1 of 2

অলৌকিক জলযান – ৪০

।। চল্লিশ।।

রাতে মৈত্র ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিল।

ওর এটা আজকাল খুব বেশি হচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়লেই সুন্দর সব স্বপ্ন দেখছে। এবং অধিকাংশ সময় স্বপ্নে ম্যান্ডেলা সমুদ্র-তীরে দাঁড়িয়ে থাকে। পায়ের কাছে ক্যাঙ্গারুর বাচ্চাটা লাফায়। দূরে একটা পাইন গাছের ছায়ায় ছোট্ট সাদা রঙের বাড়ি, সামনে সব নানা বর্ণের গাছ-গাছালি।

স্বপ্ন দেখলেই সে আর যা দেখতে পায়, ম্যান্ডেলার মাথায় লাল রঙের টুপি, হাতে সাদা দস্তানা। ম্যান্ডেলার চুল সোনালী রঙের। ওর মুখ নরম আর কি তাজা। কেবল বুকে নিয়ে আদর করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ম্যান্ডেলাকে সে যেন কিছুতেই হাসিখুশি দেখতে পায় না। চোখ দু’টো ভারী ভারী, একটু আদর করলেই টস টস করে দু’গাল বেয়ে চোখের জল নেমে আসবে। তখনই ওর ইচ্ছে হল জাদুমন্ত্রে সে মেয়েটাকে কোনো দ্বীপে পৌঁছে দেবে। যেখানে জাহজডুবিতে একজন মানুষ সমূদ্রে আটকে পড়েছে। একটা নির্জন দ্বীপে সে আছে। ম্যান্ডেলাকে নিয়ে যেতে পারলে মানুষটার আর কোনো দুঃখ থাকবে না।

স্বপ্নটা ঘুরে ফিরে কখনও একই রকমভাবে বার বার সে দেখে ফেলে।

যেমন সে দেখে ফেলে সকাল হলেই ম্যান্ডেলা সমুদ্রের ধারে নেমে আসছে। ওর মা জানালায় বসে দেখতে পাচ্ছে, ম্যান্ডেলা বালিয়াড়িতে পায়ের ছাপ রেখে কেবল এগিয়ে যাচ্ছে। বাতাসে ওর চুল উড়ছে। চারপাশে ছুটে বেড়াচ্ছে ক্যাঙ্গারুর বাচ্চাটা। সে পালকটা দিয়ে আসার পর মা তার ভাল হয়ে যাচ্ছে। আর ওর মা’র চোখে সেই দূরের সমুদ্র, যেন কতকাল পর তার ঘরের মানুষ ফেরার কথা, চোখ- মুখ উত্তেজনায় অধীর। ম্যান্ডেলার মা’কে সেই যে এক বাংলাদেশের নাবিক পালক দিয়ে গেল আর এল না। সাদা রঙের জাহাজ দেখলেই ম্যান্ডেলার মা’র মনে হত ওটা বসন্তনিবাসের জাহাজ। সে আবার এ-শহরে ফিরে আসছে। মা তার তখন সুন্দর নীল রঙের গাউন পরতে ভালবাসে। পায়ে সাদা রঙের জুতো। জাহাজিদের নীল রঙটা ভারি পছন্দ তার। ম্যান্ডেলার মা বোধহয় বুঝতে পারে সব। হাতে তার লাল রঙের দস্তানা।

শীত নেই তবু স্বপ্নে ম্যান্ডেলার মা দস্তানা পরে সমুদ্রের ধারে চলে আসে। ম্যান্ডেলার হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু জাহজাটা নোঙর না ফেলে চলে যেত। নানারকম বার্চ গাছের নিচে ম্যান্ডেলার মা’কে সাদা পুতুলের মতো মনে হতো তখন।

এভাবে স্বপ্নে ম্যান্ডেলার দেশে শীত এসে যায় কখনও। বরফ পড়তে থাকে। পাইন গাছগুলো সাদা হয়ে যায়। একটা লাল রঙের বল আকাশে কেউ ছুঁড়ে দেয় তখন। বলটা গড়িয়ে নিচে পড়ে যায় না। আকাশের গায়ে লটকে থাকে সূর্যের মতো। তুষারপাতের সময় কখনও স্বপ্নে মৈত্র দেখতে পায় ম্যান্ডেলা আর তার মা জানালার কাঁচ বন্ধ করে বসে আছে। তুষারপাত দেখতে দেখতে বুঝি কখনও মনে হয় মাহিমের ঘোড়া পাহাড়ে যাচ্ছে সাদা মস্ খেতে। বরফের ছবি ফুলের মতো ভেসে থাকে জানালায়। হাত দিয়ে বার বার মুছে দিতে ভাল লাগে ম্যান্ডেলার।

কখনও স্বপ্নে বসন্তনিবাস দেখতে পায় সমুদ্রে বড় বড় তিমি মাছ ভেসে যাচ্ছে। সব সাদা তিমি মাছ। মাছের ওপর বরফ জমে, কখনও অতিকায় দ্বীপের মতো। সারি সারি পালতোলা নৌকার মতো ওরা ভেসে যায়। অথবা ওরা এক পাল ভেড়ার পাল যেন, জলের ওপর এমন অজস্র ছবি। ডলফিনগুলো লেজ নেড়ে নেড়ে একটা বাচ্চা মেয়ের কাছে চলে আসছে, আদর খেতে। স্বপ্নে বসন্তনিবাস ম্যান্ডেলাকে নিয়ে তখন সমুদ্রে নেমে মাছের সঙ্গে খেলা শুরু করে দেয়।

আর এভাবে এক আশ্চর্য সুষমা তৈরি হয়ে গেলেই ম্যান্ডেলার মা’র বোধহয় মনে হয় আগামী বসন্তে আবার সেই বসন্তনিবাস চলে আসবে। পাইন-পাতার লম্বা বাঁশি থাকবে তার হাতে। সে আর ওয়াকা এবং শহরের সব ছেলেদের পেছনে পেছনে ব্যান্ড বাজিয়ে যাবে। ব্যান্ড-মাস্টার বসন্তনিবাস।

আবার কোনো কোনো রাতে মৈত্র স্বপ্নে বসন্তনিবাস হয়ে গেলে দেখতে পায়, ওর জাহাজটা গভীর সমুদ্রে নোঙর ফেলে আছে। একটা বোটে সে নেমে যাচ্ছে। যেন কোনো দূরবর্তী বন্দরে যাবার কথা। যাবার পথে দেখা করে যাচ্ছে ম্যান্ডেলা আর তার মা’র সঙ্গে। কি যেন ওদের দিয়ে যাবার কথা আছে।

কোনো কোনো রাতে ম্যান্ডেলা আর তার মা সারারাত যেন জেগে থাকে। দূরে একটা জাহাজ নোঙর ফেলে আছে, জাহাজ থেকে কেউ আসবে। ওরা সারা-রাত, দরজা খুলে দেবে বলে জেগে বসে আছে। যদি বসন্তনিবাস এসে ফিরে যায়। রিন-রিন্ করে তখন বসন্তনিবাসের মাথায় একটা আশ্চর্য বাজনা বাজতে থাকে। মানুষের সুখ-দুঃখের অতীত এক জাদুকরের বাজনা, সে তখন জেগে নিজের ভেতরই নিজে বিভোর হয়ে থাকে। তার আর কিছু ভাল লাগে না।

কখনও সে স্বপ্নে দেখতে পায় সমুদ্রে ঝড় উঠলেই ম্যান্ডেলার মা ভীষণ দুঃখী। ঝড় উঠলেই বুঝি ম্যান্ডেলার বাবার কথা খুব বেশি করে মনে পড়ে যায়। এবং যেবারে ওর বাবা ক্যাঙ্গারুর বাচ্চাটা নিয়ে এসেছিল সেকি আনন্দ আর উৎসব বাড়িতে। সারাক্ষণ বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে, তখন তো ম্যান্ডেলা আরও ছোট, সে বাচ্চাটাকে সামলাতে পারত না, ফাঁক পেলেই দু’ লাফে পালিয়ে যেত এবং এক রাতে যখন বাচ্চাটাকে খুঁজে পাওয়া গেল না, ম্যান্ডেলার কি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না! কিন্তু সকালে কি আশ্চর্য, দরজা খুললে ম্যান্ডেলা দেখতে পেয়েছিল বাচ্চাটা গুঁড়ি মেরে দারজার কাছে শুয়ে আছে। ম্যান্ডেলা বলেছিল, সেবারই যে বাবা জাহাজে গেল আর ফিরে এল না। স্বপ্নে বসন্তনিবাস সে-সব হুবহু দেখে গুম মেরে বসে থাকত। তার কিছু ভাল লাগত না।

স্বপ্নে মাঝে মাঝে ম্যান্ডেলার সঙ্গে কথাবার্তা হলে সে শুনতে পায়, ম্যান্ডেলা করুণ মুখে বলছে, তারপর আর বাবা ফিরে এল না। মা বিছানা নিলে। মনে হয়েছিল মা বাঁচবে না। যেমন বাবা সমুদ্রে চলে গেছে মা’ও তেমনি একদিন কোথাও চলে যাবে।

বসন্তনিবাসের তখন কতরকমের ইচ্ছে হয়। ইচ্ছে হয় পৃথিবীর কোথাও থেকে সে একটা জাদুকরের টুপি নিয়ে আসবে মেয়েটার জন্য, ক্যাঙ্গারুর বাচ্চাটার জন্য একটা ঘন্টা। ম্যান্ডেলা টুপি পরলেই যেখানে খুশি চলে যেতে পারবে, সঙ্গে ওর প্রিয় ক্যাঙ্গারুর বাচ্চা হাইতিতি। ম্যান্ডেলা আর হাইতিতি বাতাসে ভেসে যাবে, এবং সঙ্গে সে। তারপর পৃথিবীর যেখানে যত দ্বীপ আছে, খুঁজে দেখবে কোথায় আটকা পড়েছে মানুষটা। যেন হাইতিতি গন্ধ শুঁকে টের পেয়ে যাবে এবং পেলেই ওরা কোনো নির্জন দ্বীপে পাহাড় গাত্রে দেখতে পাবে মানুষটা দাঁড়িয়ে তার মেয়ের ছবি আঁকছে। নির্জন দ্বীপে সে সময় পেলেই বালিয়াড়িতে অথবা পাহাড়ের গায়ে মেয়ের ছবি এঁকে যায়। তার শরীরে পাতার পোশাক। ঘাসের কুটিরে সে থাকে। কচ্ছপের ডিম খেয়ে মানুষটা বেঁচে আছে দ্বীপে।

আর যা ভাবে বসন্তনিবাস, যেন মানুষটাকে নিয়ে ফিরতে পারলেই, ম্যান্ডেলার মা’র অসুখ সেরে যাবে। ম্যান্ডেলাকে ফেলে কোথাও আর চলে যাবে না।

রাতে আবার সে স্বপ্ন দেখল! ম্যান্ডেলার জন্য সে নিয়ে গেছে জাদুকরের টুপি আর হাইতিতির জন্য একটা ঘন্টা। জানালায় দাঁড়িয়ে আছে ম্যান্ডেলা। চারপাশে সাদা জ্যোৎস্না। আর গীর্জায় ঘন্টা বাজছিল। সমুদ্র থেকে এলোমেলো বাতাসে সবুজ পাইনের বন যেন উড়ছে। বসন্তনিবাস বাতাসে ভাসতে ভাসতে পাইনের বন পার হয়ে গেল। এবং ঠিক জানালার পাশে ছোট্ট উইলোর ঝোপে নেমে ডাকল, ম্যান্ডেলা, হাইতিতি। জানালায় ম্যান্ডেলা, ওকে দেখে চিনতে পারছে না। সে যত বলছে, আমি বসন্তনিবাস, আমাকে চিনতে পারছ না? হাইতিতি পিট্‌পিট্ করে তাকাচ্ছে আর তখনই ম্যান্ডেলা দৌড়ে বের হয়ে বলছে, কোথায় তুমি, তোমাকে তো দেখতে পাচ্ছি না। আর তখনই বসন্তনিবাসের মনে হয়, সে তার মাথার পালকটা খুলে না ফেললে ম্যান্ডেলা দেখতে পাবে না। যেই না খুলে ফেলা, বসন্তনিবাস জ্বলজ্বল করে উঠল। বলল, মা কোথায়?

ম্যান্ডেলা বলল, বসন্তনিবাস তুমি কী সুন্দর, বসন্তনিবাস তুমি পাতার পোশাক পরে আছ কেন?

—তোমার মা কোথায়?

—মা ছুটি কাটাতে মারুয়াতে গেছে।

—সেটা আবার কোন দ্বীপ?

—সাউথ আয়লান্ডে।

—আমরা ওখানে এখন যেতে পারব না?

—অনেক দূর।

—তুমি কার সঙ্গে থাকো?

—বুড়ি মা আছে। ড়াকব?

—না না ডাকতে হবে না। এটা তুমি রাখো। এটা মাথায় পরলেই তুমি বাতাসে ভেসে যেতে পারবে। কেউ দেখতে পাবে না। ঘন্টাটা হাইতিতির গলায় ঝুলিয়ে দেবে। সেও তোমার সঙ্গে যেখানে খুশি ভেসে যেতে পারবে। কেউ দেখবে না। কেবল ঘন্টা বাজবে। লোকে শুনতে পাবে বাতাসে ঘন্টা বাজছে। আর কিছু বুঝতে পারবে না। বাতাসে ঘন্টা বাজলেই পৃথিবীর লোকেরা বুঝতে পারবে ম্যান্ডেলা তার বাবাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। সঙ্গে তার প্রিয় ক্যাঙ্গারুর বাচ্চা হাইতিতি।

—তুমি আমাদের সঙ্গে থাকবে না?

—আমিও থাকব।

—কি মজা হবে। বলেই সে লাফাতে লাফাতে বসন্তনিবাসের কাছে চলে গেল। টুপিটা মাথায় পরে ফেলতেই হঠাৎ একটা ঘুড়ির মতো বোঁ করে ওপরে উঠে গেল। ভেসে যাচ্ছে। ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠল, বসন্তনিবাস, আমি উড়ে যাচ্ছি। আমি পড়ে যাব। মরে যাব।

বসন্তনিবাস হাসল, তুমি যা ইচ্ছে করবে, বলবে। যা বলবে, টুপিটা তাই শুনবে।

—আমি নামব। কোথাও আমি যাব না।

—কোথায় নামবে বল।

—বাড়িতে।

একেবারে ছোট্ট পুতুলটির মতো নেমে এল ম্যান্ডেলা। বসন্তনিবাস ম্যান্ডেলাকে তারপর কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াল সারা শহর যেখানে যত খাবার সব তিনজনে মিলে গর্ গর্ করে খেয়ে ফেলতে থাকল। যত প্লাস্টিকের খেলনা সব কিনে সে উজাড় করে ফেলল। যত সুন্দর সুন্দর পোশাক সব সে ম্যান্ডেলার জন্য কিনে ফেলল। যেন ম্যান্ডেলাকে পৃথিবীর সবকিছু দিয়ে যেতে পারলে তার আর দুঃখ থাকবে না।

সে বলল, ম্যান্ডেলা আর ভয় পাবে না?

ম্যান্ডেলা বলল, না।

—ভয় পেলে আমাকে ডাকবে। আমি চলে আসব। কেমন!

মেয়েটা ঘাড় কাত করে তাকাল। বলল, আচ্ছা। তারপর কেমন কুয়াশার ভেতর ম্যান্ডেলা এবং হাইতিতি হারিয়ে যেতে থাকল। আর মনে হল, কেউ ডাকছে তাকে। সে চোখ মেলে কিছুতেই তাকাতে পারছে না। সে বুঝতে পারছে এক নম্বর পরীর গ্রীজার ওকে জাগিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। এমন সুন্দর স্বপ্নটা তার নষ্ট হয়ে গেল। সে জেগে চুপচাপ শুয়ে থাকল। স্বপ্নের উষ্ণতা তার শরীরে লেগে আছে এখনও। প্রপেলার সমুদ্রের অতলে ঘুরছে, তার শব্দ পাচ্ছে শুয়ে। বোধহয় সমুদ্রে সামান্য ঝড়-ঝঞ্ঝা উঠেছে। পোর্ট-হোল দিয়ে জল নেমে আসছে নিচে। সে উঠে পোর্ট-হোল বন্ধ করে দিল। এবং এই হয়, জাহাজ প্রায় তিনদিন আগে বন্দর পাবার কথা। বন্দর পাচ্ছে না। ভয়াবহ কিছু ঘটছে জাহাজে, তারা কেউ তা বুঝতে পারছে না।

আর এ-সবে এখন তার কিছু আসে যায় না। বরং সে এখন এভাবে কেন জানি পৃথিবীতে একজন সত্যিকারের বসন্তনিবাস হয়ে বাঁচতে চায়। তার আবার কখনও ইচ্ছে হয়, চুপচাপ এভাবে সারাজীবন সমুদ্রে ভেসে বেড়াবে—ডাঙায় নামবে মাঝে মাঝে, দু’হাতে সব সুন্দরী মেয়েদের সাপ্টে খেয়ে ফেলবে, আবার কখনও মনে হয়, ওর তো কিছুই নেই পৃথিবীতে, বরং সে ম্যান্ডেলার জন্য একটা পাতার বাঁশি কিনবে। ওয়াকা, সে আর ম্যান্ডেলা এবং সেই হাইতিতি মিলে একটা সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলবে। তারপর মনে হয়, কেউ তো তার জন্য অপেক্ষা করে নেই। শরীরে বিজবিজে ঘা দেখা দিচ্ছে ফের। যেন তার খারাপ ইচ্ছেগুলো যখন মাথানাড়া দিয়ে ওঠে তখনই বিজবিজে ঘা তার শরীরে একটা সবুজ ঘন ঘাসের বীজের মতো ছড়িয়ে থাকে এবং যখন যেমন খুশি সুড়সুড়ি দিচ্ছে, তখন শুধু মদ্যপান আর কখনও সমুদ্রের ধারে ধারে ঘুরে বেড়ানো। বাতাসে দু’হাত তুলে সমুদ্রকে বলা, কি আরাম জীবনধারণে। ওর এক হাতে সেই বড় মাপের জনি-ওয়াকার, সে সেটা যেন আকাশের অথবা সমুদ্রের মাথায় বাড়ি মেরে সহজেই ভেঙে ফেলতে পারে।

সে পোর্ট-হোলে দাঁড়িয়ে এমন সবই কেবল ভাবছে। ছোটবাবুর সঙ্গে কতদিন যেন দেখা হয় না। দুই গ্রহের এখন মানুষ তারা। আগে তবু খোঁজখবর নিত। আজকাল প্রায় সে এদিকটায় আসেই না। একবার ইচ্ছে হয় ছোটবাবুকে সে ডেকে বলে, খুব বড় হয়ে গেছিস না। আমি আর কেউ না? আমরা বাদে জাহাজে আর তোর কে ছিল। কেমন ওর পৃথিবীতে এভাবে সবার ওপর আশ্চর্য অভিমানে চোখ ফেটে জল আসে—আমি আর থাকব না জাহাজে। দেখবি, এবারে ঠিক নেমে যাব। আমাকে তোরা কেউ খুঁজে পাবি না।

তারপর ফের ভেবে ফেলে, কি সব আজেবাজে সে ভাবছে। ছোটর তো এখন অনেক কাজ, অনেক দায়িত্ব। জাহাজের মেরামত সারাদিন লেগে আছে। নিঃশ্বাস ফেলারই সময় নেই। দেখা করবে কখন আজ সকালে ওয়াচ থেকে ফিরে এসে শুয়ে পড়বে না। জেগে থাকবে। ছোটর সঙ্গে দেখা করবে। বলবে, ছোট তুই আমাকে চিনতে পারিস? আমি তোর মৈত্রদা। ভুলে যাসনি তো।

সকালে মৈত্র দেখা করতে গেলে ছোট বলল, আমি তোমাকে ভুলব কি করে! আমি রোজই ভাবি। একবার তোমার ফোকসালে যাব। কিন্তু কি যে হচ্ছে জাহাজে, তুমি দেখছ তো সারাক্ষণ এটা ভেঙে যাচ্ছে, ওটা ভেঙে পড়ছে। কখন কি হবে কেউ বলতে পারে না। তারপরই সে কেমন সতর্ক হয়ে যায়। এসব কথা বলা অনুচিত। একান্ত গোপন খবর, মাঝে মাঝে বনি তাকে কিছু কিছু বলে ফেলে। বনি! আশ্চর্য নাম। ওর কেবল বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল, দাদা, জ্যাক তো ছেলে নয়। মেয়ে। তোমরা মনে মনে যা ভাবো ঠিক। বোধ হয় গোপন থাকছে না। কারণ এখন তো সে দেখলেই বনিকে বুঝতে পারে, বনি যতই ঢোলা পোশাক পরে থাকুক, ওকে পুরুষ মনে হয় না। ওর শরীরের গঠন একটু মনোযোগ দিলেই বোঝা যায় পুরুষের শরীর এমন হবে কেন। বুকের নিচু অংশে কেমন সহসা সমান্তরাল এবং সামান্য বেশ বেখাপ্পা লাগে দেখতে। এটাও হতে পারে, জাহাজে একজন মেয়ে থাকবে ভাবতেই ভীষণ বিস্ময়। বরং ওর শরীরে একটু অন্য মেজাজ আছে, মেয়ে মেয়ে ভাব আছে এই পর্যন্ত। তবু একবার সংগোপনে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল, আচ্ছা দাদা, জ্যাককে তোমরা কি ভাবো! তারপর আর যা মনে হয় সে তো বার বার পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েও প্রথমদিকে বিশ্বাস করতে পারেনি জ্যাক মেয়ে। আজগুবি ভাবনা ভেবে সে বার বার জ্যাককে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। এবং যা হয়ে থাকে, জাহাজে উঠে কেমন সমকামিতায় পেয়ে বসে। সব পুরুষের শরীরে তখন মেয়ে মেয়ে গন্ধ—জ্যাক তো অসামান্য সুন্দরী, নীলাভ বড় চুল, ঢোলা কিছুটা বেল-বটসের মতো পোশাক, সহজেই মেয়ে ভাবতে ভাল লাগে। দুৰ্বলতা এভাবে উঁকি মারবে বেশি কি?

ছোট বলল, বিকেলে আমরা বন্দর পাচ্ছি দাদা।

—ক’দিন থেকেই তো শুনছি।

ছোটবাবু বলতে পারত, কম্পাস রিডিং-এ বেখাপ্পা ডিভিয়েশান। ভুতুড়ে জাহাজ, সমুদ্রে সবাইকে ঘুরিয়ে মারছে। কাপ্তান কিছুতেই সেটা স্বীকার করছে না। কেবল অফিসারদের ধমকের ওপর রাখছে। কেউ এদিক-ওদিক কথা বলতে সাহস পাচ্ছে না। ছোটবাবু বলল, ঠিক আমরা বন্দর,পেয়ে যাব।

এবং বিকেলে ওরা ঠিকই বন্দর পেয়ে গেল। দ্বীপ দেখে কেউ নিচে ছিল না। সবাই ওপরে উঠে এসেছে। সামোয়ার গেটওয়ে দেখা যাচ্ছে। নিউ-প্লিমাউথ থেকে জাহাজ চোদ্দ দিনের মাথায় বন্দর পাবে কথা ছিল। কিন্তু হিসাব করে দেখা গেল সোজা তিন হপ্তা লেগে গেছে। পাগো-পাগো শহরের ইট কাঠ দালান, পাহাড়ের ছায়া এবং গাছের জঙ্গল ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

ওরা ক্রমে, দেখতে পেল, এখানে বন্দর বলতে তেমন কিছু নেই। জাহাজ নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে থাকে। সামনে ছোট ছোট পাহাড়। তারপর ওরা দেখতে পেল, জাহাজ ক্রমে আরও এগিয়ে যাচ্ছে। থামছে না। রাত নেমে আসে। বন্দরে জাহাজ কেন যে নোঙর ফেলছে না।

আসলে জাহাজটা ওখানে নোঙর ফেলার কথা না। দ্বীপের পাশে পাশে জাহাজ চলছে। এতদিন জাহাজ সোজা উঠে এসেছে প্রায় পঁচানব্বই ডিগ্রীতে। এখন জাহাজ সোজা বাইশ ডিগ্রীতে ঘুরে যাচ্ছে। ওরা গেটওয়ে পার হয়ে ওয়েস্টার্ন সামোয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পরদিন দুপুরের দিকে এরা ঠিক ঠিক বন্দর পেয়ে গেল। বন্দর বলতে কিছু অবশ্য দেখা যাচ্ছে না। সারি সারি পাহাড় এবং দীর্ঘ বালিয়াড়ি ডান দিকে। সমুদ্রে মাছ ধরার নৌকা। অসংখ্য নারকেল গাছ আর সেই আনারসের খেত। তাহিতির মতো প্রায় হুবহু দেখতে দ্বীপটা। বোধ হয় সাউথ প্যাসিফিকের সব দ্বীপগুলোর গাছপালা অথবা তার ছোট ছোট পাহাড় এবং উপত্যকায় সব বর্ণময় ফুল ফুটে থাকা—একরকমের। ওরা দাঁড়িয়ে ছবির মতো দ্বীপ এবং দ্বীপবাসীদের দেখার চেষ্টা করছিল। ডেভিড তেমনি বাইনোকুলার নিয়ে বসে গেছে। সে আঁতি-পাতি করে খুঁজছে একটা মেয়ে। ছোটবাবু চলে যাচ্ছিল পাশ কাটিয়ে। সে আজ বলল না, এনি ওম্যান সেকেন্ড। সে কেমন নির্বিকার। ডেবিড মনে মনে হাসছে। জ্যাককে ভীষণ ভয় ছোটবাবুর।

তা যা হোক জ্যাক দাঁড়িয়েছিল চার্ট-রুমের দরজায়। এখন যতটা সম্ভব ডেবিড লুকিয়ে থাকতে চায়। জাহাজ বাঁধাছাদা হলে সে যেমন একা নেমে যায় অথবা সঙ্গে ছোটবাবু, ছোটবাবু থাকলে বেশ জমবে ভাল। সামোয়ান মেয়েরা বেঁটে হলে কি হবে, ভারি মজবুত। রং তামাটে, তা হোক—ওরা যখন গ্লাসে কাভা ঢেলে দেয় কি যে সুন্দর, এবং আশ্চর্য নেশা, গাছের মূল থেকে তৈরি মদ, কিছু লবস্টার বাদাম তেলে ভাজা, ভারী মনোরম খেতে। সে কিছুতেই জ্যাকের পাল্লায় পড়ে যাবে না। যেন শিশু নাবালকটিই আছে বোঝে না কিছু, জানে না কিছু। আমি নেই এর ভেতর। আমি বাপু পারব না, অন্য কাউকে দ্যাখো। সে যাতে জ্যাক দেখতে না পায়, দেখে ফেললেই বাবাকে আবদার করবে, আমি ডেবিডের সঙ্গে যাব। ভারি বয়ে গেছে, এমন একটা বেয়াদপ ছোকরাকে নিয়ে ঘুরতে। সে প্রায় বোটের নিচে কিছুটা হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে গেল। যেন কিছুতেই ওকে কেউ দেখতে না পায়।

তখন ছোটবাবু ডাকছিল, এলবা। তুমি কোথায়। সে পকেটে খাবার নিয়ে এলবাকে খুঁজছে। আশ্চর্য, পাখিটা দ্বীপের কাছাকাছি এসে আবার কোথায় হারিয়ে গেল। সে সকালেও দেখেছে জাহাজের পেছনে এলবা উড়ে আসছে। এখন কোথাও নেই। সে তাড়াতাড়ি বোট-ডেকে উঠে সোজা বাইনোকুলারটা ডেবিডের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিল। তারপর যতদূর চোখ যায় দেখছে, চারপাশে সে খুঁজছে—কোথায় এলবা! নেই। কেবল অসংখ্য ছোট ছোট পাখি, কবুতরের মতো, কখনও ওর দূরবীনের কাঁচে পড়ে ভীষণ বড় হয়ে যাচ্ছে, আবার খালি চোখে ভীষণ ছোট হয়ে যাচ্ছে। প্রায় সাদা পায়রার মতো সমুদ্রে ঝাঁকে ঝাঁকে বসে থাকছে আবার উড়ে যাচ্ছে। অতিকায় সোনালী ডানার পাখিটা কাছে কোথাও নেই। থাকলেও গভীর সমুদ্রে কোথাও বসে রয়েছে। ভেসে বেড়াচ্ছে, ডুব দিয়ে হয়তো নীল জলে ছোট ছোট মাছ ধরে খাচ্ছে। ডাঙার কাছাকাছি পাখিটা কিছুতেই কেন যে থাকতে চায় না!

আবার মনে হয়, হয়তো পাখিটা শেষ পর্যন্ত জাহাজ ছেড়ে চলে গেল। কিন্তু বার বার দেখেছে জাহাজ গভীর সমুদ্রে ঢুকে গেলেই এলবা পেছনে উড়তে থাকে। যেন কোথাও ওৎ পেতে বসে থাকে, কখন জাহাজ আবার সমুদ্রে ভেসে পড়বে। এই নিয়ে তিন তিন বার এলবা ডাঙা এলে নিখোঁজ হয়ে গেছে। ওর মনটা কেমন ভার হয়ে গেল। এবং একদিন সে সত্যি দেখবে পাখিটা আর জাহাজের পেছনে উড়ছে না। এ-সব মনে হলেই তার ভাল লাগে না। জ্যাক ওপরে দাঁড়িয়ে তখন ডাকল, হাই।

ছোটবাবু ওপরে তাকাতেই দেখল, ঠিক মাথার ওপরে জ্যাক। খুব হাসছে।

ছোটবাবু বলল, হাসছ কেন!

—আমরা বিচে যাচ্ছি।

—বিচে মানে?

—বারে, দেখতে পাচ্ছ না। কত সুন্দর বিচ্ সামনে।

—আমি যাচ্ছি মৈত্রদাকে নিয়ে।

—তুমি যাবে না আমাদের সঙ্গে?

—না। আমি মৈত্রদার সঙ্গে যাব। সে বলতে চাইল, তোমার খুশিমতো আমি কিছু করব না। সে একটু শক্ত হতে চাইল।

—বাবা নিয়ে যাবে।

ব্যাস মুখ চুন হয়ে গেল ছোটবাবুর। সে বলল, এই।

—কি!

—নিচে এস না।

—কি হয়েছে। বনি সোজা নিচে এসে বলল।

—আমি যেতে পারব না। একটু ম্যানেজ কর না।

—আচ্ছা বাবাকে বলব।

—আরে শোনো। তুমি বলবে না যেন আমার যেতে ভাল লাগছে না।

—বলব না।

—আরে শোনো, এত লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে যাচ্ছ কেন। আমাকে সবটা বলতে দাও।

—বল। সিঁড়িতে উঠতে উঠতে বনি থেমে গেল। এবং সেই নীলাভ সমুদ্রে তখন ছোট ছোট ঢেউ। দুরন্ত বালিকার মতো চঞ্চল।

—বড়-টিণ্ডালের শরীরটা ভাল না। আর সে হয়তো বলেই ফেলেছিল, ডাক্তারের কাছে আবার যেতে হবে। কিন্তু খুব বুদ্ধিমানের মতো বলল, বুঝতে পারছ তো বড়-টিণ্ডালের মাথাটা গেছে। আমাদের তো জাহাজে কেউ নেই। আমরাই আমাদের সব। বড়-টিণ্ডালকে নিয়ে একটু শহরটা ঘুরব।

বনি উঠে যাচ্ছিল। কিছু না বলেই সিঁড়ির শেষ ধাপে উঠে যাচ্ছে। ছোটবাবু সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে বেশ জোরে বলল, এই জ্যাক, তুমি কিছু বললে না!

—কি বলব!

—তিনি আবার রাগ করবেন না তো?

—সে আমি কি জানি!

—ধুস্। যত সব বাজে ব্যাপার। এই জ্যাক, তুমি নিচে এস বলছি।

জ্যাক আবার সুড়সুড় করে নেমে এল।–শোনো, তুমি সব পার। তুমি শোনো। এখানে এস, বসি বলেই বসতে যাবে যখন, দেখল, বোটের নিচে ডেবিড হামাগুড়ি দিচ্ছে। ডেবিড পালাতে চাইছে। ছোটবাবু অবাক, ডেবিড এ-ভাবে হামাগুড়ি দিচ্ছে কেন?—কি ব্যাপার! সে ডাকল, ডেবিড তুমি এখানে কি করছ!

ইশারায় কথা বলতে বারণ করে ডেবিড ও-পাশে লাফ দিয়ে নেমে গেল। বনি হেসে দিল।—ডেবিড ভেবেছে ওকে নিয়ে আমি শহর ঘুরতে যাব। তারপরই কেমন মুখ ভারী করে ফেলল জ্যাক। সে বলল, আসলে তোমরা কেউ আমাকে পছন্দ কর না ছোটবাবু। মাঝে মাঝে কি যে খারাপ কাজ করে ফেলি!

—আরে না না। তুমি যে কি না, তুমি আবার খারাপ কাজ কোথায় করতে গেলে!

—আমি খুব খারাপ মেয়ে। তুমি না বললেও এটা বুঝি। আমার রাতে কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না। কেবল সারারাত কি যে আজেবাজে স্বপ্ন দেখি।

ছোটবাবু বলল, স্বপ্ন দেখলে খারাপ হয় না। সবাই স্বপ্ন দেখে। আমিও দেখি। যে স্বপ্ন দেখে না সে মানুষ না।

বনি বলল, জানো, শহরটার খুব সুন্দর নাম—আপিয়া।

ছোটবাবু বলল, হাওয়াই থেকে অস্ট্রেলিয়ায় যাবার মাঝা মাঝি সমুদ্রে এমন একটা সুন্দর শহর আছে কে বলবে!

বনি বলল, আমার কতরকমের ইচ্ছে হয় ছোটবাবু।

ছোটবাবু বলল, সেটা সবারই হয়। আমার হয় না!

—তোমার মনে আছে ছোটবাবু তাহিতিতে দু’জোড়া ফিন্ কিনেছিলাম। দু’টো মাছ মারার বর্শা

—হ্যাঁ। সত্যি তো। ওগুলো কোথায়?

—আছে।

–দেশে গিয়ে সমুদ্রে বেশ মাছ ধরতে পারবে। কাজে লাগবে, নষ্ট হবে না।

বনি পারলে যেন এক্ষুনি দৌড়ে পালায়। এমন নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষ সে জীবনেও দেখেনি। বনি আর বলতে পারল না, ও দু’টো তোমাকে নিয়ে সমুদ্রে সাঁতার কাটব বলে কিনেছিলাম। সমুদ্রের নিচে মাছ ধরব বলে কিনেছিলাম। তুমি আমি। আর কেউ না। বনি তো বুঝতে পারছে না, ছোটবাবু কিছুতেই আর আশকারা দিতে চাইছে না। কারণ, ছোটবাবু শুধু একবার বলেছিল সে জেগে থাকে। কখন দরজায় বনি এসে না জানি বলবে, দরজা খোলো। তারপর থেকে যেন গভীর রাতে শুনতে পায়, বনি দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকছে। আর তারপরই বনি জাহাজে যা করল! কোনো ভয়ডর নেই। এত মরিয়া হয়ে উঠলে ভাল লাগে! ছোটবাবুর তো ভয় করারই কথা। সে তো আর কাপ্তানের ছেলে নয় যে যা খুশি করতে পারবে। অথচ কোনো দোষ হবে না। এবং সেই এক ভয় থেকে সে যেন আবার যতটা পারছে, দূরে থাকতে চাইছে। যদিও সে জানে, বনিকে নিয়ে, যে কোনো জায়গায় চলে যাবার মতো রোমাঞ্চ সে আর কিছুতে পাবে না। এবং সে চোখ বুজলেই টের পায় বনি পরেছে সোনালী জ্যাকেট, লম্বা স্যু, পাজামা আর মোটা বেল্ট কাউ-বয়দের মতো, সমুদ্রের পাড়ে পাড়ে ওরা দু’জনে কেবল ছুটছে।

খুব হতাশ গলায় বনি বলল, আমি যে খারাপ বাবাও বোধ হয় টের পেয়েছে।

সঙ্গে সঙ্গে ছোটবাবুর মুখ একেবারে ব্যাজার হয়ে গেল। তবে কি কাপ্তান টের পেয়েছেন, সেও ভাল ছেলে নয়। সে বনির সব দেখে ফেলেছে। ছোটবাবু বলল, আমার কথা কিছু বলেছেন?

বনি বুঝতে পারল ভীষণ স্বার্থপর ছোটবাবু। সে নিজেকে ছাড়া কিছু আর ভাবে না। তার বলতে ইচ্ছে হল, হ্যাঁ বলেছেন। তুমি এমন দামী সার্টিনের গাউন ফালা ফালা করে দিয়েছ, আমি বুঝি চুপ করে থাকব! বাবা সব জানে। বাবা তোমাকে গিলোটিনে দেবে বলেছে। তারপরই ওর আবার কি যে হয়ে যায় ভেতরে—সে ছোটবাবুকে নিয়ে কখনও এমন নিষ্ঠুরতার কথা ভাবতে পারে না। ছোটবাবু কিছুই বুঝতে পারে না। দুঃখে চোখ তার ভারী হয়ে আসছে। সে বলল, ছোটবাবু তুমি কবে মানুষ হবে!

—কেন কাপ্তান যে আমাকে বলেন, তুমি খুব বড় হবে। সারেঙ যে বলে, তুই আমার মান রেখেছিস! মানুষ হয়ে গেছিস। কিন্তু বনি কোনো সাড়া দিচ্ছে না। বনি কেমন সামান্য ঝুঁকে বসে রয়েছে! ওর মুখ দেখা যাচ্ছে না। ওর সুন্দর হাত, আর আঙ্গুলগুলো একেবারে কাছাকাছি মাখনের ছোট ছোট স্লাইস যেন। সজীব আর তাজা! গোলাপী আভা মুখে। ভেতরে ভেতরে ছোটবাবু এসব দেখলে মাঝে মাঝে একেবারেই স্থির থাকতে পারে না। বনি সামান্য আহত হলে ওর ভেতরটা কেমন কাঁপে। তখন নুয়ে বনির সব মুখটা না দেখতে পেলে সে কেমন অস্থির হয়ে পড়ে।

বনি তবু কোনো কথা বলল না। সে মুখ নিচু করে রেখেছে। এবং ওপরে চার্ট-রুমে কাপ্তান। চিফ- মেট দেখে গেল ওরা দু’জনে পাশাপাশি বসে আছে। এখন ছুটির সময়। জাহাজ বাঁধাছাদা হয়ে গেলে প্রায় সবারই ছুটি হয়ে যায়। এতদিন সমুদ্রে এক-নাগাড়ে থেকে থেকে ওরা এখন সবাই যে যার মতো নেমে যাবে বন্দরে। কেউ কোনো প্রশ্ন করবে না। কেবল ওরা দু’জন এখনও চুপচাপ বোট-ডেকে বসে আছে। কেউ কথা বলছে না।

ছোটবাবু বলল, বনি, কি হচ্ছে! কথা বলছ না কেন!

বনি মুখ তুলে তাকাল। চুলের ভেতরে বনির মুখ দেখা যাচ্ছে। চোখে তার আশ্চর্য মায়া। ছোটবাবু বলল, এই বনি, তিনি কি টের পেয়েছেন!

—জানি না।

—তবে তুমি আমাকে ভয় দেখাচ্ছো কেন?

—তোমাকে ভয় কোথায় দেখালাম!

—বারে, তুমি খারাপ হলে আমি খারাপ হয়ে যাব না। আমি তো কিছু করিনি। এবং ছোটবাবুর মুখ চোখ ভীষণ কাতর দেখাল।

বনি সামান্য হাসল। সে ছোটবাবুর দুঃখী মুখ একদম সহ্য করতে পারে না। সে যেন সাহস দিচ্ছে ছোটবাবুকে। শুধু বলল, বাবা টের পেয়েছে, আমি বড় হয়ে গেছি।

—বললেন বুঝি, তুমি বড় হয়ে গেছ!

–ডেবিডের সঙ্গে বেড়াতে বের হব বললাম। সঙ্গে তুমি থাকবে। তিনি রাজী হলেন না। বললেন, আমি যাব। আমার সঙ্গে তুমি চল। তারপর আমার মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। কি ভাবলেন। বললেন, ছোটবাবুকে বল সে আমাদের সঙ্গে যাবে।

ছোটবাবু বলল, তাহলে আমি যাব বনি। মৈত্রদার একটা ব্যবস্থা করে আসছি। বংকুকে বলে আসি, সে সঙ্গে থাকবে। বেশী দেরি হবে না। তুমি আমাকে ফেলে কিন্তু চলে যাবে না। সে পিছিলের দিকে ছুটে যেতে থাকল।

এবং তারপর যা হয়ে থাকে, সবার মতো স্যালি হিগিনস, বনি, ছোটবাবু জাহাজ থেকে নেমে গেল। জাহাজ বয়াতে বাঁধা। ওরা মোটর-বোটে নেমে গেল। তখন আপিয়া শহরে বিকেলের রোদ। তখন নারকেল গাছে সমুদ্রের বাতাস, সামোয়ান নরনারীদের বিচিত্র পোশাক রোদে ঝিকমিক করছে। ওরা শহরে ঢুকে গেল। গাড়ি ওদের ঠিক করা ছিল। দু’পাশে সব পাহাড়ের ছায়া। সবুজ আভা গাছের জঙ্গল চারপাশে। সুন্দর সুন্দর সব পাহাড়ী ঘর-বাড়ি ছোট ছোট উপত্যকাতে। পেছনে বনি আর ছোটবাবু সামনে কাপ্তান স্যালি হিগিনস। ওরা বিচ্ ধরে কেউ হেঁটে গেল না। ওরা শহরের ভেতর ক্রমে ঢুকে যেতে লাগল।

আর সব গল্প। যেতে যেতে স্যালি হিগিনস এই দ্বীপের সব প্রাচীন গল্প-গাথা এক এক করে বলে যেতে থাকলেন। কবে প্রথম সাতসমুদ্র পার হয়ে মিশনারিরা চলে এসেছিল। কবে এসেছিলেন রবার্ট লয়াস স্টিভেনশান। মার্গারেট মিড এবং সমরসেট মম সুযোগ পেলেই এখানে এসে কিছুদিন কাটিয়ে যান। যখনই তাঁদের কিছু ভাল লাগে না, এমন একটা বন্য পৃথিবীতে তাঁদের চলে আসতে ইচ্ছে হয়। কি সব গাছপালা আর সবুজ পাহাড় দ্বীপে, কখনও চারপাশে থাকে শুধু রকমারি পাথর। সামোয়ান বন্য মেয়েদের গলায় থাকে ফুলের হার। এরা ফুলের অলংকার পরতে ভীষণ ভালবাসে। এদের দীর্ঘদিনের বন্যজীবন যাপনে রয়েছে অদ্ভুত এক শান্তিপ্রিয় স্বভাব। এখনও নগর-সভ্যতা এদের জীবন নষ্ট করে দিতে পারেনি। চারপাশে নীল সমুদ্র, দূরে পাগো-পাগো দ্বীপের ভালবাসা আর রয়েছে অসংখ্য প্রবাদ এই দ্বীপ সম্পর্কে। আর এই সব বনাঞ্চলে আছে সবুজ এক গন্ধ। একবার এই সব গভীর বনে ঢুকে গেলে ফিরে যেতে ইচ্ছে হয় না। ভেতরে রয়েছে অরণ্য মানুষের বসবাস। তাদের ভালবাসায় পড়ে গেলে মানুষের আর রক্ষে থাকে না।

তিনি কখনও একজন ভূতাত্ত্বিকের মতো কথা বলতে ভালবাসছেন। কখনও তিনি এদের জনসংখ্যা সম্পর্কে হুবহু বর্ণনা দিচ্ছেন। এই আটশ বর্গমাইলব্যাপী ভূখণ্ডে রয়েছে অজস্র ফসফেট। অস্ট্রেলিয়ার বড় বড় বন্দরগুলোতে ফসফেট নিয়ে যাওয়া হয়। আমাদের মতো এমনি অনেক জাহাজ শুধু সারা মাসকাল ফসফেট নিয়ে যায়। দু’লক্ষ লোকের বোধহয় এতেই চলে যায়। খুব কম এদের চাহিদা। আর যখন আছে চারপাশে এত বড় সমুদ্র তখন জীবনধারণের মতো সব কিছু তারা সহজেই পেয়ে যায়।

তিনি বলে যাচ্ছিলেন, এখানে ডিসেম্বর আর এপ্রিল পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের সময়। তোমাদের ভাগ্য ভাল, আকাশ এত পরিষ্কার। এখন তো শুধু ঝড় আর বৃষ্টিপাতের সময়। আমেরিকান সামোয়া আমরা পেছনে ফেলে এসেছি। ওটার চেয়ে আমার এ-দ্বীপটা বেশী ভাল লাগে। সব গাছপালা দেখে আমার তো এখানেই থেকে যেতে ইচ্ছে করছে। তোমাদের ইচ্ছে করছে না?

ছোট বলল, আমার খুব ইচ্ছে করছে।

—জ্যাক তোমার?

—আমার! সে কি বলবে ঠিক বুঝতে পারছে না। আমারও ইচ্ছে করে—কিন্তু বললেই যেন ধরে ফেলবেন, ছোটবাবুর জন্য তার ভীষণ টান। সে বলল, আমার ইচ্ছে করে না।

ওদের গাড়ি তখন সমুদ্রের ধারে ধারে যাচ্ছিল। জ্যাক বুঝতে পারছে না বাবা তাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন। ছোটবাবুকে দেখলে মনে হয়, জীবনে ও যেন গাড়িতে চড়ার সুযোগ পায়নি। সে গাড়িতে উঠে বেড়াতে পারলেই খুশী।

তবে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সে জানতে চায় না। পাশে সমুদ্র, সমুদ্রের ধারে ধারে গাড়ি বাঁক নিচ্ছে বার বার। আর ছোটবাবু বাচ্চা ছেলের মতো ভয় পাচ্ছে। বনি ওটা বুঝতে পেরে বলল, বাবা, ছাটবাবুকে এস আমরা এখানে নামিয়ে দি।

স্যালি হিগিনস বুঝতে পারছেন, বনি ছোটবাবুকে নিয়ে মজা করছে। ছোটবাবু হয়তো এক্ষুনি বলে উঠবে, না স্যার, আমাকে নামিয়ে দেবেন না। নামিয়ে দিলে আমি জাহাজে ফিরতে পারব না। আর বোধ হয় এ-জন্যেই ছোটবাবুকে তাঁর ভীষণ ভাল লাগে।

স্যালি হিগিনস বললেন, আমরা যাচ্ছি উপুলুতে। এখন মাদা-পাসের ভেতর ঢুকে যাব। দু’পাশে তখন দেখতে পাবে আশ্চর্য সব প্রস্রবণ। স্রোতস্বিনী নদীর মতো পাহাড় থেকে গড়িয়ে নামছে। আর দু’পাশে দেখবে কত সব বিচিত্র রকমের ফুল। যেন সারাটা পাহাড় ফুলের সমারোহে ডুবে আছে। আশ্চর্য ঘ্রাণ ফুলের। চারপাশটা ফুলের সৌরভে ম’ ম’ করছে।

ওরা ক্রমে এভাবে পাহাড়ের চড়াই-এ উঠে যাচ্ছিল। অনেক নিচে সমুদ্র। কিছুক্ষণ বাদে জ্যোৎস্না ওঠার কথা। এজেন্ট-অফিসের গাড়ি, বিশ্বস্ত ড্রাইভার—আর অতিকায় গাড়ির বনেটে মাঝে মাঝে দু’টো একটা ফুলের পাপড়ি উড়ে এসে পড়ছে অথবা প্রজাপতির মতো অসংখ্য ফুলের পাপড়ি বাতাসে ভেসে যাচ্ছে। ছোটাবাবু এসব দেখতে দেখতে তন্ময় হয়ে যাচ্ছিল। সে যে একজন সামান্য বাঙালী, সে যে ক্লাস টেনে ওঠার আগে রেলগাড়ি দেখেনি, এবং যে-বার দেশ ছেড়ে চলে আসে তখন গোয়ালন্দ- মেলে মুরগীর মাংসের গন্ধ এবং মাঝে মাঝে পদ্মানদীর অতিকায় ঢেউ দেখে সে যে ভয়ে জ্যাঠামশাইকে জড়িয়ে ধরেছিল এখন তাকে দেখে কিছুতেই আর তা বিশ্বাস করা যায় না। সে পরেছে হাল্কা চকলেট কালারের স্যুট। কালো বো। চকচকে জুতো, বুটিদার মোজা, সাদা ফুল-শার্ট। বনির বার বার ওকে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল। ছোটবাবুর শরীর থেকে আবার সেই চন্দনের গন্ধ উঠছে। নরম নীল রঙের দাড়িতে হাত রাখলে বনি বুঝি গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়বে।

বাবা পাইপ টানছেন। মাঝে মাঝে ছাই ছাইদানিতে ঝেড়ে ফেলছেন। দু’একজন সামোয়ান নারীপুরুষ রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। গাড়িটা এত বেশি জোরে ছুটছে যে সব ক্রমে অস্পষ্ট হয়ে উঠছে। আর সেই ড্যাং ড্যাং বাজনার মতো। স্যালি হিগিনস তাঁর স্ত্রী, তাঁর জাহাজ, সমুদ্রের ঝড় সব এভাবে ভুলে যেতে চাইছেন।

—বুঝতে পারলে ছোটবাবু, উপুলুতেই রবার্ট লয়াস স্টিভেনশান বাড়ি বানিয়েছিলেন। তাঁর দেশে ফিরে যেতে আর ইচ্ছে হয়নি। মাউণ্ট ভিয়াতে তাঁর সমাধি আছে।

ছোটবাবুর একবারও জানতে ইচ্ছে করছিল না কে এই স্টিভেনশান! সেতো সমরসেট মমের ‘অফ হিউমান বণ্ডেজ’ পড়েছে। এসব বই এখন জ্যাক ওকে সংগ্রহ করে দেয়। কখনও ডেবিড। তার চেয়ে চারপাশের দৃশ্যাবলী বেশী ভাল লাগছিল। পাশে জ্যাক। মাঝে মাঝে জ্যাক ওকে চুরি করে দেখছে। তখন কে স্টিভেনশন, কে মার্গারেট মিড, অথবা মাউণ্ট ভিয়াতে কার সমাধি আছে কিছু অসে যায় না। সে শরীর এলিয়ে দিয়েছে। ওর মাথার চুল উদাসীনভাবে বাতাসে ভাসছে। দ্বীপটা একজন লেখকের পক্ষে ভারী মনোরম জায়গা। তার মনে হল পৃথিবীতে শুধু লেখকদের সে হিংসে করতে পারে। সে তার এই সমুদ্রযাত্রায় যেসব বর্ণমালা দেখতে পেল কখনও তার হুবুহ বর্ণনা মানুষের কাছে যদি পৌঁছে দিতে পারত।

তখন স্যালি হিগিনস বললেন, ঐ যে দেখছ, সমুদ্রে আর একটা দ্বীপ ভেসে আছে, মনে হয় আলাদা দ্বীপ, আসলে ওটা আলাদা নয় একেবারে। ছোট্ট সরু, এই ফুট পাঁচেকের মতো একটা প্রবালের রাস্তা আছে। তারপরই ছোট্ট দ্বীপে আমরা বসে কফি খাব। ইচ্ছে করলে সমুদ্রের জলে তখন তোমরা প্রচুর স্যামন মাছ দেখতে পারো। দ্বীপের চারপাশে এখন দলে দলে স্যামন মাছ ডিম পাড়তে আসবে। সমুদ্রের অতলে রুপোলী মাছের ঝাঁক দেখার জন্য বহু লোক এখানে চলে আসে। কখনও শোনা যায় এক বাজনা। পাথরের ফাঁকে নিচে দেখা যায় শুধু নীল জল। মাছগুলো সমুদ্রে যখন লেজ নেড়ে চলে যায়, বুঝলে আমার মনে হয়, ওখানে সব স্ফটিক স্তম্ভ আছে কোথাও, যার চারপাশে ঘুরে বেড়ালে মনে হয় আশ্চর্য অর্কেস্ট্রা সমুদ্রের নিচে কেউ অবিরাম বাজাচ্ছে।

ছোটবাবু আর বনি দ্বীপে সেই জায়গাটা খুঁজে বেড়াল। স্যালি হিগিনস ওদের সঙ্গে হেঁটে পারছেন না। চারপাশে মনোহারিনী জ্যোৎস্না। আর শুধু পাথর। একটা গাছ নেই। পাথরের ফাঁকে ফাঁকে নীল জল উজ্জ্বল আরশির মতো। একটা জায়গায় এসে ওরা থমকে দাঁড়াল। সমুদ্রের অতলে সুন্দর সব শব্দতরঙ্গ। ওরা কান পেতে শুনল, সত্যি সমুদ্রের অতলে কারা যেন কখনও উঁচু লয়ে, কখনও ধীরে ধীরে অর্কেস্ট্রা বাজিয়ে যাচ্ছে। আশ্চর্য এক মিউজিক!

ওরা তিনজন কতক্ষণ এভাবে সেই শব্দতরঙ্গের ধ্বনিতে অভিভূত ছিল, কতক্ষণ ওরা তিনজন সেই দ্বীপে চুপচাপ মাথায় হাত রেখে পাহাড়ে শুয়ে থেকেছিল মনে নেই—কেবল মনে আছে, হঠাৎ ড্রাইভার চিৎকার করে ওদের তিনজনকেই সচকিত করে দিয়েছিল, স্যার আপনারা দেরী করবেন না। সমুদ্রে জোয়ার আসার সময় হয়ে গেছে। এবার চলে আসুন। জোয়ার এলে সমুদ্রের নিচে দ্বীপটা ডুবে যাবে।

তারপর স্যালি হিগিনস প্রায় পাগলের মতো বনি আর ছোটবাবুকে নিয়ে দৌড়েছিলেন। গাড়িতে উঠে বসেছিলেন। এবং জাহাজে ফিরে এসে শুনলেন বড়-টিণ্ডাল নিখোঁজ। বড় টিণ্ডালকে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই ফিরে এসেছে কেবল সে আসেনি। জাহাজে তখন ভীষণ গোলমাল শুরু হয়ে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *