1 of 2

অলৌকিক জলযান – ২০

।। বিশ।।

আর আশ্চর্য, সকালে সবাই দেখল বড়-মিস্ত্রি বাক্স-পেটারা নিয়ে জাহাজ থেকে নেমে যাচ্ছে। বড়- মিস্ত্রির চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। আর্চি এবং ফোর্থ এনজিনিয়ার ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। যেন একটা এম্বুলেন্স ডাকলেই ভাল হত। জাহাজ বাঁধাছাঁদার পর পরই বড়-মিস্ত্রি রিচার্ড নেমে গেল।

সবাই অবাক। জাহাজে বিন্দুমাত্র খবর রটেনি। সত্যি সত্যি বন্দর এলে বড়-মিস্ত্রি নেমে যাবে। যেন গোপন রাখা হয়েছিল ব্যাপারটা। কাপ্তান নেমে যাবার আগে হ্যাণ্ডসেক করেছেন। ডেক-অফিসার, এনজিন-অফিসাররা মিলে ওকে গাড়িতে তুলে দিয়ে এল।

এনজিন-সারেঙ ওর চোখ মুখ দেখে ঘাবড়ে গেছেন। এমন শক্ত সমর্থ মানুষটা কি পাতলা হয়ে গেছে! ভেতরে কি এমন কঠিন অসুখ তিনি বুঝে উঠতে পারলেন না। মাঝে একবার এই কদিন আগে ভূত দেখেছিলেন বড়-মিস্ত্রি। জাহাজে এ জন্য কেউ ভাবে না। পুরানো ভাঙা জাহাজে এ-সব সংস্কার থেকে থাকে। সাহসী মানুষও মধ্যরাতে ঠাণ্ডা ঘরের ভেতর ঢুকতে ভয় পায়। অথবা সেই এলি-ওয়ে ধরে গেলে গা ছমছম করতে থাকে! ভূতের ভয়ে বড়-মিস্ত্রি জাহাজ ছেড়ে চলেছেন বিশ্বাস হয় না! আরও বড় কিছু কারণ। লক্কড়মার্কা জাহাজ, জাহাজে থাকতে ভাল লাগার কথা না। অথবা বাড়িতে কোনও দুর্ঘটনা। তিনি যতটা জানেন বড়-মিস্ত্রির নিজের বলতে ছোট এক ভাই আছে। রাউদ- এনজিনিয়ারিং ডকে কি একটা বড় কাজ করে। এবং স্ত্রী বলতে তিনি জেনেছেন, বন্দরে বন্দরে যারা তাঁর সঙ্গে রাত কাটিয়েছে তারাই।

সুতরাং কোনও খবর না দিয়েই বড়-মিস্ত্রি যেন নেমে গেল। দুটো একটা প্রশ্ন সবাই করেছে, কিন্তু কেউ কোনও উত্তর পায়নি। বোধ হয় গোপন রাখার কথা বলা হয়েছে, আসলে যে বড়-মিস্ত্রি সেই রাত থেকে আর ঘুমোতে পারেনি, বুকের ভেতর রাত বাড়লেই মনে হত, একটা কালো হাত ‘পোর্ট-হোল দিয়ে গলে পড়বে। এবং সেই ভয়ে মানুষটা সারারাত জেগে বসে থাকত। একটা আশ্চর্য ম্যানিয়া হয়ে গেল। কাপ্তান নিজে ওর কেবিনে এক রাতে দেখেছেন, পোর্ট-হোলের দিকে সবসময় চোখ বড়-মিস্ত্রির। হাত ঝুলে পড়ছে ভেবে মানুষটার ভেতরে এক ধরনের ক্রমে অসুস্থতা গড়ে উঠছে। সে জাহাজের সবাইকে অবিশ্বাস করছে। তাকে সবাই চক্রান্ত করে জাহাজে তুলে এনেছে এমন একটা ভাব যেন, এবং কি করে যে ওর কি হয়ে গেল! এ-জাহাজে থাকলে সে ভয়ে মরে যাবে। এমন মনে হলে, কাপ্তান বেতার সংকেতে জানিয়ে দিলেন বড়-মিস্ত্রি ভীষণ অসুস্থ। নিউ-অরলিনসের ঘাটে সে নেমে যাচ্ছে। যদিও ব্যাপারটা একবার ভেবে দেখবার দরকার ছিল, কেন এমন হল, কিন্তু পরে মনে হয়েছে, জাহাজ থেকে নেমে গেলে যদি সে ভাল হয়ে যায়, তবে আর এতগুলো লোককে ঘাঁটিয়ে লাভ নেই।

জাহাজে এরপর দুটো বিশেষ ব্যাপার দেখা গেল। যেমন মৈত্র কেন জানি অমিয়র সঙ্গে কথা বন্ধ করে দিল। তাছাড়া জ্যাককে আর বেশি ডেকে দেখা যেত না। জ্যাক সারাটা দিন প্রায় কেবিনেই থাকত। কাপ্তানের সঙ্গে কখনও বের হয়ে যেত। নিজের কেবিনে দরজা বন্ধ করে বসে থাকত। আবার তিন চারদিন দেখা গেল, জ্যাক সব সময়ই কেবিনে। বেরই হচ্ছে না। কাপ্তান-বয়, গরম জল দিয়ে আসছে মাঝে মাঝে। একটা হট-ওয়াটার ব্যাগ নিয়েও দু-তিন দিন দেখেছে কাপ্তান ওপরে উঠে গেছেন। বোধহয় জ্যাক অসুস্থ। কিন্তু কি অসুখ কেউ বলতে পারল না। এবং জাহাজ সালফার বোঝাই হয়ে যখন ফের মিসিসিপি ধরে নেমে যাচ্ছিল, তখন আরও তাজ্জব খবরে জাহাজের সবাই অবাক হয়ে গেল।

সারেঙ এসে বললেন, তোকে ছোটবাবু, কাপ্তান ডেকেছেন

ছোটবাবুর হাঁটুতে কাঁপুনি লেগে যায়। কাপ্তান এ-ভাবে কেন যে বার বার অযথা ডেকে পাঠান। কি কারণ, সে জানতে চাইলে সারেঙসাব বললেন, তুই যা না। তোকে তিনি খারাপ কিছু বলবেন না। খারাপ বললে মনে রাখবি, আমাকে বলতেন। ভাল জামা কাপড় পরে যাবি। যা অগোছালো তুই।

ছোটবাবু তখন কেমন মানুষটাকে জাহাজে বাপ-পিতামহের মতো না ভেবে পারে না। এবং যা হয়ে থাকে জাহাজে কাপ্তান ডেকে পাঠালেই খুব বড় খবর। আবার ছোটবাবু লকারের আয়নায় নিজের মুখ দেখে নেয়। গরম বলে সে সাদা ট্রাউজার পরেছে, আর নীল রঙের ঢোলা গেঞ্জি। চুল বড় বড় বলে মাথাটা বেশ বড় এবং নীল দাড়ি। সে টের পেল জাহাজে সে সত্যি ভীষণ সুপুরুষ। সে খুব সহজভাবে কাপ্তানের সঙ্গে কথা বলবে। যেমন সারেঙসাবকে নিজের ভালমন্দের অভিভাবক ভাবলেই তার আর ভয় থাকে না। শুধু শ্রদ্ধা, সমীহ থাকে। সে কাপ্তানের সঙ্গে ব্যবহারে শ্রদ্ধা এবং সমীহের ভাবটুকু বজায় রাখবে।

বের হবার মুখে দেখল সবাই ভিড় করে দাঁড়িয়েছে। বন্ধু, অনিমেষ ছুটে এসেছে। মনু, মান্নান সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে আছে। কাপ্তানের ডেকে পাঠানো একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার তাদের কাছে। ওদের মুখ খুব শুকনো দেখাচ্ছে। প্রায় যেন ফাঁসির আসামীর মতো মুখ। ছোটবাবু বের হয়ে ওদের মুখ দেখেই হেসে ফেলল। বলল, কিরে কে মারা গেছে! সে ব্যবহারে বেশ সহজ স্বাভাবিক দেখাতে চাইল।

—বাড়িয়ালা তোকে ডাকল কেন?

—কি করে বলব।

—তুই কিছু করেছিস?

—কি করব! কেবল ডেবিডের সঙ্গে পালিয়ে মদ খেয়েছিলাম। আর তো কোন দোষ করেছি বলে মনে হচ্ছে না।

—যখন তখন কেন যে ডেকে পাঠায়। এবং কথা বলতে বলতে সবাই গ্যালি পর্যন্ত এগিয়ে গেল। আর কেউ নামল না নিচে। সারেঙসাব আগে আগে যাচ্ছেন। পেছনে ছোটবাবু। পর পর দুটো ফল্কা তারপর চিফ-কুকের গ্যালি, পাশে এলি-ওয়ে, ভেতরে ঢুকলেই কার্পেট পাতা। কার্পেটের ওপর দিয়ে ছোটবাবু হেঁটে গেল। এবং দেখতে পেল, পাঁচ নম্বর মিস্ত্রির ঘর খালি। এ-ভাবে অন্য সব কেবিন বাইরে থেকে লক করা। সে হেঁটে গেল। সে দেখল, ডাইনিং-রুমে সবাই বসে রয়েছে। প্রায় সব অফিসারেরা।

এনজিন-অফিসাররা একদিকে, ডেক-অফিসারেরা একদিকে। মাঝখানে কাপ্তান। এনজিনসারেঙ ছোটবাবুকে ডাইনিং-হল পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েই চলে গেলেন। সারেঙ চলে যেতেই সে ভীষণ ঘাবড়ে গেল। তবু কোনরকমে ডাইনিং হলে ঢুকেই বলল, গুড মর্নিং।

সেকেন্ড অফিসার ডেবিড মুচকি হাসছে। সে তাকাল ডেবিডের দিকে। তারপর কাপ্তান, এবং শেষে একে একে সবাইকে দেখল। জ্যাককে আশা করেছিল। জ্যাক নেই। সবাই যে যার পুরু ইউনিফরম পরে বসে আছে। এবং সবাইকে মনে হচ্ছিল, ভীষণ জাঁকজমকের ভেতর রয়েছে তারা। সে এ- সব দেখে আরও ঘাবড়ে গেল। মুখে আবার সেই রক্ত চাপ, মাথাটা ঝিম-ঝিম করছে। সে বুঝতেই পারছে না এ-ভাবে সবার সামনে কাপ্তান তাকে ডেকে কি বলতে চান। অথবা এমন কি সে কিছু করেছে, যা সবার কাছে এখন বলা দরকার।

কাপ্তান ওকে তখন বললেন, প্লিজ সিট দেয়ার মাই বয়। তিনি পাশের একটি চেয়ারে ওকে বসতে বললেন।

ছোটবাবু সত্যি এত ভাবতে পারে না। তার পক্ষে এসব কথা খুব সম্মানের। সে জানে, চারপাশে ক্রুদের ভেতর এখন ভীষণ উত্তেজনা। এ-ভাবে ডেকে নেবার কি কারণ! ছোটবাবুর জন্য কি কোন দুঃসংবাদ আছে! ওর দেশ থেকে কি কোন মারাত্মক খবর এসেছে! কেন এ-ভাবে ডেকে আনা, এবং এমন একটা পরিবেশের ভেতর তাকে এ-ভাবে বসিয়ে রাখা! সে একেবারেই বুঝতে না পেরে হতবাক হয়ে গেল। নানাভাবে চেষ্টা করেও সে তার মুখ সহজ স্বাভাবিক রাখতে পারল না। মুখে চোখে ওর কেমন দুশ্চিন্তা ফুটে উঠেছে।

কাপ্তান বললেন, মাই বয়, ভয়েজ কেমন লাগছে?

—খুব ভালো স্যার।

–একঘেয়ে লাগে না?

—তা লাগে। মাঝে মাঝে লাগে।

মাস্টার তার পাইপের ছাই টিপে টিপে আবার আগুন ধরাবার সময় বললেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। বলেই তিনি তাকালেন মেজ-মিস্ত্রি আর্চির দিকে। যেন আর্চিকেই এ-কথাগুলো বলা। তিনি বললেন, তোমাকে সব বলেছি মিঃ আর্চি। এখন থেকে তবে ছোটবাবু তোমাদের ছ’নম্বর

আর্চি কোনোরকমে অষুধ গেলার মতো বলল, হ্যাঁ ছ’নম্বর।

—ছোটবাবু ভাল কাজ জানে না। তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে নাও।

মেজ মিস্ত্রি বলল, তাই হবে।

ছোট এ-সব কি শুনছে! সে কেন পারবে এমন সব গুরুত্বপূর্ণ কাজ। অথচ সে কাপ্তান হিগিনসের দিকে মুখ তুলে তাকাতে পারছে না। মানুষটা সত্যি যেন অনেক বড়। তিনি যা বলবেন, সবাই মাথা পেতে নেবে, তাকে নিতে হবে। তবু যেন সে বুঝতে পারল, এনজিনে কাজ করার মতো বিদ্যা- বুদ্ধি তার নেই।

তখনই আবার হিগিনস বললেন, উইনচ-রিপেয়ারের কাজগুলোতো তোমার মোটামুটি জানা?

ছোটবাবু বলল, সামান্য স্যার।

—আপাতত এভাবে চালিয়ে যেতে পারলেই হবে।

ছোট্ট বলল, কিন্তু স্যার……। কিন্তু কাপ্তান ওকে কথা বলার সুযোগ দিলেন না। ডেবিড আগের মতোই ওর দিকে চেয়ে আছে। খুব খুশি ডেবিড। সবাই চেয়ে আছে। কেবল আর্চির গোমড়া মুখ চোখ তাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। আর্চি কিছুতেই নিজের এই অবমাননা যেন সহ্য করতে পারছে না। কোথাকার একটা অনভিজ্ঞ নেটিভ জাহাজে উঠেই সবার মন জয় করে ফেলল। এখন যেন ইচ্ছে করলে এই ছোটবাবু জাহাজে অনেক কিছু করতে পারে। আর্চি কিছুতেই কাপ্তানের বিরুদ্ধে যেতে পারছে না। চিফ জাহাজ থেকে নেমে যাওয়ায় ওরও একটা প্রমোশন কোম্পানীর ঘরে হয়তো হয়ে যাবে। কাপ্তান হিগিনিস বাদ সাধলে তার কিছুই হবে না। এবং তেতো ওষুধ গেলার মতো সে বলল, একবার পরীক্ষা করে নিলে হত না। ওর চেয় বেশি অভিজ্ঞ অনেকে আছে। কশপ ভাল কাজ জানে, ওকে দেখা যেতে পারত।

কাপ্তান বললেন, জাহাজের অবস্থা ভাল না। বয়সী মানুষ দিয়ে হবে না। আমাদের এখন ইয়াং এনারজেটিক লোকের দরকার।

মেজ-মিস্ত্রি আর্চি বুঝল, কাপ্তান নিজের সিদ্ধান্তে স্থির। সুতরাং সে চুপ করে থাকল।

কাপ্তান বললেন, নাউ বয়, এখন থেকে তুমি ডাইরেকট মেজ-মিস্ত্রির আন্ডারে। তাঁকে তুমি ভক্তি শ্রদ্ধা করবে। তিনি এখন তোমার বস। তাঁর মর্জি মতো তোমাকে এখন থেকে চলতে হবে। তারপর থেমে বললেন, তুমি এমন কিছু করবে না যাতে তিনি এতটুকু দুঃখ পান।

ছোটবাবুর এখন আবেগে গলা বুজে আসার মতো। সে ভাবতেই পারেনি এনজিন-রুমের ছ’নম্বর সে কখনও হতে পারবে। আজ থেকে সে জাহাজের একজন দায়িত্বশীল লোক।

তার খাবারের মেনু আলাদা। সে ভাল পোশাক পরতে পাবে। স্যাবি পোশাক পরে থাকতে হবে না। মাইনে সে পাবে অনেক বেশি। কত পাবে এখনও ঠিক জানতে পারেনি, তবু এখন যা আছে তার চেয়ে কুড়ি গুণ বেশি। সে এখন থেকে ডাইনিং হলে খেতে আসবে। তার জন্য একটা কেবিন থাকবে। মেস-রুম-বয় তাকে দেখলেই সেলাম ঠুকবে। জাহাজিরা তাকে দেখলেই ছ’নম্বর বলবে। জাহাজে সে এ-খবরটা কতক্ষণে সবাইকে যে দিতে পারবে!

আর তখনই কাপ্তান সবাইকে বললেন চলে যেতে। এবং সারেঙকে ডেকে পাঠাবার জন্য বললেন। বোধহয় এখন ওঠার দরকার এমন ভেবে ছোটবাবু উঠতে যাবে, কাপ্তান হিগিনস এসে ওর সামনে দাঁড়ালেন। বাঁধানো দাঁত জিভের ওপরে তুলে আবার মাড়িতে ফিট করে চারপাশে দেখলেন। কেউ নেই। তখন ধীরে ধীরে বললেন, মাই বয়, ফেস এনি হিউমিলেশান এ্যান্ড পানিশমেন্ট লাইক এ সেলর। ছোটবাবু বুঝতে পারল না এতে হিউমিলেশানের কি আছে! তারপরই যেন আর্চির চোখ তাকে অনুসরণ করতে থাকল। সে বলল, আই উইল ডু স্যার।

তিনি ফের বললেন, মাই বয়, অলওয়েজ রিমেম্বার, ওয়ান হ্যান্ড ফর ইউরসেলফ, এ্যান্ড ওয়ান ফর দা শিপ।

সে বলল, ইয়েস আই উইল।

তারপর তিনি বললেন, সো দিস ইজ দা লাইফ এট সি। তুমি যেতে পার।

কেমন কিছুটা টলতে টলতে ছোটবাবু বের হয়ে যেতে থাকল। পৃথিবীতে এ-কাজটা তাকে এমন অহংকারের চূড়োয় তুলে দিতে পারে সে কখনও ভাবে নি। সে যেন হেঁটে যাচ্ছে না, দৌড়ে যাচ্ছে, সে যেন দু-হাত ওপরে তুলে বলতে চায়, আমার কি হয়েছে দ্যাখো, আমি কত বড় দ্যাখো। কিন্তু কিছুটা এসেই সে থমকে দাঁড়াল। সব ক্রুদের জটলা একেবারে ভান্ডারি-গ্যালির সামনে। ওরা অপেক্ষা করছে। কি খবর! কোন দুঃসংবাদ। সে বলল ভীষণ ভীষণ দুঃসংবাদ, সে উঠেই প্রথম দেখল মনু সামনে, সে মনুর গলা জড়িয়ে ধরল, ভীষণ ভীষণ দুঃসংবাদ, সে বলল, মৈত্রদা কোথায়, চাচা কোথায় অমিয়, এই অমিয়—চাচা কোথায় গেল!

সকলে অবাক। ভেবে পাচ্ছে না ছোটবাবু এমনভাবে সবাইকে খুঁজছে কেন!ওরা বলল, কি হয়েছে! মৈত্র ছুটে এসেছে নিচ থেকে। যেন বড় রকমের একটা দুঃসংবাদ বয়ে আনবে ছোটবাবু। ওরা নিচে নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসেছিল। ছোটবাবুর হাঁকডাকে ওরা লাফিয়ে ওপরে ওঠে এল। আর সঙ্গে সঙ্গে মৈত্রের গলা জড়িয়ে ধরে বলতে বলতে কেঁদে ফেলল ছোটবাবু, আমাকে কাপ্তান এনজিনরুমের ছ’নম্বর করে দিয়েছে। আমি অফিসার হয়ে গেলাম দাদা। কাল থেকে তোমাদের সঙ্গে আর থাকতে পারব না।

ততক্ষণে সারেঙও ফিরে এসেছেন। এসেই বললেন, বাড়িওয়ালা কালই ওর কেবিনে সব সামান রেখে আসতে বলেছে। ওর কেবিন দেখে এলাম। রঙ করতে হবে। আজই করতে হবে।

মৈত্র বলল, এই অমিয়! এমন একটা খবরে মৈত্র গলে জল হয়ে গেছে। অমিয়র উপর রাগ নেই।

অমিয় বলল, কি! মৈত্র ফের কথা বলায় সে খুব খুশি।

—রঙ করতে হবে।

মান্নান বলল, আমরা রঙ করব।

মনু বলল, কি কন!

মান্নান বলল, আমি আর ইয়াসিন রঙ করব।

—ক্যান। আমরা কি করতে আছি। ছোটবাবু এনজিন রুমের। ছোটবাবু আমাদের লোক।

এনজিন-সারেঙ বলল, মৈত্রমশাই ছোটবাবু আর আপনার হেপাজতে থাকল না। বলতে বলতে কেমন গলা ধরে এল তার।

আসলে এনজিন-সারেঙ নিজের দুঃখটা এই বলে ঢাকা দিতে চাইছেন। ছোটবাবুর ওপর আজ থেকে তাঁর আর কোন দাবী থাকল না। ছোটবাবুর ভাল-মন্দের জন্য তার যা কিছু দায়িত্ব—বাড়িয়ালা এক কলমের খোঁচায় তা কেড়ে নিলেন। ছোটবাবুর জন্য ভেতরে কি যে মায়া! কারণ ছোটবাবুকে আর এদিকে বেশি আসতে দেখা যাবে না। আজ থেকে ছোটবাবুর জাত-মান বেড়ে গেল। অথচ সারেঙ-সাব খুব খুশি, ছোটবাবুকে এমন একটা কাজই মানায়। খুব-খাটুনির কাজ, আর মেজ-মিস্ত্রি আর্চির কথা মনে হলেই সারেঙ-সাব কেমন শক্ত হয়ে যান। ডেকের ওপর মেজ মিস্ত্রি যেভাবে পাঁচ নম্বরকে হেনস্থা করে থাকে, কিল চড় ঘুষি মেরে থাকে, পাঁচ নম্বর কাজে ভুল করলে, লাথি মেরে ফেলে দেয়, যদি ছোটবাবুকে এ-ভাবে এবং এভাবে যেন একটা কিছু হয়েও যাবে—ভয়ে সারেঙের বুকটা কেঁপে উঠল। যেন একটা হাঙ্গরের মুখে বাড়িওয়ালা ইচ্ছে করেই ছোটবাবুকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। এখন থেকে মেজ-মিস্ত্রি ছোটবাবুর সব। তিনি তার কেউ না, তিনি ফালতু।

সারেঙ-সাব বললেন, আমার সঙ্গে মনু অমিয় আয়। অর্থাৎ সারেঙসাব আর দেরি করতে পারছেন না। বোধহয় বেশি কথা বললে, আবেগে চোখ ঝাপসা হয়ে যেতে পারে ভেবে অমিয় এবং মনুকে নিয়ে চলে গেলেন। নিজে দাঁড়িয়ে ছোটবাবুর কেবিনে রং করবেন। সাদা, নীল যেখানে যে-রং লাগালে মানায় এবং এমন চাকচিক্যময় করে তুলতে হবে, যেন ছোটবাবুর কেবিনের পাশে আর সব কেবিন ভীষণ ম্যাড়ম্যাড়ে, ছোটবাবুর কেবিনে অন্য অফিসাররা এলেই যেন বুঝতে পারে—এ কেবিন ছাড়া ছোটবাবুকে মানায় না।

ছোটবাবু তারপর ফোকসালে নেমে গেল। সবাই এখন ছোটবাবুর চারপাশে। ওরাও নেমে গেল। কত বড় সম্মান! যেন এখন এই সাধারণ জাহাজিরা বলতে চায়, আমরাও কম কিসে, আমাদের আর এত ছোট ভেব না। আমাদের লোক ছোটবাবু। তোমাদের ধার দিচ্ছি। এবং এর ভেতরই সেজে এল মজুমদার। সে যা করে থাকে, ঘুরে ঘুরে নাচে, এবং পায়ে ঘুঙুর। কারণ, এছাড়া ছোটবাবুকে ওরা কি দিয়ে বিদায়বেলার উৎসবে বলতে পারে তুমি আমাদেরই লোক। ছোটবাবু আমাদের ভুলে যেও না।

কেবল মৈত্র পাশে বসে ভাবছে। সে এই নাচ গান হল্লা শুনছে না। চা আসছে, চপাটি আসছে, এরই ভেতর চপাটি সবাই খাচ্ছে যেন ওরা ভেবে ফেলেছে রঙ-বেরঙের কাগজের মালা, ফুল এবং সব নানা রঙের ফেস্টুন ছোটবাবুর বিদায় উৎসবে উড়ছে, ঝুলছে। তার ভেতরই তারা চা খাচ্ছে। আসলে এটা চা নয়, যেন পানীয় এবং মাথার ওপরে ছাদ, সাদা রঙের। একটা মরা আলো ফোকসালে। এতে ওদের আসে যায় না। ওরা ভেবে ফেলেছে এখানে এখন জ্বলছে হাজার রকমের নীল বাতি, উজ্জ্বল বর্ণমালার ভেতর ওরা নেচে গেয়ে ছোটবাবুকে হেইল করছে।

কেবল ছোটবাবু চুপচাপ। এবং মৈত্রদা ছোটবাবুকে দেখছিল। ওদের এখন থামা উচিত। মৈত্র ওদের বলল, এবার তোরা যা। ছোটকে একটু একা থাকতে দে।

ছোটবাবু বলল, না, না। ওরা থাক না। জান মৈত্রদা, আমার ভাল লাগছে না। কেমন ভয় ভয় করছে। তোমাদের ছেড়ে যেতে আমার ভাল লাগছে না।

—ভয়ের কি আছে!

—আমি তো কিছু ঠিক জানি না। ট্রেনিঙে যা শিখেছি, আর এই পাঁচ ছ মাসে পাঁচ নম্বরের সঙ্গে কাজ করে করে যা বুঝেছি।

মৈত্র বলল, কি বা কাজ, উইনচ ঠিকঠাক রাখা, ফিলটার পরিষ্কার করা, টিউবে বয়লারের জল রোজ একবার টেস্ট করা—আর কি, তবে তুই কিছু বইটিই কিনে ফেলবি। তোর কাজে অনেক সুবিধা হবে।

মৈত্র অবশ্য জানে কিসের জন্য ছোটবাবুর মুখ ব্যাজার। এতদিন একসঙ্গে থাকলে একটা মায়া গড়ে ওঠে ওদের ছেড়ে থাকতে ছোটবাবুর ভাল লাগবে না। এবং ছোটবাবু বোধহয় মনে মনে টের পেয়েছে—মেজ-মিস্ত্রি আর্চির নিষ্ঠুরতার শেষ নেই। মৈত্র বলল, ভয় কি আমরা তো আছি।

ফোকসাল এখন ফাঁকা। কেবল ছোটবাবু আর মৈত্র বসে রয়েছে। অন্য ফোকসালে সবাই এখন ছোটবাবুর গুণগান করছে। আসলে যখন জাহাজে ছোটবাবু উঠে এসেছিল, তখনই সবাই টের পেয়েছে, ওদের মতো এমন ছোট কাজ করার লোক ছোটবাবু নয়। বাদশা মিঞা বলেছে, জানো ছোটবাবু কত লেখাপড়া জানা ছেলে। আমাদের মতো সে কেন ডেকে এনজিনে পড়ে পড়ে মার খাবে। ঠিক লোক এবার থেকে ঠিক জায়গায় চলে গেল। এতদিন ছোটবাবু তাদের সঙ্গে কাজ করেছে এই যথেষ্ট। এমন যে হবে সেটা এখন কে বেশি টের পেয়েছিল তা নিয়ে কোথাও কোথাও ঝগড়া বচসা পর্যন্ত আরম্ভ হয়ে গেল। এবং তখন বারোটা বাজলে, ওয়াচে মৈত্র একবার নেমে দেখে এল, সব ঠিকঠাক আছে কিনা। জাহাজ ভীষণ আস্তে চলছে বলে, কয়লা কম হচ্ছে। আর আমেরিকান কোল, খুবই কম কয়লায় বয়লারে স্টীম উঠে যায়। ছাই একেবারেই হয় না। যেন তেলের মতো জ্বলতে থাকে। তখন কোলবয়ের তেমন কাজ থাকে না। দু-চার বেলচা কয়লা মারলেই হয়ে যায়। সুতরাং তিনজন ফায়ারম্যান নিচে ঠিকঠাক কাজ চালিয়ে নিচ্ছে। তবু একবার দেখা দরকার ভেবে বোটডেকে উঠে যাবার সময় দেখল, সারেঙ-সাব এলি-ওয়ে ধরে বের হয়ে আসছেন। আর অবাক, বিচিত্র রং- এ সারেঙ-সাবের সাদা বয়লার স্যুট অদ্ভুত দেখাচ্ছে। চুলে দাড়িতে রঙ লেগেছে। নাকে কিছুটা সাদা রঙ। সারেঙ-সাবকে একজন বুড়ো জোকারের মতো দেখাচ্ছে। ওর হাসি পাচ্ছিল। অনেক কষ্টে হাসি চেপে বলল, সারেঙ-সাব মুখটা মুছে ফেলুন।

সারেঙ-সাব বললেন, বুড়ো হলে কি হবে, কাজ কাম হাতে অনেকদিন করি না বলৈ কি হবে, এখনও পারি, রং লাগাতে পারি। অমিয় মনু পারে না। যত বলি ঠিক হচ্ছে না, তত বলে আর কি হবে সারেঙ-সাব। তখন কি করি বলুন, বুরুশ হাতে নিলাম। বললাম, দ্যাখ, দেখছিস—বুরুশের দাগ কোথায় ভেসে উঠছে!

মৈত্র বুঝতে পারল, ছেলের জন্য নিজে রঙ করে দিতে না পারলে সারেঙ সাবের মন ভরছে না। সারেঙ-সাবের কি এখন গর্ব। ছেলে তার মান-সম্মান যখেনি শুধু, সবার ইজ্জত বাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি আবার ছেলেমানুষের মতো বললেন, আসুন না, দেখবেন কি রকম রঙ করলাম। কেমন দেখাচ্ছে। বলে প্রায় জোরজার করে মৈত্রকে ধরে নিয়ে গেল। মৈত্র এদিকে কখনও আসেনি। কার্পেটের ওপর দিয়ে সে কেন যেন দ্রুত হাঁটতে পারে না। সে তবু সারেঙ-সাবের সঙ্গে প্রায় দৌড়ে গেল। সারেঙ- সাব দরজা খুলে দিয়ে বললেন, দেখুন। ছাদে নীল রং, কশপকে বলেছি রং এক নম্বর দিতে হবে, দেয়ালে একটু ব্লু আর মেজেন্টা মিলিয়ে কি রং এনেছি দেখুন। কোথাও বুরুশের দাগ ভেসে উঠেছে? তবে!

অমিয় মনু রং-এর টব আর বুরুশ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। মৈত্র অমিয়কে বলল, তোরা কি! মনুকে বলল, সারেঙ-সাবকে তোরা রং করতে দিলি?

—আমরা দিয়েছি!

অমিয় বলল, সাবান জল দিয়ে যত ধুই তত বলেন, না সাফ হচ্ছে না। ঠিক হচ্ছে না। রং লাগালে চিৎকার করছেন, হচ্ছে না। বুরুশের দাগ ভেসে উঠছে। আমরা কি করব বল? একা একা সবটা করলেন।

সারেঙ-সাব বললেন, কেমন হয়েছে বললেন না তো?

—খুব ভাল!

মৈত্র আর দাঁড়াল না। নিচে এক্ষুনি নেমে যেতে হবে। এবং যেতে যেতেই বুঝতে পারল, ছোটবাবু ফোকসাল ছেড়ে আসায় সবচেয়ে অসহায় যেন এই মানুষটা। এমনিতে তিনি কম কথা বলেন, কাজকামে ডুবে থাকেন। জাহাজের কোথায় কি করার দরকার, সবার আগে তিনি বোধহয় টের পান। ভীষণ সতর্ক নজর। এতদিন একবারও মনে হয়নি, জাহাজে মৈত্রের চেয়ে ছোটবাবুর জন্য কেউ বেশি ভেবে থাকে। ছোটবাবুর জন্য আরও একজন মানুষ এই জাহাজেই নিরন্তর মহামহিমের কাছে প্রার্থনা করে থাকেন সে জানত না। সে বলল, ছোটবাবু, তোমার কপাল দেখে আমার হিংসে হচ্ছে।

আর এভাবেই পরদিন ছোটবাবু তার নিজের বলতে সবকিছু ছেড়ে অর্থাৎ ছোটবাবুর শরীরে এতদিন যে খোলস ছিল, এখন একেবারে ভিন্ন রকমের, এবং এভাবে স্বভাব পালটাতে সবারই কষ্ট হয়। ছোটবাবুরও হয়েছিল। ফোকসালটা এ-ক’মাসে এত প্রিয় হয়ে গেছল সে বুঝতে পারেনি। যেন কথা ছিল চিরদিন সে এখানেই থাকবে। মৈত্র এবং অমিয় অথবা অন্য জাহাজিরাই তার সব, আর কেউ আছে পৃথিবীতে ক্রমে যখন ভুলে যাচ্ছিল, ঠিক তখন জীবনে এই পরিবর্তন খুব হকচকিয়ে দিল।

.

প্রথম দিন সে কেবিনে ঘুমোতে পারেনি। পাঁচ নম্বর, ওয়াচে নেমে গেছে। চিফের কাজকর্ম মেজ- মিস্ত্রি চালাচ্ছে। মাঝে মাঝে মেজ-মিস্ত্রি ওয়াচেও নেমে যাচ্ছে। এবং উইনচের স্ট্রেপার বিয়ারিং, ওঠানামায় ক্ষয়ে গেছে। ভেতরে লাইনিং দিয়ে মেরামত করতে হবে। ফাইলের কাজ বেশি। পাঁচ নম্বর কুঁড়ে প্রকৃতির বলে, ফাইল সে ছোটবাবুকে দিয়ে অনেকবার করিয়েছে। এখন সে নিজে দু-দিকে সমান চাপ দিয়ে ঘসে ঘসে লোহার পাত, তামার পাত অথবা ব্রাশ ঘসে ঘসে ঠিক যত মিলিমিটার পাতলা দরকার করে ফেলতে পারে। এবং যখন ওপরে উঠে আসে, তখন দেখতে পায় নদী ক্রমশ আবার বিস্তৃর্ণ হয়ে যাচ্ছে। বিকেলের দিকে মোহনা পাবার কথা।

তখন কাপ্তান বনির কেবিনে। জাহাজ মোহনা ছাড়িয়ে আবার সমুদ্রে ভেসে চলেছে। বনির শরীরে একটা রঙবেরঙের সিল্কের চাদর। বনি শুয়ে আছে। চোখ কনুই দিয়ে ঢেকে রেখেছে। তার কেবিনে যে হিগিনস এসেছেন সে যেন টের পায়নি। অথবা এমন এক অতলে ডুবে আছে যে মনে হচ্ছে বনি ঘুমোচ্ছে।

হিগিনস মেয়ের মাথার কাছে একটা চেয়ার টেনে বসলেন। যেন তিনি তাঁর এই একমাত্র জাতকের কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছেন—এমন চোখ মুখ! অর্থাৎ বনির শরীরে সুহাস সুবর্ণ সব বাতিঘরেরা যে খেলে বেড়াচ্ছে তা তিনি বুঝতে পারছেন। এ-ভাবে পুরুষের মতো সেজে থাকতে বনির ভাল লাগছে না। অথচ উপায় নেই বলে থাকতে হচ্ছে। তবু ইচ্ছে করলেই হিগিনস সবাইকে বলে দিতে পারেন, আসলে বনি মেয়ে, সে জাহাজে মেয়ের মতোই থাকতে ভালবাসে—কিন্তু জাহাজের একঘেয়েমি এবং নিষ্ঠুরতা বনিকে ছিন্ন-ভিন্ন করে দিতে পারে। বনিকে তিনি মেয়ে বলে কিছুতেই জাহির করতে পারছেন না। এটা তাঁর ভয়। ভয় বলেই জোরজার করে তিনি সহজ সরল সত্যকে বিকৃত করছেন। মনে মনে বনির কাছে এখন খুব ছোট হয়ে যাচ্ছেন। যেন বলার ইচ্ছে, বনি আর কিছুদিন, এই যতদিন জাহাজ ফের হোমে না ফেরে ততদিন তারপর আর কখনও তোমাকে এভাবে থাকতে হবে না। তোমার জন্য আমি সুন্দর সুন্দর পোশাক কিনে দেব।

তিনি ডাকলেন, বনি।

বনি চোখ থেকে হাত সরাল না। বলল, এখন আমরা কোথায় বাবা?

মোহনা ছাড়িয়ে গেছি। কিছু আর কোথাও দেখা যাচ্ছে না।

—বনি আর কিছু বলল না। সে যেমন চুপ করে জেগেছিল তেমনি আবার অতলে ডুবে গেল।

—কাপ্তান বললেন, ব্যথাটা কেমন?

—নেই।

—ভাল লাগছে?

—ঘুম পাচ্ছে বাবা।

—তুমি ভয় পাওনি তো?

—না বাবা।

—এখন এ-সব তোমার হবে। তুমি হয়ে বড় যাচ্ছ বনি।

বনি বলল, বাবা, আমার কেবল ঘুমোতে ইচ্ছে করছে।

হিগিনস মেয়ের কপালে হাত রাখলেন, সুন্দর ছোট্ট কপাল বনির। চুল ঘন এবং নরম বলে ভারি মনোরম লাগছে হাত বুলাতে। তিনি কপাল থেকে বনির চুল সরিয়ে দিলেন। এবং ইচ্ছে হল আস্তে চুমু খেতে। বনির ঘুম আসছে, ঘুমোক। এই বিকেলে, সূর্য যখন সমুদ্রে নানা বর্ণমালার ভেতর অস্ত যাবে, তখন বনি, এই সাদা জাহাজের ভেতর ঘুমিয়ে পড়বে। তিনি বললেন, কিছু খাবে?

—না বাবা।

হিগিনস বললেন, আমরা নিউ-প্লাইমাউথ যাচ্ছি।

—কোথায় বাবা?

—আমরা পানামা খাল পার হয়ে যাব। তারপর পঁচিশ-ছাব্বিশ দিন জাহাজ একনাগাড়ে চলবে, একদিনের জন্য তাহিতিতে থামবে। রসদ এবং জল নেওয়া হবে। নিউ-প্লাইমাউথ, নিউজিল্যান্ডের ছোট্ট বন্দর।

তাহিতি দ্বীপের কথা শুনেই—কবে যেন কার কাছে বনি দ্বীপের সব সুন্দর সুন্দর গল্প শুনেছিল। পৃথিবীর সব সুখী মানুষেরা তাহিতি দ্বীপে একবার যেন না গিয়ে পারে না। সে বলল, আমরা নামতে পারব বাবা?

—তোমার খুব নামতে ইচ্ছে করে?

বনি কি বলবে, সে এবার মুখ থেকে হাত সরিয়ে তাকাল। বড় বড় চোখে বাবাকে দেখছে। কী সুন্দর তার বাবা!

কাপ্তান বনির চোখের দিকে তাকালে আর স্থির থাকতে পারেন না। বয়স হওয়ার জন্য এটা বোধহয় হয়েছে। তিনি না থাকলে বনির কেউ থাকবে না। বনি বড় হচ্ছে, আর কিছু বড় হলে ভাবনার থাকবে না। আর কিছুদিন তিনি পৃথিবীতে থাকতে চান। এই মেয়ে ঠিক ঠিক বড় হয়ে গেলে তিনি মরতে ভয় পাবেন না। কাজেই বনি এভাবে তাকিয়ে থাকলে, কারণ দেখতে পাচ্ছেন, বনির চোখ বড় অসহায়। কিসের একটা ভয় ওকে তাড়া করছে। চোখ দেখলেই টের পান সব। তিনি উঠে যাবেন ভাবছিলেন। কিন্তু চোখে যেন একটা আতঙ্ক বনির। তিনি বললেন, তুমি কি বনি কোন দুঃস্বপ্ন দেখেছ?

—না বাবা।

—মুখ চোখ দেখে মনে হয় কতদিন না ঘুমিয়ে আছ।

বনি বলল, না তো।

—তবে চোখ মুখ এত শুকনো কেন? একা থাকতে ভয় পাও?

বনি হেসে দিল। বলল, ভয় পাব কেন?

—তবু কেন যে তোমাকে দেখে ভাল লাগছে না!

—শরীর ভাল না থাকলে এমন হবে না!

যেন হিগিনস এবার স্বস্তি পেলেন। রিচার্ড জাহাজ থেকে নেমে গেছে। ওর কিছু ম্যানিয়া আছে। এসব ভারতীয়দের সঙ্গে কাজ করার অভ্যাস তার আগে ছিল না। প্রথম থেকেই সে খুব একটা খুশি ছিল না। কোম্পানী জোরজার করে ওঁকে পাঠিয়েছে। মনে হয় একটা অজুহাত দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত নেমে গেল।

বনি উঠে বসল। বলল, তুমি খুব ভীতু বাবা।

হিগিনস মেয়ের এমন কথায় সামান্য হাসলেন। তাঁকে কেউ কখনও এভাবে কথা বলতে পারে না। এই মেয়েটা তাঁর ভাল-মন্দ সব কিছু। এমন কি তিনি দেখেছেন, আজকাল বনি তাঁকে মাঝে মাঝে ঠিক শাসনের সুরে কথা বলে থাকে। বেশি খাটাখাটনি করলে রাগ করে খেতে যায় না। আচ্ছা আর হবে না, এই বলে অনেক বুঝিয়ে তবে বনিকে তখন খাওয়ানো যায়। আর বুঝতে পারছেন, ডাঙ্গার জন্য যা কিছু টান—এই ‘ছোট্ট সুন্দর ফুলের মতো মেয়েটার জন্য।

হিগিনস বললেন, তুমি ঘুমোবে। ভুত-টুত জাহাজে, বাজে কথা

বনি হেসে ফেলল। হেসে দিলে বনির ঝকঝকে দাঁত এত বেশি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে চোখ দুটো এমন মায়াময় হয়ে যায়—যে মনেই থাকে না এই মেয়ে কিছুক্ষণ আগে মুখে অতিশয় আতঙ্কের ছবি এঁকে রেখেছিল। বনি বলল, আমি ভাল আছি বাবা। আমার জন্য ভাববে না। যেন বলতে চাইল ভয় আছে, আমি টের পাচ্ছি চারপাশে একটা ভয় ঘোরাফেরা করছে, কিন্তু যখন ছোটবাবুর কথা ভাবি তখন একেবারে ভয় থাকে না।

সে বলল, বাবা, ছোটবাবু ঠিকমতো কাজ করছে তো।

—পারছে না। আর্চি তো কাল বলল কি একটা পার্টস ভেঙে ফেলেছে ছোটবাবু।

আর তক্ষুনি বিষন্ন হয়ে গেল বনির মুখ। আবার সেই আতঙ্ক ক্রমে সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল।

হিগিনস মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কি যেন বুঝতে পারলেন। বললেন, প্রথম প্রথম একটু এমন হবেই।

বনি বলতে পারল না, আর্চি তোমাকে ঠিক ঠিক রিপোর্ট করছে না বাবা। আমি আবার ডেকে বের হতে পারলে বুঝতে পারব। আর্চি তোমাকে বানিয়ে যত রাজ্যের রিপোর্ট করে যাবে।

এবং বোধহয় এ-ভাবেই জাহাজে দুই প্রতিদ্বন্ধী এখন হেঁটে বেড়াচ্ছে। বনির কপালে হিগিনস যাবার সময় ধীরে চুমু খেলেন। বাবা চলে গেলে দরজা বন্ধ করে বনি আবার বসে থাকল ভেতরে। কিছু ভাল লাগছে না। ছোটবাবুর সঙ্গে যেন তার কতদিন দেখা হয়নি। এই তিন চারদিনেই মনে হয়েছে—কবে কোন দ্বীপে একবার যেন সেই মানুষটিকে সে দেখেছিল। তার শরীরে লম্বা আলখাল্লা। সমুদ্রের পাড়ে পাড়ে সে হেঁটে যাচ্ছে। শরীরে তার সুবর্ণ নদীর জলের ঘ্রাণ। সমুদ্রের নীল জল পায়ে তার আছড়ে পড়ছে। মানুষটাকে সে অনেকদিন ভেবেছে, সামনে দাঁড়িয়ে দেখবে। দেখতে পারেনি। যতবার সে হেঁটে আগে যাবার চেষ্টা করেছে ততবার মনে হয়েছে পারছে না। সে হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছে। আলখাল্লায় পায়ের পাতা ঢাকা তার। সমুদ্রের নীল জলে তা ভিজে যাচ্ছে। এবং কোনো সম্রাটের মতো সে যখন হেঁটে যায় বনি যেন ছোট্ট মেয়ের মতো তাকে দেখতে ভালবাসে। এবং কতকাল থেকে, যেন সেই শিশুবয়েস থেকে, অথবা বলা যায় শৈশবের প্রারম্ভে কিংবা তারও পরে সে এমন একজন মানুষকেই ভেবে আসছে। নরম সবুজ নীল দাড়ি, মাথায় একরাশ নরম নীলাভ চুল আর বড় বড় চোখ, লম্বা, ঠিক সম্রাট সিজারের মতো অথবা মনে হয়, সে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই, বনি পেছনে পেছনে ছুটেও তার নাগাল পাচ্ছে না। যেন সে তখন ডাকছে, হেই অহংকারী যুবক, তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছ না! আমি বনি

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *