1 of 2

অলৌকিক জলযান – ১৭

।। সতেরো।।

এখন জাহাজ ইউকাটান প্রণালীতে ঢুকে গেছে। পোর্ট-অফ জ্যামাইকা ছেড়ে আসার তিন চার দিনের ভেতরই জাহাজ ম্যাকসিকো উপসাগর পেয়ে গেল। পেছনে পড়ে থাকল নানারকম দ্বীপমালা। যেমন কিউবা এবং তার পাশাপাশি অসংখ্য সব দ্বীপ। দ্বীপের ছড়াছড়ি এ-অঞ্চলটাতে। কত বিচিত্র সব নাম। ভূগোল বইয়ে এদের হয়তো কোনও উল্লেখ নেই। কোনো জরিপমালাতে হয়তো একটা বিন্দুর মতো রয়েছে এদের অবস্থান। তবু কি যে সুন্দর লাগে এদের পাশ দিয়ে যখন জাহাজ যায়। কিছুতেই বিশ্বাস হয় না পৃথিবীর মানচিত্রে এদের কোনও উল্লেখ নেই।

এভাবে সমুদ্রের দু’পাশে জাহাজ ফেলে এসেছে নানারকম দেশ। পোর্টসাইডে রয়েছে বৃটিশ হণ্ডুরাস। অথবা গুয়াতেমালা, নিকারগুয়া এবং অন্যপাশে যেমন স্টারবোর্ডের কথাই ধরা যাক, আছে পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের অসংখ্য নারকেল গাছ অথবা আনারস কিংবা আখের খেতের ছবিয়ালা দ্বীপ, কিংবা বড় বড় পিচের হ্রদ। কিউবার পাশ কাটিয়ে কিছুটা নাক উঁচিয়ে ঢুকে যাবার মতো জাহাজটা এল-কুইয়োর পাশাপাশি এসে গেছে। এখন সোজা নব্বই ডিগ্রি বরাবর ওপরে উঠে গেলেই নিউ- অর্লিয়নস্ বন্দর। মিসিসিপির মুখে এই বড় বন্দরে জাহাজ আপাতত যাচ্ছে।

ব্রীজে পায়চারি করছে তিন নম্বর মালোম। রাত তখন এগারোটা বাজতে দশ মিনিট। আর পুরো এক ঘণ্টা দশ মিনিট ওর ওয়াচের সময়। সময়টা যথেষ্ট, সে এ-সময়টুকুর ভেতর তার হাতের যা কাজ সেরে ফেলতে পারবে। লুক-আউট ডিউটিতে আছে পাঁচ নম্বর জাহাজি মান্নান। অস্পষ্ট অন্ধকারে আফটার-পিকের মাথায় ওর ছায়াটা নড়ছে। অন্ধকার রাত। চারপাশে কিছুই চোখে পড়ছে না। তবু মাঝে মাঝে কাচের ভেতর দিয়ে দূরবর্তী নিহারীকাপুঞ্জ দেখতে ভীষণ ভাল লাগে। আকাশ পরিষ্কার থাকলে এটা তার হয়। মন মেজাজ ভাল না থাকলে এটা হয়। সে সারাক্ষণ আকাশে নক্ষত্রমালা দেখে রাত কাবার করে দিতে পারে কারণ, তার মন ভাল না থাকলে চোখে ঘুম আসে না। সে যতদূর জানত, জাহাজ ভিকটোরিয়া পোর্ট থেকে নেবে লৌহ আকরিক। তারপরই জাহাজ হোমের দিকে মুখ ঘুরিয়ে দেবে কারণ কথা এমনই ছিল, কিন্তু জাহাজ বুয়েনএয়ার্স থেকে ছাড়বার সময়ই সে সব টের পেয়ে যায়। এবং সেই থেকে মন খারাপ।

সে বাণ্টির চিঠি পেয়েছে। বাণ্টির সঙ্গে দু’বছরের পরিচয়। এবং কথা আছে সেকেণ্ড মেটের পরীক্ষায় বসে তারপর ভেবে ঠিক করা যাবে বিয়ের দিন। বাণ্টির চিঠি চারদিন আগে এসেছে। ওর বাবা তেলবাড়িতে চলে যাচ্ছে। ও এখন আপাতত একা আছে ব্রিমিংহামে। সে ভেবেছিল, থার্ড ফিরে গেলে কিছুদিনের জন্য ইউরোপের দেশগুলোতে ঘুরে বেড়াবে। যদিও পছন্দ করে না থার্ড, বরং সে যে-কদিন হোমে থাকে, অন্তত সে-কদিন কোথাও নড়তে চায় না। কোন বড় রাস্তা ধরে ওর হেঁটে যেতে ভাল লাগে। অথবা ওর বাবার খামারে আলু কিংবা বাঁধাকপির চাষ কেমন হল, সে বাবার সঙ্গে তখন খামারে খাটতে ভালবাসে। এবং এভাবে সে হোমে ফিরে গেলে কি কি করত মনে মনে ভাবছে। বাণ্টিকে সে যেখানে খুশি চুমো খেত অথবা কোন রেস্তোঁরাতে বসে হৈ-চৈ অথবা যদি কোন গীর্জা থাকে তার পাশে চুপচাপ নীরবে বসে থাকা, কিন্তু জাহাজ হোমে যাচ্ছে না বলে, সে কিছুটা কর্তব্যে শীথিল, কাজ করতে ভাল লাগছিল না। তবু তাকে কিছু কাজ সেরে ফেলতেই হবে। সময় পিছিয়ে দেওয়া একটা বড় কাজ। তাকে ওয়াচে ত্রিশ মিনিট ঘড়ির কাঁটা পিছিয়ে দিতে হবে। এ-ভাবে ঘড়ির কাঁটা পিছিয়ে দেওয়া এবং লগ-বুকে সব নোট করে রাখা তার কাজ। লুক-আউট- ডিউটির পাঁচ নম্বর জাহাজি তখন হঠাৎ দুম করে একটা বেল বাজিয়ে দিল।

থার্ড অফিসার তাড়াতাড়ি স্টাবোর্ড-সাইডে ছুটে গেল। এবং ঝুঁকে দেখল—অন্ধকারে একটা জাহাজ উঠে আসছে। কিছু সিগনালিঙের কাজ থাকে তখন। হোয়াট সিপ, বাউণ্ড ফর দি পোর্ট, এ-সব জেনে নিতে হয়। কোথায় যাবে জাহাজ, কোন দেশের, কি লাইন। কোথা থেকে এল। এমন সব খবর নেওয়া দরকার। অথবা ওরা যে সমুদ্র পার হয়ে এসেছে, তার ওয়েদার রিপোর্ট—এবং এসব জেনে নেওয়া ভাল। অথচ মন খারাপ বলে সে কিছুই করল না। দুটো একটা সিগনালিঙ পাঠিয়ে যখন বুজতে পারল, না কোনোই জবাব পাওয়া যাচ্ছে না, জাহাজটা চলে যাচ্ছে, থার্ড মেট আর কোনও সিগনাল পাঠাল না। কাপ্তান বুড়ো মানুষ। এখন হয়ত তিনি জেগে থাকার নামে বেশ ঘুমোচ্ছেন। ওঁর কেবিনে সোজা তো ঢুকে যাওয়া যায় না। সে দু-একদিন দেখেছে, বেল বেজে উঠলে তিনি কেমন ফোলা ফোলা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে দরজা টেনে বলেন, কাম ইন। বারোটা-চারটায় ডিউটি দিতে আসছে সেকেণ্ড-মেট ডেবিড। যদি লগ-বুকে কিছু নাও লিখে রাখে ডেবিড হয়তো কিছু বলবে না। কেমন ছেলেমানুষ ডেবিড। ডেবিড বয়সে বড় এবং সোজাসুজি কথা বলতে ভালবাসে বলে, থার্ড ডেবিডকে সবার চেয়ে বেশি মান্য করে থাকে। যত ঝামেলা বুড়ো কাপ্তানকে নিয়ে। ডেবিডকে তার ওয়াচ বুঝিয়ে যেতে হবে এবং যেহেতু এটা কাপ্তানের ওয়াচ, সে কাপ্তানের হয়ে কাজটা করে থাকে, তাকে বেশি ঝামেলা পোহাতে হয়। ওয়াচের পর প্রায় অনেকক্ষণ তাকে কাপ্তানের ঘরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। যতক্ষণ তিনি সই না করে দিচ্ছেন, যতক্ষণ তিনি সবকিছু দেখে নিচে সই করে না দিচ্ছেন, ততক্ষণ সে যেতে পারে না।

এবং এজন্য তাকে সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে হয়। এত বার সে নির্ভুল করতে চেয়েছে রিপোর্ট, কিন্তু কেন যে সে দেখেছে, কোথাও না কোথাও তিনি ঠিক ভুল ধরে ফেলেন। আজ সে যেন একটু স্বাধীনভাবে দেখতে চাইল, কাপ্তান সত্যি ঘুমোন কিনা। বুড়ো হলে যা হয়ে থাকে, খুব খুঁতখুঁতে স্বভাবের, যেন সবদিকে ঠিক নজর আছে এমন দেখাতে চান। এবং সে জানে মাস্টার যতই বড় কথা বলুক এত রাত পর্যন্ত জেগে থাকেন না; বরং তার পাশে ঘড়ি থাকে, ঠিক সময় হলে হয়তো তাঁকে জাগিয়ে দেয়। এবং এসব ভেবে যখন বেশ একটা মজা করা যাবে ভেবেছিল তখন কেন যে মনটা খচখচ করছে। কি জানি, যদি তিনি সত্যি জেগে থাকেন। সে তো বাণ্টির কথা ভাবতে ভাবতে কেমন অতলে ডুবে গেছিল। যেন লুক-আউট ডিউটির পাঁচ নম্বর জাহাজির সব দোষ। আরে বাবা সামনে পাহাড় কিংবা দ্বীপ-টিপ না পড়লেই হল। অন্ধকার। কিছু দেখা যায় না, চড়ায় জাহাজ আটকে গেলে ভয়াবহ ব্যাপার। দ্বীপ, পাহাড়, অথবা একেবারে নাক বরাবর জাহাজ এলে ভয়। কলিসান এড়াতে বেল বাজাও। কোথাও দূরে কি একটা জাহাজ নেমে যাচ্ছে—কি যে দরকার বুঝি না। আসলে ঘুম, এই মধ্যরাতে ভীষণ ঝিমুনি আসে এবং জেগে থাকার জন্যই কেবল যেন মাঝে মাঝে বেল বাজানো।

মধ্যরাতে এভাবে মনটা খিচে গেলে সে দেখল ঘুম ঘুম চোখে ডেবিড এসে দাঁড়িয়েছে। কোয়ার্টার- মাস্টার মহসীন চলে যাচ্ছে। তিন নম্বর কোয়ার্টার মাস্টার এসেছে ওয়াচ বদল করতে।

ডেবিড ঘুম ঘুম চোখেই বলল, কোনো খবর নেই?

—কিসের খবর?

—জাহাজ কোথায় যাচ্ছে।

—নিউ অরলিনস্ যাচ্ছে।

—সেটা আপাতত। তারপর কোথায়। পোর্ট অফ সালফার কথা ছিল, সেখানে যাচ্ছে না? সালফার বোঝাই হবে নিউ অরলিনসে। আবার শুনছি, জাহাজ আর চালাবে না কোম্পানী। জাহাজ এবার স্ক্র্যাপ করার অর্ডার হয়েছে।

—স্ক্র্যাপ! বলছেন কি! এত রাতে এমন খবরে থার্ড কেমন হতবাক।

—ভাঙ্গা জাহাজ! আর কতদিন চালাবে।

—সেতো শুনেছি আরও ক’বার স্ক্র্যাপ করার কথা হয়েছিল।

—হয়েছিল। এবারও হয়েছে। কিন্তু আমাদের কপাল যাবে কোথায়! শেষ পর্যন্ত হবে না। স্ক্র্যাপ করা যাবে না। অর্ডারে সই করবে কে!

-কেন, কোম্পানীর যারা মালিক!

—তুমি কিচ্ছু জান না। এ জাহাজে প্রথম সফর। জানবেই বা কি করে! পাইপে আগুন ধরাতে গিয়ে হাওয়ায় আগুন নিভে গেল ডেবিডের।

—জানি কিছুটা, বলে ডেবিডের পাইপে আগুন ধরিয়ে দিল। বলল, একটা দুর্ঘটনা ঘটে যায়, আর কর্তৃপক্ষ স্ক্র্যাপ করতে সাহস পায় না।

—তবে আবার কথা বলছ কেন! দেখে যাও। তবে যা অনুমান, সে যে অর্ডারই আসুক, আমরা বেঁচে থাকতে এর রহস্য উদ্ধার করতে পারব না। বেঁচে থাকতে এটা স্ক্র্যাপ করা হচ্ছে না।

আসলে ওরা রহস্যের কথা বলতে গিয়ে এই জাহাজের এতদিন টিকে থাকার রহস্যের কথা বলছে। জাহাজের বয়সকাল নির্ণয় করা যাচ্ছে না। তবে এটা যে প্রথম মহাযুদ্ধের আমলের জাহাজ তার রেকর্ড কোম্পানীর ঘরে রয়েছে। কোম্পানীর ঘরে এর আগের নাম সিনারা, জার্মান সিপ এবং কোন এক সি-ডেভিল ছিল জাহাজের কাপ্তান। তার সব নানারকম কাহিনী আছে, এবং সেই সি-ডেভিল বার বার বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়েছে এমন সব ঘটনাও নাকি কোম্পানীর ঘরে লিপিবদ্ধ আছে। আর আছে ওর কনভয়ে ছিল, কিছু যুদ্ধে আহত মানুষ এবং জাহাজটাকে যখন ধরে আনা হয়েছিল, তখন দেখা যায় ক্যাপ্টেন লুকেনার নিহত। তিনি তাঁর কেবিনে মৃত অবস্থায় পড়েছিলেন। ধরা পড়ার আগে আত্মহত্যা করেছিলেন। এটা একরকমের ইতিহাস জাহাজ সম্পর্কে। লুকেনার ধরা পড়ার মুহূর্তে সব নেম প্লেট, এবং কবে কোথায় জাহাজের নির্মাণ হয়েছিল তার সব হদিশ মুছে দিতে আদেশ দিয়েছিলেন। সেই থেকে জাহাজটা নামগোত্রহীনের মতো, তবু যা হোক ব্যাঙ্ক লাইন খুব সস্তায় কিনে জাহাজটাকে ফের সমুদ্রগামী করে তুলেছিল।

সুতরাং জাহাজিদের মুখে নানা গুজবে শোনা যায় মাঝে মাঝে। যে জন্মায় না, সে মরে না। সিউল ব্যাংকের কোন জন্মসালই নেই, সে আদতে মরবে কিনা, অর্থাৎ তার কোন শেষ আছে কিনা কেউ বলতে পারে না। যদি জাহাজ নিউ-অরলিসে গিয়ে আর না চলে, অর্থাৎ স্ক্র্যাপ করার পাকা অর্ডার পেয়ে যায়—তবে কি যে মজা! ডেবিড তবে ঠিক একমাসের ভেতরই এবির কাছে চলে যেতে পারছে। বোধ হয় ডেবিড এমন একটা স্বপ্ন এতক্ষণ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখছিল। সে বলল, অল রাইট! অল-ও-কে? সে একটা স্বপ্ন দেখছিল তার চোখ মুখ দেখে তা বোঝা যাচ্ছে। স্বপ্নটা স্বপ্নই। তবে জাহাজ স্ক্র্যাপ করার কথা এখন উঠছে না। তবে উঠতে কতক্ষণ! সে স্বপ্নে দেখেছিল জাহাজের সব প্লেট খুলে দেওয়া হয়েছে। একটা কঙ্কালের মতো জাহাজের সব রিবগুলো বন্দরে ঝুলছে। ক্যাপ্টেন হিগিনস মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন জেটিতে; পাশে সে দেখতে পেয়েছিল ছোটবাবুকে। ছোটবাবু পুরো পোশাকে এবং বোধহয় কালো রঙের সুট এবং গোলাপী নেকটাই আর কি সুমহান চেহারা ছোটবাবুর। আর কি যেন স্বপ্নে, হ্যাঁ একজন ব্যালাড সিংগারের মতো মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সাটিনের ফ্রক গায়, ছোটবাবুর পাশে সেও দাঁড়িয়ে আছে। আর একজন, সে কে? কিছুতেই মনে আসছে না। সাদা দাড়ি, সাদা চুল, লম্বা মানুষ, বেশ লম্বা, মাথায় সাদা টুপি এবং কিছুটা তীর্থযাত্রীর মতো দেখতে। ক্যাপ্টেন হিগিনসের পাশে সেও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণে সে ধরতে পারল তিনি এনজিন-সারেঙ। প্রায় গোটা স্বপ্নটাই চোখের ওপর সত্য হয়ে দেখা দিলে ডেবিড উইংসের একপাশে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে গেল। থার্ড অফিসার নেমে যাচ্ছে। অন্ধকার রাতে, জাহাজের এমন একটা নীরবতার ভেতরও বোঝা যাচ্ছে, পাঁচ ছ’মাসেই সবার ভেতর ভীষণ একঘেয়েমি এসে গেছে। থার্ড- মেট নেমে যাচ্ছে, যেন ঘুমে টলতে টলতে নামছে। বড় শ্লথগতিতে সে নামছে। সে কি হাঁটতে হাঁটতে অথবা সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে ঘুমুচ্ছে! সে কি কাপ্তানের ঘরে ঘুমের ঘোরে ঢুকে যাবে। ডেবিডের ইচ্ছে ছুটে গিয়ে থার্ড-মেটকে জাগিয়ে দেয়। কিন্তু তখনই মনে হল, দরজা খোলার শব্দ। থার্ড-মেট কাপ্তানের ঘরে পৌঁছে গেছে। তার আর নিচে নামার দরকার নেই।

আসলে এটা হয় জাহাজিদের। সফরের সময় যত বাড়তে থাকে তত তিক্ততা বাড়ে। মেজমালোম ডেবিড যা জানত এখন তার উল্টো। সে ভেবেছিল জাহাজ যখন হোমে ফিরবে তখন, কিছুদিন হোমে থাকা, অন্তত ফের এই ভাঙা জাহাজে সফর করতে এক্ষুনি উঠতে হবে না। কিন্তু বুয়েনস্- এয়ার্সে চার্ট করতে গিয়ে বুঝতে পারল, জাহাজের গতি কাপ্তান পাল্টে দিচ্ছে। জাহাজ আপাতত আর হোমে ফিরছে না। কবে ফিরবে কেউ ঠিক বলতে পারবে না। স্বয়ং কাপ্তান নিজেও না। এমন এক কাজ নিয়ে জাহাজ ভেসে পড়বে যে, কেউ আর তখন হোমে ফেরার কথা ভাবতে পারবে না। এসব মনে হলেই মুখে ভয়ঙ্কর বিস্বাদ। আর তখন সারাটাক্ষণ সেই দূরবীণ, পোর্ট অথবা দ্বীপ দেখলেই যা হয়ে থাকে,একটু দেখে ফেলা এবং এসব দেখার ফলেই আজগুবি সব স্বপ্ন, না হলে জাহাজের নিচে কাপ্তান, এবং ছোটবাবু, অথবা ব্যালাড সিংগারের মতো মেয়ে এসব দেখার কি মানে! আর তারপরই যা হয়ে যায়, সে স্বপ্নে পাতলা কুয়াশার ভেতরে কি দেখতে পায়, এবং এভাবে তার রাতের পোষাক নষ্ট হয়ে গেলে মনে হয়, এক্ষুনি সে নিজে বড় একটা হাতুড়ি নিয়ে দমাদম ঘা মারবে জাহাজের বালকেডে। ভাঙ্গা জাহাজ সে একেবারে ভেঙ্গে দেবে।

আর তখন কাপ্তান লগবুকে নুয়ে কী দেখছেন! কি যে এত দেখেন, থার্ড-মেট বুঝতে পারে না। প্রায় তো ঘুরেফিরে একইরকম রিপোর্ট। যতক্ষণ মাথা তুলে লগ-বুক ওকে ফিরিয়ে না দেবেন ততক্ষণ সে সোজা সরল বৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে থাকবে। এবং প্রায় এক নাগাড়ে বিড় বিড় করে পড়ে যাবার মতো, তিনি প্রতিটি কলামের ওপর অর্থাৎ যা যা আছে যেমন—সঠিক কি কোর্স জাহাজের, জাইরো কমপাসের কি কোর্স, জাহাজের যদি কিছু ভুলভ্রান্তি থাকে তারপর স্ট্যাণ্ডার্ড কমপাসের কি কোর্স এবং কি ডিভিয়েশন, বাতাসের গতিপ্রকৃতি, ওয়েদার এবং তার ভিজিবিলিটি, যদি সমুদ্রে ঝড় থাকে তার সি-হাইট, অবশ্য এখন ঝড় নেই বলে, কলামটা তার কাছে তেমন জরুরী নয়, বরং বাদ দিয়ে যাবার মতো পরের কলামে কি আছে দেখার সময় একবার কি ভেবে চোখ তুলে থার্ড-মেটকে দেখলেন, কিছু বললেন না। তারপর আবার টিক, এই শালা ভাঙ্গা জাহাজে কাপ্তানের নক্কিপক্কি বিরক্তিকর। থার্ড-মেটের ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। অথচ মুখে হাসি হাসি ভাব। কি খুশী দাঁড়িয়ে থাকতে পেরে! কাপ্তানের জন্য সে এভাবে যে কতকাল দাঁড়িয়ে থাকতে পারে!

তখনই ট্যাংক এবং বিল সাউন্ডিং-এর ঘরে এসে পেনসিলটা কানে গুঁজে ডান পাটা বাঁ পায়ের ওপর রেখে, ঠিক অনেকদিন আগের মতো যেন যৌবনেই আছেন হিগিনস্ এমনভাবে থার্ড-মেটকে দেখলেন। জাহাজের ড্রাফট ভীষণ কমে গেছে। খালি জাহাজ। ডিপ ট্যাংক নাম্বার ওয়ান, টু, থ্রিতে জল নেই বললেই চলে। এবং এভাবে জাহাজ নিয়ে চলা ভীষণ রিস্ক। এক নম্বর হোল্ডে দু নম্বর হোল্ডে জল যতটা থাকা দরকার তার চেয়ে কম। তিন নম্বর চার নম্বরে যতটা থাকা দরকার তার চেয়ে বেশি। এখুনি বড় মিস্ত্রি রিচার্ডের ঘরে রিপোর্ট পাঠিয়ে দিতে হবে জল কোথায় কি আছে! ওরা ওদের লগবুকে একবার দেখে নিক। কোথাও ভুলভ্রান্তি হতে পারে। এতসব খুটিনাটি দেখার পরে তার মনে হল কোর্স মেড গুড। তারপর তিনি নাবালকের মতো পাখি সব করে রব পড়ে যাবার ঢঙে পড়ে গেলেন—টোটেল আওয়ার্স ইউজড রাডার পাঁচ, ডি. এফ. —দুই তারপর দেখলেন ক্লক কতটা পিছিয়ে দেওয়া হল এবং ইফ এনি এংকোর বিয়ারিঙ। এতসব দেখেও শেষ হয় না, জাহাজের পজিসান ল্যাটিচুড লংগিচুড দেখলেন এবং পাশে দেখলেন অবজার্ভিং অফিসারদের সাইন।

এত কি যে দেখার আছে। থার্ড-মেটের চোখে কি যে ঘুম! সে তবু একেবারে সোজা। কোন কষ্ট হচ্ছে, বুঝতে দিচ্ছে না। জাহাজ ভাঙ্গা বলে কাপ্তান ভীষণ খুঁতখুঁতে স্বভাবের! না কি এই জাহাজই মানুষটার সব। জাহাজের হাল তবিয়ত সব ঠিক না থাকলে মানুষটারও বুঝি কিছু ঠিক থাকে না। তার তখনই বুকে কম্প দিয়ে জ্বর আসার মতো হৃৎপিণ্ডে ওর জ্বর এসে গেল। যা খুব সাহসী মানুষের মতো মনে হয়েছে, এখন তাকে তাই হৃৎপিণ্ডে ঝড় তুলে দিচ্ছে। সিগনালিঙ না করে যেন ভালো করেনি। কাপ্তান আটটা বারোটায় সত্যি ঘুমোন না। আদৌ তিনি ঘুমোন কিনা এ মুহূর্তে বিশ্বাস করতে কষ্ট হল। মানুষটা কবে থেকে যেন এ-জাহাজে জেগেই বসে রয়েছেন। সে এখন কিভাবে যে পালাবে।

আর তখন তিনি চোখ না তুলেই বললেন, খারাপ লাগছে?

থার্ড-মেট মাথা চুলকাল।

তিনি বললেন, এ-কাজে আসা কেন!

থার্ড-মেট ভীষণ ঘেমে যাচ্ছে।

–শরীর ভাল নেই?

থার্ড-মেটের হাঁটুতে কাঁপুনি ধরে যাওয়ার মতো। এবং যেন এক্ষুনি মাস্টার চিৎকার করে উঠবেন, গেট এলংগ দেয়ার ইউ লোফার! কিন্তু তিনি তা না বলে শুধু বললেন, খুব শান্তভাবে, এ সেলর উইল এনডিউর মেনি এ হার্ডসিপ! সিগনেলিঙ সম্পর্কে তিনি একটা কথাও বললেন না, বললেন, ইউ মে গো, তিনি সই করে ছেড়ে দিলেন।

তারপর তিনি শুতে যাবার আগে একবার নিচে নামেন। ঠিক নিচেই বনি ঘুমোচ্ছে। বনিকে নিয়ে মাঝে মাঝে খুব অসহায় বোধ করেন। এখন হয়তো মেয়েটা পা মুড়ে শুয়ে আছে। হয়তো এমন গরমেও পাখা চালাতে ভুলে গেছে। এবং দরদর করে ঘামছে। নিচে নেমে তাঁর কিছু করার থাকে না। কারণ ভেতরের দিকে দরজা বন্ধ। দরজা না খুললে তিনি কিছু দেখতে পান না। তবু এটা অভ্যাসের মতো, শুতে যাবার আগে একবার নিচে নেমে দেখা। বনি যত বড় হচ্ছে এবং তিনি যত বুঝতে পারছেন বনি এই জাহাজে এখন মেয়ের মতো থাকতে চায়, তত যেন তিনি সতর্ক হয়ে যাচ্ছেন।

এবং এ ভাবেই হিগিনস আবার সিঁড়ি ধরে ওঠার সময় দেখতে পান, চারপাশে শুধু অন্ধকার, কালো সমুদ্র, কালো আকাশ, গভীর উজ্জ্বল নক্ষত্র, এবং সমুদ্রের ঠাণ্ডা বাতাস এখন মাংকি-আয়ল্যাণ্ডের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। তিনি তখন বুঝতে পারেন শেষ রাতের দিকে সমুদ্রের বাতাস ঠাণ্ডা হতে আরম্ভ করেছে। এবং এখন গিয়ে শুধু শুয়ে পড়া। শোবার আগে একবার নাইট অর্ডার বুকটা চেয়ে নেবেন। সেকেণ্ড-মেটকে বলে দিতে হবে, রাত তিনটেয় একটা বাতিঘর দেখা যেতে পারে, তখন যেন তাকে ডেকে দেওয়া হয়। এসব ভেবে কেবিনের ভেতর যা যা তিনি এই মধ্য যামিনী অন্তে করে থাকেন হাঁটু মুড়ে বসা খৃষ্টের মূর্ত্তির সামনে এবং দেখলেই মনে হবে, মহামহিম ঈশ্বরের কাছে একজন রণক্লান্ত সৈনিকের আত্মনিবেদন—মাথাটা নুয়ে আছে, সাদা চুল মাথায় কদম ফুলের মতো ধবধবে, পাশেই জ্বলছে একটা স্তিমিত আলো, এবং নানারকম সব মোটা বই, কিছু মানচিত্র, যদিও একধারে ওগুলো সরানো, তথাপি মনে হয়’যে যী সাস নিরন্তর এই জাহাজের সীমাহীন নির্ভরতা, কারণ তাঁর মাথার ওপরে তিনি আছেন। এবং নিচে লেখা, ও দাই লর্ড, ইয়োর সি ইজ সো ভাস্ট, এণ্ড মাই বোট ইজ সো স্মল….এবং তখনই মনে হল, একটা চাপা গোংগানি কোথাও থেকে উঠে আসছে। মনে হচ্ছে একদল লোক ছুটে আসছে নিচে, কেউ দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে এবং অন্ধকারে এত রাতে এমন কোলাহল ভাবতেই দরজার সামনে চিৎকার, ঘোস্ট!!

মিঃ হিগিনস কিছু বুঝতে পারছেন না! একেবারে হতভম্ব।

বড়-মিস্ত্রি রিচার্ড এখন এলিওয়ের কার্পেটের ওপর সংজ্ঞাহীন। রিচার্ড কথা বলতে বলতে শেষ পর্যন্ত আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি। চোখ গোল গোল, এবং লাল টকটকে। শরীরে কোন পোশাক নেই। আতঙ্কে বোধহয় ওর মাথা ঠিক ছিল না। সে বোধহয় কেবিন থেকে লাফিয়ে একদণ্ড দেরি করেনি। ছুটে আসার সময় বোধহয় চিৎকার করছিল ফলে কারো কারো ঘুম ভেঙ্গে গেছে। ওরা দরজা খুলে দেখছে এলি-ওয়ে ধরে বড়-মিস্ত্রি একপায়ে ছুটছে। উলঙ্গ হয়ে ছুটছে। গরমকাল, গায়ে পোশাক রাখা যায় না। যে-যার কেবিন থেকে দেখছিল। এবং ওদেরও খুব একটা শরীরে পোশাক ছিল না। তাড়াতাড়ি কিছু জড়িয়ে সবাই যখন কাপ্তানের দরজায় হাজির তখন সবাই দেখতে পাচ্ছে, কাপ্তান নিচে নেমে একটা পাতলা চাদরে বড়-মিস্ত্রির শরীর ঢেকে দিচ্ছেন। এবং সবাইকে বলছেন, ওকে ওর কেবিনে রেখে আসতে। ব্যাপার কিছু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।

আর তখনই বড়-মিস্ত্রি ফের ধড়ফড় করে উঠে বসল। সে শুনেছে মিঃ হিগিনস তাকে তার কেবিনে রেখে আসতে বলেছেন। সে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল, নো, নো…..। সবাই ভাবল যাক জ্ঞান ফিরেছে। সবাই কিছুটা যেন আশ্বস্ত। এখন তবে সত্যি কেবিনে পাঠানো যায় না। কে যেন ছুটে বড়-মিস্ত্রির জন্য একটা হাফপ্যান্ট নিয়ে আসতে গেল। কেউ ওর মুখে মাথায় জলের ঝাপটা দিল। বনি পর্যন্ত চিৎকার চেঁচামেচিতে জেগে গেছে। সেও ভুল করে ফেলেছিল। তাড়াতাড়ি গাউন খুলে লম্বা ঢোলা জামা, আর পাজামা পরে ওপরে উঠে এলে, সে না হেসে পারল না। এমন ধাড়ি মানুষটা একেবারে খোকা! ভূতের ভয়ে কেবিন থেকে পালিয়ে এসেছে, আর এই নিয়ে ঠাট্টা সোরগোল যত এমন সব হচ্ছিল তত রেগে যাচ্ছে বড়-মিস্ত্রি। মেসরুম বয়কে দিয়ে এক কাপ গরম কফি এনে খাইয়ে দেওয়া হয়েছে। এবং কাপ্তান এখন একটু ঘুমোবেন। জাহাজে বড়-মিস্ত্রির দায়িত্ব তাঁর চেয়ে কম নয়। অথচ এখন ছেলেমানুষের মতো ভয়ে ঘামছে। তিনি কিছুটা বিরক্ত না হয়ে পারছেন না। ঘোস্ট জাহাজে থাকে, এবং বয়স বাড়ার সঙ্গে এ-বিশ্বাসটা তার যে না হয়েছে তা না। তার জন্য এভাবে উলঙ্গ হয়ে ছোটা এবং চিৎকার চেঁচামেচি করে সবার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেওয়া ঠিক না। সব কিছু জীবনে সহজভাবে মেনে নিতে না জানলে জাহাজে আসা এবং কাজ করা শক্ত। অবশ্য এতটা তিনি রিচার্ডকে বলতে পারেন না, বলতে পারেন শুধু, কি দেখেছো?

রিচার্ডের মুখ চোখ এখনও কেমন আতঙ্কে ডুবে আছে। সে শুধু বলল, ঘোস্ট! সে আর কিছু বলতে পারছে না। সাদা চোখে চারপাশে কি খুঁজছে!

—কোথায়? কাপ্তান প্রশ্ন করলেন।

রিচার্ড কিছু বলছে না আর। ওর টাকমাথা, গোলগাল ফুটবলের মতো চেহারা সত্যি ভারি হাস্যকর! কিছুটা এখন মানুষ না ভেবে, মানুষের ডামি ভাবা ভাল। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে থার্ড-মেট। ভেতরের দিকে চিফ-মেট। সেকেণ্ড-এনজিনিয়ার ওর ঘাম মুছিয়ে দিচ্ছে।

কাপ্তান জোরে পাখা চালিয়ে দিলেন, দরজা ফাঁকা করে দিতে বললেন, এবং বয়বাবুর্চি যারা ভিড় করেছিল, তাদের চলে যেতে বললেন। স্টুয়ার্ডের এখন অনেক কাজ, কখন কি লাগবে, কাপ্তান তাকে যেতে না বললে যেতে পারে না সে। সেও বাইরে বোট-ডেকে পায়চারি করছে। সেকেণ্ড-মেট এসে, ফিস ফিস করে কি বলে গেল বনিকে। বনি এবার হা-হা করে হেসে উঠল। এটা কাপ্তানের নিজেরও ভাল লাগল না, সবাই হয়তো একটু বেয়াড়া ভাবল বনিকে। কাপ্তান বনির দিকে চেয়ে বললেন, তুমি জেগে থাকবে না বনি। নিচে যাও।

সুতরাং বনি আর থাকতে পারে না, বনি এমনিতে রিচার্ডকে পছন্দ করে না, বন্দরে বনি দেখেছে, খোঁড়া লোকটা ভীষণ ধূর্ত। ধূর্ত না হলে সব বন্দরেই সে মেয়ে পাবে কি করে! কি সব সুন্দর সুন্দর মেয়েরা এই ধূর্ত লোকটার কাছে ধরা দেয়। সে টাকা দিয়ে ওদের পুষে রেখেছে। যেন লোকজন ঠিক করাই আছে, অথবা সে এই গোটা পৃথিবীর অধীশ্বর, যখন যে বন্দরে থাকবে, সেখানেই ভোগের নিমিত্ত উপাচার। উপাচার না হলে এই ধূর্ত মানুষটা আরও শয়তান হয়ে যায়। যত শয়তান হয়ে যায় তত বেশি দাবার ছকে ঝুঁকে থাকে। ভেতরের অদম্য আকাঙ্ক্ষাকে সে কেমন নিজের প্রতিপক্ষ ভেবে খেলায় মেতে গিয়ে ভুলে থাকে! বনির এমনই মনে হয় খোঁড়া লোকটাকে দেখলে। ওর ইচ্ছে ছিল ক্রাচ দুটো বন্দরে ঢোকার আগে সমুদ্রে সবার অলক্ষ্যে ফেলে দেবে। এবং এভাবে যদি লোকটাকে অন্তত একটা বন্দরে অকর্মণ্য করে রাখা যায়। কিন্তু কি আশ্চর্য সে তার বাবার টেবিলের পাশে, এলি-ওয়েতে এমনকি বোট-ডেকে কোথাও ক্রাচ দেখতে পেল না। সে তাহলে একপায়ের ওপর ভর করে এতটা ওপরে উঠে এসেছে! সে নিজেই কেমন ভেবে ফেলল, রিচার্ড নিজেই একটা ভূত। ভূত না হলে সারাদিন সারামাস সমুদ্রে কারো সঙ্গে একটা কথা না বলে থাকা একেবারে অসম্ভব।

তারপরই মনে হল, সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি। জাহাজে তবে এই রিচার্ডের চেয়েও বড় ভূত আছে। সে রিচার্ডকে খুব কাবু করে ফেলেছে। বনির খুব ইচ্ছে হল ফের জোরে হাসে। সেকেণ্ড- এনজিনিয়ার কর্তার মুখে আতঙ্ক দেখে কি ভালমানুষ! যেন কিছু জানে না কিছু বোঝে না! বনি দরজা বন্ধ করার সময় বলল, আর্চি তুমি আরও বড় ভূত। সব আমি বুঝি। আমাকে পুরুষ ভেবেই এত, মেয়ে জানতে পারলে না কি করতে!

সকালবেলা খবরটা জাহাজে ফের রটে গেল। বড়-মিস্ত্রি জাহাজে ভূত দেখেছে। এবং ভূত দেখে বড়-মিস্ত্রি সোজা এক পায়ে লাফিয়ে কাপ্তানের কেবিনের সামনে মূর্ছা গেছে। কাপ্তান এটা ক্রুদের ভিতর রটে যাক চাননি। তিনি বয় বাবুর্চিদের বলতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন। স্টুয়ার্ডকে ডেকে বলেছিলেন, এসব ভূত টুত সংক্ৰামধ ব্যাধি। একজন দেখলে সবাই একে একে দেখতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ভূতের ভয়েই জাহাজে বিদ্রোহ দেখা দেবে বিচিত্র কি! তিনি এই সব ভেবে শেষ পর্যন্ত স্টুয়ার্ডকে এমন বলেছিলেন। তাছাড়া রিচার্ড জাহাজে তার পরেই, এমন একজন মানুষের পক্ষে ভূত দেখা ঠিক না, দেখলেও আতঙ্কে হৈ-চৈ বাঁধিয়ে দেওয়া আরও বেঠিক। এবং তিনি নিজেও এ-বয়সে মাঝে মাঝে দেখতে পান এলিস তার পাশ কাটিয়ে কেবিনে ঢুকে যাচ্ছে, এমনকি মনে হয় গাউনের বাতাস শরীরে পর্যন্ত লাগছে! মাঝে মাঝে এলিসের শরীরে সঠিক আতরের গন্ধটা পর্যন্ত পান! কেবল মাঝে মাঝে খুব বেশি ভয় হলে বনিকে ডাকেন, তারপরই বুঝতে পারেন মনের ভুল। তিনি আগের মতো হয়ে যান। বনিকে বলেন, না কিছু না। আর কিনা রিচার্ড একটা আহাম্মকের মতো ভূতের ভয়ে মুর্ছা গেল!

রিচার্ডের কেবিন পাল্টে দেওয়া হয়েছে। আর বিস্ময়কর ঘটনা, জাহাজে রিচার্ডের পেছনে পেছনে লরেনজো-মরকুইসের ঘাট থেকে উঠে এসেছে তাজা একজন ভূত। অথবা বলা যায় ঘাটে ঘাটে সেই এক মুখ, সে ভেবে পায় না এটা কি করে সম্ভব!

রিচার্ড বলেছিল কাপ্তানকে, ডারবানে ওকে আমি ফের দেখি। শহরের একপাশে একটা অন্ধকার মতো জায়গায় সেই রেল ব্রীজ পার হয়ে, সেই এক মুখ, ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, ওর জন্য আমি জাহাজে ফিরে আসতে পেরেছিলাম, ও আমার জেব খালি না করে দিলে ঠিক কারো ঘরে চলে যেতাম। এসে দেখি মিলড্রেড আমার কেবিনে। ওকে ধন্যবাদ জানানো দরকার ভেবেছিলাম।

হিগিনস আর্চি অথবা ডেবিড এমন শুনে প্রথমে ভেবেছিল পকেটমার-টার হবে। বড় বেশি নেশা করে পোর্টে নামলে এমনতো হবেই। কিন্তু পরে যা বলল রিচার্ড, তাতে ওরা বোকা বনে গেল।

রিচার্ড বলেছিল, ধন্যবাদ জানাতেই দেখলাম অন্ধকারে মিশে গেল ছায়াটা। সঙ্গে সঙ্গে, বিশ্বাস করুন মিঃ হিগিনস ঈশ্বরের দোহাই, আমার কম্প দিয়ে জ্বর এসে গেল। কোথায় লরেনজোমরকুইস, কোথায় ডারবান, সেই লোকটা হুবহু এক রকমের দেখতে, আমি এতটুকু ভুল দেখিনি। মেয়েমানুষের দালালটা আমার পেছনে এভাবে কেন যে লাগল! কাকে আমি বোকার মতো ধন্যবাদ জানাতে গেলাম!

সবাই চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল। রিচার্ড শুয়ে আছে তখন। ওর পাশে সবাই জেগে। ওর কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে বোঝা যাচ্ছিল। কাপ্তান সবটা না শুনে যেন নড়তে পারছিলেন না।

—আমি কিন্তু কাউকে কিছু বলিনি। আমার সাহস তো কারো চেয়ে কম নয়, বলেই ফ্যাক ফ্যাক করে কেঁদে দিয়েছিল বড়-মিস্ত্রি। দোহাই আপনার মিঃ হিগিনস জাহাজ থেকে আমি নেমে যাব। আপনি অন্য কাউকে দেখুন।

কাপ্তানের চোখ কপালে ওঠার দাখিল তখন। তিনি বলেছিলেন, তারপর?

—তারপর ফের বুয়েনএয়ার্সে। বেশ কিছদিন ভাল ছিলাম। শহরে বেশ ক’দিন যাওয়া-আসা হচ্ছে। আর কিছু দেখছি না। বেশ ভাবলাম, ঘাড় থেকে ভূত নেমে গেছে। কিন্তু হায়, ঐ সেদিন, মানে যেদিন আপনার শহরে বেশ গণ্ডগোল, আইখম্যান পালিয়ে আছে, তাকে ধরার জন্য কারা ফাঁদ পেতেছে এবং গণ্ডগোল, সেদিন তো আপনি জানেন মিঃ হিগিনস্, কি কুয়াশা সারা শহরময়। বন্দরে আমাদের নামতে উঠতে পর্যন্ত অসুবিধা হচ্ছিল, সেদিন সন্ধ্যায় দেখি কুয়াশার ওপর দিয়ে ভেসে ভেসে এল, এসে ঠিক আমার মুখের ওপর ঝুঁকে, আমি কি করি বলুন, একেবারে মুখের ওপর দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। সেই মুখ, নীল পোশাক, কামানো দাড়ি গোঁফ দেখতে ইণ্ডিয়ানদের মতো। হুবহু এক, এক চেহারা। জাহাজে কখনও কোন বড়-মিস্ত্রি দালালদের পয়সা মেরেছে বলে জানি না। আপনি জানেন স্যার? পয়সা মারলে মরার পর শোধ নিতে পারে। আমি তো এক পেনি কাউকে ঠকাইনি! তবে আমার কেন এমন হল। আবার কান্না।

কাপ্তান বিরক্ত হয়ে বললেন, মনের ভুল রিচার্ড। তুমি মনের ভুলে এ-সব দেখে যাচ্ছ। তারপর কাঁটার মতো ইণ্ডিয়ান কথাটায় খোঁচা খেলেন। তিনি তাকালেন চীফ-মেটের দিকে।—তুমি কিছু বুঝতে পারছ।

চীফ-মেট বলল, নো স্যার।

—তুমি? তিনি আর্চির দিকে তাকালেন।

—নো স্যার।

—আমাদের জাহাজের কেউ পিছু লাগেনি তো!

আর্চি হাসল। এত সাহস তারা পাবে কোথায়?

স্টুয়ার্ড ডাকল, স্যার।

হিগিনস স্টুয়ার্ডের দিকে তাকালে সে কেমন আমতা আমতা করে বলল, কিছু একটা জাহাজে আছে স্যার। বলেই সে তার অভিজ্ঞতার কথা বলল। কারণ সে, রাতে কখনও কখনও সহসা জেগে যায়। তার মনে হয়, ঠাণ্ডা ঘরের দরজায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে। সে উঠে দরজা খুলে দেখেছে স্টোর- রুমের দরজা তেমনি লক করা। সে তবু ভেবেছে ভেতরে যদি কিছু হয়ে থাকে! দরজা খুলে আলো জ্বেলে দিতেই ওপরে তেমনি কাপ প্লেট ডিস, নানাবর্ণের ক্রোকারিজ, এবং পাশে সিঁড়ি, নিচে নেমে গেছে। ডানদিকে সব্জির পাহাড়। ফল এবং ডিমের ঝুড়ি থাকে থাকে সাজানো। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, আর সামনে কোল্ড স্টোরেজ, বড় বড় গরু ভেড়া মুরগীর মাংস আস্ত হুকে ঝুলছে। কেউ ভেতরে টেবিল টেনে বসে নেই। বাটলার তখন ভীষণ ঠাণ্ডা মেরে যেত। শাক-সব্জি এবং মরা মাংস মিলে একটা উৎকট গন্ধ থাকত, ভয়ে সে তাও টের পেত না।

ডেবিডও একবার ঘুরে গেছে, কেমন আছে রিচার্ড দেখার জন্য। সে এসে বলেছিল, কিছু হয়তো আছে জাহাজে। সে বলল, ছোটবাবুও ভূত দেখেছে। এবং তার সমর্থন চারপাশ থেকে। কাপ্তান জানেন, যে কেবিনে, রিচার্ড থাকে, ঠিক সেই কেবিনে, লুকেনার আত্মঘাতী হয়েছিল। যদিও এ-সব তিনি বাজে কথা ভেবে থাকেন, যদিও মাঝে মাঝে আবার মনে হয় হয়তো কোথাও এর সত্যাসত্য আছে, কারণ, তিনি এই সমুদ্র অথবা সৌরজগতের কতটুকু জানেন। তখনই রিচার্ড ফের উঠে বসেছিল, আপনি বিশ্বাস করুন মিঃ হিগিনস, বন্দরে না হয় হল, কিন্তু জলে, বিশ্বাস করুন আমার জন্য একটা ডিম একটা আপেল, অবশ্য ডিম একটা নয়, সে স্টুয়ার্ডের সঙ্গে বন্দোবস্ত করে একটার বদলে দুটো নেয়, দুটো নিতে পারে না, নেওয়ার নিয়ম নেই, সে সেজন্য একটা ডিমের কথা বলল।

সে বলেছিল মিঃ হিগিনস আমার সঙ্গে রোজ মেসরুম-বয়ের ঝগড়া হত। সকালে আমি ডিমের অমলেট খাই। নিজেই করে নিই। একটা আপেল খাই, খুব সকালে। তখন কেউ ঘুম থেকে ওঠে না। কিন্তু ক’দিন থেকে দেখি টেবিল থেকে সব উধাও।

হিগিনস মেসরুম-বয়কে ডেকে সব জেনে নিতে পারতেন। কিন্তু কি হবে! তিনি চুপচাপ শুনে যেতে থাকলেন।

রিচার্ড বলেছিল ফের, প্রথম মনে হতো অধিক নেশার জন্য আমি ভুল দেখছি। একটা লম্বা কালো হাত, গলে পড়ছে পোর্ট-হোলে। কি কালো! তারপর কেমন শূন্যে ঝুলে থাকত আপেলটা কিছুক্ষণ। চোখের ওপর এমন ঘটলে কতদিন আমি মাথা ঠিক রাখি বলুন!

রিচার্ড ফের বলেছিল, আজকে আমি কিছু খাইনি। মুখ শুঁকে দেখুন। সে প্রায় উঠে কাপ্তানের মুখের কাছে হা-হা করতে থাকল। কোনো গন্ধ আছে! নেই। তবে। আমি দেখলাম, পোর্টহোলে সেই মুখ, বীভৎস ভয়ঙ্কর। আমি নেমে যাব। আমি আর জাহাজে থাকব না। আপনি আমাকে কিছুতেই রাখতে পারবেন না মিঃ হিগিনস।

হিগিনসের মনে হয়েছিল অকেদিন থেকে রিচার্ড একটা ভয়ের ভেতর পড়ে গেছে। ভয়ের ভেতর পড়ে গেলেই নানাভাবে মন দুর্বল থাকে। সে তখন কখনও লম্বা হাত, এবং বীভৎস মুখ দেখতে পায়। আপেল অথবা ডিম চুরি যাবার ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। বয়-বাবুর্চিদের স্বভাব খুব ভাল না। বড়-মিস্ত্রি যখন সব সময় মৌজে আছেন, তখন তারাও একটু মৌজে থাকার জন্য ছল চাতুরী খেলতে পারে। তিনি মেসরুম বয়কে ডেকে ধমকে দিয়েছিলেন। তারপর তিনি ঘড়ি দেখে বুঝতে পেরেছিলেন, সকাল হতে দেরি নেই। অন্ধকারে তিনি বোট-ডেকে উঠে গিয়েছিলেন। চারপাশের নিস্তব্ধ অন্ধকারে, আকাশের নক্ষত্রমালার ভেতর কি দেখতে দেখতে ভেবেছিলেন এভাবে এত সব মৃত আত্মা এই জাহাজে কবে থেকে রয়েছে! যেমন এলিস, তাঁর প্রথম পক্ষের স্ত্রী তিনি যেখানেই যান, এলিস তাঁকে ছেড়ে থাকে না। এলিস বোধহয় তাঁকে ছেড়ে থাকতে পারে না।

সকালবেলাতে এটাও একটা খবর ছিল, কাপ্তান বোট-ডেকে ডেক-চেয়ারে ঘুমিয়ে আছেন। কেউ ডাকতে সাহস পায়নি। বনি এসে তাঁকে ডেকে তুলেছে এবং তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। এমন- ভাবে তিনি কখনও ঘুমোন না। বোধহয় স্বপ্নটপ্ন দেখেছেন, কী স্বপ্নে দেখেছেন মনে করতে পারছেন না। কেবল খুব দূরে যেন এক কুয়াশাজালে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে সব সময়। আর বলছে আমাকে চিনতে পারছ?

সে আর কেউ না। তার প্রথম পক্ষের স্ত্রী এলিস। কি করুণ আর বিষণ্ণ মুখ। হিগিনস কেমন ধীরে ধীরে তখন হাঁটতে থাকেন। বনি পাশে না থাকলে তিনি যেন চিৎকার করে বলতেন, না, আমি তোমাকে কখনও কোথাও দেখিনি। তুমি আমাকে প্লিজ কষ্ট দেবে না। প্লিজ প্লিজ….!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *