।। সাইত্রিশ।।
এই জাহাজ যেন নিরবধিকাল এভাবেই চলবে। এর চলার শেষ নেই। স্যালি হিগিনস নিজের কেবিনে জেগে আছেন। বেতার সংকেতের জন্য রেডিও-অফিসার সেই যে বসে রয়েছে ওপরে আর নামছে না। কোনো নতুন খবর বেতারে ভেসে এলেই কথা আছে তাকে জানানো হবে। তিনি পোর্ট- হোল খোলা রেখেছেন। বেশ গরম পড়েছে। তবু সমুদ্র বলে তেমন গরম মনে হচ্ছে নাা। পোর্ট- হোল খোলা রেখে বসে থাকতে ভালই লাগে। জ্যোৎস্না রাত হলে তো কথাই নেই। অন্ধকার রাতেও তার বেশ ভাল লাগে। আকাশের গায়ে দু’টো একটা নক্ষত্র ক্রমে সরে যায়। এই বয়সেও কখনও মনে হয় সবকিছুই তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে। ঘুমিয়ে পড়লেই সব শেষ হয়ে গেল। তিনি কি ভেবে চিফ-মেটকে ডেকে পাঠালেন। তার সঙ্গে পরামর্শ করা দরকার।
চিফ-মেট এলে বললেন, বোস।
চিফ-মেট জেগেই ছিল। বিপদের সময় জাহাজে ওদের জেগেই থাকতে হয়। বার বার চেষ্টা করেও এরিয়া-স্টেশনকে শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল না! কাছাকাছি অন্য সব স্টেশনেও খবর পাঠানো হয়েছে—কোথাও থেকে কোন জবাব আসছে না। যেন জাহাজটার সব সংযোগ নষ্ট হয়ে গেছে। পৃথিবীর সবকিছু থেকে জাহাজটা ক্রমে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। এখন জ্যাক নিচে কি করছে, কে জানে। হয়তো জ্যাক শুয়ে আছে। জ্যাক ঘুমোচ্ছে। পোর্ট-হোল সে খোলা রাখে না। দরজা বন্ধ থাকে। পাখা চালিয়েছে, না ভুলে গেছে। ওর তো স্বভাব দিন দিন ভারি মিষ্টি হয়ে যাচ্ছে। আগের মতো জ্যাক দুষ্টুমী করে না। কারো পেছনে লাগে না। জাহাজটা বিপদে পড়ে গেলে জ্যাককে কিভাবে যে রক্ষা করবেন এবং যা মনে হয় এ-সব সময়ে, একমাত্র সেই ঈশ্বর, করুণাময় ঈশ্বরের কথা বেশী করে মনে হতে থাকলে তিনি বললেন, চিফ-মেট তোমার কি মনে হয়?
চিফ-মেট বলল, স্যার কি বলব, ঠিক বুঝতে পারছি না। আমার জীবনে তো এমন দেখি নি।
স্যালি হিগিনসও এমন বলতে চাইলেন, আমিও চিফ-মেট এ ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হই নি। যদিও মনে হচ্ছে আমরা ঠিকই যাচ্ছি। এবং চার্টের ওপর পেন্সিলে দাগ কেটে বললেন, জাহাজ এখন এখানে আছে। যদি বড় রকমের ঝড়ে পড়ে না যাই নেক্সট ফ্রাইডেতে বন্দর পেয়ে যাব।
চিফ-মেট বলল, সেই যেন হয় স্যার!
স্যালি হিগিনস মুখ দেখে বুঝতে পারলেন চিফ-মেট ভীষণ আতঙ্কে ভুগছে। এ-সব সময়ে সবারই বাড়ি ঘরের কথা মনে হবার কথা। তিনি ‘চিফ-মেটের স্ত্রী এবং ছেলেপিলেদের কথা পাড়লেন। এবং বললেন, তোমরা নিশ্চিত থাকতে পার আমরা ঠিক ঠিকই যাচ্ছি। ট্রানসমিটারে কোথাও কোনো গণ্ডগোল হয়েছে। আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।
কেবিনে খুব কম-পাওয়ারের আলো জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে। খুব স্বাভাবিক দেখাচ্ছে না কাউকে। স্যালি হিগিনস দু’ গ্লাসে সামান্য মদ ঢেলে নিলেন। বললেন, খাও।
চিফ-মেট প্রায় সবটাই খেয়ে ফেলল একসঙ্গে।
স্যালি হিগিনস বললেন, ডেবিড কি করছে?
—জানি না স্যার।
—চল সব ঘুরে ঘুরে দেখা যাক। ভাল কথা, ডেক-জাহাজি কাউকে পেছনে ডিউটি দিয়ে দাও। এখন চারপাশে লক্ষ্য রাখা দরকার।
চিফ-মেট বলতে পারত, ফরোয়ার্ড পিকে যখন ওয়াচ রয়েছে তখন আফটার-পিকে গিয়ে কি হবে? কিন্তু সে জানে তিনি না বুঝে কিছু বলেন না। সে বলল, এক্ষুনি খবর পাঠাচ্ছি তবে। এবং ডেক- সারেঙ এলে বলল, পিছিলে ওয়াচ রাখবে। লক্ষ্য রাখবে দূরে কিছু দেখা যাচ্ছে কিনা।
এবং স্যালি হিগিনস, চিফ-মেট আর ডেবিডকে নিয়ে বের হয়ে পড়লেন। জাহাজের আলোগুলো যেন তেমন জোর নয়। চারপাশে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কেবল গোটা জাহাজটা অন্ধকারে প্রবল বেগে ধেয়ে চলছে। নিচে বাংকার। কোল-বয় কেউ হবে জোরে জোরে নিচে কয়লা ফেলছে। মেডিসিন- কার টেনে নিয়ে যাচ্ছে আসছে তার শব্দ। ব্রীজে তখন কাঁচের ভেতর পায়চারি করছে থার্ড-মেট। কম্পাসের সামনে হুইল ধরে আছে মহসীন। তিনি প্রায় সবাইকে অভয় দিতে যেন বের হয়েছেন। নেভী ব্লু স্যুট এবং উজ্জ্বল সোনালী বোতাম, কালো স্যু পায়ে কাঁধে চার-চারটা স্ট্রাইপ। ব্যাণ্ড বাজলে মনে হতো তিনি এখন কোনো যুদ্ধজাহাজ চালিয়ে নিচ্ছেন। সামনে শত্রুপক্ষের জাহাজ।
জাহাজে যেহেতু মাত্র চার-পাঁচজন জানে, একটা কোথাও কিছু গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে জাহাজে এবং মনে হয় সেই হেতু অন্য সবাই খুব স্বাভাবিক। অন্তত স্যালি হিগিনস বয়লার-রুমে নেমে এটা বিশেষভাবে টের পেলেন।
ছোট-টিণ্ডালের ওয়াচ। সে উইণ্ড-সেলের নিচে বসে স্টিম-গেজের কাঁটা দেখছিল। অসময়ে কাপ্তানকে দেখে সে হৈ-চৈ বাধিয়ে দিল। জোরে কয়লা মারতে বলল সবাইকে। কাপ্তানকে বলল, গুড-নাইট স্যার।
কাপ্তান ওর কথা বেশ দূর থেকে শুনেছেন, এবং বেশ সহজভাবে তাকিয়েই বললেন, গুড-নাইট। তিনি এই যে বয়লার-রুমে নেমে এসেছেন এবং এবার এনজিন-রুমে ঢুকে যাবেন, হয়তো দেখবেন, চার-নম্বর ঝুঁকে আছে টেবিলে, কারণ সে তো জানে না, জাহাজে এখন নানাভাবে সব দুর্ঘটনার খবর আসছে এবং সামনে কোথায় কি আছে সমুদ্রে কেউ বলতে পারছে না। অর্থাৎ যখন বার বার বেতার- সংকেত পাঠিয়েও কিছু জানা যাচ্ছে না তখন হয়তো অলৌকিক কিছু ব্যাপার সমুদ্রে ঘটে যাচ্ছে। অলৌকিক না বলে ভৌতিক বলাই ভাল। অথবা লুকেনার, সেই প্রাচীন নাবিকের অদৃশ্য আত্মার ছলনা হতে পারে, জাহাজে দীর্ঘদিন কাজ করলে এ-সব বিশ্বাস করতে ভাল লাগে। এবং যখন কোনো হদিস নেই কিছুর সব সংযোগ বিচ্ছিন্ন তখন আর কি ভাবা যায়! কলকব্জা সব ঠিক অথচ ভৌতিক সব কোলাহল, কি যে ব্যাপার—এবং অসময়ে নামা বোধ হয় ঠিক হল না। কারণ তিনি অসময়ে নেমে এসেছেন বলে সবাই কেমন সংশয়ের দৃষ্টিতে ওঁকে দেখছে। তিনি খুব স্বাভাবিক গলায় চার-নম্বরের সঙ্গে কথা বললেন। চার-নম্বর খুব সহজে ব্যাপারটাকে মেনে নিতে পারল না—কেউ ঠিক ঠিক কাজ না করলে কাপ্তান সেকেণ্ড এনজিনিয়ারকে ডেকে পাঠাতে পারতেন, জাহাজে এটাই নিয়ম অথচ অসময়ে চিফ-মেট, ডেবিড এবং স্বয়ং কাপ্তান নিজে। সে পেছন থেকে ডেবিডের হাত ধরে ফেলল। কাপ্তান এবং চিফ-মেট তখন লাফিয়ে সিঁড়ি ভাঙছেন। সময় বুঝে চার নম্বর বলল, কি ব্যাপার! হঠাৎ কৰ্তা নিচে নেমে এলেন!
ডেবিড হয়তো বলেই ফেলত, আমরা ক্রমে এক রহস্যের ভেতর ঢুকে যাচ্ছি। কিন্তু সামলে নিল নিজেকে। বলল, সব কর্তার মরজি। ঘুম আসছে না—বুড়ো মানুষ, ঘুম এমনিতেই কম, কি খেয়াল হল, বলল, জাহাজটা ঘুরে দেখব চল! ঘুরছি।
ডেবিড আর বেশী কথা বলল না। কি বলতে শেষে কি বলে ফেলবে! সে তাড়াতাড়ি সিঁড়িতে উঠে গেল। অনেক পেছনে পড়ে গেছে। এত পেছনে পড়ে গেলে কর্তার গোঁসা হতে পারে। সে সিঁড়ি ভেঙে দ্রুত ওপরে উঠে গেল। এবং হাত নেড়ে বাই বাই করল চার-নম্বরকে। ভালো থাকো, কোথায় যচ্ছো জনো না, না জানাই ভাল। কিছু হলে হঠাৎ কিছুর সম্মুখীন হবে, আমাদের মতো সেই সকাল থেকে দগ্ধাবে না। বেশ আছো, ভালো আছো।
ওপরে উঠে দেখল, সিউল-ব্যাংক অন্ধকারের ভেতর আলোর মালা পরে যেন দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশে সীমাহীন জলরাশি, টেরই পাওয়া যাচ্ছে না। জাহাজটা চলছে না থেমে আছে বোঝা যাচ্ছে না।
ডেবিডের বুকটা ছাঁত করে উঠল। চোখের ওপর এটা কি দেখছে! জাহাজটা আর সে-জাহাজ নেই। ভাঙা এবং বুড়ো জাহাজ, অথচ সেজে আছে যুবতীর মতো। কিছুতেই পুরানো হতে চাইছে না। জাহাজের সব আলো কেউ আজ জ্বালিয়ে দিল। কোথাও কোনো অন্ধকার নেই। ডেকে যেন উৎসব হবে, না হলে সব আলো, যেমন করিডোর ধরে গেলে যত অলোর ডুম, সব জ্বালা হয় না কখনও অথচ এখন জ্বলছে। যেমন উইংসের দু-পাশে যেমন ডেরিকের গোড়ায় এবং গ্যালির দু- পাশে ক্রু-গ্যালির ছাদের নিচে অর্থাৎ সর্বত্র এমনভাবে সব আলো জাহাজে জ্বলছে, অথচ ওরা যখন এনজিন-রুমে নেমে যাচ্ছিল তখন জাহাজের সব আলো এভাবে জ্বালা ছিল না। জ্বালা থাকলে সে এতটা বিভ্রান্তির ভেতর পড়ে যেত না। কেবল মনে হচ্ছে, স্যালি হিগিনস সমস্ত জাহাজটা ঘুরে দেখবেন বলে সহসা কেউ সব আলো জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। সামান্য অন্ধকারের ভেতর জাহাজে নিশীথে হাঁটতে গা ভারি ছম ছম করে।
আর তা ছাড়া এখন তো তারা আর কোনও কথা বলতে পারছিল না। ক্রু-গ্যালির দিকে যখন হিগিনস হেঁটে যাচ্ছিলেন তখন ডেবিড জাহাজের পাশে দাঁড়িয়ে একটু অন্ধকারে উঁকি মারবে ভেবেছিল। উঁকি দিয়ে দেখবে, সমুদ্রের জল কেটে জাহাজ সত্যি এগুচ্ছে না ভুতুড়ে দরিয়ায় জাহাজটা থেমে আছে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি ওরা হেঁটে যাচ্ছে এত বেশী দ্রুত ওরা ডেক পার হয়ে গেল যে ডেবিড একা ডেকের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে সাহস পেল না। সে প্রায় দৌড়ে ওদের নাগালে চলে গেলে। জাহাজটা এভাবে এত কিম্ভূতকিমাকার এবং আকাশে নক্ষত্রেরা এত স্থির যে ডেকে একা দাঁড়িয়ে থাকলে ভয়ে এমনিতেই মরে যাবে। সাদা ফ্যাকাশে হয়ে যাবে। যেন কেউ ওর শরীর থেকে সব রক্ত শুষে নিয়ে ডেকে ফেলে রেখে গেছে মনে হবে। এবং এমন যে জাহাজে কখনও না হয়েছে তা নয়।
সে প্রায় দৌড়ে ক্রু-গ্যালির ছাদের নিচে চলে গেল। আগে আগে স্যালি হিগিনস, চিফ-মেট। কি যে কেবল দেখে বেড়াচ্ছে! ডেক-সারেঙ খবর পেয়ে নিচে থেকে উঠে এসেছে এবং সালাম জানাচ্ছে। স্যালি হিগিনস কিছুই লক্ষ্য করছেন না। তিনি ঝুঁকে এখন সুমদ্রে কি দেখছেন। ডেবিড সঙ্গে সঙ্গে সময় বুঝে রেলিঙে ঝুঁকে পড়ল। দেখল প্রপেলার ভীষণভাবে গজাচ্ছে। জাহাজ খালি বলে নীল জলে প্রপেলার অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কুয়াশার মতো মনে হয়। প্রপেলার ঠিক ঠিক ঘুরে যাচ্ছে। জাহাজ থেমে নেই। ওর কিছুটা এখন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার মতো।
সে আবার ঠিক সহজভাবে হেঁটে যেতে থাকল। বরং হাঁটা-চালায় সে নিজেকে বেশী সাহসী প্ৰমাণ করার জন্য কিছুক্ষণ একা ডেকে দাঁড়িয়ে পাইপ টানল। যেন পৃথিবীতে সাহসী মানুষের মতো বেঁচে থাকা দরকার। আর দুরে তখন লেডী-অ্যালবাট্রস উড়ছে। কখনও জাহাজের মাস্তুলে এসে পাখা ঝাপটাচ্ছে, কখনও ওর কর্কশ চিৎকার ভেসে আসছে বাতাসে। অন্ধকারে মনে হবে কেউ গলা ছেড়ে কাঁদছে। এমন সব কর্কশ আওয়াজ যেন ওরা কখনও শোনে নি। লেডী-অ্যালবাট্রস কি টের পেয়েছে জাহাজের সামনে কোন কঠিন বিপদ এবং যদি জাহাজডুবির আশঙ্কা থাকে, অর্থাৎ সেই যে অন্ধকার সমুদ্রে সহসা কোনো বেতার-সংকেত থাকে না, সহসা দেখা গেছে, কোথাও কোনো চুম্বকের আকর্ষণে তলিয়ে যাচ্ছে জাহাজ কিম্বা কোনো অগ্নুৎপাতে পড়ে গেলে কারণ এই সমুদ্রের সীমাহীন জলরাশির নিচে অজস্র এমন সব অদৃশ্য ভয়, আর এও তো ঠিক যদি সেইসব সমুদ্রের প্রাগৈতিহাসিক জীবেরা কখনও সমুদ্রের সারফেসে চলে আসে, সময় বুঝে যদি টেনে নিচে নামিয়ে নিয়ে যায়, অথবা যে সব অলৌকিক ঘটনা সমুদ্রে মাঝে মাঝে দেখা যায়, যেমন একবার ডেবিড দেখেছিল, সমুদ্রের নিচ থেকে এক অগ্নিস্তম্ভ আকাশে উঠে যাচ্ছে, যেমন সে এটা কত দেখেছে, জলরাশির ভেতর অজস্র নক্ষত্র টুপটাপ যেন ঝরে পড়ছে। অর্থাৎ সমুদ্রে নিশীথে ডেকে দাঁড়িয়ে থাকলে এমন সব বিচিত্র অভিজ্ঞতা না হয়ে পারে না, তখন বেতার-সংকেতে গণ্ডগোল তেমন কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। সে অনায়াসে কেবিনে ঢুকে এখন একটু ঘুমিয়ে নিতে পারে। সে এবার গিয়ে শুয়ে পড়বে ভাবল। সে খুব সাহসী মানুষ ঘুমিয়ে প্রমাণ করবে।
আর তখনই মনে হল মাস্তুলের নিচে কেউ বসে রয়েছে। সে লক্ষ্যই করে নি, কেউ এত রাতে মাস্তুলের নিচে বসে থাকতে পারে। এবং এভাবে কেউ মাস্তুলের নিচে বসে থাকলে ভয়ের কথা সে কাছে গিয়ে দেখল, বড়-টিণ্ডাল চুপচাপ বসে রয়েছে। ডেবিডকে দেখেও ওঠে দাঁড়াচ্ছে না। সে ডাকল, এবং ডাকলে বড়-টিণ্ডাল ঠিক সাড়া দিল, বলল, স্যার আপনি! ঘাবড়ে গিয়ে বলল, আমার এখন ওয়াচ।
—ওয়াচ! এখন তো নেকস্ট ওয়াচ আরম্ভ হতে আরও এক ঘণ্টার ওপর। এত আগে উঠে বসে আছ!
—স্যার নিচে ভীষণ গরম। গরমে ঘুমোতে পারছি না।
.
মৈত্র এবার উঠে দাঁড়াল। সে ওয়াচের পোশাক পরে আছে। হাতে দস্তানা। মাথায় কিছু ওর গণ্ডগোল ছিল। বন্দর থেকে জাহাজ ছাড়ার সময় অজস্র শিশুদের বেলুন উড়িয়ে দেওয়া, ওয়াকা বলে একজন মাউরি বালকের অবিরাম ব্যাণ্ড বাজিয়ে যাওয়া এবং বড়-টিণ্ডাল সেই যে ডেকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ওদে বিদায় জানিয়েছিল সব এখন মনে পড়ছে। বড়-টিণ্ডালকে বন্দরে রাজার মতো লাগছিল। এখন সেই বড়-টিণ্ডাল কেমন দুঃখী মানুষ। মাস্তুলের নিচে হেলান দিয়ে বসে আছে। বোধ হয় সে ঝিমুচ্ছিল। অথবা আকাশের নক্ষত্র দেখতে সে এখন ভালবাসছে। এভাবে তার স্ত্রীর কথা সে মনে করতে পারে হয়তো, হয়তো এইসব নক্ষত্র দেখতে দেখতে সে প্রায় সব শিশুদের কথা মনে করতে পারে—ফোকসালে শুয়ে থাকলে সে বোধ হয় কিছু মনে করতে পারে না, মাস্তুলের নিচে এসে সে- জন্য ওয়াচের অনেক আগে বসে থাকে। সে নিজের সঙ্গে জাহাজের সঙ্গে এভাবে ভেসে ভেসে যায়।
ডেভিডআর দাঁড়াল না। শুয়ে পড়বে ভেবেছিল, কিন্তু ওয়াচের খুব আর একটা দেরীও নেই। পাশের কেবিনগুলোতে পাঁচ-নম্বর, স্টুয়ার্ড এবং ছোটবাবু সবাই ঘুমোচ্ছে। ওরা বুঝতেই পারছে না বেতারে সব রহস্যজনক খবর আসছে। সে ভাবল, আরও কিছুক্ষণ জেগে থাকবে। তার ওয়াচের সময় চিফ- মেট কাপ্তান জেগে থাকবেন কিনা সে জানে না। সে যদি একা হয়ে যায়। সে একা ব্রীজে! রেডিও- অফিসার ওপরে থাকবে হয়তো, যতক্ষণ কোনো সঠিক খবর না পাচ্ছে ততক্ষণ রেডিও-অফিসার নড়তে পারছে না ভেবে ডেবিড কিছুটা আশ্বস্ত। কারণ স্যালি হিগিনসের মতো এই সব বুড়ো কোয়ার্টার- মাস্টারগুলো হাড়ে হাড়ে বজ্জাত। এদের ঠিক বিশ্বাস করা যায় না। রাতের বেলা মাঝে মাঝে ভীষণ সংশয়ের ভেতর ফেলে দেয়। ভেতরে প্রাণ আছে বোঝা যায় না, ঠিক একটা মমির মতো। অনেক সময় সে দেখেছে ডাকলেও সাড়া দেয় না। সুতরাং ভরসা মাত্র রেডিও-অফিসার। ও কি আর এখন মানুষ আছে? ওর চোখমুখ দেখলেই ভয় লাগছে! ওর মুখচোখ কি সাদা আর ফ্যাকাশে! তবু জাহাজে, একা ব্রীজে যখন সে ডিউটিতে থাকবে, অন্তত একজন তার মাথার ওপরে মাংকি-আয়ল্যান্ডে জেগে থাকবে। তার ভয়ে ঘাবড়ে যাবার কিছু নেই।
আর সে ঠিক যা ভেবেছিল তাই। ডিউটির সময় সে দেখল, স্যালি হিগিনস ধার্মিক নাগরিকের মতো বলছে, চিফ-মেট তুমি বরং একটু ঘুমিয়ে নাও। আমি আছি। আর চিফ-মেট চলে গেলে হিগিনস বললেন, ডেবিড দরকার হলে ডাকবে। দরজা বন্ধ করে দিলেন তিনি। এবার বোধ হয় তিনিও শুয়ে পড়লেন। সে বলল, হারামী।
মনে মনে হারামী কথাটা কতবার যে ইতিমধ্যে আর্চিও উচ্চারণ করেছে। সে সেই সকাল থেকে ভাবছে, ভাবতে ভাবতে মাথাটা ভার এবং প্রায় ঝিম ঝিম করছে। এবং রাত হলেই শরীরের রক্তপ্রবাহ ভীষণ অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। গেল রাতে সে ভেবেছিল, দরজায় শব্দ করলে, ছোটবাবুর কথা ভেবে ঠিক দরজা খুলে দেবে জ্যাক। খুলে গেলে তার আর যা যা করার ইচ্ছে যেমন সে ঢুকেই বলত, খুব দরকারে হঠাৎ এসে গেলাম জ্যাক, তোমার ঘুমের কোনো অসুবিধা ঘটালাম না তো? সে এভাবে জ্যাকের সঙ্গে অসময়ে দেখা করে প্রাণপণ বোঝাতে চাইবে, তার কিছু খারাপ ইচ্ছে নেই। যদিও সে দু’ একবার বলবে, জ্যাক তুমি যে মেয়ে আমি আগেই টের পেয়েছি, আসলে জাহাজে আমার মতো তোমাকে কেউ বুঝতে পারে নি, কাপ্তান ভীষণ খারাপ কাজ করছেন, এ-ভাবে আর কতদিন তুমি থাকবে, জাহাজে একজন মেয়ে যদি থেকেই যায়, আহা যদি থেকেই যায়, জ্যাক আসলে মাথা আমারও ঠিক নেই, কেমন গন্ডগোল হয়ে যায় তোমাকে ভাবতে ভাবতে এবং তখন কোনটা করা ঠিক, কোনটা করা ঠিক না, বুঝতে পারি না। তুমি চিৎকার চেঁচামেচি করতে পার, কিন্তু ওপরে কেউ শুনতে পাবে বলে মনে হয় না। আমি অবশ্য এমন কিছু করব না, যে তোমাকে চিৎকার চেঁচামেচি করতেই হবে, শেষ পর্যন্ত বন্ধুত্ব যদি করে ফেলি, এই ধর তোমার খবরটুকু শুধু আমি রাখব আমার-টুকু, তুমি, আহা মুখ সরিয়ে নিচ্ছ কেন, তোমার কোমরে হাত রাখতে দাও, দ্যাখো না, নাভির নিচে, আহা কি যে গরম উলের মতো আরাম, আহা, কি হচ্ছে, আমি বুঝি দেখিনি—তুমি সেই ম্যানকে চুমো খেয়েছ, চিৎকার চেঁচামেচি করলে সব ফাঁস
করে দেব।
সে টুক করে দরজা খুলে ফেলল। সন্তর্পণে গলা বাড়িয়ে দেখল, এলি-ওয়ে ধরে কেউ হেঁটে যাচ্ছে কিনা। না, কেউ নেই। কেবল কে যেন এলি-ওয়েতে আজ সব উজ্জ্বল আলো জ্বালিয়ে রেখে গেছে। এত জোর আলো সাধারণত কখনও থাকে না। বাইরে বের হয়ে সে আলো সব নিভিয়ে দিল। অন্ধকারে কিছুক্ষণ প্রায় দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বুঝল সহজেই ওপরে উঠে যাওয়া যায়, সে আর দেরি করল না। ছোটবাবুর কেবিনের পাশ কাটিয়ে সিঁড়ির মুখে যেতে হবে। ওর এত কাছে সিঁড়ির মুখ, অথচ মনে হচ্ছে পথটা অনেক লম্বা আর বড় হয়ে গেছে। এক দৌড়ে সে কিছুতেই সেখানে পৌঁছাতে পারবে না।
তারপর কি ভেবে সে খুব সহজ হয়ে গেল। সে এত বেশি ভয় পাচ্ছে কেন? সে তো অনায়াসে মধ্যরাতে এনজিন-রুমে নামার জন্য স্বাভাবিকভাবে সিঁড়ির মুখ পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারে। সে স্বাভাবিকভাবেই সিঁড়ি পর্যন্ত হেঁটে গেল। ছোটবাবুর কেবিনের পাশে দাঁড়িয়ে কান পাততে ইচ্ছে হল, যদি গোপনে জ্যাক ছোটবাবুর কেবিনে নেমে আসে। তা হলে যেন তুরুপের তাস। সহজেই হাতে পেয়ে যায়। সবার কাছে সে গোপন রাখবে, জাহাজে কোন মেয়ে নেই। কোন ভালবাসা নেই। কেবল বিনিময়ে সে বাকি সফর যুবতীকে নিয়ে ফূর্তি করে যাবে। এবং যেন এই ফূর্তি তার হকের। সে যেমন বন্দরে নেমে মেয়েদের শরীরে তার হক খুঁজে পায়, জাহাজে তেমনি মাত্র ফুটে ওঠা কুঁড়ির পাপড়ি ছিঁড়ে খেতে খেতে যুবতী তার হকের ধন ভেবে ফেলেছে। তার প্রাপ্য সে বুঝে নিতে যাচ্ছে অথবা বুঝতে পারবে সে আর আহাম্মক নয়। এবং শরীরে কামুক গন্ধ তার। সে যথাযথ বিষয়ী মানুষ হয়ে গেছে বুঝতে পারবে। জাহাজে বালিকা যুবতী হবে, আর সে চিৎপাত হয়ে পড়ে থাকবে জাহাজে, আঙ্গুল চুষবে কেবল, তেমন মানুষ সে নয়। চোখের ওপর এমন ভোগ্যপণ্য বে-হাত হয়ে যাবে সে ভাবতে পারে না।
আর বোধ হয় এ-ভাবেই সব মানুষ সব কাজের পেছনে যুক্তি খাড়া করে থাকে। আর্চিও এটা যুক্তিযুক্ত কাজ ভেবেছে। কারণ সে দেখেছে ভাল কথায় মেয়েটি সব সময় চোখ ত্যারচা করে থাকে, তাকে গঙ্গাবাজুতে দেখলে, মেয়েটা যমুনা-বাজুতে পড়ি মরি করে ছুটতে থাকে—সে আর এ-ভাবে কতক্ষণ পারে? সে তো একটা মানুষ? ফুল ফুটবে, সে গন্ধ শুঁকবে না কি করে হয়!
আর তখন ছোটবাবু নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। দেখে কে বলবে কেবিনে দুরন্ত বালিকা যুবতী সেজে ওর জন্য অপেক্ষা করছে। বরং দেখে মনে হবে ছোটবাবুর কোথাও যাবার কথা নেই। ঘরে সবুজ আলো। বুকের ওপর ওর দু-হাত কিছুটা প্রার্থনার মতো। নীল দাঁড়ি সবুজ আলোর ভেতর মিহি ঘাসের মতো নরম। ওর চোখ ভারি। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। পাখার হাওয়া এত প্রবল যে, ঘাম হবার কথা নয়, কিন্তু কেন জানি দেখে মনে হবে ছোটবাবু স্বপ্ন দেখছে। ছোটবাবু এত রাত পর্যন্ত বোধ হয় জেগে থাকতে পারে না। সে ঘুমোবার আগে কেবল ভাবছিল কখন ডেবিডের ওয়াচ আরম্ভ হবে। ডেবিডের ওয়াচ আরম্ভ হলেই কথা থাকে কাপ্তান তার কেবিনে ঘুমিয়ে পড়বেন। তখন দরজায় সামান্য কড়া নাড়া। সে কড়া নাড়লেই দেখবে বনি ফ্রক গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। এমন সর্ব মুহ্যমান দৃশ্যের কথা সে কেবল শুয়ে শুয়ে ভাবছিল, আর ঘড়ি দেখছিল। সে কি করবে অথবা কি ভাবে কথা বলবে বনির সঙ্গে, যেমন বনিকে বলা যেতে পারে, আচ্ছা বনি তোমাদের বাড়ির পাশে আমার কেন জানি মনে হয় খুব বড় একটা বন আছে। তোমাকে দেখলেই মনে হয়, বনের ভেতর তুমি খেলা করে বেড়াতে, সামনে সমুদ্র, দূরে বাতিঘর—বনের গাছাপালার ভেতর অজস্র পাখি আছে মনে হয়। রঙিন পাখিরা কখনও ঝাঁকে ঝাঁকে তোমার মাথার ওপরে উড়ে যাচ্ছে অথবা মনে হয় কখনও বালিয়াড়িতে তুমি দাঁড়িয়ে আছ, তোমার পায়ের পাতা জলে ডুবে আছে, ছোট ছোট মাছেরা খেলছে তোমার চারপাশে, জলে কখনও ফ্রক ভিজে যাচ্ছে, কখনও ফ্রক উড়ে যাচ্ছে বাতাসে, আবার মনে হয় তুমি চুপি চুপি দেখছ পাহাড়ের কোলে বসে আমি কি করছি, তোমাকে যুবতী ভাবলেই আমার এমন মনে হয়, যেন কতকাল থেকে তুমি কোনো ফুলের উপত্যকাতে হেঁটে বেড়াচ্ছ। কারো আসার কথা, তুমি ফুলের ভেতর অথবা ঘাসের ছায়ায় নিজেকে দেখতে দেখতে কখন বড় হয়ে গেছ টের পাও নি।
ছোটবাবুর আরও কি সব মনে হয়। তখন চোখ মুখ ওর জ্বালা করতে থাকে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়তে থাকে। কারণ সুন্দর মায়াবী শরীর বনির। লম্বা দু’হাত কারুকার্যময় ব্যালেরিনার মতো। ছোটবাবু বইয়ে সুন্দর সুন্দর সব ব্যালেরিনার ছবি দেখেছে, একেবারে দু’হাতে যেন দু’আকাশের সবকিছু নক্ষত্র সে পেড়ে আনতে চায় অথবা কখনও যখন মনে হয়.বনি দু’হাতে আবার সব নক্ষত্র আকাশের গায়ে লটকে দিচ্ছে তখন ওর পা এবং জংঘা, জংঘার পাশে কোমল অভিমানিনী তার, উজ্জ্বল সমুদ্রের তরঙ্গমালার মতো। ধেয়ে আসছে, প্রবল বেগে ধেয়ে আসছে। যেন ছোটবাবুকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, দূরে অনেক দূরে নিজের মতো নির্জন দ্বীপে তাকে নিয়ে কেবল ঘুরে ঘুরে কোনো পাহাড়শীর্ষে উঠে যাওয়া। এবং উঠেই যেন বলছে, আমি ঝাঁপ দিই ছোটবাবু। তুমি আমাকে তুলে আনবে। আর তো
আমার মরে যেতে ভয় করে না।
ছোটবাবুর বলতে ইচ্ছে হয়, মরে যেতে ভাল লাগে তোমার! –
—জানি না কেন মরে যেতে এত ভাল লাগে।
আসলে এখন ছোটবাবু বুঝতে পারে ওকে সামান্য জড়িয়ে ধরলেই আর ওর মরে যেতে ইচ্ছে করবে না। বুকের ভেতর মুখ লুকিয়ে বলবে, এই।
–কী!
—তুমি খুব খারাপ।
ছোটবাবুর তখন ইচ্ছে হয়, সে আরও দুষ্টুমী করে ফেলবে। কিন্তু তারপরই মনে হয়, সে তো বনির কেউ নয়, বনি কাপ্তানের মেয়ে, জাহাজ দেশে ফিরে গেলেই সে নেমে যাবে। হয়তো বনি হাত নাড়বে ডেক থেকে। চোখে বিন্দু বিন্দু জল। এবং তখন বনি ওর দিকে সোজা তাকাতে পারবে না। তখনই মনে হয় সেও ফুল ছিঁড়ে খেতে ভালবাসে। নিজেকে ভারী নষ্ট চরিত্রের মানুষ সে ভেবে ফেলে। এমন পবিত্র আকাঙ্ক্ষা অথবা ফুলের মতো তাজা প্রাণ সে বিনষ্ট করতে পারে না।
যদিও বিনষ্ট কথাটার সঠিক অর্থ সে এখনও ভালভাবে বুঝে উঠতে পারে না। তখনই বড় বড় হাই উঠতে থাকে, কেমন যেতে ইচ্ছে করে না আর ওপরে। ঘুমিয়ে পড়তে কেবল ভাল লাগে। অকারণ সে ফুল ছিঁড়ে খেতে পারে না।
এটা যে সংস্কার অথবা প্রাচীন গাঁথার মতো শরীরে আজন্ম লেপ্টে আছে—ছুঁয়ে দিলেই নষ্ট হয়ে যায় না, সে যদি জানত এবং বুঝতে পারত এ-সবে নষ্টামি বলে কিছু নেই বরং পবিত্রতা আছে, সে কিছুতেই ঘুমিয়ে পড়তে পারত না।
তখন আর্চি কেবিনের চারপাশে সন্তর্পণে হাঁটছে। সব দেখেশুনে সে দরজায় দাঁড়াবে।
তখন রেডিও-অফিসার প্রায় উবু হয়ে বসে আছে। কোনো খবর, অথবা আগুন আগুন এমন সব ভৌতিক গন্ডগোল থেকে যদি জাহাজটা রক্ষা পায়।
তখন ডেবিড প্রায় গভীর অন্ধকার সমুদ্রে তাকিয়ে আছে। চুপচাপ। তাকেই এখন কাঁচের জারে মমির মতো দেখাচ্ছে। সুতরাং আর্চি জ্যাকের দরজায় দাঁড়াতে পারে এবার। খুট খুট করে দরজায় শব্দ করতে পারে।
এবং কান পেতে থাকল আর্চি। নিচ থেকে এনজিনের শব্দ উঠে আসছে—কতটা জোরে অর্থাৎ সে কতটা জোরে কথা বললে অথবা জ্যাক কতটা জোরে কথা বললে ওপরে কাপ্তান জেগে যাবে না, যেন সেটা সে আন্দাজ করছে। সমুদ্রে ঝড়ো হাওয়া নেই। সামান্য হাওয়াতে যেমন সমুদ্র উত্তাল থাকার কথা এবং যে-ভাবে সব শব্দ সমুদ্রে তৈরি হয়—তার চেয়ে বেশি না, সে বুঝতে পারল এই ঠিক সময় এবং এমন ভেবে দরজায় দাঁড়িয়ে যেই খুট খুট শব্দ তখনই সমুদ্রে অগ্নিকান্ড। মুহূর্তে সারা আকাশ যেন আলোকিত হয়ে গেল, চারপাশে সমুদ্র লাল হয়ে গেছে। একেবারে কাছাকাছি একটা জাহাজে আগুন জ্বলছে। ধোঁয়া এবং পোড়া তেলের গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল। ডেবিড চিৎকার করতে করতে নেমে আসছে। আফটার পিকে ঢং ঢং করে এলার্মিং বেল বাজিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যে যেখানে ছিল লাইফ- জ্যাকেট পরে উঠে আসছে। আর্চি দেখল স্যালি হিগিনস ব্রীজে উঠে যাচ্ছেন। চিফ-মেট সিঁড়ির মুখে উঠে আসছে। সে তাড়াতাড়ি প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে নিচে পালিয়ে যেতে থাকল। সমুদ্রে এমন ভয়াবহ অগ্নিকান্ড পর্যন্ত তাকে বিস্মিত করতে পারল না। সে উন্মত্তের মতো ছুটে যাচ্ছে নিচে। জোরে যতটা জোরে সম্ভব লাথি মারছে ছোটবাবুর দরজায়। হাঁকছে, লেজি বাগার। যেন ছোটবাবুই সময় বুঝে সুমদ্রে অগ্নিকান্ড এবং তার বাড়াভাতে ছাই দিয়েছে।
ছোটবাবু দরজা খুলে বিস্মিত। আর্চি সামনে। সে ভেবেছে সকাল হয়ে গেছে। কাজের সময় হয়ে গেছে। আর্চি তাকে সে-জন্য গালাগাল করছে। সে বলল, গুডমর্নিং স্যার।
আর্টি বলল, গুডমর্নিং। এবং তারপর কেমন অমায়িক হয়ে গেল কথাবার্তায়। তুমি ম্যান ঘুমোচ্ছ! তুমি তো আচ্ছা লোক হে! জাহাজে আগুন লেগেছে জান না।
তাহলে জাহাজে কিছু ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে! এখনও এলার্মিং বেল বাজছে। সে তাড়াতাড়ি লাইফ- জ্যাকেট গায়ে জড়িয়ে নিল। এবং তখন দেখতে পাচ্ছে জ্যাক হাঁপাতে হাঁপাতে নেমে আসছে নিচে। সেই কাউ-বয়দের মতো পোশাক। শরীরে তার সোনালী লাইফ-জ্যাকেট। আর্চি ভীষণ খুশী যেন আর কি জ্যাক এসে গেছে! সে কত অমায়িক এমন দেখানোর জন্য বলল, তোমরা ওপরে যাও, আমি যাচ্ছি। বলেই সে প্রায় ছুটে কেবিনের দিকে চলে গেল।
ছোটবাবু বলল, কি হয়েছে জ্যাক। এলার্মিং বেল বাজছে! বলেই সে ওপরে ছুটে যেতে চাইলে জ্যাক খপ করে হাত ধরে ফেলল। এখন যে যার কাজে নিচে ওপরে ছুটছে। যেমন মেজ-মিস্ত্রি আর্চি নিচে নেমে গেছে। বোট ডেকে ডেক-জাহাজিরা জড়ো হচ্ছে। খুব চিৎকার চেঁচামেচি যখন এ-ভাবে হচ্ছিল তখন জ্যাক পাগলের মতো টলতে টলতে এলি-ওয়ের অন্ধকারে নিয়ে ছোটবাবুকে দাঁড় করিয়ে দিল। রাগে সে ফুঁসছে। আঁচড়ে কামড়ে দিচ্ছে ছোটবাবুকে। ছোটবাবু যত বলছে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বনি তত আরও ক্ষেপে যাচ্ছে। তারপর ঠিক পোকামাকড়ের মতো লেপ্টে যাচ্ছে শরীরে। ছোটবাবুর ঠোটে গালে কপালে পাগলের মতো চুমো খাচ্ছে জোর-জার করে। ছোটবাবু হতভম্ব। সে বাধা পর্যন্ত দিতে পারছে না! এমন একটা ভয়াবহ অগ্নিকান্ড সমুদ্রে, আর বনি এটা যে কি ছেলেমানুষী করছে!