1 of 2

অলৌকিক জলযান – ৩৯

।। উনচল্লিশ।।

এবং এভাবে একজন মানুষ স্মৃতি-বিস্মৃতির জটিলতায় তলিয়ে যাচ্ছিলেন। যতই অবিশ্বাস করতে চান সবকিছু তত যেন তাঁকে পেয়ে বসে, তত তিনি রহস্যজনক কথাবার্তা শুনতে পান।—তুমি কতটুকু জানো! তুমি যা জানো তার কতটা তুমি বিশ্বাস কর। যা তুমি জান না, যা তুমি বুঝতে পার না তাকে তুমি অবিশ্বাস করবে কি করে! আবার মনে হয় কেউ হাসছে। ওঁর নির্বোধের মত চোখমুখ দেখলেই কেউ হাসছে। যখন ভেবে কুলকিনারা পান না, কেবল হাতড়ে বেড়ান তখন যদি ওঁর বোকামি দেখে কেউ হেসে ফেলে তিনি কি করতে পারেন! মাঝে মাঝে সেই হাসি একেবারে পাগল করে দেবার মতো—নো, নো, তোমাদের হাসি শুনতে পাচ্ছি না আমি!

মনে আছে তাঁর, তিনি তখন সিউল-ব্যাংকের পুরোপুরি কাপ্তান। তিনি কাপ্তান স্যালি হিগিনস। ভীষণ জাঁকজমক করে জাহাজ কার্ডিফ বন্দর থেকে ছাড়ছে। এমন একটা জাহাজের ভার স্যালি হিগিনসের ওপর। বহু হাতবদলের পর যখন জাহাজ খুব সস্তায় পাওয়া গেছে তখন আর ভাবনা কি! এবং স্যালি হিগিনস আর তাঁর স্ত্রী এলিস জাহাজে। যারা বিদায় জানাতে এসেছিল বন্দরে, ইয়েস মনে পড়ছে, রিচার্ড ফ্যালের বাবা ম্যাথিউ ফ্যাল নিজে এসেছিলেন জাহাজঘাটায়। জাহাজ সওদা নিয়ে জাভা সুমাত্রা যাচ্ছে। তিনি হ্যাণ্ড-শেক করার সময় বলেছিলেন—উইশ্ য়োর গুডলাক। তোমার সমুদ্রযাত্রা শুভ হোক।

আসলে স্যালি হিগিনস জানতেন একটা গণ্ডগোলে জাহাজ তাঁকে দেওয়া হয়েছে। জাহাজটা কেউ রাখতে পারেনি। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই হাতবদল হয়ে যাচ্ছে! এমন একটা জাহাজ এবং একবার জাহাজটাকে তিনি ঠিক ঠিক পৌঁছে দিয়ে যখন প্রমাণ করেছেন, তিনি পারেন আর যার ফলে কোম্পানির কর্তাব্যক্তি খুশি হয়ে একেবারে সোজাসুজি তাঁকে জাহাজের ভার দিয়ে ফেললেন, তখন মনে হয়েছিল, নিজের এই সুনাম তিনি কিছুতেই ক্ষুণ্ণ হতে দেবেন না। জীবনে তা ক্ষুণ্ণ হতে দেননি। শেষ সফরেও তিনি সোজা থাকতে চাইছেন। তখনই মনে হল আবার সেই হাসি। ঠিক হাসি কিনা বোঝা যায় না, কখনও মনে হয় দীর্ঘশ্বাসের মতো। জাহাজের সাউণ্ডিং পাইপ নিচে বিজে নেমে গেছে। জল সরে যাবার শব্দ, কিন্তু অন্ধকারে কেন যে মনে হয় ঠিক পেছনে ঘাড়ের ওপর কেউ নিঃশ্বাস ফেলছে। তিনি তখন চেঁচিয়ে বলতে চান, কে! কে! আর তখনই মনে পড়ে তিনি স্যালি হিগিনস, কাপ্তান, এস. এস. সিউল-ব্যাংক। তিনি ফের চেয়ারটাতে ফিরে আসেন। রাত দুপুরে এই অন্ধকার সমুদ্র ক্রমশ রহস্যময়ী হয়ে উঠছে। সার্চ-লাইট তেমনি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ফেলা হচ্ছে। বোটের পাত্তা নেই। জলে হিস্ হিস্ শব্দ। এসব কারণে সব আজগুবি শব্দ, কখনও হাসির মতো কখনও দীর্ঘশ্বাসের মতো কানে এসে বাজছে।

তারপরই কেমন থমকে যান। বিচলিত বোধ করেন। হাত-পা কাঁপতে থাকে। সত্যাসত্য নির্ণয় করতে গেলে সব কেমন অবিশ্বাস্য ঠেকে। মনে হয় সব ভুল। আসলে সেই যে একটা ভীতি ছিল জাহাজ সম্পর্কে, কিছু একটা আছে জাহাজটার ভেতর, জাহাজটাকে কিছু ভর করে থাকে—কোনো অদৃশ্য আত্মা, এমন সব কত ঘটনা জাহাজ সম্পর্কে লুকেনার সম্পর্কে কানে এসেছে এবং লুকেনার তো মানুষ ছিলেন না। বেঁচে থাকতেই লোকটা ছিল সী-ডেভিল। দুরন্ত, দুর্বিনীত ধূর্ত প্রতিপক্ষের অজস্র যুদ্ধ জাহাজের মোকাবেলা করেছেন তিনি। এমন সব গল্প শুনে শুনে মনের কোথাও এক আশ্চর্য দুর্বলতা প্রশ্রয় পেয়েছে মনে হয়। এবং এমন মনে হলেই তিনি গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে চান, কিন্তু…….।

জাহাজে এলিস উঠে এসেছিল। নতুন ক্যাপ্টেনের নতুন বৌ। বয়সের ফারাক যাই হোক না কেন। বরং সেদিনও বোধ হয় ছিল এমনি অন্ধকার রাত্রি। জাহাজ ইকুয়েডরের দিকে উঠে যাচ্ছিল। তিনি কেবিনে এলিসকে বুকে জড়িয়ে চুমো খাচ্ছিলেন। আর তখুনি মনে হল পোর্ট-হোলে কেউ দাঁড়িয়ে আছে, কেউ হাসছে। পেছন ফিরে দেখলেন—কিছু নেই। সমুদ্রের সামান্য জলোচ্ছ্বাসে এমন শব্দ কখনও হাসির মতো অথবা বাতাসেরা যখন জলের ওপর দিয়ে ভেসে ভেসে যায় তখন তার হিস্ হিস্ শব্দ ক্ৰমান্বয় ভেসে গেলে সবই মনের ভুল ভেবে পোর্ট-হোলের কাঁচ বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

জাহাজ সিঙ্গাপুর থেকে ছেড়ে বেশ ক’দিন ভালই যাচ্ছিল। ঠিক জাভা অথবা সুমাত্রার কাছাকাছি জায়গায়, সমুদ্রে তখন ভীষণ সাদা জ্যোৎস্না, সারা আকাশময় কি আশ্চর্য সুগন্ধময় বাতাসের খেলা। চার্ট-রুমে তিনি বসে আছেন। ওসনোগ্রাফী সম্পর্কে সামান্য পড়াশোনা করছিলেন। রাত যে অনেক হয়ে গেছে একেবারে টের পাননি। এলিস কি না ভাবছে! এলিস বেশি রাত জেগে থাকতে পারে না। একটু রাত হলেই ঘুমিয়ে পড়ার স্বভাব। এলিস এত রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে পারে না। হয়তো অভিমানে এলিসের মুখ থমথম করছে। এমন কি যে একবার ওকে ডেকে মনে করিয়ে দেবে, কত রাত আর বসে থাকব, তুমি আসছ না কেন, এসবও ওকে জানায়নি। তিনি সেজন্য মনে মনে ভীষণ দুঃখিত। ভেবেছিলেন সোজা কেবিনে ঢুকে ওকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেলে সব অভিমান নিমেষে ভেঙে যাবে। কিন্তু বাইরে বের হয়ে দেখেছিলেন, এলিস নিচে দাঁড়িয়ে আছে। বোট-ডেকে বোটের মাঝখানে এলিস। পাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে যেন। মাথায় তার জাহাজি টুপি, শরীরে জাহাজি পোশাক। মানুষটার মুখ তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। এবং মনে হয়েছিল জাহাজের কোনো যুবক অফিসার ওর পাশে দাঁড়িয়ে গল্প-গুজব করছে। এত রাতে এভাবে গল্প-গুজব এলিসকে যেন মানায় না। একজন ক্যাপ্টেনের স্ত্রীর পক্ষে এটা ঠিক না। এলিসের এটা বোঝা উচিত।

সেদিন আরও রাত করে নিচে নামলেন। একেবারে থার্ড-অফিসারের সব কাজকর্ম দেখে সইসাবুদ শেষে নিচে যখন নেমে এসেছিলেন তখন রাত বারোটার ঘণ্টা পড়ছে।

কিন্তু অবাক এত রাত পর্যন্ত এলিস জেগে আছে! ওর শরীরে রাতের পোশাক। শরীরে দামী আতরের গন্ধ। ওর শরীরে পাতলা সিল্কের সোনালী গাউন। এত স্পষ্ট সব যে তিনি একমুহূর্ত অপেক্ষা করতে পারেন নি। এলিসকে বুকে জড়িয়ে বলেছিলেন, বোট-ডেকে কার সঙ্গে গল্প করছিলে!

এলিস ভীষণ বিস্মিত। সে চোখ বড় বড় করে বলেছিল, কার সঙ্গে গল্প করব!

—দু’ নম্বর বোটের পাশে দাঁড়িয়েছিলে?

—তা ছিলাম তো। তুমি আসছ না।

—কেউ পাশে ছিল?

—কি বলছ যা তা!

—তোমার পাশে কেউ ছিল, তুমি আমাকে বলছ না!

—মাই গড়

স্যালি হিগিনস বুঝতে পারলেন এলিস কিছু গোপন করতে চাইছে। তিনি বললেন—ঠিক আছে। এলিস কেমন সরে দাঁড়াল। হিগিনসের চোখে মুখে ভীষণ নিষ্ঠুরতা।

হিগিনস বললেন—ঠিক আছে। এস। বলে তিনি প্রায় জোর করে বিছানায় টেনে ফেলে দিলেন। চোখে মুখে অতিশয় সংশয়। তিনি ছটফট করছিলেন। তাঁর সঙ্গে এলিসের বয়সের তফাত অনেক। এবং এসব সময়ে যা হয়ে থাকে কেমন অমানুষের মতো এলিসকে উল্টে-পাল্টে নিচ্ছিলেন, বয়স হয়ে গেছে বলে কোনো তরুণ যুবকের চেয়ে তিনি কম নন। কারণ তিনি বস্তুত তাঁর সব শরীরের নৃশংসতা এলিসের সুন্দর শরীরে ছড়িয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, তুমি এলিস নষ্ট হয়ে গেলে আমিও নষ্ট হয়ে যেতে পারি। বস্তুত এলিসকে সেদিন তিনি রেপ্ করেছিলেন।

এবং সেই থেকে ছিল জাহাজে লুকোচুরি খেলা। কখনও বোট-ডেকে কখনও আরও দূরে, তিনি আর রাতে কখনও দেখতে পেলেন না একা এলিস কোথাও দাঁড়িয়ে আছে। রাতে তিনি যতবার এলিসকে নির্জনে কোথাও দেখেছেন, এলিস একা থাকছে না। ওর পাশাপাশি একজন জাহাজি মানুষ পুরো ইউনিফরম পরে দাঁড়িয়ে আছে।

তিনি তাঁর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে এত সচেতন যে তাঁর স্ত্রী সংগোপনে কিছু করছে এটা প্রমাণ করার জন্য কাউকে ডেকে কোনো সংশয়ের কথা বলতে পারেন নি। কেবল নিজে একা একা জ্বলে পুড়ে খাঁক হয়েছেন। এলিসকে বললে কখনও স্বীকার করত না। একদিন তো হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেছিল এলিস। আমাকে তুমি দেশে পাঠিয়ে দাও প্লিজ। এবং তাই হয়তো করতেন। কিন্তু জাহাজি মানুষের জীবন কখনও সুখের হয় না, এটা তিনি জানেন। জেনেও যখন কিছু করতে পারছেন না, সব ঠিকঠাক, পরবর্তী বন্দরে এলিস নেমে যাচ্ছে, নেমে যাবার আগে জাহাজ কি যে ঝড়ের মুখে পড়ে গেল! সেই প্রচণ্ড টাইফুনের ভেতর জাহাজ যখন হাবুডুবু খাচ্ছে, যখন তিনি চার্ট-রুমে ব্যস্ত এবং বিস্তারিত খবর পাঠাচ্ছেন এরিয়া- স্টেশনকে মিনিটে মিনিটে, রেডিও-অফিসার নেমে এসে খবর দিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের ঢেউ কতটা উচ্চতা রেখে এগিয়ে আসছে আর সমুদ্রে ভয়ংকর সাদা ফেনা কেবল আর কিছু দেখা যাচ্ছে না, কেবল তুষারপাতের মতো আকাশে জলকণা উড়ে বেড়াচ্ছে, সাঁ সাঁ হাওয়ায় বোট-ডেক ধরে হাঁটা যাচ্ছে না, তখনই মনে হল নিচে এলিস দ্রুত নেমে যাচ্ছে। এবং এলিসকে অনুসরণ করার জন্য তিনিও এগিয়ে যাচ্ছেন—তারপর এলিস কেমন সন্তর্পণে সেই এলি-ওয়ে ধরে টলতে টলতে এগিয়ে যাচ্ছে—শেষে বোট-ডেকে ফের উঠে আসতে চাইলে আবার মনে হল সেই জাহাজি মানুষ যার মুখ কখনও তিনি দেখেননি, পেছন ফিরে যে কেবল দাঁড়িয়ে থাকে, উঁচু লম্বা প্রায় দেখতে জাহাজের থার্ড-অফিসারের মতো সে অনুসরণ করছে এলিসকে। কিন্তু তিনি নেমে কিছু দেখতে পেলেন না। একটা প্রচণ্ড ঢেউ জাহাজটাকে ভীষণ কাত করে দিল। আর মনে হল রেলিং ধরে কেউ পালাচ্ছে। তিনি কিছুতেই নিজেকে স্থির রাখতে পারলেন না। কেমন সব গোলমাল হয়ে গেল। যেন অদৃশ্য এক অশুভ প্রভাবে দরজার মুখে তিনি এলিসকে মাথায় মেরে ফেলে দিলেন। হাতে ছোট্ট একটা হাতুড়ি। আর তখন সেই অট্টহাসি সমুদ্রের ঢেউগুলো পার হয়ে নক্ষত্রের দিকে ছুটে যাচ্ছে। কেউ যেন জয়লাভ করে লাফাতে লাফাতে সমুদ্র পার হয়ে চলে গেল।

প্রচণ্ড জলোচ্ছ্বাসের ভেতর জাহাজটা থরথর করে কাঁপছিল। তিনি সেই ঝড়ের রাতে সহসা আর্তনাদ করে ওঠার মতো ছুটে গিয়েছিলেন বোটের পাশে। হয়তো পা ফসকে পড়েই যেতেন। অথবা তাঁকে জলোচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে নিত। তিনি জানতেনও না তখন প্রচণ্ড রোষে আবার সেই অশুভ প্রভাব এগিয়ে আসছে, তিনি হাঁফাচ্ছিলেন, অন্ধকারে কে আপনি! এভাবে কোথায় দাঁড়িয়ে হাসছেন! এবং বোটের নিচে পড়ে আছে এলিস। কেউ ব্রীজ থেকে নেমে আসতে পারে, বয়লার-রুম থেকে কেউ উঠে আসতে পারে—কিছুই তাঁর মনে ছিল না। প্রচণ্ড জলোচ্ছ্বাস বোট-ডেক ভাসিয়ে নিয়ে গেল। যেহেতু স্যালি হিগিনস অভিজ্ঞ এবং তিনি জানেন তখন কি করণীয়, লাফ দিয়ে পাশের একটা রড ধরে ফেললেন দু’হাতে। ভেসে থাকলেন জলে। জল নেমে গেলে তিনি সোজা ছুটে গেলেন দরজার পাশে। দেখলেন এলিস নেই। এলিসকে সমুদ্রের ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এলিসের কোনো চিহ্ন নেই। তাঁর পোশাক ভিজে গেছে। কেমন শীতে কাঁপছিলেন। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা চারপাশে মনে হচ্ছিল। শীতে যেন হাত-পা স্থবির হয়ে আসছে। নড়তে পারছিলেন না। কাঁপতে কাঁপতে কোনোরকমে ব্রীজে উঠে যেতে চাইছেন। আর কি আশ্চর্য, বার বার সিঁড়ি থেকে তিনি গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছেন। পা স্লিপ করে যাচ্ছে। কে যেন তাঁকে ব্রীজে কিছুতেই উঠতে দিচ্ছে না। এতটুকু শক্তি নেই শরীরে। তিনি সিঁড়ির গোড়ায় যতক্ষণ পারলেন ঝুলে থাকলেন। তারপর কি হয়েছিল মনে নেই। আর তিনি মনে করতেও চান না। কিন্তু কি যে হয়, বোট হারিয়ে যাবার পর পুরোনো সব স্মৃতি তাঁকে আরও বেশি যেন কাবু করে ফেলছে। তিনি তেমনি বসে আছেন। থার্ড-মেট ওপরে উঠে এসেছে এবং যেহেতু জাহাজ স্ট্যাণ্ড-বাই, সবাই মাঝে মাঝে ওপরে উঠে দেখছে, বোট ফিরে আসছে কিনা। তখন থার্ড-মেট না বলে পারল না, স্যার আপনি এবারে যান। আমরা আছি।

স্যালি হিগিনস ঘড়ি দেখলেন চারটা বেজে গেছে। তিনি কেবিনে গিয়ে শুয়ে পড়তে পারেন। কিন্তু জানেন কিছুতেই দু’চোখ এক করতে পারবেন না। এতটা বিচলিত কেন বুঝতে পারছেন না। আসলে কি তিনি সেই অপোগণ্ডটার কথা ভেবে ভীষণ বিচলতি হয়ে পড়ছেন! তিনি কি এই অপোগণ্ডের জন্য ভেতরে ভেতরে নিজেও এক ভীষণ মায়ায় জড়িয়ে পড়েছেন!

তিনি তখন ভেবে পান না, ছোটবাবু কেন কখনও প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে যায় তাঁর! আবার কখনও মনে হয়, ছোটবাবুর শান্তশিষ্ট মুখে চোখে এক অদ্ভুত সারল্য—ছেলেটাকে কোথাও ফেলে গেলে তিনি যেন বাকি জীবন শান্তি পাবেন না। বোটে অন্য যারা আছে তাদের কথা একবারও ভাবতে পারছেন না কেন? ভীষণ স্বার্তপর মনে হলে তিনি উঠে দাঁড়লেন। বলতে চাইলেন, তুমি কে হে? তোমার জন্য আমার এত ভাবনা! তারপরই বুঝি মনে হয়ে যায় মেয়েটা তাঁর নিচে বসে রয়েছে। সেও ঘুমোচ্ছে না। আসলে বনির কথা ভেবে বোধ হয় এমন মনে হচ্ছে তাঁর। তিনি প্রায় জোর করে উঠে পড়লেন। এবং কেবিনে ঢুকে দেখলেন বনি পোর্ট-হোলে মুখ রেখে ভোরের সমুদ্র দেখছে। তিনি বললেন, বনি এস আমরা দু’কাপ কফি খাই। তিনি মেয়েকে একটু অন্যমনস্ক করার জন্য বললেন, এখানেই মুখ ধুয়ে নাও। তারপর বেল টিপে ডাকলেন, কোয়ার্টার-মাস্টার। কোয়ার্টার মাস্টার এলে কফির কথা বলে দিলেন।

.

তখন নীল জলে শুধু একটা সাদা বোট আর তার পাঁচজন আরোহী। ওদের মুখে কোনো কথা নেই। সবাই অবাক, দেখছে সিউল-ব্যাংক জাহাজটা সামনে কোথাও নেই। চারপাশে কেবল শুধু জল আর জল। দিগন্তব্যাপী শুধু সমুদ্র আপন মহিমায় জেগে রয়েছে। দু’টো একটা মাছ, কখনও ছোট ছোট মাছের ঝাঁক বোটের পেছনে ভেসে ভেসে আসছে। আর কখনও অতিকায় সব হাঙ্গরের ঝাঁক পাইলট-ফিশদের তাড়া করছে। আবার কখনও দেখছে ছোট ছোট সব র‍্যামোরা মাছ বোটে এসে শামুকের মতো লেগে রয়েছে। ওরা কেউ, কোনো একটা র‍্যামোরা মাছ তুলে আনছে। জলে হাত দিলেই মাছগুলো ঝাঁকে ঝাঁকে এগিয়ে আসছে এবং চুম্বকের মতো হাতে সেঁটে যাচ্ছে। অদ্ভুত ওদের মুখ। এবং নানা বর্ণের ছবি মাছের গায়ে। হাতে সেটে গেলে টেনে তুলতে হচ্ছে। প্রায় জোঁকের মতো ওদের যেন রক্ত শুষে নেবার ক্ষমতা।

ডেবিড দূরবীন নিয়ে এলে দূরের সমুদ্র দেখতে পারত। কিন্তু ওরা ভুলে সঙ্গে দূরবীন আনেনি, ওরা এমন কি এল-বি সেট সঙ্গে আনলেও পাশাপাশি সব জাহাজে খবর পাঠাতে পারত। ওরা রকেট ছুঁড়ে আকাশের গায়ে সিগন্যালিং করতে পারত, কিন্তু সকাল হয়ে গেছে। সমুদ্রে সূর্য উঠে আসছে। আকাশে রকেটের আলো ফ্যাকাশে হয়ে যাবে। এখন ওদের কি করণীয় বুঝতে পারছে না। সামান্য হাওয়া উঠেছে। বড় বড় জলের আবর্তে বোট কেবল উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে ভাসছে। ওদের মুখ দেখলেই বোঝা যায় ভারি অসহায় মুখ। প্রতিটি দণ্ড পল ভয়াবহ দীর্ঘ সফরের মতো, যেন ওরা আর তাদের আস্তানায় ফিরতে পারবে না। মান্নান সারাক্ষণ খিস্তি করছে। সবাইকে যা মুখে আসে বলছে। বোধহয় সেও আর কিছু ভেবে উঠতে পারছে না। ডেবিড নিজেও কিছু আর ভাবতে পারছে না। চুপচাপ, এবং এভাবে ক্রমে ওরা দেখতে পেল, সমুদ্রের বুকে লাল সূর্য, সমুদ্রের নীল রং ক্রমে ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে, রোদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ গরম। বোটের জল বিন্দুমাত্র ওরা ব্যবহার করেনি। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর কিছু একটা স্থির করে ফেলতেই হবে। জাহাজ না পেলেও, ওরা কম্পাসের কাঁটা দেখে সোজা কেবল বোট চালিয়ে যাবে। ভরসা তাতেও নেই, কারণ মোটর-বোট বলে ওরা যা তেল এনেছে সঙ্গে সে বড় কম সময়ের জন্য। ভরসা, যারা যাত্রী, সবাই প্রায় জোয়ান। বোট ওরা দাঁড়ে টানতে পারবে কিছুক্ষণ—সেটাই বা কতদূর! এবং যতদিন শরীরে শক্তি থাকে, খাবার থাকে—খাবার বলতে শুকনো খাবার, আর তো ঝড়ের সময় এমন ছোট্ট বোটের কোনো পাত্তা পাওয়া যাবে না। ওরা বুঝতে পারছিল, মৃত্যুর মুখোমুখি ওরা ক্রমে এগিয়ে যাচ্ছে।

ছোটবাবু দাঁড়গুলো সব এক এক করে টেনে বের করছে। ডেবিডের ভীষণ হাসি পাচ্ছিল ছোটবাবুর কাণ্ড দেখে! অসীম অন্তহীন সমুদ্রে ছোটবাবু ভেবেছে দাঁড় টেনে কোথাও ঠিক পৌঁছে যেতে পারবে।

ছোটবাবু বলল, ডেবিড তুমি তো সমুদ্রের অনেক কিছু জানো। সামনে কোথাও দ্বীপটিপ আছে?

ডেবিড বলল, কাছাকাছি এমন কিছু নেই ছোটবাবু। এখন ভরসা একমাত্র কোনো জাহাজ যদি দেখতে পায়।  

রোদে ওদের মুখ পুড়ে যাচ্ছে। ইস্পাতের রং ধরছে সমুদ্রে। ডেবিড বলল, এখানে থাকা বাদে কোনো উপায় নেই। সিউল-ব্যাংক খুঁজতে বের হলে যদি এদিকটায় ঘুরে যায়।

ছোটবাবু বলল, ডেবিড তোমার বাড়ির কথা মনে পড়ছে না!

ডেবিড বুঝতে পারল ছোটবাবু তাকে সাহসী করে তুলতে চাইছে। ছোটবাবু হয়তো নিজেও বাড়ির কথা ভাবছে। ওর মতো মনে মনে ভেঙে পড়ছে, কিন্তু বুঝতে দিচ্ছে না।

ছোটবাবু বলল, দ্যাখো আমরা দাঁড় টেনে ঠিক ডাঙা পেয়ে যাব। অথবা কোনো জাহাজ আমাদের দেখতে পেলে তুলে নেবে। আচ্ছা ওরাই বা কি করছে? সে বনিকে আসার সময় অযথা ঠেলে ফেলে দিয়েছিল। এখন কেন জানি মনে হচ্ছে কাজটা সে ভাল করেনি। আর হয়তো বনির সঙ্গে তার জীবনে দেখা হবে না। সে বলল, তোমার কি মনে হয় ডেবিড, ওরা আমাদের ফেলে চলে গেছে!

—বুঝতে পারছি না।

—তোমার কি মনে হয়, বলেই সে বুঝতে পারল, এখন এসব বলা ঠিক হবে না। বোট যদি শয়তানের প্রভাবে পড়ে যায় তবে কেউ রক্ষা পাবে না। বরং এখন যতটা পারা যায় সবাইকে স্বাভাবিক রাখা দরকার। সে কিছু লজেন্স বের করে নিল। সবাইকে একটা একটা করে দিল, প্রায় রেশনের সামিল, এখন কিছুতেই ওরা বেহিসাবী হতে পারে না। গলা শুকিয়ে উঠছে। আর সমুদ্র থেকে যেন এবার ক্রমে প্রচণ্ড উত্তাপ উঠতে আরম্ভ করবে। আসলে ওরা এমন একটা পরিস্থতিতে পড়ে ঘাবড়ে গেছে। গলা শুকিয়ে চ্যাট চ্যাট করছিল।

—একটু পানি, দু’নম্বর জাহাজি সোলেমান এমন বলল।

ছোটবাবু বাকেট থেকে একটু জল ঢালতে গেলে ডেভিড চিৎকার করে উঠল।

—এটা তুমি কি করছ ছোটবাবু!

–সোলেমান জল খেতে চাইছে।

—এখন জল দেবে না।

বোটের দায়দায়িত্ব ডেবিডের। সুতরাং যা কিছু সে করবে ডেবিডের অনুমতি নিয়ে। সে একটা একটা করে লজেন্স বের করে দিয়েছিল, যেন তাও ঠিক হয়নি। ডেবিড না বললে সে কিছুই দিতে পারে না। কিন্তু সবার চোখ যেভাবে জ্বলছে, কখন ডেবিডকে ওরা জলে ফেলে দেবে কে জানে! এবং মনে হল সেই যেন নিরুদ্দেশ যাত্রা। ক্রমে সবাই ক্ষুধায় তেষ্টায় অমানুষ হয়ে উঠছে। মান্নান আর মান্নান নেই। সে একটা অমানুষ হয়ে যাচ্ছে। সে নিজেও একটা অমানুষ! সব খাবার এবং জল শেষ। বুকে অসহ্য কষ্ট। চোখ কোটরাগত। আর শুধু নানারকমের সব ভয়ঙ্কর ছবি সমুদ্রে। এবং এটা হয়, বোট অসীম সমুদ্রে হারিয়ে গেলেই এটা হয়। বিচিত্র সব হেলোসিনেসান—কখনও মনে হয় একটা বড় ক্রস সমুদ্রে ঝুলে আছে, কখনও মনে হয় অতিকায় সব উড়ুক্কু মাছ ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসছে অথবা মরুভূমির মতো দূরে উট দেখা যায়, মরূদ্যান দেখা যায় আর বিচিত্র সব সামুদ্রিক অপদেবতারা তখন চারপাশে হাত নেড়ে ভয় দেখাতে থাকে। এবং মনে হল, তখন বোটের সবাই কংকালসার মানুষ, ওরা সবাই মিলে ডেবিডের রক্ত চুষে খাচ্ছে। এসব ভেবে ছোটবাবুর মুখ কেমন সহসা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ছোটবাবু বসেছিল গলুইয়ে, ডেবিড বোটের পাছাতে আর ডানদিকে মান্নান। সোলেমান মাঝখানে। আর বাঁদিকে জব্বার। ওরা সমুদ্রে সতর্ক হয়ে গেছে ভীষণ। বোটটা ভীষণ দুলছে। এবং বার বার ছোটবাবু সমুদ্রের গভীরে এই নীল জল পার হয়ে, আরও গভীরে, যে অন্ধকার আছে সেখানে কতটা আরও গভীর, এবং

ডুবে গেলে সেই জলরাশির ভেতর হাঙ্গরেরা কিভাবে ছুটে আসবে, ওর শরীর থেকে মাংস খুবলে খুবলে খাবে ভাবতে ভাবতে সে শিউরে উঠল। সে একটা কথা বলছে না। সে কেমন ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠল। পাগলের মতো সে চারপাশে তাকাতে থাকল। সোলেমানের মতো সে নিজেও যেন তেষ্টায় কষ্ট পাচ্ছে। এবং এমনকি সে যে দু’টো একটা কথা বলবে সহজভাবে তা পর্যন্ত পারছে না। সে চুরি করে একটা লজেন্স বেশী খেয়ে ফেলল।

ক্রমে সূর্য মাথার ওপরে উঠে আসছে। ডেবিড ঘড়ি দেখে বলল, দশটা বাজে। কি করবে ছোটবাবু?

ছোটবাবু বলল, জাহাজটাতো এখানেই থাকার কথা!

জব্বার বলল, ছোটবাবু তুই বেশি মাতব্বরি করবি না। কিছু জানিস না কেবল মাতব্বরি চালাচ্ছিস। তুই কী বুঝিস সমুদ্রের। আমাদের এখানে ঘুরে আসা ঠিক হয়নি। যদি কিছু হয় তোমাকে খুন করব ছোটবাবু।

ডেবিড বুঝতে পারল ক্রমে সবাই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। বচসা, মারামারিও শুরু হয়ে যেতে পারে। সবাই সবাইকে দোষারোপ করতে থাকবে। এখন যত বেশি মাথা ঠাণ্ডা রাখা যাবে তত তেষ্টা কম পাবে। গলা কম শুকোবে। ঘাম কম হবে। এসব নিয়ে ছোটখাটো একটা সে বক্তৃতা পর্যন্ত দিয়ে যখন বুঝতে পারল কোনো আশা নেই, মৃত্যু ক্রমে দু’হাত তুলে সমুদ্রে নাচানাচি শুরু করে দিয়েছে এবং দূরে সব শিস্ শোনা যাচ্ছে, হয়তো হাজার হাজার ডলফিন ভেসে আসছে, তাদের হাঁক-ডাক শোনা যাচ্ছে—তখন নিজেরাও ক্রমে সমুদ্রের জীব হয়ে যাচ্ছে ভেবে আবার চুপচাপ হয়ে গেল।

বোটটা তেমনি সমুদ্রের জলে দুলছে। লাফাচ্ছে। ওদের শরীরও দুলছে। ওরা আবার সামান্য কুটোগাছটি যদি ভেসে আসে এ আশায় কি যে অসহায় চোখে কেবল দেখে যাচ্ছে, কেবল সমুদ্র যেখানে শেষ হয়ে গেছে মনে হয়, দূরে অতিদূরে যেখানে দিগন্তরেখায় আকাশ নেমে গেছে সেখানে সবাই একসঙ্গে কিছু একটা দেখছে, দেখতে পাচ্ছে বিন্দুর মতো নীল সমুদ্রে সচল কি ভেসে আসছে।

ডেবিড চিৎকার করে উঠল, ওটা কি আসছে ছোটবাবু?

—বুঝতে পারছি না।

—মান্নান?

—জানি না স্যার।

—সোলেমান?

—কি যে আসছে!

—জব্বার? :

—কিছু একটা ছুটে আসছে।

আর তখনই দু’হাত তুলে ছোটবাবু সেই মহাসমুদ্রে সামান্য একটা বোটের ওপর দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল—লেডি-অ্যালবাট্রস আসছে সেকেণ্ড। বোট ফেরাও। সে আমাদের নিতে এসেছে।

ওরা দেখল সেই অতিকায় পাখিটা ঢেউয়ের ওপর ভেসে এগিয়ে আসছে। অথবা কখনও অনেক ওপরে উঠে যেন কিছু দেখছে। নিচে শুধু জলরাশি, জলে ওর প্রতিবিম্ব ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছে। এবং দূরে সে কেমন দেখতে পায়, আর এক দিগন্তে সেই জাহাজ, যেখানে তার পুরুষপাখিটা রয়েছে কাঠের বাসে বন্দী এবং একজন মানুষের মুখ বুঝি তার অতীব চেনা, সে থাকতে না পেরে উড়ে উড়ে দেখছে কোথায় সে।

এসবই ছোটবাবু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেবল ভাবছিল। তার ভাবতে ভাল লাগছিল। বোট দ্রুতগতিতে পাখিটার পেছনে ধেয়ে চলেছে, এবং পাখিটার কাছাকাছি চলে গেলে ওরা দেখতে পেল, আগে আগে সে উড়ে উড়ে যাচ্ছে, পেছনে তারা। মান্নান ছোটবাবুকে আনন্দে জড়িয়ে ধরেছে। ডেবিড নড়তে পারছে না। হালে সে বসে রয়েছে। এবং সামনে ওরা চারজন একেবারে মুহ্যমান, যেন অতিশয় স্থির এবং নির্বাক গভীর সমুদ্রে কুটোগাছটির মতো পাখিটা তাদের এখন একমাত্র অবলম্বন।

ছোটবাবু যেমন আজকাল পাখিটাকে আদর করে ডাকে, কখনও এলবি, আবার কখনও এলবা বলে, তেমনি সে ডাকল, এলবা ঠিক ঠিক নিয়ে যাচ্ছ তো! আমাদের জাহাজটা আর কতদূর? জাহাজে সবাই ভাল আছে তো? যেন মনে হয়েছিল ছোটবাবুর, কতকাল আগে অনেকদিন হয়ে গেছে ওরা জাহাজ ছেড়ে এসেছে। ঠিক আর তাকে জাহাজ ভাবা যায় না, বাড়ি-ঘরের মতো। প্রবাসী মানুষের মতো সে এখন ঘরে ফিরে যাচ্ছে। এবং গলা খুব খাটো করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, বনি কেমন আছে? চাচা কেমন আছে? সে বলতে পারল না। কারণ তখনই দূরে সেই সিউল-ব্যাংক, অস্পষ্ট ছায়ার মতো দিগন্তে ভেসে উঠেছে! ওরা আনন্দে সবাই সবকিছু ফেলে, এমনকি ডেবিড হাল ছেড়ে নৃত্য শুরু করে দিল। বোট যে ঘুরপাক খেয়ে ভরাডুবি হতে পারে সে খেয়াল পর্যন্ত নেই ডেবিডের। সে শুধু বলল, ডেবিড যেভাবে লাফাচ্ছো, বোট যে ডুববে!

ছোটবাবুর কথায় ওরা কেউ এতটুকু দমল না। তখন আর কি করা, হালে সে গিয়ে নিজেই বসল। প্রায় বোটটাকে সে জলের ওপর দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইল—বনি, আমি আসছি। আমরা সত্যি ফিরে আসছি। বনি, মাই লিটল্‌ প্রিন্সেস, দু’হাত তুলে কেবল এসব বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল তার।

তখন জাহাজে সবাই ওপরে উঠে এসেছে, সবাই বোট দেখে হাত নাড়ছে। এবং কেউ কেউ চুপচাপ কেবল দেখছে সে আসছে। ছোটবাবু হাল ধরে বসে আছে। লেডি-অ্যালবাট্রস বোটের সামনে আর নেই। বোট পৌঁছে দিয়ে সমুদ্রের নিরিবিলি আকাশে অথবা গভীর সমুদ্রে অদৃশ্য হয়ে যাবার চেষ্টা করছে। তখন রেডিও-অফিসার ঝুঁকে আছে বেতার-যন্ত্রটির ওপর। পিঁপ্ পিঁপ্ আর করছে না। রিন্ রিন্ করে কিছু ভেসে আসছে। গলা চেনা মনে হচ্ছে,যেন কতকাল পর আবার খোঁজখবর নিচ্ছে। তার মুখ চোখ অধীর। প্রথম খুব অস্পষ্ট, এবং মনে হচ্ছে হিসিং-সাউণ্ড, যেন খুব গভীর গোপন কথাবার্তা। রেডিও- অফিসার বুঝতে পারছে না। হেড-ফোন আরও জোরে চেপে ধরছে, ইয়েস, ইয়েস, হ্যাঁ হ্যাঁ সিউল- ব্যাংক। এস. এস. সিউল-ব্যাংক বলছি, ইয়েস ইয়েস, হ্যাঁ হ্যাঁ নেক্‌স্ট পোর্ট অফ কল সামোয়া, ইয়েস ড্যানসিং গার্ল, একুশ বারি স্ট্রীট, লণ্ডন। ইয়েস, ক্যাপ্টেন স্যালি হিগিনস অফ হার কমাণ্ড। আর সঙ্গে সঙ্গে সে প্রায় উত্তেজনায় গালাগাল করতে যাচ্ছিল। রাসকেল, তোমরা এতক্ষণ কি করছিলে? তোমরা কি সব ঘুমোচ্ছিলে!

কিন্তু কে কাকে বলে! অপরপ্রান্ত থেকে ভয়ঙ্কর সব কথাবার্তা ভেসে আসছে।—তোমরা কি সব নেশাভাঙ করে আছ! সকাল থেকে চেষ্টা করছি, কিছুতেই ধরতে পারছি না। আর যা হয়ে থাকে দিকে দিকে ওরা খবর পাঠিয়েছে, সকাল আটটার পর থেকে এস. এস. সিউল-ব্যাংকের কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না। আর সব খবর, যেমন জাহাজ কোন কোর্সে যাচ্ছে, তার ওয়েদার রিপোর্ট এবং সবকিছু জানিয়ে এরিয়া-স্টেশন থেকে পৃথিবীর সর্বত্র প্রায় ইথারে ভেসে গেছে, জাহাজ এস. এস. সিউল-ব্যাংক নিখোঁজ। এবং যা হয়েছিল, হেড-অফিসে মি. রিচার্ড ফ্যাল্ তখন মাত্র কথাবার্তা চালাবেন স্থির করেছেন, এবং এটা তৃতীয়বারের চেষ্টা—জাহাজ স্ক্র্যাপ করার সঠিক কথাবার্তা হবে, জাহাজ সাউথ-সীতে থাকতে থাকতেই কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে। স্যালি হিগিনসের এটাই শেষ সফর, তারপর এই জাহাজের জন্য কোনো আর মাস্টার-মেরিনার পাওয়া যাবে না। স্যালি হিগিনস থাকতে থাকতেই কিছু একটা করে ফেলতে না পারলে যতদিন যাবে তত সিউল-ব্যাংক ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে। এবং যা তিনি ভেবে শেষ পর্যন্ত স্থির করেছেন, স্যালি হিগিনসকে দিয়েই বিক্রি-বাট্টার দলিলে সই করাতে পারলে ব্যক্তিগত বিপদ থেকে তিনি ত্রাণ পাবেন। এমন একটা দুরভিসন্ধি যখন মাথায় খেলছে ঠিক তখনই খবর এসেছিল, এস. এস. সিউল-ব্যাংক মিসিং।

হেড-অফিসের সব মানুষ আনন্দে যে-যার টেবিল থেকে উঠে পড়েছিল, তবু শোক-জ্ঞাপনের মতো কিছুটা চেহারা রাখতে হয়, ভেতরের আনন্দ, অর্থাৎ সেই দুর্ভোগবহনকারী জাহাজটা আর কখনও নানারকমের দুঃসংবাদ বয়ে আনছে না, সে শেষ হয়ে গেছে, ফিস্ ফিস্ গলায় কেমন চারপাশের মানুষগুলো নড়েচড়ে বসেছিল, কেউ কেউ মি. ফ্যালের ঘরে ছুটে খবরটার সত্যাসত্য প্রমাণের ইচ্ছায় পাগল হয়ে যাচ্ছিল, তখন মি. ফ্যাল চুপচাপ বসে আছেন। তিনি কাগজটা উল্টে পাল্টে দেখছেন। সামনে বসে রয়েছেন এক ভদ্রলোক। নাম মি. হ্যামিলটন। তিনি এসেছেন, জাহাজ কেনাবেচার ব্যাপারে। জাহাজ এস. এস. সিউল-ব্যাংক যখন দক্ষিণ সমুদ্রে আছে তাকে সহজেই জাপানের উপকূলে ভিড়িয়ে দেওয়া যাবে। প্রাথমিক কথাবার্তা যখন এভাবে এগোচ্ছিল, তখন এমন একটা খবরে মি. ফ্যাল প্রায় মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলতে গিয়েও বুকটা কেমন ধড়াস করে উঠল—আসলে সিউল-ব্যাংক মিসিং। এটা তো মাঝে মাঝে দু-একবার হয়েছে। এমন রেকর্ড তো অফিসের খাতাপত্রে রয়েছে। আবার যথানিয়মে সমুদ্রের কোথাও তাকে দেখা যাবে। এমন যে কতবার হয়েছে! তিনি কেমন ভীষণ আবার হতাশায় ডুবে কথা শুরু করে দিতে চাইলেন।

হ্যামিলটন বললেন, তাহলে আর কথাবার্তা বলে লাভ নেই।

ফ্যাল্ বললেন, বসুন। চা খান।

হ্যামিলটন বললেন, খুব বড় রকমের লোকসানের মুখে পড়ে গেলেন।

ফ্যাল্ বললেন, হবে।

হ্যামিলটন একটু বিস্মিত। এতবড় দুর্ঘটনা ঘটে যাবার পরও মানুষটা বিচলিত নয়। এতগুলো মানুষের জীবন সংশয়, সমুদ্রে জাহাজডুবি সুতরাং পৃথিবীর সর্বত্র বড় বড় হরফে যখন ছাপা হয়ে যাবে, এস. এস. সিউল-ব্যাংক নিখোঁজ তখনও একজন মানুষ কত সহজভাবে চা খেতে বলছেন।

হ্যামিলটন চা খাবার পর বললেন, উঠি।

ফ্যাল্ বললেন, কথাবার্তা কিন্তু শেষ হয়ে যায় নি।

হ্যামিলটন বুঝতে না পেরে টুপিটা মুখের কাছে এনে ফের নামিয়ে নিলেন। বললেন, কথাবার্তা আর কি থাকতে পারে?

—খোঁজখবর নেবেন

—আপনাদের আরও জাহাজ আছে?

মি.ফ্যাল উঠে দাঁড়ালেন। তিনি সামান্য ভারি চেহারার মানুষ—এবং তিনি হ্যান্ডশেক করার সময় বললেন, স্ক্র্যাপ করার মতো নেই।

—তবে?

—দু’একদিনের ভেতর জাহাজটার খবর আমরা পেয়ে যাব!

—কিন্তু এত বড় একটা খবর, আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না। চোখ প্রায় কপালে তুলে হ্যামিলটন কথাটা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। সেই ভাল, যেন না হয়, করুণাময় ঈশ্বর ওদের রক্ষা করুন।

বিকেলে ফ্যাল্ হ্যামিলটনকে ফোনে জানালেন কাল আসবেন। এস.এস. সিউল-ব্যাংক বহাল তবিয়তে আছে। মাঝে একদিন শুধু ওর টি-আর পাওয়া যাচ্ছিল না। ওটা কিছু না। ট্রানসমিটারে গন্ডগোল হলে এসব হয়। যেন কত সহজে তিনি এর ব‍্যাখ্যা দিয়েছিলেন হ্যামিলটন সাহেবকে। নিজের দুর্ভাবনার কথা, জাহাজ নিয়ে যে তিনি তাঁর পুত্রের মৃত্যুর পর ভয়াবহ একটা দুর্ভাবনায় পড়ে গেছেন কি করে কি করা যায়, এবং যে জন্য তিনি সব সময় ভাবছেন, স্যালি হিগিনসের শেষ সফর যখন এটা, এবং আর যখন কাউকে পাওয়া যাবে না অর্থাৎ যিনিই উঠুন না কেন, জাহাজ তাঁকে সমুদ্রে নিশীথে এ-ভাবে এক দু’বার ঘুরিয়ে মারলেই পাগল হয়ে যাবেন। এবং জাহাজের নামে যখন এমন সব কিংবদন্তী তৈরি হয়ে যাচ্ছে অথবা বলা যেতে পারে—সেই জাহাজ এস.এস. সিউল-ব্যাংক আসছে আসছে, মাস্তুলে লম্ফ জ্বালিয়ে আসছে, যেন কতকাল থেকে এভাবে সে সমুদ্রে ভেসে বেড়াচ্ছে, তাকে কিছুতেই নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া যাচ্ছে না—তখন স্যালি হিগিনসই একমাত্র কিছু একটা করতে পারেন। ভাবলেন, তিনি নিজে কোনো সই-সাবুদে যাবেন না। এস.এস. সিউল-ব্যাংক তাঁর পরিবারের কাউকে সহ্য করতে পারে না। বরং স্যালি হিগিনসের সঙ্গে যখন এত দহরম মহরম তিনিই তার শেষকৃত্য করে যাবেন, এটাই স্বাভাবিক। বিক্রি-বাট্টার কাগজপত্রে স্যালি হিগিনস কর্তৃপক্ষের হয়ে অনায়াসে সই-সাবুদের কাজটা সেরে ফেলতে পারেন। বোধ হয় এস.এস. সিউল-ব্যাংক নিজেও এটা মেনে নেবে। তার রোষে তখন আর তাঁকে অথবা তাঁর পরিবারের কাউকে পড়ে যেতে হবে না। তিনি মনে মনে ভীষণ খুশী এবং এমন কি তিনি গাড়ি থেকে নেমে বড় লনের ভেতর হেঁটে যেতে যেতে নাবালকের মতো শিস্ দিতে থাকলেন। কতদিন পর যেন সেই অশুভ প্রভাবের হাত থেকে নিষ্কৃতির একটা পথ খুঁজে বের করতে পেরেছেন।

তখন রেডিও-অফিসার আরও নুয়ে পড়ছে। সে বলছে, কি কি বললেন! সে যেন পারলে আরও জোরে চিৎকার করে উঠত।

—এমন হয়েছে।

—কি বাজে কথাবার্তা।

—না বাজে নয়। এটা হয়েছে।

—ঠাট্টা হচ্ছে!

অপর প্রান্ত থেকে তখন আর কোনো কথা ভেসে আসছে না। সে নিচে না নেমেই হল্লা শুরু করে দিল। বলল, স্যার শিগগির আসুন। কি বলছে এরিয়া-স্টেশন শুনুন।

সে তারপর ফের বলল, কবে হয়েছে?

—এই বছর দুই আগে।

—কাদের জাহাজ ছিল? —আমেরিকান অয়েল-ট্যাংকার।

—আমেরিকান অয়েল-ট্যাংকার!

কাপ্তান এলে হেড-ফোন খুলে দিয়ে বলল, শুনুন কি বলছে এরিয়া স্টেশন।

তিনি বললেন, ক্যাপ্টেন স্যালি হিগিনস বলছি।

—গুড আফটারনুন স্যার।

—ইয়েস গুড আফটারনুন।

—স্যার, জাহাজের কোনো ক্ষতিটতি হয়নি তো?

—না।

—সবাই নিরাপদে ফিরে এসেছে?

—হ্যাঁ। লাস্ট বোট এই মাত্র এল।

—সবার শরীর ভাল তো?

স্যালি হিগিনস কেমন বিরক্ত গলায় বললেন, সবাই ভাল। তোমরা এতক্ষণ কোথায় ছিলে!

—আমরা তো স্যার ঠিকই খবর নিচ্ছি। কিন্তু কিছুতেই ধরতে পারছিলাম না।

স্যালি হিগিনস বললেন, দুপুর রাতে জাহাজডুবি হল কোনো খবর রাখো!

—ওটা স্যার কিছু না। মাঝে মাঝে জাহাজিরা এটা দেখে থাকে।

—তারে মানে!

—বছর দুই আগে এখানে একটা অয়েল-ট্যাংকার ডুবেছিল। কি করে আগুন লেগে যায়। একটা দিকতো বিস্ফোরণে উড়েই গেল। আর একটা দিক ডুবে গেল তারপর। কাউকে রক্ষা করা যায়নি। কেউ যেতেই পারেনি কাছে। চারপাশে আগুন কেবল আগুন। সারারাত সমুদ্রে সব আগুনের ফুলকি ভেসেছিল।

স্যালি হিগিনস শুনে কেমন হতবাক হয়ে গেলেন। তিনি কি বলবেন বুঝতে পারছিলেন না, তখন আবার গলা ভেসে এল, মাঝে মাঝে এ সমুদ্রে এলেই কোনো কোনো জাহাজের নাবিকেরা এটা দেখে ফেলে। এমন আরও দু-একবার হয়েছে তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যান।

স্যালি হিগিনস এমনই কিছু সন্দেহ করেছিলেন। তিনি এতটুকু বিচলিত হলেন না। কেবল রেডিও- অফিসারকে বললেন এসব ভৌতিক খবর গোপন রাখতে। জাহাজিদের ভেতর খবরটা ছড়িয়ে পড়া ঠিক না। শুধু বলে দিলেন জাহাজডুবি হয়েছে খবর সঠিক। অলৌকিক কিছু নয়। কারণ তিনি তাঁর প্রাচীন অভিজ্ঞতা থেকে এমন সব খবর আরও কিছু দিতে পারেন। তা ছাড়া তিনি তো সেই প্ৰথম থেকে এ জাহাজে এমন সব আরও ঘটনা দেখেছেন। চোখের ভুল বার বার ভাবতে চেয়েছেন। এবং সমুদ্রে শয়তানের পাল্লায় জাহাজ এভাবে পড়ে যেতে পারে তিনি বাদে আর কে বেশি বিশ্বাস করেন। তবু সবাইকে একটা জাহাজডুবির খবর দিয়ে নিরাপদে এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত। তিনি খুব সহজভাবে নেমে এলেন। বোট থেকে এখন সবাই উঠে আসছে। এক এক করে সবাই দেখা করে যাচ্ছে তাঁর সঙ্গে। বনি একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সারেঙ ছোটবাবুকে জড়িয়ে ধরেছে আর যারা ছিল সবাই এখন বোট-ডেকে হল্লা করছে। এবং বোট তুলে নেওয়া হচ্ছে। আবার এস.এস.সিউল-ব্যাংক সমুদ্রে ভেসে চলেছে। বোধ হয় টের পেয়ে গেছে ওর মৃত্যুর সমন এখন হেড-অফিসে টাইপ হচ্ছে। ক্রমশ সে কেমন ফের বেয়াড়া হয়ে যাচ্ছে চলায় ফেরায়। রাত বারোটায় কম্পাসের ডিভিয়েশান দেখে হিগিনস সেটা যেন আরও বেশি টের পেলেন। জাহাজ ঠিক চার্ট-মতো রান করছে না। আবার সে অস্থির হয়ে উঠছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *