1 of 2

অলৌকিক জলযান – ১

।। এক।।

১৭ই মে—১৯৫৩।

এ-ভাবে সোনা ক্রমে হেঁটে যাচ্ছে। ক্রমে সেই দিনগুলো থেকে, জন্ম থেকে সে এভাবে ক্রমে হেঁটে যাচ্ছে যেন। বড় হতে হতে চার পাশের মুগ্ধতার ভিতর কখন যেন কঠিন কিছু আবিষ্কার করেও সে হেঁটে যাচ্ছে। নস্কর বাড়ির লাল পাঁচিলের পাশ দিয়ে সূর্যের আলো আসছে। সে তার ভিতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। ক্রমে সূর্য ওপরে উঠছে, সে তখনও হেঁটে যাচ্ছে। ক্যাম্বেল হাসপাতাল পার হয়ে সে হেঁটে যাচ্ছিল সারপেনটাইন লেন ধরে, তারপর সে আরও কিছু দূর গেলে দেখতে পেল ট্রাম যায়। তবু সে হেঁটে যাচ্ছে। তাকে ধর্মতলা, চৌরঙ্গী পার হয়ে যেতে হবে। সবুজ রেমপার্ট সামনে। ফোর্ট উইলিয়ামের দুর্গ বাম দিকে। এবং এভাবে আর কিছুদূর হেঁটে গেলে শিপিঙ অফিস। সে সেখানে হেঁটে হেঁটে আর পারছে না। চোখ মুখ দেখলে বোঝা যায় তার অশেষ যন্ত্রণা। সরল সহজ চোখ দুটো দুঃখে টস টস করছে।

এভাবে সোনা শিপিঙ অফিসে আসছে-যাচ্ছে। মাসতার দিচ্ছে। জাহাজের খবর হলেই বড় বড় মাসতার পড়ে যায়। সে দাঁড়িয়ে থাকে সবার সঙ্গে। হাতে জাহাজী ছাড়পত্র ‘নলি’। ঠিক যেন অনেকটা ধর্ম-পুস্তকের মতো সে দু হাতের ভিতর নলিটাকে ধরে রাখে। দেখলে মনে হবে সে প্রার্থনা করছে।

সবাইকে এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। বড় আম গাছের ছায়া ক্রমে ছোট হয়ে যায়। মানুষের ছায়া ক্রমে ছোট হয়ে আসে। জাহাজ থেকে কাপ্তান বড় মিস্ত্রি নেমে আসেন। ওরা যত কাছে এগিয়ে আসে তত বুকটা কাঁপে। সোনা তখন সোজাসুজি তাকাতে পারে না পর্যন্ত। সে প্রথম সফরে যাবে। প্রথম সফর বলে, অভিজ্ঞতা নেই বলে কেউ তাকে নিতে চায় না।

তার যন্ত্রণা বাড়ে। বোর্ডের লেখাগুলো সব এক এক করে মুছে দেওয়া হয়। আর কোনো জাহাজের খবর নেই। আজ আর কোনো জাহাজ থেকে জাহাজী রিক্রুট করতে কেউ আসছে না। সে তবু বড় আম গাছটার ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকে। যেন মনে হয় সে আজ হোক কাল হোক, কোনও জাহাজ পাবেই। বয়স যতই ওর কম হোক, অভিজ্ঞতা কিছু না থাকুক, একদিন না একদিন সে ঠিক সবার মতো জাহাজ পেয়ে যাবে। তার আকাঙ্ক্ষা তখন বাড়ে।

মাঝে মাঝে সোনা দেখতে পায় একজন বুড়ো মতো মানুষ তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন। সাদা লম্বা দাড়ি। চুল ছোট করে ছাঁটা। সাদা পাজামা। ঢোলা পাঞ্জাবি গায়ে। হাতে একটা লেদার ব্যাগ। মাসতার শেষ হয়ে গেলে তিনি এসে কিছুক্ষণ বড় আম গাছটার নিচে দাঁড়ান। কি যেন দেখেন। বোর্ডে পরদিন কোন কোন জাহাজ নোঙর ফেলছে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখার স্বভাব। জাহাজ না থাকলে লোকটাও ঠিক ওর মতো চুপচাপ ফিরে যায়।

চারপাশে সব মানুষেরা জাহাজ পেয়ে যখন হাসি ঠাট্টায় মসগুল অথবা কেউ না পেয়ে যখন চুপচাপ চলে যাচ্ছে তখনও দুজন মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে—একটা খবর না পেলে চলছে না। জাহাজ না পেলে ওরা আর বেশীদিন এই বড় শহরে থাকতে পারছে না।

সোনা দেখল তখন পাশে নদী। নদীতে কত জাহাজ। জাহাজের মাস্তুলে নানা বর্ণের নিশান। কোথাও জাহাজ রঙ হচ্ছে। কোথাও কোনও জাহাজ থেকে নাবিকরা নেমে ট্যাকসি ধরে শহরের ভিতর ঢুকে যাচ্ছে—। আর তারা দুজন জাহাজের অপেক্ষায় মাসতারের অপেক্ষায় চুপচাপ গাছের ছায়ায় যেন কত যুগ ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

বুড়ো মানুষটা একদিন বললেন, তুমি বাবা জাহাজ পাচ্ছ না?

সে বলল, না চাচা।

—এত কম বয়সে তো জাহাজে নেয় না।

—আমার ‘নলি’ আছে। ভদ্রা জাহাজ থেকে ট্রেনিং নিয়েছি।

—নলি দিয়ে কিছু হয় না। সফর না দিলে কিছু হয় না।

—আমার তবে হবে না?

বুড়ো মানুষটা সামান্য হাসলেন। হবে না কেন, হবে। তবে খুব ঝামেলা। বুড়ো মানুষটার মুখে চোখে আবার সেই কঠিন চেহারা। যেন এই মানুষ নিত্যদিন সফর করে জাহাজের সমস্ত খবর অথবা বলা যায় প্রাচীন নাবিকের মতো চোখ-মুখ এবং তিনি জানেন, সফরে কি যে কঠিন অভিজ্ঞতা। তুমি ছেলে নাবালক বলা চলে, ভাল করে দাড়ি গোঁফ ওঠেনি, তুমি ছেলে জাহাজে যাচ্ছ, তুমি তো জান না, সমুদ্র কি ভয়ঙ্কর, ঝড় কি ভয়ঙ্কর, সি-সিকনেস কি কঠিনভাবে নাড়া দেয়, রক্ত উগলে দিলেও তুমি নিস্তার পাবে না। আর সেই দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রায় হোম-সিকনেস এক কঠিন অসুখ। তুমি যাবে জাহাজে এটা চাট্টিখানা কথা!

আসলে বুড়ো মানুষটা বুঝি আর কথাই বলতেন না ওর সঙ্গে। কারণ চোখ-মুখ দেখলেই টের পাওয়া যায়—বুড়ো মানুষটা তাকে ভীষণভাবে উপেক্ষা করছেন। সব খবর না নিয়ে তোমার আসা ঠিক হয়নি ছেলে। তোমার জাহাজী ট্রেনিং এক, সমুদ্র সফর অন্য রকম। কিন্তু ওর বলার ইচ্ছা ছিল, চাচা, আপনি যা ভেবেছেন আমি তা জানি। আমি জানি সব। আমার বয়সের কথা আমি টের পাই। আমার চেহারার ভিতর একজন মায়াবী মানুষের ছবি আছে টের পাই। জাহাজে এমন মানুষের ছবি থাকা ঠিক না আমি জানি। তবু চাচা আমাকে অনেকটা পথ হেঁটে আসতে হয় এখানে। যতটা আমাকে ওপরে নরম মনে হয়, ভেতরে ভেতরে আমি তত শক্ত। জাহাজ ধরতে না পারলে পৃথিবীতে আমার দাঁড়াবার আর কোনও জায়গা থাকবে না চাচা।

সোনা বলল, আপনি জাহাজ পেয়েছেন?

বুড়ো মানুষটা বললেন, না। আমার জাহাজ আসছে। দু-চার দিনের ভিতর এসে যাবে।

—কোন কোম্পানির?

—ব্যাঙ্ক লাইন।

—জাহাজের নাম?

—এস এস সিউল ব্যাঙ্ক।

—জাহাজে ওরা আপনাকে নেবেই?

—নেবে না! কি যে বলছ! বলে একটা হাই তুলল বুড়ো মানুষটা। বাসটাস ধরতে হয় এমন একটা ভাব। কেমন নিশ্চিন্ত ভঙ্গী। আর তার তখন মনে হল যারা আসে সবাই একে একে জাহাজ পেয়ে যায়। সে পায় না। সে বলল, আমি যে কি করে জাহাজ পাব?

বুড়ো মানুষটা বললেন, আমার সঙ্গে তুমি যেতে পার। বলেই কি ভাবলেন—না না ঠিক হবে না। তেলের জাহাজে তুমি বরং যাও। পার তো মোটর ভেসেলে। কয়লার জাহাজে তুমি পারবে না ছেলে।

সেই এক কথা। বার বার সে এমন কথা শুনেছে। শুনেছে ভীষণ হাড়ভাঙ্গা খাটুনি—ঠিক খাটুনি বলা যায় না, প্রায় ক্রীতদাসের সামিল কাজ। সে বলল, আমি পারব না কেন চাচা?

—পারবে না ছেলে। চোখ-মুখ দেখলেই ওরা বুঝতে পারে কে কেমন মানুষ। মাঝ দরিয়ায় একটা কিছু হয়ে যাক ওরা চায় না। তাও যদি দুটো-একটা সফর থাকত তবে নিতে সাহস করত।

সোনা বুঝেছিল বুড়ো মানুষটা জাহাজে সারেঙ অথবা টিণ্ডালের কাজ করেন। দেখলেই বোঝা যায় অনেক সমুদ্র-সফর ওঁর মুখের রেখাতে। তিনি সহজেই সমুদ্র সম্পর্কে সব বলে যেতে পারেন। বলে যেতে পারেন সমুদ্রের নোনাজলের হাওয়া একবার গায়ে লাগলে কি হয়। তিনি বলে যেতে পারেন—পৃথিবীর কোথায় কি মানুষ আছে, তারা কিভাবে বাঁচে। সব মানুষেরাই এভাবে নানা কারণে সব কাজ পারে না। তখন সোনা আর সাহস পায় না বলতে, আমি ঠিক পারব।

বুড়ো মানুষটা বললেন, সিউল ব্যাঙ্ক জাহাজটা আসলে জাহাজ না। জাহাজ হলে তোমাকে আমি নিতাম। সে যত কঠিন কাজই হোক না। আসলে ওটা একটা ইবলিশ। ইবলিশ বুঝতে পার?

—না চাচা।

—ইবলিশ জান না? ইবলিশ মানে শয়তান।

তারপর মানুষটা একেবারে চুপ। কিছু বলছেন না। সাদা পাতা মুখে দেবার স্বভাব মাঝে মাঝে। কৌটা খুলে সাদা পাতা জিবে ফেলে দিয়ে বললেন, আর দাঁড়িয়ে কি হবে। জাহাজ তো আর আজকে নেই। কাল তিনটে জাহাজ আসছে। বোর্ডটা একবার ভাল করে দেখে যাও। ক্ল্যান কোম্পানীর জাহাজ পাও কি না দ্যাখো। ভাল জাহাজ। কাজ কম। খাবার-দাবার ভাল। দু-তিন মাসের পচাগোস্ত অন্তত খাওয়ায় না। লম্বা সফরেও বের হতে হয় না।

সোনা কিছু বলছিল না। সে জানে, কালও এমনি আসবে। কালও সে এমনি ফিরে যাবে। পুরানো জাহাজিরা সফর শেষে ছ-সাত মাস বসে থেকে জাহাজ পাচ্ছে না। সব কপাল। কপাল ভাল থাকলে কেউ কেউ দু-তিন মাসেও জাহাজ পেয়ে যায়। সে তো এই পনের-ষোল দিন হল মাত্ৰ ক্ৰমান্বয় মাসতার দিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং মনে হল—এই বুড়ো মানুষটাই তাকে কেবল রক্ষা করতে পারেন। সে, যে করে হোক তাকে সহজে ছাড়ছে না।

—জাহাজটা শয়তান কেন চাচা?

—ওটা কোন আমলের জাহাজ কেউ বলতে পারে না। কেউ বলে ডেনিসদের ওটা যুদ্ধ জাহাজ ছিল, কেউ বলে পালের জাহাজ, আবার কেউ বলে, প্রথম মহাযুদ্ধে জাহাজটা খুব ঘায়েল হয়েছিল। মাঝ দরিয়া থেকে মাঝিমাল্লারা টেনে কার্ডিফে নিয়ে যায়। চক্ পাল্টে, বয়লার পাল্টে ওটাকে ওরা কার্গোসিপ বানিয়ে ফেলে। কিন্তু ঘাড়ে শয়তান চেপে আছে। পুরানো জাহাজ কখন দরিয়ায় যে খসে খসে পড়বে কে জানে!

সোনা বলল, মানুষ এমন জাহাজে যায় সফর করতে!

বুড়ো মানুষটা পেট দেখাল। এটা ছেলে, এটা।

—আপনি যাবেন!

—যাব না! বলেই চোখ বুজে ফেললেন। যেন কতদিন পর তার অতি প্রিয়জন আসছে।

—বারে বা এ তো বেশ। সোনা খুব চিন্তায় পড়ে গেল। চোখ খুলছেনই না। যেন ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছেন। জাহাজটা বুঝি সাদা রংয়ের—কি আশ্চর্য নীল জলের ওপর দিয়ে জাহাজটা আসছে। সে এবার জোরে ডাকল, চাচা!

—হুঁ। বলেই চোখ মেলে হাসলেন। দুনিয়ায় দুজন কাপ্তান আছে জাহাজটাকে চালাতে পারে। একজন উইলিয়াম, বুড়ো মানুষ, হিগিন্স আরও বুড়ো। শেষ বয়সের বিয়ে। বৌ পালিয়ে গেছে। ছোট একটা ছেলে আছে। জাহাজে কাজ করলে অবশ্য এমন হামেশাই হয়। ছেলেটাও একটা ইবলিশ। বাপের সঙ্গে সঙ্গে জাহাজে ঘুরে বেড়ায়, পড়াশোনা করে না, বেহদ্দ পাজি।

ওর মনে হল বুড়ো মানুষটা কথা বলতে ভীষণ ভালবাসেন। আর কি যে কারণ থাকে কখনও কখনও মানুষ সহসা সবকিছু মন খুলে বলে দেয়।—আমারও কেউ নেই ছেলে। আমি আছি, দরিয়া আছে আর আছে তিনটে জ্যান্ত কসবি। জাহাজের তিনটে বয়লার। এই কসবি তিনটেকে বাগে আনতে পারে মাত্র দুজন সারেঙ। হ্যাঁ দুজন সারেঙ। বুড়ো মানুষটা কানের কাছে ঝুঁকে কেমন ফিস ফিস গলায় বললেন, মোহব্বত না থাকলে ছেলে জাহাজ চলে না। বয়লার স্টিম দেয় না।

সে বলল, আর কেউ পারে না চাচা?

—না। দুজনই পারে। একজন ইমানুল্লা, আর একজন এই বুড়ো মানুষ। ইমানুল্লা আসছে। খুব লম্বা, ঢ্যাঙা মানুষ। তুমি দেখলেই বুঝবে—কি শক্ত হাত-পা, মাংস, শরীর শুকিয়ে গেছে। কেবল হাড় কটা। লোহা পুড়িয়ে পুড়িয়ে যা হয়।

সোনা বুঝেছিল, বুড়ো মানুষটা এনজিন সারেঙ। তাকেও এনজিনে কাজ করতে হবে। কোলবয় হয়ে জাহাজে উঠতে হবে। একজন এনজিন সারেঙের সঙ্গে পরিচয় থাকা ভাল। সে বুড়ো মানুষটাকে ছাড়তে চাইত না। যখন যেখানে দেখা হত দাঁড়িয়ে গল্প করত।

পরদিনও দেখা। বুড়ো মানুষটা দোতালা থেকে নামছেন। সিঁড়ির মুখে সে দাঁড়িয়ে। কি ছেলে জাহাজ পেলে?

—না।

—একবার ওদিকের ব্যারাকে চলে যাও। সিটি-লাইনের জাহাজ আসছে। বোর্ডে কিছু লেখা হচ্ছে না। ওরা শুধু ক্রু নিতে আসছে। মাল খালাস-টালাস হবে না। তেলের জাহাজ। কাজ করে সুখ আছে। জাহাজটা খুব বড়। মাঝখানে ফোকসাল। দেওয়ানী তেমন লাগবে না। সারেঙ মজিদ মিঞা। স্টারবাক সাহেব কাপ্তান। ইয়র্কে বাড়ি……

ওর মনে হল বুড়ো মানুষটা জাহাজের এন্তার ফিরিস্তি দিয়ে যাবেন। যেন পৃথিবীর কোথায় কোন সমুদ্রে কোন কোম্পানির কটা জাহাজ আছে, জাহাজের কি কি সুখ-সুবিধা, কোন কাপ্তান কেমন, কে নতুন কাপ্তান হয়ে কোথায় আসছে, কাপ্তান কি কি পছন্দ করে, এবং দরিয়ায় মানুষের জন্য আর কি সুখ-সুবিধা রাখা দরকার—অন্যান্য দেশের দরিয়ায় জাহাজিরা কি কি পেয়ে থাকে, ওরা কি কি পায় না, আসলে সব সময় ওর মাথার ভিতর বুঝি জাহাজী খবর ঠাসা থাকে। পৃথিবীতে আর কোন জীবন আছে, সুখ-দুঃখ আছে বুড়ো মানুষটা বুঝি জানেন না। অথচ তার দেরি হয়ে যাচ্ছে, বুড়ো মানুষটা কথা থামাচ্ছে না। মাসতারে সে সবার শেষে পড়ে যাবে। অবশ্য শেষে আগে বলে কিছু নেই। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা। ছায়া ছবির মতো বড় মালোম, মেজ মালোম অথবা মেজ মিস্ত্রি এসে সার সার দেখে যাবেন। ‘নলির’ ওপর উঁকি দেবেন। ক’ সফর, কনডাকট এসব দেখে ঝুড়িতে মাছ তুলে নেবার মতো তুলে নেবেন। ওর ‘নলি’ দেখে যদিও কেউ নেবে ভাবে—ওর মুখ দেখে কেউ নেয় না। জাহাজে কঠিন কদর্য শক্ত মুখ চোখ না হলে সমুদ্রের সঙ্গে যোঝা কঠিন। বড় মালোম মেজ মিস্ত্রি এটা জানেন।

সে তাড়াতাড়ি টিনের সেড পার হয়ে ক্যান্টিনের পাশ দিয়ে বের হয়ে গেল। রাস্তা পার হলে অন্য পাশে লম্বা দোচালা টিনের ঘর সব। সামনে মাঠ। কিছু ফল-ফুলের গাছ। এবং তার ছায়ায় মানুষের জটলা। সিটি লাইনের জাহাজের নাম গন্ধ নেই। সে আরও দ্রুত হেঁটে গেল। ভাল জাহাজ, কাজ কম, কম সময়ের সফর, বেশীদিন এক নাগাড়ে সমুদ্রে থাকতে হয় না। সে যত যাচ্ছে তত এসব মনে হচ্ছে। বেশ হয় জাহাজটা পেলে।

কে যেন তখন খবর নিয়ে এল—আসছে আসছে। লাইনে দাঁড়াও। সবাই যে যেখানে ছিল লাইনে জুটে গেল। খুব লম্বা লাইন। এনজিন রুমের জন্য ওদিকটায় মাসতার পড়েছে। সে ছুটে গেল ওদিকটায় একটু জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। চেনা জানা দু-একজনকে সে দেখতে পেল। ওর সঙ্গে ওরা ট্রেণিং নিয়েছে। এখনও জাহাজ না পেয়ে ঘুরছে। সে ওদের দেখে কেমন সাহস পেল সামান্য।

না, সেই এক রকমের ব্যাপার। নলিটা উঁকি দিয়ে দেখলেন মেজমিস্ত্রি। তারপর কাগজে টোকা মারলেন। এবং একবার চোখ তুলে ওর মুখটা দেখেই কি ভেবে আর আগ্রহ প্রকাশ করলেন না। সে বুঝতে পারছে না কেন এমন হয়। এই যে মেজমিস্ত্রি, ভীষণ সুপুরুষ, লম্বা, মাথায় এংকোরের ছবি আঁটা টুপি। কাঁধে দুটো করে সোনালি স্ট্রাইপ, এবং সিগার টানছিলেন। তিনিও তো এ জাহাজেই কাজ করছেন। সে আর দাঁড়াল না। ওর ধারণা, বেশী দেরী করলে সেই বুড়ো মানুষটাকে সে হারিয়ে ফেলবে। তাড়াতাড়ি দু’লাফে আবার রাস্তা পার হয়ে গেল। লাফ দিয়ে পার হতে গিয়ে চটি ছিঁড়ে গেল। চটিটা হাতে নিয়ে সে এখন ছুটছে এবং সিঁড়ির মুখে গিয়ে দেখছে, বুড়ো মানুষেটা নেই। সে চোখ গোল গোল করে বসে পড়ল। মনে হল হতাশায় নাকটা সামান্য লম্বা হয়ে গেছে।

তবু খুঁজতে হয়। সে খুঁজতে খুঁজতে ম্যাডিকেল রিপোর্টের ঘরটা পার হয়ে গেল। বাঁদিকে বড় রাস্তার ওপর যে ফুল বাগানটা রয়েছে সেখানে উঁকি মারল। একটু ডানদিকে ঘুরে পেশাপখানায় ঘুরে ঘুরে দেখল। অনেক মানুষের ভেতর বুড়ো মানুষটা নেই সে ভাবতে পারল না। এক হতে পারে চলে গেছে, অথবা ক্যান্টিনে, না কি নদীর পাড়ে চুপচাপ বসে রয়েছে। সে, সে-সব জায়গায় খুঁজে তারপর ক্যান্টিনে ঢুকতেই দেখল, বুড়ো মানুষটা হা হা করে হাসছেন।

সে ঢুকেই ডাকল, চাচা।

—হেই।

—জাহাজ হল না! সে বলতে বলতে কাছে চলে গেল।

—বোস। বুড়ো মানুষটা নিজের মানুষের মতো ওকে কাছে বসাল। বলল, আমার বিবিজান তো চলে আসছে। ভয় কি!

সে বুঝতে না পেরে তাকিয়ে থাকল। সারেঙ সাব এবার পাশাপাশি মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, জাহাজ পাচ্ছে না। কেউ নিচ্ছে না জাহাজে! মুখ দেখেই টের পাচ্ছে বাবু মানুষ। সখ করতে জাহাজে ঘুরতে যাচ্ছে।

—না না সখ করতে না চাচা। সখ করবার সময় কোথায়! একথা ঠিক না।

চা এসেছিল, বুড়ো মানুষটা চা, দুটো নিমকি বিস্কুট দিয়েছেন খেতে। সে খুব আগ্রহের সঙ্গে খাচ্ছে। এবং খাওয়া দেখেই কেন জানি টের পেলেন বুড়ো মানুষটা, ছেলেটার ভিতরে খুব খিদে। পেট ভরে খেতে পায় না।

বুড়ো মানুষটা এবার বললেন, জাহাজ আসছে। কাল। লম্বা জাহাজ। লম্বা ডেরিক। কাপ্তানের অসুখ। জাহাজ হোমে ফিরে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারছেন না। এখানে নেমে যাবেন। এবারের বাড়িয়ালা হিগিনস। সেই বুড়ো মানুষটা। কেবল চার্ট রুমে বসে বসে ঝিমোয়।

সোনা বলল, বাড়িয়ালা!

—আরে ঐ হল কাপ্তান। আমরা তো সারাজীবন বাড়িয়ালা বলেই চালিয়ে দিলাম। এখনকার ছোকরা জাহাজিরা এসব শুনে হাসে! তা যাক—শোন, তুই যাবি। এখনও ভেবে দেখ। সব বলে রাখা ভাল। তারপর বলবি, সব খুলে বলিনি। কাজেই ছেলে আমায় দোষ দিবি না। দিলে ভাল হবে না। আমার আবার বদনাম নিতে ভীষণ খারাপ লাগে।

আর যারা পাশে ছিল, ওরা একে একে উঠে যাচ্ছে। বুড়ো মানুষটা এবার খিস্তি করছেন। শালারা! শালারা ভেবেছে ব্যাঙ্ক লাইনের এডেন ব্যাঙ্কে যাচ্ছি। চাচা আমারে নিবা না, আমার কথা মনে রাইখ। বেইমান—যেই শুনেছে সিউল ব্যাঙ্কে যাচ্ছি, শালারা দেখলি কেমন সুর সুর করে উঠে গেল।

সোনা চা খেয়ে বেশ কথা বলতে জুত পাচ্ছে।

—ওরা চাচা তোমার সঙ্গে যাবে ঠিক ছিল!

—কিছু ঠিক ছিল না। ঘুরঘুর করার স্বভাব। বলে, বুড়োমানুষ উঠে দাঁড়ালেন। সব ফাঁস করে দিতে যেন এ-সময় বুড়োমানুষটাও আর সাহস পাচ্ছেন না।

সে বলল, আমি কিন্তু আপনার সঙ্গে যাব।

—যাবি যাবি। বুড়ো মানুষটা হাঁটছে আর গজগজ করছে। মুখগুলো চিনে রাখা দরকার। বেশ নানাভাবে গুছিয়ে আনছিলেন। সিউল ব্যাঙ্ক আর তেমন জাহাজ নেই। খোলনলচে পাল্টে একেবারে আলাদা। কি এর মেসরুম, কি এর ফোকসাল, চক্ পাল্টে বয়লার রিপেয়ার করে সব এখন এমন ঠিকঠাক যে কয়লা না দিলেও চলে। বেশ শুনছিল কথা কিন্তু যেই না শুনেছে বুড়ো মানুষটা আসলে সেই জাহাজেই যাচ্ছে, কাল আসছে জাহাজটা, তখনি সুর সুর করে ওরা উঠে গেল।—আচ্ছা দেখা যাবে, ভালো জাহাজ আমার নসিবে এলে দেখা যাবে—আর বলি জাহাজটা খারাপ কি! এখন তো কত জাহাজ, কত আরাম। আগে তো এসব ছিল নারে বাপু। আমরা কাজ করিনি! জাহাজ চালিয়ে সমুদ্র পার করে দিইনি—গজগজ করতে করতেই মনে হল—হ্যাঁ পাশে সেই ছেলেটা –কিছু জানে না, যেতে চায়—কালতো সিউল ব্যাঙ্কের মাসতার দিতে বললে, লাইন থেকে লোক পালাবে। অথবা কেউ দাঁড়াবে না। যারা ছ-সাত মাস থেকে জাহাজ পাচ্ছে না তারা নসিবের ওপর ভর করে বিশমিল্লা রহমানে রহিম বলে ঝুলে পড়বে। এসব যখন হবে বা হচ্ছে তখন ছেলেটাকে সব খুলে না বললে বুঝি ঠিক হবে না।

বুড়ো মানুষটা তখন গজগজ করছেন আর হাঁটছেন। রোদের ভিতর দিয়ে হাঁটছেন। খুব তাড়াতাড়ি হাঁটার স্বভাব। যেন এই বয়সেও দেখানোর স্বভাব বয়স তেমন হয়নি। কথা খুব তাড়াতাড়ি বলেন—আচ্ছা আচ্ছা বাপু তুমি এস। যাবে যখন বলছ যাবে। এখন আমাকে আর কথা বাড়িও না। তবে ভেবে দ্যাখো একবার, ভাববে, কেন মাসতারে কেউ দাঁড়াতে চায় না। সিউল ব্যাঙ্কের নাম শুনলে সবাই পালায়। এনজিনরুমের ক্রু কিছুতেই যোগাড় করা যায় না। সব অচল মাল শেষপর্যন্ত তুলে নিতে হয়।

বুড়োমানুষটা যত জোরে হাঁটছেন, হাতের ফোলিও ব্যাগটা যত জোরে দুলছে তত সে দ্রুত হাঁটছে পাশাপাশি। যেন ছুটে যাওয়ার সামিল। মাঝে মাঝে কথা বলতে বলতে পিছিয়ে পড়ছেন। খিদিরপুরের ব্রিজের কাছে বাস। কিছুটা পথ না হেঁটে গেলেই নয়—সুতরাং তারও বুড়ো মানুষটাকে কিছুটা পথ এগিয়ে দেবার মতো যেন কথা বলতে বলতে যাওয়া। কিন্তু অচল মালের কথায় আসতেই সে কেমন থমকে দাঁড়াল। অনেকটা পিছিয়ে পড়ল সে। হনহন করে মানুষটা দু’পাশের বাড়িঘর গাছপালার ছায়া ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। সে কেন এমন থমকে দাঁড়াল বুঝতে পারছেন না, তারপর ফের অচল মালের কথা মনে হতেই ডাকল—হেই!

—হেই। এস। এভাবে কেউ দাঁড়ায় না!

—হেই অচল মাল! সোনা জোরে জোরে হাসল। দুহাত ওপরে তুলে হা-হা করে হাসল।

—হেই অচল মাল! বুড়ো মানুষটাও জোরে হা-হা করে হেসে উঠলেন।

সে এবার ছুটে গিয়ে ধরে ফেলল বুড়োমানুষটাকে। তিনি বললেন, আসলে ওটা অচল জাহাজ, অচল মালে চলে। আসলে ওটাই হচ্ছে সবচেয়ে তেজী জাহাজ, জাহাজিরা তেজী। দুনিয়ায় তোমার এমন জাহাজ একটাই আছে।

—হিগিন্‌স্‌ আসছে জানো? হিগিন্‌স্‌ দুনিয়ার সেরা বাড়িয়ালা। ছেলেকে ছেড়ে কোথাও যায় না। অচল জাহাজ চালিয়ে নিয়ে যায় বলে কোম্পানি কিছু বেশি সুযোগসুবিধা দেয় হিগিন্‌স্‌ সাহেবকে। তুমি না দেখলে বুঝতে পারবে না, হিগিন্‌স্‌ সাহেব কী ভীষণ রগচটা মানুষ। কেবল ছেলেটার কাছে একেবারে জুজু। ওকে হাত করতে পারলে তুমি রাজার হালে থাকতে পার।

—কেমন বয়স?

—তোমার গিয়ে তেরো চোদ্দ হবে। একটু বেশি হতে পারে। ঠিক জানি না।

ওরা ক্রমে ব্রিজের ওধারে চলে গেল। এখান থেকে বুড়োমানুষটা বাসে উঠে যাবেন। সে যাবে কিসে জানে না। আসলে তাকে হেঁটে যেতে হবে। সুতরাং সে কিছু বলছে না। এখন দুটো চটিই হাতে। এবং সহসা বুড়ো মানুষটার মনে হল, এমন গরমের দিনে পিচের রাস্তার ওপর দিয়ে ছেলেটা হেঁটে এসেছে। মুখ লাল হয়ে গেছে। ভীষণ ঘামছে। জবজব করছে ঘামে। পায়ে ফোসকা পর্যন্ত পড়ে যেতে পারে। বুড়ো মানুষটা কি ভেবে বলল, চটিটা ঠিক করে নে।

সোনা জেব উল্টে দেখাল—নেই।

—যাবি কি করে?

—হেঁটে।

—কোথায় আছিস?

—দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়ি।

—খেতে দেয়?

—দেয়।

—আমার কাছে থাকবি? কোন অসুবিধা হবে না। একটা তো দিন। সোনা কেমন বিব্রত বোধ করতে লাগল।

বুড়োমানুষটা প্রথম বাসটা ছেড়ে দিলেন। পাশের একটা দোকানের শেডে দাঁড়িয়ে ফোলিও ব্যাগটা খুলে দেখলেন—কি আছে ব্যাগে। এবং কিছু পয়সা, এই রেজকি নোট মিলে টাকা তিনেকের মতো আছে দেখে বললেন, কিছু মনে করিস না। পয়সা কটা রাখ। কাল তোর জাহাজ হবে। পরশু,সাইন হবে। সাইন হলে টাকা পাবি। আমি তখন তোর টাকাটা কেটে নেব। কিছু মনে করিস না।

কখনও সখনও মানুষের চোখ-মুখ সজল হয়ে যায়। সে চারপাশে তাকিয়ে সেই সজল চোখ লুকিয়ে ফেলল মানুষটার কাছে। কত দিন পর, হ্যাঁ কতদিন পর একজন মানুষ তার দুঃখটা কি, সে কেন যাচ্ছে তার দেশ মাটি মানুষ ফেলে, টের পাচ্ছে। ওর মনে হল কতদিন পর আবার একজন মানুষ পৃথিবীতে তার যন্ত্রণা ঠিক ঠিক ধরতে পারছে। সে হাত পেতে পয়সা নেবার সময় সোজাসুজি তাকাতে পারল না। মনে হল মানুষটা অনেক উঁচু হয়ে গেছে। সে যতই মুখ তুলে তাকাক মানুষটার আসল মুখ দেখতে পাবে না।

পরদিন সে অবাক, সত্যি এতবড় একটা জাহাজে ক্রু নেয়া হবে অথচ ভিড় নেই। ডেক জাহাজিদের লাইনে ভিড়টা তবু আছে, কিন্তু এনজিন ক্রুদের লাইনে খুব কম। যত লোক লাগবে তার সিকিভাগও নেই। কারণ এনজিনে তিনটে বয়লার, তিন বয়লারের জন্য তিনজন করে প্রত্যেক ওয়াচে ফায়ারম্যান। তিনটে ওয়াচের জন্য সুতরাং ন’জন ফায়ারম্যান। প্রত্যেক ওয়াচের জন্য দুজন করে কোলবয়। মোট ছ’জন। দুজন ডংকিম্যান। তিনজন গ্রিজার, একজন কসপ, বড় টিণ্ডাল, ছোট টিণ্ডাল, সারেঙ। তাছাড়াও দুজন বাড়তি। খুন জখম, জাহাজ থেকে জলে ঝাঁপ দেওয়া এসব তো আছেই। কারণ সফরে এক দুজন মানুষ মরবে, বা জলে ভেসে যাবে এ-আর বেশি কি।

জাহাজের বড়-মালোম ডেক-জাহাজিদের বেছে নিচ্ছেন। এনজিনে কিছু বাছার নেই। গড়পড়তা সব। এমনকি দু-একজন ব্ল্যাকলিসটেড জাহাজী এ-ফাঁকে জাহাজ পেয়ে গেল। তবু হয় না। বুড়োমানুষটা ডেকে সেধে আনছেন। এনজিন জাহাজিরা কোথায় ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে তিনি জানেন। মেজমিস্ত্রি বড়মিস্ত্রি হিমসিম খাচ্ছে। ওরা জানে এমনটা হয়। জাহাজিরা যেতে চায় না এ জাহাজে। ঘুরেফিরে দুটো দল। হোমে যারা যায় তারাই আবার বছর ঘুরে এলে ফিরে আসে।

কিন্তু বুড়োমানুষটার হয়েছে ঝামেলা। তিনি শেষপর্যন্ত একজনকে টেনে টেনে নিয়ে আসছেন। ওর লুঙ্গি খুলে যাচ্ছে। মানুষটা একহাতে লুঙ্গি আগলাচ্ছে। বুড়োমানুষটা এখনও বেশ শক্তি রাখেন। তিনি টেনে আনছেন, প্রায় যেন টেনে হেঁচড়ে নিয়ে আসছেন—যাবে না, যাবে না বললেই হল। এবং বোঝা যায় যাকে টেনে আনা হচ্ছে সে এই বুড়ো মানুষটাকে সমীহ করে—তবু যেতে চায় না—কি যে ভয়!

সোনা এসব দেখেও ঘাবড়াল না। আর জাহাজ সে যখন পাচ্ছে না, এখানেও সে বেশিদিন থাকতে পারছে না, তখন যে কোনও জাহাজ, সে যত ভয়াবহ হোক, ভাবে না। সে যখন সাইন করে টাকা নিচ্ছিল তখনও বুড়োমানুষটা বললেন, ভেবে দ্যাখ। এখনও ইচ্ছা করলে থেকে যেতে পারিস। কিছুদিন অপেক্ষা করলে একটা ভাল জাহাজ মিলে যেতে পারে।

সোনা হেসেছিল। কিছু বলেনি। তার গুনে গুনে টাকা নেবার স্বভাব না, কারণ সে এই প্ৰথম পরিশ্রমের বিনিময়ে টাকাটা এডভান্স পাচ্ছে। এই টাকায় কেনাকাটা করে থাকে জাহাজিরা। অনেকদিনের সফর। সফর শেষে কবে ফিরবে, কি আদৌ ফিরবে না ঠিক থাকে না। তাছাড়া বসে খেলে যা হয়, জাহাজ থেকে দেশে ফিরে এলে চুপচাপ বসে থাকা, পয়সা নেই আবার জাহাজ না পেলে টাকা- পয়সা হয় না। সুতরাং এ-টাকাটার ভীষণ দাম জাহাজিদের কাছে। সে অবশ্য তত কিছু বোঝে না। কেবল সে জানে যতটা বেশি সম্ভব এর থেকে টাকা মাকে পাঠাতে হবে। টাকা তিনেকের মতো দিতে হবে চাচাকে। বাকি টাকাটা দিয়ে একজোড়া জুতো, একটা প্যান্ট, একটা জামা, টিনের একটা সুটকেস, মাজন, এখন রেজার-টেজার দরকার হবে না, গালের দাড়ি বেশ সামান্য কোঁকড়ানো এবং অল্পস্বল্প।

—বেশ একটা মুখে তার ঈশ্বর ঈশ্বর ভাব। সে এভাবে আরও অনেকদিন চালিয়ে দিতে পারবে। আরও কিছু কেনা দরকার। চাচাকে সে বলে জেনে নিতে পারে আর কি দরকার। সে ছুটে গিয়ে বলল, আর কি নিতে হবে।

চাচার ফদমতো সে নিল, একজোড়া নীল রঙের প্যান্ট, নীল রংয়ের জামা। এই পরে কাজ করতে হবে। পুরানো সু কারো যদি থাকে মেরামত করে নাও। বেশ শক্ত হতে হবে তলা। সে তাও নিল। সে বেশ ঘুরেফিরে কেনাকাটা করেছে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার সময় কেমন তার সবকিছুর ওপর দিয়ে উড়ে উড়ে যেতে ইচ্ছা হচ্ছিল। সে যেন বেশ একটা বিজয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। সে মাকে একটা চিঠি লিখতে পারে। লিখতে পারে—মা আমি জাহাজে যাচ্ছি, কবে ফিরব জানি না। আদৌ ফিরব কিনা তাও জানি না। একটা ভাঙ্গা জাহাজে সমুদ্রযাত্রা। কিন্তু সে লিখতে পারে না। মা তার তবে ভীষণ ভাববে। কেবল টাকাটা পাঠিয়ে দেবে জাহাজ ছাড়ার ঠিক একদিন আগে—এবং মা বুঝতে পারবে তার নিখোঁজ ছেলে জাহাজে চলে যাচ্ছে। অথচ তখন করার কিছু থাকবে না।

এই কলকাতা শহরে সে আজ প্রায় তিন মাস এগারো দিনের মতো আছে। এদিক ওদিক করে আড়াই মাসের ওপর ভদ্রা জাহাজে ছিল রোববার ছুটির থাকত ছিল। সাদা কোর্তা পরে নীল রঙের জাহাজি পোশাক আর সাদা টুপি মাথায় সে কখনও হেঁটে হেঁটে অথবা অল্প পয়সার ট্রাম ভাড়ায় ঘুরে বেড়িয়েছে—এই শহর কি বড়, ‘আর কত মানুষ, মানুষেরা এখানে কেউ কেউ রাস্তায় শুয়ে থাকে, রাস্তায় মরে যায়। এসব দেখলে মনে হত সেও রাস্তায় একদিন এভাবে না খেতে পেয়ে মরে পড়ে থাকবে।

এখন আর এসব মনে হয় না। বড় বড় শো-কেসগুলোর আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। একটা বড় জাহাজ, তার ওপর সে যেন দাঁড়িয়ে আছে, আর সমুদ্রে কি যে স্বপ্ন থাকে মানুষের, সে যাচ্ছে কোলবয় হয়ে, সবচেয়ে কঠিন এবং পরিশ্রমের কাজ। তার প্রথম সফর, কোলবয় প্রথম সফরে, দ্বিতীয় সফরে সে ঠিক ফায়ারম্যান হয়ে যাবে, আর একটা সফর দিতে পারলে সে গ্রিজার, তারপর টিণ্ডাল। একটা পরীক্ষা, ওর তো ততদিনে জাহাজি অভিজ্ঞতা হয়ে যাবে, সে তো কলেজের পড়াশুনা কিছুটা এগিয়ে রেখেছে, সে তো ইংরেজি খুব ভাল জানে, অঙ্কে সে ভালো। পরীক্ষায় বসলে অনায়াসে বি-এ-ও- টির কাছাকাছি কিছু একটা সার্টিফিকেট পেয়ে যাবে। তারপরই সে জাহাজের ফিফ্থ এনজিনিয়ার, তার পরেই ফোর্থ, থার্ড, সেকেণ্ড চিফ। এমন সব স্বপ্নের ভেতর দিন তার কেটে যায়। এমনভাবে সে এই বড় শহরের ওপর দিয়ে কখনও হেঁটে যায়নি। কেমন ভয় ভয় ছিল। মানুষজনের ভিড়ে ওকে খুব অসহায় মনে হত। এখন সে বেশ প্রায় লাথি মেরে সব উলটে পালটে যেন হেঁটে যাচ্ছে। হাঁটার ভেতর কিছুটা হাওয়ায় ভেসে যাবার মতো ভাব তার।

হাঁটতে হাঁটতেই কেন জানি মৈত্রের কথা মনে পড়ল। মৈত্র এসেই ওকে বলেছিল, কি নাম? সে নাম বললে বলেছিল, ছোটবাবু তুমি জাহাজের?

—ছোটবাবু!

—কোলবয়দের আমি ছোটবাবু ডাকি।

মৈত্র সঙ্গে যাচ্ছে। অমিয় বলে ওর চেয়ে একটু বেশি বয়সী আরও একজন জাহাজী যাচ্ছে। সেও কোলবয়। মৈত্র টিণ্ডাল। সে কাজ করত রয়েল নেভিতে। নৌ বিদ্রোহের দুটো একটা গল্প গাছের ছায়ায় সকলকে দাঁড় করিয়ে বেশ হাত নেড়ে নেড়ে শুনিয়ে দিয়েছে।

মৈত্র বেশ তাজা মানুষ। খুব হাসিমশকরা করতে ভালবাসে। ডেকে আরও দুজন আছে। ওদের সঙ্গেও আলাপ করে নিতে হয়েছে। আসলে, দীর্ঘ সমুদ্র-যাত্রায় ওরাই সব। চাচা বলছে, এরা তোমার জাতভাই ছেলে। আর তো সব আমার জাতভাই। আগে তো কেউ তোমাদের ছিল না। এখন দুচারজন, ট্রেনিং নিয়ে জাহাজে আসছে।

আসলে সোনা বোধহয় এতটা সাহস পেত না এই শহরকে উপেক্ষা করার। চাচা এবং মৈত্র সঙ্গে আছে বলেই তার এত সাহস। এবং সমুদ্র সফর যেন খুব বড় কাজ, এই শহরের অলিগলিতে পচে মরার চেয়ে, অসীম সমুদ্র-যাত্রায় এক কঠিন সুখ আছে। তুমি ছোটবাবু অনায়াসে সব মানুষকে অবহেলা করতে পার। এই শহরকে লাথি মারতে পার।

মৈত্রকে দেখলে এটা বিশ্বাস করা যায়। জাহাজে মারামারি করতে গিয়ে দু-দুবার ব্ল্যাকলিস্টেড হয়েছে, গর্বের সঙ্গে বলে। সে পরোয়া করে না, বেশ একটা অহমিকা নিয়ে আছে, যেন কোনও ভয় নেই বাছারা আমরা সবাই ঈশ্বরের সন্তান। কোন শালা কার চেয়ে কম। মৈত্রর এমন সব কথাবার্তা শুনে সে মাঝে মাঝে হেসে ফেলেছে।

—তাহলে ছোটবাবু জাহাজে মুখ গোমড়া করে থাকবে না।

সোনা বলেছিল, না না।

—কষ্ট হয় হবে। পারবে না যখন বলবে, আমরা আছি। কিছু লজ্জা করবে না বলতে। জাহাজে ওঠার সময় মৈত্র আগে। সে পিছনে। লম্বা সিঁড়ি। এক এক করে সবাই উঠে যাচ্ছে। মৈত্র বেশ লম্বা। খুব শক্ত মানুষ। বড় একটা সেলার হাতে। মাথায় তালপাতার নীল টুপি। মোটা বেল্ট কোমরে আঁটা। এবং জুতো কুমীরের চামড়ার। বেশ শক্ত মজবুত এবং হাঁটু পর্যন্ত জুতোর চামড়া উঠে গেছে। কিছুটা গামবোটের মতো দেখতে। সে পরেছে লাল রঙের পাতলা গেঞ্জি। সে তারপর পিছনের দিকে তাকালেই দেখল অমিয় কিং জর্জ ডকের তিন নম্বর জেটিতে দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে কথা বলছে।

আর সে যা দেখল, কেমন নিঝুম একটা জাহাজ। মাস্তুলে একটা পাখি বসে আছে। সিঁড়ির ওপাশে একটা বড় জাহাজ থেকে মাল নামানো হচ্ছে। তার অতিকায় শব্দ, আর সব সারি সারি ক্রেনের নিচে জাহাজিরা এক এক করে উঠে আসছে দল বেঁধে।

জাহাজে ইউনিয়ান জ্যাক উড়ছে। এই জাহাজে সে এখন ছোটবাবু।

সোনার এসব খেয়াল থাকার কথা না। সিঁড়ি ধরে ওঠার সময়ই সে ঘাবড়ে গেছে। কি লম্বা সিঁড়ি, কি খাড়া! খুব সন্তর্পণে উঠে গেছে। এবং গ্যাঙওয়েতে মাত্র একজন রয়েছে। এবং বোধহয় কোয়ার্টার মাস্টার সে। বুড়ো মানুষটা বসে বসে একটা মাছ ধরার জাল বুনছে। মাঝে মাঝে কেবল জিজ্ঞাসা করলে জবাব দিচ্ছে—ওদিকে। জাহাজিদের সে আস্তানা দেখিয়ে দিচ্ছে।

সোনা দেখল বেশ বড় জাহাজ। সে হেঁটে গেল—সে জমুনা বাজু ধরে হাঁটছে। আগে যারা উঠে এসেছিল তারা পিছিলে দাঁড়িয়ে আছে। সে তাদের ভিতর চাচাকে দেখতে পেল। খুব সকালে চাচা সবার আগে চলে এসেছেন। মৈত্র কাছে থাকায় যত না সাহস ছিল, জাহাজে চাচাকে দেখে সে আরও সাহসী হয়ে গেল। সে বেশ লাফ দিয়ে দিয়ে যেন উঠে যাচ্ছে। বাঁদিকে বড় বড় ফলকা পার হয়ে প্রায় কাছাকাছি গিয়ে বলল, কোনদিকে?

—নিচে নেমে যা। সিঁড়ি আছে সামনে। তোদের পছন্দ মতো ফোকসাল দেখে নে।

এসব ব্যাপারে যা হয়, ছোটবাবু, মৈত্র, অমিয় একসঙ্গে একটা ফোকসাল বেছে নিল। ওপরে নীচে দুটো দুটো চারটে বাঙ্ক। এটা পোর্ট-সাইড, এবং পোর্ট-সাইডে সব এনজিন ক্রুদের বুঝি থাকবার নিয়ম। সে বেশ তাড়াতাড়ির মাথায় তার বাঙ্কটা দখল করে নিলে মৈত্র বলল, এটা নিলে ছোটবাবু সামলাতে পারবে তো?

ছোটবাবু বলল, জানি না।

—এটা নাও। তোমার ভাল হবে। দেওয়ানি কম পাবে।

সে ভালমন্দ বোঝে না। চারপাশে কেমন একটা গন্ধ। রঙ বার্নিশ মিলে একটা পোড়া পোড়া গন্ধ। সে মোটা ম্যাট্রেসের ওপর একটা চাদর পেতে দিল। তখন মৈত্র বলল, একটু চা হলে ভাল হত ছোটবাবু। চা করে আনছি। তুমি বরং দেখে এসো অমিয় উঠে আসছে কিনা।

তখন অমিয় উঠে আসছিল। ওর লটবরহ যেন অনেক। এত লটবহর নিয়ে সে উঠে আসতে পারছে না। ওর কাঁধে বড় দুটো কিডস ব্যাগ। সঙ্গে একটা নীল রঙের লম্বা টিন, ডান হাতে একটা সুটকেস্, সঙ্গে ফ্ল্যাকস। বাঁ হাতে কোন রকমে সমস্ত শরীরের ব্যালেন্স রেখে সে উঠে আসছে।

ছোটবাবু তাড়াতাড়ি নিচে নেমে ওর কাছ থেকে টিনটা নিয়ে নিল। আরও সে দেখল বড় একটা ট্রাঙ্ক। এসব নিয়ে অমিয় জাহাজে উঠে আসছে। ওর ভারি অবাক লাগল, টিনের ভেতর মুড়ি, মোয়া নাড়। ওর মা ওর জন্য সমস্ত সফরে কি কি কষ্ট হতে পারে ভেবে বাঁধাছাঁদা করে যাবতীয় সুখ- সুবিধা ওর সঙ্গে গুছিয়ে দিয়েছে। ছোটবাবু অমিয়র দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেলল।

সারাটা সকাল এভাবে একজন দুজন করে উঠে আসছে। কিং জর্জ ডকের চারপাশে যখন সব বড় বড় ক্রেনগুলো বড় বড় জাহাজ থেকে মাল নামাচ্ছে, সূর্য বেশ মাথার ওপর কিরণ দিচ্ছে, এবং ভীষণ গরম, ফোকসালে টেঁকা যাচ্ছে না, ডেক-সারেঙ এনজিন-সারেঙ ছুটোছুটি করছে, কাজকাম বুঝে নিচ্ছে তখন ছোটবাবু দেখল, একজন বুড়ো মতো মানুষ জেটিতে খুব দামী গাড়ী থেকে নামছেন। সঙ্গে এক টেডি বয়। ঠিক টেডি বয় বললে ভুল হবে, চুল কেমন নীলাভ রঙের, কালো প্যান্ট সাদা হাফসার্ট, হাতে একটা ক্যামেরা, চোখ ভীষণ নীল, সমুদ্রে গেলে এ চোখের রঙ কেমন হবে সে এখন বলতে পারে না।

জাহাজের সব অফিসারেরা এখন খবর পেয়ে গেছে, ক্যাপ্টেন হিগিনস জেটিতে নেমেছেন। ওরা ছুটে ছুটে সিঁড়ি ধরে নেমে গেল। বড় মালোম জাহাজ থেকেই হাত তুলে ওয়েলকাম করছে কাপ্তানকে সব জাহাজিরা এসে ভিড় করছে রেলিঙে। এনজিন-সারেঙ নেমে গেছে নিচে। জাহাজের সর্বত্র ঘটাঙ ঘটাঙ শব্দ। আর সেই বুড়ো মতো মানুষ, সঙ্গে তার একমাত্র সন্তান, আগে আগে বেশ নিরিবিলি, যেন তার সব দেখা, জানা। পুরানো জাহাজের গন্ধে টের পান জাহাজের হাল তবিয়ত কেমন আছে, রেলিঙে হাত রেখেই টের পান, এ-সফরে কতটা নসিবে দুর্ভোগ আছে। তিনি সিঁড়ি ধরে উঠতে উঠতে গল্প করে যাচ্ছেন। কারণ সবাই তো তাঁর চেনা জানা। অনেক সফর এদের সঙ্গে তার কেটেছে। বড় মালোম তো বনিকে গত সফরে দেখেছে। বনিকে এ-সফরে দেখেও বড় একটু ঘাবড়ে যেতে পারে।

তবু কি করা ঠিক, কাপ্তান স্থির নিশ্চয় কিছু জানেন না। কোনটা ভাল ছিল। এই নিয়ে আসাটা ভাল, না রেখে আসা ভাল ছিল। তিনি সেজন্য এ-ব্যাপারে বড়কে মোটামুটি কিছু বলবেন। বড় যে একটা প্রশ্ন তুলবে তিনি ওঠার মুখে বড়র মুখ দেখে টের পেয়েছেন। যেন বড় এতে খুশি হয়নি। অন্য কেউ এটা জানে না বলে তারা বনিকে বেশ হেইল করছে। বনি আবার কতদিন পর—আঃ সেই জাহাজ! বনি এখন হয়তো ডেকে উঠেই সারা ডেকময় ছুটে বেড়াবে। ওর দৌরাত্ম্য মাঝে মাঝে বড় বেশি কষ্টদায়ক।

কাপ্তান বুড়ো, ভীষণ বুড়ো, লম্বা, একটু নুয়ে গেছেন। কালো প্যান্ট, সেই সাদা হাফসার্ট, গলায় টাই। গরমে ঘামছেন। চোখ সাদাটে! নীল রঙটা চোখে কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। প্রথমেই ওঁর যা অভ্যাস, জাহাজে উঠেই ব্রীজে দু’বার পায়চারি করা। দু’বার পায়চারি করলে সমস্ত জাহাজটা চোখের ওপর কেমন আশ্চর্য জ্যান্ত হয়ে যায়। যেন জাহাজটা আর জাহাজ থাকে না, কাপ্তান হাত তুলে হেই বলে চিৎকার করে ওঠেন—হেই, হেই ডার্লিঙ এসে গেছি।

বনির আলাদা ঘর। কাপ্তানের আলাদা ঘর। ঠিক ব্রীজের পিছনে চার্ট রুম। চার্ট রুমের পাশে কাপ্তানের কেবিন। এবং তার ঠিক নিচে বনির কেবিন।

তিনি বনিকে নানাভাবে বুঝিয়েছেন, জাহাজে তুমি বড় হয়ে যাবে। তুমি আর আগের মতো চলাফেরা করলে চলবে না। তুমি মনে রাখবে সমুদ্রযাত্রা ভয়ঙ্কর সাহসী কাজ। সেখানে নানা কারণে বিদ্রোহ দেখা দিতে পারে। তুমি জাননা বনি—এই ইণ্ডিয়ান জাহাজিরা কত ভদ্র। তাদের তুমি উৎপাত কর না। অবশ্য বনি বলেছে, আমি দুষ্টুমী করব না বাবা, আমি ভাল হয়ে থাকব। তোমাকে আমি দুঃখ দেব না।

সিঁড়িতে তিনি তখন শব্দ পেলেন, ক্যাপ্টেন বয় সালাম জানাতে এসেছে। তিনি তাকে বললেন, দু’কাপ কফি পাঠাবে। জ্যাকের কেবিনে এক কাপ

আসলে বনি এখন এ-জাহাজে জ্যাক হয়ে গেছে। গত সফরেও বনি জ্যাক ছিল। চিফ-মেটের সঙ্গে একটু পরামর্শ দরকার। সেও তো তার মত বয়সী মানুষ। এবং বনিকে ভীষণ স্নেহ করে থাকে। তিনি দেখলেন পাইপটা নিভে গেছে। বাইরে তখন চিফ-মেটের গলা, স্যার আসতে পারি?

—ইয়েস্ কাম্ ইন্।

চিফ-মেট এসে চুপচাপ টেবিলের পাশে বসল। মাস্টার পিছন ফিরে আছেন। উনি একটা খৃষ্টের ছবি দেয়ালে টানাচ্ছেন। ওটা সব সময় ওঁর সঙ্গে থাকে। এবার যে আরও বেশি বুড়ো হয়েছেন ওঁর হাত কাঁপা দেখে চিফ এটা টের পাচ্ছে। সে এগিয়ে বলল, দিন। আমি ঠিক করে দিচ্ছি। কারণ যতবার এটা কাপ্তান করতে গেছেন ততবার কেমন ছবিটা তেড়চা হয়ে গেছে। ঠিক সোজা থাকছে না। কাপ্তানের চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। এ-সফর তার শেষ সফর। তিনি যত ঝড় সাইক্লোন থাকুক, খারাপ ওয়েদার থাকুক, চোরা হিমবাহ থাকুক, সমুদ্রের নিচে গোপন পাহাড় থাকুক, তার ডার্লিংকে বন্দরে ঠিক ভিড়িয়ে দিতে পারবেন। অথচ এবার কেমন একটা অমঙ্গলের আশঙ্কা। ছবিটা সোজা থাকছে না। চিফ এসে ছবিটা সোজা টানিয়ে দিলে কিছুটা শান্ত মুখে যেন বসতে পারছেন। কফি খেতে খেতে চিফই প্রথম বলে ফেলল, এবারও বনিকে নিয়ে এসেছেন দেখছি।

—কিছুতেই থাকতে চায় না।

—কিন্তু ওতো বড় হয়ে যাচ্ছে। আমরা কবে ফিরব ঠিক কি। ততদিন পর্যন্ত ওকে ছেলে সাজিয়ে রাখা যাবে?

কাপ্তান বললেন, জানি না কি হবে। কিন্তু না নিয়ে এসেই বা উপায় কি! কার কাছে রেখে আসব, কেউ রাখতে চায় না। হোসটেল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। কোনও আইনকানুন মানতে চায় না।

তারপর আর কোনও কথা না। বড়-মালোম আর কাপ্তান চুপচাপ কেবল গরম কফি খেয়ে যাচ্ছেন। ওঁরা শুনতে পাচ্ছেন, বনি ওর রেকর্ড-প্লেয়ারে একটা পপ গান বাজাচ্ছে। বনি বোধহয় এমন শান্ত আকাশ, নিরিবিলি নদীর ছবি দেখে চুপচাপ থাকতে পারছে না। সে কেবিনের ভেতর নাচছে আর গাইছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *