1 of 2

অলৌকিক জলযান – ২৬

।। ছাব্বিশ।।

ওরা এভাবে সবাই ডেকের ওপর দাঁড়িয়েছিল!

মাংকি-আয়ল্যাণ্ডে কাপ্তান, রেডিও-অফিসার, সেকেণ্ড-মেট। ব্রীজে চিফ-মেট, কোয়ার্টার-মাস্টার, থার্ড-মেট। কাপ্তান চোখ থেকে কিছুতেই দূরবীন নামাচ্ছেন না।

সেকেণ্ড-মেট কিছু বুঝতে পারছে না। জাহাজের পেছনে অনেক দূরে, কত দূরে হবে বুঝতে পারছে না, প্রায় যেন দিগন্তের কাছাকাছি ভলকানিক ইরাপসান অথবা কালো ধোঁয়া ক্রমান্বয়ে কুণ্ডলি পাকিয়ে ওপরে উঠে আসছে।

কাপ্তান বললেন, কি যে এগিয়ে আসছে?

—দেখেছেন স্যার, কেমন ওটা এখন একেবেঁকে দিগন্তে সার সার সমান্তরাল রেখা হয়ে গেল! রেডিও-অফিসার বলল, ঠিক যেন কোন চিত্রকরের ছবি

এবং এভাবে ওরা সেই দিগন্তে দেখতে পেল নানারকমের সব ছবি হয়ে যাচ্ছে। অতিকায় সব ছবি। কখনও একেবেঁকে ফুল লতা-পাতার মতো, কখনও ঘুরে ঘুরে জলস্তম্ভের মতো, কখনও উড়ে উড়ে বিন্দু বিন্দু আঙ্গুরগুচ্ছের মতো আকাশে ঝুলে পড়তে লাগল। তারপর ফের ছড়িয়ে পড়ল পেছনের আকাশে। এত দূরে যে দূরবীনে আসছে না। তবু ওরা যে এদিকে এগিয়ে আসছে এটা বোঝা যাচ্ছে। কারণ ক্রমশ ওদের এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে আবার শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে এগিয়ে আসার ভেতর মনে হচ্ছিল, মেঘেরা সজীব হয়ে গেছে। এবং যেমন খুশি আকাশের গায়ে চিত্রকরের মতো অতিকায় সব বর্ণাঢ্য ছবি এঁকে দিচ্ছে। আবার মনে হচ্ছিল, বড় মাঠে সেই সুন্দর বালিকারা যেমন দ্রুত প্যারেড করার সময় হাত-পা কখনও উঁচুতে কখনও নিচুতে আবার রাইট টার্ন, আবার লেফ্‌ট টার্ন, আবার ঝুঁকে বসে পড়া একসঙ্গে এবং একসঙ্গে উঠে দাঁড়ানো, অথবা দু’হাত ছড়িয়ে ডানা মেলে দেবার মতো ঘুরে ঘুরে ছবি হয়ে যাওয়ার মতো কোনো বড় মাঠে প্যারেড হচ্ছে। এত বড় আকাশটা ওদের যেন হাঁটা চলার জন্য। ঘুরে বেড়ানোর জন্য, কখনও পোশাক সবুজ বর্ণের মনে হয়, অথবা ঘন নীল রং-এর সমুদ্রে এসব দৃশ্য সবাইকে ক্রমে অস্থির করে তুলছে।

তখনই সেকেন্ড-মেট বলল, স্যার বিন্দু বিন্দু কিছু একসঙ্গে জড় হয়ে এদিকে আসছে।

—বিন্দু বিন্দু! কাপ্তান দূরবীন নামিয়ে চশমা রুমাল দিয়ে খুব করে মুছে নিলেন।

—মনে হচ্ছে পাখির মতো।

—পাখি! কাপ্তান অতীব আতঙ্কে প্রায় চিৎকার করে উঠলেন।

তারপর কাপ্তানের মনে হল, তিনি জাহাজের রক্ষাকারী এবং সর্বময়, সুতরাং পাখির কথায় এভাবে ভেঙ্গে পড়া ঠিক না। এবং তিনি যে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠেছিলেন ওটাও ভাল ভুল হয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবে কথাবার্তা বলা দরকার। তিনি বললেন, তবে ওরা আসছে?

—হ্যাঁ, মনে হয় আসছে।

—আসতে দাও।

সেকেন্ড-মেট বলল, ওরা কেন আসছে?

–বোধ হয় খাবারের সন্ধানে।

সেকেন্ড-মেট এমন কথায় আশ্বস্ত হতে পারল না। এবং দেখল প্রায় দীর্ঘ এক অজগর সাপের মতো একটা গগনচুম্বী আঁকাবাঁকা কালো কিছু আকাশের গায়ে ঝুলে পড়ছে। মনে হচ্ছে বিশাল জলরাশির অতল থেকে ওরা দলে দলে একসঙ্গে ঝাঁকঝাঁক পাখি, একসঙ্গে জড় হয়ে ক্রমশ সমুদ্রে ছায়া বিস্তার করে উড়ে আসছে।

ওরা দেখতে পেল ওটা ক্রমশ বিস্তার লাভ করছে সাপের ফণার মতো। অথবা ছাতার মতো অনেক ওপরে জাহাজটাকে ঢেকে দিচ্ছে।

তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। অন্ধকার সমুদ্র তারপর। রাতে ওরা কোথায় কি করবে কেউ বুঝতে পারছে না। পাখিগুলো যে ধূসর বর্ণ এটা টের পাচ্ছে তারা। দূরবীনে ওদের এখন পঙ্গপালের মতো লাগছে দেখতে। ওরা বুঝল, পাখিগুলো আকারে খুব ছোট। একসঙ্গে ঝাঁকে ঝাঁকে এই সব পাখিরা দল বেঁধে উড়তে ভালবাসে। সুতরাং এরা জাহাজের ওপর প্রায় একটা প্রকান্ড ছাতার সামিল। শুধু ধূসরবর্ণ, আর একসঙ্গে ওরা কলরব করছে বলে, ঝমঝম বৃষ্টিপাতের মতো শব্দ। ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে, ছড়িয়ে পড়ছে। অনেক দূরে দিগন্তের কাছাকাছি সরু লম্বা লেজের মতো হয়ে গেছে ওদের শেষ প্রান্ত। একটা গোপন মৃত আগ্নেয়গিরির মুখ থেকে উঠে আসার মতো যখন গোটা ব্যাপারটা তখন কি করা যায়! জাহাজিরা কিছুই বুঝতে পারছে না। যে যার ফোকসাল থেকে উঠে এসে পিছিলে জড় হয়েছে। ওদের তীক্ষ্ণ শিস দেবার মতো শব্দে কানে তালা লেগে যাচ্ছে। জাহাজিরা পাগলের মতো ছোটাছুটি করছে। ডেক-সারেঙ বার বার ব্রীজের নিচে দাঁড়িয়ে এখন কি করণীয় নির্দেশ চাইছে। কিন্তু ব্রীজ থেকে কেউ নামছে না। কিছু তাকে বলছে না। এমন একটা দৃশ্যে সবাই কেমন হতবাক হয়ে গেছে।

তখন একজন মাস্তুলের নিচে বলে উঠল, আমাদের পাপে এটা হয়েছে।

—কে এভাবে চিৎকার করে! এনজিন-সারেঙ দৌড়ে গেল।

–এটা কি এটা কি! বলেই সে তার হাত বাড়িয়ে দিল। সারেঙ দেখল, সামান্য মলমূত্র পাখির সে বলল, ভীষণ জ্বালা করছে সারেঙ-সাব।

সঙ্গে সঙ্গে এই দু-এক ফোঁটা যারা ডেকে দাঁড়িয়েছিল তাদের শরীরে এসে পড়তে থাকল। প্ৰায় ফোসকা পড়ার মতো জ্বালা। এবং যারাই দাঁড়িয়েছিল তাদের শরীরে এক আধ ফোঁটা পড়ছে, পড়ছে তো পড়ছেই। আগুনে ছ্যাঁকা লাগলে যেমন শরীর জ্বালা করে তেমনি ছটফট করতে করতে সবাই সিঁড়ির নিচে দৌড়ে যেতে থাকল। চিফ-মেট ব্রীজ থেকে চোঙে জোর গলায় বলে যাচ্ছেন, জাহাজিরা ভেতরে ঢুকে পড়। কেউ বাইরে বের হবে না। আমাদের জাহাজে সেই সব বিষাক্ত পাখিরা উড়ে এসেছে। আমরা জানি না এদের হাত থেকে কি করে রেহাই পাব।

দুটো একটা পাখি ততক্ষণে খুব নিচে নেমে এসেছে। এইসব হাজার হাজার পাখিদের এমন বীভৎস হাঁকডাক ভাবা যায় না। নিচে নেমে এলে জাহাজিরা দেখেছিল ওদরে চোখ রক্তবর্ণ। ঠোঁট সাদা, ডানা সবুজ রঙের, পেটের দিকটা একেবারে ধূসরবর্ণ। মলমূত্রে যাদের মুখ হাত-পা সামান্য বিবর্ণ হয়ে গেছে তারা বিছুটি শরীরে লাগালে যেমন দৌড়ে দৌড়ে জ্বালা নিবারণ করে, সেভাবে দৌড়ে দৌড়ে জ্বালা নিবারণ করছে।

আর্চি বাহবা নেবার জন্যে বাইরে এসে যেই না দাঁড়িয়েছিল আর অমনি ওর মুখে সেই সব তরল পদার্থ এবং সে পাগল প্রায় এখন ছুটছে। জ্যাক ছিল চিফ-কুকের গ্যালির ছাদের নিচে। সে তখন ছুটছে ওপরে—চিফ-মেটের তখন সতর্ক কথাবার্তা, নিচে যে যেখানে আছে সবাইকে বলে দাও, ডেক ধরে কেউ যেন হেঁটে না যায়। এনজিন-জাহাজিদের জন্য টানেল পথ খুলে দেওয়া হোক।

জাহাজে এখন অন্ধকার ক্রমে বসে যাচ্ছে, আর ব্রীজ থেকে চীফ-মেটের অসহায় গলা ভেসে আসছে। সেকেন্ড-মেট কোনরকমে হুমড়ি খেয়ে গড়িয়ে পড়ল নিচে, তারপর দু’হাত মুখের ওপর রেখে ভীতু কাপুরুষের মতো দৌড়ে পালাতে থাকল। কে কোথায় কিভাবে আছে দেখার সময় নেই।

কেবল জ্যাক কিছুটা ছুটে এলি-ওয়েতে ঢুকেই ভাবল, ছোটবাবু-কোথায়!

সে ফের ছোটবাবুর কেবিনের দিকে ছুটতে থাকল। ছোটবাবুর দরজা লক করা। আর্চি পাগলের মতো কেবিনে চিৎকার করছে। জ্বলে গেল বলছে, এবং যে যেখানে এভাবে মলমূত্রের ভেতর পড়ে গেছে তারা জ্বলে গেল বলছিল। অমিয়র হাতে, মজুমদারের কানের ওপর, ইয়াসিনের পায়ে, ডেক- কশপের বুকে, ডেক-সারেঙের গলায় এবং প্রায় সবাই এইসব ধূসরবর্ণ বিষাক্ত পাখিদের আক্রমণের ভেতর পড়ে গেছিল। কেবল বেঁচেছে যারা এনজিন রুমে তখন কয়লা মারছিল, যারা এনজিন রুমে ডিউটি দিচ্ছিল, আর যারা ব্রীজে কিংবা মাংকি-আয়ল্যান্ডে দাঁড়িয়ে দেখছিল, ওরা আসছে।

আগেই সতর্ক করে দেওয়া দরকার ছিল। এইসব বিষাক্ত পাখিদের আক্রমণের ভেতর কোনো কোনো জাহাজ পড়ে থাকে, কাপ্তানের কাছে এমন খবর রয়েছে। ওরা কোথায় থাকে কোথায় কি ভাবে বসবাস করে কেউ হদিস করতে পারে না। প্রশান্ত মহাসাগরে এভাবে কোনো কোনো সময় দেখা গেছে, খুব ক্বচিৎ এটা ঘটে থাকে এবং অবিশ্বাস্য মনে হয়, তবু ঘটনা। যদিও এখন এটা ভেতরে ভেতরে সবার ধারণা ম্যান-এ্যালটাব্রসের মৃত্যু তাদের ভীষণ পাপের ভেতর ফেলে দিয়েছে। আর তাছাড়া তো প্রাচীন নাবিকদের মতো তাদের এখন তেমন সংস্কার নেই। তবু রাইম অফ দি এনসিয়েন্ট ম্যারিনারের কথা মনে হওয়া স্বাভাবিক। সে সময় এসব পাপবোধ ভীষণ কাজ করত। তখন জাহাজিরা সমুদ্র সম্পর্কে তেমন অভিজ্ঞ ছিল না। সমুদ্রের দ্রাঘিমা অক্ষাংশের খবর ছিল সামান্য। কোর্স-লে তৈরি করার ব্যাপারে ছিল অনভিজ্ঞ। ওরা সমুদ্রে সহজেই হারিয়ে যেতে পারে। কিন্তু ওসেনোগ্রাফি এখন একটা যদিও কঠিন বিষয় তবু প্রায় হাতের কব্জায় আছে সব কিছু। ওরা ম্যান এ্যালবাট্রসের মৃত্যুর জন্য এমন ঘটেছে জোর গলায় কেউ বলতে পারল না। কেবল কাপ্তান স্থির দাঁড়িয়ে আছেন। ব্রীজের কাছে তিনি দেখতে পাচ্ছেন, পাখিদের ডানা লেপ্টে যাচ্ছে। ওরা কাচের ওপর ধাক্কা খেয়ে নিচে পড়ে যাচ্ছে। একটা পাখি কি করে ভেতরে ঢুকে ডানা মেলে পড়ে গেল। আলো একদম সহ্য করতে পারছে না। প্রায় বাদুড়ের মতো দেখতে ওরা। ওদের ধরা ঠিক না। একটা স্টিক দিয়ে পাখিটাকে ঠেলে নিচে ফেলে দিতেই আর একটা এবং এভাবে ওরা ভীষণ আলোর ভেতর পড়ে কেমন দাপাতে থাকল। বেশি আলোতে ওরা দেখতে পায় না তবে! এবং সকালে সূর্য ওঠা পর্যন্ত জাহাজের এখন এভাবে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।

আর তখন জ্যাক প্রায় দরজা ভেঙ্গে ফেলার মতো অবস্থা করে ফেলেছে। ছোটবাবু ছুটি পেয়ে ঘুমোচ্ছিল। ওর ঘুম ভাঙলে মনে হল জাহাজে আগুন লাগলে যে যে শব্দ হাওয়ায় নাচতে থাকে সমস্ত জাহাজের চারপাশে তেমন সব বীভৎস শব্দ। আর দরজায় জ্যাকের গলা। এমন একটা দুঃসময়ে সে যে কেবিনে কি করে ঘুমিয়েছিল!

সে দরজা খুলে ফেললে হুমড়ি খেয়ে ভেতরে এসে ছিটকে পড়ল জ্যাক। সে দেখল, জ্যাকের চোখ মুখ শুকনো।

সে বলল, জ্যাক কি হয়েছে!

শুকনো মুখে জ্যাক বলল, বিষাক্ত সব পাখিরা এসে জাহাজটাকে ঘিরে ফেলেছে। বাইরে একদম যাবে না।

জ্যাক এখন ওপরে উঠতে পারছে না। এনজিন রুমে দ্রুত কয়লা হাঁকড়াচ্ছে জাহাজিরা। যত দ্রুত পারা যায়, এ সমুদ্র থেকে জাহাজ নিয়ে পালাতে চাইছে সবাই।

জ্যাক ওপরে উঠলেই সেই বৃষ্টিপাতের মতো মলমূত্র এসে ওর মুখে শরীরে পড়তে পারে। সে একটা চাদর চেয়ে নিল ছোটবাবুর কাছ থেকে। সেটা মাথায় মুখে জড়িয়ে নিল। প্রায় যেন বোরখার মতো চাপিয়ে সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠে যাচ্ছে। যাবার আগে ফের সাবধান করে দিল, সব জাহাজটাকে বিষাক্ত পাখিরা ঘিরে ফেলেছে। সমুদ্র দেখা যাচ্ছে না। আকাশ দেখা যাচ্ছে না। কুয়াশার ভেতর জাহাজ পড়ে গেলে যা হয়। সামনে পেছনে কেবল ওরা হাজার লক্ষ উড়ছে। আর জাহাজটা নোংরা করছে।

এটা যে কি হয়ে গেল! সে একটু এগিয়ে গেল সামনে। ওদিকের এলি-ওয়েতে আলো জ্বলছে না। চারপাশে সব দরজা লক করে দেওয়া হয়েছে। এলি-ওয়েতে এখন কোনও পাখি আর ঢুকে পড়তে পারবে না। পাঁচ-নম্বর, তিন-নম্বর, ছোটবাবু, ডেবিড একসঙ্গে জটলা করছে। পাঁচ-নম্বর এতক্ষণ আর্চির ঘরে ছিল। সমস্ত মুখে আর্চির সে মলম লাগিয়ে দিয়েছে। ওপর থেকে কেউ আর নামতে পারছে না। ওর একবার আর্চিকে দেখে আসা দরকার। সে, ডেভিড, তিন নম্বর সবাই আর্চির কেবিনে ঢুকে গেল। ছোটবাবু বসল না। ওকে বসতে না বললে সে বসতে পারে না। জ্বালাটা বোধ হয় কমেছে। আর তখন ওপরে রেডিও-ট্রানসমিশান রুমে একের পর এক খবর ট্রানসমিট করে যাচ্ছে—জাহাজ সিউল-ব্যাঙ্ক কঠিন দুর্বিপাকে পড়ে গেছে। রেসকু আস, বলতে পারছে না। কাপ্তানের তেমন নির্দেশ নেই। তবু যা সব ঘটনা সে কাচের ভেতর দাঁড়িয়ে দেখেছে, ভাবতে পারে না, অজস্র পাখি জাহাজের মাস্তুলে দড়াদড়িতে জড়িয়ে একেবারে নিচে পড়ে যাচ্ছে এবং এভাবে যদি তিন-চার দিন চলে, দেখা যাবে সব মৃত পাখিদের ডাঁই এবং দুর্গন্ধ জাহাজে—ভীষণ অসুখে পড়ে যাবে সবাই অথবা মৃত পাখিরা এবং জীবিত পাখিরা মিলে কঠিন অসুখে ফেলে দেবে। ওরা কেউ নিস্তার পাবে না।

তবুও যা ঘটনা তাই জানানো হল। বিষাক্ত পাখিদের মলমূত্রের ছিটেফোঁটা যাদের শরীরে পড়েছে, জ্বালা করছে ভীষণ। এবং জাহাজ ভিড়লে বোধ হয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা দরকার। কাল কি হবে আমরা বলতে পারছি না। পাখিগুলো এখনও জাহাজের চারপাশে রয়েছে। যেখানে যেভাবে পারছে ঠোকরাচ্ছে। আমরা কি করব বুঝে উঠতে পারছি না।

কাপ্তান নিজেও চুপচাপ বসে নেই। তিনি চিফ-মেটকে নিয়ে সিঁড়ি ধরে নামছেন। শরীর মুখ ঢাকা। বনির কেবিন বন্ধ। তিনি ডাকলেন, বনি

বনি বলল, ভেতরে বাবা।

—বাইরে বের হবে না।

–বের হচ্ছি না।

তিনি তারপর আরও নিচে নেমে গেলেন। আর ভাবছিলেন, এরা কোত্থেকে এল! এমন পাখিদের আক্রমণে জাহাজ পড়বে ভাবতেও পারেন নি। গল্প গাঁথার মতো এসব খবর সমুদ্রে শুনেছেন। মনে হয়েছিল, যেমন সব জাহাজি গল্পে দিনকে রাত বানিয়ে ফেলতে পারে এও তেমনি। কিন্তু নিজে এমন ঘটনার সম্মুখীন হবেন, স্বপ্নেও ভাবতে পারেন নি। নিচে নেমে আর্চির কেবিনেই প্রথম ঢুকে দেখলেন, আর্চি শুয়ে আছে। কাঠপিঁপড়ের কামড়ের মতো মুখের দু-একটা জায়গা ফুলে গেছে। আসলে এটা এক ধরনের চুলকানি। ভীষণ, এবং জ্বালার মতো মনে হয়। অভয় দিয়ে বললেন, সকালে ঠিক হয়ে যাবে। আরও এভাবে সব ঘুরে ঘুরে দেখা। তারপর এনজিন রুমে নেমে টানেল-পথে ঢুকে গেলেন। প্রপেলার স্যাফটের গা ঘেঁষেঘেঁষে হেঁটে গেলেন। তারপর লম্বা খাড়া লোহার সিঁড়ি ওপরে উঠে গেছে। দু’পাশের দেয়াল থেকে কিছুটা হামাগুড়ি দিয়ে ওঠার মতো তিনি দ্রুত উঠে যেতে থাকলেন। মনেই হয় না বয়েস হয়েছে মানুষটার। লাফিয়ে লাফিয়ে এখন সিঁড়ি ভাঙছেন। স্টোররুমের পাশে এসে সিঁড়িটা থেমেছে। ঢাকনা খুলে খোলের ভেতর থেকে উঠে আসার মতো গলা বাড়ালেন ওপরে। চিফ-মেট একটা হাত ধরে প্রায় টেনে তুলে নিলে তিনি দেখলেন, সবাই ছুটে এসেছে। ডেক-সারেঙ সামনে দাঁড়িয়ে সালাম জানাচ্ছে। সবার ঘরে ঘরে উঁকি দিলেন। যেখানে যার ছিটেফোঁটা পড়েছে হাতে, পায়ে, তা দেখে বললেন, মাস্টার অয়েল লাগিয়ে দাও। ভয়ের কিছু নেই।

তিনি অবশ্য জানেন না সত্যি কিসে কি নিরাময় হতে পারে। তবু একজন অভিজ্ঞ মানুষের মতো কথা বলে সবার সাহস ফিরিয়ে আনছেন। পাখিদের আর্ত চিৎকার চারপাশে। কান পাতা যাচ্ছিল না। সমুদ্রে শুধু অন্ধকার। জাহাজের আলো সব নিভিয়ে একবার দেখা যেতে পারে, ওরা কেবল আলোর দিকে ছুটে আসে কিনা। হাঁটতে হাঁটতে নানাভাবে উপায় খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কিভাবে এদের সঙ্গে মোকাবিলা করে যাবেন। ফোকসাল থেকে নেমে যাবার আগে কি কি দরকার, সকাল না হলে যে কিছু ভাবা যাচ্ছে না—এসব মোটামুটি চিফ-মেটকে বুঝিয়ে ফের সেই ঢাকনার পাশে এসে দাঁড়ালেন। চিফ-মেট ডেক-সারেঙকে সব বুঝিয়ে দিল। এনজিন সারেঙ ঢাকনা খুলে দিয়েছে। কাপ্তান আবার নেমে যাচ্ছেন। টর্চ মেরে মেরে নামছেন

সারা রাত জাহাজিদের মনে হল, আগুন লেগেছে জাহাজটাতে। এমন শব্দ চারপাশে। এইসব হাজার হাজার পাখির ডানায় কোনো বনাঞ্চলে অগ্নিকান্ডের মতো—সাঁই সাঁই আওয়াজ। ডানায় অজস্র ঝটপট শব্দ, এবং এক করুণ কলরব। এ-সবের ভেতর মনে হল, লেডি-এ্যালবাট্রস সমুদ্রে তোলপাড় করে বেড়াচ্ছে।

ওরা পোর্ট-হোলে মুখ রেখে দেখল, এখানে-সেখানে সব পাখি। পাখিরা জাহাজের মাস্তুলে এবং দড়িদড়াতে আছড়ে পড়ছে, পাখির এমন নরম ডানা যখন, তখন এই জাহাজের চারপাশে উড়ে বেড়াবার কি যে অর্থ কেউ বুঝতে পারছে না। যত রাত বাড়ছে তত মনে হচ্ছে, অসহ্য। এভাবে চারপাশে পাখিরা মশার মতো বনবন করে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়তে থাকলে ওরা নিশ্চিন্তে ঘুমায় কি করে! সবাই ডেবিডের ওপর ক্ষেপে যাচ্ছে। মৈত্র নিজের জ্বালায় বাঁচছে না। তার ওপর এই সব পাখিদের শিস দেওয়া ডাক, যেন হাজার লক্ষ শুশুক মাছ সমুদ্রে ডেকে বেড়াচ্ছে। ওরা ডাঙ্গার মানুষ, সমুদ্রে ওরা চিরদিন থাকে না, সবাই ভুলতে বসেছে।

এবং এই নিয়েই মৈত্র, জব্বার এবং ইয়াসিন পিছিলে একটা দারুণ বিদ্রোহ গড়ে তুলতে পারে। আর ডেবিড বোধ হয় এটা আঁচও করেছিল মনে মনে ম্যান-এ্যালবাট্রসের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে—অর্থাৎ এক রাতও পার হয় নি, তখন কিনা এমন কঠিন সঙ্কট জাহাজের সামনে। বিষাক্ত পাখিরা এসে জাহাজে উপদ্রব আরম্ভ করে দিয়েছে। কাপ্তান ওকে যে-কোনো সময় ডেকে পাঠাতে পারেন—তাকে কৈফিয়ৎ দিতে হতে পারে। ম্যান-এ্যালবাট্রসের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে জাহাজে যখন একটা সত্যি অপরাধ ঘটে গেল—এবং তার প্রায়শ্চিত্ত পর্যন্ত আরম্ভ হয়ে গেছে তখন ডেবিডের কসুর কাপ্তান ক্ষমা করবেন না।

ডেবিড ঐ সব ভাবছিল আর কেবিনে পায়চারি করছিল। সে এক জায়গায় স্থির হয়ে বসতে পারছে না। প্রথম প্রথম সে অপরাধের গুরুত্ব বুঝতে পারে নি। যত রাত বাড়ছে নিশীথে যত পাখিদের আক্রমণ বাড়ছে তত সে অস্থির হয়ে উঠছে। বিশেষ করে এদের ভেতর অসন্তোষ দেখা দিলে মারাত্মক কিছু একটা হয়ে যাবে। সে দরজা খুলে এলি-ওয়েতে প্রায় ছুটতে থাকল, ছোট, ছোট—ঘুমোলে!

ছোট দরজা ফাঁক করে বলল, ঘুম আসে?

—তা আসে না। কিন্তু! কেমন ভীত চোখ মুখ ডেবিডের।

ছোট বলল, বোস।

ডেবিড় ভীষণ ঘামছিল। সে বলল, ডেবিড কি হয়েছে?

ডেবিড বলল, আমাকে কাপ্তান ঠিক এবারে ডাকবেন!

—কেন ডাকবেন? কি করেছ?

—ম্যান-এ্যালবাট্রস…সে বলতে পারল না আর।

ছোটবাবু বুঝতে পারছে না। ম্যান-এ্যালবাট্রসের কথা বলছে কেন ডেবিড। সে বুঝতে না পারলে কোন প্রশ্ন করে না। তাকিয়ে থাকে শুধু।

ডেবিড বলল, আমি মেরেছি!

ছোটবাবু এবারে নিঃশ্বাস ফেলল স্বাভাবিকভাবে। বলল, তার জন্য কি হয়েছে।

—যদি এ-জন্য হয়ে থাকে?

—তুমি কি! কেউ আজকাল এ-সব বিশ্বাস করে?

—কাপ্তান বুড়ো মানুষ তিনি…

ছোটবাবু এখানেই ছোটবাবু! সে বলল, এ যুগে এ-সব অচল ডেবিড। তোমরা পুরোনো নাবিক, আমি নতুন। আমার তো কিছুই মনে হচ্ছে না।

—নতুন বলেই হচ্ছে না। পুরোনো হলে তোমারও হত।

—না, হত না। তুমি ডেবিড এত বুদ্ধিমান, তুমি ডেবিড কাপ্তানের সিউল-ব্যাংকে কাজ নিয়ে কতবার এসেছ, সিউল-ব্যাংকের ভবিষ্যত সম্পর্কে তুমি এতো জানো—আর তুমি এতে ঘাবড়ে গেলে!

—যদি এরা বিদ্রোহ করে?

—কারা তারা?

–এই জব্বার, মৈত্র, এনজিন-সারেঙ…।

—কেউ করবে না।

—তুমি ঠিক বলছ?

—ঠিক। বলে সে বলল, এস। ওরা বাইরে বের হয়ে গেল। ছোটবাবু নিজের কেবিনের দরজা লক করে দিল! সে এবং ডেবিড একসঙ্গে বের হয়ে দেখল, সবার দরজা লক করা ভেতর থেকে। কেউ বাইরে বের হচ্ছে না। ওরা দুজন ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকল। আর বাইরে তেমনি পাখিদের ডানার শব্দ, যেন লকলক করে আগুন জ্বলছে—যেন বড় একটা গঞ্জ পুড়ে যাচ্ছে। বাতাসের সাঁই সাঁই শব্দ, এমন শব্দে মাথা সত্যি ঠিক রাখা যায় না। ছোটবাবুও পারত না। কিন্তু ছোটবাবু জানে সমুদ্র সফরে বের হলে এমন হামেশা হবে। এনজিন-সারেঙ তাকে এ-জন্য বার বার সিউল-ব্যাংকে কাজ নিতে বারণ করেছিলেন। যেন সিউল-ব্যাংকে কাজ নিয়ে উঠলেই সমুদ্রে জাহাজডুবির আশঙ্কা থাকে। সে এতটা ভেবে জাহাজে এসেছে। সুতরাং সে পাখিদের আক্রমণের ভেতর পড়ে ঘাবড়ে যাবার ছেলে নয়। অন্তত ডেবিডের সঙ্গে কথাবার্তায় এটাই এখন প্রমাণ করতে চাইছে।

তা ছাড়া এমনই স্বভাব ছোটবাবুর। ডেবিড যখন ভয়ে কাহিল তখন সে একেবারে সোজা সরল, এবং যতটা সোজা সরল অথবা নির্ভয় মনে মনে, তার চেয়ে বেশি দেখানোর চেষ্টা। সে এমন কি লকার থেকে গ্লাস এবং বোতল বের করে নিজে সামান্য খেল, ডেবিডকে খেতে দিল। দেখে মনে হবে, ছোটবাবু এখন এ-জাহাজের সব চেয়ে সাহসী নাবিক

ডেবিড গ্লাস নিয়ে প্রায় সবটা একসঙ্গে গলায় ঢেলে দিল। ওর এটা অনেক আগেই করা উচিত ছিল। তবে সে এতটা ভেঙ্গে পড়ত না। সে খুব ছেলেমানুষী করে ফেলেছে। সে আরও কিছুটা গলায় ঢেলে বলল, চল।

—কোথায়?

–ক্রুদের আস্তানায়।

—এখন?

—হ্যাঁ এক্ষুনি। তুমি একবার ওদের হাবভাব দেখে আঁচ করে আসবে।

ছোটবাবু বুঝতে পারল ডেবিড এখনও নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। সে বলল, চল।

আর ছোটবাবুকে ফোকসালে এ-সময় ওরা পেয়ে কি যে করবে ভেবে পেল না। ওরা কেমন আছে জানতে এসেছে ছোটবাবু। মনু চা পর্যন্ত করে নিয়ে এল। সে বলতে পারল না ঢাকনার নিচে মেজ-মালোম বসে রয়েছে, বললে, ডেবিডকে অপমান করা হবে। কথা প্রসঙ্গে শেষ পর্যন্ত পাখিদের কথা উঠল। এবং অমিয় বলল, শালা শুঁয়োপোকার মত জ্বলছিল রে?

ছোটবাবু বলল, মৈত্রদা চুপচাপ এত?

—কিছু ভাল লাগছে না।

—তাহিতিতে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

—আমাকে কিছু টাকা ধার দিবি ছোট?

এত লোকের সামনে মৈত্রদার টাকা চাইতে এতটুকু সংকোচ হল না। ফের বলল, তুই তো অনেক টাকা পাবি। আমার কোম্পানীর ঘরে সামান্য পাওনা আছে।

ছোটবাবু বুঝতে পারল মৈত্রদা আর সে মৈত্রদা নেই। কেমন ভীরু কাপুরুষ হয়ে গেছে। অসুখটার জন্য এমন হয়েছে হয়তো। ভালো হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আজকাল এ-অসুখের তেমন ভয় নেই সে শুনেছে। সে বলল, বাইরে এস।

বাইরে এসে বলল, দেব। কাউকে বলবে না। যখন পারবে দেবে। তারপর ছোটবাবু বলল, যাচ্ছি। ওরা সঙ্গে আসতে চাইলে বলল, তোমরা যাও। নিচে ডেবিড বসে রয়েছে। তোমাদের দেখলে খুব অপ্রস্তুত হয়ে যাবে।

এনজিন-সারেঙ বলল, মেজ-মালোমকে ডাকলি না কেন?

ছোটবাবু বলল, ওই তো নিয়ে এল। তোমরা কেমন আছ আমাকে পাঠিয়ে খবর নিচ্ছে।

ওরা সবাই মেজ-মালোমের তারিফ করল। দু-একজনের মনে যা-ও একটু আতঙ্ক ছিল, ম্যান- এ্যালবাট্রসের হত্যার জন্য তারা পাখিদের ক্ষোভে পড়ে গেছে, ডেবিড নিজে এসেছে শুনে তাও ভুলে গেল। বলল, ডাক না একবার।

ছোটবাবু ঢাকনা খুলে ডাকল ডেবিডকে। বলল, ওপরে উঠে এস। কিছু ভাবনার নেই। সব ঠিক আছে।

সে উঠে এসেই দেখল, সবাই খুব প্রীত এবং কথাবার্তায় একেবারে নিজের মানুষের মতো। ওদের কথাবার্তা সে বুঝতে পারে না। কিন্তু মুখ দেখে বুঝতে পারছে, পরিণামে জাহাজের যাই হোক তাকে দায়ী করে ওরা জাহাজে বিদ্রোহ করবে না। ওরা বন্দর-পেলে জাহাজ থেকে নেমে পড়বে না। ছোটবাবু ওদের কাছে যাদুকাঠির মতো। এবং সে-রাতেই, কারণ রাতে কেউ ঘুমোতে পারবে না জানত, ডেবিড আর একবার আর্চি কেমন আছে দেখতে গিয়ে সব বলে ফেলল। বলল, আর্চি, তুমি ছোটবাবুকে আর র‍্যাগিং করবে না। তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি। আজ যা দেখাল ছোটবাবু। এবং সে কথাপ্রসঙ্গে ছোটবাবু এদের কতো নিজের মানুষ, সে ইচ্ছে করলে আর্চিকে নাকের জলে চোখের জলে এক করে ফেলতে পারে তাও বলল।

এবং ডেবিডের এভাবে যে কি হয়ে যায়। এখন সে খুব বেশি নিশ্চিন্ত। সারাটা দিন তার ভাল কাটেনি। মাথার ভেতর দুশ্চিন্তা। দুটো-একটা কথা, পাখিটা মেরে ফেলার পর যে কানে না এসেছে তাও নয়। এবং এভাবে সে সারাদিন ভীষণ দুশ্চিন্তায় ছিল। ভাল করে রাতে খেতে পারেনি। এবং সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে যখন পাখিরা এসে জাহাজটাকে ঘিরে ফেলেছিল, চোখে তার সর্ষে ফুল—যদিও সে কথায়-বার্তায় সব সময় ড্যাম-ডেয়ারিং গোছের, কিন্তু মনে মনে মরমে মরে যাচ্ছিল—তখন ছোটবাবু তাকে সব দুশ্চিন্তা থেকে বাঁচিয়েছে।

সে ফিস ফিস গলায় বলল, বুঝলে না সব অশিক্ষিত নাবিক। সংস্কার ভীষণ। ম্যান-অ্যালবাট্রসের জন্য এমন হয়েছে ওরা ভাবতে শুরু করেছিল।

আর্চি শুয়ে আছে। বালিশ উঁচু করা। মাথাটা ওপরের দিকে। জ্বালা-যন্ত্রণা একেবারেই নেই। সে কেমন দু-পাটির দাঁত শক্ত করে বলল তাই বুঝি!

—ছোটবাবুকে দিয়ে সব মিটমাট করা গেল। বাবাঃ এখন ঘুমোতে যাব।

এবং সকালে সবাই দেখল গোটা জাহাজে ভীষণ দুর্গন্ধ। মল-মূত্রে জাহাজের ডেক, বোট-ডেক, মাংকি-আয়ল্যান্ডের ছাদ,গ্যালির ছাদ, সামনে-পেছনে ঢাকা। কেউ বের হচ্ছে না। আর আশ্চর্য একটা পাখিও নেই। যাদের মনে হয়েছিল, ডানা ভেঙে ডেকে পড়ে আছে, একটাও তেমন পাখির সন্ধান পাওয়া গেল না। কেবল দুর্গন্ধে টেকা যাচ্ছে না। কাদার মত প্যাঁচ প্যাঁচ করছে—নাবিকেরা গামবুট পরে, হাতে দস্তানা লাগিয়ে নিয়েছে। এবং খুব সতর্কতার সঙ্গে সবাই কাজ করছে। ওপরে কাপ্তান দূরবীন লাগিয়ে চারপাশে যতদূর চোখ যায় দেখছেন। ডেবিডও দেখছে। সে কিছু দেখতে পেল না। না, একেবারে কিছু দেখতে পায়নি ঠিক না, অনেক দূরে সমুদ্রের ঢেউয়ের মাথায় লেডি-এ্যালবাট্রস বসে রয়েছে। দূর থেকে জাহাজটাকে অপলক দেখছে।

জ্যাক কেবিন থেকে বের হতে পারছে না। বোট-ডেকে জল মারা হচ্ছে। হোস পাইপে জল মারছে এবং এমন ভাবে মারা হচ্ছে যাতে ছিটে-ফোঁটাও কারো চোখে-মুখে গিয়ে না পড়ে। স্টিক ব্রুম ডেক জাহাজিদের হাতে। ওরা জল মেরে ব্রাশ চালাচ্ছে। এবং বোট-ডেকের কাজ সারতেই সকাল কেটে যাবে তাদের। ওরা প্রথমে একেবারে মাংকি-আয়ল্যাণ্ড থেকে কাজ আরম্ভ করেছে। ক্রমে নিচে নেমে আসবে। বোট-ডেকে পা মাড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। অথচ এমন একটা দুঃস্বপ্ন এত সহজে কেটে যাবে জ্যাক বুঝতেই পারেনি। প্রায় জাহাজ ডুবতে ডুবতে যেন বেঁচে গেল। মেজ-মালোমকে সে দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকছে। আর চেঁচাচ্ছে—কি দেখছ? ওরা কি দুরে কোথাও আছে?

ডেবিড ইশারায় বলছে—না। না নেই। কেবল লেডি-অ্যালবাট্রসকে দেখা যাচ্ছে। আর কিছু নেই।

কাপ্তান চিফ-মেট ভাল করে দেখে প্রায় যখন নিশ্চিন্ত, রেডিও-অফিসার তখন বেতার সংকেত পাঠাচ্ছে। অল ক্লিয়ার—বেতার সংকেতে সে এরিয়া-স্টেশনকে জানিয়ে দিচ্ছে।

যখন রেডিও-অফিসার অল-ক্লিয়ার জানাচ্ছে তখন একমাত্র একজন কেবিনে বসে অল-ক্লিয়ার ভাবতে পারছে না! সে তার মাথা সমান উঁচু আয়নায় দাঁড়িয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখ ঘসছে। কালো দাগ। যেন কেউ সারা মুখে উল্কি পরিয়ে দিয়েছে। জ্বালা-যন্ত্রণা শেষ হয়ে গিয়ে ও-সব উল্কির মত কি ফুটে উঠছে! হাত দিলে জায়গাগুলো সামান্য অসাড় লাগছিল শুধু। সে বার বার বাথরুমে যাচ্ছে, সাবানে মুখ ঘষছে এবং কেবিনে এসে লকারের আয়নায় মুখ দেখতে দেখতে উন্মাদের মতো চিৎকার করে উঠতে চাইছে। এটা কি হল? ঠিক উইচদের মতো মুখ? সাদা রঙের পাশে কালো কালো উল্কি পরানো? কোনোটা ইয়ারিংয়ের মতো, কোনোটা সমান্তরাল, অথবা ডিম ভেঙে চড়াৎ করে এসে পড়লে যেমন হয়ে যায়, যেখানে-সেখানে মুখে তারাবাতির মতো বিন্দু বিন্দু কালো ফুটকরি। সারা মুখে বিচিত্র সব ছবিতে একেবারে একটা সে মন্ত্রপুত মানুষ হয়ে গেছে। যেন এখন কোমরে সিংহের চামড়া থাকলে উট-পাখির পালক গুঁজে দিলে এবং নানারকমের পাথরের মালা গলায় পরলে হাতে বর্শা থাকলে সে আফ্রিকার কোন অরণ্যসর্দারের ভূমিকা নিতে পারে।

সে নিজেকে ভয় পাচ্ছিল। তার হাত-পা ঘামছে। সে ছুটে এলি-ওয়েতে বের হয়ে এল। মুখে এটা আমার কি হয়ে গেল! সে ছুটে ছুটে ডেবিডের কেবিনে ঢুকে বলল, ডেবিড সি, এই যে দেখছ! দ্যাখো দ্যাখো সারা মুখে কি আমার! কোন ব্যথা বেদনা নেই। একটু অসাড় লাগছে। সারা সকাল ধরে চেষ্টা করেছি এসব দাগ তুলে ফেলতে পারছি না। বলেই সে বাংকে দু-হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ল।

আর্চিকে ডেবিড চিনতেই পারছিল না। সে প্রথম ভেবেছিল আর্চি ওকে ভয় দেখাবার জন্য মুখে রং কালি মেখে অথবা তামাসা করার জন্য ছুটে এসেছে। সে প্রথম খুব হকচকিয়ে গেছিল। তারপর মুখটা আর্চির এটা সে বুঝতে পেরেছিল। তারপর এই সাত সকালে এসব তামাশার কি মানে সে যখন বুঝতে পারছিল না, তখনই আর্চি বলতে বলতে ভীষণ ছটফট করছিল। অধৈর্য এবং প্রতিশোধের স্পৃহা সারা মুখে। সে বসতে পারছিল না, সে দাঁড়াতে পারছিল না—কেবল কি করা যায় ভাবছে। সে বিড় বিড় করে বলে যাচ্ছিল, তখন রাত দুটো, দুটোর পর মনে নেই কিছু, তার মানে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলামে। ঘুমোবার আগে মুখটা দেখেছি। ফোলা জায়গাগুলো তখন বসে যাচ্ছে। সব ঠিক হয়ে যাবে ভেবে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে উঠে ডেবিড বিশ্বাস কর, বলে দু-হাত ঝাঁকাতে থাকল, আমি আয়নায় নিজেকে দেখে আঁতকে উঠলাম। আমার মুখটা…বলে সে থেমে থাকল। হাঁ-করা মুখ। মুখের দিকে তাকাতে ভয় করছে।

ডেবিড, আর্চির মুখের চামড়া দু-আঙুলে টেনে টেনে দেখল। পোর্ট-হোলের কাচ খলে ভালো করে আলোতে দেখে বুঝল, ভেতরে চামড়ার ভাঁজের অনেক গভীরে দাগ ঢুকে গেছে। এখন ভালো ডাক্তার না দেখালে হবে না। সে এ-সবের কিছু বুঝতে পারছে না। তবু ভালো জাতের ক্রিম অথবা হয়তো কিছুই না, সময় পার হলে আপনি নিরাময় হয়ে যাবে—এজন্য এমন মুষড়ে পড়তে বারণ করল ডেবিড। বলল, আসলে পাখিগুলোর মলমূত্রে ভীষণ এসিডিটির ব্যাপার রয়েছে! তোমার কি মনে হয়

আর্চির মুখে কঠিন বিরক্তি। সে এসব শুনতে চাইছে না। এ-মুখ নিয়ে বের হয়ে যাওয়া, এবং যদি দেখা যায়, জ্যাক দেখে ফেললে ভীষণ মজা পাবে। ছোটবাবু দেখলে, মুখ ব্যাজার করে ফেলবে। সে আরও বেশি এবার থেকে ছোটবাবুকে ভয় দেখাতে পারবে। ছোটবাবু ওর মুখের এই অমানুষসুলভ অবয়বে ঘাবড়ে যাবে!

আর্চির চোখ এভাবে লাল হয়ে যাচ্ছে ভীষণ। সে কাপ্তানের কাছে যেতে পারত। নিচে পাঁচ- নম্বর ওর হয়ে ডিউটি করছে। পাঁচ-নম্বর ওর এখন বিশ্বাসী লোক। ছোটবাবুকে সে পছন্দ করে না। কে কে এখন এই ছোটবাবুটিকে জাহাজে পছন্দ করে না তার একটা হিসাব হাতের আঙুলে গুনে দেখল, মাত্র তিনজন। সে নিজে, পাঁচ-নম্বর আর এনজিন-রুম-কশপ। ডেবিড এবং অন্যান্য সবাই তার পক্ষে। সে ডেবিডকে কিছু বুঝতে না দিয়ে দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে এল। স্লিপিং গাউন ওর হাঁটু পর্যন্ত ঝুলছে। দু-পাশের বেল্ট খুলে আছে। মাতালের মতো সে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। সে এখন শুধু কেবিনে দরজা বন্ধ করে পড়ে থাকবে। মুখ দেখাতে—বিশেষ করে বন্দর এলে সে আর সুন্দরী মেয়েদের কাছে যেতে পারবে না, এমন একটা অমানুষের মতো মুখ জেব্রা অথবা ওরাং- ওটাং সে হয়ে গেল তাদের কাছে। অথবা হীন ব্যক্তি, মুখে উল্কি পরা থাকলে হীন শয়তান মনে করে ফেলবে সবাই। এবং কতদিন পর তার মনে হল—সে তার স্ত্রীর কাছে একমাত্র ফিরে গেলে সে তাকে ফিরিয়ে দেবে না। জাহাজে তার স্ত্রীর কথা আজ সে প্রথম মনে করতে পারল। স্ত্রী লরা একটা স্টেশনারী দোকানের মালিক। জাহাজ আসার খবরে লরা সেজেগুজে জেটিতে দাঁড়িয়ে থাকে। লরা দেখতে পায় জাহাজ থেকে আর্চি নামছে। আর্চি লরার সঙ্গে কথা বলে না। লরা কেবল দেখতে পায় তার সামনে আর একটি মেয়ে হাত নাড়ছে। লরা বুঝতে পারে এবার আর্চি এ মেয়েটির সঙ্গে যতদিন দেশে থাকবে রাত কাটাবে। সে যেসব ফুল নিয়ে এসেছিল সব নিয়ে ফিরে যেত। চার- পাঁচ বছর ধরে এমন চলছে। আর্চি জানে সফর শেষে হোমে ফিরে গেলে এবারেও সে জেটিতে ওর জন্য অপেক্ষা করবে। হয়তো সে তার ইয়ার বন্ধুদের, বান্ধবীদের কারো খোঁজ পাবে না এবার। লরাকে কেবল দেখতে পাবে একা দাঁড়িয়ে আছে।

লরার কথা ভেবে এতটা দুর্বল হয়ে পড়া ঠিক না। সে মনে মনে লরাকে ভুলে যাবার চেষ্টা করছে। লরা নিজের মতো থাকুক সে চায়। লরা এত ঢ্যাঙা আর এত পাতলা যে তার একেবারে ভাল লাগে না। ওর কিছু নেই। শুধু হাত-পা এবং আর যা আছে তাতে ওর মন একেবারে ভরে না।

তবু বার বার লরার কথা স্মৃতিতে এলে সে নিজে আর স্থির থাকতে পারছিল না। এতদিন পর আবার কেন। বিয়ে-টিয়ের ব্যাপারে তার বিশ্বাস-টিশ্বাস একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। বিশেষ করে তাদের মতো জাহাজি জীবন যাদের—বিয়ে করা একেবারে উচিত না। লরাকে সেজন্য আইন মোতাবেক পরিত্যাগ করেনি। আছে যখন থাক। ওর জীবন-যাপনে যখন লরা প্রতিবন্ধক নয় তখন লরা বৌ হিসেবে থেকে গেলে একদিকে মন্দ না। জাহাজি মানুষের বৌ অসুখে-বিসুখে টনিকের মতো। একজন অন্তত তখন পাশে রয়েছে ভাবতে ভাল লাগে।

এ সব কথা মনে হওয়া ঠিক না—সে এবার জোরে ডাকল, বয়। বয় ভেতরে ঢুকে বিস্মিত হল। চা কফি কি দেবে ঠিক করতে পারল না। আর্চি শুধু বলল, ছোটবাবুকে আসতে বল। বয় বুঝতে পারল না, মুখটা জেব্রার মতো দেখতে হয়ে গেছে কেন?

ছোটবাবু তখন এনজিন-রুমে কাজ করছে। অনেকগুলো লোহার রড তাকে কাটতে দিয়েছে। কিছু লোহার পাত। বাইশ টেবিলে সে রড বেঁধে কাটছে। হ্যাকসো বার বার টেনে টেনে দু-হাতের পেশী ফুলে গেছে। পেশী এত শক্ত যে প্রায় লোহার মতো। সে প্রায় দু-লাফে ওপরে উঠে এসেছে এবং বাইরে দাঁড়িয়ে বলেছে, মে আই কাম ইন স্যার। কাম-ইন। গম্ভীর গলা। ছোটবাবু ভিতরে ঢুকলে আর্চি দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। আর্চিকে সে সকালের দিকে এমন পোশাকে দেখেনি। বোধ হয় মুখের যন্ত্রণায় এখনও আর্চি কষ্ট পাচ্ছে।

ছোটবাবু কিছু বলতে পারল না। সে পরেছে সাদা প্যান্ট, সাদা সার্ট, পায়ে কেডস, মোজা সবুজ রঙের। সে পিছনে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় সৈনিকের মতো আজ্ঞাবহনকারী মানুষ মাত্র। আয়নায় ওর অবয়ব এত স্পষ্ট যে, সে এত সতর্কতার ভেতরও একবার নিজের মুখ, নীল রঙের দাড়ি, এবং কোথায় যেন এক পবিত্রতা মুখে, নিজেই যখন এসব টের পেয়ে যায় তখন নিজেকে নিজে দেখলে আজকাল ভীষণ সাহসী হয়ে যায়। কোন কিছুতেই ভয় পাবে না সে বিশ্বাস করতে ভালবাসে।

আর তখনই বাঘের মতো হালুম করে যেন আর্চি ডেকে উঠল। ফিরে দাঁড়াতেই ছোটবাবু আর্চির মুখে কদর্য সব উল্কি দেখল। যেন এ-সব উল্কি পরে আর্চি তাকে ভয় দেখাবে বলে এতক্ষণ এভাবে দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিল।—ম্যান কোথায় কাজ করছ?

ছোটবাবু মুখ দেখবে না কথার জবাব দেবে। সে কোনরকমে বলল, এনজিন-রুমে

—নো। ইউ ম্যান, হোপলেস। তুমি ম্যান খুব ফাঁকিবাজ আছ। পুরো বাংলায় বলতে চেষ্টা করল আর্চি। তারপর যা বলল, তা আরও মারাত্মক। এক্ষুনি ছোটবাবুকে ডেকে কাজ করতে যেতে হবে। চার-নম্বর উইনচের পিস্টন রড খুলতে হবে। খুলে, এনজিন-রুমে নিয়ে যেতে হবে। ফাইলে মাজাঘসা আছে।

ছোটবাবু বলল, স্যার ডেকে এখন যাওয়া ঠিক না। স্যার আপনার মুখে এসব কি? খুব সহজভাবে বলে ফেলেই বুঝতে পারল মহামান্য সেকেণ্ড এনজিনিয়ার আর্চিকে সে অবান্তর প্রশ্ন করতে পারে না। কিন্তু স্বভাব যাবে কোথায় ছোটবাবুর। আর্চি দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে তেমনি দাঁড়িয়ে আছে। কথার জবাব দিচ্ছে না। যত এমন হচ্ছে, ভেতরটা ছোটবাবুর গুড়গুড় করছে। মরতে কেন যে এসব বলতে গেল। অথবা আর্চি এভাবে রাতে সেজে শুয়ে থাকতে হয়তো ভালবাসে। আর্চির ভেতর একটা শয়তান আছে এই প্রথম সে যেন টের পেল। সে আর থাকতে না পেরে বলল, যাচ্ছি স্যার।

আর তখনই কঠিন এক অবজ্ঞার হাসি, ইয়েস ইউ গো।

ছোটবাবু জানত, এই মলমূত্রের ভেতর পড়ে গেলে সে জ্বলেপুড়ে যাবে। তবু সে যাবে। সে হাঁটতে থাকল। স্বভাবেই তার এটা আছে। তার এখন থেকে ভীষণ সতর্ক থাকা দরকার। অশরীরী আত্মার মতো অতিকায় হিংস্র আর্চি যে কোনো সময় তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। কিন্তু কেন যে এ সব হয়, সে তা বুঝতে পারে না, সে তো আর্চিকে মান্য করে থাকে। তবু শয়তানের মতো মুখ মানুষটার, ওর এ-সব ভেবে কষ্ট হতে লাগল। মানুষের মুখ শয়তানের মতো হয়ে গেলে ভারি দুঃখের।

জাহাজ এভাবে চলছে। নিরন্তর চলছে এমনই মনে হয়। চলতে থাকলে মনে হয় না জাহাজটা আর কখনও বন্দর পাবে। জাহাজের ভেতর মানুষগুলো নিরন্তর কাজ করে চলেছে, বিরাম বিশ্রাম বলতে সামান্য, কেবল তাদের ভাবনা জাহাজটাকে ঠিক ঠিক বন্দরে পৌঁছে দেওয়া। দিতে পারলেই কাজ শেষ। তখন যা খুশি করো, যেখানে খুশি যাও, দিনে হাজির থাকলেই হয়ে যায়। কাজে কর্মে তেমন তাড়া থাকে না।

সিউল-ব্যাংক জাহাজ একটু অন্যরকমের। এর কাজ লেগেই রয়েছে। কত সব উটকো কাজ। এবং সন্তর্পণে সবাই এখন জল মারছে। দুটো হোস পাইপে একসঙ্গে জল মারা হচ্ছে। জল মেরে দিলে সরে যাচ্ছে—চুনগোলা জলের মতো পাখিদের মলমূত্র। এবং জাহাজের সর্বত্র টক টক দুর্গন্ধ। আর জাহাজে যারা রয়েছে তারা পোর্ট-হোল খুলতে পারছে না। এলি-ওয়ের দরজাগুলো সব বন্ধ করে রেখেছে। কোনো কারণে দরজা খুললেই গন্ধে যখন টেকা যাচ্ছে না তখন ছোটবাবু ডেবিডের কাছ থেকে তার গামবুট দুটো চেয়ে নিল। গামবুটের ব্যবহার ডেক জাহাজিদের নিরন্তর —ঝড়-বৃষ্টিতে, তুষারপাতের সময় বরফ জমে গেলে ডেকে জাহাজিরা পায়ে গামবুট পরে চলাফেরা করে। আর ডেক, ফল্কা, মাস্তুলের নোংরা জল মেরে তুলে ফেলার সময় গামবুট পরে না নিলে, প্যান্ট জলে ভিজে যায়। এনজিন-রুম জাহাজিদের এসব দরকার হয় না। ছোটবাবুর গামবুট ছিল না সেজন্য। সে ডেবিডের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছে।

সে বালতিতে হাতুড়ি, চিজেল নিয়েছে নানা সাইজের। একটা ছোট টবে কেরোসিন তেল। এবং এই বালতি টব তাকে দেখলেই দেখা যাবে। কাজে ছোটবাবু আছে বালতিটা নেই টবটা নেই ভাবা যায় না। ছোটবাবু এলিওয়ে ধরে দরজা খুলে ফেললে, দেখতে পেল ডেকটার সাদা রং। ডেবিডের কাছে মনে হয়েছে তুষারপাত হয়েছে। ছোটবাবুর তুষারপাত সম্পর্কে কোন অভিজ্ঞতা হয়নি। সে দরজা খুলতেই নাকে এসে ঝাঁঝ লেগেছে। এবং বমি আসছিল। সব যেন ভেতর থেকে উঠে আসছে। সে সন্তর্পণে হেঁটে যাচ্ছিল। হাতে চামড়ার মোটা দস্তানা। মাথায় ছেঁড়া টুপি, কেবল মুখে কিছু নেই। সে গন্ধ থেকে বাঁচার জন্য ইউকেলিপটাস তেল নাকে তুলোয় গুঁজে নিতে পারত। কিন্তু দেরি হয়ে যাবে। রুমাল চার-পাঁচ ভাঁজ করে মুখে বেঁধে নিয়েছে। এবং এখন ওর দুটো চোখ কেবল দেখা যাচ্ছে। নাকে কেরোসিন তেল সামান্য লাগিয়ে রেখেছে। গন্ধটা সে আর তেমন টের পাচ্ছিল না।

তখন মান্নান বোট-ডেকে হোস পাইপে জল মারছে। ডেক-টিন্ডাল আর একটা হোস পাইপে জল মারছে। সূর্য বেশ ওপরে উঠে যাচ্ছে। মান্নানই প্রথম দেখতে পেয়েছিল ডেক ধরে কেউ হেঁটে যাচ্ছে। সে বুঝতে পারল না কে এমন মলমূত্র মাড়িয়ে যাচ্ছে। সাহস আছে মানুষটার। ডেকে যখন কেউ বের হচ্ছে না ভয়ে, জ্বালা যন্ত্রণার ভয়ে তাছাড়া সে তো শুনছে, কালো কালো দাগ হয়েছে হাতে পায়ে, তখন এমন কার দুঃসাহস! সে তখনই ভাবল হেই করে ডাকবে। কিন্তু অফিসারদের ভেতর যদি কেউ হয়। এই ভেবে সে যখন সামান্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল, তখনই মনে হল আরে এ তো ছোটবাবু। ওর হাতে বালতি টব দেখেই সে চিনে ফেলেছে। আর তখুনি সে চেঁচিয়ে উঠল ওপর থেকে—হারে এডা যে ছোটবাবু।

ছোটবাবু পিছন ফিরে তাকাল। চার্ট-রুমের পাশে জ্যাকের কেবিন। তার ছাদে দাঁড়িয়ে মান্নান হা হা করছে—কোনে যাচ্ছ!

—পিস্টন খুলতে। চার নম্বর উইনচে যাচ্ছি।

—মরণের ওষুধ কানে বানতে চাও চঁইয়া।

ছোটবাবু হাসল। মান্নানের স্বভাব এভাবে কথা বলা। চঁইয়া কথার সঠিক মানে সে জানে না। তবু এটা কিছুটা কাঁচা খিস্তি জাতীয়। এবং মান্নানের এভাবে কথা বলার স্বভাব। সে বলল, দ্যাখেন টিন্ডাল, ছোটবাবুর কান্ড দ্যাখেন। মরণের ওষুধ কানে বানদনের লাইগা যাইতাছে।

সবাই এটা দেখে ঘাবড়ে গেল। ছোটবাবু সন্তর্পণে হেঁটে যাচ্ছে। পিছলে পড়ে যেতে পারে। তার চেয়েও ভয়াবহ পড়ে গেলে হাতে পায়ে কিছু হবে না, মুখে লেগে গেলে ভীষণ কষ্ট পাবে ছোটবাবু। ওরা বুঝতে পারছে এটা সেই আর্চির কাজ। ছোটবাবুকে আর্চি একদম সহ্য করতে পারছে না। ওরা ওখানে আর দাঁড়াল না। হোস পাইপ খুলে ফেলল। এবং নেমে যেখানে ছোটবাবু কাজ করবে দুটো হোস-পাইপে জল মেরে একেবারে সাফসোফ করে ফেলছে। ছোটবাবু দেখল, নিশ্চিন্তে নির্ভয়ে সে এখন কাজ করে যেতে পারবে। তবু চারপাশের মলমূত্রের ভেতর কাজ করা অসহ্য রকমের কষ্ট। সকাল থেকে দুর্গন্ধে কেউ কিছু খেতে পারছে না। সকালে খবর এসেছে, জ্যাক কেবিনেই বমি করেছে।

বিকেলের দিকে জাহাজ একদম পরিষ্কার। কেবল দুটো মাস্টের ওপরে ওরা উঠতে পারে নি। মাস্তুলের রঙ চেনা যায় না। সাদা হয়ে গেছে। ওগুলো চিপিং না করলে উঠবে না। এবং কড়া রোদ সারাদিন, সুতরাং বিকেলের দিকে গন্ধটা একদম থাকল না। কেবিনে কেবিনে ইউকলিপটাস তেল স্প্রে করা হয়েছে। জাহাজের সর্বত্র। কেবল আশংকা আবার বিকেলে তেমনি, অর্থাৎ সূর্য অস্ত যাবার আগে ওরা যদি উড়তে থাকে। কারণ ওরা সমুদ্রের কোথাও যদি পালিয়ে থাকে, অথবা দিগন্তের নিচে অথবা সামনে যে-সব দ্বীপ রয়েছে, দ্রুত উড়ে গিয়ে জাহাজটাকে আবার আক্রমণের জন্য যদি ওৎ পেতে থাকে।

ব্রীজে একজন, চার্ট-রুমের রেলিঙে একজন। জ্যাকের কেবিনের ছাদে কাপ্তান নিজে দাঁড়িয়ে আছেন। আর ব্রীজের উইংসে চিফ-মেট। ওরা চারজন চারদিকে দূরবীন চোখে দাঁড়িয়ে আছে। যদি কিছু আবার দেখা যায়। ওরা যদি আবার কোথাও থেকে উড়তে আরম্ভ করে। সামান্য এক টুকরো মেঘ ভেসে উঠলে আতঙ্কে সবার চোখ কেমন সাদা হয়ে যাচ্ছে। যখন চারজন মিলে রায় দিতে পারছে, না ওটা একখন্ড মেঘ তখন সবাই নিশ্চিন্ত হতে পারছে।

কেবল লেডী-এ্যালবাট্রস জাহাজের পেছন ছাড়ছে না। এটা কাপ্তানের ভাল লাগছিল না। এবং যেন যতদিন এই পাখিটা জাহাজকে অনুসরণ করবে ততদিন একটা না একটা দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকবে। কাপ্তানের এমন বয়েস যে, তিনি পাখিটা সম্পর্কে বেশি কিছু ভাবতে পারছেন না। এই যে এমন একটা ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মতো রাত কাটল সমুদ্রে এটা যে এই পাখিটার জন্য হয় নি কে বলতে পারে! এ্যালবাট্রস পাখি সমুদ্রে মেরে ফেলা ভারি অমঙ্গলের ব্যাপার। যদিও আজকাল এ-সব মানা হয় না। জাহাজ যত বেশি নিপুণ হয়ে যাচ্ছে চলা-ফেরায় তত সংস্কার জাহাজিদের মন থেকে মুছে যাচ্ছে। কিন্তু এরা ভাবে না কেন সিউল-ব্যাংক জাহাজ আজকালকার দশটা জাহাজের মতো নয়। সে তার পুরনো সংস্কার নিয়ে বেঁচে আছে। পাখিটাকে তাড়িয়ে দেবার ব্যাপারেও হাতে কিছু এমন উপায় নেই। মাস্তুলে বসতে না দিলেও ওর আসবে যাবে না, কারণ সমুদ্রে সে খুশিমত বিশ্রাম নিতে পারে। লেডি-এ্যালবাট্রস হিগিনসকে সত্যি খুব দুর্ভাবনায় ফেলে দিল।

সূর্যাস্ত পর্যন্ত ওরা এভাবে দাঁড়িয়েছিল। চারজন পুরো জাহাজি ইউনিফরমে, প্রায় যেন একটা যুদ্ধ জাহাজ চালিয়ে নিচ্ছে। যে কোন সময় আক্রমণ হতে পারে, বিশেষ করে এই সূর্যাস্তের সময়। এ- সব দেখলে মনেই হবে না জাহাজ সিউল-ব্যাংক যাচ্ছে তাহিতিতে। ওখানে জল, বাংকার, রসদ নেবে জাহাজটা। জাহাজের ড্রাফট আটাশ ফুট, গ্রস-ড্রাফট বত্রিশ। জল, বাংকার নিলে জাহাজটা পুরো লোডেড। এবং মাল বলতে জাহাজে আছে সালফার। সেই মাটি। সালফার, ফসফেট, সবই মাটির সামিল। অথবা আয়রণ-ওর। এ-বাদে জাহাজে বেশি কিছু কার্গো দিতে এজেন্ট-অফিস ভরসা পায় না। একমাত্র ভারতবর্ষের বন্দরে গেলে কিছু ভাল মাল, যেমন জুট, চা এ-সবের পেটি তুলে নিতে পারে। ভারতবর্ষের বন্দরে সস্তা মালবাহী জাহাজের ভীষণ কদর। দু-দিকেই টাকা পয়সার লেনদেন চলে। কলকাতা বন্দরের মতো জাহাজটাও দুবলা বলে, বন্দরের সঙ্গে জাহাজটার বেশ ভালবাসাবাসি আছে। কলকাতা বন্দরে একবার ঢুকলে জাহাজ আর বের হতে চায় না। যত দিন যায় তত কর্তৃপক্ষ কাপ্তানের ওপর অধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়ে

হিগিনস লেডি-এ্যালবাট্রসকে দূরবীনে দেখতে দেখতে কেবল এমন সব ভেবে চলেছেন। জ্যাক সারাদিন কিছু খেতে পারে নি। রাতে হয়তো পারবে। জাহাজ-ডেক খুবই পরিচ্ছন্ন। রাতে জ্যোৎস্না ওঠার কথা আছে। জ্যোৎস্না উঠলে, তিনি জ্যাককে নিয়ে বোট-ডেকে কিছুক্ষণ আজ চুপচাপ বসে থাকবেন।

কাপ্তান-বয় আটটায় নালিশ জানাল, ছোটসাব খাচ্ছে না।

খাচ্ছে না অনেকে। গন্ধটা সবার নাকে লেগে রয়েছে। আর্চির খাবার কেবিনে গেছে। সে সারাদিন কেবিন থেকে বের হয় নি। ওর মুখে কালো কালো সব দাগ হয়েছে। এমন বিচিত্র ব্যাপার পৃথিবীতে সত্যি তবে ঘটে, ওর মুখটা দেখতে জেব্রার মতো হয়ে গেছে। জ্যাক তো শুনে হেসে গড়িয়ে পড়ছিল। কাপ্তান জ্যাককে এ-সব বলে কিছুটা যেন ভুলিয়ে-ভালিয়ে খাওয়াচ্ছিলেন। জ্যাক ভাবল, কি করে আর্চির মুখটা দেখা যায়।

এবং আর্চি বিকেলে ছোটবাবুকে ডেকে পাঠিয়েছিল। ছোটবাবু সুবোধ বালকের মতো দাঁড়িয়ে কথা বলেছে। কোথাও কিছু ঘটেছে ছোটবাবুকে দেখে মনেই হয় না। পিস্টন খুলে মেরামত করে ঠিক ঠিক লাগিয়েছে পাঁচ-নম্বর এসে খবর দিয়ে গেছিল আর্চিকে। সুতরাং আর্চি আর কিছু করতে পারে না। ছোটবাবু চলে গেলে আয়নার সামনে বসে কেবল মুখ দেখা ওর কাজ। এবং বন্দর পেতে আরও চার-পাঁচ দিন। এর ভেতর সে বের হতে পারবে না। ডাক্তার দেখালে ঠিক একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

এভাবে ঠিক খবর রটে গেল, একমাত্র আর্চির মুখ জেব্রার মতো। সে এখন কেবিন থেকে বের হচ্ছে না। অফিসারদের সবাই আর্চির ঘরে গিয়ে দেখে এসেছে। কাপ্তানের সঙ্গে জ্যাকও গিয়েছিল। জ্যাক তারপর বের হয়ে হা হা করে হাসতে হাসতে ছুটেছে। জ্যাক কেবিন থেকে বের হয়েই হাসতে পারে নি, সে দু-হাতে মুখ চেপে রেখেছিল, তারপর ছোটবাবুর কেবিনে ঢুকে কেবল হাসছে। কেবল হাসছে। ছোটবাবু ওকে এভাবে হাসতে দেখে ভয় পেয়ে গেল। কাপ্তানের ছেলেটার কি যে হয় মাঝে মাঝে। অকারণ কি হাসছে দ্যাখো! সে বলল, এই যে কি হয়েছে! এত হাসছ কেন?

—সে। কেমন অবাক চোখে দেখল ছোটবাবুকে।

—এত হাসছ কেন?

আবার হাসি! হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাবার জো। অথচ জ্যাক হাসছেই।

ছোট বলল, ইস তুমি না জ্যাক একেবারে ছেলেমানুষ।

জ্যাক বলল, হুঁ! আবার অবাক চোখে ছোটবাবুর মুখ দেখতে থাকল। বড় বড় চোখ ছোটবাবুর। কপাল কি সুন্দর। ঠোঁট দুটো ভারী, চিবুক ছোট, আপেলের মতো। নাক লম্বা, মনোরম চোয়াল।

ছোটবাবু বলল, এত হাসছিলে কেন?

—জেব্রা, জেব্রা।

ছোটবাবু বুঝতে পারল জ্যাক কি বলতে চায়। সে বলল, দেখলে?

—দেখলাম।

—ভাবতে কেমন লাগে সত্যি।

—কি?

—এই যে কোথা থেকে পাখিরা এল, কোথায় উড়ে চলে গেল। কেন এল, কেন এভাবে সারারাত উড়ে গেল, ডেক ফল্কা নোংরা করে গেল, তাজ্জব লাগে ভাবতে। আর আরও তাজ্জব, ওদের মলমূত্রে মানুষের কি হয়ে যায়। এমন পাখি পৃথিবীতে আছে আমি শুনি নি জ্যাক।

—জ্যাক বলল, তুমি দেখেছ?

–কী!

—বারে, জেব্রা।

ছোটবাবু চাইছে এ-ধরনের রসিকতা জ্যাক না করুক। আর্চি আর যাই হোক ওর বস। জ্যাক ওকে ছোট করলে সেও কিছুটা ছোট হয়ে যাবে। আর তাছাড়া বোধ হয় ছোটবাবুর এমনই স্বভাব, মানুষকে খাটো ভাবতে তার খারাপ লাগে। জ্যাক খুব ছেলেমানুষ। আর্চির কষ্টের কথা না ভেবে, তার মুখের কথা ভাবছে। এটা ঠিক না। তা ছাড়া জ্যাক ওর কেবিনে আছে আর্চি দেখলে ক্ষেপে যাবে। সে জ্যাককে বলতে পারছে না, আস্তে। বলতে পারছে না, জ্যাক তুমি এখন যাও।

জ্যাক বলল, কি তুমি জেব্রা দেখেছ?

—দেখেছি।

–কেমন শয়তান শয়তান লাগছে মুখটা।

ছোটবাবুর মনে হল, সেও আর্চিকে আজ সকালে দেখতে দেখতে শয়তান ভেবেছে। মানুষকে শয়তান ভাবা ঠিক না। আসলে ওর তখন মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। মাথা ঠান্ডা ছিল না। অথচ নাবিকের সবচেয়ে বড় পবিত্র কাজ মাথা ঠান্ডা রেখে জাহাজে কাজ করা। সে বলল, এমন বলতে নেই।

জ্যাক বলল, কেন?

–না বলতে নেই।

জ্যাক দেখল, ছোটবাবু ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেছে। ছোটবাবুর এমন মুখ সে কখনও দেখে নি। যেন এ-মুখটা দেখলে সমীহ করতে ইচ্ছে হয়। সহজেই আর বলা যায় না, না বলব। বললে তুমি কি করতে পার।

জ্যাক বলল, ওপরে যাবে?

ছোটবাবু বলল, না।

—আর্চি দেখবে না। সে বের হচ্ছে না কেবিন থেকে।

—ভাল লাগছে না। আমি ঘুমোব।

এবার জ্যাক কেমন ভেতরে ভেতরে ক্ষেপে গেল। বলল, বাবা তোমাকে ডেকেছেন।

—আবার আমাকে!

জ্যাক উঠে দাঁড়িয়েছিল। বের হবার মুখে বলল, আমার কেবিনে।

ছোটবাবু যখন সেজেগুজে উঠে গেল, তখন নটা বাজে। সে জ্যাকের কেবিনে ঢোকার মুখে দেখতে পেল, জ্যাক ওকে ডাকছে। বোট-ডেকে জ্যাক বসে রয়েছে। পাশে ডেক-চেয়ারে কেউ আছে। এবং অস্পষ্ট আলোতে সে ঠিক বুঝতে পারল না কে তিনি। কাছে গেলে বুঝতে পারল স্যালি হিগিনস জ্যাকের সঙ্গে গল্প করছেন।

জ্যাক, ছোটবাবুকে দেখেই বলল, এই যে ছোটবাবু।

স্যালি হিগিনস কাছে গেলে বললেন, বোস।

ছোটবাবু জ্যাকের পাশে বসে পড়ল।

স্যালি হিগিনস বললেন, কেমন লাগছে কাজকর্ম?

—ভাল লাগছে স্যার।

—কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো?

—অসুবিধা হচ্ছে না।

—এভাবে সমুদ্রে ঘুরে বেড়ানোর একটা অনন্দ আছে।

—তা আছে স্যার।

—আমরা তাহিতি যাচ্ছি। বড় সুন্দর দ্বীপ। আচ্ছা জ্যাক বলতো তাহিতির রাজধানী কোথায়?

এই হয়েছে মুশকিল। জ্যাকের মুখ ব্যাজার হয়ে গেল। কবে কখন কি বলেছেন, এখন ঠিক তা ঝালিয়ে নিচ্ছেন, জ্যাক বলল, তুমি বলবে না। বলছি। ইস কি যে হয় না বাবা, সব কেমন ভুলে যাই।

—ছোটবাবু বলতে পার?

ছোটবাবুর এ-ব্যাপারে কোনো সঙ্কোচ নেই। এত খবর তার রাখার কথা না। না রাখলেও কিছু আসে যায় না। সে সোজাসুজি না বলল।

—মনে রাখবে। সব দেশের একটা ইতিহাস আছে। সব না জানলেও কিছুটা যে কোন নাবিকের পক্ষে জেনে রাখা ভাল। দেশে ফিরে গেলে, তোমাকে কত লোক কতভাবে জিজ্ঞাসা করবে, বলতে না পারলে ভারী অসম্মানের। তিনি বললেন, পিপিতি। পিপিতিতে জাহাজ যাচ্ছে। তারপর কেমন তিনি প্রাচীন গাঁথার মতো বলে যেতে ভালবাসেন—এই সব পলিনেশীয় দ্বীপপুঞ্জ আবিষ্কার করেন একজন এশিয়াবাসী। এবং যেমন ফোনেশিয়ান এবং গ্রীকরা খৃষ্টজন্মের ছ’শ বছর আগে পূর্ব আটলান্টিক আর ভূমধ্যসাগরের সব খবরাখবর সংগ্রহ করেছিল, ফোনেশিয়ানরা পূর্ব-আফ্রিকার উপকূল আবিষ্কার করেছিল, তেমনি একজন এশিয়াবাসী সামান্য কাঠের জাহাজে ভেসে চলে এসেছিলেন তাহিতিতে।

তারপর তিনি বললেন, বলতো জ্যাক আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল কত সালে কে আবিষ্কার করেন?

জ্যাকের এটা মনে ছিল। সে বলল, খৃষ্টের জন্মের প্রায় চারশ বছর আগে হানো আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল আবিষ্কার করেন।

এভাবে কাপ্তেন আবার বলে যান ন’শ চুরাশী খৃষ্টাব্দে এরিক দি রেড আবিষ্কার করেছিলেন, গ্রীনল্যান্ড। চোদ্দশো ছিয়াশীতে ডিয়াজ, কেপ অফ গুড হোপ। চোদ্দশো সাতান্নব্বুইতে ভাস্কো-ডা-গামা ভারতবর্ষে যান। পনেরশো বিশে মেগালান সমস্ত পৃথিবী পরিভ্রমণে বের হন। টাসমান প্রথম অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কার করেন। কাপ্তান কুকের প্রথম সমুদ্রযাত্রা সতেরোশ আটষট্টি থেকে একাত্তর। এভাবে তিনি আমুন্ডসেন পর্যন্ত বলে থামলেন।

ছোটবাবুর শুনতে বেশ ভাল লাগছিল। জ্যাকের পড়াশোনা বোধ হয় জাহাজে এভাবে হয়ে থাকে।

তারপর তিনি বললেন, পিপিতি ভারি সুন্দর ছোট্ট ছিমছাম শহর। আজকাল আর টিয়ারী হোটেলের চার পাশের ঘিঞ্জি বাড়ি-ঘর দেখতে পাবে না।

মনেই হবে না, এখানে এখনও দেড়শ-দুশো বছর আগে আদিবাসীদের সঙ্গে ফরাসীদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম হয়েছিল। ভ্রমণকারীরা শহরে ঢুকেই প্রথম চলে যায় গোগাঁর আর্ট গ্যালারী দেখতে। সুন্দর বন্দর রয়েছে। এবং বালিয়াড়ি, ছোট ছোট নৌকা দেখতে পাবে। শহরটাতে প্রায় ত্রিশ হাজার লোক বসবাস করে থাকে। প্রতিদিন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসছে ভ্রমণকারীরা। নেমেই ওরা তাহিতিদের প্রিয় খাবার পিসান ক্রু খেতে ভারি ভালোবাসে। এদের প্রিয় ফিস্টের নাম ট্যামারা। গরম পাথরের ওপর লোবস্টার, চিকেন, মেরিল্ড ফিস উল্টে-পাল্টে নানারকম মসলাপাতি দিয়ে ভাজা হয়। খেজুর গাছের ছায়ায় সমুদ্র দেখতে দেখতে যখন কেউ খায় তখন জীবন বড় সুন্দর মনে হয়।

তিনি বললেন, পাহাড়ের ওপর তাহাড়া হোটেল। কতরকমের গাছপালার ফাঁকে ওপরে উঠে যেতে হয়। অধিকাংশ গাছ বলতে খেজুর তাল। ছোট ছোট এক রকমের ঝোপ রয়েছে, বন্য ফুলে ভরা। আর পাহাড়ের মাথা থেকে দেখতে পাবে অনেক দূরে একটা দ্বীপ, দ্বীপের নাম মুরিয়া। প্রায় বারো মাইল দূরে এই দ্বীপ। আসলে দ্বীপটাতে রয়েছে নানা বর্ণের পাহাড়। আর নীল রঙের লতাপাতা। পাহাড়ের চূড়ো একটা দুটো নয়, অনেক। প্রায় মনে হয় অসংখ্য ছোট ছোট পিরামিড—কোন প্রাচীন ফারাও নিজের জন্য এমন একটা নির্জন দ্বীপ যেন গড়ে রেখেছেন। পিপিতি থেকে মোটরবোটে গেলে নাইনটি মিনিটস লাগবে। ছোট ছোট বোট ভাড়া পাওয়া যায়। ইচ্ছে করলেই ঘুরে আসা যেতে পারে। তাহিতির উত্তর-পশ্চিমে প্রায় এক’শ চল্লিশ মাইল দূরে রয়েছে বোরা দ্বীপ। দু’হাজার লোকের বাস সেখানে। দ্বীপটা তার লেগুনের জন্য বিখ্যাত। সরু লম্বা লেগুন একেবারে দ্বীপের ভেতর ঢুকে গেছে। গ্লাস আঁটা মোটরবোটে অসংখ্য ভ্রমণকারী লেগুনে ঘুরে বেড়ায়। রাত কাটায়। জ্যোৎস্না রাতে জলের ধারে ছোট ছোট হোটেলে তারা থাকে। মাছ ধরে। সমুদ্র থেকে ঠান্ডা বাতাস চলে আসে। মাছ ধরার সময় ওদের খুব নিবিষ্ট লাগে দেখতে। গলদা চিংড়ি, হেরিং আর ম্যাকরোল মাছের জন্য জায়গাটা খুব বিখ্যাত

তারপর তিনি ছোটবাবুর দিকে তাকালেন—কেমন মনে হয় ছোটবাবু, কেবল দু’পাশে উঁচু পাহাড়, নিচে নীল জল, ছোট ছোট উপত্যকা পাহাড়ের কিনারায়। সেখানে ছোট ছোট কাঁচের ঘর, বাতিদান, লাল-নীল চেয়ার, এবং পানীয় বলতে প্রিয় মদ হিনা, মানুই। বেশ গরম পাথরের বাটিতে চিংড়ি মাছ ভাজা আস্ত।

ছোটবাবুর ভাজা চিংড়ি মাছ আস্ত শুনে প্রায় জিভে জল এসে গেল। বাবা হাট থেকে বড় গলদা চিংড়ি আনলে চিংড়ি মাছের মুড়ো ভাজা, নরম আতপ চালের গোলাতে ভিজিয়ে এবং মাথার ভেতরের অংশটা কি লাল, মুড়ো ভেঙ্গে ভাত মেখে নিলে ভাতটা একেবারে লাল হয়ে যেত। কতদিন সে ভাত এবং চিংড়ি মাছের মুড়ো ভাজা না খেয়ে আছে। যেন দেশে ফিরে গেলে সে প্রথমেই হাট থেকে বড় গলদা চিংড়ি কিনে আনবে।

আর তখনই কাপ্তান হিগিনস পাইপ ঝেড়ে ফেলে দিচ্ছেন। দামী টোবাকো বোধ হয় খান। বেশ গন্ধ টোবাকোর। টাকা-পয়সা জমলে সেও একটা লম্বা পাইপ কিনবে, লম্বা গোঁফ রাখবে, এবং পাইপে টোবাকো টানবে। জ্যাক কিছুই বলছে না। সে এ-সব শুনছে কিনা তাও বোঝা যাচ্ছে না। জাহাজটা চলছে—আকাশের নক্ষত্র সব পেছনে পড়ে থাকছে, কখনও কখনও মনে হয়—না কেউ পেছনে পড়ে থাকছে না। জাহাজটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তারাও সবাই তাহিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। নক্ষত্র, সমুদ্র, আকাশ, এ্যালবাট্রস পাখি, জাহাজ, জাহাজের নাবিকেরা সবাই যেন তাহিতির এমন সব সুন্দর দৃশ্যাবলীর কথা শুনে স্থির থাকতে পারছে না। একসঙ্গে সবাই তাহিতি দর্শনে যাচ্ছে।

ছোটবাবু বলল, আমরা তো মাত্র একদিন থাকব স্যার?

—একদিন থাকবে, আর এক রাত। সেদিন সবার ছুটি থাকবে। তোমরা যতটা পার দেখে নিও।

ছোটবাবুর ভীষণ আশ্চর্য লাগছে—আগে হিগিনসকে মনে হত অন্য গ্রহের মানুষ। তিনি গঙ্গাবাজু ধরে আসছেন শুনলে সে হাঁটত যমুনাবাজু ধরে। যেন সামান্যতম বেয়াদপি দেখলেই তিনি সমুদ্রে তাঁকে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন। জাহাজে কিসে কি বেয়াদপির সামিল সে জানত না। এখন এই জাহাজে চলতে চলতে তিনি কি যে আপন হয়ে যান কখনও কখনও। ঠিক পিতা, পিতামহের মতো মনে হয়। পৃথিবীতে সব পিতা-পিতামহেরা বোধ হয় এভাবে বেঁচে থাকে। সে বলল, আপনি কিনারায় নামবেন না? বলেই ভাবল, এটা কি বলা ঠিক হল। এটা অবান্তর কথা। একজন কাপ্তানের কিনারায় নামা না নামা সম্পর্কে সে কোনই প্রশ্ন করতে পারে না। সে প্রায় মরমে মরেই যেত।

তখন হিগিনস খুবই অবাক হয়ে বললেন, নামব না! তাহিতি আমার খুব প্রিয় জায়গা। এইটুকু বলে তিনি অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। মনে হচ্ছে সবই সেদিনের কথা। এলিস তাহিতিতে নেমে ছেলেমানুষের মতো হৈ-চৈ বাঁধিয়ে দিয়েছিল। সমুদ্রের ধারে ধারে পিচের রাস্তা কত রকমের রং-বেরংয়ের গাড়ি, এবং আশ্চর্য বাজনা—গাড়ি চালাতে চালাতে সেই অদৃশ্য মিউজিক চারপাশে বেজে উঠেছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *