1 of 2

অলৌকিক জলযান – ২৭

গাছপালা, সবুজ গাছপালার ভেতর দিয়ে, তারপর আনারসের ক্ষেত মাইলের পর মাইল, কোথাও কমলালেবুর বাগান এবং নীলকুঠি, পাশে স্যালি হিগিনস, সঙ্গে খাবার নানারকমের এবং কোনো উপত্যকায় গাড়ি উঠে গেলে নির্মল আকাশের নিচে উজ্জ্বল রোদে ওর বালিকার মতো হেঁটে যাওয়া, পর্বতগাত্রে নিজের নামের পাশে স্যালি হিগিনস এই সব বর্ণাঢ্য ছবি ভেসে উঠলে ভেতরে ভেতরে কেমন গুম মেরে যান। সে-বয়সে এলিসকে সত্যিই বালিকা ভাবা চলে। সমুদ্রে এলিসের ভীষণ একঘেয়ে জীবন, এই ডাঙ্গায়, কোন রেস্তোরাঁতে বসে সামান্য মদ্যপান, এবং চাইনিজ অথবা ফরাসী খাবার খেতে খেতে লাস্যময়ী হয়ে যাওয়া সবই সেদিনের কথা মনে হলে তিনি আর স্থির থাকতে পারেন না। এবং এসব ভাবলেই এলিস ওর সামনে এসে দাঁড়ায়, বলে, আমি এলিস। হিগিনস, আমাকে তুমি চিনতে পারছ না? তারপরই সেই পতনের শব্দ পান। জাহাজ থেকে সমুদ্রে কেউ পড়ে গেল। তিনি এলিসের ভাবনায় এ-জন্য কখনও মগ্ন হয়ে যান না।

ছোটবাবু, জ্যাক পায়ের কাছে চুপচাপ বসেছিল। হিগিনস কিছু না বললে, সে কিছু আর বলতে পারে না। বোধ হয় হিগিনস টের পাচ্ছিলেন, ছোটবাবু এভাবে বসে থাকতে বিব্রত বোধ করছে এবং জ্যাকও যখন আর কোনো কথা বলছে না, তখন ঠিক চুপচাপ থাকা ঠিক না। তিনি বললেন, পাখিগুলো কোত্থেকে যে এল!

ছোটবাবু যা হোক একটা কথা পেয়ে গেছে। সে বলল, এটা কেন যে হল?

—আমি এর কিছু জানি না। তিনি পায়ের ওপর পা রেখে দোলাতে থাকলেন। একবার চুলের ভেতর আঙ্গুল চালিয়ে চুল টানলেন। ওপরের পাটির দাঁত ঠেলে আবার ঠিক জায়গায় বসালেন। কথা শুরু করার আগে ঠিক তাঁর এমন সব অভ্যাস বজায় রাখেন। তিনি ফের বললেন, জাহাজের অনেক কাহিনী, গল্পগাঁথা হয়ে যায়। নাবিকের ডাইরী থেকে এমন সব আজগুবী কাহিনী অনেক পাওয়া যায়। যার কোনো সঠিক ব্যাখ্যা চলে না। তোমার মনে আছে হয়তো, কী ভয়ংকর ব্রেকারের ভেতর পড়ে গেছিলে। এর কার্যকারণ আমরা জানি না। ডাইরীতে লেখা থাকবে। এই যেমন অনেকের লেখা থাকে। নাবিকের ডাইরী থেকেই জেনেছিলাম, প্রশান্ত মহাসাগরে এ-সব পাখিদের আস্তানা রয়েছে। কিন্তু কেউ খুঁজে বের করতে পারে নি বলে কাল্পনিক ভেবেছে সবাই।

তিনি বললেন, এই যে জ্যাক। ঘুমোচ্ছ?

জ্যাক বলল, যাঃ ঘুমোব কেন?

—কথা বলছ না। হাটুর ভেতর মাথা গুঁজে রেখেছ?

জ্যাক যেন সমবয়সী বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছে। সে তার বাবাকে একদম পাত্তা দিতে চাইল না। ছোটবাবুর ভারি মজা লাগছিল। জ্যাক কেমন অনায়াসে বলে ফেলল, বাবা আমার ঘুম পাচ্ছে। তোমার কোনো কথা শুনতে আর ভালো লাগছে না।

ছোটবাবুকে ভালো শ্রোতা পেয়ে বুড়ো মানুষটা বর্তে গেছেন। জাহাজে তাঁর কথা বলার লোক কম। ছোটবাবুকে প্রথম থেকেই ভালো মানুষ ভেবে ফেলেছেন। ছোটবাবুর সব সে জেনেছে—জ্যাক তো যত কথা বলে তার বেশির ভাগ ছোটবাবুকে নিয়ে। ছোটবাবুর পাশে বসে থাকতে জ্যাকের ভাল লাগার কথা। কিন্তু জ্যাক বসে থাকতে চাইছে না, এত তাড়াতাড়ি ঘুম পাচ্ছে—জ্যাকের কি ভাল লাগছে না বুড়ো মানুষটাকে—কেমন চাপা অভিমান তাঁর—জ্যাক বড় হয়ে গেছে বুঝতে পারছেন, ঠিক বালিকার মতো স্বভাব এখন আর তার নেই। মাঝে মাঝে জ্যাক এমন গম্ভীর হয়ে যায় যে, তিনি নিজে পর্যন্ত কথা বলতে ভয় পান।

সুতরাং ছোটবাবুই তার একমাত্র সময় কাটানোর মতো মানুষ। ওপরে থার্ড-মেট আছে। বারোটা পর্যন্ত তিনি জেগে থাকবেন। ওরা ছেলেমানুষ—ওদের বেশি রাত পর্যন্ত আটকে রাখা ঠিক না। তবু যা বলছিলেন, শেষ না করলে ছোটবাবুর মনে তার সম্পর্কে সংশয় থেকে যাবে। সমুদ্র সম্পর্কে সঠিক ধারণা হবে না।

তিনি বললেন, সমুদ্রে কি হয় না হয় কেউ বলতে পারে না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগের ঘটনা। জাহাজে তখন চিফ-মেটের প্রমোশন পেয়েছি। চীন উপসাগরে জাহাজ। সকালের দিকে আরও দুটো জাহাজ পাশাপাশি। এই ধর পঞ্চাশ মাইলের ভেতর। মাঝে মাঝে ঠিক বেতার সংকেত চলে আসছে। দুপুর পর্যন্ত আমরা খবরাখবর ঠিক রেখে যাচ্ছি। আর বিকেলে খবর এরিয়া স্টেশন থেকে—এস এস সিটি অফ পানামার খোঁজ নেই। কোনো এস-ও-এস ছিল না। সমুদ্রে কোনো ঝড় নেই। ঘন্টা তিনেকের ভেতর হংকং থেকে উড়ো জাহাজ ফ্লাই করল, আমরা এগিয়ে গেলাম—কিচ্ছু দেখা গেল না। জাহাজ মিসিং। জাহাজের কুটোগাছটি কোথাও আমরা ভেসে যেতে দেখলাম না। একেবারে রহস্যের অন্তরালে সে চলে গেল।

তিনি থেমে বললেন, এভাবে কত জাহাজ মিসিং হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। ওরা যে গভীর সমুদ্র থেকে উঠে আসা কোন প্রাচীন দানবের সাক্ষাৎ পায়নি কে বলবে। জাহাজটাকে যে নিমিষে কোন চম্বুকের পাহাড় অতল সমুদ্রে ডুবিয়ে দেয়নি কে বলবে, অথবা এইসব বিষাক্ত পাখিদের মতো আরও অতিকায় নাটকীয় কিছু ঘটেনি কে বলবে। সব তো লেখা থাকে না। লেখা থাকলেও কাল্পনিক ভেবে নিতে কতক্ষণ।

—কিন্তু আর্চির মুখের দাগ!

—সবাই বলবে, মারামারি করতে গিয়ে কেউ আঁচড়ে খামচে দিয়েছে। জাহাজ থেকে নেমে বেটারা বেশ গল্প ফেঁদেছে এ-সবও যে বলবে না তার বিশ্বাস কি! তবু তুমি যা দেখলে ভাববে, জাহাজ সমুদ্রে এভাবেই সব প্রতিকূলতার ভেতর পড়ে যায়। ওঁর ইচ্ছে থাকলে বাঁচেন, ইচ্ছে না থাকলে বাঁচেন না। সমুদ্রে তিনিই সব। বলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। জ্যাক সত্যি ঝিমুচ্ছিল। তিনি ডাকলেন, জ্যাক শুতে যাও। এই জ্যাক তুমি ঘুমোচ্ছ? ঠিক ঘুমোচ্ছ।

—হ্যাঁ আমি ঘুমোচ্ছি। বলে জ্যাক যখন উঠে দাঁড়াল, জ্যাকের চোখ লাল। জ্যাক ঘুমিয়ে পড়েছে এটা ভাবতে সে লজা পাচ্ছে। সে বলল, তুমি যাচ্ছ?

—তোমরা যাও। বলে তিনি যুবক বয়সে যেভাবে সিঁড়ি ভাঙতেন, প্রায় তেমনি সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলেন। জ্যাকের কেবিন যেহেতু বোট-ডেকে সে দরজার পাশে এসে বলল, গুড-নাইট।

ছোটবাবু বলল, গুড-নাইট। কিন্তু জ্যাক দেখল, ছোটবাবু নিচে সিঁড়ি ধরে নেমে যাচ্ছে না। সে বোট-ডেক ধরে হেঁটে যাচ্ছে। সে ডাকল, এই ছোটবাবু কোথায় যাচ্ছ আবার?

—একটু পরে শোব। ঘুম পাচ্ছে না।

—এই যে বললে, ঘুম পাচ্ছে খুব। ওপরে উঠবে না।

—এখন আর পাচ্ছে না।

—আমারও পাচ্ছে না বলে সে দৌড়ে ছোটবাবুর কাছে চলে গেল।

—কোথায় যাচ্ছ? —কোথাও না।

—তুমি রাগ করেছ ছোটবাবু?

—রাগের কি আছে!

—না এই যে ডেকে আনলাম। মিথ্যে কথা বলে বাবার কাছে বসিয়ে রাখলাম।

—আরে না। তুমি যে কি না জ্যাক। ঘুমোও গে তো।

জ্যাক বলল, কি যে সুন্দর লাগছে না আকাশটা।

—কত নক্ষত্র! ছোটবাবু দাঁড়িয়ে গেল।

—দ্যাখো এরা সবাই জাহাজটার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে না, আমাদের সঙ্গে সবাই যাচ্ছে তাহিতিতে।

—তাইতো!

ওরা বোটের আড়ালে দুজনে বসে পড়ল। জ্যাক তার পাশে বসেছে, একেবারে গা ঘেঁসে এবং পুষিবেড়ালের মতো করছে। জ্যাক কি যে ছেলেমানুষী করছে। এবং মাঝে মাঝে সে বিরক্ত হয়ে পড়ছে। বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, তুমি ঠিক হয়ে বোস। এভাবে গোটা শরীর ছেড়ে দিলে বসতে পারি। কিন্তু বলতে পারে না। জ্যাক এখন চুপচাপ আকাশ দেখছে। নক্ষত্র দেখছে। সাত-পাঁচ মুখে যা আসছে বলে যাচ্ছে। ওর বাবা রাতের পর রাত নক্ষত্র দেখে জেগে থাকতে পারত। ওর বাবা কোন্ আকাশে কোন্ সময়ে কি কি নক্ষত্রের সমাবেশ ঘটে বলে দিতে পারে। যেমন তার ইচ্ছে বাবার কাছ থেকে সে সব নক্ষত্রের নাম জেনে নেবে, এবং রাতে যখন কিছু ভাল লাগবে না, ছোটবাবুকে সঙ্গে করে বোট-ডেকে উঠে আসবে এবং এক-দুই করে সমস্ত আকাশের নক্ষত্রের নাম বলে যাবে ছোটবাবুকে। কি যে সব মাথামুন্ডু বলছে। ওর পিঠে হেলান দিয়ে জ্যাক বেশ সুখে বসে রয়েছে। জ্যাকের মুখ যমুনাবাজুর দিকে। ওর মুখ সমুদ্রের দিকে।

তখন মনে হল ঠিক নিচে আরও একজন একাকী এভাবে দাঁড়িয়ে আছে। উইন্ডসেলের পাশে, চুপচাপ, সমুদ্রের নির্জনতার ভেতর আকাশ দেখছে। প্রথমে ভূতটুতের ব্যাপার ভাবল, তারপর তড়াক করে লাফিয়ে দেখতে গেল কে এভাবে দাঁড়িয়ে? কাছে গিয়ে বুঝতে পারল, এনজিন সারেঙ। সাদা চুল সাদা দাড়িতে এমন সুন্দর চেহারা জাহাজে আর একটিও নেই। ছোটবাবু বলল, চাচা আপনি।

—তুই! তুই এখনও জেগে আছিস। শরীর খারাপ করবে।

—আমি একা না। জ্যাকও আছে।

—জ্যাক! কেমন গুটিয়ে গেলেন এনজিন-সারেঙ।

ছোটবাবু বলল, জ্যাক ভীষণ ভাল চাচা। জ্যাক এগিয়ে এস।

সারেঙ-সাব বললেন, থাক থাক। বলে টুইন ডেক ধরে হাঁটতে থাকলেন। ছোটবাবু কি করবে বুঝতে পারল না। পাশে পাশে হেঁটে গেল। মানুষটা পৃথিবীতে ভীষণ একা। এখানে দাঁড়িয়ে এত রাতে কি দেখছিলেন সে বুঝতে পারল না। গত রাতে ওরা একটা দুঃস্বপ্নের ভেতর ছিল, কেউ যেন এখন তা মনে করতে পারছে না। সে এগিয়ে গেল। বলল, চাচা আপনার শরীর ভাল তো? এমন একটা প্ৰশ্ন এত উদ্বিগ্ন গলায় জাহাজে কেউ তাঁকে করতে পারে তাঁর জানা ছিল না। তিনি দাঁড়ালেন। ছোটবাবুর মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ভাল আছি। বুড়ো মানুষের সব সময় ভাল থাকা ছাড়া উপায় থাকে না ছেলে।

ছোটবাবু বলল, আপনাকে দেখে ভীষণ খারাপ লাগছে।

—কেন রে!

—আপনাকে বড় একা মনে হয়।

—আমি একা থাকব কেন। আমার আল্লা আছেন না। তিনি থাকলে আমার আর কিছু লাগে না ছেলে। আমি তাঁর কাছে আছি ভাবতে ভাল লাগে। সবাই ঘুমিয়ে থাকলে, জাহাজ ডেকে চুপচাপ দাঁড়াতে ভাল লাগে। এত বড় সমুদ্রে রাতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলে তাঁকে খুব কাছে পাওয়া যায়।

এবং এভাবে সারেঙ-সাবকে দেখলেই আর একজন মানুষের কথা সে না ভেবে পারে না। ঠিক যেন সেই মানুষ তাকে রক্ষা করতে জাহাজে উঠে এসেছেন। দেশভাগের সময় যে তিনজনকে সঙ্গে নিয়ে গেলে মনে হত ওর পৃথিবীতে তার কিছু হারায় নি, তিনি ছিলেন তাদের একজন। জাহাজে উঠে ছোটবাবু অন্ততঃ সেই একজনকে আবার ফিরে পেয়েছে। সে বলল, চাচা আমি ঠিক পারছি তো!

চাচা বুঝতে না পেরে, ওর দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

–এই কাজ কর্ম। আপনি তো ভয়ে জাহাজে নিতে চাননি। আমি কিন্তু চাচা আপনার এতটুক অসম্মান হয় তেমন কাজ করি নি।

—তুই এ-সব বলছিস কেন?

—আমার কেবল ভয় হত, আপনি ছোট না হয়ে যান। হাতে ধরে আপনি আমাকে এনেছেন।

—আমাকে তো তুই অনেক বড় করে দিয়েছিস।

ছোটবাবু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল।

এনজিন-সারেঙের চোখ ছলছল করছে। বললেন, পারবি। পারবি তুই। আর দাঁড়ালেন না। দ্রুত চার নম্বর ফল্কা পার হয়ে গ্যালির কাছে উঠে গেলেন। জ্যাক কিছু বুঝতে পারল না। সে দূরে দাঁড়িয়ে শুধু দেখছে। ছোটবাবু কেমন মুহ্যমান। এটা যে কি হয় মাঝে মাঝে ছোটবাবুর। মাস্তুলের নিচে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ছোটবাবু কি তার লিট্ল প্রিন্সেস-এর জন্য খোলা ডেকে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। সারেঙ-সাব কি তাকে কোনো খবর দিয়ে গেল। এবং কাছে গিয়ে ডাকল, এই ছোটবাবু, ছোটবাবু! তুমি এভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন?

ঘুম থেকে জেগে ওঠার মতো মুখ, নিমেষে, সে তার ছোট আর এক গ্রহ থেকে যেন ঘুরে এল। তাদের প্রিয় আশ্বিনের কুকুরের কথা মনে হল। বর্ণময় লতাপাতা ঘেরা এক পৃথিবী, সেখানে একজন মানুষ কেবল হেঁটে যাচ্ছেন। তাঁর মুখে কিটসের কবিতা। সে বলল, জ্যাক তুমি কিটসের কবিতা আবৃত্তি করতে পার?

—কিটসের কবিতা! কেন বলতো!

—এই এমনি। বলে সে হাঁটতে থাকল। সে বলতে পারল না, আমি যে গ্রহ থেকে এসেছি জ্যাক সে ভারি সুন্দর গ্রহ। এত দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছি, তেমনি সুন্দর ছোট্ট গ্রহ কোথাও খুঁজে পেলাম না। মানুষের জন্মভূমি বড় প্রিয়। প্রিয় তার সেই গাছপালা, শৈশব আর আশ্বিনের কুকুর। একজন মানুষের হাতীতে চড়ে মাঝে মাঝে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া, তাঁর ফিরে আসা, তাঁর কবিতা আবৃত্তি এবং মাঝে মাঝে কি হয়ে যেত আমাদের সবার, তিনি না থাকলে আমাদের কিছু নেই এমন মনে হত। সে-সব তুমি বুঝবে না।

তখনই জ্যাক বলল, দ্যাখো দ্যাখো!

ছোটবাবু ওপরের দিকে তাকাল। সত্যি সে আশ্চর্য হয়ে গেল দেখে। লেডি-অ্যালব্রাটস ক্রোজনেস্টের মাথায় বসে রয়েছে। এবং নিচে আলো, আলোর ডুম দুলছে। যেন কতদিন পর সে ফিরে এসেছে। সমুদ্রে উড়ে উড়ে ক্লান্তিতে ঘুম পাচ্ছে পাখিটার। এবং এক আক্রোশ এই পাখিকে কেন্দ্র করে। যে-কোনো সময় যে কেউ বন্দুকের নলে পাখিটাকে নামিয়ে আনতে পারে। যেমন তার আশ্বিনের কুকুরের জন্য কষ্ট হত, তেমনি এই পাখিটার জন্য মায়া। সারেঙ-সাব, কাপ্তান, ওর সেই হাতীতে চড়ে মাঝে মাঝে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া পাগল জ্যাঠামশাইর সঙ্গে ভারি মিল পাখিটার। নিঃসঙ্গ সে। পাখিটাকে আজ আর তাড়িয়ে দিতে পারল না। বরং মনে হল, মাস্তুলের নিচে সে নিজে এবার থেকে বসে থাকবে। পাহারা দেবে পাখিটাকে। ভোররাতে সমুদ্রে উড়িয়ে ধীরে ধীরে চলে যাবে কেবিনে। তারপর ঘুম যাবে। পাখিটার জন্য নিশীথে এই গভীর সমুদ্রে এক আশ্চর্য ভালবাসা গড়ে উঠল। সে বলতে চাইল, হে মহান লেডি, আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমোন। অধম নিচে পাহারায় থাকল।

এ-ভাবেই মানুষের কখনও কিছু একটা হয়ে যায়। কখন কার জন্য ভালবাসা গড়ে উঠবে সে জানে না। লেডি-অ্যালবাট্রসের জন্য ছোটবাবুর কাজ বেড়ে গেল। সে জ্যাককে তার কেবিনে পৌঁছে দিল। নিজে নেমে এল নিচে। এখন ঘড়িতে দশটা বেজে পঁচিশ। সে আসার সময় জ্যাককে বলে এসেছে, দোহাই কাউকে বলবে না, লেডি-অ্যালাবাট্রস, রাত গভীরে জাহাজের মাস্তুলে এসে বসে থাকে, ঘুমোয়। সকালের দিকে জাহাজিদের ঘুম না ভাঙতে সে সমুদ্রে উড়ে যায়। কেউ টের পায় না, রাতে পাখিটা এই জাহাজের মাস্তুলে নিজের বাসভূমি তৈরি করে নিয়েছে। সবচেয়ে ভয় এখন আর্চিকে। সে যা কিছু ভালবাসবে, আর্চি জানতে পারলেই তা বিনষ্ট করবে। যদি কখনও পাখিটার ভোর রাতে ঘুম না ভাঙে…!

এখন যা করণীয়, একটা টাইমপিস ঘড়ি। ভোর রাতের দিকে সে এলার্ম দিয়ে রাখবে। এলার্ম বাজলে উঠে পড়বে বাংক ছেড়ে। এবং চারপাশে সতর্ক নজর রাখবে। খুব সন্তর্পণে গিয়ে দাঁড়াবে মাস্তুলের গোড়ায়। তারপরে হাতে তালি বাজিয়ে পাখিটাকে জাগিয়ে দেবে এবং উড়িয়ে দেবে।

জাহাজে দু’জনের দুটো টাইমপিস ঘড়ি আছে। একটা কাপ্তান স্যালি হিগিনসের, আর অন্যটা এনজিন সারেঙের। সে এনজিন সারেঙের কাছ থেকে অনায়াসেই চেয়ে নিতে পারে। কারণ জাহাজে ওয়াচের পর ওয়াচ চলে। যেমন এনজিন-রুমে গ্রিজার ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় চলে। তার কাজ আধ ঘন্টা আগে পরবর্তী ওয়াচের লোকদের জাগিয়ে দেওয়া। তার কাজ যথাসময়ে পরবর্তী ওয়াচের সবাইকে সজাগ করা। সারেঙসাবের ঘড়ি না হলেও চলে। তবু তিনি ঘড়িটা কাছে রাখেন, মধ্যরাতে ওয়াচের সব লোকেরা মাঝে মাঝে ভীষণ ক্ষেপে যায়। মারামারি পর্যন্ত আরম্ভ করে দেয়। একটু আগে পরে হয়ে গেলে এমন হয়।

তবু যা মনে হল, সে সারেঙ-সাবের কাছে ঘড়ি চাইলে তিনি দেবেন। কিন্তু যদি তিনি ঘড়িটা না থাকলে সত্যি অসুবিধা বোধ করেন তাহলে কি হবে বুঝতে পারল না। ঘড়িটা নেই, অসুবিধা হচ্ছে, তিনি মুখ ফুটে কখনও বলবেন না। সে তো তাঁকে এতদিনে প্রায় জেনে ফেলেছে।

সবচেয়ে ভাল হয় ডেবিডের সঙ্গে কথা বলে রাখা। ওর ডিউটি বারোটা-চারটা। চারটায় সে যখন কেবিনে ফিরে আসবে, তখন তাকে ডেকে দিলেই চলবে। সে সোজা গিয়ে ডেবিডের দরজায় আঙুলে টোকা মারল। ডেবিড দরজা খুললে বলল, তোমাকে একটু বিরক্ত করতে এলাম।

ছোটবাবুর কথা বলার স্বভাবই এ-রকমের। ছোটবাবু ভেবেছিল, ডেবিড হয়তো ঘুমোচ্ছে। ওকে ডাকা ঠিক হবে কি হবে না বুজতে পারছিল না। তবু যখন না ভেবে চলে এসেছে তখন এভাবেই কথা বলা উচিত। ডেবিডের বোধ হয় চোখে ঘুম লেগে এসেছিল। স্লিপিং গাউনের দড়ি আঁটতে আঁটতে বলল, কি ব্যাপার বলবে তো!

—ব্যাপার কিছু না। আমার খুব সকালে ওঠা দরকার। ঘুম ভাঙতে দেরি হয়ে যায়। ওয়াচ থেকে ফেরার সময় আমাকে একটু ডেকে দেবে!

–দেব।

—রোজই দেবে।

—তা দেব।

—অন্ততঃ যতদিন না তাহিতিতে পৌঁছাচ্ছি।

—হবে হবে। কিন্তু এত সকালে!

ছোটবাবু চলে গেল। কিছু আর বলল না। কি যে দরকার সকালে ওঠার! পাগল! ডেবিড এ নিয়ে আর কিছু ভাবল না। সে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। জাহাজে উঠলে নানারকমের বাতিক দেখা দেয়। ছোটবাবুকে খুব সকালে ওঠার বাতিকে পেয়েছে।

এবং সে ওয়াচ থেকে ফেরার সময় ঠিক মনে রেখেছে। সে ডাকল, এই ছোট, ওঠো।

ছোট বলল, উঠেছি।

এক ডাকেই ছোটবাবু সাড়া দিয়েছে। ডেবিড ভেবে পেল না, ছোটবাবুর রাতে ঘুম হয়েছে কিনা। না আদৌ ঘুমোয় নি। সে সারারাত সকালে উঠতে হবে বলে জেগে বসেছিল। ডেবিড বলল, ছোট, কফি খাবে?

ছোটবাবু বলল, না।

এলি-ওয়েতে সে এ-ভাবে দাঁড়িয়ে ফের বলল, তোমার সকালে কফি খেতে ভাল লাগে না?

—না সেকেণ্ড।

আসলে ছোটবাবু তো বলতে পারে না, তোমার সঙ্গে কফি খাওয়া মানে, তুমি গল্প আরম্ভ করে দেবে। অথবা আমি কি করছি না করছি তোমার জানা হয়ে যাবে। ছোটবাবু দরজা কিছুতেই খুলল না। ডেবিড দাঁড়িয়ে থেকে কিছুক্ষণ কি ভাবল, তারপর নিজের কেবিনে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

দরজা বন্ধের অস্পষ্ট শব্দে সে বুঝতে পারল ডেবিড চলে গেছে। সে এবার খুব সন্তর্পণে দরজা খুলে মুখ বাড়াল। এলি-ওয়েতে কেউ নেই। কেউ থাকার কথাও না। পাঁচ-নম্বরের এখন নিচে নামার কথা। তিন-নম্বরের এনজিন-রুম থেকে ফিরে আসার কথা। এনজিন-রুমের ফায়ারম্যান, টিণ্ডাল ওয়াচ শেষ করে ফিরে যাবে। সে আর একটু সময় অপেক্ষা করল। দরজা বন্ধ করে বসে থাকল। কারণ ডেবিডের হাত মুখ ধোওয়ার ব্যাপার আছে, কফি না খেয়ে শুতে যাবে না, তিননম্বর এনজিনিয়ার এসেই শুয়ে পড়বে না, সেও কোনো না কোনো কারণে এলি-ওয়ে ধরে হেঁটে যেতে পারে। দেখা হয়ে গেলে দাঁড়িয়ে দু একটা কথা বলতেই হবে। অসময়ে ছোটবাবু এলি-ওয়ে ধরে কোথায় যাচ্ছে এ-সব প্রশ্ন স্বাভাবিক কারণেই ওদের মনে হতে পারে। সুতরাং একটু অপেক্ষা করে তবে যাওয়া ভাল।

সে যখন হেঁটে গেল—কেবিনের সব দরজা বন্ধ। শুধু আলো জ্বলছে, সরলরেখার মতো। অনেক দূরে—একটা খোলা সরু বাকসের মতো দরজা দেখা যাচ্ছে। সে চারপাশে সতর্ক নজর রেখে হেঁটে গেল ডেকে। অস্পষ্ট অন্ধকার। আলোগুলো দুলছে। দূরের সমুদ্রে কেমন সঙ্গীতের মতো একটা বাজনা বাজছে। সমুদ্রের এই সংগীত এবং ওপরে লেডি-অ্যালবাট্রস পাখার ভেতর ঠোঁট গুঁজে ঘুমিয়ে আছে —আর জাহাজের ওপর দিয়ে আকাশটা তার নক্ষত্রমালা নিয়ে একেবারে একটা নীল আচ্ছাদনের মতো হয়ে গেছে এসব দেখতে দেখতে সে দাঁড়িয়ে গেল। ওর শরীরে সাদা পোষাক। সাদা পায়জামা, সাদা হাফসার্ট এবং বাথরুম স্লিপার পায়ে। সে চটি পরে আসেনি, যদি শব্দে কেউ টের পায়, ছোটবাবু যাচ্ছে ডেকে। অসময়ে ছোটবাবু ডেকে যাচ্ছে কেন!

আসলে এইসব নিরিবিলি সমুদ্রের ভেতর দাঁড়িয়ে না থাকলে টের পাওয়া যায় না, জীবনে এক মুহ্যমান ব্যাপার থেকে যায় কখনও কখনও। তখন হিসেব করে পৃথিবী থেকে পাওনা গণ্ডা মিটিয়ে নেবার কথা মনে থাকে না। কি দরকার যে ছিল ওর, সে বুঝতে পারছিল না। সারারাত সে দুচোখ এক করতে পারেনি। যদি ডেবিড ডেকে দিতে ভুলে যায়। ডেবিডের ওপর সে বিশ্বাস রাখতে পারে নি। তারপর ভেবেছে, সে জেগে না গেলে পাখিটা ঘুমিয়ে পড়বে, সকালে কেউ ওপারে তাকালেই দেখতে পাবে—লেডি অ্যালবাট্রস মাস্তুলে বসে রয়েছে। এমন একটা প্রতিশোধের সুযোগ পাওয়া ভার—সুতরাং ছোটবাবু রাতে কিছুতেই ঘুমোতে পারল না। মাস্তুলের নিচে দাঁড়িয়ে সে শুধু পাখিটার অসহায়তার কথা ভাবছে। ভাবতে ভাবতেই সে জোরে তালি বাজাল। আর সঙ্গে সঙ্গে পাখিটা ঠোঁট পাখার ভেতর থেকে বের করে ঘাড় বাঁকিয়ে দেখল। নিচে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে। হাত তুলে হুঁশহাঁশ করছে।

লেডি অ্যালবাট্রস ডানা মেলে দিল আকাশে। তারপর উড়তে থাকল। সূর্য যেদিকে ওঠার কথা সেদিকে উড়ে উড়ে যেতে থাকল।

পরদিন সকালে ডেবিড আবার তাকে ডেকে দিল। সে উঠে সামান্য সময় বসে থাকল, এবং যখন সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত সে পাখিটাকে উড়িয়ে দিল! সে বুঝতে পারছে আর দুদিন। ঠিক বন্দরের কাছে গেলে, পাখিটা আবার ডাঙ্গা পেয়ে যাবে। তাকে আর তখন এত সকালে না উঠলেও চলবে। ডাঙ্গা পেলে পাখিটা আর একটা পুরুষ পাখিও খুঁজে পাবে। তখন আর পাখিটা অসহায় থাকবে না। নিজের মতো কেউ মিলে গেলে, পাখিটা আবার একটা জাহাজের পেছনে উড়তে উড়তে নিজের দ্বীপে ফিরে যেতে পারবে।

এ-ভাবে সে পাখিটাকে এখন সময় পেলেই—কারণ সে দেখেছে যখন পাখিটা দূরে দূরে উড়ে বেড়ায়, অথবা খুব কাছে এসে যায়, সে পাখিটাকে কিছু নরম মাংস, এই যেমন মাংসের হাড় এবং সে কখনও চিফ-কুকের গ্যালি থেকে উচ্ছিষ্ট হাড় মাংস পকেটে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কাছে এলেই সে মাংস হাড় ছুঁড়ে দিলে খুব সুন্দরভাবে পাখিটা নেমে এসে ধরে ফেলে। সমুদ্রে পড়ে যাবার আগেই হাড় মাংস তুলে নিয়ে যায় ঠোঁটে। এবং দূরে গিয়ে একটা হাঁসের মত জলে সাঁতার কাটতে থাকে, গলা উঁচু করে হাড় মাংস গিলে ফেললে বোধহয় পাখিটার সজীবতা বাড়ে—তাকে আর মনেই হয় না খুব অসহায়। বরং এ-ভাবে ছোটবাবুর হাতে তার খাবার প্রত্যাশা বেড়ে যায়।

এবং এ-দুদিনেই সে দেখেছে, ডেকে তাকে দেখলেই তার কাছাকাছি উড়তে ভালবাসে পাখিটা সবসময় খাবার থাকে না। তার ডেকে কাজ। উইনচে কাজ থাকার দরুন সে দেখেছে, কখনও তার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেছে পাখিটা। সে তখন বুঝতে পারে পাখিটা কিছু খেতে চায়। হাতের কাজ ফেলে প্রায় দৌড়ে চলে যায় তখন ছোটবাবু। চিফ-কুকের গ্যালি থেকে যত উচ্ছিষ্ট খাবার, দু’পকেটে, যতটা পারে তুলে নেয়। তারপর সন্তর্পণে আবার চলে যায় স্টারবোর্ড-সাইডে। এদিকটায় কেউ বড় আসে না। ছোটবাবু একটা নিভৃত জায়গায় দাঁড়িয়ে পাখিটাকে খাওয়ায়।

মৈত্র এবং’ অমিয়, ইয়াসিন, জব্বার, কখনও সারেঙ-সাব দেখেছে ছোট চুপচাপ দাঁড়িয়ে পাখিটাকে দেখছে। ওরা কেউ বুঝতে পারছিল না, ছোট এভাবে দু’দিন ধরে মাঝে মাঝে এখানে দাঁড়িয়ে থাকে কেন। সারেঙ-সাব বিকেলে বলেছিল, হ্যাঁ রে কি করিস মাস্তুলের নিচে।

সারেঙ-সাবের কাছে সে মিথ্যা কথা বলতে লজ্জা পেল। সে বলল, দেখবেন। বলেই পকেট থেকে এক টুকরো মাংস বের করে জোরে সমুদ্রে ছুঁড়ে দিল। কোথায় ছিল পাখিটা, ঠিক নজর আছে, বাজপাখির মতো শাঁ শাঁ করে উড়ে এল। জলে পড়ার আগে ঠিক ঠোটে তুলে উড়তে উড়তে দূরে চলে গেল।

সারেঙ সাব বললেন, আমাকে দে তো, আমি দ্যাখি একবার।

—একটু দাঁড়ান। এখন দিলে হবে না। দেখছেন না বিবি এখন পরিপাটি করে খাচ্ছে। সাঁতার কাটছে। জলে ডুবে স্নান করছে।

জাহাজের একঘেঁয়েমির ভেতর পাখির এই সমুদ্রে স্নান করা, উড়ে বেড়ানো, পাখায় সমুদ্রের জল নিয়ে ক্রমে এগিয়ে আসা, অথবা এই যে মনোরম হয়ে যাচ্ছে সমুদ্রটা, সমুদ্র আর খালি খালি লাগছে না, সমুদ্রে এভাবে সাঁতার কাটতে কাটতে পাখিটা সত্যি যে এক আশ্চর্য পৃথিবী গড়ে তুলছে—ছোটবাবুর সঙ্গে না দাঁড়ালে টের পাওয়া যায় না। ছোটবাবুর পাশে দাঁড়িয়ে পাখিটার কাণ্ডকারখানা দেখে সারেঙ মুগ্ধ হয়ে গেলেন। বললেন, এবারে দেব।

—দিন, খাওয়া হয়ে গেছে। খাবারের লোভে দেখুন আবার কি কাছে এসে গেছে! কিন্তু এটা কেন হচ্ছে। সারেঙ দু’বার ছুঁড়ে দিলেন, দু’বারই পাখিটা দূরে সরে গেল। এসে ছোঁ মেরে তুলে নিল না।

—কি রে খাচ্ছে না কেন?

—ভয় পাচ্ছে।

—তুই দে তো আবার

ছোটবাবু জোরে ছুঁড়ে দিল।

পাখিটা ঠিক আসছে। জাহাজটা ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছে বলে পাখিটা এসে যখন ধরে ফেলে তখন পিছিলের কাছাকাছি চলে যায় পাখিটা। ওরা ঠিক জাহাজের মাঝখানে রয়েছে। খাবার নিয়ে যখন উড়ে চলে যায়, তখন দুজনকেই পেছনে উঁকি দিয়ে দেখতে হয়। এবং খাওয়া হয়ে গেলেই আবার উড়ে এল। সারেঙ-সাব বললেন, দেব এবার!

—দিন।

তিন বারের বার পাখিটা সারেঙ-সাবকে আর ভয় পেল না। ঠিক তুলে নিয়ে গেল।

ছোটবাবু বলল, আপনাকে চিনে ফেলেছে। আপনাকে পাখিটা ভালবেসে ফেলেছে। আপনি দিলেই খাবে। আপনাকে দেখলেই পাখিটা আপনার মাথার ওপরে উড়ে আসবে। তারপর সে ফিসফিস করে বলল, চাচা কাউকে বলবেন না। বললে, মেজ-মিস্ত্রি জানতে পারবে। পাখিটার ওপর খুব রাগ। ভুলিয়ে এনে গুলি করতে পারে।

সারেঙ-সাব বললেন, মুখের দাগ ওর যাচ্ছে না।

ছোটবাবু বলল, উল্কি পরার মতো হয়ে গেছে মুখটা। তারপর বলল, ঐ দেখুন আবার আসছে। সারেঙ-সাবের নামাজ পড়ার সময় হয়ে গেছে। তিনি নামাজ পড়তে চলে যাচ্ছেন। তিনি এই ছেলেটার মায়ায় জড়িয়ে পড়েই কেমন জীবনে গণ্ডগোলে পড়ে গেছেন। আবার একটা পাখি! এখন এ-সব থেকে যত দূরে থাকা যায়। তিনি যেতে যেতে বললেন, কাপ্তানকে একবার বল না। এজেণ্ট অফিসকে লিখে তোর বাড়ির ঠিকানাটা আনতে পারে কিনা?

—কি করে পারবে!

—ওরা না পারে এমন কাজ নেই। ইচ্ছে থাকলে ওরা সব পারে।

ছোট, সারেঙ-সাবের পাশে পাশে হেঁটে গেল। বলল, চাচা এটা হয় না। এতবড় মানুষটাকে আমি বলতে পারি!

—কাপ্তান তোকে খুব ভালবাসে ছোট। তুই জানিস তা।

—কি জানি, বুঝছি না।

—বুঝছিস না? বলে হাঁটতে হাঁটতে একবার ছোটবাবুকে পাশ থেকে দেখলেন। ওরা এখন ডেক- ভাণ্ডারির গ্যালিতে উঠে গেছে। সারেঙ-সাবের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সে এদিকে চলে এসেছে। একবার সামনের দিকে তাকাল। না কেউ দেখছে না। সে বলল, ঠিকানা পাবে কি করে?

–কেন, আগে তোরা যে জায়গায় ছিলি, পাশাপাশি বাড়ির কেউ খবর দিতে পারে!

–যদি পারত, তবে ঠিকানা ওরা রি-ডাইরেক্ট করতে পারত। পোস্টাফিস থেকে নট ক্লেইমড় হয়ে ফিরে আসত না।

–পোস্টাফিসের দায় পড়েছে!

—আসলে কি জানেন চাচা, বলে সে এবার সিঁড়ি ধরে ধরে নিচে নেমে যাচ্ছে। বাঁ-দিকে সারেঙের ফোকসাল। তিনি এখানে একা থাকেন। সারেং ওকে একটা মোড়া এগিয়ে বসতে দিল।—আসলে কি জানেন, বাবা জ্যাঠামশাই এখানে এসে নিজেদের সম্মান বজায় রাখতে পারলেন না। না খেয়ে বাঁচা যায় বোধহয় বাবা জ্যাঠামশাই ভেবেছিলেন। তবু মান সম্মানটুকু থাকুক। সেটুকু বোধহয় শেষ পর্যন্ত ওঁদের ছিল না। ওঁরা যাবার সময় কাউকে কিছু ঠিকানা রেখে যান নি। ওঁরা অপরিচিতের মতো বাঁচতে চাইতেন। প্রতিবেশী বলতেও তেমন কিছু ছিল না। বন-জঙ্গল সাফ করে মাত্র আবাস তৈরি করেছিলেন।

—তোর এক কাকা আছেন না!

—আছেন! এ-দেশে এসে তিনি ভিন্ন হয়ে গেলেন। বাবা জ্যাঠামশাইর সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখেন নি।

অনেকদিন পর যেন ছোটবাবুর মনে হল, সে ডাঙ্গার মানুষ। সারেঙ-সাব এক এক করে সব মনে করিয়ে দিচ্ছেন। ওর মুখটা আবার বেজার হয়ে গেছে। সে তবু বলল, চাচা আপনি, ডেকসারেঙের মতো কাঠের পুথিদান করে নিতে পারেন না!

সারেঙ-সাব দেখলেন, ওর ছেঁড়া বইটা বাংকে পড়ে আছে। তিনি সময় পেলেই যখন জাহাজে একঘেঁয়েমি মনে হয় ভীষণ, যখন একঘেঁয়েমির যন্ত্রণায় জাহাজিরা ফোকসালে মারামারি পর্যন্ত লাগিয়ে দেয় তখন এই পবিত্র কোরান শরীফ তাঁর একমাত্র শান্তি পারাবার। তিনি বুঝতে পারলেন, ছোট তার দেশ-বাড়ির কথায় কষ্ট পাচ্ছে। সে, তাঁকে অন্য কথায় নিয়ে আসতে চায়। তিনি ইচ্ছে করেই আর ওর বাড়ি সম্পর্কে কোন কথা বললেন না। বাংকের দড়ি থেকে গামছাটা নিলেন। বাংকের নিচ থেকে বদনা বের করলেন। এখন অজু করতে যাবেন। যাবার সময় বললেন, কাঠের পুথিদানে বইটা রেখে পড়তে আমার ইচ্ছে হয়। বার বার ভাবি একটা কিনব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে না। ভুলে যাই।

ছোট বলল, আমি একটা কিনে দেব আপনাকে।

সারেঙ-সাব বললেন, তুই আমাকে কিনে দিবি কেন? পয়সা বেশি হয়েছে!

ছোটবাবু চোখ তুলে তাকালে তিনি আর বলতে পারলেন না, না ছেলে, তোকে কিনে দিতে হবে না। তোর কোনো জিনিস আমি নেব না। আমাকে তুই এটা দিয়ে বলতে চাস, সব আপনার দিয়ে দিলাম। তোমাকে আমি ছোটবাবু সে সুযোগ দিচ্ছি না। কিন্তু মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি আর কিছু বলতে পারলেন না। শুধু বললেন, দিস। আমাকে কিছু দিতে যাই তোর ভাল লাগে দিস। তারপর তিনি হাত মুখ ধুয়ে দুটো রুটি, একটু চা খেলেন। অজু করলেন শেষে। মেসরুমে তিনি নামাজ না পড়ে খোলা আকাশের নিচে হ্যাচের ওপর মাদুর বিছিয়ে নামাজ পড়তে বসলেন। মাথায় সাদা টুপি সাদা লুঙ্গি। লক্ষ্ণৌ কাজকরা সাদা পাঞ্জাবি। যেন এক সন্ত মানুষের মতো। সাদা দাড়িতে কি যে সুন্দর দেখাচ্ছে মানুষটাকে। কোনো কালে পৃথিবীতে মানুষটার আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল, তিনি তাঁর স্ত্রীকে জাহাজ থেকে ফিরে গিয়ে দেখতে পাননি, বালিকা স্ত্রীর জন্য সেই তরুণ বয়সে কখনও শোক করেছিলেন, শান্ত সুষমামণ্ডিত মুখ দেখে এখন আর তা একেবারেই মনে হবে না। দেখে মনে হয় পৃথিবীতে তিনি সারা জীবন এ-ভাবেই বেঁচে ছিলেন।

আর পরদিন সকালেই ড্যাং ড্যাং আসছে, বন্দর চলে আসছে। ছোট দ্বীপমালা দূরে দূরে। সকাল হচ্ছে সমুদ্রে। সিউল-ব্যাঙ্ক ক্রমে এগিয়ে যাচ্ছে। পানামা থেকে প্রায় দু হাজার মাইলের যাত্রা-পথে কত ঘটনার সাক্ষী যেন জাহাজটা। সকালের রোদে দ্বীপের গাছপালা কেমন মায়াবী। দ্বীপের সবুজ গাছপালার পাশ কাটিয়ে সিউল-ব্যাঙ্ক ক্রমে এগিয়ে যাচ্ছে। ডেবিড ওয়াচ থেকে ফিরে এসেই দূরবীন নিয়ে বসে গেছে। আর চোখে কি যে হয়, চারপাশের গাছপালার ভেতর দূরে দূরে সব দ্বীপের অধিবাসীরা মনে হয় হেঁটে বেড়াচ্ছে। সে জানেও না, এইসব দ্বীপগুলোতে মানুষ আছে কিনা, কিন্তু সুন্দর গাছপালা, বালিয়াড়ি, রং-বেরঙের ঝিনুক চোখে পড়লে সে বিশ্বাস করতে পারে না, এমন একটা দ্বীপে মানুষের আবাস নেই। মনে হয় গাছপালা, লতাপাতার অথবা প্রবালের প্রাচীর পার হলেই সকালের সূর্য পৃথিবীতে যেমন কিরণ দেয় এখানেও তেমনি কিরণ দিচ্ছে।

এবং এসব ভাবতে ভাল লাগে। সিউল-ব্যাংক যাচ্ছে, দ্বীপ-টিপ সে জানে না, তাহিতিতে সে যাচ্ছে। সেই কবে, খৃষ্টপূর্ব চার হাজার বছর আগে মানুষের বিশ্বাস ভেলায় করে চার হাজার মাইল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে পেরু থেকে যে সভ্যতা এখানে বিস্তার করেছিল তার মতো তাদের এই অভিযান। বিশেষ করে জ্যাকের তো এমনই মনে হয়। যেন সেই প্রাচীনকালে সে তাদের একজন কেউ ছিল। এবং সঙ্গে আর যে যে ছিল মনে হয় এই ছোটবাবু, আর কে, আর বাবা, আর কে? আর-আর বুড়ো সারেঙ। ব্যাস এই চার জন হলেই সে ভেলায় করে, যত প্রাচীনকালই হোক, সেই ব্যাবিলিয়ান সভ্যতার আগে, কিংবা গ্রীক সভ্যতার আর আর যদি ভাবা যায় ফারাওদের আমলে সে আর ছোটবাবু ছিল সেই অভিযানের প্রথম নারী-পুরুষ এবং এখানে তাদের বংশধরেরাই হাজার হাজার বছর পর ছোটবাবুর ফিরে আসার জন্য প্রতীক্ষা করছে। এ সব ভাবতে ভীষণ ভাল লাগছিল জ্যাকের। মনে মনে সে এভাবে কত রকমের যে আজগুবি স্বপ্ন ছোটবাবুকে নিয়ে ভাবতে ভালবাসে।

আসলে এখন তো আর মনে হয় না, জাহাজটা ছিল সমুদ্রে, গভীর সমুদ্রে, বিষাক্ত পাখিদের আক্রমণের কথাও মনে আসার কথা নয় তাদের। দ্বীপ, গাছপালা এবং মাটি দেখলেই নিমেষে সবাই সমুদ্রের সব দুঃখ ভুলে যায়। এখন ঠিক অমিয় টব বাজাচ্ছে। সবাই সুর ধরে গাইছে। তাদের গানের লহরি যেন সেই নৌকা বাইচের গান, দূর থেকে দূরে—হা-হা-হো, হা-হা-হো ক্রমে শব্দটা সমুদ্রে ছড়িয়ে পড়ছে।

জাহাজ সিউল-ব্যাংক এখন আর মনে হয় না পুরোনো। মনে হয় আর দশটা হাল আমলের জাহাজের চেয়ে তার নৈপুণ্য বেশি। জাহাজিরা সব দুঃখ ভুলে যাচ্ছে। কাপ্তান এবং চিফ-মেট এখন ব্রীজে। হাওয়া উঠে আসছে। সামনেই সেই মূল ভূখণ্ডের উপকূল। শহর এখনও দেখা যাচ্ছে না, মাইল চার-পাঁচ এগিয়ে সামান্য সাউথ-সাউথ-ওয়েস্টে বাঁক নিতে হবে। তখনই চোখে পড়বে সুন্দর পরিপাটি বন্দরের ছবি, দুটো একটা স্কাই স্ক্র্যাপার। আর সেই বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে প্রশস্ত পথ। ড্যাং ড্যাং করে লাল নীল রঙের গাড়ি কেবল এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে যেন ছুটে যাচ্ছে, ভেতরে সুন্দরী সব রকমারী যুবতীরা পর্বতগাত্রের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে।

সিউল-ব্যাংক ক্রমশ কক্স উপসাগর পাড়ি দিচ্ছে। জাহাজের মাস্তুলে কার্সিফ্ল্যাগ টাঙিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সামনে পেছনে জ্যাক-ফ্ল্যাগ, এনসাইন-ফ্ল্যাগ পতপত করে উড়ছে। পাইলট উঠে এসেছে জাহাজে, পাইলট জাহাজের ভার নিয়েছে এবং আবার ড্যাং ড্যাং। সমুদ্রে সিউল-ব্যাংক আর নেই, এখন বন্দরের ভেতর জাহাজ ক্রমে ঢুকে গেলে চারপাশে শুধু জাহাজ, মাস্তুল, সেই এক বন্দরের ছবি—চারপাশে সব নানা দেশের জাহাজ, নানা বর্ণের পতাকা, নানা রঙের চিমনি, এবং চিমনির রং দেখে, জাহাজের পতাকা দেখেই বলে দেয়া যায়, কোন দেশের জাহাজ, কোন কোম্পানীর জাহাজ।

টাকা কে কত তুলবে—যেমন একশ সি এফ পির সমান, এক দশমিক ষোল সেণ্ট। পাউণ্ড মূল্যে দাঁড়ায় দশমিক চুয়াল্লিশ পাউণ্ড। ছোটবাবুকে বোধহয় সবচেয়ে বেশি টাকা তুলতে হচ্ছে। সে তুলেছে ত্রিশ পাউণ্ডের মতো। ওতে ওর দুটো বয়লার স্যুট এবং এক প্রস্থ স্যুট হয়ে যাবে। আর অনেকে যে যা টাকা তুলবে, তার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। এজেণ্ট-অফিস থেকে লোক এসে গেছে। সঙ্গে চিঠিপত্র। জাহাজিদের চিঠিপত্ৰ কম

জাহাজে আবার বাঁধাছাদার কাজ। সেকেণ্ড-মেট, চিফ-মেট পেছনে সামনে। আবার সেই বাঁধা বুলি—হারিয়া হাফিজ। নিচে ছোট টাগবোটে এ-দেশের মানুষ—তাহিতিয়ান, চুল খাড়া খাড়া, শরীরের তুলনায় মাথাটা বড় মনে হয়, এবং শ্যামলা রং, আর পোশাক ঢিলেঢালা। ওরা হাসিল তুলে নিয়ে যাচ্ছে এবং কিনারায় নিয়ে হাসিল বেঁধে ফেলছে বিটে। মানুষগুলোর সঙ্গে ভারতীয় চেহারার ভারি মিল। যেমন ওরা বন্দরে ঢোকার আগে দেখেছে সব ছোট ছোট নৌকা। একজন দাঁড় ফেলছে। যে দাঁড় ফেলছে সে আছে মাঝখানে, আগে একজন বসে রয়েছে, হাতে ছিপ, পেছনে একজন হাল ধরে বসে আছে। হালে যারা আছে—অধিকাংশ মেয়ে। পোশাক বলতে ঘাসের স্কার্ট পরা, ওদের বুকে সামান্য ব্রেসিয়ার। কেউ লুঙ্গির মতো পরে আছে, খোপকাটা সব রং-বেরঙের চাদর। খালি গা। কেউ সামান্য জাঙ্গিয়া পরেই মাছ ধরছে নিবিষ্ট মনে। জাহাজটা ওদের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। জাহাজিরা কাজ ফেলে ওপরে উঠে এসেছে। জাহাজ জাহান্নামে যাক, তবু ওরা সমুদ্রে এমন সব সুন্দরী মেয়েদের দেখে হাত না তুলে পারবে না। মেয়েগুলোও জাহাজিদের হেইল করছে। ছোটবাবু ছেলেমানুষের মতো অবাক হয়ে দেখছে।

জাহাজ বন্দরে বেঁধে ফেললেই ছুটি। কাপ্তান ছুটি ঘোষণা করেছেন। কেবল একজন ফায়ারম্যান নিচে থাকবে। কোয়ার্টার-মাস্টার থাকবে গ্যাংওয়েতে পাহারায়। স্টুয়ার্ডকে থাকতে হবে। রসদ আসবে। অর্ডারমাফিক রসদ ঠিক ঠিক স্টিভেডর দিয়েছে কিনা দেখতে হবে। এদিক ওদিক হলে রিপোর্ট রেখে যেতে হবে। আর থাকছেন কাপ্তান নিজে, চিফ-মেট। আর পিছিলে দুই সারেঙ। আর সবাই যে-যার মতো ছটি ভোগ করবে।

জ্যাক বলল, বাবা আমি যাব?

—কোথায়?

—ডেবিডের সঙ্গে। ওরা এখন বের হচ্ছে।

কাপ্তান কিনারায় যাবেন না। তাহিতিতে কবে আর কে আসছেন! বনি তো কখনও আর সুযোগ পাবে না। তিনি ডেবিডকে ডেকে পাঠালেন। ডেবিড এলে বললেন, তোমার সঙ্গে জ্যাক যাচ্ছে।

ডেবিডের মুখটা সামান্য তেঁতো হয়ে গেল। কি যে দরকার—সে ভেবেছিল নেমেই লি- বেলভিডিয়ারে ফরাসী খাবার খাবে। ছোটবাবু যদি সঙ্গে যায়, যাবে বলে মনে হচ্ছে না, ওর পুরানো দোস্ত অমিয়, মৈত্র। ওর সঙ্গে যাবে বোধ হয়। সে দেখেছে, দু’বার মৈত্র এসে ঘুরে গেছে। কেউ না গেলেও তার ক্ষতি নেই এবং ওর মনে হল কেউ না গেলেই ভাল হয়। সে একা একা এভিনিউ প্রিন্স হ্যানয় ধরে অথবা ওরা-কিকিতে চাইনিজ খাবার অথবা সেই গোগাঁর মিউজিয়ামে, এবং মিউজিয়াম- কাম-বারে সুন্দরী রমণীদের কথাবার্তা—একটু অন্ধকার হলে, অবশ্য অন্ধকার না হলেও ক্ষতি নেই, দ্বীপের বালিয়াড়িতে ঘুরে বেড়ানো অথবা রোদে পিঠ দিয়ে পড়ে থাকা ভারি মনোরম। বড় গোল ছাতার নিচে দু’জনে বসে থাকবে। নীল রঙের চশমা থাকবে মেয়েটার চোখে, শুধু ব্রেসিয়ার বুকে, এবং হাল্কা সিল্কের জাঙ্গিয়া আর নরম উরু, নাভির কোমল ত্বকের নিচে গভীর উষ্ণতা। সামান্য মদ, সঙ্গে, পিসান- ক্রু, লোবস্টার অথবা মেরিও ফিস মশালায় ভাজা—কি যে সুস্বাদু! জ্যাক সঙ্গে গেলে সব মাটি। কাপ্তান যা একখানা চরিত্র করেছে জ্যাকের! মেয়েমানুষ দেখলেই ঘাবড়ে যায়। ঠিক ঘাবড়ে যায় না। কেমন বিগড়ে যায় জ্যাক।

ছোটবাবু এতসব দেখে লেডি-অ্যালবাট্রসের কথা একেবারে ভুলে গেছে। পাখিটাকে সে শেষ বারের মতো কোথায় দেখেছে মনে করতে পারছে না। ঠোঙার খাবার নিয়ে সে ঘুরছিল তখন। না, কাছে কোথাও পাখিটা নেই। নেই, নেই। বোধ হয় জাহাজ যখন সাউথ-সাউথ-ওয়েস্টে ঢুকে যাচ্ছিল, তখনই সে এটা বুঝতে পেরেছিল। জাহাজে সবার সঙ্গে পাখিটাও যাত্রী ছিল তাদের। পাখিটা নেই বলে চারপাশের সবকিছু বিস্বাদ ঠেকল। ওর বন্দরে নেমে যেতে ইচ্ছে করছিল না।

তবু একবার নামতে হবে। বোট দ্য ফেয়ারে একজন ভাল ডাক্তারের খোঁজ সে কিনারার লোক থেকে সংগ্রহ করেছে। মৈত্রদাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে একবার যেতে হবে। সে ভাবল, ফেরার পথে যা টাকা বাঁচবে তাই দিয়ে বয়লার স্যুট এবং বাঁচলে একপ্রস্থ স্যুট কিনে ফিরে আসবে। দ্বীপের ভেতর গাড়ি ভাড়া করে ঘোরার টাকা আর হাতে থাকবে না।

ছোটবাবু ঠোঙার খাবারগুলো ফেলে দিল না। ছোট ছোট চিড়িয়াপাখি দলে দলে মাস্তুলের মাথায় উড়ছে। জাহাজের চারপাশে তাদের কলরব। এবং ঢং করে কোথাও বড় লোহার পাত ফেলার শব্দ, অর্থাৎ বন্দরে ঢুকলে যেসব অতিকায় শব্দের ভেতর ডুবে যেতে হয়—পাখিদের কলরব তা থেকে আলাদা করা যায় না। সে খাবারগুলো পাখিগুলোকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিল। তারপর ফিরে আসার সময় দেখছে, ডেবিড কেমন অন্যমনস্ক ভাবে হেঁটে যাচ্ছে এলি-ওয়েতে। ছোটবাবুকে দেখেও সে কিছু বলছে না।

ছোটবাবু ডাকল, এই ডেবিড!

ছোটবাবুর এমন ডাকে মনেই হয় না ডেবিড তার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। একেবারে অমিয় মৈত্রের মতো কাছের মানুষ হয়ে গেছে। ডেবিড বলে না ডাকলেই বরং সেকেণ্ড-মেট রাগ করে। সে বলল, আমাকে কিছু বলছ ছোটবাবু?

—মুখটা এত গোমড়া কেন?

—না, কিছু না।

—এমন তো কখনও তোমার মুখে দেখি না।

—আর বলবে না, প্রায় ফিসফিস গলায় বলল, অর্ডার হয়েছে জ্যাককে নিয়ে শহরটা দেখতে হবে, দ্বীপের ভেতরটা যতদূর সম্ভব দেখাতে হবে। গাড়ি ভাড়া করতে বলছে। টাকা সব কাপ্তানের। কিন্তু, বলেই সে থেমে গেল। ছোটবাবু জানে বাকিটা ঠিক বলবে। সে তাকিয়ে থাকল।

—আচ্ছা বলত, কতদিন পর বন্দর পেলাম, এখন এসব ভাল লাগে! এগুলো কাপ্তানের টরচার। এমন একজন বালককে নিয়ে আমি কোথায় যাই! বারে যেতে পারব না, মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারব না। কাপ্তান কি ভাবে আমরা মানুষ না?

ছোটবাবু কি বলবে! সে তো বলতে পারে না কাপ্তান এটা ঠিক করেন নি। সে বলতে পারত, আমি নিয়ে যেতে পারতাম, জ্যাক আমার কাছে দু’বার এসেছিল কিন্তু আমার কাজ অনেক। মৈত্রদাকে ডাক্তার দেখাতে হবে। কতক্ষণ লাগবে, তাতো জানি না ডেবিড, এবারের মতো তুমি নিয়ে যাও। কোথায় যাচ্ছে সে জ্যাককে বলেছে। কোন রাস্তায় কত নম্বর সব বলেছে। জ্যাক আর পীড়াপীড়ি করেনি। তাছাড়া সে জ্যাকের সঙ্গে জাহাজ থেকে নামতে পারে না। আর্চি দেখলে ক্ষেপে যাবে।

ডাক্তার দেখিয়ে বের হবার মুখে জ্যাক আর ডেবিড হাজির। এদিকটায় সব দোকানপাট চাইনিজদের। কাঠের বাড়িগুলো বেশ সুন্দর দেখতে। ছোট একটা উপত্যকার মতো জায়গাটা। বাড়িগুলোর লাগোয়া সব ফুলের বাগান। সমানে বড় খেলার মাঠ। এবং বেলা প্রায় তিনটে, বসন্ত কাল অথবা গরমের সময় বলে মানুষজনেরা পাতলা কটনের জামা নানা লতাপাতা আঁকা জামা গায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তখন জ্যাক তাকে বলল, কার অসুখ ছোটবাবু?

ছোটবাবু বলল, অসুখ কারো তেমন হয়নি। মৈত্রদাকে খুব মনমরা দেখাচ্ছে। মৈত্রদা এভাবে থাকলে জ্যাক এবং ডেবিড দুজনেই টের পাবে কিছু হয়েছে বড়-টিণ্ডালের। সে মৈত্রকে বলল, চল একটা শো দেখি কোথাও।

অমিয় বলল, তোরা যা। আমি একটু ঘুরে পরে যাচ্ছি।

ডেবিড বলল, এখন আবার শো দেখার কি হল, চল না বরং লা পয়েন্ট ভেনাসে প্রথম ইউরোপিয়ান সেলারদের মোমের সব মূর্তি রয়েছে, দেখে আসি।

ছোটবাবুর কোথাও যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। মৈত্রদার অসুখটা ভারি খারাপ। ইনজেকসান পরপর দু’বার দিয়েছে। খুব ভিরুলেন্ট টাইপের অসুখ, এখানে মৈত্রদার থেকে যাওয়া দরকার। ক্রমান্বয় ইনজেকসান ওষুধপত্র পড়লে হয়তো সেরে যেত। কিন্তু উপায় নেই। কিছু ট্যাবলেট সঙ্গে নিয়েছে। নিউ প্লাইমাউথে গেলে বেশ অনেক দিন সময় পাওয়া যাবে। তখন থরো ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করা যাবে মনে হচ্ছে। এতদিন কি যে হবে! সে এসব ভাবতে ভাবতে দ্বীপের এই ছোট্ট শহরটির মানুষজন, রাস্তাঘাট, উঁচু-নিচু টিলার গায়ে ছবির মতো ছিমছাম শহরটিকে একেবারে উপেক্ষা করল।

তখন জ্যাক যেন মরিয়া হয়ে বলল, এই যে অমিয়। আপনি বড়-টিণ্ডালকে নিয়ে যান। ছোটবাবু আমাদের সঙ্গে যাবে।

এসব কথা বললে অমিয়র সাহস নেই না করে। সে মৈত্রকে একটা ট্যাকসিতে তুলে নিয়ে চলে গেল।

ডেবিড বলল, ছোটবাবু আমি এখানে আছি। সন্ধ্যার পর এখানে তোমরা আমার খোঁজ করবে।

ছোটবাবু এবারে জ্যাককে ভাল করে দেখল। জ্যাক পরেছে হাফহাতা ঢোলা সিল্কের সার্ট। দামী প্যান্ট ক্রিমসন কালারের। মোটা সাদা বেল্ট। একটা সবুজ টুপি মাথায়। হাতে লম্বা তরবারির মতো লাঠি। কোমরে চাবির রিং। হিপপকেটে লেদারের পার্স। চুলের নীলাভ রঙে উজ্জ্বল রোদ এসে একেবারে জ্যাককে কাউ-বয় বানিয়ে দিয়েছে।

ছোটবাবু বলল, জ্যাক তাহলে কোথায় যাবে?

—তাহারা হোটেলস্ হিলে যাব। ট্যাকসি ডাকলেই ঠিক আমাদের নিয়ে যাবে।

জাহাজ থেকে নামার আগে এ-দেশের দুটো একটা কথা ওরা জেনে নিয়েছে। যেমন মৌরুরা অর্থাৎ অনেক ধন্যবাদ। ছোটবাবু ট্যাকসিতে উঠে গেলে বলল, মৌরুরা।

ছোটবাবু বুঝতে পারল জ্যাককে ওর সঙ্গে ভিড়িয়ে দিয়ে ডেবিড রক্ষা পেয়েছে।

ছোটবাবু ট্যাকসিয়ালাকে বলল, টাহারা।

জ্যাক বলল, নো। এখন আমরা যাব মিউনিসিপাল মার্কেটে।

মিউনিসিপাল মার্কেট দুটো রাস্তার ক্রশিঙে। নাম জানে না ওরা রাস্তার। জ্যাক ছোটবাবুর জন্য কিছু কিনবে বলে লা-কাভেতে ঢুকে গেল। ওরা ফরাসী অথবা তাহিতিয়ান ভাষা জানে। ইংরেজি ওরা কিছু কিছু বুঝতে পারে। সুতরাং জ্যাক স্যুটের রং পছন্দ করতে গিয়ে সেলস-গার্লদের বিরক্ত করে মারছে। জ্যাক লক্ষ্য করছে সেলস্-গার্লগুলো হাঁ করে দেখছে ছোটবাবুকে। সে বুঝতে পারল বেশি দেরি করলে, ছোটবাবুকে ওরা কিডন্যাপ করতে পারে। নেভি ব্লু রঙের ভারি স্নিগ্ধ একপ্রস্থ স্যুট পছন্দ করে বলল, ছোটবাবু তুমি পরে এস। পরে এলে গলায় ওর পছন্দ মতো টাই কিনে পরিয়ে দিল। এবং এটা সে বুঝতে পারছে, এখানে বেশি দেরি করলে ছোটবাবুকে ওরা গিলে খেয়ে ফেলবে। ছোটবাবুর মোমের মতো শরীরে কেউ কেউ ছাতির মাপ নেবার সময় বড় বেশি ঝুঁকে পড়েছিল। আর ছোটবাবুও কেমন, ওদের দিকে তাকিয়ে বেশ হেসে মজে যাচ্ছে। সে যে এটা পছন্দ করছে না ছোটবাবু বুঝতে পারছে না। এত আগলে সে তাকে বেড়াবে কি করে? প্রায় টানতে টানতে ছোটবাবুকে বের করে নিয়ে গেল। যেন ছোটবাবু আর এখান থেকে নড়বে না—ওর রকমসকম দেখে তাই মনে হচ্ছিল।

ট্যাকসিতে জ্যাক ছোটবাবুর সঙ্গে কথা বলল না। নিজের খুশিমতো নামছে উঠছে। ছোটবাবুকে বসিয়ে রেখেছে ট্যাকসির ভেতর। সে ফরাসী পারফিউম কিনে এনেছে। ছোটর হাতে দিয়ে আবার লাফিয়ে লাফিয়ে রাস্তা পার হয়ে যাচ্ছে। ছোটবাবু এমন একটা গাড়ি পার্ক করার জায়গায় বসে বেশ নিরিবিলি মানুষজন দেখছিল। এখন চারটে বেজে গেছে। ওদের অফিসকাছারি ছুটি। গাড়িগুলো সব হৰ্ণ দিতে দিতে বের হয়ে যাচ্ছে। ফরাসী রাজকর্মচারীদের দেখলেই চেনা যায়। ওদের পোশাক ভীষণ বর্ণাঢ্য। তাহিতিয়ান সুন্দরীরা ঘাসের চটি, ঘাসের স্কার্ট পরে কি সুন্দর হেঁটে-হেঁটে যাচ্ছে। ওর ইচ্ছে হচ্ছিল লাফিয়ে নেমে যায়। এবং এরা কোথায় যে থাকে!

ছোটবাবু দেখে অবাক, দুটো বেদিং স্যুট কিনে এনেছে জ্যাক। একটা মেয়েদের একটা ছেলেদের। জ্যাকের তবে দেশে ইতিমধ্যেই প্রেমিকা বড় হয়ে যাচ্ছে। সে যখন ফিরে যাবে তখন হয়তো ওরা দু’জনেই বেশ বড় হয়ে যাবে। তারপরই ফের জ্যাক ফিরে এল। দুটো বর্শা। সমুদ্রের নিচে ডুবে ডুবে মাছ ধরার জন্য এমন বর্শার দরকার। দু’জোড়া ফিন, দু’জোড়া অকসিজেন সিলিণ্ডার। এ-সব কিনে টাকা নষ্ট করার কি যে দরকার সে বুঝছে না। কিন্তু জ্যাক এমন মুখ গোমড়া করে রেখেছে যে সে একটা কথা বলতে সাহস পাচ্ছিল না। জ্যাক একটা ঝিনুকের মালা পর্যন্ত কিনে ফেলল। আর শেষে যা কিনা দেখে অবাক না হয়ে পারল না ছোটবাবু, সারা মিউনিসিপাল মার্কেট চষে সে কিনে ফেলল পাখির পালকে তৈরি এ-দেশের মেয়েদের ট্রাইবাল পোশাক। সে বলল, জ্যাক তোমার কি মাথা খারাপ!

—হ্যাঁ আমার মাথা খারাপ। তুমি আমার সঙ্গে একটা কথা বলবে না বলছি।

ছোটবাবু বলল, ঠিক আছে। সেও গুম্ মেরে বসে থাকল। এখন ট্যাকসি ড্রাইভার যাচ্ছে তাহারা হোটেলস্ হিলে। সব শহরটা ঘুরিয়ে এবং এদিক ওদিক দেখিয়ে সন্ধ্যার আগে সে তাদের সেই তাহারাতে নিয়ে যাবে। জ্যাক বলেছে, ওরা পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে সমুদ্রে সূর্যাস্ত দেখবে।

যেতে যেতে ইংরেজিতে সব বলে যাচ্ছে ট্যাকসিয়ালা।—আসলে আমাদের এ-দ্বীপটার দুটো ভাগ। বরং দুটো পাহাড় বলা যেতে পারে। সবুজ উপত্যকা নামতে নামতে সরু একটা জমিতে দুটো দ্বীপ ভাইবোনের মতো মিশেছে। বড় দ্বীপটার নাম তাহিতি-নু, ছোটটার নাম তাহিতি-ইতি। এমন সুন্দর দ্বীপ স্যার আর কোথাও দেখতে পাবেন না। দু’দিন থেকে যান, সব ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেব। প্রায় বিজ্ঞাপনের ভাষায় ড্রাইভার কথা বলে যাচ্ছে। একটু ঘুরে গেলে দেখতে পেতেন আমাদের শেষ সম্রাট পামারা ফিফথ-এর স্মৃতিসৌধ। তিনি মদ খেতে ভীষণ ভালবাসতেন বলে সমাধির মাথায় রয়েছে এক অতিকায় গোল গম্বুজ, দেখতে প্রায় একটা মদের পিপের মতো। তার আর কিছুর সঙ্গে জীবনে প্রেম ছিল না স্যার। তার লাইফ-লঙ লাভ অ্যাফেয়ার উইথ দা ড্রিংকসকে আমরা ভুলিনি। সে বলল, দেয়ার আর অলসো এ নাম্বার অফ মিউজিয়াম—পিপিতি মিউজিয়াম, গঁগা মিউজিয়াম এবং লা পয়েন্ট ভেনাসে সতেরো’শ ঊনসত্তরে ক্যাপ্টেন কুক, ফার্স্ট ড্রপড্ এনকোর ইন দিজ আয়ল্যাণ্ড। অথবা যেতে পারেন বোটানিক্যাল গার্ডেনে—এ্যাণ্ড স্যার, হোয়েন ইউ আর টায়ার্ড অফ লুকিং এট দা গার্ডেনস, ইউ ক্যান টেক এ টু-আওয়ার গ্লাস বটড্ বোট টুর অফ দা লেগুন অ্যাণ্ড দা গার্ডেনস অফ দা সি।

ছোটবাবুর ইচ্ছে হল বলতে, এবারে থামো বাপো। অনেক হয়েছে। গাড়িটা শাঁ করে তখন মোড় ঘুরে ওপরে উঠে যেতে থাকল। দু’পাশে বিচিত্র সব গাছ, যেন দ্বীপবাসীরা সারা পৃথিবী খুঁজে খুঁজে সব দামী গাছপালা পাহাড়টার চারপাশে লাগিয়ে দিয়েছে। এবং কত সব গাড়ি গাছের ছায়ায়, যেমন বড় বড় ইউকন গাছের ছায়ায় গাড়িগুলো ঘুরে ঘুরে ওপরে উঠে যাচ্ছে। জ্যাক একটা কথা বলছে না। ছোটবাবুকে দেখলে মেয়েগুলো কি যে হ্যাংলার মতো চলে আসে। ছোটবাবু জানে না কেন, এটা ঠিকনা। জাহাজে বনি বড় হচ্ছে। ছোটবাবু কিছুতেই টের পাচ্ছে না। এসব ভেবে জ্যাক আরও গম্ভীর হয়ে গেছে। অধীর হয়ে গেছে। অধীর হয়ে উঠছে।

বোধহয় সেই পাহাড়ের মাথায় সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে বনি একটা কেলেঙ্কারি করে বসত। কি সুন্দর দেখাচ্ছে সমুদ্রটাকে। একেবারে লাল এবং সবুজ দ্বীপমালা দূরে, আর নীলাভ অন্ধকার দ্বীপের আকাশে, যেন এক আশ্চর্য বর্ণমালা সমুদ্র, আকাশ এবং দ্বীপমালা মিলে গড়ে তুলছে। আর তখন যুবক যুবতীরা হেঁটে হেঁটে গাছের ছায়ায় অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। নিচে নেমে যাচ্ছে কেউ, ওপরে উঠে আসছে কেউ এবং পৃথিবী যখন বর্ণমালায় সেজে রয়েছে তখন ওরা ঠিক থাকে কি করে! ঘাসের ওপর ওরা শুয়ে পড়েছে। গাছের ছায়ায় ওরা চুমো খাচ্ছে, বনি দেখতে দেখতে অধীর হয়ে যাচ্ছে। এবং একসময় পাশে বসে ঘাস ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলছে, ছোটবাবু এস আমরা নেমে যাই। কেউ টের পাবে না।

ছোটবাবু বলল, মেয়েরা তোমাকে মারবে জ্যাক। যাও না, গিয়ে একবার বলে দ্যাখো না। কি বলে দ্যাখো। তারপরই ছোটবাবু কেমন ক্ষেপে যাবার মতো বলে যেতে থাকল, জ্যাক, আমি কিছু জানি না। তোমার যা খুশী কর। আমি এখন জাহাজে ফিরব। তোমার মাঝে মাঝে কি যে হয়! তারপরই যেন বলতে ইচ্ছে হয়েছিল, জাহাজে মেয়ে সেজে বিপদে ফেলে দিয়েছিলে, আবার এখানে কিছু একটা কেলেঙ্কারি কাণ্ড করে ফেললে কাপ্তানের কাছে মুখ দেখাতে পারবে না জ্যাক! তোমার এ-বয়সে এত সাহস ভাল না।

জ্যাকের কখন যে কি মর্জি—সে বুঝতে পারে না। জ্যাককে জোর করে তুলে নিয়ে না গেলে কিছুতেই যাবে না। জ্যাক এখন ঘাসের ওপর পাশ ফিরে শুয়ে আছে। ঘাসের ভেতর দু’হাতে মুখ ঢেকে রেখেছে। এবং জ্যাকের শরীরের গঠন মেয়েদের মতো। সে পাশে শুয়ে ওকে ডাকল, এই কি হচ্ছে!

—কিছু না। বলে ধড়ফড় করে জ্যাক উঠে গেল। এবং গাড়ির দিকে ছুটে গেল। সেও জ্যাকের পেছনে পেছনে ছুটতে আরম্ভ করল। বালিকার মতো মুখ, হাতে পায়ে লম্বা জ্যাক—জাহাজে থেকে থেকে ওর মতো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জাহাজে থাকলে বোধহয় এটা হয়। সবাইকে নষ্ট হয়ে যেতে হয়। গাড়িতে বসে জ্যাকের বলতে ইচ্ছে হল, আমার কিছু ভাল লাগছে না ছোটবাবু। জাহাজে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি আমাকে কোথাও নিয়ে চল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *