবং ডান হাতে আর একটা হাত, আহত কোন সৈনিকের মতো ছোটবাবু তার মৈত্রদাকে নিয়ে যাচ্ছে। বোধহয় সে মৈত্রদাকে কোনো মৃত মানুষের মতো ভাবতে পারছে না। জলে ডুবে মরা মানুষেরা কখনও বেঁচে ওঠে—হয়তো বোটে নিয়ে যেতে যেতে মৈত্রদা ফিক করে হাসবে, কিরে ছেলে না মেয়ে? এমন যখন হতে পারে তখন তাকে একজন আহত সৈনিকের মতো সে নিয়ে চলল। বেঁচে গেলে যেন বলতে না পারে, রাখ রাখ তোরা তো আমাকে মেরেই ফেলেছিলি। এবং এভাবে ছোটবাবু মৈত্রকে শুইয়ে দেবার সময় বোটের চারপাশে সবাই জড়ো হতে থাকলো। একটা মাত্র বোট। ঠিক থাকল বাকি সবাই হেঁটে যাবে জাহাজে। বোটে ছোটবাবু ডেবিড বন্ধু এনজিন- সারেঙ। বনি উঠতে চেয়েছিল। ছোটবাবু বলল, নো। তুমি হেঁটে যাও।

আর এখন এই যে একজন সমুদ্র-মানুষের শেষ কাজ, শেষ কাজ বলতে ওরা মৈত্রকে দূর সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে আসতে পারে—একজন সমুদ্র-মানুষের সমাধি এভাবে হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু বন্ধু অনিমেষ ধার্মিক নাগরিকের মতো চোখ মুখ করে রেখেছে। বহুদিন পর মনে হয়েছে ওরা জাতিতে হিন্দু ওদের ধর্মে নানা বিধিনিষেধ আছে, তীরের কাছাকাছি কোথাও একটা দাহ করার জায়গা খুঁজে বের করতে হবে। ওরা ছোটবাবুকে বলল, ছোটবাবু তুমি কিন্তু কিছুতেই রাজী হবে না।

বনি আবার বলল, ছোটবাবু আমাকে নাও। আমি যাব।

ছোটবাবু বলল, উঠে এস। বলেই ওরা বোট ছেড়ে দিল। ওদের অনেকটা পথ ঘুরে যেতে হবে, ছোটখাটো সব দ্বীপমালা ভেসে রয়েছে। জাহাজটা আছে সামনে, মনে হয় কাছাকাছি। কিন্তু এই সব দ্বীপমালা চারপাশে, অনেক ঘুরে ঘুরে যেতে হবে। মোটর-বোটে ওরা ভেসে যাবার সময় দেখল মৈত্রদা নিরীহ স্বভাবের মানুষ, ঘুমিয়ে আছে মতো। শরীর এখনও শক্ত হয়নি। দু’টো একটা প্লাস্টিকের খেলনা জামায়, ছোট পুঁতির মালা। পকেটে হাত দিয়ে পেল সামান্য ক’টা চকোলেট। এবং জামাটা ওপরে উঠে গেলে ছোটবাবু অবাক, পেটে পিঠে অদ্ভুত সব নীল চাকা চাকা দাগ। সামান্য দুর্গন্ধ। জামা ওঠে এলে সবাই কেমন চোখ মুখ কুঁচকে দেখল শরীরে মানুষটার কিছু বাকি ছিল না। এনজিন-সারেঙ বললেন, ছোট সর্বনাশ তুই ঘাটছিস! তোর রক্ষা থাকবে না।

ছোটবাবু জেদী বালকের মতো নরম হাতে জামা টেনে দেখল। বনি আছে নয়তো সে প্যান্ট খুলে দেখত, কোথায় কোথায় মানুষটা শরীরে এমন কঠিন অসুখ নিয়ে বেঁচেছিল। বনি আছে বলে সে ফের জামা টেনে বলল, বন্ধু কাঠ পাবি কোথায়?

বন্ধু বলল, ছোটবাবু তুমি কিন্তু আমাদের কথার বাইরে যাবে না। গেলে হাতাহাতি হবে।

অনিমেষ বলল, আমরা মৈত্রকে আগুনে পোড়াব। মাটির নিচে কিছুতেই চাপা দেব না। ধর্মাধর্মের ব্যাপারটা তুমি অবহেলা করবে না।

ডেবিড বলল, বড়-টিণ্ডালের এত বড় অসুখ ছোটবাবু তুমি জানতে না!

ছোট কি বলবে! সে বলল, না। সে সোজাসুজি মিথ্যা কথা বলল।

–তোমরা ছোটবাবু মরবে।

ছোটবাবু বলল, ডেবিড আমার কিছু করার ছিল না

এবং ভীষণ চিন্তিত দেখাল ডেবিডকে। ডেবিড বলল, লোকটা ঘায়ের জ্বালায় পাগল হয়ে গেল। আর তোমরা চুপচাপ দেখে গেলে!

ছোটবাবু ভারী লজ্জায় পড়ে গেছে মতো মাথা নিচু করে রেখেছে।

তখন বনি বলল, ডেবিড, বড়-টিণ্ডালের শরীরে ওসব কি!

ছোটবাবু সহসা চিৎকার করে উঠল, বনি!

এবার ছোটবাবু ডেবিডের দিকে না তাকিয়েই বলল, ডেবিড এসব কথা আর কেউ যেন না জানে। মৈত্রদার ইচ্ছে নয় কেউ জানুক। আমরা ক’জনই না হয় জানলাম, মৈত্রদা একটা নোংরা অসুখে মরে গেল। আর তখনই ছোটবাবুর মুখটা ভারী বিষণ্ণ হয়ে যায়। যেন মনে হয় ওর উচিত ছিল ডেবিডকে সব খুলে বলা। মৈত্রদার ভয়ে সে এটা করেনি। মৈত্রদা তা হ’লে বেঁচে যেতো। সে বলল, ডেবিড আমি জানতাম। মৈত্রদার ভয়ে বলিনি। এখন মনে হচ্ছে আমি সত্যি মানুষটাকে মেরে ফেললাম। বুঝতে পারছি আমার আরও সাহসী হওয়া দরকার।

ডেবিড বলল, ছোটবাবু জাহাজে মানুষ এভাবেই বাঁচে। তোমার দুঃখ করার কিছু নেই। নসিবে আছে মরবে—তুমি কিছু করতে পার না।

বন্ধু তখন আবার বলছে, ছোটবাবু আমরা কিন্তু মৈত্রকে পোড়াব।

ছোটবাবু বলল, পোড়াবি তো পোড়াবি। বার বার বলার কি আছে!

–তুমি যা মানুষ। ভালো মানুষের মতো রাজী হয়ে গেলে আমাদের কথা কেউ তখন শুনবে না।

ওরা ছ’জন মানুষ আর মাঝখানে লম্বা হয়ে পড়ে আছে বসন্তনিবাস। আকাশ ভীষণ মেঘলা। সমুদ্রের জল তেমন নীল নয় আর। কেমন ঘোলা দেখাচ্ছে। ওরা দু’টো-একটা দ্বীপের পাশ দিয়ে জাহাজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। হালে বসে আছে সামোয়ান মাঝি। মানুষটার কাছে আশ্চর্য লাগছে, কোথাকার মানুষ কোথায় এসে মরে গেল। লোকটার স্ত্রী, ছেলেমেয়েরা কোথায় থাকে জানার খুব তার ইচ্ছে। সেও দু’টো একটা কথা বলছে।

দু’এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল এ-সময়। ওদের বোট এখন জাহাজের নিচে ভিড়ে গেছে। সিঁড়ির কাছে বোট বেঁধে ছোটবাবু বন্ধু ওপরে উঠে গেল। কিভাবে কি হবে ওরা এখনও জানে না। জাহাজে মাল বোঝাই হবার কথা সকাল থেকে। কিন্তু সকালে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেলে সব বন্ধ হয়ে গেল। জাহাজে মাল বোঝাই হবে না। একজন মৃত জাহাজির সম্মানে সব কাজকর্ম বন্ধ। ছোটবাবু, ডেবিড, এনজিন-সারেঙ হেঁটে যাচ্ছিল। অন্য জাহাজিরা এখন রেলিঙে ঝুঁকে আছে। বড়-টিণ্ডালের লাশ দেখছে। খুবই হতাশা মুখে এবং আর্চি তেমনি জাহাজিদের পাশে পাশে হেঁটে যাচ্ছে। মুখে সে চুরুট রেখে জাহাজের মাস্তুলে নানাবিধ দুর্ঘটনার ছবি প্রত্যক্ষ করছে। সেও বেশ ঝুঁকে দেখছে।

তখন স্যালি হিগিনস ব্রীজ থেকে হাঁকলেন, কোয়ার্টার-মাস্টার!

কোয়ার্টার-মাস্টার এলে বললেন, ছোটবাবুকে ডাকো।

ছোটবাবু প্রায় দৌড়ে ওপরে উঠে গেলে হিগিনস বললেন, দাহ করা যাবে না। স্থানীয় মানুষেরা আপত্তি করবে।

ছোটবাবু বলল, কেন স্যার?

–ভারী বীভৎস ব্যাপার বলছে। ফোনে কথাবার্তা বললাম, কিছু করা গেল না। শহরের মেয়র রাজী হচ্ছে না। গণ্ডগোল বেঁধে যেতে পারে।

সে বলল, যদি দূরে এই ধরুন দশ-বারো মাইল দূরে কোনো দ্বীপে নিয়ে যাই! সেখানে পুড়িয়ে আসি!

–দেখি তবে।

তিনি ফোন করে সব খবরাখবর নিলেন। বললেন, হবে। তাহলে তোমরা বোট নিয়ে ভেসে পড়।

দু’টো বোট ভাড়া করেছে চিফ-মেট। এখন কে কে যাবে? স্যালি হিগিনস বললেন, ছোটবাবুকে জিজ্ঞাসা কর, কে কে যাবে?

কাছে কোথাও ছোটবাবু ছিল না। সে তখন জাহাজের পাশে ছোট্ট বোটটাতে নেমে গেছে। তীরে সব মানুষদের জটলা। সূর্য ক্রমে সমুদ্র থেকে ওপরে উঠে আসছে। দলে দলে সব সাদা রঙের পাখি জাহাজটার মাথায় উড়ছিল। ছোটবাবু বড়-টিণ্ডালের জামা প্যান্ট খুলে ফেলছে। বনি উঁকি দিলেই হাঁকছে, এই তোমার এখানে কি! যাও ভেতরে যাও। বনি মুখ ব্যাজার করে কেবিনে ঢুকে বসে থাকছে। বার বার ভাবছে—আর যাবে না। সারাক্ষণ ধমকের ওপর রাখলে কার মেজাজ ঠিক থাকে!

এনজিন-সারেঙ অবাক, জ্যাক ছোটবাবুকে কবে থেকে এত মান্য করতে শিখল। তিনি একেবারে হাঁ। সব দেখে-শুনে এখন ইচ্ছে হচ্ছে তাকেও ছোটবাবু কিছু বলুক। কিছু এই যেমন সামান্য চন্দন কাঠ কোথায় পাওয়া যাবে। সামান্য ঘি স্টোর রুমে পাওয়া যাচ্ছে—কাঠের জন্য বন্ধু আর ডেবিড চলে গেছে। ছোটবাবু তাকেও পাঠালে পারত। জব্বার মনু বাদশা মিঞা চুপচাপ বড়-টিণ্ডালের পাশে বসে রয়েছে। এবং যা হয়ে থাকে সবাই নিজের নিজের সুখ দুঃখ অর্থাৎ এই মৃত্যু মানুষের কোন দূরবর্তী আকাঙ্ক্ষার মতো, মৃত্যু তাদের যেন অনেক বড় করে দিয়েছে। কিছুতেই ওরা আর ছোট কাজ করতে পারবে না। একজন জাহাজি নানাকারণে পৃথিবীর অন্যসব মানুষের চেয়ে আলাদা।

বোট ছাড়ার সময় হয়ে যাচ্ছে। যারা যারা যাবে হাত তুলে ছোটবাবু ইশারায় ডাকছে। যেমন যাচ্ছে ছোট-টিণ্ডাল, এনজিন-সারেঙ, বড়-টিণ্ডালের ওয়াচের তিনজন ফায়ারম্যান, দু’জন কোলবয় স্যালি হিগিনস নিজে, ডেবিড, বন্ধু, অনিমেষ। বনি লাফিয়ে নামছে। বেহায়ার মতো জাহাজের ওপরে দাঁড়িয়ে হাঁকছে, ছোটবাবু আমি যাব। ছোটবাবুর তাকাবার পর্যন্ত সময় নেই। হাত তুলে সে ইশারায় না করছে। স্যালি-হিগিনস নেমে আসার সময় দেখতে পেলেন বনি কেবিনের দিকে ব্যাজার মুখে ফিরে যাচ্ছে। তিনি বললেন, বনি যাবে? গেলে চল।

বনি বলল, না বাবা আমি যাব না।

বনি বোধ হয় মানুষের এই নিষ্ঠুর পরিণতি দেখতে সাহস পাচ্ছে না।

আর একটা বোট নিয়ে ফিরছে বন্ধু এবং ডেবিড। ওরা কাঠ মেটে হাঁড়ি এবং নতুন সাদা থান এনেছে। এবং বাঁশ লম্বা মতো দু’টো। কিছু শুকনো ডাল আর সব চন্দন কাঠ। পাটকাঠি পাওয়া যাচ্ছে না। তার চেয়ে নরম ঘাসের কাণ্ড এনেছে যা পাটকাঠির মতো জ্বলবে। তারপর দু’টো বোট সমুদ্রে ক্রমে একটা দ্বীপ খুঁজে বেড়াতে বেড়াতে বেশ পাঁচ-ছ মাইলের মাথায় একটা আশ্চর্য সবুজ রঙের পাথরের দ্বীপ পেয়ে গেল। দূর থেকে দ্বীপ বলে চেনা যায় না। সমুদ্র যেন সহসা ঢেউ তুলে স্থির হয়ে গেছে। ঢেউটা আর নড়ছে না। উঁচু নিচু সব ঢেউ আর তার উপত্যকা। ওরা কাছে গেলে বুঝতে পারল বেশ ছোট দ্বীপটা। ফার্লং-এর মতো দ্বীপটা প্রস্থে দৈর্ঘ্যে সমান। ওরা চারজন, ডেবিড বন্ধু সামনে, অনিমেষ ছোটবাবু পেছনে, উঠে যেতে থাকল।

মাচানের ওপর শুয়ে আছে বড়-টিণ্ডাল। পেছনে আসছে সবাই। মাথায় করে তুলে আনছে কাঠ বাঁশ। এবং স্যালি হিগিনসের হাতে চন্দনের কাঠ। সারেঙের হাতে ঘি-এর টিন। সব নিয়ে উঁচু একটা জায়গা দেখে ওরা উঠে যাচ্ছে। চারপাশে শুধু সমুদ্র আর তার তরঙ্গমালা। সবুজ পাহাড়ের মাথায় সেই এক অগ্নিকাণ্ডের আয়োজন। ডেবিড এবং স্যালি হিগিনস দূরে দাঁড়িয়ে ক্রমে কৌতুহলী হয়ে উঠেছেন। মানুষের শরীর আগুনে পুড়ে যায়—জীবনেও ওঁরা দেখেন নি। কেমন ভয়ে কৌতুহলে ওঁরা সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে দেখছেন।

ছোটবাবু সমুদ্র থেকে হাঁড়িতে জল তুলে আনছে। জলে স্নান করানো হচ্ছে বড়-টিণ্ডালকে। বড় একটা পাথরের ওপর বসন্তনিবাস শুয়ে আছে। ঘড়া ঘড়া জল ঢালা হচ্ছে। একে একে সবাই জল এনে ওর শরীরে ঢেলে দিল। তারপর সাদা নতুন কাপড় এবং কাঠ সাজিয়ে রাখা হচ্ছে। সূর্য ঠিক তখন সমুদ্রে অস্ত যাবার মুখে। ছোটবাবু মৈত্রদার মুখে আগুন দেবার সময় বলল, বন্ধু, তোরা হরিবোল দিলি না; সবই যখন হল এটা বাদ যাবে কেন?

এবং এই এক শব্দ পাহাড়ের মাথায় আর এই দিগন্তে। এখন সমুদ্র জয় করে অথবা আকাশ- বাতাস জয় করে ছুটে যাবে। ওরা তার চিতা প্রদক্ষিণ করল। ছোটবাবুর সেই ঠাকুরদার দৃশ্যের কথা মনে পড়ছে। এবং পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার কথা ভাবছিল। কি যে ভয় ছিল তখন! এখন সে সাহসী মানুষের মতো অথবা বলা যায় অভিভাবকের মতো কাঠের নিচে আগুন দিয়ে পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে থাকল। আগুন ক্রমে প্রবল হয়ে উঠছে। কাঠের ফাঁকে ফাঁকে আগুন ক্রমে আকাশ ছুঁয়ে দিতে চাইছে।

আর আগুনের ভেতর ছোটবাবু সহসা কেন যে বনির মুখ দেখে ফেলল। জাহাজে বনি একা। স্যালি হিগিনস পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে মানুষের সৎকার দেখছেন। কেমন হুঁশ ছিল না তার। ছোটবাবু পাশে দাঁড়িয়ে ডাকল, স্যার।

–কিছু আমাকে বলবে?

–অনেক রাত হবে। আপনি বরং স্যার ফিরে যান একটা বোটে। সে ডাকল, চাচা! সারেঙ পাহাড়ের মাথায় উঠে গেলে বলল, আপনারা ফিরে যান। আমরা একেবারে শেষ হয়ে গেলে ফিরব। একটা বোট এখানে থাক।

হিগিনস জাহাজে ওঠার মুখে দেখলেন, বনি বোট-ডেকে দাঁড়িয়ে আছে! আবার সেই সাদা জ্যোৎস্না সমুদ্রে। বোট-ডেকে বনিকে আবছা দেখা যাচ্ছে। বনির কাছে গিয়ে বললেন, ওদের ফিরতে রাত হবে বনি।

–ওরা কতদূর গেছে?

তিনি এবার দূরে অস্পষ্ট জ্যোৎস্নায় দেখলেন নক্ষত্রের মতো সমুদ্রের বুকে আগুনটা জ্বলছে।–এই যে দেখছ, দেখতে পাচ্ছ না, মাঝে মাঝে একটা উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো আগুন আকাশে কখনও বেশ দপ্ দপ্ করে জ্বলছে আবার নিভে যাচ্ছে দেখতে পাচ্ছ?

—হ্যাঁ বাবা।

–ওখানে ওরা একটা দ্বীপে বড়-টিণ্ডালকে আগুনে পুড়িয়ে দিচ্ছে। তিনি এবার বললেন, ভয় করলে ব্রীজে এসে বসতে পার।

এবং তখনই হঠাৎ ওপরে কোয়ার্টার মাস্টারের গলা। স্যার ফোন। সে বলতে বলতে নেমে আসছে। ওপরে উঠে তিনি বললেন, ইয়েস ক্যাপ্টেন স্যালি হিগিনস, বলুন। তারপর চুপচাপ। আবার বললেন, ইয়েস ইয়েস। কিন্তু এটা কেন হচ্ছে। বনি দেখল বাবার মুখ দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।

ফোনে তিনি চিৎকার করে উঠলেন, হোয়াট

–স্যার রিচার্ড ফ্যালের এমনি নির্দেশ আছে।

–নো নো। আমি পারব না। বলতে বলতে উত্তেজনায় তিনি থরথর করে কাঁপছেন। তারপর কেমন স্তিমিত গলায় বললেন, আসবেন। নিশ্চয়ই আসবেন। তারপর বসে পড়লেন। কেমন রক্ত- শূন্য হয়ে গেছেন সহসা। সাদা ফ্যাকাশে মুখ। বনির দিকে তাকিয়ে আছেন। আর চোখ নামাচ্ছেন না। বনি বাবাকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, বাবা কি হয়েছে! বাবা! বাবা!

স্যালি হিগিনস ভীষণ নিথর। ঠাণ্ডা। যেন জীবনে আর একটা কথা বলবেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *