1 of 2

অলৌকিক জলযান – ৩৮

।। আটত্রিশ।।

স্যালি হিগিনস এনজিন-রুমে টেলিগ্রাম পাঠালেন—স্ট্যান্ড বাই

জাহাজ থেমে গেল। কাপ্তান নিজে সব করে যাচ্ছেন। তিনি চিফ-মেটকে ডাকলেন। বোট হারিয়া করা দরকার। কে কে যাবে সব চটপট বলে দিতে হবে।

তিনি স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছিলেন না। কেউ পারছিল না। সবাই ওর চারপাশে ঘুরছে। বোট- ডেকে সব ডেক-জাহাজিরা এখন মাস্তার দিয়েছে। এনজিন-রুমের সিঁড়ি ধরে নামছে মেজ-মিস্ত্রি। এ- সময়ে ওকে সব সময় নিচে থাকা দরকার। সে পছন্দমতো পাঁচ-নম্বর এবং তিন-নম্বরকে কাছে রাখল। আগুন জাহাজটাতে তেমনি জ্বলছে। খুব বেশি দূরে মনে হচ্ছে না। মনে হয় মোটর-বোটে গেলে আধঘন্টার মতো লাগবে। তবু এই মাঝরাতে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না কতদূর হবে। বরং যখন আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে মনে হচ্ছে খুবই কাছে জাহাজ, আবার যখন কমে আসছে, মনে হচ্ছে জাহাজ দূরে ভেসে চলেছে। এ-সবের ভেতরই ওরা দেখতে পাচ্ছিল, আগুন ছড়িয়ে পড়ছে সমুদ্রে। জাহাজিরা রেলিঙে ঝুঁকে আছে। ওরা নিয়মকানুন মানতে চাইছে না। এক্ষুনি যদি কাপ্তান নেমে আসেন আর দেখতে পান সবাই এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে ভীষণ ক্ষেপে যাবেন। কিন্তু যা সব হচ্ছে সমুদ্রে ওরা তো সব দেখে হতবাক।

রেডিও-অফিসার কাছাকাছি সব স্টেশন ধরার চেষ্টা করছে। আশ্চর্য! একটা স্টেশন থেকে সে জবাব পাচ্ছে না। এতবড় সমুদ্রের এই দু’চারশ মাইলের ভেতর কি কোনো জাহাজ নেই! পাঁচ-সাতশ মাইলের ভেতর! সে ক্রমে ক্ষেপে যাচ্ছিল, আর যত দূরের সব স্টেশনে বার্তা পাঠিয়ে দিচ্ছে, ইয়েস, দি সিপ’স বার্নিং। না, কেউ জবাব দিচ্ছে না। হ্যালো, সিউল-ব্যাংক বলছি, নেকস্ট পোর্ট অফ কল সামোয়া —না কোথাওকেউ জবাব দিচ্ছে না। সে ফের বলল, মনে হচ্ছে এটা একটা তেলের জাহাজ। সে কাঁচের ভেতর দিয়ে সমুদ্র দেখছে আর বলছে, সে এত বেশি উত্তেজিত যে কেবল বলেই যাচ্ছে—কেউ শুনছে কিনা তার খেয়াল থাকছে না—হ্যাঁ মনে হচ্ছে হ্যালো ইয়েস, আনডার দ্য হরাইজন, কিন্তু কেউ কিছু সাহস দিচ্ছে না, একেবারে চুপচাপ। সে যেন আছাড় মেরে এবার সব ভেঙে দেবে। দরজার মুখে স্যালি হিগিনস চিফ-মেট দাঁড়িয়ে আছেন। পাশাপাশি কোন্ কোন্ জাহাজের সঙ্গে কথা বলা গেল জানতে চাইছেন। অথবা শেষ পর্যন্ত এরিয়া-স্টেশন থেকে কোনো খবর এসেছে কিনা। এবং সিউল-ব্যাংক যে এখন স্ট্যান্ড-বাই, দু’টো বোট নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এ-সব খবরও এরিয়া-স্টেশনকে পৌঁছে দিতে পারলে ভাল হত। স্যালি হিগিনস পুরানো কাপ্তান—জাহজাডুবি সম্পর্কে তিনি অভিজ্ঞ। এবং তিনি জানেন, কোথায় সামান্যতম ত্রুটি হলে কাপ্তানের ওপর এসে সব দোষ বর্তায়, আর কতটা বিবেচনার সঙ্গে কাজ করলে শেষ পর্যন্ত কাপ্তান স্যালি হিগিনস সাহসী, সমুদ্রে শয়তানের ঘাড় ঠিক সময়ে মটকে দিয়েছেন। এবং বোধহয় এভাবেই সব কিংবদন্তী তৈরি হয়ে যায়। যেমন স্যালি হিগিনস যখন উঠে যাচ্ছিলেন ওপরে অথবা নিচে নেমে আসছিলেন, জাহাজিরা তখন একজন মানুষের চলাফেরা দেখে সাহসী হয়ে উঠছে। এবং বোধ হয় এক্ষুনি তিনি নাম ঘোষণা করবেন —হাই

কার কার নাম থাকবে, অর্থাৎ বোটে কে কে যাবে। সবাই তো এমন একটা অগ্নিকান্ডের সামনে সহজে যেতে চায় না। কারণ কাছাকাছি গেলে, কখন খোল থেকে সব নানারকমের বিস্ফোরণ হবে কে জানে! তিনি এক এক করে নাম হেঁকে যাবেন, ঠিক নাম বললে ভুল হবে, নম্বর হেঁকে যাবেন, অবশ্য এ-ব্যাপারে পরামর্শদাতা ডেক-সারেঙ আর চিফ-মেট এবং সঙ্গে এনজিন-সারেঙ থাকতে পারেন। যারা কখনও দু-চার কথায় সারেঙের সঙ্গে বচসা করেছিল, কেন যে মাথা গরম করতে গেল, এবং ওদের মনে হচ্ছিল ঠিক ডেক-সারেঙ ওদের নাম দিয়ে দেবে। ওরা বোট-ডেকে চুপচাপ ছিল। এমন কি দূরে যে এতবড় একটা অগ্নিকান্ড ঘটছে তাও আর দেখতে সাহস পাচ্ছে না।

আসলে সমুদ্রটা তখন লাল হয়ে গিয়েছিল। চারপাশে, একেবারে মনে হচ্ছে দিগন্তব্যাপী এক উজ্জ্বল আলোকমালা গড়ে তুলছে জাহাজটা। নীলাভ নক্ষত্রমালায় যেন আগুন লেগে গেছে।

কেউ বলছিল, ওটা যাত্রী-জাহাজ হবে।

কেউ বলছিল, ওটা তেলের জাহাজ।

মান্নান কোথা থেকে এসে ভিড়ের ভেতর উঁকি মেরে বলল, দূর শালা ওটা মাছ ধরার জাহাজ তিমি মাছ ধরার জাহাজ হবে, বলে দিলাম। শালা তিমির চর্বি না হলে আগুন এত সাদা হয় না।

মনু বলল, তুই তো তিমি মাছ ধরার জাহাজে কাজ করতিস।

—না করলে বুঝি মিঞা হয় না।

—আরে রাখো বে, দ্যাখো না শালা জাহাজ কেমন ফুটছে। তিমি মাছ বেরিয়ে যাবে।

এবং সবাই উদ্বিগ্ন। কেউ কেউ খোঁড়াতে পর্যন্ত থাকল। এনজিন-সারেঙ তখন দেখলেন বাদশা মিঞা আসেনি। ওর তো, ওয়াচ নেই। এখন বড়-টিন্ডালের ওয়াচ। তিনি তাড়াতাড়ি খুঁজতে থাকলেন—এত চেঁচামেচি, কারো কথা কানে আসছে না। তিনি হেঁকে গেলেন, ছোট-টিন্ডাল। কোথাও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।

পিছিলে এসে দেখলেন একেবারে খালি ফোকসাল। কেউ নেই। কারও থাকার কথাও নয়। মাস্তার বললে সবাইকে তো বোট ডেকে হাজিরা দিতেই হবে। তখন ছোট-টিন্ডাল যে কোথায় গেল। এবং তখনই মনে হল ভেতরে কেউ গোঙাচ্ছে। সে ভেতরে ঢুকে তাজ্জব। এমন গরমে বাদশা মিঞা কম্বল গায়ে শুয়ে রয়েছে। এবং কাছে যেতেই সে হাউ হাউ করে কাঁদছে।

সারেঙ-সাব জানেন, ভয় পেয়ে বাদশা মিঞা শুয়ে আছে, যদি বোটে ওকে নামিয়ে দেওয়া হয়। বাদশা মিঞার মুখ দেখে তিনি ক্ষেপে গেলেন। তবু তাঁর স্বভাবে আছে এক আশ্চর্য গাম্ভীর্য। তিনি বললেন, ছোট-টিন্ডাল, ওঠো। ওঠো বলছি।

সারেঙ-সাবের ভয় হচ্ছিল, এভাবে এখন এখানে তার থাকা ঠিক না। যে কোন সময় বাড়িয়ালা তার খোঁজ করতে পারেন। তিনি বাদশা মিঞাকে, তারপর মনে হল শুধু বাদাশা মিঞা নয়, আরও দু’একজন এভাবে লুকিয়ে আছে। সবাইকে প্রায় গোরুর পাল ঘরে থেকে মাঠে নিয়ে যাবার মতো উঠে গেলেন। এবং তখনই তিনি দেখলেন, আশ্চর্য সব আগুনের ফুলকি সমুদ্রে ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছে। এবং হাজার হাজার এভাবে সারা সমুদ্রে ছড়িয়ে পড়তে থাকল।

স্যালি হিগিনস বললেন, চিফ-মেট দেখছ!

—দেখছি স্যার।

ডেবিড বলল, স্যার, সব মশাল জ্বলছে সমুদ্রে।

একজন জাহাজি তখন নিচ থেকে হেঁকে উঠল, স্যার, মনে হচ্ছে মশালের মিছিল। হাজার হাজার মশাল এভাবে জাহাজের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে।

আর যখন এভাবে সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছিল, স্যালি হিগিনস বোট হারিয়া করার তোড়জোড় করছেন, এবং চারপাশে সেই সব আগুনের ফুলকি ভেসে বেড়াচ্ছে তখন ছোটবাবু প্রাণপণ চেষ্টা করছে জ্যাককে ওপরে নিয়ে আসতে। জ্যাক পাগলের মতো লেপ্টে রয়েছে শরীরে। কেবল ছোটবাবুর পিঠে বুকে মুখ ঘসছে। ছোটবাবুকে নিয়ে কি করবে সে যেন বুঝতে পারছে না।

ডেক-জাহাজি এলার্মিং বেল বাজিয়ে যাচ্ছে সমানে।

ছোটবাবু বলল, জ্যাক ছাড়ো বলছি। কি হচ্ছে এ-সব

জ্যাক একটা কথাও বলছে না। সে লতাপাতার মত জড়িয়ে আছে। এবং নানাভাবে ছোটবাবুর শরীরে উন্মত্তের মতো ঘাড়ে গলায় ঠোটে চুমো খাচ্ছে।

ছোটবাবু আর ধৈর্য রাখতে পারছে না। বোট-ডেকে ওদের না দেখতে পেলে কেউ খুঁজতে চলে আসতে পারে। তখন কি যে হবে না!

এবার সে প্রায় জোর-জার করে জ্যাককে ছাড়াতে চাইল। জ্যাক প্রায় পেছনে ঝুলে থাকার মতো! এবং এটা বড় অসম্মানের—ছোটবাবুর জন্য সে সারারাত প্রায় জেগে বসেছিল। এবং যেন সময় পাওয়া গেছে, সবাই একটা ভয়ঙ্কর ঘটনায় যখন ওপরে ছোটাছুটি করছে তখন ছোটবাবুকে নিয়ে ছেলেমানুষের মতো কখনও অভিমানে আঁচড়ে-কামড়ে দিতে চাইছে, কখনও চুপ-চাপ বুকে মুখ লুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে চাইছে, এমন একটা নির্জন অন্ধকার থেকে সে কিছুতেই যেতে চাইছে না।

সমানে এলার্মিং বেল বাজছে তো বাজছেই।

ছোটবাবুর মনে হল, সবাই ওপরে উঠে গেছে, এবং কেবল সে আর বনি এভাবে পালিয়ে রয়েছে অন্ধকারে। ওর ভয় ধরে গেল। বনিকে নিয়ে প্রায় টানতে টানতে সিঁড়ির মুখে চলে গেল। আর প্রায় টেনে-হিঁচড়ে বনিকে ওপরে তুলে হাত ছেড়ে দিল। বনি আক্রোশে তখন প্রচন্ড ফুঁসছে। সে যেন তার সব কান্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।

ওপরে উঠে ছোটবাবু স্তম্ভিত। সে এ-সব কি দেখছে? আগুন, চারপাশে আগুন। দূরের জাহাজ থেকে সব আগুনের গোলা যেন ঝাঁপিয়ে পড়ছে জলে। আর পড়েই ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে, বিন্দু বিন্দু হয়ে যাচ্ছে, তারপর আরও ছোট, আকাশের নিচে অজস্র প্রদীপের মতো ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছে, কখনও মনে হচ্ছে আকাশের নিচে অজস্র সোনার পদ্ম সমুদ্রে ফুটে উঠেছে। এমন গভীর নিশীথে সে এ-সব দেখে কারো সঙ্গে একটা কথা বলতে পারল না। কি বলবে! সবার চোখেই ভীষণ ত্রাস। সবাই ব্যাপারটা রেলিং-এ ঝুঁকে বোঝার চেষ্টা করছে।

থার্ড-মেট দাঁড়িয়েছিল পোর্ট-সাইডের ঠিক দুটো বোটের মাঝখানে। বোট হারিয়া করার ভার তার ওপর! ডেক-সারেঙ, ডেক-টিন্ডাল বোটের ওপর উঠে গেছে। কপিকলে তেল ঢেলে দিচ্ছে। দড়ি টানাটানি করে কপিকল সহজ করে নিচ্ছে। অর্থাৎ যেন বোট নামতে নামতে মাঝখানে আবার আটকে না যায়।

সমুদ্রে বোট নামিয়ে দেবার সব রকমের প্রস্তুতি চলছে।

তখন ডেবিড ছোটবাবুর পাশে এসে কাঁধে হাত রাখল। ডেবিডকে দেখে কিছুটা সে আশ্বস্ত। সে বলল, দেখছ সমুদ্রটা কি ভয়ংকর দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে হাজার হাজার সোনার পদ্ম সমুদ্রে ভাসছে। আবার নিভে যাচ্ছে।

ডেবিড বলল, আসলে ওটা তেলের জাহাজ। তেলের জহাজে আগুন লাগলে এমন হয়। সমুদ্রে তেল যত ছড়িয়ে যায়, আগুন তত ছড়িয়ে যায়। ঢেউ এসে সেগুলো আরও ভেঙে দেয়। আগুন ক্রমশ বিন্দুবৎ হতে হতে কখনও আগুনের ফুলকি হয়ে যায়।

ছোটবাবুর আর কথা বলতে ভাল লাগছিল না। জাহাজটাতে সেই মানুষগুলি এখন কি না করছে! অথবা সবাই হয়ত পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। এবং এ-সব ভাবলেই ছোটবাবু ভীষণ ছটফট করতে থাকে। লেডি-অ্যালবাট্রস সমুদ্রে কোথাও উড়ছে না। সে পাখিটাকে খুঁজতে একবার গঙ্গা-বাজুতে ছুটে গেল, আবার যমুনা-বাজুতে—পাখিটাকে সে দেখতে না পেয়ে জোরে জোরে ডাকতে চাইল, এলবা। লেডি- অ্যালবাট্রসকে সে কখনও কখনও এভাবে ডাকতে ভালবাসে। না, কোথাও নেই। সমুদ্রে আর অন্ধকার একেবারে নেই। স্পষ্ট সবকিছু দেখা যাচ্ছে। আগুনের আভায় দাঁড়ালে যেমন শরীর মানুষের স্পষ্ট হয়ে যায়, তেমনি আকাশ, তার নক্ষত্রমালা এবং সমুদ্র খুবই স্পষ্ট। এমন কি যদি এলবা আকাশে উড়ে বেড়াতো এখন তার প্রতিবিম্ব জলে দেখা যেত, পাখিটা সমুদ্রে নেই তবে। পাখিটাকে না দেখা গেলেও ওর প্রতিবিম্ব দেখে বুঝতে পারত, সমুদ্রেই আছে পাখিটা। কোথাও হারিয়ে যায় নি।

যখন সবাই বোট নামিয়ে দেবার জন্য হুড়োহুড়ি করছে তখন ছোটবাবু বোট-ডেক থেকে নিচে নেমে ডাকল, এলবা। বেশ জোরে গলা ছেড়ে ডাকতে ইচ্ছে হল। এটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে ভেবে সে ফোরমাস্টের নিচে এসে দাঁড়াল। এখানে পাখিটা কখনও আজকাল বসে থাকে। ওপরে তাকালে দেখল এলবা ঠিক বসে রয়েছে। এবং পাখার নিচে ঠোঁট গুঁজে ঘুমোচ্ছে। সমুদ্রে এমন সাংঘাতিক জাহাজডুবি অথচ পাখিটার এতটুকু ভ্রুক্ষেপ নেই। সমুদ্রে আর দশটা রাতের মতো সে যেন নিশ্চিন্ত। ছোটবাবু পাখিটাকে ঘুমোতে দেখে ঘাবড়ে গেল। এই সব ঘটনার ভেতর কোথাও যেন একটা আশ্চর্য রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে সে। সে ধীরে ধীরে ফের ওপরে উঠতেই কাপ্তানের গলা পেল—হাই

স্যালি হিগিনস কাউকে ডেকে কিছু বলছেন। চার্ট-রুমের রেলিঙে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। দু’টো বোঁট ঠিকঠাক নামানো যাচ্ছে কিনা লক্ষ্য রাখছেন। ঠিক না হলেই মাঝে মাঝে চড়া গলায় হাঁকছেন—গালাগাল করছেন। এবং দু’টো একটা খারাপ কথাও মুখ থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। অবশ্য এ-সময়ে মাথা ঠিক রাখা মুশকিল। সবাই নির্দেশমতো কাজ করে যাচ্ছে। নিচে এনজিন-রুমে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন, জাহাজ স্লো চালাতে হবে। যতক্ষণ তিনি ফের নির্দেশ না দিচ্ছেন জাহাজ সামনের দিকে এগুবে। আরও কিছু এগিয়ে দেখা গেল, জাহাজটার সামনে আগুন, পেছনে লোক-লস্কর আবছা দেখা যাচ্ছে। ওরা নিচে ঝাঁপ দিতে চাইছে এমন অস্পষ্ট সব ছবি।

তখনই বোট হারিয়া করতে বললেন স্যালি হিগিনস।

দু’টো বোট ক্ৰমে নিচে নেমে যেতে থাকল। লম্বা দড়ি সব ফেলে দেওয়া হচ্ছে। কাপ্তান নাম বলছেন, অথবা নম্বর বলছেন, আর তারা লাফিয়ে দড়ি বেয়ে নিচে নেমে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এক দণ্ড দেরি করতে পারছে না কেউ। আর তিনি নির্দেশ দিচ্ছেন—অর্থাৎ কাজ এবং কথা একসঙ্গে চলছে।

তিনি বললেন, দু’নম্বর বোটে চিফ-মেট, ফাইভার, তিনজন ক্রু। তিনজন ক্রুর তিনি নম্বর বলে গেলেন।

ওরা নেমে নিচে দাঁড়িয়ে আছে। বোট দুলছে ভীষণ। এখনও দড়ি ছেড়ে দেওয়া হয়নি। একটু শুধু এগিয়ে নেওয়া হয়েছে বোট। এক নম্বর বোট নেমে যাচ্ছে। কেউ একটা কথা বলছে না, এখন কে যাবে! তখনই তিনি চিৎকার করে বললেন, হাই। হাই বলতেই সবাই সতর্ক হয়ে গেল। তিনি হেঁকে গেলেন, ডেবিড, ছোটবাবু, সঙ্গে তিনজন ক্রু। তিনি ক্রুদের নম্বর বলে গেলেন। ওরা সবাই লাইফ- জ্যাকেট পরেই ছিল। কেবল এখন দড়ি ধরে নেমে যাওয়া। ওরা ঠিক এক একজন পুতুলের মতো যেন খেলনার দড়ি বেয়ে নেমে যেতে থাকল। বোট অনেক নিচে। প্রথম ডেবিডকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সে ঠিক জায়গা মতো নেমে যেতে পারে নি, কিছুটা ফসকে গিয়ে একেবারে সমুদ্রে পড়ে গেল। কিন্তু হলে কি হবে এসব সময়ে সবাই এত বেশী সতর্ক থাকে যে মুহূর্তে সে জল কেটে বোটে ঠিক ঝুঁকে পড়ল। ওপর থেকে চেঁচামেচিতে সে কিছু বুঝতে পারছে না। কেবল হাত তুলে সে ইশারা করল। সে ভাল আছে। তারপর ছোটবাবু এবং পাশে সে দেখল জ্যাক দড়ি ধরে আছে। কিছুতেই আল্গা করছে না। আবার চার্ট-রুমের রেলিঙ থেকে কাপ্তানের চড়া গলা, হাই

জ্যাক বলল, আমি যাব বাবা?

কাপ্তান বিরক্ত গলায় বললেন, না। দড়ি আল্‌ল্গা করে দাও।

জ্যাক দড়ি আল্গা করে দিতে থাকল। তখন কাপ্তান নিচে নেমে এসেছেন। জ্যাক কেন এখন এ- জায়গায়, এ-কাজ তো ছোট-টিণ্ডালের এবং ডেক-বোসানের। তিনি দড়ি আল্গা করার জন্য তাদেরই রেখেছেন। কিন্তু কাছে এসে কেমন মনে হল ভীষণ স্বার্থপরের মতো কাজ করে ফেলেছেন। এতগুলো জীবনকে তিনি ভয়াবহ এক অগ্নিকাণ্ডের সামনে পাঠিয়ে দিচ্ছেন, নিজের সন্তানের বেলায় তিনি না বললেন। কিন্তু তিনি ততক্ষণে স্থির করে ফেলেছেন, এ-সময়ে কাউকে কিছু না বলাই ভাল। ইশারায় তিনি শেষবারের মতো নির্দেশ দিলে বোটগুলো সমুদ্রে দুলে উঠল।

তিনি নির্দেশ দিলেন, সাবধানে এগুবে। তেল ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। আগুন বাঁচিয়ে বোট সামনে নিয়ে যাবে। একটা বোট থাকবে। আর একটা বোট চলে আসবে। দরকার হলে আরও লোকজন যাবে। তিনি নিজে যেতে পারলে ভাল করতেন। কিন্তু চিফ-মেট স্যমুয়েল বার বার এ-অভিযানে কর্তৃত্ব চাইছে। এ-সব ঘটনা পৃথিবীর সব কাগজগুলোতে ছাপা হয়ে যায়। কারণ এক দুর্ধর্ষ অভিযান এটা। চিফ-মেট জাহাজের খুব কাছ থেকে দেখবে সব। এবং যেন সিউল-ব্যাংক থাকল বেস-ক্যাম্পের মতো। দরকার মতো সব চেয়ে পাঠানো হবে। যদি কেউ ইতিমধ্যে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে থাকে তাদের তুলে আনা, তাদের দেখাশোনা, সেবাশুশ্রূষা, সামনে অনেক কাজ, তিনি বনির কাঁধে হাত রেখে বললেন, যাদের উদ্ধার করা হবে তাদের তুমি দেখাশোনা করবে জ্যাক। খুব একটা বড় কাজ তোমাকে দেওয়া গেল।

তারপর তিনি পাইপে আগুন জ্বালালেন। কি নিথর সমুদ্র! আর নির্জনতা। সমুদ্র এতটুকু ফুঁসছে না। সামান্য যেটুকু ঢেউ আছে, অস্পষ্ট অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না। আর দূরে সেই অগ্নিকাণ্ড। একটা দিক জাহাজের এখনও অক্ষত। ওখানে যদি সব নাবিকেরা আশ্রয় নিয়ে থাকে। এবং উদ্ধারের আশায় বসে থাকে। যারা পুড়ে গেছে এবং অর্ধদগ্ধ তাদের জন্য সব রকমের ব্যবস্থা, কফিন এবং ফার্স্ট-এড সবকিছু তাঁর চিন্তা-ভাবনার ভেতর রাখতে হচ্ছে।

এরপর সিউল-ব্যাংকের সার্চলাইট জ্বেলে দেওয়া হল। যতক্ষণ বোটগুলো দেখা যাচ্ছে তাদের সামনে পেছনে সার্চ-লাইটের আলো ফেলা হতে থাকল। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সর্বত্র এখন আলো ফেলে মহাসমুদ্রে মানুষ খোঁজাখুঁজি চলছে।

জ্যাক দাঁড়িয়ে ছিল ব্রীজে। আরও অনেকে ব্রীজে এসে জড়ো হচ্ছে। কোনো বাধানিষেধ কেউ মানছে না। দূরে জল কেটে হাঁসের মতো দুটো বোট ভেসে যাচ্ছে। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছিল। ছোটবাবু নুয়ে কি সব করছে! বোধহয় সমুদ্রের জল হাতের কাছে বলে সর্বত্র দু’হাতে জল ছিটিয়ে দিচ্ছে। সব আগুনের ফুলকি, ঠিক ফুলকি বলা যায় না, কিছুটা পদ্মকলির মতো ছোট ছোট আগুনের শিখা, ঢেউ খেয়ে জ্বলছে নিভছে। অজস্র বয়ার আলোর মতো, খুব তীব্র গতিতে বোটগুলো ঢেউ ভেঙে খান খান করে এগিয়ে যাচ্ছে। এবং যারা ব্রীজে অথবা নিচে বোট-ডেকে অথবা আরও নিচে টুইন-ডেকে ছোটাছুটি করছে তারাও বসে নেই। কেবল দেখছে কোথাও কালো বিন্দুর মতো অথবা সাদা লাইফ-জ্যাকেট ভাসছে কিনা! দেখলেই তিন নম্বর বোটের ডাক পড়বে। যদিও বোটের সব লোকজন ঠিক করা থাকে, যেমন কে কোন বোটে জাহাজডুবির সময় উঠে যাবে ঠিক থাকে কিন্তু যখন জাহাজডুবি না হয়ে উদ্ধারকারী হয়ে যায় তারা, তখন সব কাপ্তানের মরজি। কে যাবে, কে যাবে না বলে দেবেন তিনি। সুতরাং যারা যাবার জন্য প্রস্তুত ছিল অথচ যেতে পারে নি, কারণ এ-সব ভয়াবহ সময়ে অনেকে কেমন আত্মত্যাগের জন্য অনুপ্রাণিত হয়ে পড়ে—সুতরাং যেতে না পারায় হতাশ মানুষের মতো দাঁড়িয়ে দেখছে, যেন বিন্দুর মতো কিছু সমুদ্রে ভেসে গেলেই বোট নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। কিছু একটা না করা পর্যন্ত স্বস্তি নেই যেন।

এটাই হয়ে থাকে, নিশীতে মহাসমুদ্র এক অতিকায় দুয়ে রহস্য, এবং ভেতরে মহামায়া অর্থাৎ এই সব আগুনের ভেতর কঠিন কিছু আবিষ্কারের নেশায় পেয়ে যায়। তখন কিছুটা সবাই বেহুঁশ, মাথা ঠিক রাখা, মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করা খুবই কঠিন। কঠিন বলে স্যালি হিগিনসের এতটুকু অস্থিরতা নেই চলা-ফেরাতে। বরং জ্যাককে এখন সমুদ্রের সব প্রাচীন ইতিহাস শোনাবার জন্য, যেমন বলতে পারেন আফ্রিকা এবং এশিয়া একসময় একই মহাদেশ ছিল। অথবা তুষার যুগের আগের ঘটনা বলার সময় তখনকার গাছপালা কেমন ছিল বলবেন। প্রাচীন সব অতিকায় হাতির ফসিল আবিষ্কারের গল্প বলবেন এবং যেন তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন, সাইবেরিয়া অঞ্চল তখন তুষারাবৃত ছিল না। সব ঘাস তরুলতা এবং বন্য প্রাণীরা চরে বেড়াচ্ছে, তারপর সহসা সেই তুষার ঝড়। তুষারপাত বছরের পর বছর। এবং সেই মদ্দা হাতির শুঁড় তুলে ছোটা, ছুটতে ছুটতে এক সময়ে খাদের ভিতর ক্রমে তুষারে ঢাকা পড়ে যাওয়া। হিম হয়ে যাওয়া। রক্ত মাংস সব একেবারে ফ্রিজ। এমন অজস্র হাতির পালের গল্প, উট বন্য বরাহের গল্প, খরগোশের গল্প তিনি একের পর এক অনায়াসে যেন বলে যেতে পারেন। কোথায় কোন জাহাজে আগুন লেগেছে উদ্ধারকারীর দল এগিয়ে যাচ্ছে, তিনি বেস-ক্যাম্পে প্রতীক্ষায় আছেন খবর আসবে—আরও সাহায্য চাই, দড়িদড়া চাই, গ্যাস-সিলিণ্ডার চাই, তার জন্য এতটুকু ভ্রুক্ষেপ নেই। এমনই মানুষ যখন স্যালি হিগিনস তখন চিৎকার করতে করতে ছুটে আসছে রেডিও-অফিসার, স্যার, শিগগির আসুন। দেখে যান কি কাণ্ড!

স্যালি হিগিনস কেবিন থেকে ছুটে বের হয়ে ব্রীজের রেলিঙে ঝুঁকে পড়লেন। এটা কি দেখতে পাচ্ছেন? এটা কেন হচ্ছে? চারপাশের সেই সব খণ্ড খণ্ড আগুন সহসা নিভে গেছে। কোথাও আগুন নেই। কেবল সেই অর্ধদগ্ধ জাহাজ তিনি দেখতে পাচ্ছেন। যত দূর সম্ভব সার্চ-লাইট ফেলে দেখলেন বোট দু’টো দেখা যাচ্ছে না। জাহাজটা তো কাছেই জ্বলছিল। এখন মনে হচ্ছে জাহাজটা তেমন কাছে নেই, বেশ দূরে সরে যাচ্ছে।

রেডিও-অফিসার বলল, স্যার কি হবে?

নিচে তখন চেঁচামেচি সোরগোল। আগুন-লাগা জাহাজটাকে কিছুতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। বোট দেখা যাচ্ছে না, এমন সব চিৎকার ভেসে আসছিল। এনজিন-রুমে স্ট্যাণ্ড-বাই আর্চি, থার্ড-এঞ্জিনীয়ার। বয়লার- রুমে আছে মৈত্র, তিনজন ফায়ারম্যান। বাংকারে তেমনি ঝুপ ঝুপ কয়লা ফেলার শব্দ। আর এইসব হট্টগোলের ভেতর হিগিনস বুঝতে পারলেন না জাহাজের আগুন এভাবে ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে কেন। তিনি ঘড়ি দেখলেন, দু’টো বেজে গেছে। এক ঘণ্টার মতো বোট সমুদ্রে ভেসে গেছে। সার্চ-লাইটের আওতায় হয়তো বোট নেই, কাজেই খুব ভয়ের নয় বোট না দেখা। কিন্তু তাঁকে যা ভীষণ চিন্তিত করছে, জাহাজটা ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে। দূরে সরে যাচ্ছে, না আগুন ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে কোনটা? কারণ এত দূর থেকে কিছুই সঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

তিনি সহজভাবে বললেন, হ্যালো এনজিন-রুম। মাউথ-পাইপের সামনে মুখ রেখে বলে গেলেন, এনজিন-রুমে আর্চি কান পেতে শুনছে—তিনি বলছেন তখনও, একটা আশ্চর্য ব্যাপার আর্চি, জাহাজের আগুন কমে আসছে, বোটগুলো দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে এগোনো দরকার। তারপর আর্চির জবাবের জন্য অপেক্ষা না করে ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে দেবার মতো টেলিগ্রামের কাঁটা ঘুরিয়ে দিলেন। এনজিন- রুমে কাঁটা ঘুরে এস্টার্ন থেকে এ-হেডে চলে এল। তারপর কাঁটা ‘ফুল’ এই নামাঙ্কিত শব্দের ওপর আটকে তির্ তির্ করে কাঁপতে থাকল। সঙ্গে সঙ্গে আর্টি লিভার টেনে ধরল। এনজিন গর্জে উঠল। প্রপেলার-স্যাফট ধীরে ধীরে তারপর সামান্য দ্রুত তারপর আরও দ্রুত ক্রমে ক্র্যাংক-ওয়েভগুলো চরকিবাজির মতো ঘুরতে ঘুরতে একটা গোলাকার বৃত্ত হয়ে গেল। সিউল-ব্যাংক ফুল স্পীডে আবার সমুদ্রে এগিয়ে যাচ্ছে।

তখন ডেবিড কেমন হুঁশ ফিরে পাবার মতো বলল, কী ব্যাপার বল তো?

ছোটবাবু বলল, কী?

—কিছু বুঝতে পারছ না?

—না তো।

–দেড় ঘণ্টা বোট চালিয়ে কোথায় এলাম?

—কেন, কি হয়েছে?

—দেখছ না চারপাশে কিছু দেখা যাচ্ছে না?

—ছোটবাবু বলল, তাই তো!

—আমাদের জাহাজটা দেখতে পাচ্ছ?

অনেক দুরে ছোট্ট একটা ভেলার মতো দেখা যাচ্ছে সিউল-ব্যাংক। খুব ছোট। ছোটবাবু বলল, ঐ তো সিউল-ব্যাংক। তারপর আতঙ্কে ফেটে পড়ল সে, আমাদের দু’নম্বর বোট?

–দেখা যাচ্ছে না।

ডেবিড এবার ছেলেমানুষের মতো অন্ধকার সমুদ্রে চিৎকার করে উঠল, মি. স্যামুয়েল? তোমরা কোথায়?

কোনো সাড়া নেই। সমুদ্রে জোরে চিৎকার করলে অনেক দূরে সেই শব্দ ভেসে ভেসে যায়। কিন্তু মোটর-বোটের শব্দে সে কিছু শুনতে নাও পারে। ডেবিড এবার বোট থামিয়ে জলের কাছে ঝুঁকে থাকল। যদি দু’নম্বর বোটের শব্দ কানে ভেসে আসে।

মান্নান বলল, এই চঁইয়া হইছে কি কও?

ছোটবাবু বলল, কিছু হয় নি। ডেবিডের মুখ দেখে ওরাও একটা কিছু আন্দাজ করতে পারছে। কিন্তু ডেবিড এবং তার ইংরেজী কথাবার্তা বিন্দুবিসর্গ বুঝতে না পেরে মান্নান ক্ষেপে যাচ্ছে।

ডেবিড বলল, এত দূর এলাম অথচ দ্যাখো মনে হচ্ছে বোট একেবারে এগোচ্ছে না। বোটের প্রপেলার কতটা ঘুরছে দেখার জন্য সে ঝুঁকে পড়ল, এবং সমুদ্রে বেশ দ্রুত জল কেটে বোট যে এগিয়ে যাচ্ছে বোঝাই যায় এবং ওরা যে অনেকটা পথ চলে এসেছে পেছনে তাকালে সেটা আরও স্পষ্ট, এবং সিউল-ব্যাংক ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে, জাহাজের আগুনও ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে, আরও কিছু সময় চালিয়ে দেখা দরকার। এবং এক সময়ে মান্নান আর ধৈর্য ধরতে না পেরে বলল, ছোটবাবু তুমি কি মিঞা, কোনখানে নিয়া আইলা!

ছোটবাবুর বুকটা কেঁপে উঠল। সিউল-ব্যাংক ওদের দৃষ্টির বাইরে কখন চলে গেছে! যত ডিগ্রিতে বোট চালিয়ে এসেছে ঠিক তার বিপরীতমুখী গেলে সিউল-ব্যাংক জাহাজে পৌঁছানো যাবে। তবু ভয়ে কেমন সে গুটিয়ে গেল এবং তখনই দেখল সেই সমুদ্রে অতিকায় অগ্নিকাণ্ড যা তাদের নানা প্রলোভনে ফেলে এত দূরে নিয়ে এসেছে, নিমেষে সহসা দিগন্তের আকাশ আলোকোজ্জ্বল বর্ণমালায় ভরে দিয়ে সমুদ্রগর্ভে অদৃশ্য হয়ে গেল। আর কিছু থাকল না। কেবল অন্ধকার চারপাশে আর সমুদ্রে সেই উজ্জ্বল ফসফরাস অথবা নানা বর্ণের ছোট ছোট অতি-ছোট সব মাছ। শুঁড় আছে এবং কুচো চিংড়ির মতো মাছের মুখে অজস্র লাল নীল আলো। যেন আকাশের মতো নানা নক্ষত্রমালায় সমুদ্র সেজে আছে। এ- হেন সময়ে ডেবিড এবং ছোটবাবু কি করবে বুঝতে পারল না। ঠায় বসে থাকল অন্ধকারে। কেবল মাঝে মাঝে ডেবিড চিৎকার করছে, মি. স্যামুয়েল আমরা এখন কি করবো? যেন সে তার চিৎকার সুদূর সেই অদৃশ্য জাহাজে পৌঁছে দিতে চাইছে। স্যালি হিগিনস আমরা কোথায় এলাম? অন্ধকার সমুদ্রে সেই চিৎকার ভেসে যাচ্ছে।

ছোটবাবু বলল, বোট ফেরাও।

কম্পাসের কাঁটা দেখে ডেবিড বোট ঘুরিয়ে দিল। এভাবে বোট গেলে ঘণ্টা দু-একের ভেতর ওরা সিউল-ব্যাংক জাহাজে পৌঁছে যাবে। এবং এখন জাহাজ, আগুন, সমুদ্রগর্ভে তার অন্তর্হিত হওয়া কেমন ভীতির সঞ্চার করছে। ওরা চুপচাপ, একটা কথাও বলতে পারছে না, আরও সব রহস্যময় ঘটনা যে ঘটবে না কে বলবে। এবং মনে হচ্ছিল, ভোঁস করে হয়তো একটা অতিকায় তিমি ভেসে উঠবে, অথবা একটা নয়, একপাল, অথবা এমন গভীর সমুদ্রে সামান্য একটা বোট, কত যে অসহায়, ছোটবাবু প্ৰথম টের পেয়ে খুব ভারী গলায় বলল, ডেবিড শেষ পর্যন্ত আমরা ফিরতে পারবো তো?

.

আর সেই মধ্যযামিনীতে জাহাজে যেন একটা তোলপাড় আরম্ভ হয়ে গেল। বয়লার-রুমে দু’বার ছুটে এসেছে মেজ-মিস্ত্রি আর্চি। জাহাজ একবার এস্টার্ন একবার এ-হেড অর্থাৎ নেভিগেশানে কোথাও কিছু গণ্ডগোল, কখনও স্লো কখনও হাফ, কখনও ফুল, কি যে ছাই মাথামুণ্ডু সব ঘটনা। এখন খবর এসেছে যত জোরে পারো এ-সমুদ্র থেকে পালাও। ফায়ারম্যানদের চোখ-মুখ ধকধক করে জ্বলছে। স্টিম কিছুতেই উঠছে না। মৈত্র বার বার ছুটে যাচ্ছে। বয়লার গেজ দেখছে, ঠিক স্টিম না উঠলে সে নিজে জোর করে কেড়ে নিচ্ছে স্লাইস। একেবারে বয়লারের পেটে ঢুকিয়ে আগুন উল্টে-পাল্টে দিচ্ছে এবং লেলিহান সেই আগুন ফঁস করে বের হয়ে আসছে। মৈত্রের হাতের শিরা উপশিরা এবং অমানুষিক চোখ মুখ দেখলেই বোঝা যায় ঠিক ঠিক বয়লার স্টিম না দিলে একেবারে গলা টিপে ধরবে। রাশি রাশি কয়লা ফার্নেসে, তিন তিনটে বয়লারের ন’টা ফার্নেসে আগুন জ্বলছে। প্রায় সেই আগুন ভয়াবহ আর এক অগ্নিকাণ্ডের মতো। এবং তখনই মৈত্র দেখল যথাযথ স্টিম-গেজের কাঁটা লাল দাগটাতে এসে কাঁপছে।

স্যালি হিগিনস তখনও ব্রীজে পায়চারি করছেন। রেডিও-অফিসার জেগে আছে। এখনও ট্রান্‌সমিটারে কোনো খবর নেই। একেবারে ঠাণ্ডা। নব্ ঘোরালে দূরবর্তী কোনো বেতার থেকে গানবাজনা ভেসে আসছে। কোনোটা সুদূর দক্ষিণ আমেরিকার উপকূল থেকে, কোনোটা আবার শৌখিন বেতারবিদ্ পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় তার শখের খবর পৌঁছে দেবার চেষ্টা করছে। এতে করে রেডিও-অফিসার বুঝতে পারছে বেতারযন্ত্রটি ঠিক আছে—কোনো গণ্ডগোল নেই। যা কিছু গণ্ডগোল এই সমুদ্রের অথবা আবহাওয়া কোনো কারণে দূষিত হয়ে আছে। এমন সব আজগুবি চিন্তায় মাথাটা তার ক্রমে খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

আর তখনই মনে হল দূরে অন্ধকার সমুদ্রে একটা আলো ভেসে আসছে। দূরবর্তী মাঠে একজন নিশীথের মানুষ যেভাবে হাতে লণ্ঠন নিয়ে হেঁটে যায়, তেমনিভাবে খুব ধীরে ধীরে আলোটা দুলছে সমুদ্রে। তিনি বুঝতে পারলেন একটা বোট আসছে। কিন্তু আর একটা বোট? তাকে আশেপাশে কোথাও দেখা গেল না। যেমন এসব সময়ে জাহাজ থামিয়ে দেওয়ার কথা থাকে, বোট এলে সব লোকজন তুলে নেবার কথা থাকে তেমনি তিনি তাদের তুলে নেবেন বলে জাহাজ থামিয়ে দেবার জন্য টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দিলেন নিচে। জাহাজ আবার থেমে গেল। ঘড়িতে দেখলেন তিনটে বেজে গেছে।

দড়ির সিঁড়ি নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রথমে এক এক করে সব জাহাজি, শেষে ফাইভার এবং চিফ- মেট উঠে এল। ওদের পোশাক জলে ভিজে গেছে। এবং ওরা কেউ একটা কথা বলতে পারছিল না। ওরা আস্তানায় ফিরে আসতে পেরেছে শেষ পর্যন্ত। এখন শুধু বিশ্রাম। ভীষণ একটা ভয়াবহ উত্তেজনা থেকে রেহাই পেলে যা হয়ে থাকে, গলা বুজে আসছে কথা বলতে। চিফ-মেট রিপোর্ট করছে সব। এক নম্বর বোট তো ওদের সঙ্গেই ফিরে আসার কথা, চিফ বলল, সে এক নম্বর বোটের খবর জানে না।

বোট-ডেকে আবার জটলা। সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। স্যালি হিগিনস এখন কি করবেন বুঝতে পারছেন না। তবু শান্ত গলায় বললেন, আপনারা যান। আমাদের এখন অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। জাহাজ এখানেই থামিয়ে রাখা হোক। ওরা ঠিক ফিরে আসবে। ভয়ের কিছু নেই।

একে একে আবার বোট-ডেক খালি হয়ে গেল। দু’জন ওয়াচে রয়েছে সামনে পেছনে। ব্রীজে স্যালি হিগিনস নিজে থাকছেন। চিফ-মেটকে তিনি ছেড়ে দিলেন। আর যারা বোটে ছিল তাদের ছুটি। স্যালি হিগিনস দেখলেন একমাত্র একজন এখনও বোট-ডেকে দাঁড়িয়ে আছে। সে কেবিনে ফিরে যাচ্ছে না। তিনি তার কাছে গিয়ে বললেন, বনি, এবার শুয়ে পড়। রাত জেগে শরীর খারাপ করবে না।

না আর একজনও আছেন। স্যালি হিগিনস আরও নিচে ঠিক টুইন-ডেকে দেখলেন এনজিন-সারেঙ দাঁড়িয়ে আছেন। রেলিঙে ভর করে দূরের সমুদ্রে কিছু কেবল অনুসন্ধান করছেন।

হিগিনস ওপরে ব্রীজে উঠে যাবেন ভাবলেন। চিফ-মেটের সঙ্গে আরও সব কথাবার্তা ছিল। কখন কিভাবে ছাড়াছাড়ি হয়, কখন ওরা কিভাবে বুঝতে পারল, বোট চালিয়ে কিছুতেই আগুনের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারছে না। তারা এমন কিছু দেখেছে কিনা যাতে মনে হতে পারে অস্বাভাবিক কিছু। শয়তানের হাত যদি থেকে থাকে, অথবা এমন কিছু দেখেছে কিনা, যাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক যথার্থই জাহাজডুবি। তিনি সিঁড়ি ধরে উঠে যাবার সময় এসব মনে করতে পারলেন। কিন্তু এখন সবাইকে অহেতুক ভয়ের ভেতরে রেখে কাজ নেই। বরং খুব স্বাভাবিকভাবে তিনি উঠে গেলেন ওপরে। যেন তিনি ওপরে উঠে ঘুমিয়ে পড়বেন। এক নম্বর বোট যেন কথা আছে যথাসময়ে ফিরে আসবে—চিফ-মেটকে জাগিয়ে রেখে দরকার নেই। অথবা এও হতে পারে খুব বেশী তিনি গুরুত্ব দিতে চাইছেন না, কারণ তিনি জানেন এখন একমাত্র তাঁর চিন্তা এক নম্বর বোটের মানুষগুলো সম্পর্কে। ওরা ফিরে না আসা পর্যন্ত তিনি আর কিছু ভাবতে পারবেন না। যদি ওরা আকাশে রকেট ছুঁড়ে সিগন্যালিং করে সেই আশায় তিনি ব্রীজে উঠে যাচ্ছেন।

আর তখনই মনে হল একটা লম্বা ছায়া ওঁর পেছনে চলে আসছে। নিশুতি রাতে জাহাজ সমুদ্রে থেমে আছে। চারপাশে শুধু কালো অন্ধকার। এবং এত বেশী নির্জনতা জাহাজে যে কেউ সিঁড়িতে পা রাখলে পর্যন্ত টের পাওয়া যায়। তিনি শুধু ছায়া দেখে চমকে উঠলেন। বোধ হয় জোরে হাই বলে চিৎকার করে উঠতেন, কিন্তু চোখ ফিরিয়ে দেখলেন, বনি ওঁর পেছনে পেছনে উঠে আসছে।

তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, তোমাকে শুয়ে পড়তে বললাম। ওপরে উঠে আসছো কেন?

বনি বলল, বাবা!

স্যালি হিগিনস সিঁড়ির এক ধাপ ওপরে। এক ধাপ নিচে বনি। মুখোমুখি দু’জন এবং অজস্র নক্ষত্র তেমনি আকাশে জ্বলছে। দু’জনের মুখে উইংসের আলো দুলছে। ভেবেছিলেন আরও ভারী গলায় বনিকে কেবিনে ফিরে যেতে বলতে পারবেন। কিন্তু তার মুখ দেখে শেষে আর তা বলতে পারলেন না। তিনি আবার উঠে যেতে লাগলেন এবং ব্রীজের ভেতর ঢুকে যাবার আগে বললেন, বনি আমাকে কিছু বলবে!

—বাবা!

স্যালি হিগিনস বললেন, বোস।

চারপাশে কাঁচে মোড়া বলে এখানে বসলে জাহাজের সবটা দেখা যায়। এবং জাহাজের সবচেয়ে ওপরে বলে তিনি খুব দূরে যত দূরেই হোক সমুদ্রের কোথাও যেন আগুনের ফুলকি দেখলে বুঝতে পারবেন এক নম্বর বোট ফিরে আসছে।

বনি বসল না। বাবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকল।

স্যালি হিগিনস একপাশে ঝুঁকে কি দেখলেন! আকাশের একটা নক্ষত্র দিগন্তের নিচে ঝুলে আছে। এত নিচে যে মনে হয় আলোর ফুলকির মতো। আর সমুদ্রে সামান্য ঢেউ আছে বলে নক্ষত্রটা একবার দেখা যাচ্ছে একবার দেখা যাচ্ছে না। তিনি বোটের আলো ভেবে এগিয়ে গিয়েছিলেন। যখন বুঝতে পারলেন ওটা আলো নয় নক্ষত্র, জলের ওপর নিচে ভেসে ভেসে খেলা করছে তখন কম্পাসের ওপর ভর করে ডাকলেন, বনি।

বনি কাছে এলে বললেন, কিছু করার নেই। এখন শুধু অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের উপায় নেই। আর তিনি আছেন, তিনি বলতে সেই ঈশ্বরের পুত্রের কথা বলতে চাইলেন স্যালি হিগিনস

বনি বাবাকে আর একটা কথাও বলতে পারল না। সে যে এসেছিল অনেক কথা বলবে বলে!–বাবা, যদি বোটে কেউ হারিয়ে যায় কি হবে, ওরা দ্বীপ-টিপ পাবে না! ওরা কোথাও একটা ডাঙা পেয়ে যাবে তো! বাবা, কাছাকাছি কি কি দ্বীপ আছে? যদি কোনো স্রোতের মুখে পড়ে যায় বাবা। আচ্ছা বাবা, সমুদ্রে বোট হারিয়ে গেলে তাদের কি কি কষ্ট হতে পারে। জল ফুরিয়ে গেলে কি হবে? খাবার?

স্যালি হিগিনস সহসা দেখলেন, বনি আর ব্রীজে নেই। প্রথমে ভাবলেন বোধ হয় ওর কেবিনে ফিরে গেছে। কিন্তু কেবিনে ফিরে গেলে সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পেতেন। কোথায় গেল! তিনি ব্রীজের এদিক- ওদিক চার্ট-রুম এবং পাশে নিজের কেবিনে উঁকি দিতেই দেখলেন মেয়ে তাঁর যীশুর পায়ের নিচে হাঁটু মুড়ে বসে আছে। এবং দু’পায়ে বনির কপাল ঠেকে আছে। এমন ভঙ্গীতে তিনি বনিকে বসে থাকতে দেখে বুঝতে পারলেন, ছোটবাবু এখন বনির সব। ছোটবাবু এখন বনির সব। এই সব শব্দ তাঁর বুকের ভেতর থেকে বার বার উঠে আসতে থাকল। তিনি বুঝি আর বনির কেউ নন—তার চোখ জলে চিকচিক করছে।

এখন থেকে বনির জীবনে ছোটবাবু সব। এবং এসব বুঝতে পারলেই ভেতরের কষ্টটা বেড়ে যায় চুপচাপ বসে থাকেন ব্রীজে। চোখ ভীষণ উদাসীন হয়ে যায়। পৃথিবীতে এত বড় একটা কষ্ট আছে মানুষের তিনি যেন জাহাজে এটা ক্রমে বুঝতে পারছেন। তারপর কেন যে তিনি ছোটবাবুর ওপর ক্ষেপে যান, যেন শুধু এ জাহাজে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কেবলমাত্র লুকেনার নয় অথবা এই যে নিশীথে জাহাজ সমুদ্রে ভেসে বেড়াচ্ছে এবং একটা বোটের সন্ধান এখনও নেই, যেন না থাকাই ভাল, তিনি মনে মনে ছোটবাবুকে সমুদ্রে ফেলে যেতে পারলে বোধ হয় সবচেয়ে খুশী হতে পারতেন। নির্ভর করার মতো ছিল তাঁর সামান্য একটা মেয়ে, কোথাকার কে ছোটবাবু জাহাজে এসে তাঁর কাছ থেকে তাও কেড়ে নিচ্ছে।

এতদিন যা তিনি ভেবেছেন, মেয়েটার নানারকমের আবদার শুধু তিনি মেটাচ্ছেন, ছোটবাবুর হয়ে বনির কথাবার্তা সব একজন সমবয়সী মানুষের জন্য দুঃখবোধ আর কিছু না এবং এ বয়সে বনি যদি জাহাজে কোনো প্লে-মেট খুঁজে না পায় তবে নানা কারণে ওর নিজের জীবনই যেন বনি অতিষ্ঠ করে তুলত। প্রায় সেই জেদ থেকে আত্মরক্ষার নিমিত্ত সব সহ্য করে গেছেন—এখন সেই অপোগণ্ড ছোটবাবু তাঁর নাড়ি ধরে টান দিয়েছে। যেন এখুনি তিনি ফের টেলিগ্রাম পাঠাতে পারলে বাঁচতেন, মুভ এ-হেড নিখোঁজ বোটের জন্য আমাদের বসে থাকলে চলবে না। ক্যাপ্টেন লুকেনার সমুদ্রে আবার তাঁর হাত বাড়িয়েছেন।

কিন্তু তিনি জানেন তাঁর নাম স্যালি হিগিনস। নিজের এই নামটির প্রতি তিনি অতিশয় মোহগ্রস্ত এবং ভেতরে ভেতরে এক আশ্চর্য ধর্মবোধ যা বয়স বাড়ার সঙ্গে বাড়ছে। এবং কর্তব্যপরায়ণ মানুষ হিসেবেই তাঁকে এখন যেন ছোটবাবুকে জাহাজে তুলে নিতে হবে। যতটা সতর্ক ছিলেন এখন তার চেয়ে বেশি সতর্ক। সার্চ-লাইট জ্বালিয়ে রেখেছেন সামনে। ওয়াচম্যান বার বার চারপাশে আলো ফেলে দেখে যাচ্ছে এবং সেই আলো দূরবর্তী সমুদ্রে যদি দৃশ্যমান হয় বোট তবে ঠিক ঠিক দেখে ফেলবে, ঐ যে জাহাজের আলো। এবং এটা ঠিক রাতে যতটা সুবিধাজনক জাহাজে ফিরে আসা,.সকাল হয়ে গেলে সে সুবিধা থাকে না। রোদ উঠলে সমুদ্র ঝলসে যাবে। কারণ যত ইকুয়েডরের দিকে জাহাজ উঠে যাবে তত সমুদ্র তেতে উঠবে। তত সমুদ্র ইস্পাতের মতো রং ধরবে। সাদা জাহাজের রং আর সমুদ্রের রং প্রায় কখনও কখনও এক হয়ে গেলে ওরা কাছাকাছি চলে এলেও স্থির করতে পারবে না জাহাজটা কোথায়!

এ-ভাবে যত সময় যেতে থাকল ক্রমে তত তিনি অস্থির হয়ে উঠছেন। কি করবেন ঠিক বুঝতে পারছেন না। এ-ভাবে জাহাজ থামিয়ে অপেক্ষা করা ঠিক হচ্ছে কিনা বুঝতে পারছেন না। চারপাশে শুধু গভীর অন্ধকার, আর কিছু নক্ষত্র মাথার ওপর এবং দূরে সমুদ্র তেমনি প্রবলভাবে ফুঁসছে। আর মনে হয় তখন সব অদৃশ্য শয়তানেরা সমুদ্রের ওপর হাত তুলে দিচ্ছে। তারা এগিয়ে আসছে। তারা যেন ওঁর গলা টিপে ধরবে এবার। অথচ তিনি চুপচাপ বসে পাইপ টানছেন। পাশে কোয়ার্টার-মাস্টার, হুইলের পাশে স্ট্যাণ্ড-বাই। নড়ছে না। সেই প্রাচীন মমির মতো তার মুখ।

সামান্য বোটের জন্য এ সমুদ্রে অপেক্ষা করা ঠিক হচ্ছে কিনা বুঝতে পারছেন না। সামান্য ক’জন জাহাজির জন্য জাহাজটা যদি আবার নতুন দুর্ঘটনায় পড়ে যায়। ক্যাপ্টেন লুকেনার এবং তাঁর অশুভ প্রভাব তো সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। এমন একটা সুযোগ হেলায় ছেড়ে দেবেন তিনি হিগিনস কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না।

অথবা এই যে আগুন, আগুনের ফুলকি, ট্র্যান্সমিটারে ভৌতিক সব আর্তনাদ, এবং সহসা সব আবার হাওয়া, সবই সেই ক্যাপ্টেন লুকেনারের ছলনা নয় কে বলবে! সেই ধূর্ত মানুষটির অশুভ প্রভাবে জাহাজ কখন যে আবার অস্থির হয়ে উঠবে। ঠিক কিউ-টি-জি পাওয়া যাবে না, এবং টি-আর ধরা যাবে না। অথবা নিশিদিন সমুদ্রে ঘুরিয়ে মারার যে স্বভাব ওঁর রক্তে আছে—যদি আবার সবই এক এক করে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, তিনি কি করবেন! দুঃর্ভাবনায় তিনি ক্রমে অস্থির হয়ে উঠছেন। কখনও পায়চারি করছেন পাগলের মতো। আবার কখনও মাথার চুল ছিঁড়ছেন, এমনভাবে দু’হাতে তিনি চুল টানছেন মাথার। কারণ জাহাজ সিউল-ব্যাংক কখনও এত ধূর্ত হয়ে যায়, ওর কম্পাসে ম্যাগনেটিক কারণে এত বেশি গণ্ডগোল থাকে যে তিনি দেখেছেন বার বার কম্পাস পাল্টেও কিছু হয়নি, এবং এমন যে জাইরো-কম্পাস যার তুলনা নেই, তাও কেমন ঠিকঠাক তখন কাজ করে না। এবং এ-সব মনে হলে তাঁর বুঝতে অসুবিধা হয় না, সবই সেই ধূর্ত মানুষটির কাজ। তাঁর অশুভ প্রভাব ঠিক ঠিক কাজ করে যাচ্ছে।

আবার ভেবেছেন কখনও, হয়তো জাহাজের ভেতরে আছে সব রকমারি ইস্পাতের স্তর সাজানো, পুরানো আমলের কারিগরেরা এমন সব ইস্পাতের ব্যবহার রেখেছেন যার স্বভাব জানা ছিল একমাত্র ক্যাপ্টেন লুকেনারের। স্যালি হিগিনসও দীর্ঘদিনের সফরে জেনে ফেলেছেন, জটিল-প্লাস মাইনাসের একটা অতি সূক্ষ্ম ব্যবহার আছে। ওটা ধরতে না পারলেই সব গেল। আর সবটা যে শুধু অংকের ব্যাপার, কে বলবে। কিছু অনুভূতি। আবার মনে হয় বিশ্বাস রাখা দরকার জাহাজের ওপর, ভালোবাসার দরকার, সব মিলিয়ে জাহাজটা চলে। ভালবাসা না পেলে জাহাজটা চলে না।

জাহাজটা যত বিশ্বাসী হয়ে উঠছে, প্রিয় হয়ে উঠছে, তত সেই অশুভ প্রভাব ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে। তিনি বুঝতে পারছেন, এই শেষ সফরে তাঁর সর্বস্ব গ্রাস করতে চায় সে।

পায়চারি করতে করতে ক্যাপ্টেন লুকেনারের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তাঁর বেড়ে যায়। তিনি চিৎকার করে বলতে চাইলেন, মিঃ লুকেনার, আমি জাহাজ ঠিক বন্দরে পৌঁছে দেব। আপনি কিছুতেই আমাকে ঘাবড়ে দিতে পারবেন না।

তারপর ভাবলেন নিশীথে ভয় পেয়ে তিনি কি অদ্ভুত সব আজেবাজে কথা বলছেন! নিজের ওপর আর বিশ্বাস রাখতে পারছেন না! আর সঙ্গে সঙ্গে তিনি দেখতে পেলেন সেই দৃশ্য! এলিস অন্ধকারে রেলিঙে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে একজন লম্বা মত মানুষ। যার মুখ দেখা যায় না।

সহসা তিনি চিৎকার করে উঠলেন, কোয়ার্টার-মাস্টার!

—ইয়েস স্যার।

—স্টার-বোর্ড সাইডে দ্যাখো। কিছু দেখতে পাচ্ছ?

—না তো স্যার!

আবার তিনি ডেক-চেয়ারে বসে পড়লেন। বোট সমুদ্রে দেখা যাচ্ছে না। না আকাশে কোনো রকেটের ফুলঝুরি। ওরা অন্তত আকাশে রকেট ছুঁড়ে তাঁদের অবস্থান বলে দিতে পারত। আসলে বোধ হয় ওরাও সেই অশুভ প্রভাবের পাল্লায় পড়ে গেছে। যেমন এলিস জাহাজে উঠে পড়ে গিয়েছিল। তিনি কিছুতেই তাকে রক্ষা করতে পারেন নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *