1 of 2

অলৌকিক জলযান – ২

।। দুই।।

সকাল থেকেই বেশ একটা এলোমেলো হাওয়া দিচ্ছে। নদী থেকে এই হাওয়া উঠে এলে মৃদু ঠাণ্ডা একটা ভাব থাকে জাহাজের ভেতর। ছোটবাবুর উঠতে দেরি হয়ে গেছে। দুবার মৈত্র অমিয় ডেকে গেছে। কিন্তু ছোটবাবু রাতে একটা দুঃস্বপ্ন দেখায় সারারাত প্রায় ঘুমোতে পারেনি। সকালের দিকে ঘুমটা এসেছিল। পোর্টহোল দিয়ে সামান্য রোদ পর্যন্ত পায়ের কাছে এসে পড়েছে। কেমন শান্ত একভাব জেটিতে। মনেই হয়নি সে একটা জাহাজের ভেতর আছে। তার মনে হয়েছিল, সে আগের মতোই আছে—কাজ কর্ম নেই, একটু দেরি করে উঠলে কোন ক্ষতি হবে না।

সে সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠে এল। চারপাশে রোদ। ডেক জাহাজিরা ও-পাশে চা চাপাটি খাচ্ছে। এ-পাশে এনজিন-জাহাজিরা গ্যালিতে ভিড় করেছে। আর একটু পর কাজের সময় হয়ে যাবে। সবাই বেশ জলদি যে যার চায়ের জল গরম করে নিচ্ছে। গতকালই ওরা রেশন পেয়েছে। চা, চিনি, সিগারেট। মৈত্র, অমিয় এবং ছোটবাবু মিলে ‘বিশু’ করে নিয়েছে। তদারকির ভার মৈত্রের ওপর। চা করবে অমিয়, কাপ প্লেট ধুয়ে রাখার ভার ছোটবাবুর।

কাল জাহাজটাকে খুব নিরিবিলি শান্ত মনে হচ্ছিল। আজ সকালে একেবারে আলাদা চেহারা। জেটি থেকে মানুষ-জন উঠে আসছে। চারপাশে সব লম্বা লম্বা জেটি। এক দুই তিন করে, সে গুনে গুনে দেখল এ-ডকে এগোরোখানা জাহাজ রয়েছে। বয়াতে বাধা জাহাজগুলোতে নৌকায় মানুষজন উঠে আসছে।

হাওয়াটা বেশ লাগছে তো। সে এখনও জানে না কি কাজ করতে হবে তাকে। জাহাজটাকে কিছুতেই ইবলিশ মনে হচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে বেশ বড় জাহাজ। কত লম্বা হবে, সে মেপে বলতে পারে। তবে জাহাজের পেছনে আছে এনজিন আর ডেক-ক্রুদের বাথরুম, তারপরে আছে দু’পাশে দুটো মেসরুম। মেসরুম দুটোর মাঝখানে সিঁড়ি। সিঁড়ি টুইন-ডেকে নেমে গেছে। সিঁড়ির দু’পাশে দুটো ফোকসাল। পোর্ট-সাইডের ফোকসালে এনজিন-সারেঙ, পরেরটায় দুজন এনজিন টিণ্ডাল। ‘স্টাবোর্ড-সাইডের ফোকসালে ডেক-সারেঙ, পরেরটায় ডেক-টিণ্ডাল এবং কশপ। তারপর সিঁড়ি ক্রমে লোয়ার ডেকে নেমে গেলে মাঝ বরাবর বড় একটা লম্বা ঘর। ঘরে ক্রুদের জন্য রসদ। দু’পাশে লম্বা ভাগ করা সব ইনজিনক্রুদের থাকার জায়গা। ওপর নীচ বাঙ্ক মিলে অনেকগুলো পর পর ফোকসাল। লোয়ার – ডেকে ঠিক সিঁড়ির মুখের ফোকসালটায় ছোটবাবু, মৈত্র এবং অমিয় থাকে।

ওরা তিনজন তিনটা লকার পেয়েছে। তিনজনের জিনিসপত্র আলাদা রাখা আছে। কেবল চা চিনি একসঙ্গে। ছোটবাবু সিগারেট খায় না বলে প্রথম নিতে চায়নি, পরে মৈত্রকে দিয়ে দিতে চাইলে, মৈত্র বলল, রাখো ছোটবাবু রেখে দাও। আমাদের জাহাজ আপাতত যাচ্ছে বুনো সাইরিস। সেখানে তোমার সিগারেট সোনার দামে বিক্রি হয়ে যাবে। সে টাকায় সেখান থেকে ইচ্ছা করলে দামী কম্বল কিনে নিতে পার। পৃথিবীর কোথাও এত ভাল শস্তা দামী কম্বল তৈরি হয় না। সুতরাং ছোটবাবু সিগারেট নিয়ে লকারে রেখে দিয়েছে। তার খুব ইচ্ছে মার জন্য ভাল একটা কম্বল নিয়ে দেশে ফিরবে। শীতের রাতে মার ভীষণ কষ্ট। ঠান্ডা ঘরে কাঁথায় মার শীত কমে না। ছোট ছোট ভাই-বোনেদের ঢেকেঢুকে মার জন্য বাকি কিছু থাকে না। একটা ভালো কম্বল হলে বেশ হবে।

ডেকে দাঁড়িয়ে ছোটবাবুর মনে হল আসলে জাহাজটা ইবলিশ না। পুরানো জাহাজ হলে যা হয় কাজ সব সময় লেগেই থাকে। এখান থেকে রঙ খসে পড়ে যায়। ওখান থেকে রেলিং খসে পড়ে যায়। কাঠ উঠে যায়, এবং জাহাজ পুরানো হলে যা হয়, কেবল মেরামতের কাজ লেগেই থাকে। রঙ-বার্নিশের কাঁচা গন্ধ। জাহাজের আপ-ডেকে, মেসরুমের দু’পাশে দুটো গ্যালি। তারপর দুটো হ্যাঁচ। দু’হ্যাচের মাঝখানে মাস্তুল। মাস্তুলের দু’পাশে দুটো দুটো করে চারটা ডেরিক। মাস্তুলের গোড়ায় দুটো; করে উইনচ্। মাস্তুলের রঙ হলুদ। খোলের রঙ সাদা, কেবিনের রঙ সাদা। তারপর চীফ-কুকের গ্যালি। গ্যালির দু’পাশে দুটো এলি-ওয়ে। দুটো এলি-ওয়ে দিয়েই এনজিন-রুমে নামা যায়। দুটো এলি-ওয়ের পোর্টসাইডে থাকে এনজিনের অফিসাররা। প্রথমটায় থাকে ফিফথ-এনজিনিয়ার, পরেরটায় ফোরথ, এভাবে শেষেরটায় থাকে চীফ এনজিনিয়ার। এরা কেউ এসেছে ওয়েলস থেকে। কারু বাড়ি স্কটল্যান্ডে, কেবল ফিফথ মানে ফাইবারের বাড়ি কলকাতায়। জাতিতে বাঙালী খৃষ্টান। স্টাবোর্ড সাইডের প্রথম কেবিনটা ফাঁকা। পরের কেবিনটাতে থাকে স্টুয়ার্ড। স্টুয়ার্ড কলকাতার পার্ক সার্কাসের মানুষ। বুড়ো এবং দেখলে খুবই অথর্ব মনে হয়। একটা কি যেন অসুখ আছে তার। জাহাজঘাটায় ছোটবাবুর এমন মনে হয়েছিল। পরের কেবিনগুলোতে ছোট-মালোম, মেজ-মালোম, বড়-মালোম এবং মাঝখানে রয়ে গেছে চৌকোন একটা বিরাট ফাঁকা জায়গা। ওপরে উঠে গেলেই বোট-ডেক এবং কাঁচের স্কাইলাইট। একটা লম্বা সিঁড়ি ‘দ’-এর মতো বেঁকে বেঁকে পাতালে নেমে যাবার মতো। সিঁড়ির প্রথম ধাপে আছে প্রকান্ড সিলেন্ডার। বড় বড় লম্বা থামের মতো মোটা, স্টিম পাইপ এসে জুড়ে গেছে। সিঁড়ির পরের ধাপে রয়েছে গোল গোল লম্বা তিনটে পিস্টন রড। স্টিলের মোটা এত মোটা স্টিলের রড ছোটবাবু জীবনেও দেখেনি। আকার এবং পরিমাণ দেখে ছোটবাবু ঘাবড়ে গেছিল। নিচে নেমে গেলে ক্র্যাঙ্ক স্যাফট। লম্বা, কত লম্বা হবে, যেন ওটা যেতে যেতে টানেল পথে কোথায় হারিয়ে গেছে। ওটা গেছে ঠিক ওদের ফোকসালের অনেক নিচ দিয়ে এবং বাইরে বের হয়ে প্রপেলারকে ধরে রেখেছে। আশ্চর্য বিস্ময়ে ছোটবাবু দেখতে দেখতে বুঝল বড় বেশি তাপ্পি মারা জাহাজ। সে এনজিন-রুমে দৈত্যের মতো তিনটে অতিকায় বয়লার দেখতে পেল। বয়লারের গায়ে নানারকম পাইপ, কক এবং গেজ লাগানো আছে। এ-পাশে জেনারেটর, এভাপরেটার, ও-পাশে কনডেনসার, ব্যালেস্ট পাম্প, জেনারেল সার্ভিস পাম্প। জাহাজের ডানদিক দিয়ে ঠিক বয়লারের গা ঘেঁষে ওপাশে ঢুকে গেলে বয়লারের বিরাট তিনটে করে হাঁ-করা মুখ, যেন গিলতে আসছে। লম্বা স্টোক-হোলডে দাঁড়িয়ে সে ওপরের দিকে তাকাল। ভীষণ নিচে সে নেমে এসেছে। বয়লারের সামনে একা দাঁড়িয়ে থাকতে ওর ভীষণ ভয় লাগছিল। বয়লারের তিনটি করে ফারনেস। দুদিকে দুটো, একটা নিচে। লম্বা সব স্লাইস র‍্যাগ শোয়ানো পাশে। একটা তুলতে গিয়ে মনে হল খুব ভারি আর তখন ঝুপ করে মনে হল কিছু মাথায় পড়ছে। কালো অন্ধকার গহ্বরে ঢুকে গেলে যেমন ভয় লাগে, তেমনি একটা ভয়। এখনও ঝুর-ঝুর করে মাথার ওপর কি সব পড়ছে। গুঁড়ো গুঁড়ো, এবং ক্রমে অন্ধকার করে দিচ্ছে, প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার মতো।

সে তাড়াতাড়ি স্টোক-হোলডের সিঁড়ি ধরে ওপরে ওঠার মুখেই দেখল কাপ্তানের বেহদ্দ ছেলেটা কি করে দেখতে পেয়েছে, নিচে সে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটার হাতে চিপিঙ করার পাতলা হাতুড়ি। ফানেলের গুড়ি থেকে সব ময়লা টেনে ফেলছে। ছোটবাবু বুঝতে পারল না, ওকে দেখে এমন করছে, না, না দেখে। যেভাবেই হোক ছোটবাবু রাগ করতে পারে না। বাড়িওয়ালার ছেলে, কোন কারণেই সে মুখ গোমড়া করে উঠে যেতে পারে না। ছোটবাবু ওঠে ওর পাশ কাটিয়ে যাবার সময় সামান্য হেসে বলল, গুড-মর্নিং স্যার।

—গুড-মৰ্ণিঙ।

ছোটবাবুর মুখ বেশ কালো হয়ে গেছে। আসলে ও-সব কয়লার গুঁড়ো। জ্যাকেরও জাহাজে কাজ থাকে। একজন নাবিক হিসাবে ওকে উঠে আসতে হয়েছে। সে দেখতে পায়নি নিচে কেউ আছে। সে ওর খুশিমতো কাজ করে। যখন যেখানে খুশি। সে দেখছিল হলুদ রঙের চিমনি, তার চারপাশে সব কয়লার গুঁড়ো, রঙ খেয়ে নিচ্ছে। সে ভেবেছিল, জায়গাটা সাফ করে রঙ করবে। ওর তো খুশিমতো কাজ। কশপকে বলে হলুদ রঙ নিয়েছে। সে সেজন্য বেশ টেনে টেনে ময়লা নামাচ্ছে, এবং খুব নিচে একজন যে মানুষ দাঁড়িয়েছিল, এবং বয়লার দেখে ভয় পেয়ে গেছিল, তার মাথায় গিয়ে পড়েছে সব, সে জানত না। সে নিজের মতো কাজ করে গেছে। কে গুড-মর্নিং বলল, চোখ তুলে তার দেখার স্বভাব না। কারণ সে জানে, এ জাহাজে এখন কেবল সালাম সার, গুড মর্নিঙ, গুড নুন সাব। মাঝে মাঝে সে খুব বিগড়ে যায়, কেন যে এমন হয় সে জানে না। সুতরাং বনি জানে না একজন কম বয়সের জাহাজি এ জাহাজে উঠে এসেছে। বরং সে জানে এ জাহাজে সে খুব ছোট, সবাই তাকে খাতির করে থাকে। তার ওপর কথা বলার কারু যেন অধিকার নেই।

আর ছোটবাবু দেখল, বেশ নিরিবিলি শান্তভাবে কাপ্তেনের ছেলেটা কাজ করে যাচ্ছে। আসলে ওর কাছে এটা কাজ না, খেলা। ছোটবাবু এটা দেখেই টের পেয়েছে। এবং তখনই মনে হল লম্বা চিমনি যেন আকাশ ছুঁতে চায়। তার নিচে, সাদা বয়লার স্যুট পরে নীল চোখের অতি মায়াবি মুখ সে ভেবে পায় না, কেন এই ছেলেকে সবাই খারাপ ভেবে থাকে। ওর মা নেই। মা না থাকলে মানুষের কি থাকে। ছোটবাবুর বেশ কষ্ট হচ্ছে। ছেলেটি লম্বা, অথচ বয়স কম, চোখ দেখলেই টের পাওয়া যায়, খুব নির্দোষ স্বভাবের মুখ। সে কারো দিকে বুঝি তাকায় না, না তাকিয়েই গুডমর্নিঙ বলে থাকে। এভাবেই জাহাজে যেন ছোটবাবু ওর মতো আর একজন দুঃখী মানুষকে সহসা আবিষ্কার করে ফেলল। সামনে একমডেসান ল্যাডার। কাপ্তানের ঘরে উঠে যাবার সিঁড়ি। নিচে বোধ হয় ছেলেটার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। টোপাস সকাল থেকেই চারপাশটা ভীষণ ভালভাবে সাফসোফ করছে। কাপ্তানের কেবিনের পাশে চার্ট-রুম। তারপর ব্রীজ। ব্রীজে দুটো কম্পাস। পাশে স্টিয়ারিং হুইল। সাদা রঙ ব্রীজের। দু’পাশে তার দুটো উইংস। কাপ্তান সেখানে পায়চারি করছেন অন্যমনস্কভাবে। সে ল্যাডারের আড়ালে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারল ক্রমে সে এক ভীষণ উঁচু জায়গায় উঠে এসেছে। এখান থেকে নিচে জাহাজের সামনের হ্যাঁচ দুটো চোখে পড়ছে। বড় মাস্তুল চোখে পড়ছে। দড়ি-দড়া সব চারপাশে ওপরে নিচে ছড়িয়ে আছে। দুটো হ্যাচের মাঝখানে দুটো দুটো চারটে ডেরিক। তারপর বড় একটা আলাদা উইনচ। জাহাজের নোঙর ফেলার জন্যে রাখা হয়েছে। সামনে পতাকা উড়ছে। এ-ভাবে একটা জাহাজ আর তার মানুষজন চোখের ওপর ভেসে উঠলে, সে দেখল, পেছনে কে দাঁড়িয়ে তাঁকে ডাকছে—ছেলে আমার সঙ্গে আয়।

মুখ ফেরালে সারেঙ দেখলেন, মাথায় মুখে কয়লার ধূলোতে ছেলেকে একবোরে চেনা যাচ্ছে না। এ সবে সারেঙের ঘাবড়াবার কথা না। বললেন, কোথায় ছিলি ছেলে? মাথাটা বাঁ-হাতে ঝেড়ে দিতে দিতে বললেন, মুখে মাথায়, এসব কয়লা লাগিয়েছিস?

—জাহাজটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম চাচা! স্টোক হোলডে ঢুকতে এমনটা হল।

—আয় আমার সঙ্গে।

ছোটবাবু সারেঙের সঙ্গে হাঁটতে থাকল।

এনজিন সারেঙ যখন ছোটবাবুকে নিয়ে বয়দের কেবিন পার হয়ে বোট ডেক থেকে আপ ডেকে নেমে যাচ্ছেন তখনই জ্যাকের মনে হল, সাব না বলে কে যেন স্পষ্ট বলল স্যার। গুড মর্নিঙ কথাটা বেশ টেনে টেনে তার উচ্চারণ। জাহাজে একমাত্র অফিসাররা ওকে জ্যাক বলে ডাকে। যারা ক্রু তারা সবাই সাব, কিন্তু কে একজন বলে গেল স্যার, মনে হল স্যার বলে রসিকতা করে গেল।

জ্যাক উঠে দাঁড়াল। ওর কোকড়ানো চুল গভীর নীল রঙের। চোখ কিছুটা উদাসীন মাঠে বরফ পড়ার মতো। নাক সুন্দর নরম, মসৃণ ঘাড় গলা, থুতনি আশ্চর্য ঢেউ খেলানো, আর গোটা মুখে গোলাপি আভা। বোধ হয় সদ্য দেশ থেকে আসার দরুন এমন দেখাচ্ছে। এবং দেখলেই বোঝা যায়, খুব ঘন নীল রঙের চুলের ভিতর ভারি মনোরম হয়ে আছে মুখখানি। জ্যাক দৌড়ে বোট-ডেক থেকে নেমে গেল।

সূর্য তেমনি উঠে আসছে তিন নম্বর জেটির ও-পাশ থেকে। ক্রেনের ছায়াগুলো ক্রমে ছোট হয়ে আসছে। কে এমন বলে গেল, স্যার, তার কি স্যার বলার বয়স হয়েছে। সাব, বাংলা কথা জাহাজিরা বললে এটা সম্মানের বাবা এমন বলেছেন। সে সেই লোকটাকে খুঁজতে গিয়ে মনে হল, না অনর্থক খোঁজা। কাকে সে জিজ্ঞাসা করবে। এমনিতেই সে অনেক সময় খুব গুটিয়ে যায়, বাবাকে সব খুলে বলতে পারে না, তবু মাঝে মাঝে ভীষণ রেগে গেলে ওর কান্ড-জ্ঞান থাকে না। জাহাজে উঠেই সে ঝামেলা পাকালে বাবা খুব বিব্রত বোধ করবেন। ফিরে আসার সময়ে মনে হল, উইনচের তলায় কেউ ঢুকে গেছে! পা দুটো বের হয়ে আছে। উইনচের ভিতর থেকে পুরানো নাটবোল্টু টেনে টেনে খুলে আনছে। ফিফথ ঝুঁকে আছে ভিতরে। সে খুব উৎসাহ দিচ্ছে, আবার আবার। আরো জোরে আঃ লাগছে না!

—এই তো ভাল করে লাগালাম স্যার।

—না লাগে নি।

—ফসকে যাচ্ছে স্যার। এবং মুখে তেলকালি লাগায় এখন আর ছোটবাবুকে আদৌ চেনা যাচ্ছে না। তবু ফানেলের নিচে সেই কোঁকড়ানো চুলের মুখ, ভারি সুন্দর এবং মুগ্ধতায় ভরা। কেন জানি ওর ভারি ইচ্ছে হচ্ছে ছেলেটির সঙ্গে বন্ধুত্ব হোক। সে তার ছেলেবেলাকার কবিতার কথা মনে করে, ফিফথকে বলল, আমি একটা কবিতা বলতে পারি স্যার।

—মানে?

—মানে স্যার এবার আটকে গেছে। দেখুন। বলে সে টান দিলে নাটটা আদৌ ঘুরল না। স্যার আপনি হ্যাঁচ্য দিন।

—হ্যাঁচ্য মানে?

—এই যে বলে না, বলুন স্যার, জ্যাক এন্ড জিল হেঁইয়; ওয়েন্ট আপ দি হিল—হেঁইয়। এই দেখুন ঘুরছে। আবার সে রেঞ্চ এঁটে বলল, জ্যাক এন্ড জিল ডাউন, হেঁইয়। ব্রেক হিজ ক্রাউন, হেঁইয়। এবার নাটটা একেবারে ঢিলে করে গা ঝাড়া দিয়ে বের হয়ে পেছনে তাকাতেই একেবারে কাঠ। জ্যাক দাঁড়িয়ে আছে। সব শুনেছে। ওর মুখটা এমনিতেই চেনা যাচ্ছিল না, জ্যাককে দেখে মুখটা আরও গোলমেলে হয়ে গেল।

জ্যাক ওর এমন কাতর মুখ দেখে হা-হা করে হেসে উঠল। হেসেই সে দু লাফে বোট-ডেকে উঠে গেল। ছোপ ছোপ কালির ভেতর ছোটবাবুর মুখ নরম দাঁড়ি কিছুটা বুড়ো ক্লাউনের মতো। এমন জোরে হাসায় ছোটবাবুও হি-হি করে হেসে দিল। পরে একেবারে শক্ত হয়ে গেল। ফের ভিতরে ঢুকে বলল, স্যার আমাদের জাহাজ কোথায় যাবে?

—কোথায় যাবে এখনও ঠিক হয় নি।

—শুনেছি বুনোসাইরিস যাবে।

—বুয়েনস-এয়ার্স যাবার কথা আমরাও শুনেছি। তবে বোর্ডে তো কিছু দেয় নি এখনও।

—স্যার, আমি জ্যাক এন্ড জিল বললাম বলে ছোট স্যার রাগ করে নি তো?

—সে তো আমি জানি না।

—আচ্ছা স্যার আমি না জেনে দোষ করেছি। কাপ্তান ডেকে পাঠালে এমন বললে নিশ্চয়ই ক্ষমা করে দেবেন।

—তা দিতে পারেন। আসলে ছোটবাবুর ভিতরটা খচ খচ করছে। এদিকের উইনচ চলছে না কারণ, পুরানো জং-ধরা মেসিন। বাইরে ক্রেন থেকে বড় বড় পাটের গাঁট নামানো হচ্ছে ফল্কার ভেতর। হারিয়া হাফিজ—কেবল ক্রমাগত এমন সব শব্দ গোটা ডেকময়। সব পাটের গাঁট বোঝাই হচ্ছে। এগুলো কোথায় যাবে—ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। এজেন্ট অফিস থেকে কোনও খবর দিতে পারে, কাপ্তান অথবা বড় মালোম খুলে কিছু বলছেন না। তবু আন্দাজে ধরে নেওয়া যায়। জাহাজ কোথায় যাবে ধরে নেওয়া যায়—যাবে বুনোসাইরিস।

সে জাহাজে উঠে উঠেই এটা যে কি করে ফেলল। উইনচের তলায় সে এখন চিত হয়ে শুয়ে আছে। ওর পা দুটো ডেকের ওপর সাঁড়াশির মতো এবং সাদা পা দুটোর মোজা কালো রঙের। পুরানো হাফ-সোল মেরামত করা জুতোর ফাঁক দিয়ে বুড়ো আঙুল বের হয়ে আছে। এবং এখন যেন এই ফাইবার অর্থাৎ ফিফথ এনজিনিয়ারকে খুশি রাখা একান্ত দরকার। ফাইবার কিছুতেই উইনচের নিচে ঢুকতে চাইছে না। কারণ, এত বড় শরীরটা তার ঢুকবে না। অবাঙ্গালীর মতো লম্বা এবং ঘাড়ে- গর্দানে খুব শক্ত। বেশ যখন ছেলেটা কাজ চালিয়ে যেতে পারছে, তখন নীচে না ঢুকে বরং সাফসোফ থেকে সকালের টিফিনটা সেরে নেওয়া যাবে। পরে পরে হয়ে গেলে মন্দ কি! আসলে সারেঙের কাছে ফাইবার একজন হেলপার চেয়েছে। এ সব কাজ ফাইবারেরই করার কথা। ছোটবাবু শুধু এটা- ওটা এগিয়ে দেবে। নাট বোল্ট তেলে ধুয়ে দেবে, বাটালি হাঁতুড়ি এগিয়ে দেবার কথা। অথচ ফাইবার ওকে দিয়েই সব করিয়ে নিচ্ছে। সে এটা-ওটা ছোটবাবুকে এগিয়ে দিচ্ছিল।

ছোটবাবুর এসব কাজ জানা। ট্রেনিং শিপে সে এমন সব কাজ করে এসেছে। সে এখন অন্য কিছু ভাবতে পারছে না। ফাইবার বাঙ্গালী সাহেব। বাঙ্গালী সাহেবকে হাত না করতে পারলে তার চলবে না। সে তো আর ছোট-স্যারকে রাগাবার জন্য এমন বলে নি। সে তো কেমন সুন্দর সব ছবির দৃশ্য ভাবতে ভাবতে ছেলেবেলাকার একটা কবিতা মনে করতে পেরেছে। জ্যাক এন্ড জিল বলে হেঁইয় দিতে গিয়ে যত গন্ডগোল। ফাইবার হাতে থাকলে একজন অন্তত তার সাক্ষী থাকবে।

খাবার টেবিলে ছোটবাবুকে খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। ওরা তিনজন মিলে এক বীশু। মৈত্র, ছোটবাবু আর অমিয়। মৈত্র বলে দিয়েছে, বিফ যেন দেওয়া না হয় ওদের। সারেঙ বলেছে, আজ তো মটন দিয়েছে, কাল কি দেবে বলতে পারি না।

ছোটবাবু খেতে বসে বিফ কি মটন দেখছে না। অথবা ওদের কথাবার্তা বেমালুম শুনছে না। সে অন্যমনস্কভাবে খাচ্ছে। সে খুব ভীতু স্বভাবের মানুষ। সে হেসে দিয়েছিল, ছোট-স্যার হেসেছেন বলে। মুখ গোমড়া রাখলে যদি আরও রেগে যায়। কিন্তু হেসে কি লাভ হল। ছোট স্যার তো তখন লাইফ বোটের ও পাশে চলে গেছে। সে হাসল কি কাঁদল কে দেখেছে।

স্নান করে ছোটবাবু একটা সাদা প্যান্ট সাদা হাফ-সার্ট গায়ে দিয়েছে। সারা দিন সে কাজ করেছে ফাইবারের সঙ্গে। বারোটায় তাড়াহুড়ো করে ভাত ডাল খেয়েছে, বাঁধাকপি ভাজা খেয়েছে। মাংস খায়নি। এখনও জাহাজের বাসি মাংস শেষ হয়নি। যখন সকালের দিকে ভান্ডারী মাংস কাটছিল সে ভীষণ দৃশ্য, সাদা হয়ে গেছে, বরফ ঘরে মাংস দীর্ঘদিন থাকলে যা হয়।

কাল পরশু রসদ উঠবে। মৈত্র এ-নিয়ে একটা ঝগড়া বাধিয়ে পর্যন্ত দিয়েছিল, সারেঙকে শাসিয়েছে—মটন যেন রসদে বেশী করে নেওয়া হয়। আমরা যারা হিন্দু আছি তাদের কথা ভাববেন। অথচ মৈত্র সব খায়। সে বিফ মটন মানে না। তার কাছে দুই সমান। তবে সে এমন করছে কেন! ওরা দুজন বাঙালি হিন্দু জাহাজি নতুন উঠেছে বলে। ডেকে যে দুজন উঠেছে, একজনের নাম বঙ্ক, অর্থাৎ বন্ধুবিহারী দেবনাথ। অন্যজনের নাম মজুমদার, অনিমেষ মজুমদার। মৈত্র বোধ হয় এদের নিয়ে জাহাজে একটা দল করতে চায়। আর্টিকেলে কি আছে না আছে, সে সেটা শুনতে চাইছে না।

মৈত্র মাংসের হাড়িটা ছোটবাবুর দিকে এগিয়ে দিল। —যা লাগে নে।

ছোটবাবু বলল, মৈত্রদা আমার মাংস খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না।

অমিয় বলল, আমারও।

—ওটা হলে তো চলবে না। মাংস না খেলে জাহাজ চালাবে কি করে। আবার এটা কয়লার জাহাজ। তারপর আবার জাহাজে স্টিম ঠিক থাকে না। সমুদ্রে পড়লে ঝড় উঠলে বুঝবে, বুঝবে। খাও খাও। পুরুষ মানুষ মাংস খাবে না, সে কি রকম কথা।

ছোটবাবু বলল, মাংসের আসলে যা চেহারা দেখেছি।

—পোকা দ্যাখো নি তো।

—পোকা?

—হ্যাঁ-হ্যাঁ পোকা।

ছোটবাবুর সঙ্গে সঙ্গে ওক উঠে এল। সে সোজা দৌড়ে গেল বাথরুমে। মৈত্র শুনতে পেল, ছোটবাবু বমি করছে।

—এ হলেই হয়েছে! সে তাড়াতাড়ি ভাত ফেলে ছুটে গেল। তুই ছোটবাবু এ-কথায় বমি করে দিলি! জাহাজে কি ট্রেনিং নিয়েছিস তবে। কচু ট্রেনিং! ওঠ। চল খাবি। তোকে জোর করে মাংস গেলাতে হবে, বমি তোর বের করে দিচ্ছি।

এনজিন-সারেঙ মেসরুমের বাইরে ছিলেন। জোরজার করে ছোটবাবুকে মাংস খাওয়ানো হবে বলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ছোটবাবুর মুখে রা নেই। এনজিন-সারেঙ মেসরুমে ঢুকে বললেন; মৈত্রমশায় কেন জোরজার করছেন। আস্তে আস্তে সব সয়ে যাবে। জোরজার করলে এই ভীতু ছেলেটা আরও ভয় পেয়ে যাবে।

মৈত্র, জাহাজের বড় টিন্ডাল। মৈত্রকে সারেঙ যথেষ্ট সমীহ করে কথা বলছেন এবং মৈত্র এ জাহাজের একজন দায়িত্বশীল মানুষ বুঝতে পেরে ছোটবাবু বলল, তাই মৈত্রদা। সময় ঠিক করে দেবে।

তবু মৈত্র কেমন গুম হয়ে বসে থাকল।—চল নিচে। ওরা নিচে নেমে গেলে দেখল ডেকজাহাজি বন্ধু অনিমেষ ওদের বাংকে বসে রয়েছে। অমিয়, ছোটবাবুর থালা গ্লাস ধুয়ে আনছে। ও এখনও নামে নি।

মৈত্র ভিতরে ঢুকেই গজগজ করছিল—হয়েছে বেশ, জাহাজে যে কেন আসা। মৈত্র টান মেরে লকার খুলে ফেলল, জামা কাপড় টেনে বের করছে। এ সব দেখে ওরা ঠিক বুঝল না মৈত্র এখন কি করতে চায়। মৈত্র তারপর একটি টিন বের করে বাংকের নিচে কি খুঁজছে। অমিয় এসে গেলে, ওর হাত থেকে একটা প্লেট টেনে তোয়ালে দিয়ে বেশ করে মুছল। অমিয়র সেই টিনটা। ওতে মুড়ি মোয়া নাড় আছে। গতকাল ওরা দুটো একটা করে খেয়েছে। অমিয় বাউন্ডুলে স্বভাবের ছেলে। সে দুটো একটার বেশি নিজে খায়নি। কিন্তু এখন যেন মৈত্র নিজের টিন থেকে মুড়ি বের করে দিচ্ছে। একবার অমিয়র দিকে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত।

ছোটবাবুর মনে হল এটা ঠিক হচ্ছে না। অমিয়কে ওর মা সফরে যাচ্ছে ছেলে, কবে ফিরবে ঠিক কি, পূজাপার্বণে ছেলের কথা মনে হবে, ছেলের জন্য বেশ যত্ন করে মোয়া, নারকেলের নাড়, তিলের তক্তি সব কত যত্ন করে সঙ্গে দিয়েছে। এ-ভাবে শেষ করে দেওয়া ঠিক না। সে বলল, মৈত্রদা আমার কিছু খেতে ইচ্ছা হচ্ছে না।

—খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না কেন? সারাদিন খেটে তো চোখ কোথায় গেছে! মুখ চোখ তো একেবারে ঈশ্বরের পুত্রের মতো করে রেখেছ। কে যে তোমাকে জাহাজে আসার ছাড়পত্র দিলো।

—সেই তো মৈত্রদা।

অমিয় বলল, খা না। কিছু তো একটা খেতে হবে।

মৈত্র ফের বলল, আরে জাহাজে বাবা মা কেউ কারো আসে না। আমরা নিজেরাই নিজেদের বাবা মা। সংকোচের কিছু নেই।

ছোটবাবু বলল, রাখো। খাচ্ছি।

তখন পোর্ট-হোল দিয়ে জেটির ও-পাশের ক্রেন দেখা যাচ্ছে। বন্দরের সব মানুষেরা ঘরে ফিরে যাচ্ছে। একটা জাহাজ ঢুকছে লকগেট দিয়ে। চোঙ মুখে পাইলট দু’পাশের মানুষদের দড়িদড়া ঢিলে দেবার অথবা টেনে ধরার নির্দেশ দিচ্ছে। বেশ সুন্দর উজ্জ্বল রোদ। সূর্য গঙ্গার ও-পাশে পাটকলের চিমনি পার হয়ে নারকেল গাছের ছায়ায় নেমে যাচ্ছে। সে কেমন অনিচ্ছার সঙ্গে খাচ্ছিল। ওকে ঘিরে ওরা চারজন নানারকম গল্প চালিয়ে যাচ্ছে। আর ক’দিন জাহাজ আছে, আর ক’দিন এ-ভাবে থেকে একদিন জাহাজ গিয়ে সমুদ্রে পড়বে। ছোটবাবু তখন শুধু ভাবছিল জ্যাক যদি বাবাকে বলে দেয়, যদি বলে দেয়, আমাকে বাবা ঠাট্টা করেছে এবং সে এ-ভাবে একসময় সেজেগুজে গিয়ে ওপরে দাঁড়াল। দেখল, ডেকের পাশে মাস্তুলের নিচে জাহাজিরা বসে তাস খেলছে। সে কেবল ভাবছিল, কখন সারেঙ ডাকবে, ছেলে তোকে ডাইনিংরুমে বাড়িয়ালা ডেকেছে। এবং এ-ভাবেই ক্রমে রাত্রি বাড়ে।

আর অজস্র নক্ষত্র আকাশে। চারপাশে জাহাজ, জেটির লাল নীল আলো। সেই পরিচিত আবহাওয়া। ঠিক সে যেমন রেলিঙে দাঁড়িয়ে ভদ্রা জাহাজে কত কিছু ভাবত, আজও তেমনি এক সময় ভাবতে গিয়ে দেখল বোট-ডেকের ও-পাশে জ্যাক দাঁড়িয়ে আছে। ওর মুখে নীল রঙের আলো। উইংসের আলো মুখে বেশ একটা মহিমময় স্নিগ্ধ সুষমা সৃষ্টি করেছে। তার কেন জানি নিমেষে সব ভয় কেটে গেল।

এবং এ-সবই কেবল বিকেলে সবুজ ঘাস মাড়িয়ে যাবার মতো। সে যে কতদিন কোনো মাঠের ঘাসের ওপর ধীরে ধীরে হেঁটে যায়নি। তার ভারি ইচ্ছে কাল বিকেলে যে চলে যাবে বড় মাঠে। একা একা হেঁটে সেই ফোর্ট উইলিয়ামের রেমপার্টে বসে থাকবে। যে ক’দিন জাহাজ এ বন্দরে আছে মাঠের ঘাসে বসে থাকবে। একা থাকলে সে নিজের সঙ্গে অজস্র কথা বলতে পারে। তার তখন কোনও কষ্ট থাকে না।

জাহাজে মাল বোঝাই প্রায় শেষ। সবই চটের গাঁট। সামনে পেছনে চারটা ফল্কাতেই পাটের গাঁট আছে। উপরে রয়েছে কিছু চায়ের পেটি। এবং জাহাজ ছাড়ার আগের দিন এল বড় বড় খাঁচায় সব সারস পাখি। পাখিদের ডেকের ওপরই রাখা হল। মোটামুটি বোঝাই শেষ। ক্রেনগুলো সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। চব্বিশ ঘন্টায় ফ্ল্যাগ উড়ছে। সকালে জ্যাক পাখিদের খাবার দিচ্ছে। জ্যাক বেশ একটা ভাল কাজ পেয়ে চুপচাপ। সে আর কারো দিকে তাকাচ্ছে না। ছোটবাবু বেশ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পেরেছে। সে আর কখনও কাছে যায় না। জ্যাক পোর্ট-সাইড ধরে হাঁটলে, ছোটবাবু যায় স্টাবোর্ড সাইড ধরে। মুখোমুখি হতে ছোটবাবু ভীষণ ভয় পাচ্ছে।

সারেঙকে ছোটবাবু সব খুলে বলেছিল। সারেঙ জবাবে বলেছে, খুব বেঁচে গেছ। ওর নালিশ দেবার স্বভাব না। সে কখনও বাপকে লাগায় না। এমন অতিষ্ঠ করে তুলবে, তুমিই শেষ পর্যন্ত বাড়িয়ালার কাছে ছুটবে। যতটা পার এড়িয়ে যাবে।

সে খুবই এড়িয়ে যাচ্ছে। যদিও জ্যাকের মুখ ভারি সুন্দর, জ্যাককে কখনই খারাপ লাগার কথা না, তবু ছোটবাবু আর তাকায় না। বরং ছোটবাবু দেখল, জাহাজ লকগেট দিয়ে নামছে। বড় মিস্ত্রি, মেজ মিস্ত্রি সবাই বোট-ডেকে দাঁড়িয়ে আছে। জ্যাক বাইনোকুলারে কিছু দেখছে।

ছোটবাবু জানে, বাইনোকুলারটা মেজ-মালোমের। তিনি এখন কাজে ব্যস্ত। জাহাজ নদীতে না নামা পর্যন্ত তিনি অবসর পাবেন না। সে জাহাজে উঠেই মেজ-মালোমকে দেখেছে মাঝে মাঝে তিনি বসে থাকেন বোট-ডেকে। চোখে থাকে বাইনোকুলার। অনেক দূরের কিছু দেখার আশা। খুব কাছে বড় বড় হয়ে দেখা দিলে বুঝি সব কিছুর মানে অন্যরকম তাঁর কাছে।

জাহাজের ওয়াচ আরম্ভ হয়ে গেছে। ছোটবাবুকে কোনও ওয়াচে রাখা হয়নি। এটা সারেঙ নিজেই ঠিক করেছেন। ওয়াচ ভাগের দায়িত্ব তাঁর। জাহাজে দুজন কোলবয় ফালতু। পাঁচ নম্বর অথবা চার নম্বর মিস্ত্রির সঙ্গে হেলপার হিসাবে কাজ করার কথা ওদের। ছোটবাবুকে সেজন্য ফালতু রাখা হয়েছে।

জাহাজ যাচ্ছে কলম্বোতে। বোর্ডে লেখা রয়েছে এমন। তারপর জাহাজ যাবে লরেঞ্জোমরকুইস এবং পরে ডারবান কেপ-টাউন হয়ে সোজা দক্ষিণ আমেরিকার সেন্টিসে। তারপর বুয়েনস-এয়ার্স। এই পর্যন্ত বোর্ডে লেখা রয়েছে। তারপর জাহাজ কোথায় যাবে, কেউ জানে না। এমন কি কাপ্তান পর্যন্ত বলতে পারবেন না। আর ব্যাঙ্ক লাইনের সফর বড় বেশি লম্বা সফর। কবে জাহাজ ফিরবে হোমে কেউ জানে না। আদৌ ফিরবে কি না, কারণ সমুদ্রের মায়ায় ভীষণভাবে মানুষেরা পড়ে যায়। তখন বুঝি পৃথিবীতে মাটি গাছপালা পাখি বলে কিছু আছে মনে থাকে না।

এবং এভাবেই সংসারে এক অতীব ইচ্ছা কখনও কখনও মানুষকে ভীষণ পাগল করে দেয়। কাপ্তানের পায়চারি দেখলে সেটা টের পাওয়া যায়। তিনি অন্যমনস্কভাবে হেঁটে যাচ্ছেন কেবল। তিনি কেবল জানেন, জাহাজের দূর্বলতম স্থান কোনটা। একটার পর একটা মেরামত করা হচ্ছে আবার অন্য জায়গায় ফুটোফাটা হয়ে যায়। বালকেডে নানারকম হিজিবিজি লোহার পাত লাগানো। কোনোটা সরে গেলে অথবা কোন কারণে ফুটোফাটা হয়ে গেলে কি হবে তিনি জানেন। এসব জানেন বলেই ব্যালেস্টের ওপর খুব নজর। একটা নয়, দুটো ব্যালেস্ট রেখেছেন। এবং এ জাহাজেই আছে একমাত্র উত্তরাধিকার তাঁর। তিনি তাকে নিয়ে উঠেছেন। তাঁর যে ভারি সখ ছিল—অন্তত একটা ছেলে। ছেলে না হলে এমন যে একটা পৃথিবী আছে, যার তিনভাগ জল, একভাগ স্থল, সমুদ্রে বের না হলে যা টের পাওয়া যায় না এবং সমুদ্রের এক ভারি আশ্চর্য টান আছে। সমুদ্রে তিনি জাহাজ নিয়ে প্রায় যাবতীয় দেশ এবং সমুদ্রের দ্বীপ, গাছপালা, ঝড় টাইফুন, তিমি মাছ, ডলফিনের ঝাঁক অথবা সিন্ধুঘোটক দেখে বেড়িয়েছেন। তাঁর মতো সেই উত্তরাধিকারও পুরুষানুক্রমে সেই ধারা টেনে নিয়ে যাবে এবং এভাবেই তিনি ভেবে থাকেন। মেয়েটাকে ছেলে বানিয়ে রাখেন। ছেলেটাকে সঙ্গে নেন। আসলে ওসব বলতে হয় চিফকে। –দ্যাখো নদী দ্যাখো। এর নাম কলকাতা বন্দর, হুগলী নদীর তীরে অবস্থিত বন্দর। তোমাদের পূর্বপুরুষরা এ বন্দরে প্রথম কলের জাহাজ নিয়ে এসেছিল। তুমি এসব দেখে রাখো।

বনি বাপের পাশে দাঁড়িয়ে চোখে দূরবীন লাগিয়ে সব দেখছে। সে স্থির। গরমকাল। সে গলস্‌ পরেছে চোখে। যখন দূরবীন পরছে না, তখন গগল্স্ পরে থাকছে। এটা গ্রীষ্মের বিকেল, এবং সারা দিনের প্রচণ্ড উত্তাপে জাহাজ-ডেকে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। বোট-ডেক কাঠের। ডেক-জাহাজিরা জল মারছে এখন। জাহাজ বেশ দুপাশে বয়া রেখে এগিয়ে যাচ্ছে। এনজিনে খুব একটা স্টিমের দরকার হচ্ছে না। দুটো বাঙ্কারে দুজন কোলবয় একটু ফাঁক পেয়ে বিড়ি খাচ্ছে। এবং গুহার মতো কিছু সাইড বাঙ্কার থেকে সোজা স্টোক-হোলডে নেমে গেছে। অথবা সুট বলা যেতে পারে। কয়লা হড়হড় করে নেমে গেলে আবার সুট ভরে ফেলতে হবে। ক্রস-বাঙ্কার খোলা আছে। বাংকারে কয়লা ছাদ পর্যন্ত বোঝাই। দরজা খুলে বেলচা মেরে দিলেই হড়হড় করে নেমে আসে। তিনজন ফায়ারম্যান উইণ্ডসেলের নিচে দাঁড়িয়ে স্টিম দেখছে। খুব একটা স্টিম লাগছে না। একশো আশি হলেই হয়ে যাচ্ছে। অল্প কয়লা খাচ্ছে। এখনও স্টোক-হোলড তেমন তেতে যাচ্ছে না। বালকেডগুলো হাত দিয়ে ছোঁয়া যাচ্ছে। আসলে কাজ আরম্ভ এখনও ঠিকমতো হয়নি। মৈত্রের ওয়াচ। সে মাঝে মাঝে হেঁটে যাচ্ছে। ওর নীল রঙের টুপি, হাতে দস্তানা, পায়ে পুরানো বুট জুতো। সে মাঝে মাঝে ফার্নেস-ডোর খুলে দেখছে, কোনটায় কয়লা মেরে দিতে হবে, কোনটায় র‍্যাগ মেরে ছাই ফেলে দিতে হবে, অথবা কোনটাতে স্লাইস মেরে কয়লার চাঙ টুকরো টুকরো করে দিতে হবে। সে নিজেই দেখে যায়। কখনও এয়ার বালব ছেড়ে দেয়। মাঝে মাঝে এনজিনরুম থেকে গ্রীজার ছুটে আসে। মেজ-মিস্ত্রি ছুটে আসেন। কম, কম স্টিম মাংতা। আসলে জাহাজটা যাচ্ছে ভীষণ ধীরে ধীরে। কলকাতা বন্দরকে ভারি অবিশ্বাস সকলের।

তখন ছোটবাবু দেখল বেশ নিরিবিলি একজন মানুষ বোট-ডেকে ডেক-চেয়ারে চুপচাপ বসে আছে। পাশে মেস-রুম-বয় কফি রেখে গেছে। একটা ছোট টিপয়ে দুটো বই। বইয়ের ওপর আপেল একটা। ছোটবাবু তখন স্নান সেরে ডেক ধরে উঠে যাচ্ছে। অমিয় এবং মৈত্রের ওয়াচ আছে। ওরা চারটার ওয়াচ শেষ করে উঠে এসেছে। ওদের স্নান সারতে সময় লাগবে। এসময় বাথরুমে ভীষণ ভিড়। সে একটু পায়চারি করবে বলে ডেক ধরে যাচ্ছে। আসলে ওর ফোকসালে বসে থাকতে ভাল লাগছে না। কত কথা মনে হচ্ছে। এখনও সে এ-দেশের গাছপালা, বাড়িঘর, কলের চিমনি এবং জেলেডিঙ্গি অথবা জাহাজ ঢুকছে খাড়িতে এসব দেখতে পাচ্ছে। এখনও সে দেখতে পাচ্ছে দূ’পাশে কি সুন্দর নারকেল গাছ, মানুষের ছায়া। ঘুরে ফিরে মা, ছোট ভাইবোন, বাবার মুখ নদীর জলে ভেসে উঠছে।

মেজ-মালোমের পাশ কাটিয়ে সে নেমে যাচ্ছিল। আসলে সে চুরি করে মেজ-মালোমের দূরবীনটা দেখতে চাইছে। ওর ভারি সখ দূরবীন দিয়ে দু’পাশের গাছপালা পাখি দেখে। কিন্তু সে তো সবচেয়ে ছোট কাজ করে। সে যদিও জাহাজিদের ভিতর সবচেয়ে পড়াশোনায়ালা আদমি, এটা জাহাজে সারেঙই প্রচার করে দিয়েছে। সবাই খতটত লেখাবার জন্য আসবে সেটাও ঠিক। এবং সুন্দর ইংরেজি বলতে পারে বলে ফাইবারও বেশ পছন্দ করে ওকে কাজের সময়। চার নম্বর মিস্ত্রি দেখেছে; ছেলেটিকে কোনো কাজ একবার বললেই বুঝে নেয়। বার বার প্রশ্ন করে বিরক্ত করে না।

মেজ-মালোমের মনে হচ্ছিল, এই যে ছেলেটি যাচ্ছে জাহাজে, যার চোখ ভারি আশ্চর্য মিষ্টি, মুখে গোঁফের রেখা, গালে দাড়ি মাত্র কালো হয়ে উঠেছে এবং প্রায় যেন লম্বা গাছের মতো শান্ত নিরীহ, কিছু বলতে চায় না, জাহাজে উঠেই চুপ মেরে গেছে তাকে একবার ডেকে বললে হয়, তুমি বাবু জাহাজে উঠেই গুম মেরে গেলে কেন? তারপরই মেজ-মালোম ডাকল, হেই।

সে কাছে গিয়ে খুব সুন্দর এবং স্পষ্ট ইংরেজিতে বলল, আমাকে ডাকছেন স্যার?

—হেঁ।

সে ছুটে গিয়ে আরও সামনে দাঁড়াল।

—এসব জায়গার কি নাম?

—ফলতা হবে। তবে আমি স্যার ঠিক বলতে পারব না।

—তোমার দেশ, তুমি জান না?

—এখানে তো কখনও আসিনি স্যার।

—কিচ্ছু নেই।

—ছোটবাবু বলল, না স্যার, গাছ-পালা, বাড়ি-ঘর, গ্রাম, মাঠ সব আছে।

—না, কিচ্ছু নেই।

—না স্যার, সব আছে।

—কিছু নেই। তুমি দ্যাখো, কিছু দেখা যায় কিনা, বলেই তিনি কফি খেতে থাকলেন।

ছোটবাবু তাড়াতাড়ি দূরবীনটা চোখে লাগালে দেখতে পেল, বেশ সব বড় বড় কলের চিমনি। কি যে বড়! আকাশে উঠে গেছে যেন একটা নারকেল গাছ। তারপর একটা বাঁধানো ঘাট, মানুষজন নেই, চিতায় আগুন-টাগুন আছে। সে দেখছে আর বলে যাচ্ছে। সব আছে স্যার। মানুষের যা যা দরকার সব আছে স্যার।

—আসল জিনিষটা নেই। তিনি আপেল খাচ্ছেন কামড়ে। তার গালে সামান্য দাঁড়ি মুখে প্রবীণতার ছাপ। চোখ দুটো খুব তাজা। বেশ খচমচ করে খেয়ে যাচ্ছেন। ভালো করে দ্যাখো। আমার দেখতে দেখতে চোখ টাটাচ্ছে।

ছোটবাবু দেখছিল সব। সে বলতে বলতে মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে। কেমন ছায়াছবির মতো সব সরে যাচ্ছে।

মেজ-মালোম বললেন, সব বললে হে, কিন্তু একটা কথা বললে না।

—কি স্যার?

—ওম্যান! ওম্যানের কথা বললে না।

—তা স্যার দেখলাম নাতো।

—তাহলে তুমি বলছ মানুষের জন্য যা দরকার সব আছে?

—না স্যার ঠিক বলিনি। ছোটবাবু কি যে ফ্যাসাদে পড়ে গেল। সে মুখ খুব কাঁচুমাচু করে রেখেছে।

—মানুষের জন্য যা যা দরকার সব আছে শুধু আসল জিনিসটাই নেই জাহাজে। বুঝবে ঠ্যালা। সমুদ্রযাত্রা কাকে বলে বুঝবে। বলেই সে থু করে আপেলের বোঁটাটা মুখ থেকে ফেলে দিল।—এজন্য বসে থাকি। বসে থাকি আর ভাবি, বেশ দিনকাল কেটে গেল। জীবনের সবটাই জাহাজে কেটে গেল। আসল জিনিসটাই মাঝে মাঝে কেমন জীবন থেকে হারিয়ে যায়। খুঁজি। খুঁজে যখন পাই তখন বন্দর থেকে জাহাজ ছেড়ে দেয়।

ছোটবাবুর ভারি মজা লাগছিল। বেশ মানুষটা। সে পরে আছে সাদা প্যান্ট গা-খালি। গায়ের রং শঙ্খের মতো সাদা অথবা মানুষের চামড়া তুলে নিলে যে রং হয়—তেমনি সাদা লালে মিলে এক আশ্চর্য কঠিন রং এবং গরমে পুড়ে কেমন ফোস্কা পড়ার মতো। পিঠের ওপরে ঠিক কাঁধের নিচে ঘা। কিছু মলম-টলম মাখানো।

এটা হয়। যারা শীতের দেশের মানুষ, তাদের এই গরমে রোদে ঘোরাঘুরি করলে ফোসকা পড়ে যায়। মানুষটার কোন কষ্ট হচ্ছে বোঝাই যায় না। বেশ শুনে যাচ্ছে। তারপর? —জাহাজ যাচ্ছে। জল কেটে জাহাজ যাচ্ছে। আর বাতাস কেটে ছায়াছবির মতো সব পার হয়ে যখন ছোটবাবু দেখল সূর্য অস্ত যাবার মুখে তখন মেজ ওঠে বললে, নসিব খারাপ। সে দুটো একটা যে বাংলা জানে ছোটবাবুকে এমন বলে যেন সমঝে দিতে চাইল।—নো ওম্যান। ঠোঁট উল্টে সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে তড়তড় করে নেমে গেল। যেন চোখের ওপর থেকে ভোজবাজির মতো অদৃশ্য হয়ে গেল মানুষটা।

সে একা দাঁড়িয়ে থাকল। উইংসে মাস্তুলে ডেরিকে, কেবিনে কেবিনে সব আলো জ্বলছে, লাল নীল রঙের আলো। ছোটখাটো একটা যেন শহর নিয়ে ছোটবাবু নদী ধরে সমুদ্রে নেমে যাচ্ছে। এনজিনের একটানা শব্দ উঠে আসছিল। সমস্ত আকাশ জুড়ে নক্ষত্রের যে নামটাম মুখস্থ করে রেখেছিল সে সব মনে করার চেষ্টা করল। কবে একবার একটা বিদেশী ছবিতে কোনও ধর্মীয় সঙ্গীতের সময় সে শুনেছিল এক আশ্চর্য সিমফনি। নির্জনতা, একাকীত্ব সে সিমফনির সুরে সুরে ভরা। তারপর মনে হল, এইসব নক্ষত্র দেখতে দেখতে মনে হল, সে ভীষণ একা। ভীষণ সে অসহায়। সে কোথায় যাচ্ছে জানে না, কোথায় এর শেষ জানে না, কবে ঘরে ফিরবে জানে না। এমন নিরুদ্দেশে যাত্রা মানুষের হয় তার জানা নেই। কে যেন বলেছিল এ-বংশের একজন না একজন নিরুদ্দেশে যাত্রা করে থাকে। তারা কেউ আর ফিরে আসে না। তুমি আমার জেনারেশনে সেই মানুষ ছোটবাবু। তুমি বোধহয় ফিরে আসছ না।

মনে হল তখন কেউ পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সে দেখল, মৈত্রদা।—কিরে মন খারাপ! দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছিস বলে মন খারাপ। মৈত্রদা না এলে সে সত্যি ভীষণ যেন এখন ভয় পেয়ে যেত।

ছোটবাবু ঘুরে দাঁড়াল।

—তোর এরকম হবার কথা না তো। মন খারাপ হবে আমাদের। বিয়ে করেছি। বৌ থাকল ঘরে। আমি ভেসে গেলাম সমুদ্রে। কিছু একটা হলেও কিছু করার থাকবে না। ছুটে আসতে পারব না। কত সব চিন্তা। ভাবলে ঘুম আসে না।—আয়, একা একা থাকবি না। জাহাজে একা একা থাকা খুব খারাপ। গল্পটল্প করে সব ভুলে থাকবি।

—এখানে আমি আছি কে বলল তোমাকে?

—আমরা জানি কে কোথায় থাকতে পারে। বলে হাসল। তুমি যে বোট-ডেকে থাকবে আমরা জানতাম। তোমার খুব যে ইচ্ছা কাপ্তানের ছেলেটার সঙ্গে বন্ধুত্ব হোক সেটা আমরা বুঝি!

—না মৈত্রদা। সত্যি তা না। এখান থেকে চারপাশটা স্পষ্ট দেখা যায়। এখানে মানুষজন কম থাকে, এখানে মেজ-মালোম দূরবীন নিয়ে বসেছিলেন। আমার ভারি সখ ছিল দূরবীনে পাড়ের গাছপালা দেখি।

—বেশ করেছ। এখন এস। লক্ষ্মী ছেলেটির মতো খেয়ে নাও। কাল সকালে সমুদ্রে পড়ব। তখন আর ঠিকমতো খেতে পারবে না। জাহাজে পিচিঙ আরম্ভ হয়ে যাবে।

মৈত্র এভাবে কখনও ছোটকে তুই তুকারি করে কখনও তোমার বলে। এভাবে সে-রাতে ছোটবাবু বেশ পেট ভরে খেল। মনে হল জাহাজে খুব একটা পরিশ্রমের কাজ থাকে না। যা শুনেছে তা, এমন কি ভীতিকর সে বুঝছে না। যদিও সমুদ্রে জাহাজ পড়বে কাল সকালে। তিন জোয়ারে জাহাজ সমুদ্রে গিয়ে পড়বে। ফলতার কাছে ওদের একবার নোঙর ফেলতে হয়েছে, রাতে এক জায়গায়, সকালে সমুদ্র দেখতে কেমন না জানি হবে।

ভোরের দিকে ঘুম ভাঙলে মনে হল জাহাজটা একেবারে থেমে গেছে। বোধহয় নোঙর ফেলেছে। ছোটবাবু ওপরে উঠে এল। বা বেশ। সে চিনতেই পারছে না। পাইলট নেমে যাচ্ছে জাহাজ থেকে। ওপরে অজস্র পাখি। বড় বড় পাখি। যেন কি করে টের পেয়েছে একটা পুরানো জাহাজ যাচ্ছে সমুদ্রে। টের পেয়েছে, প্রচুর খাবার এই জাহাজে। ওরা মাস্তুলের ওপর ঝাঁকে ঝাঁকে বসে রয়েছে। আর সেই দিগন্ত বিস্তৃত নীল জলরাশি। ছোটবাবু ভাবল জলরাশি না বললে এর ঠিক ওজন থাকে না। অসীম জলরাশি। পারাপারহীন জলরাশি। আকাশ এবং সমুদ্র মিলে এক নীল ভূখণ্ড যেন। এভাবে একটা সাদা জাহাজ নীল জলরাশির ভিতর নীল আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থাকলে আশ্চর্য, ছবি হয়ে যায়। আর পাখিগুলো সাদা বিন্দু বিন্দু প্রজাপতির মতো অনবরত সেই ছবির ভেতর উড়ে বেড়াচ্ছে। ছোটবাবু এমন একটা নিথর জগৎ আছে, এমন একটা ধীর স্থির সমুদ্র আছে, জানত না। পাইলট সিপটাই ছিল ডাঙ্গার শেষ সূত্র। সেও ক্রমে দূরে দূরে সরে একসময় সমুদ্রের ঢেউয়ের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল।

ছোটবাবু ডেকের ওপরে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না আর। জাহাজ এগিয়ে যাচ্ছে। দ্রুতগতিতে জাহাজ এগিয়ে যাচ্ছে। জাহাজ হেলছে দুলছে। মাস্তুল, ডেরিক, দড়িদড়া হেলছে দুলছে। এভাবে দাঁড়ালে বেশিক্ষণ সে ডেকে দাঁড়াতে পারবে না। সে দু’পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে ছিল, তারপর সামনে পেছনে বেশ ঝুঁকে ঝুঁকে তাল রেখে হেঁটে গেল। টুইন-ডেক পার হয়ে দ্রুত ছুটে গেল সামনে। জাহাজের আগিলে সে উঠে দাঁড়াল। শেষবারের মতো বোধহয় পাইলট সিপটাকে সে দেখতে চায়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। সে ফিরে আসছে। জাহাজের পিচিঙ আরম্ভ হয়ে গেল বলে মাথা পেট গোলাচ্ছে। অথচ তার কাজ ফাইবারের সঙ্গে। তাকে এ-জাহাজে এভাবে এ-সফরে কাজ করে যেতে হবে। সে আর থামতে পারে না। ফিরে যেতে পারে না।

সে ফিরে আসার মুখেই দেখল জ্যাক মাংস কেটে পাখিদের খাওয়াচ্ছে। জ্যাক লম্বা বয়লার স্যুট পরেছে। পায়ে কেডস জুতো। ছোটবাবু সন্তর্পণে পালাচ্ছে। পালাবার সময়ই মনে হল কেউ সহসা ডাকছে—হেই। সে পড়ে যেতে যেতে কোনরকমে উঠে দাঁড়াল। দেখল, আড়চোখে তাকে দেখছে জ্যাক। সে এবার প্রায় ছুটে পালাল। জাহাজে পিচিঙ, এভাবে ছুটলে সে পড়ে যেতে পারে তার তাও মনে থাকল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *