1 of 2

অলৌকিক জলযান – ৩১

।। একত্রিশ।।

নিউ-প্লিমাথ আসলে ভারি ছোট বন্দর। বন্দরে চার-পাঁচটা জাহাজ ভিড়তে পারে। ঠিক পাহাড়ের নিচে সমুদ্র। বাতাসে প্রবল ঢেউগুলো যেখানে ভেঙে খান খান হয়ে যায় তার পাশে এক যেন বিশাল দীঘি। নীল জল টলমল করছে। সমুদ্রের ভেতরই দীঘির মতো পাড় বাঁধানো অথবা সহসা দেখলে মনে হয় প্রবালের বলয়রেখা। একটু কাছে গেলেই বোঝা যায় সমুদ্রের নিচ থেকে কংক্রিটের দেয়াল তুলে এই ছোট্ট নির্মাণকার্য সুপটু হাতে সম্পন্ন করা হয়েছে।

ডিসেম্বর মাস। গ্রীষ্মের সময় বলে আয়ন বায়ু এখন নেমে আসছে। জোরে হাওয়া উঠছে। সমুদ্রের বড় বড় ঢেউ কনক্রিটের দেয়ালে এসে মাথা কুটে মরছে। প্রচণ্ড গর্জনে সব সময় এইসব ঢেউ ভাঙার শব্দ, অথবা এক অতীব গর্জন এবং মনে হয় যেন সদলবলে ছুটে আসছে অগণিত ঢেউ আর কংক্রিটের দেয়াল ভেঙে দেবার জন্য নিরন্তর কেবল ফুঁসে ফুঁসে মরছে।

ভেতরে সিউল-ব্যাংক জাহাজ ভিড়ে আছে। সঙ্গে আরও দু-তিনটে জাহাজ। দেখে মনে হয় অস্ট্রেলিয়াগামী। অথবা এরা সব দ্বীপটিপ পার হয়ে এখন নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নিচ্ছে। জাহাজে তেমন ত্বরা নেই, তেমন মাল ওঠা নামার ব্যস্ততা নেই। বড় শান্ত জেটি। দু’টো-একটা ট্রাক এসে সকাল থেকে লাগছে। মাল নিয়ে আবার পাহাড়ী পথ বেয়ে উঠে যাচ্ছে। দূরে দেখা যাচ্ছে এগমন্ট হিলের শীর্ষদেশ। সাদা বরফে ঢাকা, আর জেটি পার হলে ঠিক এই বন্দর অথবা শহরের মতোই ছোট্ট বেলাভূমি—সকাল থেকে মানুষরা রোদে পিঠ দিয়ে বসার জন্য অথবা সমুদ্রে সাঁতার কাটবে বলে ছোট বর্শা এবং অক্সিজেন সিলিণ্ডার পিঠে বেঁধে বড় ছাতার নিচে অপক্ষো করছে।

আর রয়েছে সারি সারি পাইন গাছ। ঠিক পাইন বলা চলে না, পাইনের মতো সরু লম্বা নয়, অনেক ডালপালা নিয়ে গাছগুলো মাথায় উঁচু। নীল আকাশের নিচে এই সব সবুজ গাছ পাহাড়ময়। কৌরি-পাইনের জঙ্গল এভাবে সর্বত্র। আর ঠিক তারই পাশে জেটি থেকে কংক্রিটের পথ সোজা ওপরে উঠে বাঁদিকে মোড় নিয়েছে। উঁচু-নিচু পথের দু’পাশে ছোট ছোট উপত্যকায় লাল নীল কাঠের বাড়ি। সামনে ছোট সবুজ লন আর কারুকার্যময় গোলাপের বাগান। বোধ হয় এখন গ্রীষ্মের দিন বলে কেবল এই গোলাপ আর ক্রিসেন্থিমামের সমারোহ। এবং মনে হয় শান্ত নিরিবিলি আশ্রমের মতো এই বন্দরটি। কোথাও কোন ব্যস্ততা নেই। কেমন ছুটির দিনের মতো সব

তবু মৈত্র ফেরার পথে দেখেছিল, সব দোকানপাট নানাবর্ণের লাল নীল হলুদ কাগজে সাজানো হচ্ছে। মৈত্র বুঝতে পেরেছিল হপ্তা দুই পার করে দিতে পারলেই বড়দিনের উৎসব। ডাক্তার মানুষটি খুব ভাল। ইচ্ছে করলেই ধরিয়ে দিতে পারত। প্রথমে ভীষণ চেঁচামেচি করেছে। গালাগাল করেছে। ইংরেজী ভাষায় গালাগাল শুনতে মৈত্রের বেশ ভাল লাগে। আরও ভাল লেগেছিল, যখন ভদ্রলোক ওকে নানাভাবে বুঝিয়েছিল, কত খারাপ অসুখ এটা। সে এটা লুকিয়ে রেখে ভাল করেনি। তবু কথা আদায় করে নিয়েছে, বাপু তুমি কোথাও কিন্তু যাবে না। গেলে মরে যাবে। মানুষটি তাকে স্থানীয় মাউরি মেয়েদের সম্পর্কে এমন সব ভয়-টয় ধরিয়ে দিল যে বোধ হয় মৈত্র আর বাপের জন্মেও ওধার মাড়াবে না।

কিন্তু মানুষের জীবনে যা হয়ে থাকে, মৈত্র সুই ফুটিয়ে আরাম বোধ করছিল। যখন সে জাহাজ থেকে নেমে পিকাকোরার দিকে হেঁটে যায় তখন সে কিছু দেখেনি। ট্যাকসিতে সে প্রায় মৃগীরুগীর মতো পড়ে ছিল। ডাক্তার মানুষটি সত্যি সুমহান, ওকে সামান্য কিভাবে যে ম্যাসেজ করে দিয়েছে, শরীরে যেন আর বিন্দুমাত্র গ্লানি নেই। সে ভেবেছিল জীবনে আর কখনও খারাপ কাজ করবে না। সন্ধ্যার সময় ডাক্তার মানুষটি বলেছিল, এবারে যাও বাছা। যে ক’দিন থাকবে একবার করে আসবে এখানে। ডাক্তারের সুন্দর গোলাপ-বাগানটি তার ভাল লেগেছিল। সেখানে সে প্রথম সুন্দর একটি বালিকাকে দেখে থমকে দাঁড়াল। ছ-সাত বছরের বালিকাটি ওকে দেখে হাত নাড়ছে।

সেও হাত নাড়ল।

মৈত্র ভেবেছিল, ডাক্তারবাবুর মেয়ে। মানুষটির ওপর ওর ভীষণ কৃতজ্ঞতা তার ওপর গোলাপের বাগানে এমন ফুটফুটে মেয়ে—সে এক মুহূর্ত আর দেরি না করে প্রায় দু’হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বালিকাটি পরম ঔৎসুক্যে ওকে দেখছিল শুধু। ওর কাছে যেতে সাহস পায়নি। রেলিঙের ও- পাশে দাঁড়িয়ে কেমন বিরস মুখে বলছে, ইউ সেলর?

মৈত্র বলল, ইয়েস মি সেলর। মি মৈত্ৰ।

—মাই ফাদার ওয়াজ অলসো সেলর।

—এখন?

—এখন নেই!

–কেন নেই। কি হয়েছে?

—জানি না।

মৈত্র বুঝতে পারল, সে ডাক্তারবাবুর কেউ নয়। পাশাপাশি বাড়ির কেউ হবে, আত্মীয়ের মতো হবে। আর কে আছে এমন সুন্দর কাঠের লাল নীল রঙের বাড়িতে? ছবির মতো ছিমছাম। সমুদ্র থেকে সামান্য ওপরে পাহাড়ের উপত্যকায়, একেবারে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের মতো ছোট্ট রহস্যময় জগত। মেয়েটি বর্ণাঢ্য ছবির মতো বাড়িটার যেন প্রাণ। সে বলল, তোমার নাম?

—আমার নাম ম্যাণ্ডেলা।

—খুব সুন্দর নাম। কোথায় থাকো?

ম্যাণ্ডেলা মৈত্রকে রেলিঙের ফাঁক দিয়ে উবু হয়ে দেখছে। ম্যাণ্ডেলা পরেছে পাতলা কটনের ফ্রক। পায়ে পাতলা স্লিপার। ঘন সোনালী চুলে রিবন বাঁধা। সে কোথায় থাকে কিছু বলল না।

মৈত্র বলল, মি সেলর কি করে বুঝলে?

ম্যাণ্ডেলা বলল, মামাবাবু তোমাকে খুব বকেছে।

মৈত্র বুঝতে পারল, ম্যাণ্ডেলা ভেতরে কোথাও তখন ছিল। সে আড়ালে সব শুনেছে।

ম্যাণ্ডেলা বলল—তোমার জাহাজে আমি যাব।

—আমার জাহাজ ভাল না। ভাঙা জাহাজ।

—ভাঙা জাহাজে থাক কেন?

—এবারে একটা ভালো জাহাজ কিনে ফেলব।

ম্যাণ্ডেলা বোধ হয় একা। ওর সঙ্গে কেউ বোধহয় কথা বলে না। –ম্যাণ্ডেলা, মামাবাবু তোমাকে খুব ভালবাসে?

ম্যাণ্ডেলা বলল—আমরা ওখানে থাকি। বলে পাশে এক ফার্লং-এর মতো দূরে ঠিক আর একটি ছোট্ট উপত্যকায় কিছু আপেল গাছের ফাঁকে মিকি-মাউসের মতো একটা বাড়ি এবং কি যে হয়ে যায় মৈত্রের, এখানে সব বাড়িগুলিই ছেলেবেলার বইয়ের ছবিতে দেখা বাড়ির মতো। বাড়িগুলো কুটীরের মতো। কাঠের দেয়ালে কাঁচের জানালা। ছাদ কাঠের মনে হয় এবং চিমনি কালো রঙের। একই রকমের সব বাড়ি। শহরের ভেতরে ইট কাঠের দালান, পাকা রাস্তা, ট্রাম গাড়ি সবই আছে। মৈত্র ম্যাণ্ডেলার সঙ্গে কথা বলতে বলতে দূরের বাড়িটা দেখল

—ওখানে কে থাকে?

—মা।

—মা।

—তোমার বাবা?

—আমার বাবা ভাঙা জাহাজে সমুদ্রে গিয়েছিল। অনেকদিন আগে—বাবার জাহাজ সমুদ্রে ডুবে গেছে।

মৈত্র বুঝতে পারছে এ পরিবারে সমুদ্র এবং জাহাজ আর তার নিরুদিষ্ট জীবন নিয়ে একটা দুঃখের প্রাসাদ গড়ে উঠেছে। মৈত্রের কেন যে ম্যাণ্ডেলাকে কোলে তুলে নিতে ইচ্ছে হচ্ছে। সে বলল, কাল আবার আসব। তুমি যাও। মামাবাবু তোমাকে ডাকছে দ্যাখো।

মৈত্র ড. বুচারকে আর একবার দূর থেকে হাত তুলে কৃতজ্ঞতা জানাল।

মৈত্র এভাবে উঁচু-নিচু পথ ধরে এখন বন্দরের দিকে হাঁটছে। আকাশে দু’টো-একটা নক্ষত্র যীশুর জন্মদিনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। ভীষণ ঠাণ্ডা বাতাস সমুদ্র থেকে উঠে আসছে। এদেশের মানুষদের কাছে এখন গ্রীষ্মকাল আর মৈত্রের মনে হচ্ছে তার দেশে শীতকালেও এত ঠাণ্ডা থাকে না। সে গরম উলেন কোট-প্যান্ট পরেছে। গলায় মাফলার জড়ালে কনকনে ঠাণ্ডায় সে এত বেশি শীতে ঠাণ্ডা হয়ে যেত না। সুন্দর সব আলোর ডুম খাড়া পাহাড় থেকে ঝলে পড়েছে রাস্তায়। মানুষের ভিড় নেই। সে একটা বাসে চড়ে বন্দরে নেমে যেতে পারত। কিন্তু কেন জানি ঠাণ্ডায় অথবা এই দেশের মনোরম গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় হেঁটে যেতে তার ভাল লাগছিল।

আর যেন পড়ে আছে পেছনে সেই মিকি-মাউসের মতো বাড়িটা। ওখানে ম্যাণ্ডেলার মা থাকে। ওর মনে হচ্ছিল জানালায় ঠিক ম্যাণ্ডেলার মতো এক যুবতী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ম্যাণ্ডেলা হয়তো এতক্ষণে বাড়ি ফিরে গেছে। মাকে সে তার গল্প করবে। ওর মার মুখে আকাশের দু’টো একটা নক্ষত্রের মতো বোধ হয় এখন নিঃসঙ্গতা। ওর বার বার সেই নিঃসঙ্গতার কথা মনে হতেই শেফালী অনেক দূরের এক যুবতী এবং প্রতীক্ষা অথবা সন্তান ধারণে শেফালীর মুখে ক্লিষ্টতার ছাপ এসব চিন্তা, একটু ভালভাবে বেঁচে থাকা ওর এখন দরকার—কিছু টাকার সংস্থান করতে পারলে শেফালীকে পাঠিয়ে দেবে।

সে বেশ দ্রুত হাঁটছে। ম্যাণ্ডেলা এবং তার মা অথবা শেফালী, শেফালীর কথা মনে হলেই সে বুঝতে পারে ঠিক পাঁচ-সাত বছর পর ওর সন্তান ম্যাণ্ডেলার মতো বড় হয়ে যাবে। সমুদ্রগামী জাহাজে সে হয়তো কোন দ্বীপের পাশ দিয়ে যাবার সময় মনে করতে পারবে—সেই সন্তানের মুখ। তখন তার, ইচ্ছে হবে পৃথিবী থেকে যাবতীয় খেলনা কিনে নিয়ে যাবে তার শিশু সন্তানের জন্য। ভারি মজা হবে দেশে ফিরলে। যতবার সমুদ্র ঘুরে দেশে ফিরে যাবে ততবার সে তার কাছে প্রথম প্রথম ভীষণ দূরের মানুষ। শেফালী নানাভাবে বোঝাবে, তোমার বাবা। বাবা বলে ডাকো। আচ্ছা তুমি কী? শেফালী হয়তো কপট রাগে মুখ গোমড়া করে থাকবে তখন, জোর করে কোলে তুলে নিতে পারছ না?

কিন্তু কি যে হয়ে যায় শেফালীর কাছ থেকে জোর করে তুলে নিলেই কাঁদবে ছেলেটা। যদি মেয়ে হয় সুন্দর ফ্রক-পরা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নানাভাবে বলতে হবে কাঁদে না। অথবা কাঁধে নিয়ে রাস্তায় বের হয়ে সব সুন্দর সুন্দর খেলনা কিনে দেবে ওকে। তারপর সামান্য চেনাজানা হয়ে গেলে এবং যখন বাবা বলে সত্যি ডেকে ফেলবে তাকে তখনই একটা চিঠি হাজির। ঠিক ঠিক পরিচয় হতে না হতেই আবার জাহাজে ভেসে পড়া। ভাবতে ভাবতে মৈত্রের মুখটা কেমন বিমর্ষ হয়ে গেল।

সে বন্দরে নেমে খুব আশ্চর্য হয়ে গেল। কোথায় তার জাহাজ! পর পর তিনটে জাহাজ। একটাও সিউল-ব্যাংকের মতো দেখতে নয়। সে ঠিক ঠিক চিনে আসতে পারেনি হয়তো। সারি সারি ক্রেন। দু’টো ট্রাক পর পর। দু-একজন মানুষ। জেটির ওপাশে বেলাভূমি শূন্য। আর অন্ধকার তারপর। সে ঘন অন্ধকারে ঢুকে যাচ্ছে। সামান্য জেটির আলোতে শেষ মাথায় এসে বুঝতে পারল অন্ধকারের ভেতর সিউল-ব্যাংক ঘাপটি মেরে আছে। মাস্তুলের আলো জ্বলছে না। সিঁড়িতে ওঠার মুখে অন্ধকার যেন চাপ বেঁধে আছে। জাহাজে আলো নেই। আলো না থাকলে মরা এবং ভুতুড়ে মনে হয় জহাজটাকে মেন-জেনারেটর বোধ হয় গেছে। স্ট্যাণ্ড-বাই সমুদ্রেই খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

সে জাহাজে ওঠার মুখে গ্যাঙওয়েতে দেখল কোয়ার্টার মাস্টার মহসীন চুপচাপ অন্ধকারে বসে রয়েছে। সারাদিন প্রায় সে জাহাজে ছিল না এবং এখন এমন অন্ধকারে কোয়ার্টার মাস্টারকে বসে থাকতে দেখে ভাবল কিছু বলবে। জাহাজে আলো নেই কেন অথবা তোমরা সব জাহাজের আলো নিভিয়ে দিয়েছ কেন? সে কিছু বলতে পারল না। অন্ধকার এবং নিশীথে জাহাজের এমন দূরবস্থায় সে বিচলিত বোধ করছিল।

মহসীন বলল, যান ভেতরে যান।

ভেতরে সে কোথায় যাবে। মহসীন এভাবে কথা বলছে কেন। সে বলল—কি হয়েছে?

মহসীন বলল—জাহাজে আরও এক বছর।

—তার মানে!

—জাহাজ মাটি টানার কাজে লাগবে।

—জাহাজ এবার দেশে ফিরছে না?

—না। সাউথ-সীতে জাহাজ যাচ্ছে।

—সেই মাটি টানা।

—হ্যাঁ। আল্লা মুবারক।

অর্থাৎ মহসীন আল্লার নাম করে যেন জাহাজের সব কসুর ভুলে থাকতে চাইছে।

মৈত্র বলল—মেন-জেনারেটর গেছে—

—কি আর আছে জাহাজে। আপনি তো জানেন সব!

মৈত্র হাঁটতে থাকল ফের। কি মনে হওয়ায় ফের সে ফিরে দাঁড়াল।

—জ্যাক নেমে গেছে?

—না।

—তার চলে যাবার কথা।

—যাননি। বাপ বেটা যে কি ভাবে!

মৈত্র আর দাঁড়িয়ে থাকল না। তারও একটা দায়-দায়িত্ব আছে। সে বুঝতে পারছে এখন সবাই এনজিন-রুমে। সোজা সে ফোকসালে না ঢুকে বোট-ডেকে উঠে গেল। অন্ধকার পথে হাতড়ে হাতড়ে সিঁড়ি ধরে নামতে থাকল নিচে। এত অন্ধকার যে কিছু দেখা যাচ্ছে না। তবু সে প্রায় চোখ বুজে নেমে যেতে পারে। এতবার ওঠা-নামা করে এটা তার হয়েছে। নিচে একেবারে বয়লার-রুমে ঢুকেই বুঝতে পারল ওপাশে এনজিন-রুমে হল্লা শোনা যাচ্ছে। সে ঠিক তেমনি বয়লার ধরে ধরে সামনে এগিয়ে স্টারবোর্ড সাইডের ভেতরে ঢুকে গেল। কী অন্ধকার! একেবারে গভীর অন্ধকারের অতলে সে যেন ডুবে যাচ্ছে। এবং ও-পাশে গেলে দেখল অনেকগুলো টর্চ জ্বলছে। মেন-জেনারেটর খুলে ফেলা হয়েছে। এনজিন-রুমের প্রায় সবাই দড়িদড়া টানাটানি করছে। এবং সে বুঝতে পারল আর একটু বাদেই মেন-জেনারেটর ঠিক হয়ে যাবে।

মেজ-মিস্ত্রী ভীষণ চিৎকার চেঁচামেচি করছে। থার্ড ঝুঁকে আছে টর্চ হাতে। কয়েলের ওপর কি সব জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। আসলে টিণ্ডাল মৈত্র বুঝতে পারল তাপ্পি মারা হচ্ছে। এত তাপ্পি মেরে জাহাজ কখনও চলতে পারে বিশ্বাস হয় না। একটু দূরে কাপ্তান আর চিফ-মেট কি সলা-পরামর্শ করছেন। সে দূরে দাঁড়িয়ে শুধু দেখল। কাজে হাত লাগাল না। অন্ধকারে কেউ দেখতেও পাচ্ছে না। সে যদি ছায়ার মতো সিঁড়ি ধরে উঠেও যায় কেউ টের পাবে না। সারেঙ, ছোট-টিণ্ডাল, কিছু ফায়ারম্যান দড়িদড়া টেনে গলদঘর্ম। ওরা কেউ এনজিনের কলামে হেলান দিয়ে আছে। কেউ এভাপরেটারের পাশে হাঁসফাস করছে। মৈত্র যেমন নেমে এসেছিল তেমনি চুপচাপ গোপনে ওপরে উঠে গেল। কেবল ছোটবাবু নেই মনে হল।

মেন-ডেকে এসে প্রায় হাঁপ ছেড়ে বাঁচল মৈত্র। চারপাশে আলো। বাতিঘরে আলো, জেটিতে আলো। সী-ম্যান মিশানের মাথায় বড় গম্বুজ—সেখানে আলো। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে উঁচু-নিচু সব জায়গায় নক্ষত্রের মতো বাতিগুলো ঝকমক করছে। আর সেই মিকি-মাউসের মতো বাড়িটালনে সবুজ ঘাস, ঘরে সাদা রঙের কার্পেট পাতা, কাঁচের জানালায় দু’টো একটা জোনাকির মতো বড়দিনের উৎসবের বাতি জ্বলছে। অথবা কোথাও ক্রিসমাস ট্রি নানাবর্ণের সব জোনাকিতে ভরে আছে। পাশে দাঁড়িয়ে আছে ম্যাণ্ডেলা। হাত ধরে আছে ওর মা। ম্যাণ্ডেলা দূর সমুদ্রে ঘুরে বেড়ায় এমন এক নাবিকের গল্প বলছে। ওর মা চুপচাপ শুনছে।

ওর কেন জানি মনে হল এভাবে নিশীথে একা এই অন্ধকার মেন-ডেকে দাঁড়িয়ে, আসলে ওটা ম্যাণ্ডেলা নয় অথবা ওর মাও নয়। শেফালী তার সন্তানের হাত ধরে সমুদ্রগামী এক নাবিকের স্বপ্ন দেখছে। শেফালী জানে না সেই নাবিক এখন এক কঠিন অসুখে ভুগছে। শেফালী এবং সেই অনাগত সন্তানের কথা ভেবে মৈত্রের চোখে জল এসে গেল।

তারপরেই সে হেসে দিল। চোখে জল আসে ওর এটা সে ভাবতে পারে না। ছোটবাবু দেখলে বলত, তুমি কাঁদতে পার দাদা, এটা তো জানতুম না। তোমার ব্যবহার দেখে তো মনে হয় পৃথিবীতে কিছু তুমি পরোয়া কর না। মায়া দয়া তোমার তবে আছে!

সে এবারেও অন্ধকারে সামান্য হাসল।—ওটা এমনি। কারো জন্য আমার কষ্ট হয় না।

শরীরের জ্বালা যন্ত্রণা বেশ কমে যাওয়ায় পৃথিবীটা আবার ওর কাছে মনোরম হয়ে যাচ্ছে। এ ক’দিন সমুদ্রে মনে হয়েছিল বেঁচে থাকা বড় কষ্ট। কখনও কখনও জ্বালা যন্ত্রণায় সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে ইচ্ছে হয়েছে। গোপনে ডেকে উঠে সমুদ্রে লাফিয়ে পড়লে কেউ টের পেত না ওর শরীরে এমন একটা নোংরা অসুখ আছে। অথচ শেফালী এবং যে আসছে, কি যে ভালবাসা জাগে প্রাণে, কিছুতেই সে তাকে অবহেলা করতে পারেনি। এবং বার বার তখন ওর চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে বুয়েনস আয়ার্সের মেয়েটা। কি নরম উজ্জ্বল শরীর। কি সুন্দর স্তন! আর নাভিমূলে রয়েছে সমুদ্রের এক অলৌকিক দ্বীপ। ছুঁয়ে দিলেই সুধা পারাবার। সে তার কথা ভাবলেও কষ্ট পায়। নোংরা অসুখটার জন্য সেই নচ্ছার মেয়েটা দায়ী এটা তার কখনও মনে হয় না।

আর তখন মনে হল অন্ধকারে দু’টো একটা ছায়া এদিকে এগিয়ে আসছে। সে বুঝতে পারছে না কে বা কারা। আলো না জ্বললে অন্ধকারে নিচে নেমে লাভ নেই। গ্যালিতে বোধ হয় রান্নাবান্না সব বন্ধ। এবং সবাই এখন আফট্-পিকে বসে রয়েছে হয়তো। সবাই থাকবে এটা সে ভাবতে পারে না। অন্ধকার ভাল না লাগলে কেউ কেউ বন্দরে নেমে যেতে পারে। এমনিতেও পারে। অমিয় নিশ্চয়ই নিচে নেমে গেছে। তখনই সে বুঝতে পারল, ছোটবাবু এবং ডেভিড। ডেভিড ফিসফিস করে কি সব বলছে। সংগোপনে জাহাজে কিছু এমন ঘটেছে যা তাকে আরও বেশি অস্বস্তির ভেতর ফেলে দিয়েছে। জ্যাকের জাহাজে থেকে যাওয়া, এক বছরের ওপর মাটি টানার কাজে, ফের জাহাজ দক্ষিণ সমুদ্রে থেকে গেল, মহসীন মিয়ার আল্লা মুবারক বলা—সবই কেমন রহস্যজনক। সে ভেবেছিল ছোটকে ডেকে জিজ্ঞাসা করবে, কিন্তু ছোট আর ডেভিড দেখতেই পায়নি পাশে ঠিক মাস্তুলের নিচে একজন মানুষ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। ডেভিড সঙ্গে আছে বলে সে ডাকতে পারল না।

ডেভিড তখন বলছে, তোমার কি মনে হল, তিনি জানতে পেরেছেন?

—কি জানি! কি করে বলব।

—আমি মনে মনে কিন্তু কথাটা ভেবেছিলাম। জোরে বলিনি ওটা তোমাকে হলপ করে বলতে পারি। লাঞ্চে আমার কিন্তু মনে হয়েছিল কাপ্তান ভারি স্বার্থপর। ছেলেকে দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে।

যত ফিসফিস করেই বলুক, মৈত্র কথাগুলো শুনতে পেয়েছে। ছোটবাবুর সঙ্গে ডেভিডের অন্তরঙ্গতা আছে জানে, কিন্তু ছোটবাবুর কাছে ডেভিড যেন স্বীকারোক্তির মতো কথা বলছে। ছোটবাবুকে সালিশ মানছে।

মৈত্র বুঝতে পারল এই সামান্য সময়ে জাহাজে একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেছে। সেটা কি ঠিক অনুমান করতে পারছে না। সকালের দিকে যখন যায় সে শুনেছিল, আর্চি আবার ছোটবাবুকে বিজে নামিয়ে দিয়েছে। সে ভেবেছিল একবার এ-নিয়ে একটা গণ্ডগোল পাকাবে। হোক না সে অফিসার, কিন্তু সে তো বাঙালী। তাকে এভাবে র‍্যাগিং করলে সহ্য করা হবে না। তারপর মনে হয়েছে নিজের বিষের জ্বালায় সে মরছে, কে ছোটবাবু, কে আর্চি, কে বাঙালী, কে তার দেশের মানুষ চুলোয় যাক—আর এখন সে দেখছে ছোটবাবু এমন একটা দুর্ঘটনার ভেতরও বেশ ঘুরে বেড়াতে পারছে। যেন তার কিছুই হয়নি।

মৈত্র আরও শোনার জন্য উইণ্ডসেলের আড়ালে দাঁড়িয়ে গেল। তখন ছোটবাবু বলছে, আমার তো মনে হয় কাপ্তান এমনি বলেছেন

—তুমি বিশ্বাস কর ছোটবাবু, আমি স্বার্থপরতার কথা সহজে ভাবিনি। যা বলেছিলাম, মিলে যাচ্ছে?

ছোটবাবু চুপ করে থাকল। কিছু বলছে না।

—তোমার মনে নেই, বলেছিলাম, জাহাজ মাটি টানার কাজ নেবে। জাহাজটার মাথামুণ্ডু এখন বুঝতে পারছি সত্যি কিছু নেই। তুমি বিশ্বাস কর ছোটবাবু এ-সব বলা অবশ্য ঠিক না, তুমি কিন্তু কাউকে বলবে না, তাহিতিতে আসার সময় ভুলে, কোর্স-লে আমি নিউ-প্লিমাথের করে ফেলেছিলাম। জাহাজ সেই কোর্স-লে ধরেই যাচ্ছে জানি। কিন্তু চোখের ওপর দেখেছি—তারপর যা বলল ডেভিড, শুনে মৈত্র হাঁ। এই তবে জাহাজ! এর সম্পর্কে ওরা অনেক কিছু কিংবদন্তীর মতো শুনেছে, কিন্তু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা কিছু ছিল না। সে প্রায় উত্তেজনায় বলেই ফেলেছিল আর কি—মেজ-মালোম আপনি কী বলছেন!

ডেভিড বেশ জোরে জোরেই বলল, কারণ যখন কেউ নেই পাশে, তখন জোরে বললে কি আর ক্ষতি হবে। ক্ষতি যা হবার তো হয়ে গেছে। সে বলল, সেজন্য আমি ভেবেছিলাম, ভাঙা জাহাজের কথা ভেবে জ্যাককে তিনি পাঠিয়ে দিচ্ছেন। আমাদের আরও একবছর মিড়-সীতে, দ্বীপে দ্বীপে ঘোরা, যেন আমরা জাহাজের কলকব্জা। আমাদের বাড়ি যেতে ইচ্ছে হয় না। আমাদের ছেলে-বৌ নেই। তাই ভেবেছিলাম, কাপ্তান এটা স্বার্থপরের মতো কাজ করছেন। অথচ দ্যাখো কি বিস্ময়ের ব্যাপার বোট-ডেকে তিনি আমাদের বললেন, জ্যাক থাকছে। আপনাদের সঙ্গেই থাকছে। আশা করি আর আপনারা আমাকে স্বার্থপর ভাবতে পারবেন না।

তারপর ডেভিড কেমন বলতে বলতে ক্ষেপে গেল—সোয়াইন! দ্য বাস্টার্ড! ও থট-রিডিং জানে ছোটবাবু। ও শুয়োরের বাচ্চা নিজেই একটা ভূত! ভূত না হলে ভুতুড়ে জাহাজ কে চালাতে পারে বল!

ছোটবাবু বুঝতে পারছিল, ডেভিড কাপ্তানকে জুজুর মতো ভয় পায়। সামান্য কথায় না হলে কেউ এমন মুষড়ে পড়তে পারে না। সে বলল,তুমি অযথা ভয় পাচ্ছ ডেভিড। কাপ্তান এ-সব আদৌ হয়তো ভাবেনই নি।

—কি যে বলছ না ছোট? জ্যাক থাকল তো আমাদের কি এল গেল!

—কিছু না।

—তবে! অথচ দ্যাখো কি কথা! আশা করি আপনারা আমাকে আর স্বার্থপর ভাববেন না।

—ভাঙা জাহাজ, জাহাজ নিয়ে আরও এক বছর সমুদ্রে থাকা ভয়ের! জ্যাক নেমে গেলে এটা তো সবাই মনে করতেই পারে—কাপ্তান ভারি স্বার্থপর। তিনি হয়তো তাই ভেবে বলেছেন।

—কি জানি। আমার ভাল লাগছে না জানো।

মৈত্র বুঝতে পারল, জ্যাক শেষ পর্যন্ত জাহাজে থেকে গেছে। জ্যাককে নিয়ে কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে। জাহাজ এ-বন্দরে থাকছে মাসের মতো। মাল খালাস হবে। কাল থেকে জাহাজের চেহারা পাল্টে যাবে। জেটিতে কিনারার লোক, সারি সারি ট্রাক হারিয়া হাপিজ আর সারা ডেকময় সালফারের গুঁড়ো কুয়াশার মতো ভেসে বেড়াবে। যারা ফল্কায় কাজ করবে প্রত্যেকের মুখে কাপড় বাঁধা থাকবে। সালফার বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করলে হাত-পা ভীষণ জ্বালা করে। তারপর জাহাজ কোথায় যাবে, কোন বন্দরে কেউ জানে না। ভাঙা জাহাজ না বলে ভূতুড়ে জাহাজই বলা ভাল।

অন্ধকার জাহাজে হেঁটে যেতে পর্যন্ত গা ছমছম করছে মৈত্রের। সে আড়ালে আড়ালে উঠে যাচ্ছে। এখন সে যেন একা কিছুতেই অন্ধকারে নিচে আর নামতে পারবে না। ডেক-জাহাজীদের গ্যালিতে কেউ নেই। জাহাজে এমন অন্ধকার দেখেই হয়তো সবাই বন্দরে নেমে গেছে। আর তখনই মনে হল লণ্ঠন হাতে কেউ সিঁড়ি ধরে উঠে আসছে! এমন একটা বন্দরে লণ্ঠনের আলো দেখে সে আরও ঘাবড়ে গেল। কে উঠে আসছে! লণ্ঠনের আলোতে বন্দরে কেউ এভাবে উঠে আসে তার জানা নেই। গ্যাংওয়েতে মহসীন পাহারা দিচ্ছে। ওর চোখের সামনে মনে হল লণ্ঠনটা দুলছে।

এমন অন্ধকারে যা হয়ে থাকে, সামান্য আলো দেখে প্রায় যেন সবাই সেদিকে ছুটছে। এবং বুঝতে পারল ডেকের অন্ধকারে এতক্ষণ সবাই প্রায় গাঢাকা দিয়ে ছিল। গাঢাকা, না জাহাজ মাটি টানার কাজে যাচ্ছে শুনে সবাই দিশেহারা! সবাই হতবাক হয়ে এতক্ষণ যে যেখানে দাঁড়িয়ে সারেঙের হাঁক শুনেছিল, সেখানেই দাঁড়িয়ে গেছে। আর নড়তে পারে নি। আলো দেখে সবার হুঁশ ফিরে এসেছে। ওরা নড়েচড়ে উঠেছে।

ক্রমে লণ্ঠন পিছিলের দিকে চলে আসছে। দু’একজন ডেক-জাহাজি সঙ্গে। ঠিক পিছিলে উঠেই মৈত্রের মুখের ওপর লণ্ঠন তুলে বলল, জাহাজটা ভারতবর্ষ থেকে এসেছে না?

মৈত্র বলল, হ্যাঁ। কেন বলুন তো! এবং মৈত্র বুঝতে পেরেছিল, সঙ্গের দু’ একজন ডেক-জাহাজিকে সে প্রশ্ন করেছে। ওরা ইংরেজী জানে না বলে কিছু বলতে পারে নি। মৈত্র অথবা অমিয়র কাছে শেষ পর্যন্ত ধরে আনতেই হত। ডেক-অফিসার, অথবা এনজিন-অফিসারদের কাছে নিয়ে যাবার সাহস নেই। কিংবা বেশ মজা করা যাবে, যখন এত সুন্দর ছিমছাম উজ্জ্বল বন্দরে সামান্য লণ্ঠনের আলোতে কেউ কিছু খুঁজে বেড়ায় নির্ঘাত মাথায় কিছু ছিট-ফিট আছে।

বুড়ো মতো মানুষটি কিছু না বলে সহসা নাম ধরে চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে। সে যেন কিছু হারিয়ে ফেলেছে এমন ভাব। আর তখন মৈত্র দেখল সোনালী চুলের মেয়ে অন্ধকার থেকে ছুটে এসেছে। এবং দেখে মনে হল, লজ্জায় অথবা সংকোচে সে বুড়ো মানুষটার সঙ্গে ছিল না। সে এসেই বলল, এই তো আমি।

—কোথায় ছিলি! আচ্ছা দ্যাখুন তো কি অন্ধকার। এমন অন্ধকার তো জাহাজে কখনও থাকে না।

মৈত্র বলল, জেনারেটর ফেল করেছে।

—আচ্ছা, আপনারা সবাই ভারতীয় তো?

মৈত্র বলল, আমরা সবাই। তারপরই বলল, না, সবাই না। আমরা দু’জন। আর একজন আছে। সে কেবিনে থাকে। তারপর কি হিসাব করে বলল, মোট ছ’জন। মৈত্র হিসেবের ভেতর ফাইভারকেও বাদ দিল না।

—ভাল। বেশ ভাল। কিন্তু বড় বেশি অন্ধকার। অন্ধকার জানেন আমার একদম সহ্য হয় না।

মৈত্র বুঝতে পারছে না এই রাতে এমন একটা ভিন্ন পরিবেশে এই অপরিচিত বুড়ো মানুষটি কিসের আশায় জাহাজে উঠে এসেছে। যুবতী মেয়েটির ভীষণ সংকোচ, সে প্রায় সময় বুড়ো মানুষটার আড়ালে থাকতে ভালবাসছে। এতগুলো ক্ষুধার্ত নেকড়ের ভেতর যুবতীকে তার ভাল লাগল না। মানুষটি কি জানে না জাহাজে এভাবে এমন অন্ধকারে উঠে আসতে নেই। মানুষটিকে তো পুরো ইংরেজ মনে হচ্ছে। মাউরি সম্প্রদায়ের হলে তবু কথা ছিল, আর মানুষ সংগ্রহের জন্য এলে এখানে সে আসবে কেন। তার আরও বেশি আশা করা উচিত।

তখন বুড়ো মানুষটি বলল, আলো জ্বলবে না?

—বুঝতে পারছি না।

—একটু ভেতরে নামা যেত তবে!

অদ্ভুত সব কাণ্ড-কারখানার ভেতর মৈত্রের দিন কেটেছে। এখন আবার এই ঝামেলা। ওর শরীর তেমন মজবুত নয়। সে আগের মতো নেই। আগের মতো থাকলে এতটা বিরক্ত হত না। বরং এই যে যুবতী মেয়ে আড়ালে আড়ালে থাকতে চাইছে কখনও তার সাদা গাউন, হলুদ জ্যাকেট দেখা যাচ্ছে, কখনও যাচ্ছে না, কেমন মোহময়ী এবং এই অন্ধকারে এত বড় প্রলোভন থেকে সে কিছুতেই নিজেকে রক্ষা করতে পারত না। শুধু সেই মেয়ে ম্যাণ্ডেলা আর মিকি-মাউসের মতো বাড়িটা এবং শেফালীর মুখ, তার জাতক তাকে এখন ভালো মানুষ হয়ে যেতে বলছে। সে তখন সামান্য ধমকের সুরেই বলল, নিচে নেমে কি হবে?

—কথা ছিল!

—কি কথা?

—এই বলছিলাম আপনারা যদি রোববার আমার বাড়িতে আসেন।

মৈত্র সত্যি খুব রেগে গেল। সে প্রায় বলেই ফেলেছিল, এখানে এ-সব চলবে না। যান। কিন্তু সে বলার আগেই মেয়েটি সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, আমার দাদু আপনাদের নেমন্তন্ন করতে এসেছেন। আজই পত্রিকাতে দেখেছে—সিউল-ব্যাংক পোর্ট ধরছে।

মৈত্র দেখল চারপাশে তখন আরও অনেক জাহাজি। সবাই প্রায় ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। যে যেখানে ছিল এসে গেছে। এই অন্ধকারে আর কারো যেন গা ছমছম করছে না। মনে হচ্ছে একটা আশ্চর্য জিনিস মিলে গেছে, জাহাজে এ-সব থাকলে বুঝি ভয় থাকে না, গা ছমছম করে না।

এবার কেন জানি যুবতীকে তেমন অবহেলা করার মতো মনে হল না। যুবতী ধীর স্থির। সহজভাবে কথা বলছে। মৈত্র বলল, চলুন বসবেন।

ভেতরে ঢোকার মুখেই আলো জ্বলে গেল। সবাই হাততালি দিয়ে উঠল। নিমেষে জাহাজটা যেন প্রাণ পেয়ে গেল। মৈত্র বলল, আলোটা এবার নিভিয়ে দিন।

মেয়েটি বলল, আলোটা থাক। সে আলোটা একটু কমিয়ে এক পাশে রেখে দেবার সময় বলল, এই আপনার কেবিন! মেয়েটি ছোটবাবু যে বাংকে থাকত দাদুকে নিয়ে সেখানে বসে গেল। বলল, আমার নাম মিস ক্যাথারিন উড। এবং সে তার দাদুর নাম বলে ফোকসালের চারপাশটা দেখতে থাকল।

মৈত্র দেখল ভিড় চারপাশে। বঙ্কু, মজুমদার, মনু এবং অন্য অনেকে দরজায় ভিড় করেছে। মৈত্র এক ধমক লাগাল।—এখানে কী। অসভ্যের মত দাঁড়িয়ে আছিস। যা, যা বলছি।

কেউ গেল। কেউ গেল না। মৈত্র তাদের ভিতরে বসতে বলল।

ক্যাথারিন তখন দাদুর দিকে তাকাল। এবারে বল।

মি. উড বললেন, ক’দিন জাহাজ থাকছে?

মৈত্র বলল, মাসখানেক হয়ে যাবে।

—ক্রিসমাসের উৎসব পর্যন্ত তাহলে আছেন?

—আছি।

—বেশ বেশ। খুব উৎফুল্ল দেখাল মি. উডকে। আমরা থাকি শহরের শেষ মাথায়। শহরের একটু বাইরে বলতে পারেন। খামার আছে, কিছু হাঁস মুরগী ভেড়ার পাল আছে। জায়গাটা আপনাদের ভাল লাগবে। এই আমার নাতনি আর আমি আছি। আমাদের আর কেউ নেই। আমি ভারতবর্ষের মানুষ। ঠাকুর্দার বাবা ভারতবর্ষে বিহারে সিংভূম অঞ্চলে খনির ইজারাদার ছিলেন।

মৈত্র আর খারাপ কিছু ভাবতে পারল না। অমিয় না থাকায় যেন ভালই হয়েছে। থাকলে ভীষণ ঝামেলা বাধাত। সে বলল। আপনারা এ-দেশে কবে এসেছেন?

মি. উড বলতে সংকোচ বোধ করছিলেন।

তখন ক্যাথারিন দাদুর হয়ে বলল, ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে দাদু এখানে চলে আসেন। ক্যাথারিন ঘড়ি দেখে বলল, আপনারা রোববারের রাতে আমাদের সঙ্গে খাবেন। ভারতবর্ষের মানুষ এ-বন্দরে এসে ফিরে গেছে, একবেলা তিনি খাওয়াতে পারেন নি, এটা আমরা ভাবতে পারি না। আমাদের খামার, চাষাবাদ দেখলে আপনাদের ভালই লাগবে।

—একটু বসুন। আমি আসছি। সে ছোটবাবুকে ডাকতে গেল। ওর আবার সময় হবে কিনা। এই বলে সে কিছুক্ষণের ভেতরে ছোটবাবুকে নিয়ে এলে, ক্যাথারিন ছোটবাবুর দিকে তাকিয়ে থাকল। ছোটবাবু মেয়েদের দিকে সোজাসুজি তাকাতে পারে না। সে মেয়ে দেখে বরং একটু হকচকিয়ে গেল। মৈত্রদা কিছু ভেঙে বলে নি।

তখন মৈত্র বলল, এই আমাদের ছোটবাবু। ক্যাথারিন তুমি ওকে বলে যাও।

ক্যাথারিন বলল, আমার দাদুর ইচ্ছে রোববার রাতে আপনারা আমাদের সঙ্গে আহার করেন।

ছোটবাবু মৈত্রদার দিকে তাকাল। সে কি বলে।

মৈত্র বলল, আমরা যাব।

ছোটবাবু বলল, ভারি মজার ব্যাপার।

ক্যাথারিন বাংলা ভাষা বোঝে না। তবু অপলক তাকিয়ে ছোটবাবুর কথা যেন শুনছে। ছোটবাবু ফ্লানেলের বুকখোলা শার্ট পরেছে। ফ্লানেলের পাজামা। ছোটবাবুর, পুষ্ট শরীর এবং আশ্চর্য সজীব গন্ধ সমুদ্রের। দূর সমুদ্রের নাবিকেরা ডাঙা দেখলে যেভাবে আকুল হয়ে পড়ে, ছোটবাবুর কথাবার্তা শোনার তেমনি একটা তীব্র আকুলতা বোধ করছে ক্যাথারিন। ওর চোখ মুখ দেখে মৈত্র এটা ধরতে পেরেছে।

মৈত্র বলল, আমরা যাব।

ক্যাথারিন বলল, আমি আপনাদের নিয়ে যাব।

আর মৈত্র সে-রাতেই একটা আশ্চর্য স্বপ্ন দেখল। সারারাত সে একই স্বপ্নে যেন ঘুরে ঘুরে বৃত্তাকার চঞ্চলতার ভেতর ডুবে যাচ্ছিল। স্বপ্নে সে মৈত্র থাকল না। বাংলাদেশের নাবিক বসন্তনিবাস হয়ে গেল। সে বন্দরে এলেই ছোট ছোট শিশুরা টের পেয়ে যায়—শহরে বসন্তনিবাস এসে গেছে। পার্কে ছোট ছোট মেয়েরা ছেলেরা তখন সকাল সকাল খেলতে চলে আসে।

তার গায়ে লম্বা আলখেল্লা। লাল আর রুপোলী রঙের রাংতা আঁটা এবং রাংতার ওপর বিচি বর্ণের সব খেলনা সেপটিপিন দিয়ে আটকানো। সে নানারকম দ্বীপ থেকে খেলনা কিনে নিয়ে যায়। মরিশাসের কাঠের হাতি, কলম্বোর উদ্‌বেড়াল আর হাবসী দ্বীপের কাঠবেড়ালি ওর বড় প্রিয়। যখন সে হাঁটে খেলনাগুলো নেচে বেড়ায় শরীরে। পাখিরা সব উড়ে আসে সমুদ্র থেকে। মাথায় থাকে তার নীল রংয়ের টুপি, টুপিতে ময়ূরের পালক। পালকটা বাতাসে নড়লে আশ্চর্য মানুষ হয়ে যায় সে। কিছু প্রজাপতি উড়ে আসে তখন বন থেকে। শিশুরা বালিকারা চারপাশে লাফায়। সে শরীর থেকে খুলে খুলে খেলনাগুলো ওদের দিয়ে দেয়। সে এভাবে ওদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে ভালবাসে। আর কোথাও যায় না। কাজ শেষ হলেই পার্কের কাছে একটা দেবদারু গাছের নিচে এসে বসে থাকে।

তার আর অন্য জাহাজিদের মতো সরাইখানায় খেয়ে দেয়ে ফূর্তি করতে ভাল লাগে না। বরং লম্বা বুটজুতো পরে সে যখন হাঁটে, নিজের ভেতরে এক আশ্চর্য মানুষ আছে, সে টের পেয়ে যায়। জাহাজে ফিরে এসে টুপিটা খোলার সময়, সন্তর্পণে পালকটা খুলে রাখে। ওটা খোয়া গেলে সে আর আশ্চর্য মানুষ থাকবে না। পাখিরা উড়ে আসবে না সমুদ্র থেকে। মাথার ওপর থেকে প্রজাপতিরা ফিরে যাবে বনে। তার প্রাণের চেয়ে বেশি মায়া হয় তখন পালকটার জন্য। পালকটা হারিয়ে গেলে সে ফের সাধারণ মানুষ হয়ে যাবে। স্বপ্নটা কিছুতেই শেষ হচ্ছে না।

সে জাহাজে ফিরে দেখল, মাথায় তার পালক নেই। সে বুঝতে পারল ওটা ওরা কেউ নিয়ে গেছে। সে ওদের নিয়ে সমুদ্রের ধারে ধারে গান গেয়ে বেড়াচ্ছিল। বাংলাদেশের গান গাইছিল। অথবা চারপাশে ওরা যখন হাত ধরে গোল হয়ে পা তুলে নাচছিল তখন কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে।

সে আবার ফিরে গেল দেবদারু গাছটার নিচে। ওরা আসবে। সে সবাইকে পালকের কথা বলবে ভাবল। কিন্তু আশ্চর্য, সবাই এসেছে। কেবল ম্যাণ্ডেলা আসে নি। সে হাঁটতে হাঁটতে সমুদ্রের ধারে সেই মিকি-মাউসের মতো বাড়িটার দিকে চলে যেতে থাকল। সে পৌঁছে দেখল, ম্যাণ্ডেলাদের বাড়ির সামনে একটা সিলভার ওকের গাছ আছে। গাছটা দেখেই বাড়িটা চিনতে পারল। মনে হচ্ছে বাড়িটা খালি, কেউ নেই। কেবল ছোট ঝাউগাছের নিচে সে দেখতে পেল একটা ক্যাঙ্গারুর বাচ্ছা। সে ওকেই বলল, ম্যাণ্ডেলা বাড়িতে আছে?

ক্যাঙ্গরুর বাচ্চাটা কক-কক করে ডাকতেই একটা লাল রঙের জানালা খুলে গেল, ম্যাণ্ডেলার শুকনো মুখ ভেসে উঠল। তার কেমন মায়া বেড়ে গেল। যেন ম্যাণ্ডেলা সত্যি ধরা পড়ে গেছে।

সে বলল, কাউকে বলব না ম্যাণ্ডেলা। তুমি আমার পালক চুরি করেছ কাউকে বলব না। পালকটা আমাকে ফিরিয়ে দাও।

ম্যাণ্ডেলা কেমন কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, ওটা আমার মা’কে এনে দিয়েছি বসন্তনিবাস। আমার মা একটা ময়ূরের পালক স্বপ্নে দেখেছে। এক রাজা বিদেশ থেকে এসেছে, তার মাথায় ময়ূরের পালক। তোমাকে আমার সেই রাজা মনে হয়েছে। আমার মায়ের খুব অসুখ।

স্বপ্নটা কিছুতেই শেষ হচ্ছিল না।

একটু থেমে বলল ম্যাণ্ডেলা, রাতে মা’র স্বপ্নটা আমিও দেখেছি। দেখলাম, পালকটা এনে মায়ের শিয়রে রেখে দিতেই মা ভাল হয়ে উঠছে। তুমি আমার মাকে দেখবে?

সে ম্যাণ্ডেলার হাত ধরে ঘরে ঢুকে গেছে। সে দেখল, পাতলা মসলিনে শরীর ঢেকে ম্যাণ্ডেলার মা শুয়ে আছে। মুখ কেমন নীল হয়ে গেছে। চোখ দু’টো আশ্চর্য তাজা।

আর ওটা ফিরিয়ে নেবার ইচ্ছে হল না তার। যদিও সে জানে বন্দরে ওটা পরে বের হতে না পারলে বসন্তনিবাস পাগল হয়ে যেতে পারে। পালকটা যেন এক সন্ত-মানুষ তাকে দিয়েছিল। বলেছিল, বন্দরে যাবি ওটা মাথায় পরবি। নীল আকাশের নিচে হেঁটে গেলে দেখতে পাবি সমুদ্র থেকে সব পাখিরা, বন থেকে সব প্রজাপতিরা উড়ে আসছে। ওটা পরলে তুই এক দামী মানুষ হয়ে যাবি।

তবু কেন জানি ম্যাণ্ডেলার শুকনো মুখ, ওর মায়ের আশ্চর্য তাজা চোখ দেখে ওটা ফিরিয়ে নিতে ইচ্ছে হল না বসন্তনিবাসের। সে একা একা ফিরে এল জাহাজে। পাখিরা অথবা প্রজাপতিরা আর কেউ মাথার ওপর উড়ে এল না।

বসন্তনিবাস সাধারণ মানুষ হয়ে যেতেই মৈত্রের ঘুম ভেঙে গেল। স্বপ্নটা শেষ হয়ে গৈল। ধড়ফড় করে উঠে বসল। দেখল, অমিয় জাহাজে ফেরেনি। ওর বাংক খালি। খাবার ঢাকা পড়ে আছে। দরজা খোলা। সে দরজা বন্ধ করে ফের শুয়ে পড়ল। শুয়ে পড়ার সময় মনে হল ম্যাণ্ডেলার মা’র মুখ অতীব তার চেনা। কোথায় যেন তাকে সে দেখেছে। বুঝতে পারল স্বপ্নে সারাক্ষণ এলসা দ্য কেলিকে সে দেখেছে। শেফালী হয়তো। ঠিক তেমনি একজন সমুদ্রগামী মানুষের ঘরে ফেরার প্রতীক্ষায় শুয়ে আছে। এবং শেফালীর কথা ভাবতে ভাবতে সে আর সারারাত কিছুতেই ঘুমোতে পারল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *