1 of 2

অলৌকিক জলযান – ২৩

।। তেইশ।।

সেই এক দৃশ্য—চারদিকে যতদূর চোখ যায় শুধু জল, নীল জলরাশি। ঠাণ্ডা বাতাস ক্রমে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। সমুদ্রে ছোট ছোট ঢেউ। বৃত্তের মতো ঘুরে ঘুরে ডুবে যাচ্ছে তারা। বেশি উঁচুতে উঠতে না পারলে, নিজের সামান্য বৃত্তে নিজেরা হারিয়ে যায়। আর কিছু থাকে না, আদিগন্ত শুধু সমুদ্রের এই জল নিয়ে খেলা।

সিউল-ব্যাঙ্ক আপন গতিতে তেমনি চলছে। মনেই হবে না, জাহাজে কোন দুর্ঘটনা ঘটেছে। মনে হবে না সেকেণ্ড মেট ডেবিড এখন বোট ডেকে হামাগুড়ি দিচ্ছে—হাতে বন্দুক, হামাগুড়ি দিয়ে ঠিক বোটের আড়ালে মরা সাপের মতো পড়ে রয়েছে। এ্যালবাট্রস পাখি দুটো এদিকে এলেই গুলি করে নামাবে।

তার পাশে আরও দুজন—জ্যাক আর ছোটবাবু। ছোটবাবুর সাতটায় কাজে নেমে যেতে হবে। কিন্তু সেই পাখি দুটোর জন্য ভেতরে ভীষণ একটা দুঃখ। মুখ ভার। পুরুষ চড় ইটা ভয়ে ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। ওদের পায়ে পায়ে ঘুরছে। এবং জ্যাকের প্রায় কান্না পাচ্ছিল। ওরা এখনও কিছু করতে পারছে না। সেই থেকে ওরা নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে, গুলিতে ফেলে দিতে। ডেকের ওপর মাংস ফেলে রেখেছে, যদি লোভে উড়ে আসে। কিন্তু সেই যে চড়ুইটাকে তুলে নিয়ে গেল আর এল না। অনেক দূরে পাখি দুটো উড়ে উড়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে জলে আর্শিতে রোদ পড়ার মতো চোখ ভীষণ ঝলসে দিচ্ছে। পাখি দুটোকে তখন আর দেখাই যাচ্ছে না। চোখ ঝাপসা হয়ে উঠছে।

এভাবে ডেবিডের রাগ বেড়ে যাচ্ছে—যেন ক্রমে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এভাবে বেড়ে যায়। পাখি দুটোর চাতুর্যের কাছে সে হেরে যাচ্ছে। ওর ভেতরে ক্রমে প্রতিশোধস্পৃহা এভাবে বেড়ে গেলে সে স্থির থাকতে পারছে না। পাখি দুটো সামান্য কাছে এলেই পর পর গুলি ছুঁড়ে যাচ্ছে। এসব ছেলেমানুষী—কাপ্তান ভেবে পান না, ডেবিড অথবা জ্যাক, জ্যাকের তবু মানে আছে, জ্যাক ছোটবাবু পাখি দুটোর জন্য অনেক করেছিল, আর বয়স কম বলে সবকিছুর জন্য তাদের মায়া, মিসেস স্প্যারোর জন্য জ্যাক ফুঁপিয়ে কেঁদেছে পর্যন্ত। ছোটবাবু আবার বুঝি বিষণ্ণ হয়ে গেল—ছোটবাবুকে দেখলেই বোঝা যায় মুখ থমথম করছে ছোটবাবুর।

তারপরই কাপ্তান মনে করতে পারলেন আসলে ডেবিডকে ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছিল ম্যান অ্যালবাট্রসটা। ডেবিড সুযোগ বুঝে বন্দুক নিয়ে বোট-ডেকে ঠিক বোটের নিচে, কিছুটা আত্মরক্ষার মতো, কারণ ছোঁ মারলেই যেন মাংস খুবলে না নিতে পারে—বলা তো যায় না, ডেবিডের হাতের বন্দুক ওদের ভয় পাইয়ে দিয়েছে, যে কোন মুহূর্তে সাঁ-সাঁ করে নেমে এসে পিঠের মাংস তুলে নিতে পারে। বোটের নিচে আছে তারা। বোটের নিচে শুয়ে নির্ভয়ে বন্দুক চালাতে পারবে ডেবিড।

ডেবিড সামান্য সুযোগটুকুও দিচ্ছে না। দেখলে মনে হবে, বোটের নিচে ওরা তিনজন পাশাপাশি শুয়ে। মুখ সমুদ্রের দিকে, পা পেছনের দিকে। কোথায় পাখি! পাখি দুটো দূর-সমুদ্রে ডুবে ডুবে স্নান করছে। ব্রিজে দাঁড়িয়ে পাখি এবং মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখছে চিফ-অফিসার, কাপ্তান, রেডিও-অফিসার। জ্যাক মাঝে মাঝে বের হয়ে দেখছে কোথায় গেল। যেন মরণপণ লড়াই—এবং কাপ্তান, চিফ-অফিসার বেশ মজা পাচ্ছিলেন। জ্যাক মাঝে মাঝে মাংকি আয়ল্যাণ্ডে উঠে গেছে—কতদূরে আছে ওরা—আবার জ্যাক চিৎকার করে উঠল, আসছে ডেবিড, রেডি। আসছে। বাবা, ঐ দ্যাখো কেমন বেগে ধেয়ে আসছে। কি লম্বা ডানা, কি বিরাট আকারের পাখি দুটো ঠিক জাহাজের ওপরে এসে গেল। কোথায় ডেবিড আর তার বন্দুক, যেন ডেবিডকে নিয়ে মজা করছে, কিছুতেই বন্দুকের পাল্লায় পাখি দুটোকে পাওয়া গেল না। অথচ এমনভাবে নেমে আসছিল, যেন একেবারে কাছে এসে সাঁ করে ওপরে নাচতে নাচতে উঠে গেল। পাখা কাঁপল তির-তির করে। উড়তে উড়তে ঘাড় কাত করে দেখল নিচের সিউল-ব্যাংক জাহাজটাকে আর তার মানুষগুলোকে। এবং ঠিক ছোঁ মেরে ডেকের ওপর থেকে মাংসের টুকরো নিয়ে গেল। চোখের নিমেষে ঘটে গেল। বন্দুকের নল ঘোরাবার সময় থাকল না, এত দ্রুত আর এমন ত্বরিতে ওরা উড়ে গেল। বোকার মতো বসে থাকল ডেবিড।

ছোটবাবু চুপচাপ নেমে গেল এনজিন-রুমে। সে একবার ভেবেছিল বাকসোটার কাছে গিয়ে বসবে। ডিমগুলো নষ্ট হয়ে যাবে, এবং পুরুষ-চড়াইটাকে সে নিচে এনজিন-রুমে তাড়িয়ে নিয়ে এল। তারপর ওর মনে হল, কশপের কাছ থেকে স্প্যানার তেলজুট হাতুড়ি সব নিয়ে ওপরে উঠে গেলেও সারাদিন সে কাজ করতে পারবে না। সব সময় চোখ লেডি-এ্যালবাট্রস, তার উড়ে যাওয়া, তার গতিবিধি লক্ষ্য রাখাই কাজ হয়ে পড়বে। অথচ দিন যত যাচ্ছে, কাজ বাড়ছে। রেলিং ভেঙে পড়ছে, সিঁড়ি খসে পড়ছে। কার্পেন্টার এবং সে মিলে সে-সবও মেরামত করছে। কেবল জাহাজে ভেঙে পড়ার খবর। এবং মেন-জেনারেটার ক’দিন থেকে গণ্ডগোল করছে। সকালে তেমনি খবর গেছে, যেমন প্রতিদিন রেডিও-অফিসার খবর পাঠায় এরিয়া-স্টেশনকে—সিপ এস এস সিউল-ব্যাংক, বাউণ্ড ফর নিউ প্লাইমাউথ। হল্ট একদিনের জন্য তাহিতিতে। পনের হাজার টনের জাহাজ সিউল-ব্যাংক। ভাঙ্গা পুরোনো, স্পেয়ার পার্টসের একটা লিস্ট বেতার সংকেতে পাঠানো হচ্ছে। খাবার, জল, সব এভাবে যখন বেতার-সংকেতে দিকে দিকে ইথারে ভেসে চলেছে তখন এ্যালবাট্রস পাখি দুটোও ভেসে আসছে কেবল জাহাজের পেছনে। উড়ে উড়ে আসছে।

যে যখন সময় পেয়েছে বোট-ডেকে পাহারায় থেকেছে—কখন কাছাকাছি দেখা যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যা হলে সবাই দেখল, সমুদ্রে অন্ধকার নেমে আসছে। কিছু দেখা যাচ্ছে না।

গভীর অন্ধকারে সমুদ্রটা একেবারে টুপ করে ডুবে গেল। চারপাশে কিছু দেখা যাচ্ছে না। কেবল আকাশের নক্ষত্রমালা বাদে তাদের দেখবার কিছু থাকে না। সারাটা দিন একটা ভয়ঙ্কর উত্তেজনার ভেতর গেছে! পাখিদের স্বভাব সম্পর্কে কথাবার্তা, কে কোথায় কবে কত বড় এ্যালবাট্রস দেখেছে তার গল্প। এত বড় এ্যালবাট্রস তারা এই প্রথম দেখেছে এটা প্রায় একবাক্যে স্বীকার করছে সবাই। যারা প্রাচীন নাবিক, যাদের সফর বিশ-বাইশ-চব্বিশ, তারাও এত বড় এ্যালবাট্রস কোনো সমুদ্রে কখনও দেখেছে বলতে পারল না।

কাঠের বাকসোটা হাঁ করে পড়ে আছে। কাল হয়তো সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হবে। ডেক-জাহাজিরা জল মারার সময়, বাকসোটা রাখা অকারণ ভেবে ফেলে দিতে পারে। সন্ধ্যার সময় ডেবিড, ছোটবাবু পুরুষ পাখিটাকে খুঁজছে, পায়নি। ওটা যে কোথায় গেল! কখন ওটাকেও হয়তো ধরে নিয়ে গেছে। কেউ টের পায়নি। এসব ভাবলেই ছোটবাবুর কিছু ভাল লাগে না। দেশে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। কবে জাহাজ দেশে ফিরবে কেউ বলতে পারে না।

এবং এখন জাহাজের ফোকসালে অথবা কেবিনে সেই এক খবর। জাহাজটা স্ক্র্যাপ করার অর্ডার না আসা পর্যন্ত এভাবে উত্তেজনা প্রবল জাহাজে। যদিও সবাই জানে, এত পুরানো জাহাজ সমুদ্রে চলে না। এবং দু-দুবার স্ক্র্যাপ করার অর্ডার হয়েছিল। স্ক্র্যাপ করা হলে সিউল-ব্যাঙ্ক বলে একটা জাহাজ আছে, সমুদ্রে বিচরণ করছে, কখনও ছোটবাবু অথবা নতুন জাহাজিরা জানতেই পারত না।

অথচ কি আশ্চর্য সেই পঁয়তাল্লিশে একবার, আটচল্লিশে একবার, সব ঠিকঠাক, জাহাজ আর চলছে না, জাহাজ পুরোনো লোহা লক্কড়ের দামে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। অথচ কি এক অজ্ঞাত কারণে সব ভেস্তে গেল। কি এক অজ্ঞাত অদৃশ্য শক্তি জাহাজটাকে আবার সমুদ্রে ভাসিয়ে আনে। বন্দরে বন্দরে যায়, খরচ বাড়ে, কোম্পানীর কর্তাব্যক্তিরা মুখ বুজে খরচের বহর সয়ে যাচ্ছে। তবু সিউল- ব্যাঙ্কের নাম ভাগাড়ে তুলে দিতে পারছে না।

এটা আবার সংস্কারবশেও হতে পারে, যদিও কোম্পানীর প্রথম জাহাজ এটা না, তবু এর আসার সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানীর দিন দিন শ্রীবৃদ্ধি প্রায় লক্ষ্মীর মতো, বড় পয়মন্ত এই সিউল-ব্যাঙ্ক। এবং যখন সারা পৃথিবী চষে কার্ডিফের রাউদ এনজিনিয়ারিং ডকে ফিরে যেত, কোম্পানীর কর্তাব্যক্তিরা ছুটে আসত, সিউল-ব্যাঙ্কের হাল তবিয়ত দেখতে। জাহাজটা ড্রাই-ডক করা হচ্ছে, অতিকায় জাহাজ নয়, মাঝারি জহাজ, তবু যখন হেঁটে যেত কর্তাব্যক্তিরা মনে হত সিউল-ব্যাঙ্ক অতিকায় জাহাজ হয়ে যাচ্ছে। রণক্লান্ত অশ্বের মতো দাঁড়িয়ে আছে। যেন ওরা মাঝে মাঝে দেখে ফেলত, অতিকায় সেই অশ্বের চোখে মুখে ক্লান্তি, চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে, মুখ দিয়ে লালা গড়াচ্ছে। এমন সব আধিভৌতিক দৃশ্য দেখে ফেললে তারা আর জাহাজটা স্ক্র্যাপ করার কথা ভাবতে পারত না। জাহাজটা সম্পর্কে সবার কেমন মায়া গড়ে উড়েছিল। তারপরে ড্রাই-ডকে, ফের যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠার মতো, সব বড় বড় অক্সিজেন সিলেণ্ডার নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যুদ্ধের সাজে তৈরি করা হচ্ছে যেন যত খরচ লাগুক, অর্থাৎ এ যা খরচ হচ্ছে, তাতে আর একটা নতুন জাহাজ কেনা যেতে পারে, তবু খরচের বহরে কোম্পানী ভয় পায় না। কিন্তু হলে কি হবে কোম্পানী তো সব না, মেরিন বোর্ডের সার্ভেয়ার এসে শেষপর্যন্ত রায় দিলে, অচল জাহাজ সুতরাং আর এ চলবে না। তারপরই সেই এক দুর্ঘটনা, কোথায় বজ্রাঘাতে মৃত্যু, কেউ রাস্তায় যেতে যেতে দু-বার কি দেখে আঁৎকে উঠলে, কথা বলতে পারল না, ঘরে ফিরে যেতে পারল না, মৃত্যু। এবং এভাবে যখন সিউল-ব্যাঙ্ক জাহাজকে কেন্দ্ৰ করে নানাভাবে সংস্কার গড়ে উঠেছিল, তখন উনিশশো পঁয়তাল্লিশ সাল শেষ হচ্ছে। কোম্পানীর নতুন চেয়ারম্যান নিযুক্ত হলেন স্যার ম্যাথিউ দি সেকেণ্ড। পূর্বতন চেয়ারম্যান স্যার ম্যাথিউ ফেলের রহস্যজনক মৃত্যুর পরই তিনি যোগদান করলেন। তাঁর পুরো নাম রিচার্ড ফেল। বয়সে নবীন! লম্বা, ওয়েলসের লোক। স্বাভাবিকভাবে উজ্জ্বল স্বভাবের মানুষ। বাবার মৃত্যুর সঙ্গে সিউল-ব্যাঙ্ক জাহাজের স্ক্র্যাপ করার আদেশ পত্রের সঙ্গে কোনও সংযোগ রয়েছে বিশ্বাস করতে পারলেন না। তিনি এসেই এস এস সিউল-ব্যাঙ্কের নিজস্ব লাভ-লোকসানের একটা হিসাব চেয়ে বসলেন।

আশ্চর্য হিসেবটা ঘুরেফিরে হাতে আসতে তার দু’বছরের ওপর লেগে গেছিল। সংক্রামক ব্যাধির মতো ভয়। কোন অমঙ্গলের প্রতীক ভেবে সবাই সিউল-ব্যাঙ্কের কাজকর্মে এলেই কেমন ঢিলেঢালা ভাব দেখাত। মুখে কিছু বলতে সাহস পেত না। নতুন চেয়ারম্যান কেন এসব চাইছেন—বোর্ডের মেম্বারদের বছরে কত কড়ি গুনতে হচ্ছে জাহাজটার জন্য এবং জেটিতে ফেলে রাখার দরুন বন্দর কর্তৃপক্ষকে কত দিতে হয়েছে, অথবা জাহাজ চলতে চলতে ক’জন কাপ্তান কতবার অসুস্থ হয়ে ফিরে এসেছেন, কতবার কম্পাস রিডিং-এ ভুল হওয়ার দরুন কত হাজার হাজার মাইল জাহাজটা কাপ্তানকে নিশি-পাওয়া মানুষের মতো সমুদ্রে ঘুরিয়ে মেরেছে তার হিসাব এবং হিগনস্ই ছিলেন একমাত্র কাপ্তান যাঁর কাছে সিউল-ব্যাঙ্ক একেবারে শান্তশিষ্ট মেয়েটির মতো—হিগিনিস্ জাহাজ থেকে নেমে দু’মাস ও অবসর নিতে পারতেন না, আবার ডাক পড়ত। আর একজন ছিলেন ফোর্ড। বছর তিন আগে তিনি সমুদ্রেই মারা গেলেন।

স্যার ম্যাথিউ দি সেকেণ্ড যেহেতু কোম্পানীর অধিকাংশ শেয়ারের অংশীদার, স্ক্র্যাপ করার আগে একবার জাহাজটাকে দেখে যাবেন ভেবেছিলেন। দুদিন বাদে এ্যানুয়েল জেনারেল মিটিং। সব প্রস্তাব টাইপ হয়ে পড়ে আছে। তার ভেতর সিউল-ব্যাঙ্কের স্ক্র্যাপ করার প্রস্তাব। তিনি চেম্বারে বসে সইসাবুদ করতে করতে হঠাৎ কি ভাবলেন, জাহাজটা কতদিনের জাহাজ, তাঁর বাবার আমলের জাহাজ, বাবা জাহাজটার কিছু কিছু ইতিহাস বলে গেছিলেন, বিশেষ করে সেই লুকেনার ব্যক্তিটি, তাঁর মৃত্যু, আত্মহত্যা, এক জার্মান কাউণ্ট পরিবারের মানুষ ছিলেন লুকেনার, এসব কথা বলতে বলতে হঠাৎ বলে ফেলেছিলেন, আমার মনে হয় রিচার্ড, লুকেনারের মৃত্যুর এতদিন পরেও তাঁর প্রভাব রয়ে গেছে। রিচার্ড হয়তো হেসেই ফেলত। কিন্তু তাঁর বাবাকে তিনি জানেন। খুব গম্ভীর গলায় বলেছিলেন, হবে হয়তো।

সুতরাং এসব ঘটনা যতটা ডেবিড জানে অথবা চিফ-অফিসার, আর কেউ তেমন জানে না। কাপ্তান বিশ্বস্ত মানুষ হিসেবে চিফ-মেটকে কথাপ্রসঙ্গে বলতেন। চিফ-মেটও কথাপ্রসঙ্গে বলত ডেবিডকে। ডেবিড কাউকে বলত না। কিন্তু জাহাজটাতে এ-দুটো এ্যালবাট্রস আসার পরই কেবিনে জটলা হচ্ছিল। একটু যে পানীয় না খাওয়া হচ্ছে তাও নয়। ডেবিডের কেবিনে ছোটবাবু বসে রয়েছে। ডেবিডের কেবিনে ওর ফ্যামিলির একটা গ্রুপ ফটো আছে। এবং সবার নাম ছোটবাবু জানে। বড় ছেলেটি ডেবিডের প্রায় ছোটবাবুর বয়সীই হবে। কতক্ষণ আর চুপচাপ থাকা যায়। মিঃ স্প্যারো, মিসেস স্প্যারো না থাকায় জাহাজটা আবার একঘেয়ে লাগছে। ওদের দিন, আর কাটছে না যেন। জাহাজ কবে যাবে, কবে কখন হোমে সবাই ফিরবে এই নিয়ে কথাবার্তার সময় ডেবিড উঠে দাঁড়াল। এটা ডেবিডের স্বভাব, একটু উত্তেজিত হয়ে পড়লেই—সে দাঁড়িয়ে যায়। এবং পায়চারি করতে থাকে। তারপর যা হয়ে থাকে—গল্প বলার মতো বলা, আমরা আর ফিরব কিনা জানি না ছোটবাবু। আসলে জাহাজটা স্ক্র্যাপ না হলে বোধহয় ফিরতে পারছি না।

—তার মানে?

–সে অনেক কথা। কাপ্তান খুব সেয়ানা।

—কবে হবে স্ক্র্যাপ?

—কেউ বলতে পারে না।

—আমাদের কি হবে?

—এভাবে চলবে জাহাজ। আমরা সমুদ্রে ভেসে বেড়াব।

—ইয়ার্কি। জাহাজিরা সবাই বিদ্রোহ করবে না?

—তুমি জাহাজি নও। তোমার তো আর ওদের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। ওরা বিদ্রোহ করলে, ওদের নামিয়ে দেবে। কিন্তু তোমার কি হবে?

—ওদের নামিয়ে দিলে জাহাজ চলবে না। আমরাও ফিরে যাব।

—কলকাতা থেকে কোম্পানী উড়োজাহাজে ক্রু পাঠিয়ে দেবে।

—এত খরচা করবে!

—তাছাড়া কি। জাহাজটাকে এখন ওরা চাইছে যতদিন ইচ্ছে দক্ষিণ সমুদ্রে ঘুরে বেড়াক —বন্দর ধরবে না?

–এই ধরবে। বড় বড় বন্দরে আর পাঠাবে না।

—তার মানে?

—মনে হচ্ছে বড় বন্দরের নিয়মকানুন অনেক! হয়তো দেখা যাবে, ভাঙা জাহাজ দেখে ওরা আঁৎকে উঠছে। কার পারমিশানে জাহাজটা চলছে। বলেই একটু থামল। পাইপের ধোঁয়া দেখল, মাথা চুলকাল। লকার খুলে দুটো ছবি বের করে দেখল। দুটোই বড় হাঙ্গরের ছবি। ছবি দেখলেই বোঝা যায় ডেবিডের ফটোগ্রাফিতে হাত ভাল। ডেবিড ছবি দুটো একটু কাত করে দেখল, বলল, এই হচ্ছে আমাদের কর্তৃপক্ষ বুঝলে। হাঙ্গরের মুখ থেকে পালানো খুব কঠিন।

এমন একটা পরিবেশ কথাবার্তায় গড়ে তুলছে ডেবিড, যে ছোটবাবু কেমন হতাশ হয়ে গেছে। ভাঙা জাহাজ, জাহাজ চালানোর খরচ এত বেশি যে বছর বছর লাখ লাখ টাকা ক্ষতি স্বীকার করেও কেন যে জাহাজটাকে এভাবে দক্ষিণ সমুদ্রে ঠেলে দেওয়া, ভাঙ্গো তো, ভেঙ্গে ফেল, নতুন জাহাজ কেন, আমরা দ্বিগুণ উৎসাহে কাজ করে যাব। এত মেরামত জাহাজে থাকলে অবসর কখন, এখন তো কোনও কোনও দিন সন্ধ্যে সাতটা পর্যন্ত একনাগাড়ে কাজ।

অথবা এই যে দক্ষিণ সমুদ্রে জাহাজটা ভাসিয়ে দেওয়া হল, এবং কবে ফিরবে, কাপ্তান হিগিন্‌স নিশ্চয় জানেন, কবে ফিরে যেতে পারছেন, একবার জ্যাককে বলতে হবে, আমরা দেশে কবে পৰ্যন্ত ফিরতে পারব জ্যাক, অথবা এও হতে পারে, কেউ জানে না কবে ফিরবে। সবটাই এখন এই সিউল- ব্যাঙ্কের মর্জির ওপর।

তখনই বালকেডে হেলান দিয়ে ডেবিড অনেকক্ষণ ছোটবাবুকে দেখল। ছোটবাবু পাশের ব্যাঙ্কে সামান্য কাৎ হয়ে শুয়ে আছে। যত শুনছে তত সে বিমর্ষ হয়ে যাচ্ছে।

ডেবিড এবার কাছে এসে প্রায় হাঁটু গেড়ে বসল ছোটবাবুর পাশে। বলল, খুব ফিসফিস গলায়- আসলে বুঝলে কতৃপক্ষ জাহাজটাকে ভয় পায়। ভীষণ ভয় পায়। কিছুতেই বে-অফ-বিসকে পার হতে দেবে না। জাহাজটাকে ইংলিশ চ্যানেলে ঢুকতে দেবে না। যেন জাহাজ ইংলিশ চ্যানেলে ঢুকছে শুনলেই ওদের জ্বর আসতে থাকে।

ছোটবাবুর ভয়ে বোধহয় জ্বর আসছিল। আবার মনে হচ্ছিল, আসলে, জাহাজের সফর যত দীর্ঘ হবে, তত এভাবে জাহাজ সম্পর্কে নিন্দাবাদ চলবে। এটা বোধহয় তারই সূত্রপাত। সে, এসব জানে মৈত্রদার কাছ থেকে। জাহাজ তখন প্রতিদিন অসহ্য ঠেকবে। ডেবিডের প্রায় ন’মাস হতে চলেছে। সে এবং আরও দু-একজন অফিসার এ-জহাজে বেশি সফর দিয়েছে। সুতরাং এভাবে এখন থেকেই হয়তো ডেবিড ঘোঁট পাকাতে শুরু করেছে। সবার মনে একটা বদ্ধমূল ধারণা সৃষ্টি করে দেওয়া, জাহাজ নিরুদ্দেশে ভেসে চলেছে। কাপ্তানও ঠিক জানেন না, কোথায় যাবে। সালফার বোঝাই হয়ে আপাতত নিউ-প্লাইমাউথ যাচ্ছে, কিন্তু তারপর। তারপর বললে, তিনি বলবেন, তারপর জাহাজ ফিজিতে। অস্ট্রেলিয়ায় নয় কেন? মেলবোর্ণ, সিডনিতে নয় কেন, নয় এজন্য, এসব বড় বন্দর এমন লক্কড়-মার্কা জাহাজ ঢুকতে দেখলেই ধেয়ে মারতে আসবে বন্দর-কর্তৃপক্ষ

—যদি ফিজি না যায়, তবে নিউগিনি, অথবা কিংস আয়ল্যাণ্ড, টোংগা। দরকার হয় ফের উঠে যাবে হাওয়াই। হনলুলুতে কিছুদিন। সামোয়াতে ফেলে রাখা চলে কিছুদিন। কিছু একটা কার্গো পেলেই হল। মাটি, মাটিই সই। এই যে সমুদ্র দেখছ, এ-সমুদ্রেই আমাদের এখন ঘুরে মরতে হবে। একটু থেমে ডেবিড বলল, এর পর কাজ কি হবে জান?

—কি?

—মাটি টানবে জাহাজ। আমি তোমাকে বলে দিলাম, মাটি টানা বাদে এ-জাহাজে আর কেউ কোন কার্গো দিতে সাহস পাবে না।

ছোটবাবুর বেশ মজা লাগছিল এমন সব কথা শুনতে। সে এ-জন্যেই এত সহজে এমন একটা দামী কাজ পেয়ে গেছে। জাহাজে এজন্য কেউ আসতে চায় না। একটু ভয় পেলেই বাড়িয়ে ভয়কে সাত কাহন করে ফেলে। তারপর খোঁড়াতে খোঁড়াতে নেমে যায়। দরকার হলে ছোটবাবুও খোঁড়াতে থাকবে। যখন মনোটনিতে আত্মহত্যার প্রবণতা জাগবে, তখনই বুঝতে হবে, যত সত্বর সম্ভব, কিছু একটা অজুহাত দেখিয়ে নেমে যাওয়া ভাল।

ডেবিড ফিসফিস গলায় বলল, কাপ্তান হিগিনস্ আখের গোছাচ্ছে, বুঝলে!

ছোটবাবু অতসব বুঝতে পারে না। সে চুপচাপ শুনে যায়। চুপচাপ বসে থাকে! সে তো সবই কেমন নতুন শুনছে। এখন মনে হয় জাহাজে এটাই শেষ সফর তাঁর।—বুঝলে ছোটবাবু যত বেশি এখন তিনি থাকতে পারেন, তাই চেষ্টা করছেন। কোম্পানীর এমন একটা ভাঙ্গা জাহাজকে নিয়ে দক্ষিণ সমুদ্রে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আসলে ওর বলার ইচ্ছে ছিল, মতিচ্ছন্ন জাহাজ। পাগলা জাহাজ, না ঠিক পাগলা নয়, দুরন্ত দামাল, কিংবা সেই বেশি বয়সে শিশু সরল হয়ে যাবার মতো, লজেনচুস দিয়ে ভুলিয়ে রাখার মতো। হিগিনস এখন মাটি-ফাটি যা পাবেন ভরে নিয়ে সিউল-ব্যাঙ্ককে কার্গো দেবেন। লজেনচুস খাওয়াবেন। কর্তৃপক্ষ ভীষণ খুশি, গেলেই ঠিক বোর্ডের সদস্য করে নেবে। এডভাইস দাও, সুখে থাকো, গাড়ি চড়ো। হিগিনস এমনি এমনি করছে ভেবো না।

ছোটবাবু বলল, ডেবিড, আমার কিন্তু অন্যরকম মনে হয়।

ডেবিড কিছুই শুনতে চায় না। সেই সকাল থেকেই সে উত্তেজিত হয়ে আছে। সারাদিন কতভাবে চেষ্টা করেছে একটা পাখিকে অন্তত নামিয়ে আনা যায় কিনা, পারেনি। সে তারপর কি করেছে কে জানে। একটু রাত হলেই ছোটবাবুকে ডেকে এনেছে। সামান্য মদ দিয়েছে খেতে। সে নিজেও খাচ্ছে। চুক-চুক শব্দ হচ্ছে। এখন বেশ ছোটবাবু মজা পায়। ডাকলে সে না করতে পারে না। কিন্তু সে দু-চারদিন খেয়ে নিজের হিম্মত কতটুকু ধরে ফেলেছে। ডেবিড আর তাঁকে মাতাল বানিয়ে জব্দ করতে পারে না।

ছোটবাবু বলল, তুমি কিচ্ছু না শুনতে চাইলে আমি কি করব?

—কি শুনব? কি বলবে তুমি?

—এই বলছিলাম, কাপ্তান জাহাজটাকে ভালবাসে।

—হেল। কি যে বল না। জাহাজকে আবার ভালবাসাবাসি কি। আগলি। ননসেন্স। সব পরার্থ ভেবে করা নয় হে। সব স্বার্থে করা। আখের। আখের। বলেই আবার নুয়ে বলল, প্লিজ তুমি কিন্তু জ্যাককে কিছু বলবে না। বলে মদের গ্লাসটা ছুঁয়ে বলল, না। বলবে না, প্রমিস্ কেমন?

ডেবিড খুব গোপনে যেন বলছে, সে দরজার কাছে গিয়ে উঁকি দিল, কি জানি কেউ যদি দেয়ালে কান পেতে রাখে। কে কিভাবে কাপ্তানের কাছে শেষপর্যন্ত লাগাবে আর কাপ্তান চোখ লাল করে ওকে দেখবেন তখন, ভয়ে তো বুক শুকিয়ে যাবে—সেই সব কারণে দরজাটা ভাল করে লক্ করে বলল, তোমাকে বলে দিলাম, জাহাজ মাটি টানার কাজ নেবে। জাহাজ ফিজি, নেরু, ওসেনিক, কাকাতিয়া আয়ল্যাণ্ডে যাচ্ছে। মাটি এনে অস্ট্রেলিয়ার উপকূলে ঢেলে দেবে। এই কাজ হবে আমাদের। সব দ্বীপ, সব আদিবাসী দ্বীপের…বলেই সে গ্লাস নিয়ে কেমন ফ্রিজ হয়ে গেল।—ছোটবাবু, তোমার মুখ এত উজ্জ্বল দেখাচ্ছে কেন!

—দ্বীপ। দ্বীপে নেমে যাব।

—ছোটবাবু বুঝবে না, কষ্ট বুঝবে না। ভাল না। দ্বীপ ভাল না।

ডেবিড বুঝতে পারল, কথা সামান্য জড়াচ্ছে। ওটা ঠিক না। জাহাজ চালু অবস্থায় এটা ঠিক না। ওর বারোটা-চারটা ওয়াচ। এখন ওর খেয়েদেয়ে ঘুমানো দরকার। আসলে মনের কোণে এই যে গ্রুপ- ফটো দেয়ালে রয়েছে, তাদের জন্য সে পাগল হয়ে যাচ্ছে। সমুদ্রে ঘুরে ঘুরে দেশে ফেরার জন্য মন ভীষণ আকুল হয়ে উঠেছে। সে এখন সেই ছোট্ট শিশুর মুখ, হাত নাড়া, সুন্দর হাসি, মনে করতে পারলেই পাগল হয়ে যায়। তখন সে আর দেশে ফিরতে পারবে না ভেবে ভীত হয়ে পড়ে। এবং সে বোধহয় টের পাচ্ছে, জাহাজ কোথায় যাচ্ছে। যেমন অন্যান্যবার করে থাকে, এবারেও তেমনি। ব্রিটিশ ফসফেট কোম্পানী সেই সব দূরবর্তী ভাসমান দ্বীপমালা সব, ইজারা নিয়ে বসে রয়েছে। মাটি তুলে নাও। খোলে ভর্তি করে মাটি চালান করার এমন অল্প পয়সায় আর ক’টা জাহাজ ভাড়া পাওয়া যায়। খবর রটে যায়, আসছে, আসছে—সেই প্রাচীন কালের আদিম রহস্যময় জাহাজটি মাস্তুলে লম্ফ জ্বালিয়ে অন্ধকার রাত্রির বুকে, সমুদ্রের ঢেউ ফালা ফালা করে চলে আসছে। মাটি কাটার কাজ তখন দ্বীপে বেড়ে যায়। উদ্দাম উন্মত্ত নৃত্যমালা। দ্বীপের অধিবাসীদের তখন মশাল জ্বেলে সারা রাত নৃত্যমালা—মেজ-মালোম ডেবিড এখন থেকেই বুঝি দেখতে পাচ্ছে সব। ডেবিড ভয়ে কেমন গুটিয়ে আসছে। সেই দ্বীপগুলোতে ডেবিড অনেকবার গেছে। পাঁচবার সাতবার। সেখানে জাহাজ যাবে ভাবতেই ডেবিড ভীষণ চঞ্চল হয়ে উঠছে।

ছোটবাবু বলল, দ্বীপগুলো খুব বড়!

—আরে না। কোনোটা এক মাইল, দু’মাইল, পাঁচমাইল তার বেশি না।

ডেবিড ফের বলল, কিভাবে যে ওরা থাকে! ভয় পায় না। দ্বীপটা যদি ডুবে যায়। কি যে মজা হয় না! তারপরই কেমন প্রাণ পেয়ে গেল ডেবিড, যখনই রাতের জ্যোৎস্নায় হেঁটে বেড়াবে, মনে হবে সমুদ্র থেকে কারা স্নান করে ফিরছে। সুন্দরী মেয়েরা জ্যোৎস্নায় যখন সমুদ্র থেকে স্নান করে ফিরে যায়, চুলের ডগা বেয়ে টপ্‌প্ জল ঝরতে থাকে, এবং মনে হবে যেন ওরা সমুদ্রে নোনাজলের তলায় এতক্ষণ কি খুঁজে এসেছে, আসলে জানো ওরা পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে মুক্তো খুঁজতে যায়। এবং শরীরে কোন পোশাক থাকে না ছোটবাবু। গাছপালার ভেতর লুকিয়ে দেখতে কি যে ভাল লাগে না!

—দেখে ফেললে?

—দেখব কেন। দালাল থাকে। দেখানোর বদলে পয়সা নেয়। রাজার জন্য ওরা মুক্তো খুঁজে আনে। কেবল অন্যমনস্কভাবে বলে গেল—আরে বুঝলে না, আমাদেরই ইজারা নেওয়া জায়গা। এখানে ছোটবাবু বুঝল, আমাদের বলতে ডেবিড বৃটিশ দ্বীপপুঞ্জের কথা বলতে চেয়েছে।—স্বজাতি আমার ভীষণ বুদ্ধিমান তো। দেশীয় নিয়মকানুন ঘাটায় না। যা আছে থাক, রাজার নিয়ম-কানুন মেনে চলার অভ্যাস ওদের হয়ে গেছে। আমাদের কেন হবে বল? জাহাজ থেকে নেমেই তুমি কোথাও কোনও রেস্তোরাঁতে চলে যাবে। দেখবে কার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দালাল লোক। কিভাবে নিয়ে গেলে, গোপনে দেখা যাবে ওরা ঠিক জানে। খুব পয়সা নেয়। রাজার জন্য মেয়েরা মুক্তা খুঁজতে যায়। কার না লোভ হবে দেখার। তুমি বলো, আমরা তো আর মহাপুরুষ নই।

ছোটবাবু বলল, মহাপুরুষদের একবার ধরে নিয়ে গেলে হয়, দেখালে হয়। কি করে, তখন দেখা যেত। বলে দুজনেই হেসে ফেলল,—রাত অনেক হয়েছে ডেবিড। ভীষর ঘুম পাচ্ছে। আমি যাই। বলে ছোটবাবু দরজা খুলে সোজা বের হয়ে গেল।

আর তখনই মনে হল ডেবিডের, মিসেস স্প্যারোর জন্য ছোটবাবুর মন খারাপ থাকতে পারে। তাকে একটু সান্ত্বনা দেবার জন্য ডেকে এনেছিল। কিন্তু এতক্ষণ কেউ মিসেস স্প্যারোর আকস্মিক মৃত্যু সম্পর্কে কোনও কথা বলে নি। ছোটবাবুর মন খারাপ বলে হয়তো কোনও কথা বলে নি। ছোটবাবুর এমনই স্বভাব। সব দুঃখ নিজের ভেতর লুকিয়ে রাখে। কাউকে বুঝতে দেয় না। সে তাড়াতাড়ি দরজা ঠেলে মুখ বাড়াল। ডাকল, ছোট।

ছোট যেতে যেতে মুখ ফেরাল। এলি-ওয়েতে কার্পেট পাতা বলে কোন শব্দ হয় না হাঁটা চলায়। এনজিনের হাহাকার শব্দটা ভীষণভাবে শুধু সব এলোমেলো করে দেয়। সুতরাং সে প্রথম বুঝতে পারেনি কে ডাকছে। পেছন ফিরে তাকালে দেখল গলা বাড়িয়ে হাতে ইশারা করছে ডেবিড।

সে ফের ফিরে গেলে বলল, এস। ভিতরে বোস। কথা আছে। স্বাভাবিক মানুষের মত কথা বলছে। মদ খেয়ে সামান্য কথা জড়িয়ে যাচ্ছে কিছুতেই বুঝতে দিচ্ছে না।

ছোটাবাবু বসলে, বলল—তুমি দুঃখ করো না।

কিসের দুঃখ সে প্রথমে বুঝতে পারল না।

—ঠিক উচিত শিক্ষা দেব মনে রেখ। আই মাস্ট কিল দেম।

ছোটবাবু হাসল সামান্য

—ওরা ভেবেছে কি! নিজেদের সম্রাটের মতো ভাবছে? যেন সমুদ্রে ওদেরই থাকার কথা। সামান্য দুটো পাখি, কিছুতেই ওদের জন্য বাঁচানো গেল না। ওরা রাজ্য জয় করে ফিরে গেল। মর্মান্তিক।

ছোটবাবু বলল, ওরা আর আমাদের জাহাজে উড়বে না, ভাবতে খারাপ লাগে।

—কি করা বল। যা ঘটে গেল তাতে আমাদের কোনও হাত নেই। আমরা তো কম চেষ্টা করি নি।

ডেবিডের পিঠের ঘা ভাল করে শুকোয় নি। বেশী বললে, জামা খুলে হয়তো ডেবিড ঘা বের করে দেখাবে। ছোটবাবু বলল, সকালে উঠেই দেখতাম পোর্ট-হোলে মিসেস স্প্যারো বসে রয়েছে। শিস দিলেই উড়ে এসে পায়ের কাছে বসত।

ডেবিড বলল, মিসেস স্প্যারো ঠিক বুঝতে পেরেছিল, তুমি ওকে খুব ভালবাস।

—এখন তাই মনে হচ্ছে। খিদে পেলে কি কিচকিচ করত। খাবার খুঁটে খেত না। ছড়িয়ে না দিলে বিবি মুখ গোমড়া করে রাখত।

—হবেই তো। এটা আমরা ঠিক বুঝতে পারি না আসলে পৃথিবীটার সব কিছু তারা। তুমি যেখানে যাবে মনে হবে, ওদের জন্য তুমি যাচ্ছ। মনে হবে—এরা তোমার কতকালের চেনা। জেটিতে পার্কে মেয়েদের দেখলে কখনও মনে হয় না, তুমি ওদের দ্যাখো নি। মনে হয় কতকালের এরা পরিচিত। একটু হেসে কথা বললে জাহাজে আর উঠে যেতে ইচ্ছে হয় না। ঘরবাড়ি বানিয়ে বন্দরেই থেকে যেতে ইচ্ছে হয়। কি হবে এত বড় পৃথিবী দেখে। এমন সুন্দর একটা পৃথিবী কাছে থাকলে সমুদ্র, দ্বীপ, কত সামান্য মনে হয়।

—সত্যি।

—যাই হোক তুমি ভাল করে ঘুমোবে। সন্তানকে যেভাবে উৎসাহ দেয় তেমনি চোখ-মুখ ডেবিডের। সে যেন ছোটবাবুকে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে। সে বলল, জাহাজে ঘুরতে ঘুরতে কত রকমের অভিজ্ঞতা হবে, পৃথিবীর কত বন্দরে মনে হবে তোমার ভালবাসার মেয়েরা সব হেঁটে বেড়াচ্ছে, জাহাজ ছাড়ার সময় দেখবে আশ্চর্য একটা কষ্ট বুক থেকে বেয়ে উঠছে—তুমি টেরই পাও নি দু-দিন কি চার-দিন কি দু-সপ্তাহ যে সেলস গার্লটি তোমাকে হেসে কথা বলেছে, আপেল আঙ্গুর বিক্রি করেছে, মনে মনে তুমি তাকে ভালবেসে ফেলেছ। মেয়েরা যে কি! একটু হেসে কথা বললেই কেমন আপনার হয়ে যায়।

ছোটবাবু বুঝতে পারল, আসলে ডেবিড ঘুরে-ফিরে নিজের দুঃখের কথাই বলে যাচ্ছে। ঘুম আসবে না ডেবিডের। এখন সে হয়তো পোর্ট-হোলে অন্ধকার সমুদ্র দেখবে—আসলে সমুদ্রে অন্ধকার থাকলে সারাক্ষণ তার সেই বাড়ি, গীর্জার চূড়ো, ছোট্ট নদী যদি থাকে অথবা গ্রীষ্মের সময় মনোরম রোদের ভেতর গাড়ি চালিয়ে কোন বড় শহরে চলে যাওয়া, হৈ-চৈ, ছেলে-মেয়েদের দুটো-একটা আবদারের কথা, স্ত্রীর বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকা—সবই মনে পড়বে। মনে পড়লেই তার সারারাত আর ঘুম আসবে না।

ছোটবাবু বলল, যাচ্ছি।

ডেবিড তাকিয়েই আছে পোর্ট-হোলে। কিছু বলছে না।

—দরজাটা বন্ধ করে দাও।

ডেবিড নড়ছে না দেখে সে দরজা টেনে দিল।

তারপর ছোটবাবু ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকল। রাত দশটা বেজে গেছে, সে ওয়াচের ঘণ্টা শুনে বুঝতে পারল। যখন এভাবে সমুদ্রের বুকে কেউ ঘণ্টা বাজায় তখন তার ইন্চকেপ-রকের কথা মনে হয়, মঠের সেই সন্ন্যাসীর কথা মনে হয়। কোনো না কোনো ঘটনার সঙ্গে মানুষের স্মৃতি জড়িয়ে যায়। ছোটবাবুর স্মৃতি ভীষণ সতেজ বলে ঘণ্টা বাজলেই দেখতে পায় এক অতিকায় পাহাড় সমুদ্রের বুকে দাঁড়িয়ে আছে। ঝড়ের রাতে জাহাজ পথ ভুল করে ঠিক পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে ভেঙ্গে যায়। জাহাজ ডুবির এমন অজস্র ঘটনা মনে হলেই কেবল সে দেখতে পায়, সেই…মঠাধ্যক্ষ একটা বড় ঘণ্টা ঝুলিয়ে দিচ্ছেন, ঝড় উঠলেই ঘণ্টা বাজতে থাকে। দূরবর্তী জাহাজের নাবিকেরা তখন সতর্ক হয়ে যায়।

ছোটবাবুর এই এক খারাপ স্বভাব। কিছু মাথায় এলেই সহজে যেতে চায় না। সে ভীষণ অন্যমনস্ক হয়ে যায়। হাঁটতে হাঁটুতে সে টেরই পাচ্ছে না ওপাশের এলি-ওয়ের দরজায় ধ্বস্তাধ্বস্তি হচ্ছে। ওটা মেজ-মিস্ত্রি আর্চির দরজা। কেবিনের পাশে বড়-মিস্ত্রি ছিল, এখন নেই। নির্জন এলি-ওয়েতে মেজ- মিস্ত্রি একাই থাকেন। এবং ছোটবাবুর মনে হল, কেউ ডাকছে, জ্যাকের সেই মেয়েলী গলা। কাতর। কিন্তু কোথায়? সে কেবল শুনতে পাচ্ছে, নো। মি বয়। আর মনে হচ্ছিল, যদিও এনজিনের হাহাকার শব্দে শোনার উপায় নেই, খুব কাছেই কিছু ঘটছে। সে একটু পিছিয়ে ডান দিকের এলি-ওয়েতে তাকাতেই, মনে হল জ্যাক দৌড়ে পালাচ্ছে। আর শিকারী বেড়ালের মতো থাবা উঁচিয়ে আছে মেজ-মিস্ত্রি। যেন তার হাত থেকে পাখি পালিয়েছে। ছোটবাবুকে দেখে হাত ছেড়ে তাড়াতাড়ি যেন দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে।

ছোটবাবু বুঝতে পারল না, জ্যাক এখানে এত রাতে কেন? আর্চিই বা দরজা খুলে খপ করে, ` ধরতে যাবার মতো হাত বাড়িয়েছিল কেন? ধ্বস্তাধ্বস্তি করে জ্যাকই বা ওদিকে ছুটে পালাচ্ছে কেন? সে তার কেবিনে ঢুকে যাবে ভাবল। নিচে এ সময় জ্যাকের নামার কথা না। জ্যাকের কেবিনে সিঁড়ি ধরে সে উপরে উঠে যেতে পারে। কিন্তু এত রাতে সে যেতে পারে না। তাছাড়া সেও ভাল নেই। ছোটবাবুকে দেখে মেজ-মিস্ত্রি আর্চি এমন হিংস্র হয়ে উঠল, যেন খেয়ে ফেলার মতো। এবং শীতল করে দিচ্ছিল তাকে। সে আর তাকাতে পারে নি। মাথা নীচু করে চলে এসেছে।

যত দিন যাচ্ছে, ছোটবাবু রহস্যের ভেতর পড়ে যাচ্ছে। প্রথম মনে হয়েছিল জাহাজে শুধু পেটভরে খাওয়া আর দিনমান কাজ করা। আর কোনো দুঃখ নেই। বন্দর পাবে মাঝে মাঝে, পেলে নেমে যাবে বন্দরে। উৎফুল্ল হবে, বেড়াবে, এবং ফুলের গন্ধ নিতে নিতে কখনও ফুল ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে। কিন্তু এখন সে বুঝতে পারছে—জাহাজ অন্যরকম। কেমন অজ্ঞাত এক মঠাধ্যক্ষ মাঝে মাঝে তার মাথার ভেতর ঘণ্টা বাজিয়ে যাচ্ছে। ঝড়ের রাতে জাহাজ সতর্ক করে দেবার মতো তাকে সতর্ক করে দিচ্ছে কেউ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *