1 of 2

অলৌকিক জলযান – ৩৬

।। ছত্রিশ।।

আর্চি-র ঘুম আসছিল না। সে আজ এক ফোঁটা মদ পর্যন্ত খায় নি। সে মদ খেতে পারত, মদ খেলে এক সময় সে ঘুমিয়ে পড়তে পারত। সকালে ঘুম ভাঙলে সে আবার সব ভুলে যেতে পারত। ঘুম ভাঙলে রাতের সব জ্বালা কেমন মরে যায়।

নেশা করলে সে নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না। এবং তার মনে হয় মাঝে মাঝে নেশা না করে থাকলে সে ঠিক ঠিক যা ভেবে থাকে করে ফেলতে পারবে। সেজন্য জেগে থাকা। ঘড়িতে বারোটা বাজছে। একটা বাজছে। সে উঠে বসল। জাহাজের পিচিং বাড়ছে। নেশা না করে ভালই করেছে।

সে দরজা খুলে বের হয়ে পড়ল। টলে টলে হাঁটছে। পিচিং থাকলে জাহাজে ঠিকমতো হাঁটা যায় না। সমুদ্রে ঝড় ওঠার আশঙ্কা। বিকেলের দিকে রেডিও-অফিসার বলেছে, ঝড় উঠতে পারে।

গঙ্গাবাজুর গ্যাং-ওয়েতে সে নেমে গেল। রেলিঙে সে দাঁড়িয়ে থাকল। আকাশ অন্ধকার, সমুদ্রে কোনো প্রতিবিম্ব ভাসছে না। এবং চারপাশে এত বেশি অন্ধকার যে পাখিটা কোথায় কি ভাবে আছে সে বুঝতে পারছে না।

এ-জাহাজে একজন যুবতী এখন শুয়ে আছে। ঠিক যুবতী না, যুবতী হবার মুখে, ডাঁশা আপেলের মতো। আর্চির ঘুম আসছিল না। ওর চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে—ডেনজার এহেড্‌। পাখিটা অন্ধকারে উড়ছে না। কোথাও সে লুকিয়ে রয়েছে। যুবতী শুয়ে আছে, ওর হাত-পা গমের শীষের মতো পুষ্ট। আর্চি আর স্থির থাকতে পারছে না।

মনে হল কেউ আসছে। ওয়াচের লোক-টোক হবে। সে টুপ করে সিঁড়ির নিচে বসে পড়ল। এ সময় এভাবে চোরের মত ঘুরে বেড়ানো ঠিক না। দেখে ফেললে জাহাজিরা বলবে, আর্চি রাতে জাহাজে ঘুরে বেড়ায়! অহেতুক ঘুরে বেড়ানো ঠিক না। ভুতুড়ে জাহাজটা আরও তবে ভুতুড়ে হয়ে যাবে।

সিঁড়ি ধরে কোয়ার্টার মাস্টার নেমে গেল। হাতে মগ তার। চা করার জন্য চিফ-কুকের গ্যালিতে যাচ্ছে। সে এবার সামান্য পা চালিয়ে হাঁটল। তারপর ঠিক সোজা এলি-ওয়েতে ঢুকে গেল। বাঁ পাশের কেবিনগুলোর দরজা বন্ধ। লাল কার্পেটে ওর ছায়া দুলছে। সমুদ্রে পিচিং বাড়ছে। সামান্য ঝড় ঝঞ্ঝা সমুদ্রে সবসময় প্রায় থাকে। তার ওপর জাহাজ খালি। সমুদ্রে একটু বাতাস উঠলেই জাহাজের ভীষণ টাল-মাটাল অবস্থা। আর্চি দ্রুত এলি-ওয়ে পার হয়ে গেল। এবং ঠিক ছোটবাবুর দরজায় সে দাঁড়িয়ে গেল। চোখে-মুখে সংশয়। ভেতরে কেউ কথা বলছে না তো!

এটা আজকাল কি যে হয়েছে আর্চির। সংশয়, সে বুঝতে পারছে—ছোটবাবুর সঙ্গে জ্যাকের একটা হীন সম্পর্ক গড়ে উঠছে। এবং সে আর আজকাল এসব মনে হলে একেবারে স্থির থাকতে পারে না। প্রতিদিন ঈর্ষায় সে মদ খেয়ে বুঁদ হয়ে থাকে—আগের মতো ঝাল মেটাতে পারে না, কখনও কখনও সে আরও কি সব ভেবে পাগলের মতো কাজকর্ম করে ফেলতে চায়—কিন্তু সে জানে মাতাল মানুষেরা কিছু একটা শেষ পর্যন্ত করতে পারে না। সে এখন থেকে ভেবেছে মাতাল হবে না। এবং সে ঘুরে বেড়াচ্ছে যদি রাতে ছোটবাবুর কেবিনে জ্যাক নেমে আসে অথবা ছোটবাবু জ্যাকের কেবিনে উঠে যায়। সে একটা সুযোগের অপেক্ষায় আছে।

সে দরজায় কান পেতে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর সে দু’বার আস্তে টোকা মারল দরজায়। যদি কথা থাকে জ্যাক আসবে, টোকা মারবে, তবে রাসকেলটা ঠিক উঠে এসে দরজা খুলে দেবে। আর্চি আবার খুব ধীরে ধীরে দু’বার টোকা মারল। না, রাসকেলটা ভীষণ সেয়ানা। কিছুতেই ধরা পড়বে না অথবা হয়তো আজ কথা নেই কারো নামার। সে সন্তর্পণে হেঁটে যাচ্ছিল। কেউ টের পেলে সে খুব অস্বস্তির ভেতর পড়ে যাবে। দশটা ওজুহাত দাঁড় করাতে হবে সে কেন অসময়ে এভাবে জাহাজের অলি-গলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

আর্চি এবার দু-লাফে সিঁড়ি ভেঙে উঠে গেল। আর ঠিক ডানদিকে জ্যাকের কেবিন। পাশে ব্রীজে উঠে যাবার সিঁড়ি। সিঁড়ির মুখে কাপ্তানের ঘর। সে ওপরে উঠেই ডানদিকের উইণ্ড সেলের পাশে দাঁড়িয়ে গেল। ব্রীজ থেকে ওকে এখন কেউ দেখতে পাবে না। অথচ সে দেখতে পাচ্ছে ব্রীজে ডেবিড দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকার সমুদ্রে ঝুঁকে আছে ডেভিড। কাপ্তানের পোর্ট- হোলে অন্ধকার। বোধহয় শয়তানটা এখন আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছে। আর্চি আজ যেন প্রথম টের পেল ওপরে কাপ্তান এবং নিচে রাসকেলটা, মাঝখানে জ্যাক, কড়া পাহারা। বাতাসে গন্ধ শুঁকে শয়তানটা টের পেয়েছে কিছু। ঠিক সিঁড়ির গোড়ায় একটা দৈত্যকে পাহারায় রেখেছে। ওর চোয়াল সঙ্গে সঙ্গে শক্ত হয়ে গেল।

ধূর্ত বেড়ালের মতো আর্চির চোখ-মুখ জ্বলছে। সে ঘুরে বোটের দিকটায় হেঁটে গেল। এবং যেখানে সে দাঁড়িয়ে দেখেছিল জ্যাক হাত তুলে পা তুলে ব্যালেরিনার মতো নাচছে, ঠিক সেখানটায় দাঁড়িয়ে গেল। পোর্ট-হোল বন্ধ। পর্দা ঝুলছে। সে কিছু দেখতে পেল না আজ। তবু সে ভীষণ লোভে পড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। সে নড়ল না। দেয়াল ফুঁড়ে তার এখন ভেতরে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে অথবা নৃশংস ঘটনা ঘটে যায়, যদি সে কিছু একটা করে ফেলে নিজের জন্য এবং লালসা বলা যেতে পারে—হাতে পায়ে কী যে শীতল অস্থিরতা তার, যেন সারা শীরর কেবল জ্বলে যাচ্ছে, খাঁ খাঁ করছে। এবং সে এতই কামুক যে তার রক্ত-মাংসে অথবা অস্থিমজ্জায় কেবল সেই নরম মাংসের প্রলোভন। ক্ষুধার্ত বাঘের মতো সে হন্যে হয়ে ঘুরছে। ঘুরতে ঘুরতে নরম হরিণের মাংস দেখেছে সামনে ঝুলে আছে। চারপাশে কাঁটাতারের মতো বেড়া। ভয়ে সে আর এগুতে পারছে না।

অসহ্য রাগে এবং ঈর্ষায় আর্চি এখন ফুঁসছে।

তখনই দু’টো একটা বজ্রপাতের শব্দ। আকাশটা গুম গুম করছে। ফালা ফালা করে দিচ্ছে কেউ আকাশ। অথবা মনে হয় হিংস্র থাবা উঁচিয়ে আছে কেউ। সারা আকাশময় বিদ্যুতের আলো সূর্যের মতো প্রখর। চারপাশের অন্ধকার, মুহূর্তে সরে যাচ্ছে। আবার অন্ধকার এবং সাঁ সাঁ করে বাতাস, ঠিক বাতাস বললে ভুল হবে, প্রায় ঝড়ের সামিল, সাদা ফেনা সমুদ্রে এবং তরঙ্গ-সংকুল জলরাশির ভেতর আর্চি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টলছিল।

জাহাজটা জল কেটে যাচ্ছে। লাফিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে ঝড়ের সমুদ্র।

সহসা ঝড়টা মধ্যরাতে কেমন চাঙ্গা হয়ে উঠল। রেডিও-অফিসার হয়তো ট্রান্সমিটার-রুমে। আলোর ভেতর নানারকম না, ঘুরিয়ে ঝড়ের খবর দিচ্ছে। যদি ঝড় আরও বাড়ে, ঘণ্টায় ঘণ্টায় ঝড়ের খবর পাঠাতে হবে। এবং ঝড় যে তেমন প্রবল নয় এক পশলা বৃষ্টিপাতের ভেতর সেটা সে টের পেয়ে জ্যাকের দরজার দিকে হেঁটে যেতে থাকল।

আর তখনই সেই শয়তান পাখিটা যা ‘সে ভেবেছিল ঠিক লুকেনারের প্রেতাত্মা হবে, অদৃশ্য সেই প্রেতাত্মা একটা পাখির মতো মাথার ওপরে উড়ে যেতে থাকল। ঝড়ে পড়ে পাখিটা আনন্দে এমন করছে, না, সে সবাইকে জাগিয়ে দিতে চায়, আর্চি বুঝতে পারল না। পাখিটা সহসা আবার অদৃশ্য হয়ে গেল।

সে একটু সরে এসে পাখিটাকে খুঁজল। অন্ধকার। গভীর অন্ধকারে সে বুঝতে পারল না পাখিটা কোন দিকে উড়ে গেল। আবার কখন উড়ে আসবে মাথার ওপর সেটাও সে ঠিক জানে না। এবং কেন জানি মনে হল শুধু রাসকেলটাকেই কাপ্তান পাহারাদার রাখেনি, এই পাখিটাকেও সে পাহারাদার রেখেছে। জ্যাকের দরজায় হেঁটে গেলেই লুকেনারের প্রেতাত্মা ওর মাথার ওপর উড়ে এসে একটা পাখি হয়ে ভাসতে থাকবে। এবং কিছু করলেই চোখ খুবলে তুলে নেবে।

ঝড়-বৃষ্টিতে দু-একজন নাবিক তখন ভিজে ভিজে এনজিন-রুমে নেমে যাচ্ছে। কর্কশ শব্দ বজ্রপাতের। সাঁ সাঁ বাতাসে সমুদ্র কেমন উত্তাল, এবং মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকালে নীলাভ আলোতে আকাশ পৃথিবী আর সমুদ্র কেমন অতিশয় অলৌকিক। পাখিটা মাথার ওপর ভীষণ কর্কশ গলায় ডাকছে। সে ভয়ে কিছুতেই দরজার সামনে এগিয়ে যেতে পারল না। পাখিটার চোখ ভীষণ জ্বলছে। আর একটু এগুলেই অন্ধকার সমুদ্র থেকে পাখিটা সহসা উড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে। অতর্কিতে ওর দু’চোখ খুবলে তুলে নেবে। আর এক পা এগুতে সাহস পেল না। সে নিচে ফের নেমে গেল। এবং দরজা বন্ধ করে আয়নায় দাঁড়ালে বুঝতে পারল চোখে মুখে তীব্র ঘৃণা। সে হেরে যাচ্ছে। সে কিছুতেই কিছু করে উঠতে পারছে না। আসলে ঝড়ে পড়ে পাখিটা জাহাজের চারপাশে ঘুরছে সে সেটা কিছুতেই ভাবতে পারছে না।

এবং এভাবে ভয় পেলে যা হয়ে থাকে, সে ভেবে ফেলল, কাল সে আর ভয় পাবে না। কাল, অথবা যে কোনো দিন যদি সে ঘুমোতে না পারে, এবং ওপরে উঠে যায়, এভাবে ভয় পেয়ে নিচে চলে আসবে না। ঘড়ি দেখে বুঝতে পারল সকাল হতে বেশি দেরি নেই। এখন ফের ওপরেও আর উঠে যাওয়া ঠিক হবে না। তাকে আরও বেশি সাহসী এবং চতুর হতে হবে। সে এবার শুয়ে পড়ল।

সকালের দিকে ছোটবাবু ঘুম থেকে উঠে বিস্মিত। রাতে বেশ ঝড় বৃষ্টি হয়েছে সমুদ্রে। এখন একেবারে সমুদ্র শান্ত এবং নিরিবিলি। এত নিরিবিলি যে মনেই হয় না রাতে ঝড় হয়েছে। আসলে সে স্বপ্ন দেখেছে কিনা বুঝতে পারছে না। রাতে দরজায় কেউ ওকে ডেকেছিল যেন, মৃদু আঘাত দরজায়, যদি বনি হয়ে থাকে, সে হাত-মুখ ধুয়ে ওপরে গেল। এবং বনির দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকল, জ্যাক, কাল রাতে আমাকে তুমি ডেকেছিলে?

জ্যাক দরজা খুলে বলল, না তো।

-–কাল রাতে ঝড় বৃষ্টি হয়েছে?

—না তো!

—কিন্তু দুপুররাতে মনে হল জাহাজটা ভীষণ দুলছে!

জ্যাক বলল, কি জানি, আমি তো কিছু টের পাইনি!

—তুমি মেয়ে রাতে কিছু টের পাও না?

মেয়ে বলতেই জ্যাক কেমন লজ্জা পেল। বলল, যাঃ, তুমি যে কি না। কেউ শুনতে পেলে।

—কেউ শুনতে পাবে না। একটু থেমে বলল, আমার কিন্তু ভাল ঘুম হয় না। তুমি যে কি করে এত ঘুমোও!

—কেন, কি হয়েছে। বলেই জ্যাক বাইরে এসে দাঁড়াল। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছোটবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। এবং সত্যি মনে হল ছোটবাবু রাতে ভাল যেন ঘুমোতে পারে না। ওর কেমন দুশ্চিন্তা হল। ছোটবাবুকে নিয়ে এমনিতেই জাহাজে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। বাবাকে সে নানাভাবে বুঝিয়েছে, ছোটবাবুর ওপর আর্চির ভীষণ রাগ। এখন আর আর্চি তাকে ঘাঁটাতে সাহস পায় না। তবু কখনও কখনও মনে হয় আর্চি ছোটবাবুকে কিছু একটা করে ফেলতে পারে। তখন ভয়ে ওর বুক কাঁপে

ছোটবাবু ফানেলের ওদিকটায় হাঁটতে হাঁটতে চলে যাচ্ছে। কিছু বলছে না। সমুদ্র থেকে ঠাণ্ডা বাতাস উঠে আসছে। রোদ এখন জাহাজের সর্বত্র তেরচা হয়ে পড়ছে। এবং জাহাজ দুলছে, দুলবেই, কারণ খালি জাহাজে কখনও দুলোনি না থেকে পারে না, সমুদ্র যতই শান্ত হোক। ছোটবাবু রেলিঙে ঝুঁকে বলল, আমার রাতে কী যে আজকাল হয়!

—কী হয়? জ্যাক আরও বেশি ঝুঁকে দাঁড়াল। এবং ঝুঁকে ছোটবাবুর মুখ দেখতে চাইল’।

–মাঝে মাঝে মনে হয় তুমি আমাকে ডাকছ। দরজায় কড়া নেড়ে বলছ, ছোটবাবু আমি বনি, দরজ খোল।

জ্যাক বলল, ছোটবাবু, আমিও ঠিক এমন শুনতে পাই। আমারও কেমন মনে হয়, কেউ আমাকে ডাকছে, যেন দরজায় দাঁড়িয়ে বলছে, আমি ছোটবাবু, দরজা খোল বনি।

ছোটবাবু বলল, কেন এমন হয় বুঝতে পারছি না।

—হ্যাঁ ছোটবাবু, আমিও বুঝতে পারছি না। দুপুররাতে দু-একবার দরজা খুলে দেখেছি, না কেউ নেই। কখনও জ্যোৎস্নায় চুপচাপ কেমন হেঁটে গেছি। যদি কোথাও তুমি লুকিয়ে থাক। আমার মনে হয়েছিল, তুমি লুকিয়ে আছ কোথাও। ঠিক কোথাও লুকিয়ে আছ। প্রথমে ট্যাংকের ওপাশে উঁকি দিলাম, নেই। চারপাশে খুঁজে দেখেছি, নেই। তখন মনে হল কেউ আসছে। বোধহয় এনজির-রুমের কেউ। ওপরে জল নিতে এসেছিল ফিরে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে নেমে গেলাম। তারপর ছুটে ওপরে উঠে গেলাম। ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতেই কি ভয়! কেউ যদি দেখে ফেলত—কি যে হত না!

এই সাতসকালে বনি এ-সব বলছে। বনির সঙ্গে সে প্রতিদিন বিকেলে, কখনও কখনও রাতে আজকাল চুপচাপ বোট-ডেকে বসে থাকে। বনি কত রকমের গল্প করতে ভালোবাসে। যেন বনি তাকে নানাভাবে এক মনোরম জগতে নিয়ে যেতে চায়। বনিকে দেখলেই ভরা নদীর কথা মনে হয়। তীরের গাছপালা ফেলে যেন এক দুরন্ত নদী প্রবহমান—সেই বনি কখনও এ-সব বলেনি, অথচ সাতসকালে এ-সব কথা! সে বলল, তুমি তো আগে কিছু বলনি!

—তুমি ভয় পাবে বলে বলিনি।

—যদি রাতে তখন তোমাকে কেউ মেয়ের পোশাকে দেখে ফেলত!

জ্যাক এবার একটু একটু সোজা হয়ে দাঁড়াল। জ্যাক সাদা বয়লার স্যুট পরেছে। হিপ-পকেটে চিপিং করার হাতুড়ি। হাতে চামড়ার দস্তানা। পায়ে সাদা কেড্‌স্‌ এবং বয়লার-স্যুটে কোথাও কোথাও লাল নীল রঙের দাগ। চুল বড় হয়ে ঘাড় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। ওকে অনায়াসে মেয়েদের মতো চুল রাখছে বলে ঠাট্টা করা যেতে পারে, এবং মুখে ডিমের মতো মসৃণতা আর এত বেশি লাবণ্য যে ছোটবাবুর এই সাতসকালে বনিকে চুমো খেতে ইচ্ছে হল। সে বনিকে একদিন চুমো খাবে ভেবেছিল, এবং মনের ভেতরে এমন সব কত রকমের ইচ্ছে যেমন কখনও কখনও সে ভেবে থাকে বনিকে নিয়ে নিরিবিলি একটা সাদা চাদরের নিচে শুয়ে থাকবে, কখনও ইচ্ছে হয় বনির শরীরের উষ্ণতা তাকে ভীষণ আরাম দেবে। কোনো পাইনের ছায়ায় সে আর বনি, বনির হাত ওর হাতে, এবং কপালে চুমো খেলে কোন নষ্ট হয়ে যাবার কথা মনে থাকে না।

বনি ভেবেছিল, ছোটবাবু আরও কিছু বলবে। কিন্তু একেবারে চুপচাপ। কেবল কি যে ভাবছে। ওর দিকে একবার চোখ তুলে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। এমন কি ছোটবাবুর যে কাজে যাবার সময় হয়ে যাচ্ছে, ওর কেবিনে এতক্ষণে চা এসে গেছে এবং পোশাক পাল্টে বালতিটা নিয়ে উইনচের নিচে পড়ে থাকতে হবে—সে সবও যেন মনে করতে পারছে না। তখন বনি বলল, কেউ আমাকে দেখেনি ছোটবাবু। তুমি অযথা ভাববে না।

—এটা তোমার ঠিক না বনি।

—কী ঠিক না!

—এই যে হুট করে বের হয়ে যাওয়া।

—আমার জন্য তুমি ভাবো ছোটবাবু?

—না, ভাবি না।

বনি বলল, তবে আর কি! যখন ভাবো না… বনি চলে যাচ্ছিল।

ছোটবাবু বলল, এই, ভাল হচ্ছে না।

বনি বলল, আমি যাচ্ছি।

ছোটবাবু বলল, চল নিচে।

—নিচে নামব না। তোমার তো সাহস দেখছি খুব বেড়ে গেছে।

ছোটবাবু বলল, কেন জানি তোমাকে নিয়ে ভয় হয় বনি।

—আমার কিছু হবে না।

—রাতে হুট-হাঁট বের হবে না।

—আরে আমার বের হতে বয়ে গেছে।

—তবে বের হও কেন বলতো!

—তুমি ডাকলে বের হব না?

—আমি ডাকলেও বের হবে না।

—এসব বলছ কেন!

—কি জানি! কে যে আমাদের ডাকে! গলার স্বর অবিকল নকল করে ডাকে। দরজা খুলে দেখেছি, কেউ নেই। আজ রাতে দরজায় কেউ ঠিক টোকা মেরেছে, দরজায় কেউ টোকা মেরেছে আমি স্পষ্ট শুনতে পেয়েছি বনি।

তারপর ছোটবাবুর বলার ইচ্ছে হল, আসলে বনি আমি তোমার জন্য জেগে থাকি। ভাল ঘুম হয় না। কেবল মনে হয় তুমি ঠিক আর স্থির থাকতে পারবে না। নেমে আসবে। জাহাজে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়বে তখন তুমি খুব সন্তর্পণে নেমে আসবে কেবিনে। শরীরে তোমার আশ্চর্য বাতিঘর, আমি টের পাচ্ছি বাতিঘরে তুমি আলো জ্বেলে রেখেছ। ঠিক ঠিক তুমি অথবা আমি কখনও এক জায়গায় পৌঁছে যাব।

দরজার কাছে এসে বনি বলল, আমার যে কী হয় মাঝে মাঝে, তুমি বিশ্বাস কর ছোটবাবু সবাই ঘুমিয়ে পড়লে মনে হয় তুমি ঠিক চলে আসবে। তুমি যেমন পছন্দ কর, এই যেমন লতাপাতা অথবা গোলাপ ফুলের রঙ নিয়ে সুন্দর দামী ফ্রক পরে বসে থাকি। আমি আর কিছু পারি না ছোটবাবু। তারপর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কেবল স্বপ্ন দেখি, তুমি চলে আসছ। কখনও নদীর পাড়ে হেঁটে হেঁটে কখনও ফসলের খেত মাড়িয়ে অথবা মনে হয় তুমি তুষারপাতের সময় শীতে মরে যাচ্ছ। আমি তোমাকে নিয়ে কোনো গরম বিছানায় শুইয়ে দিচ্ছি। নিজে শুয়ে পড়েছি তোমার পাশে। আরও যে কি সব করে ফেলি না! আমার ভারি লজ্জা করছে বলতে।

বনি কথা বললে কি যে আশ্চর্য সুন্দর কথা বলতে পারে! আর একনাগাড়ে এত কথা বোধহয় বনির এই প্রথম। এবং ছোটবাবু দেখল বনির মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। চোখে মুখে অতীব ইচ্ছের এক খেলা। চুলে এখন বনির মুখ ঢাকা। কিছুটা দেখা যাচ্ছে কিছুটা দেখা যাচ্ছে না। ওর কত কাজ নিচে কিন্তু কি যে হয় ছোটবাবুর, বনিকে ফেলে ওর আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না! কেবল বনির চারপাশে ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে হয়। এবং রাতে যখন বনি দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে থাকে তখন ইচ্ছে হয় সেই সুন্দর কেবিনের চারপাশে ঘুরে বেড়াতে। কিছুতেই তার নিচে নামতে ইচ্ছে হয় না। এতগুলো ইচ্ছের কথা সে বনিকে এখন বলতে পারত কিন্তু সে কিছুই বলল না। সে নেমে গেল। বনি দেখল ছোটবাবু চুপচাপ ধীরে ধীরে নিচে নেমে যাচ্ছে। এবং একসময় ওর আর কিছুই দেখা গেল না। বনি দরজা বন্ধ করে বসে থাকল। সে আজ কোনো কাজ করবে না ভাবল। ছোটবাবু কোথায় কাজ করবে সে জানে। যদি সময় এবং সুযোগ পাওয়া যায় সে ছোটবাবুর পাশে বসে এটা ওটা এগিয়ে দেবে ভাবল।

এবং সবাই দেখল উইনচে ছোটবাবু কাজ করছে। পাশে ঝুঁকে রয়েছে বনি। বনির হাতে নানা সাইজের স্প্যানার। ছোটবাবু যেটা যখন চাইছে বনি এগিয়ে দিচ্ছে। অথবা বনি কোনটা কি সাইজের স্প্যানার বুঝতে না পারলে ছোটবাবু বের হয়ে আসছে উইনচের নিচ থেকে। একটা একটা করে স্প্যানার হাতে নিয়ে এক একটা স্প্যানারের সাইজ এবং তার নাম মুখস্থ করাচ্ছে।

স্যালি হিগিনস ব্রীজ থেকে সব দেখতে পাচ্ছিলেন। মেয়ের ওপর জোর করার সাহস কেমন তার কমে গেছে। অথবা তিনি হয়তো চান বনি সুখে থাকুক। বনি খুশী থাকুক। বনি যা পছন্দ করে তিনি তাতে বাধা দিতে দুঃখ পান। মেয়েটার জীবনে দুর্ভোগ এত বেশি যে সামান্য সুখ থেকে তাকে আর বঞ্চিত করতে ইচ্ছে হয় না। যদিও জানেন চিফ-মেট এটা পছন্দ করছে না। ছোটবাবুর যতই সাধুসন্তের মতো চেহারা হোক—ওর মায়াবী চোখ এবং শরীরের দৃঢ়তা যতই সবাইকে অবাক করে দিক, ছোটবাবু বছর শেষ হতে না হতেই প্রাচীন নাবিকের মতো অভিজ্ঞ হয়ে উঠবে।

আর তখনই জাহাজে এলার্মিং বেল বেজে উঠল। ট্রান্সমিটার রুমে কোনো জরুরী খবর। রেডিও- অফিসার ছুটে যাচ্ছে। এবং ফের তাকে দেখা গেল, খুব চিন্তিত মুখে সে ফিরে আসছে। প্রায় ছুটে এসে কাপ্তানের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। কথা বলতে পারছে না ঠিকমতো। কেবল হাঁপাচ্ছে। কোনোরকমে ঢোক গিলে সে বলার চেষ্টা করল—সামথিং রং স্যার। ট্রান্সমিটারে অদ্ভুত সব খবর আসছে।

স্যালি হিগিনস সহসা চিৎকার করে উঠলেন—হোয়াটস্ রং ম্যান

চিফ্-মেট, ডেবিড এবং থার্ড-মেট পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। সাধারণত কাপ্তান এত সহজে উত্তেজিত হন না। বরং সবকিছু দেখেশুনে কথা বলার স্বভাব তাঁর। অবশ্য মাঝে মাঝে যে মাথা গরম না করেন’ এমন নয় কিন্তু কোনো বিপদে তিনি এমনভাবে কখনও উত্তেজিত হয়ে পড়েন না।

রেডিও-অফিসার বলল, এস-ও-এস আসছে।

—এস-ও-এস। বলেই দু’লাফে উঠে গেলেন তিনি। ওর সঙ্গে অন্য সবাই ওপরে উঠে গেল। ওরা হাঁটু গেড়ে বসে এমন কিছুই বুঝতে পারল না যে এটা একটা এস-ও-এস! আর আশ্চর্য রেডিও- অফিসারও এমন কিছু বুঝতে পারছে না, সে বার বার এটা ওটা ঘোরাচ্ছে এবং কর্কশ শব্দ ভেতরে। কানে তালা লেগে যাচ্ছে—কিছু মানুষের হৈ চৈ শব্দ, যেন কোথাও আগুন লেগেছে। ভীষণ অগ্নিকাণ্ডের ভেতর জাহাজ ডুবে গেলে যা হয় কখনও যেন কেউ হাত তুলে বাঁচাও বাঁচাও বলছে। ছুটোছুটি দাপাদাপি তেলের পিপে ফাটার শব্দ। হুড়মুড় করে কিছু পড়ে গেল। রেডিও অফিসার ঘামছে আর বলছে, শুনতে পাচ্ছেন স্যার! শুনতে পাচ্ছেন না! ঐ তো শুনুন আবার আর্ত চিৎকার—কাছাকাছি কোথাও জাহাজডুবি হচ্ছে মনে হচ্ছে।

অথচ জাহাজডুবি কোথায় হচ্ছে ওরা কেউ বুঝতে পারছে না। চিফ-মেট দূরবীনে দেখছে চারপাশটা। কাপ্তান নিজেও দেখলেন দিগন্তে কোথাও কিছু ভেসে নেই। রোদে এখন যেন সমুদ্র পুড়ে যাচ্ছে অথবা ইস্পাতের মতো রং সমুদ্রের। কোথাও কোনো জাহাজ দেখা যাচ্ছে না। এমনকি দিগন্তে ধোঁয়া উঠছে না। র‍্যাডারে কিছু আসছে না। ওরা কি করবে কিছুই বুঝতে পারছিল না।

কাপ্তান বললেন, এরিয়া-স্টেশন থেকে তো কোনো খবর আসছে না।

—তাই তো? কাপ্তানের কথায় সবাই কেমন একটা সূত্র পেয়ে গেল।

তিনি এবার বললেন, জলদি এরিয়া-স্টেশনকে ধরো। বলো, আমরা এমন একটা খবর পাচ্ছি যেন কোথাও সমুদ্রে কোনো জাহাজে আগুন লেগেছে। জাহাজ ডুবছে। ওরা রেসক্যূ চাইছে। কিন্তু র‍্যাডারে কিছু আসছে না। চারপাশে কোথাও কিছু দেখা যাচ্ছে না।

তখন জ্যাক সহসা চোখ তুললেই দেখতে পেল ব্রীজে অফিসারদের ভিড়। সবাই সেখানে জড়ো হয়েছে। কাঁচের ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে—মাংকি আয়ল্যাণ্ডে বার বার বাবা উঠে যাচ্ছেন আবার নেমে আসছেন। কখনও দূরবীনে কি দেখছেন। সে দেখতে পেল তখন লেডি-অ্যালবাট্রস মাথার ওপর উড়ছে। এবং বারোটার লাঞ্চে ওর কাজ লেডি-অ্যালবাট্রসকে খাওয়ানো। কাজটা সে ছোটবাবুর কথামতো করছে। এবং যেন এ-জাহাজে কিছুদিনের ভেতর সে ছোটবাবুর অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে যাবে। যেমন এখন ছোটবাবু তাকে খুব খাটাচ্ছে। একদণ্ড বিশ্রাম দিচ্ছে না। নানারকমের সব পার্টস খুলছে লাগাচ্ছে। ওর কাজ সব তেলের ভেতর ভিজিয়ে রাখা, শিরীষ দিয়ে ঘসে ঘসে জং তুলে ফেলা। কখনও কখনও ধমকও খাচ্ছে। অর্থাৎ কখনও ভুল করে ফেললে ছোটবাবু দাঁত শক্ত করে, এই মেমের বাচ্চা বলেই হেসে ফেলছে।

তাছাড়া ছোটবাবু যতক্ষণ কাজের ভেতর থাকে খুব সিরিয়াস। বনি একবার ভুলে নাইনথ্ সিকস্টিন স্প্যানার হাতের কাছে দিতে পারেনি—আর কি ধমক! ইচ্ছে হয়েছিল সব মুখে ছুঁড়ে ফেলে চলে যাবে। কিন্তু সে কিছুতেই আর ছুঁড়ে দিতে পারে না। সে চলে গেলে জানে সবই ছোটবাবুর এক হাতে করতে হবে। বার বার উইনচের নিচ থেকে ওকে উঠে আসতে হবে, বারবার ধোয়ামোছা করতে হবে। এবং সবার ছুটি হয়ে গেলেও দেখা যাবে ছোটবাবুর ছুটি হয়নি। সে এসব ভেবে প্ৰায় যতটা সম্ভব রাগ সামলে কাজ করে যাচ্ছিল। কথা বলছিল না। ছোটবাবু বুঝতে পেরে বলেছিল, এই জ্যাক কথা বলছ না কেন!

জ্যাক জবাব দিচ্ছে না। গুম মেরে বসে আছে। ঠিক পায়ের নিচে। এবং নুয়ে তেলের টবটার ভেতর কি খুঁজছে। নাট-বোল্ট-বিয়ারিং সে সব ঘসে সাফ করছে। ছোটবাবু যে ডাকছে একেবারে শুনতে পাচ্ছে না।

ছোটবাবু এবার নিচে থেকে উঠে এল। উইনচের ড্রামে ভর দিয়ে বলল, রাগ করেছ মেয়ে জ্যাক চুল কপাল থেকে সরিয়ে চোখ তুলে তাকাল। তেলকালি মুখে এবং বিচিত্র রঙে বহুরূপী সেজে উইনচের নিচ থেকে ছোটবাবু উঠে এসেছে। সে হেসে ফেলল। বলল, না রাগ করিনি।

—তবে কথা বলছ না কেন?

—ভাল লাগছে না ছোটবাবু। আমার আর ভাল লাগছে না এভাবে থাকতে। আমি আর পারছি না। তারপর কেমন মাথা নিচু করে রাখল বনি। যেন শত চেষ্টাতেও আর ছোটবাবু বনির কোনো সাড়া পাবে না।

ছোটবাবু আরও নুয়ে প্রায় কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, এই!

বনি তেমনি বসে থাকল। তেলের টবে সে যেন কিছু খুঁজছে। এবং সে আর কথা বলবে না স্থির করে নিয়েছে যেন। কথা বললেই ধরা পড়ে যাবে, ছোটবাবুকে নিয়ে সে কি করতে চায় ছোটবাবু বুঝে ফেলবে। বুঝে ফেললেই সে ছোটবাবুর কাছে খুব খাটো হয়ে যাবে।

ছোটবাবুর ইচ্ছে হচ্ছে দু’হাতে ওর নরম রেশমের মতো সব চুল এলোমেলো করে দিতে। হাতে তেলকালি, সে কিছু করতে পারছে না। দু-একজন ডেক-জাহাজি যেতে যেতে দেখতে পাচ্ছে কাপ্তানের ছেলেটা ছোটবাবুর পায়ের কাছে বসে রয়েছে। নিবিষ্ট মনে কাজ করছে। ছেলেটার মাথার কাছে ঝুঁকে আছে ছোটবাবু। এনজিন-সারেঙ একদম পছন্দ করেন না জ্যাককে। ছোটবাবুর এত কাছে জ্যাককে বসে থাকতে দেখে মুখ গোমড়া করে চলে যাচ্ছিলেন। তখনই ছোটবাবু ডাকল, চাচা।

সারেঙ বলল, আমার কাজ আছে ছেলে। এনজিন-রুমে যাচ্ছি।

ছোটবাবু সব টের পায়। সে বলল, চাচা জ্যাক আপনাকে ডাকছে। ছোটবাবু জানে জ্যাকের কথা বললে তিনি কাছে না এসে পারবেন না।

এনজিন-সারেঙ ভীষণ বিরক্ত। কি করবেন বুঝতে পারছেন না। কিন্তু কাপ্তানের ছেলে ডেকেছে তিনি চলেও যেতে পারেন না। কাছে গিয়ে বললেন, জী আমাকে…..

বনি বলল, আমি তোমাকে ডাকিনি সারেঙ। ছোটবাবু মিথ্যা কথা বলেছে।

জ্যাকের চোখ-মুখ দেখে কেন জানি তিনি তাকে আর খুব খারাপ ভাবতে পারলেন না। ছোটবাবুর মুখে সামান্য হাসি। সে যেন বলতে পারলে খুশী হত, জ্যাক আসলে ছেলে নয় চাচা, সে মেয়ে। সে আমাকে ভীষণ ভালবাসে। পুরুষের পোশাকে সে আর থাকতে পারছে না। এবং সঙ্গে সঙ্গে মনের ভেতর জ্যাকের কষ্টটা ভীষণ তোলপাড় করতে থাকলে বলতে ইচ্ছে হল, জাহাজে যদি একজন মেয়ে থেকেই যায় তবে কি অপরাধ বলুন তো!

এনজিন-সারেঙ দেখল ছোটবাবু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু বলছে ন। সারেঙ বললেন, কিছু বলবি?

ছোটবাবু বলল, না।

—দেশে ফেরার জন্য মন খারাপ?

ছোটবাবু কি বলবে বুঝতে পারল না। দেশে ফেরার কথা আছে অথবা জাহাজে চিরদিন কেউ থাকে না এমন কথা সে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। সে কতদিন যেন তার লিটল প্রিন্সেসকে মনে করতে পারেনি। সেই তাজা মণিমুক্তা আবিস্কারের পর এ জাহাজটাই মনে হয়েছে তার সব। জাহাজ ছেড়ে গেলে সে মরে যাবে। সে বলল, কবে যে আমরা ফিরব! বলতে হয় কিছু তাই বলা। আসলে সে যেন বলতে চাইল, একটা নূতন দেশের খবর পেয়ে গেছি চাচা। এখন কে আমার বেশি কাছের বুঝতে পারছি না।

এনজিন-সারেঙ বললেন, দেখতে দেখতে তোর এখন সময় কেটে যাবে। জাহাজে প্রথম সাত আট মাস খুব কষ্টের। যেন ফুরাতে চায় না। তারপর দেখবি সব সহজ হয়ে গেছে। একদিন দেশেও ঠিক ফিরে যাবি ছেলে।

সারেঙ-সাব এসব বলে যখন চলে গেলেন ছোটবাবুর মন খারাপ হয়ে গেল। সত্যি তো সে চিরদিন জাহাজে থাকছে না। বনির সঙ্গে সে আর একটা কথা বলতে পারল না। সে খুবই মিইয়ে গেল। সারেঙ-সাব যেন তাকে মনে করিয়ে দিয়ে গেলেন—তুমি ছেলে বেশি জড়িয়ে পড়বে না। সারেঙ-সাব কি সব বুঝতে পারেন! তিনি কি প্রথম থেকেই জানেন জ্যাক আসলে ছেলে নয় সে মেয়ে। কাপ্তানের নির্দেশমতো জ্যাক সম্পর্কে সব মিথ্যে প্রচার চালিয়ে গেছেন।

তখন বনি বলল, ছোটবাবু তুমি আজ আমার কেবিনে আসবে?

—কখন?

—রাতে। বাবা যখন ঘুমিয়ে পড়বে। ডেবিডের যখন ওয়াচ থাকবে।

ছোটবাবু কি ভাবল। সঙ্গে সঙ্গে কিছু বলতে পারল না।

বনি ফের বলল, কোন ভয় নেই। আমি আর তোমাকে ক্লাউন বানাতে চাইব না। তুমি তো সব নিজের চোখেই দেখেছ?

—না না, আমি মানে বুঝতে পারলে ঠিক তা ভাবছি না।

—তবে কি ভাবছ?

—কেউ যদি টের পায়!

—পাক্। তুমি আসবে। কথা দাও।

—গিয়ে কি করব? বোকার মতো ছোটবাবু কী সব বলে ফেলে।

—গিয়ে আবার কি করবে! কেউ তো কিছু করতে বলেনি!

বনি হাসবে কি কাঁদবে বুঝতে পারল না। তবু ধীরে ধীরে বলল, কিছু করবে না। তোমার সামনে সুন্দর ফ্রক পরে আমি বসে থাকব ছোটবাবু। আর কিছু চাই না। এটা আমার স্বপ্ন বলতে পার। রোজ সেজেগুজে বসে থাকি মনে হয় কেবল তুমি আসবে। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়ি টের পাই না। সকাল হয়ে গেলে মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়।

ছোটবাবু বলল, যাব।

আর তখনই রেডিও-অফিসার কানে ইয়ার-ফোন লাগিয়ে হেঁকে যাচ্ছে, হ্যালো হ্যালো এরিয়াস্টেশন জিরো টু টু থ্রি….হ্যালো সিউল-ব্যাংক বলছি। মুখ ক্রমশ হতাশায় সাদা হয়ে যাচ্ছে। পাশে স্যালি হিগিনস্ চুপচাপ বসে রয়েছেন—যত মুখটা রেডিও-অফিসারের সাদা হয়ে যাচ্ছে তত ভেতরে ভেতরে অসহায় বোধ করছেন। অথচ একটা কথা বলছেন না। আশ্চর্য নির্বিকার তিনি।

সহসা চিৎকার করে উঠল রেডিও-অফিসার—হ্যালো সিউল-ব্যাংক বলছি। বাউণ্ড ফর সামোয়া এবং সে আরও জোরে দ্রাঘিমা অক্ষাংশের বিবরণ দিতে দিতে হাত পা- শিথিল করে ফেলল। বলল, নো রেসপনস্ স্যার। কোথাও কেউ রেসপনস্ করছে না।

চিফ-মেটের মুখ থেকে ফ্যাস করে কথাটা বেরিয়ে গেল, স্ট্রেঞ্জ!

স্যালি হিগিনিস তখন ধীরে ধীরে নেমে আসছিলেন। তেমনি নির্বিকার। চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে ঠিক আর দশটা দিনের মতোই জাহাজ চালিয়ে নিচ্ছেন। কোথাও কোনো গণ্ডগোল নেই। কাপ্তানের এমন নির্লিপ্ত মুখ দেখে ওরা আরও ভেতরে ভেতরে ক্ষেপে যাচ্ছিল অথবা যা হয়ে থাকে অসহায় মানুষগুলো এখন কি করবে বুঝতে পারছে না। কেবল পিঁপ্ পিঁপ্ শব্দ ট্রান্সমিটারে। আশ্চর্য, এরিয়া- স্টেশনকে কিছুতেই ধরা যাচ্ছে না। অবাক, সকালেও রেডিও অফিসার টি.আর. পাঠিয়েছে। অর্থাৎ জাহাজের নাম কোম্পানির নাম কত জি. আর. টি. কত এন. আর. টি. এবং কোন কোস্টে জাহাজ যাচ্ছে, স্পীড এবং নেকসট পোর্ট অব কল্ কি সব জানিয়েছে। অথচ দু’ঘণ্টা বাদে ফের এরিয়া-স্টেশনকে কিছুতেই ধরতে পারছে না। নানাভাবে চেষ্টা করেও পারছে না। এবং কি যে হয়ে গেছে! ওরা কি ভুল করে অন্য সমুদ্রে চলে এসেছে। কম্পাস কি ঠিক রিডিং দিচ্ছে না। কতসব আজগুবি ভাবনা যে মাথায় এসে জড়ো হচ্ছে। ওরা তখন দেখল, স্যালি হিগিনস চার্টরুমের দরজা খুলে ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেছেন।

চিফ-মেটের সামনে রেডিও-অফিসার প্রায় বলে ফেলেছিল বাস্টার্ড! কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়েছে। এমন একটা সময়ে জাহাজের সর্বময় যিনি তাঁর চোখেমুখে এতটুকু উৎকণ্ঠা নেই। তিনি নিচে নেমে গেলেন! কিছু বললেন না!

কিউ. টি. জি. বার বার চেয়েও সে যখন বিফল তখনও দেখছে রিসিভারে সেই হাহাকার শব্দ। চারপাশে আগুন লাগলে জাহাজিরা যেভাবে আত্মরক্ষা করে থাকে অথবা চিৎকার চেঁচামেচি এবং বাঁচাও বাঁচাও বলে থাকে তারপর প্রচণ্ড দাবদাহের মতো বিস্ফোরণের শব্দ, যেন কোনও জাহাজের প্রচণ্ড বিস্ফোরণে একটা দিক উড়ে গেছে—তেমনি সব শব্দ পেয়ে ওরা সবাই ঘামতে থাকল। রেডিও- অফিসার মাংকি-আয়ল্যাণ্ড থেকে এখন ছুটে নামতে পারলে যেন বাঁচে।

স্যালি হিগিনস তখন বেশ আরাম করে পাইপে আগুন ধরাচ্ছেন। পোর্ট-হোল খুলে দেখছেন দুপুরের রোদে সমুদ্র ইস্পাতের চাদর গায়ে জড়িয়ে শুয়ে আছে দিগন্তে। চোখ ঝলসে যাচ্ছে। তিনি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না কেন এমন হচ্ছে! চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। ওপরে যারা আছে তারা এক্ষুনি হয়তো নেমে আসবে। পরামর্শ চাইবে, স্যার আমরা এখন কি করব? এখন কি করতে হবে তিনি নিজেও ঠিক কিছু জানেন না।

ওরা যখন এল, তিনি শুধু বললেন, আমাদের সামনে জাহাজ চালিয়ে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।

ওরা চলে যাচ্ছিল। তিনি ওদের ফের ডাকলেন। রেডিও-অফিসারকে বললেন, তুমি চেষ্টা করে যাও। চিফ-মেট এবং ডেবিডকে বললেন, এসব আজেবাজে ব্যাপার যত কম জানাজানি হয় ততই ভাল।

ডেবিডের বুঝতে অসুবিধা হল না এটা তাকেই উদ্দেশ্য করে বলা—কাপ্তান তাকে সর্তক করে দিলেন। এমনকি জ্যাক ছোটবাবু কেউ জানবে না। ওকে এখন খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হবে। ছোটবাবুর সঙ্গে যত দেখা না হয় দেখা হলেই কি যে হয়ে যায়—গোপন কিছু থাকে না। এমন একটা অতিশয় খবর সে জানে সবার আগে সে তা ছোটবাবুকে জানাতে পারবে না ভাবলে কেমন যেন লাগে। সে সারাটা দিন ছোটবাবুর কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াল। দেখা হলেই এমন অতিশয় খবরটি ঠিক সে ছোটবাবুকে ফাঁস করে দেবে। এটা তার ভারি খারাপ স্বভাব। কাপ্তান ওর চোখমুখ দেখে ঠিক ধরে ফেলেছেন। এসব ভেবে নিজের ওপরই সে এবার ক্ষিপ্ত হয়ে গেল। ছোটবাবু তার কে! তার কাছে সব বলতে না পারলে সে কেন এমন মনমরা হয়ে থাকবে। সে ফের আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠল মুহূর্তে এবং নিজের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে এত বেশি সচেতন যে, কিছুতেই কিছু বলবে না। অথচ ঠিক ছোটবাবুর সঙ্গে সে হাজার রকমের কথা বলে যাবে ভেবে ছোটবাবুর কেবিনে ঢুকে বলল, হ্যাল্লো ছোটবাবু, তুমি কেমন আছ?

ছোটবাবু অবাক। ডেবিড যেন দূর দেশ থেকে ফিরে এসেছে। যেন কতদিন দেখা হয় নি। ডেবিড খুবই গম্ভীর এবং পাইপ টানছে ডেবিড। কিছুটা চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলছে।

ছোটবাবু বলল, ডেবিড তোমার শরীর বোধ হয় ভাল নেই। কারো ওপর তুমি ভীষণ রেগে গেছ।

—কেন? কেন? আমি কারো ওপর রেগে যাব কেন?

—আমার কিন্তু তাই মনে হচ্ছে।

—ও নো নো।

ছোটবাবু বলল, কফি খাবে না চা?

—তুমি যা বলবে।

ছোটবাবু হেসে ফেলল। বলল, আচ্ছা। বলে বেল টিপে বয়কে ডাকল। বয় এলে এক কাপ কফি দিতে বলল।

ডেবিড বলল, তুমি!

—আমার এখন খেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি খাও।

ডেবিড বলল, কেন কি হয়েছে তোমার। মন ভাল নেই?

—না, মন বেশ ভাল আছে। তারপর সামোয়াতে নেমে কি প্রোগ্রাম?

—সামোয়া! তুমি পাগল ছোটবাবু। আমরা সামোয়াতে যাব! তার আগেই দেখো জাহাজের কি হয়! প্রোগ্রাম! ক্ষিপ্ত হয়ে গেল বলতে বলতে। তারপর সহসা চোখ বুজে নিজেকে কিছুটা সামলে বলল, আমার যে কি হয় মাঝে মাঝে ছোটবাবু বুঝি না। সামোয়াতে নেমে যাব, ফূর্তি করব, মদ খাব। সুন্দরী মেয়ে যদি পেয়ে যাই ওঃ মাই গড আমার এখন ওপরে কত কাজ! এখানে আমি বসে আছি! বলেই ডেবিড দু’লাফে উঠে গেলে ছোটবাবু বাইরে এসে দাঁড়াল। কফি এখন ব্রীজে পাঠিয়ে দিতে হবে। সে ওপরে উঠে ডেবিডকে কিছু বলতে গিয়ে দেখল ব্রীজে চারজন অফিসার অনবরত দূরবীনে কি দেখে যাচ্ছে। সব জাহাজিরা যে যার ফোকসাল থেকে বের হয়ে এসেছে। আবার কি সেই সব বিষাক্ত পাখিরা জাহাজ আক্রমণ করতে চলে আসছে। ছোটবাবু তাড়াতাড়ি নিচে নেমে গেল। দরজা বন্ধ করে দিল। জ্যাকের কেবিনে এসে ডাকল জ্যাক, তুমি ভেতরে আছো? জ্যাক তুমি কোথায়? এখন কেন জানি মনে হচ্ছে সবার আগে জ্যাক কোথায় আছে দেখা। সে খুঁজে বেড়াতে লাগল জ্যাককে, জ্যাককে দেখা হলেই বলতে হবে, কোথায় ঘুরছ! সামনে আমাদের কত বিপদ তুমি জান না! কেবিন থেকে কোথাও নড়বে না।

তখন জ্যাক ওপাশের আড়াল থেকে মুখ বার করে ডাকল, ছোটবাবু আমি এখানে। আর সঙ্গে সঙ্গে ছোটবাবুর মুখে হাসি ফুটে উঠল। জ্যাক কাছে থাকলে তার আর কোনো আতঙ্ক থাকে না। সে জ্যাকের পাশে দাঁড়িয়ে গেল। সমুদ্রে তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। কোয়ার্টার-মাস্টার জাহাজের পতাকা মাস্তুল থেকে নামিয়ে ফেলছে। তারপর মাস্তুলের মাথায় আলো জ্বালিয়ে ফিরে যাচ্ছে ফোকসালে। চারপাশটা ক্রমে ধূসর হয়ে উঠছে, ক্রমশ সূর্য সমুদ্রের নিচে ডুবে গেলে এক লালবর্ণের কুসুম কুসুম উষ্ণতা চারপাশে এবং সেই উষ্ণতা মরে গেলে নীলবর্ণের সমুদ্রে কেমন ক্রমে ধূসর হতে হতে শূন্যতায় ডুবে যায়।

জ্যাক আর ছোটবাবু শূন্যতার ভেতর এক সময় কেমন মিশে গেল। ওদের আর দেখা গেল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *