1 of 2

অলৌকিক জলযান – ৩৪

।। চৌত্রিশ।।

মৈত্র বলল, এই তোর নাম কিরে?

ছেলেটা বলল, আমার নাম ওয়াকা। তুমি আবার ভুলে গেছ!

—আচ্ছা ওয়াকা, তোর কি ভাল লাগে?

—আমার? সে কি ভেবে বলল, তোমাকে। তুমি পৃথিবীর সব দেশে গেছ?

—তা আমি গেছি।

—আচ্ছা আমাদের লায়ন-রকের পর কি আছে বসন্তনিবাস?

—সমুদ্র।

—তারপর?

—তারপর অস্ট্রেলিয়া। ওয়াকা তুই পড়াশোনা করিস না?

ওয়াকা বলল, ওদের আমি ডেকে আনছি। আমাকে একটা বেশী দেবে।

মৈত্র বলল, ম্যাণ্ডেলাকে বলবি আমি এসে গেছি।

—বলব। বলে ওয়াকা ঘরে ঘরে যেন খবর দিতে চলে গেল।

এবং মৈত্র বসে থাকল। জায়গাটা বেশ সমতল। মসৃণ। চারপাশে ছোট সব পাহাড়ের ঢিবি। ঢিবিতে সব ছোট ছোট বাড়ি। নিচে ট্রামলাইন। একটু নিচে হাল্কা কুয়াশা জমেছে। এবং সূর্য অস্ত যাবে এবার। পাশে স্কুলবাড়ির মাঠ খালি। ফাদার মাঠে দাঁড়িয়ে দূরের পাহাড় দেখছেন। এবং মৈত্র বসে রয়েছে। সে পরেছে কালো রঙের জোব্বা। ওর শরীরে পৃথিবীর যাবতীয় খেলনা। ওর ইচ্ছে হচ্ছে একবার ম্যাণ্ডেলার বাড়ি যাবে। সে প্রতিদিন এখানে চলে আসে। তার পকেটে সব চকোলেট। এবং ঝুমঝুমি। সে যেতে যেতে কখনও মাথায় লম্বা ফুলের টুপি পরে নেয়। সে সমুদ্রের ধারে ধারে ঘুরে বেড়াবার সময় ওয়াকা সঙ্গে থাকে। ওয়াকা নামটা সে কিছুতেই মনে রাখতে পারে না। প্রতিদিন ওর নামটা জেনে নিতে হয় এবং মৈত্র দেখল তখন ওয়াকা গাছের ফাঁকে, পাহাড়ের ছায়ায় দৌড়ে আসছে। ওয়াকার রঙ শ্যামলা, চোখ কালো, কালো চুল এবং ওয়াকা একটা পাতলুন পরেছে, একটা কোট, নিচে জামা নেই, সাদা কেডস জুতো ছেঁড়া। ওয়াকা এসেই আরো একটা চকোলেট চেয়ে নিল।

সবাই এসে যে যার নাম বলে মৈত্রের চারপাশে দাঁড়িয়ে গেল। হাত পাতল।

—ম্যাণ্ডেলা এল না কেন রে? মৈত্র বলল।

—ম্যাণ্ডেলা ওর মার সঙ্গে বেড়াতে গেছে।

ম্যাণ্ডেলা না এলে কেমন সবকিছু অর্থহীন মনে হয়। অবশ্য ওয়াকা খুব আমুদে ছেলে। ওর বাবা মেষপালকের কাজ করে বেড়ায়। মা ফলের দোকানে কাজ করে। ওয়াকার পড়াশোনা ভাল লাগে না। সে সারাদিন বেলাভমিতে যারা আসে, তাদের ফাই-ফরমাস খাটে এবং জাহাজের নাবিকদের সঙ্গে আলাপ করার খুব ইচ্ছে। অনেক দিন থেকে সে ভেবেছে একজন জাহাজির সঙ্গেই বন্ধুত্ব করবে। সে তার মার সঙ্গে মাসখানেক হল এ-শহরে চলে এসেছে। এবং এসেই এমন সুন্দর বেলাভূমি আর সমুদ্র এবং পাহাড়, পাইনের বনভূমি দেখে একেবারে তাজ্জব। ওর ইচ্ছে সে বড় হয়ে নাবিকের কাজ করবে। ওয়াকার সঙ্গে আলাপ হবার পর এমন জানতে পেরেছে মৈত্র।

ওয়াকা সেদিন বলেছিল, গুড মর্নিং মিস্টার সেলার।

মৈত্র বলেছিল, আমি মিস্টার সেলার নই হে ছোকরা। আমি বসন্তনিবাস। ম্যাণ্ডেলার কাছে যাচ্ছি। খুব সুন্দর মেয়ে। ওর জন্য এই দ্যাখো কি নিয়ে যাচ্ছি।

—দেখি কি নিয়ে যাচ্ছ!

—একটা সাদা ঘোড়া। এটা এনেছি জাভা দ্বীপ থেকে। তোমার কি চাই?

—আমায় একটা টুপি দিতে পার। নারকেল পাতার টুপি।

—কাল পাবে। এবং পরদিন মৈত্র সোজা ডেক-টিণ্ডাল হাসানের ঘরে ঢকে গিয়েছিল। ওর একটা তালপাতার টুপি আছে। সমুদ্রে যখন ভীষণ রোদ থাকে, হাসান মাথায় টুপি পরতে ভালবাসে। মৈত্র, ওয়াকার জন্য টুপিটা গোপনে চুরি করেছিল। এবং ওয়াকাকে সে টুপিটা পরিয়ে একটা ছবি তুলেছিল পর্যন্ত। মৈত্র ওয়াকার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে ছবিটাতে।

ওয়াকা বলত, বসন্তনিবাস, তুমি তিমি মাছ দেখেছ?

—অনেক। তিমি মাছের একটা বাচ্চা ধরেছিলাম একবার। তারপর জাহাজে চৌবাচ্চা বানিয়ে রেখে দিয়েছিলাম। একদিন ভীষণ ঝড় আর বৃষ্টি। দেখি বেটা লাফিয়ে ডেকে পড়ে গেছে। আমরা ক’জন মিলে ওটাকে চৌবাচ্চায় রাখতে গিয়ে সমুদ্রে পড়ে গেছিলাম। সেই থেকে আর বাচ্চা পেলেও এখন আর ধরে রাখি না। বড্ড ঝামেলা।

—সত্যি ঝামেলা। ওয়াকা বলল, ওদের দাও। কখন থেকে হাত পেতে রয়েছে।

সে একটা একটা করে দামী চকোলেট দিল। ওদের মুখ দেখল। তোমাদের মা-বাবাকে কিন্তু আবার বলে দেবে না, বলল মৈত্র।

ওয়াকা বলল, ওরা তোমার সঙ্গে আজ খেলবে না।

—খেলবে না কেন?

—ওদের স্কুল খুলে যাবে। সকাল সকাল বাড়ি ফিরে যেতে হবে। পড়াশোনা না করলে ওরা বড় হবে কি করে?

—কাল খেলবে তো?

—তোমাকে আরও সকাল সকাল আসতে হবে বসন্তনিবাস। এখনতো সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে।

মৈত্র বলল, কাল আমি ছুটি নেব ওয়াকা। সকাল সকাল চলে আসব। ওয়াকা শোনো। বলে কাছে ডাকল। ম্যাণ্ডেলাকে বলবে কাল আমি ওঁদের বাড়ি যাব।

ওয়াকা বলল—ম্যাণ্ডেলা দের ফিরতে দেরি হবে।

—কবে ফিরবে?

—তাতো জানি না। ওদের চাকরটা কিছু বলতে পারছে না।

আচ্ছা ওয়াকা, ম্যাণ্ডেলার মা’র সব সময় অসুখ-বিসুখ লেগে থাকে তাই না?

—সর্দি জ্বর হতে দেখেছি। একদিন খুব কাশছিল।

—আর কিছু না।

সব ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তখন বলল—এই আমরা খেলব না।

ওয়াকা বলল—না, তোমরা বাড়ি যাও। রাত হলে তোমাদের মা-বাবারা বকবে।

বসন্তনিবাস বলল, ওরা থাক না। ওরাতো কোনো গণ্ডগোল করছে না।

ওয়াকা হাত ছুঁড়েফুঁ ড়ে বলল, আরে এদের মা-বাবাকে তো তুমি জান না, ভীষণ বাজে।

হয়তো তখন পাহাড়ের ওপরে কাঠের বাড়িতে কোনো জানালায় উঁকি দিয়ে কেউ দেখছে।

ওয়াকা টের পেয়েই বলছে, এই টিকি, তোকে তোর মা দ্যাখ খুঁজছে। তাড়াতাড়ি যা।

তখন হয়তো অন্য পাহাড়ের ছাদে দাঁড়িয়ে ডাকছে, টপু। টুপু কোথায় রে!

—যাই বাবা।

ছোট্ট এইসব মাউরি ছেলেমেয়েরা চারপাশে দাঁড়ালে মৈত্র সব কষ্ট ভুলে যেতে পারে। ম্যাণ্ডেলার সঙ্গে সবচেয়ে বেশি দিনের আলাপ। এবং ওর মামা ডঃ বুচার বলেছিল—বেশি আশকারা দেবে না, তবে তোমার রক্ষে থাকবে না।

মৈত্র, ম্যাণ্ডেলা আসেনি বলে কেমন গোমড়ামুখে বসে থাকল। ওয়াকা ওর পাশে ঠিক ওর মতো দু’পায়ের ওপর ভর দিয়ে বসে আছে। যেন কতদিনের বন্ধুত্ব দু’জনে। বসন্তনিবাস একটা বাচ্চা তিমি পুষেছিল। এর চেয়ে বড় খবর ওয়াকা পৃথিবীতে কি আছে জানে না।

টুপু, টিকি এবং অন্য সবাই দাঁড়িয়ে আছে। কেউ যাচ্ছে না। ওয়াকা খুব বিরক্ত হচ্ছে।—এই তোরা যা। আমরা এখন উঠব।

মৈত্র বলল—আচ্ছা ওয়াকা, ম্যাণ্ডেলার মা’কে কখনও হাসতে দেখেছ?

ওয়াকা মাথা চুলকাল। বলল—মনে করে দেখি। তোরা এখনও দাঁড়িয়ে! আর নেই। আবার যখন আসবে নিয়ে আসবে। তারপর কি ভেবে বলল—হ্যাঁ, হাসতে দেখেছি।

—কবে?

—এই তো সেদিন।

—যাঃ হতেই পারে না। জাহাজডুবির পর হাসতে দেখেছ?

—জাহাজডুবি! ওহো, আমাদের মনেই নেই। ম্যাণ্ডেলার বাবা জাহাজডুবিতে নিখোঁজ হয়েছে। জাহাজডুবির পরও হাসতে দেখেছি।

—মিথ্যে কথা। মৈত্র উঠে দাঁড়াল। রাগে ওর হাত-পা কাঁপছে।—ওয়াকা, তুমি মিথ্যে কথা বলছ।

—তা হবে। তুমি যাচ্ছ!

—জাহাজে ফিরছি।

—চল, সঙ্গে যাচ্ছি।

ওরা দু’জনেই লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে এল। পাথর কেটে সব রাস্তা। এখন চারপাশের সব বাড়ি- ঘরগুলোতে আলো জ্বলছে। কোথাও আলো জ্বেলে মেয়েরা টেনিস খেলছে। মসৃণ সবুজ ঘাসের ভেতর ওরা যখন দৌড়ায়—ওদের সুন্দর পা-হাত-মুখ এবং সাদা পোশাক দেখতে দেখতে মৈত্র কেমন তন্ময় হয়ে যায়। তখন ওয়াকা হঠাৎ ডেকে ওঠে, এই বসন্তনিবাস, তুমি জাহাজে যাবে না?

মৈত্র মনে করতে পারে জাহাজে তার কাজ। সে এদেশের কেউ নয়। ওয়াকা তার কেউ নয়। এই বাচ্চা শিশুরা ওর কেউ নয়। সে আপন মনে চুপচাপ হাঁটে। তারপর আবার সহসা অবিশ্বাসের ভঙ্গীতে বলে, সত্যি বলছ হেসেছিল।

—আমার তো তাই মনে হয়। নামতে গিয়ে ওয়াকার মাথা থেকে টুপি পড়ে গেছিল। সে টুপিটা তুলে নিল, দু’বার ঝেড়ে ওটা আবার মাথায় পরে বলল—আমি দেখেছি। ওকে অনেকবার হাসতে দেখেছি।

—অনেকবার! মৈত্র কেমন মুখ গোমড়া করে ফেলল। স্বপ্নটার সঙ্গে ঠিক মিলছে না। সে বলল- আচ্ছা ওয়াকা, তা হলে যাচ্ছি। আসলে ওয়াকা ঠিক বুঝতে পারে না। ছেলেমানুষ, না বোঝারই কথা ম্যাণ্ডেলার মা হাসতেই পারে না। বরং মৈত্রের ইচ্ছে হল একবার বলে, জানো ওয়াকা, আমি যতদূর জানি তিনি লম্বা একটা মেহগিনি খাটে কেবল শুয়ে থাকেন। সারা শরীর নরম সাদা সিল্কের চাদরে ঢাকা। মুখের রং ফ্যাকাশে। কেবল চোখ দুটো তাজা। ভীষণ তাজা আর মাঝে মাঝে সেই ছোট্ট ক্যাঙ্গারুর বাচ্চাটা বিদেশী লোক দেখলেই কুঁই কুঁই করে ওঠে।

ওয়াকা বলল—ওদিকে কোথায় যাচ্ছ! ওদিকে কোনো রাস্তা নেই। শুধু বন। গভীর বনের ভেতর ঢুকে গেলে আর বের হতে পারবে না বসন্তনিবাস।

মৈত্র তখনই একটা ভীষণ ঠাণ্ডা গলার স্বর শুনতে পেল। সে ভীষণ ভয় পায়। সেই ছোটবাবু আর ডেভিড। হাতে তাদের টর্চ। ছোটবাবু বলছে, এদিকে এস ওয়াকা, তুমি ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিলে। সারাদিন তুমি ওর সঙ্গে ছিলে?

—কোথাও না স্যার।

ডেভিড, মৈত্রকে নিয়ে আগে যাচ্ছে। ছোটবাবু ওয়াকার সঙ্গে

ওয়াকা তখন বলেছিল—বসন্তনিবাস তো বিকেলের দিকে কুইনস পার্কে গেছে। তার আগে ওকে আমরা দেখিনি। সারাদিন আমি ওর সঙ্গে থাকব কি করে!

ছোটবাবু ভেবে পেল না সারাটা সকাল দুপুর মৈত্রদা কোথায় ছিল। জাহাজে এসে সে নানারকম ঝামেলায় ক্রমে জড়িয়ে যাচ্ছে। ক্যাথারিন এসে এক রোববারে ফিরে গেছে। বন্ধু অনিমেষ এক রোববারে সবার হয়ে গেছে। ছোটবাবু যেতে পারছে না। সেই যে সে জেনে ফেলেছিল বনিকে আর তখন থেকে সে একেবারে অন্য মানুষ। কেমন সে দায়িত্বশীল মানুষ, অথবা কখনও উইনচের নিচে বনি এসে যখন ওর এটা ওটা এগিয়ে দেয় সে ভেবে পায় না বনিকে কি বলবে। বনি সহজেই অজস্র কথা বলতে পারে, বনির সঙ্গে সারারাত বোট-ডেকে বসে গল্প করতে করতে কখনও রাত কাবার হয়ে যায় এবং বনিকে নিয়ে সে ঘুরেও আসতে পারে যেন—বনি ভীষণ বুদ্ধিমতী। সঙ্গে ডেভিডকে নিতে ভালবাসে আর তারপর বনি ডেবিডকে কোন পাবে বসিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে দেয়—কথা থাকে ফেরার সময় তুলে নেবে ডেবিডকে। ছোটবাবু চুপচাপ থাকে। বনির চুল বড় হয়ে যাচ্ছে। বনির চুল বাতাসে উড়তে থাকে। বনির ভারি খারাপ স্বভাব–সে কথা বলার সময় অযথা হেসে ছোটবাবুকে ঠেলে দেয় সামান্য। ছোটবাবু তখন না বলে পারে না, এই পড়ে যাব কিন্তু। পড়ে গেলে মরে যাব।

আসলে ছোটবাবু ওয়াকাকে বলতে চাইল, ওকে বেশি দুর নিয়ে যাবে না। আমাদের জাহাজ শিগগির ছেড়ে দেবে। আমরা সামোয়াতে যাব। ওঁকে নিয়ে আমরা খুব চিন্তায় পড়ে গেছি ওয়াকা! এমন হাসিখুশী মানুষটা হঠাৎ কি যে হয়ে গেলেন!

ওয়াকা বলল—যাচ্ছি স্যার।

ওরা হাঁটতে হাঁটতে সী-ম্যান মিশানের কাছে এসে গেছে। ছোটবাবু ওয়াকাকে বলতে পারত—তোমরা ওকে বেশি দূরে নিয়ে যাবে না। ওর মাথায় গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে। জাহাজে এটা হয়। বড় একঘেয়েমী কাজ জাহাজে। তুমি তো জানো না ওয়াকা—মৈত্রদার দেশে স্ত্রী আছে। মানুষটা তার বৌকে ভীষণ ভালবাসে। ওর ছেলে হবে। ছেলে হলে একদিন ভোজ দেবার পর্যন্ত কথা ছিল। এখন সেসব আর ভাবি না।

তরপর যেন বলতে পারত, তোমাদের কি কিছু বলে মৈত্রদা? এই যেমন তাঁর বৌর কথা বাচ্চার কথা। চিঠির কথা। চিঠি একটাও কেবিনে পাওয়া যাচ্ছে না। স্যালি হিগিনস চিফ্-মেট সবাই দুঃসংবাদে ওর ফোকসালে নেমে দেখেছিল, চুপচাপ মৈত্রদা বসে রয়েছে। চোখ ঘোলা। কাজে বের হয়নি। এবং সারেঙকে সারারাত অযথা খিস্তিখেউড় করেছে। সারারাত সব চিঠিতে আগুন জ্বালিয়ে হাত-পা সেঁকেছে।

ওয়াকা চলে যাচ্ছিল। ছোটবাবু বলল—তোমার সঙ্গে ফের দেখা হলে আমাদের খবর দেবে।

—আচ্ছা। সে এবার সত্যি চলে যাচ্ছিল।

ছোটবাবু বলল—তুমি কোথায় থাকো?

সে একটা পাহাড়ের টিলা দেখিয়ে বলল—ঠিক তার নিচে। রাস্তার নাম সাইমন স্ট্রীট। সে যে বাড়ির আউট-হাউসে রাতে শুয়ে থাকে তার ঠিকানা পর্যন্ত দিয়ে দিল।

ওয়াকা বুঝতে পারছিল না এমন ভালো মানুষটাকে তাঁরা খুঁজে নিয়ে যাচ্ছে কেন। বসন্তনিবাস তো জাহাজেই ফিরছিল। বেশি রাতও হয়নি। এর চেয়ে কত বেশি রাত করে জাহাজিরা বন্দরে ফেরে। আর সে দেখেছে বসন্তনিবাসের মতো সমুদ্রের গল্প কেউ বলতে পারে না। ওরা দু’জনে অনেক দিন গল্প করতে করতে সারাটা দিন কাটিয়ে দিয়েছে। বসন্তনিবাস ওয়াকাকে ভাল ভাল খাবার খাইয়েছে দোকান থেকে। যেন বসন্তনিবাসের এর চেয়ে বড় কাজ পৃথিবীতে আর নেই।

বনি গ্যাংওয়েতে দাঁড়িয়েছিল। সে ছোটবাবুকে উঠে আসতে দেখে বলল—পেলে?

—পেয়েছি। আসছে।

বনি দেখল মানুষটা অন্ধকার থেকে উঠে আসছে। কালো পোশাক শরীরে। নানা রঙের রাংতা আঁটা। সেফটিপিনে সব লাল নীল ফিতে, হলুদ প্রজাপতি। বড়দিনের উৎসবে যেমন সবাই লম্বা টুপি পরে হৈ-চৈ করে বেড়ায় বড়-টিণ্ডালের মাথায় তেমনি লম্বা টুপি। টুপিতে সব হলুদ নীল ফুল। বোধহয় ওয়াকা বলে ছেলেটা বড়-টিণ্ডালকে ফুল দিয়ে এভাবে সাজিয়ে দেয়।

জাহাজে মৈত্রদা কারো সঙ্গে কথা বলছে না। কাজের সময় ঠিক কাজ করে যাচ্ছে। ছুটির দিনে সে সকালেই বের হয়ে পড়ে। কোনো কোনোদিন রাতে ফেরে না। একদিন ওয়াকা এসেই খবর দিয়েছিল, সমুদ্রের ধারে বালিয়াড়িতে শুয়ে আছে বসন্তনিবাস। ওয়াকা কিছুতেই জাহাজঘাটায় নিয়ে আসতে পারছে না।

এসব দিনেও ছোটবাবু, বন্ধু অথবা অনিমেষকে নিয়ে খুঁজতে বের হয়। কোনোদিন ডেভিড থাকে সঙ্গে। অমিয় কেমন স্বার্থপরের মতো ব্যবহার করছে। মাঝে মাঝে তার হাতে থাকে লম্বা একটা থলে। থলের মুখ ঢাকা। দু’দিন গ্যাংওয়েতে কোয়ার্টার-মাস্টার ধরেছিল। সে ব্যাগ খুলে দেখালে কোয়ার্টার- মাস্টার অবাক। এসব ছাই পাশ সে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে! অমিয় একটা কথাও বলেনি। দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় মাথা বোধ হয় কারো ঠিক নেই। আরো এক বছর থাকতে হবে জাহাজে, দেশে ফেরা যাচ্ছে না। এই সব শুনেই হয়তো ভয়ে বড়-টিণ্ডাল পাগল হয়ে গেল। এবং সে নিজেও ভাল নেই। জাহাজের এই হাল তবিয়ত—কখন কি হয় অথচ মুখ ফুটে বলার কারো সাহস নেই। কোয়ার্টার-মাস্টার তারপর অমিয়কে একটা প্রশ্নও করেনি।

একদিন ছোটবাবু অমিয়কে ডেকে খুব কথা শুনিয়েছিল।—তুই কিরে! মৈত্রদার কোন খোঁজ-খবর নিস না। কোথায় থাকিস!

অমিয় বলেছিল, ছোটবাবু, জাহাজের অবস্থা ভাল না তোমাকে বলে দিলাম। মৈত্রদা সেয়ানা লোক। পাগলামি করলেই ভেবেছে দেশে পাঠিয়ে দেবে। ও-সব আমরা বুঝি।

—তুই কি বলছিস যা তা!

—সত্যি কথা বলছি। তুমি তো আর জাহাজিদের খবর রাখো না। মন কারো ভালো নেই। এই যে এক বছরের জন্য কাপ্তেন সাউথ-সীতে ভেসে বেড়াবে সেটা কেন তুমি জান?

—ফসফেট টানবে জাহাজ

—ধুস, তুমি একটা আহাম্মক ছোটবাবু? ওটাতো একটা ওজুহাত। জাহাজ এখন কোম্পানির কর্তারা ডুবিয়ে দিতে পারলে বাঁচে। ওটা ওপরের দিকে উঠতে থাকলেই বাবুদের জ্বর আসতে থাকে।

ছোটবাবু একটা কথা বলতে পারল না। বেশ কানাঘুষা তবে জাহাজে যেই হোক প্রচার ভালই চালিয়ে যাচ্ছে।

ছোটবাবু বলল. আমার এসব বিশ্বাস হয় না। সব গুজব।

—তুমি নতুন ছোটবাবু। তোমার কেউ নেই। মা-বাবা-ভাই বোনের খোঁজ খরব রাখ না। তুমি কি করে বুঝবে আমাদের দুঃখ।

ছোটবাবু কেবিনে পায়চারি করছিল। অমিয় বসে রয়েছে। ছোটবাবু ভেবেছিল, কি করে এমন একটা গুজব থেকে জাহাজটাকে রক্ষা করা যায়। ডেবিড মাঝে মাঝে ক্ষেপে গেলে এমনই বলত। তার তখন বিশ্বাস করতে ভাল লাগত। ডেবিড কি এখন সবাইকে একই কথা বলে বেড়াচ্ছে। কতবার জাহাজ পথ হারিয়েছিল, কিউ-টি-জি কতবার সঠিক পায়নি, কম্পাস রীডিং ঠিক না পেলে যা হয়, যতই মেরামত করা হোক অথবা নতুন কম্পাস জাহাজে উঠলেই সবাই কেমন গণ্ডগোলে পড়ে যায়। আসলে সবই গুজব সে বলতে পারত। ক’ বার ক’জন কাপ্তান পাগল হয়ে নেমে গেছে জাহাজ থেকে তার একটা লিস্ট যেন এখুনি টানিয়ে দিতে পারে অমিয়! এবং ছোটবাবু এটা বুঝতে পেরেছে ফোকসালে নেমে। সবার চোখে-মুখে ভীষণ অসন্তোষ। সুযোগ পেলেই সারেঙকে যা তা বলছে। সুতরাং অমিয় তাকে তো স্বার্থপর ভাববেই।

ছোটবাবু বলল—মৈত্রদা তোকে কিছু বলেছে?

—কী বলবে?

ছোটবাবু বলল—এসব গণ্ডগোল হবার এমন কিছু কথা যা থেকে আমরা ধরতে পারি—অর্থাৎ কোনো ক্লু যদি আবিষ্কার করা যায়।

—তুমিও যেমন ছোটবাবু। মৈত্র কাঁচা ছেলে। সে আগে যদি কিছু বলতই তবে তোমরা তো সব ধরেই ফেলতে।

—আমার তো মনে হয় বাড়ি থেকে কিছু খারাপ খবর-টবর এসেছে।

—তুমি সেই ভেবে থাকো। আমি এখন উঠব। জাহাজ এবার ছাড়ছে। তুমিও সাবধানে থেকো। যা সব শুনেছি ওতে কারো নিস্তার নেই। কাপ্তান আস্ত একটা শয়তান। কাপ্তান মানুষ হলে এমন ভাঙা জাহাজ নিয়ে দরিয়ায় ভাসতে সাহস পেত না।

ছোটবাবুর মনটা কেমন দমে গেল। এ জাহাজে বনি আছে এবং কাপ্তেন জেনে-শুনে এত বড় দায়িত্বের ভেতর কেন যাচ্ছেন! ছোটবাবু কি ভেবে বলল—আচ্ছা ঠিক আছে, তুই যা।

অমিয় যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

ছোটবাবু তখনও পায়চারি করছে। বড়-মিস্ত্রির নেমে যাওয়া, বিষাক্ত পাখিদের উড়ে আসা, আর্চির ক্রুদ্ধ মুখ, বনিকে জাহাজে নতুনভাবে আবিষ্কার, মৈত্রদার সহসা পাগল হয়ে যাওয়া, তাকে খুবই চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। এবং জাহাজে কাপ্তান নিজেও কিসব দেখতে পান। একজন মেয়ে সবসময় সোনালী গাউনের ভেতর জ্যোৎস্না রাতে জাহাজ- ডেকে পায়চারি করে বেড়ায়। এসব মনে হতেই সে সোজা মৈত্রদার ফোকসালে চলে গেল। শেফালীবৌদি সম্পর্কে কিছু বললে একটা কথা বলে না। আজ অন্যভাবে কথা আরম্ভ করবে ভাবল। গতকাল থেকে ওকে আটকে রাখা হয়েছে। কোথায় নেবে যাবে কে জানে। সারেঙের সঙ্গে পরামর্শ করে ছোটবাবু এছাড়া আর কোনো পথ খুঁজে পায়নি। জাহাজ ছেড়ে দিলে যদি আবার সব ঠিকঠাক হয়ে যায়!

ছোটকে দেখেই কেমন ছেলেমানুষের মতো বলল—তুই এলি!

ছোটবাবু বলল—আচ্ছা মৈত্রদা, তোমাকে যদি দেশে পাঠিয়ে দেয়া যায় কেমন হবে?

—আমাকে! দেশে! কি হবে!

—তবে তুমি এমন করছ কেন?

—কী করছি। তোরাই তো আমাকে যা তা করছিস। কাল আমাকে জাহাজ থেকে নামতে দিসনি। কোয়ার্টার-মাস্টার আমাকে নামতে দেয়নি। তোরা কী ভেবেছিস!

—আমরা কিছু ভাবিনি। তুমি যদি দেশে যেতে চাও সবাই মিলে আমরা কাপ্তানকে ধরব। সবাই বললে তিনি আমাদের কথা ফেলতে পারবেন না।

—তুই মাঝে মাঝে খুব সরল হয়ে যাস ছোট। আমার দেশে যাবার কী হল! এতগুলো লোক জাহাজে কাজ করতে পারছে আমি পারব না!

—সমুদ্রের বালিয়াড়িতে শুয়ে থাকো কেন! জাহাজে ফিরে আসো না কেন!

—সকাল হলেই চলে আসতাম। জাহাজে না ফিরলে আমার কাজ কে করবে! তোদের নিজেদের মাথা ঠিক নেই। কিসব গুজব জাহাজে ছড়ানো হচ্ছে খবর রাখিস!

ছোটবাবু বলল—জাহাজটাতো সত্যি ভাল না। সবাইতো বলছে ভুতুড়ে জাহাজ। কত কাপ্তান জাহাজটার পাগলামীতে নিজেরা পাগল হয়ে গেছে। আমরা তো ভাবলাম এ-সফরে তোমাকে দিয়ে বোধহয় এটা আরম্ভ হল।

মৈত্র খুব সরলভাবে হাসল।—তুই খুব ভয় পেয়ে গেছিস।

—ভয় পাব না বল! তুমিই তো বলেছিলে ছোট, আমরা আছি ভয় কি। এখন যদি তোমরা এমন করতে থাকো তবে আমি কি করি বলত!

দু’ একজন জাহাজি দরজায় উঁকি দিয়েছিল। ছোটবাবু ওদের চলে যেতে বলায় কেউ ভিড় করে নি। সারেঙসাব সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে সব শুনছেন। ছোটবাবু, মৈত্রমশাইকে নানাভাবে বোঝাচ্ছে।

ছোটবাবু বের হবার মুখে হঠাৎ ছুটে গেল মৈত্ৰ।

—এই শোন। ছোটবাবু ঘুরে দাঁড়ালে বলল, আমি কিন্তু কাল কিনারায় যাব একবার। কোয়াটার-মাস্টারকে বলে দিস যেন আমাকে ছেড়ে দেয়। ছোটবাবু বলল, আচ্ছা বলে দেব। ওপরে উঠে সারেঙসাবকে বলল, কাল যেতে দিন। আমি কাল ওর সঙ্গে থাকব। জাহাজতো এবার ছেড়েই দিচ্ছে।

পরদিন শেষবারের মতো সালফার গাড়িতে বোঝাই হচ্ছিল। টংলিং টংলিং করে সব মালগাড়ি একে একে চলে যাচ্ছে। ক্রেনগুলো এবার সরিয়ে নেওয়া হবে। ডেরিকগুলো সব নামিয়ে দেওয়া হবে। জল মারা হবে সর্বত্র। সব সালফার গুড়ো এখন ধুয়েমুছে একেবারে খালি জাহাজ এবং গ্যাংওয়েতে দাঁড়ালেই বোঝা যায় জাহাজ কত খালি, জাহাজের সিঁড়ি একেবারে সোজা হয়ে গেছে।

বিকেলে নেমে গেল মৈত্রদা। সেই জমকালো পোশাকে। মৈত্রদা সারাদিন কাজ করেছে। যেভাবে ছোটবাবু দেখে থাকত বয়লার-রুমে আজও তেমনি দেখেছে। কাজকাম কম বলে সকাল সকাল ছুটি। মৈত্রদা নেমে গেল। পেছনে পেছনে যেন মৈত্রদা বুঝতে না পেরে সে নেমে গেল। এবং বনি আবার তার পেছনে পেছনে নেমে গেল। তার পেছনে নেমে গেল আর্চি। আর্চি নেমে যেতে না যেতেই একদল বাচ্চা এসে ঘিরে দাঁড়াল আর্চিকে। বাঘের মতো মানুষটাকে ওরা এমন ক্ষেপিয়ে তুলল যে, আৰ্চি আর সাহস পেল না। সে উঠে এসে সারাক্ষণ পায়চারি করল বোট-ডেকে। সে এখন কি করবে স্থির করতে পারছে না। যতদূর জ্যাক চলে যাচ্ছে তত দূরে সে তাকিয়ে আছে। কাপ্তান চার্ট-রুমে ভীষণ ব্যস্ত। তিনি, ডেবিড, চিফ-মেট শেষবারের মতো জাহাজের কোর্স-লে ঠিক আছে কিনা দেখে নিচ্ছেন। ক্রমে স্যালি হিগিনস ভীষণ সতর্ক। চারপাশের বাতাসে গন্ধ শুঁকে ভয়ঙ্কর ঝড়ের আশঙ্কাতে আতঙ্কিত। অথচ চোখমুখ দেখে বোঝাই যাবে না, বরং তিনি আগের চেয়ে বেশী হাসিঠাট্টায় মজে আছেন। সরল সহজভাবে কথা বলছেন সবার সঙ্গে। একজন সফল কাপ্তানের মতো সবসময় চলাফেরা। শেষ সফরে তিনি তো ভেঙে পড়তে পারেন না। তিনি তো বলতে পারেন না সিউল-ব্যাঙ্ক সত্যি অচল জাহাজ। ওকে ফের এতদিন সমুদ্রে একনাগাড়ে কিছুতেই চালানো যাবে না।

আবার হয়তো কখনো কখনো মনে হয় সিউল-ব্যাঙ্ক এতদিন সমুদ্রে ঘুরে ঘুরে নিজের ভেতরেই সে সৃষ্টি করেছে এক ঐশী শক্তি। এর সামনে সব সমুদ্রঝড়, সাইক্লোন, টাইফুন অথবা বিষাক্ত পাখিদের আক্রমণ—অর্থহীন। ভারি বিশ্বস্ত জাহাজ। মানুষের চেয়ে অনেক বেশী, স্ত্রী এলিসের চেয়ে আরও বেশি, তিনি সবকিছুর ওপর বিশ্বাস হারালেও সিউল-ব্যাঙ্কের ওপর বিশ্বাস হারাতে পারেন না। তাঁর তখন সাহস বাড়ে। তিনি তখন অনায়াসে মাথায় টুপি টেনে চঞ্চল বালকের মতো মাঠের শেষ গোলপোষ্টে দাঁড়িয়ে যেতে পারেন। দু’হাত তুলে প্রায় ঈশ্বরের সামিল সাহস এবং প্রতিযোগিতা, এই প্রতিযোগিতায় তিনি তো জীবনে কখনও হেরে যান নি। কর্তৃপক্ষের আস্থাভাজন মানুষ। শেষ সফরে হঠকারী কিছু করে ফেলতে পারেন না।

তখন বনি হাত তুলে ডাকল, ছাটবাবু দাঁড়াও। আমি আসছি।

ছোটবাবু পেছনে তাকিয়ে দেখল, বনি আসছে। বনির পুরুষের পোশাক বেশ মনেরম। এবং বনির ওপরে ওর খুশী হবার কথা। কিন্তু এখন সে ভীষণ রেগে যাচ্ছে। কি দরকার আসার। ওর ফিরতে ফিরতে কত রাত হবে কে জানে? আর মৈত্রদা কোথায় কতদূর যাবে সেতো জানে না। কেবল আড়ালে আড়ালে লক্ষ্য রাখা। সন্ধ্যা হলেই বলতে হবে, এবারে চল। ওয়াকা এবং সে মৈত্রদাকে জাহাজে নিয়ে আসবে। আর তখন কিনা বনি! সে বলল, কী, তুমি আবার কেন!

—কিছু হবে না। বাবাকে বলে এসেছি।

আর তখন ছোটবাবু দেখল, মৈত্রদা কোথাও নেই। সে যেই না অন্যমনস্ক হয়েছে, পেছনে তাকিয়েছে, কথা বলেছে বনির সঙ্গে, তখনই মৈত্রদা ভ্যানিশ! সে বলল, আরে মৈত্রদা কোথায়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *