1 of 2

অলৌকিক জলযান – ১৫

।। পনের।।

জ্যাক অনেকক্ষণ এ-ভাবে বসে থাকল। সূর্য মাথার ওপরে উঠে আসছে। আকাশে কোন মেঘের আভাস নেই! জাহাজটা দুরন্তগতিতে জল কেটে যাচ্ছে। দু’পাশে জাহাজের জলকণা উড়ছে। জাহাজের দু’পাশে অজস্র বুদবুদ ওঠে ভেঙে যাচ্ছে। অনেক দূরে সে দেখতে পাচ্ছে জলের একটা সরল রেখা ক্রমে সমুদ্রের অতল থেকে উঠে আসছে এবং টগবগ করে যেন ফুটছে। প্রপেলারের ধাক্কায় জলরাশি ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছে। দুটো একটা সামুদ্রিক মাছ মরে ভেসে উঠছে। কোথা থেকে কিছু ছোট ছোট পাখি আবার উড়ে এসে সে-সব খাচ্ছিল! জ্যাক কেমন আনমনা হয়ে গেছে সে-সব দেখতে দেখতে।

এবং তখনই মনে হল পেছনে কেউ ডাকছে তাকে। দেখল, বাবা তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। একা একা সমুদ্রে এভাবে ঘুরে বেড়াতে বোধ হয় মেয়েটার ভাল লাগছে না। এখন স্নানের সময় জ্যাককে তিনি মাঝে মাঝে সব মনে করিয়ে দেন। জ্যাক কোন কারণেই একটু অগোছালো হতে পারে না। এ-কমাসে জ্যাক আরও বড় হয়ে গেছে। জ্যাকের চুল আবার বড় হয়ে গেছে। জ্যাকের চুল কাটার সময় তাঁরও মনের ভেতর তোলপাড় করে ওঠে। কি সুন্দর নীলাভ চুল। সারা মাথা ঢেকে রয়েছে। ঘাড় পর্যন্ত চুল এসে নেমেছে। মসৃণ নরম উলের মতো চুলে হাত দিলেই অনেক স্মৃতি এসে তাঁকে তোলপাড় করে দেয়।

এবং তিনি যেন বুঝতে পারেন তাঁর যৌবনে প্রথমা স্ত্রীর চুলে ছিল এমনি সুন্দর সব বর্ণমালা। স্ত্রীর মুখ মনে হলেই কেন জানি মনে হয়, তিনি ওকে অবিশ্বাস করে ভুল করেছেন। আসলে যৌবনে মেয়েরা তো একটু চঞ্চল থাকবেই। চিরদিনই তাঁর মনে হয়েছে ভাঙা জাহাজের তিনি কাপ্তান। সব সময় উদ্বেগ, জাহাজ বন্দরে না পৌঁছানো পর্যন্ত। ভীষণ তিনি সজাগ। স্ত্রীর প্রতি তাঁর কর্তব্য রয়েছে সেটা তিনি ভুলে যেতেন। এই জাহাজ, তাঁর সব কিছু তখন। একটা পাগলা জেদি ঘোড়ার মতো জাহাজটা সমুদ্রের ঝড় সাইক্লোন কাটিয়ে যখন নিরিবিলি শান্ত আকাশের নিচে এসে দাঁড়াত তখন তাঁর মনে থাকত না যে কে তাঁর বেশি আপন। তাঁর স্ত্রী না এই জাহাজ! বোধ হয় তাঁর স্ত্রী এলিস এটা বুঝতে পারত। হিগিনস ওর জন্য একেবারেই সময় দিতে পারছেন না। সারাক্ষণ চার্ট-রুমে বড় টেবিলে ঝুঁকে অথবা কখনও সব ওসেনোগ্রাফিরর ভেতর এই জাহাজের নিরাপদ আশ্রয়ের কথা ভেবে বুঁদ হয়ে থাকতেন। মনে মনে এলিস এটা পছন্দ করত না। ভাবত বুঝি, তবে এত কষ্ট করে মানুষটার সঙ্গে সমুদ্রে আসা কেন।

কখনও জ্যোৎস্না রাতে এলিস খুব সেজে ওঁর চার্ট-রুমে ঢুকে যেত।—কি হল! এই যাচ্ছি। এলিস কেবিনে অথবা বাইরের ডেকে একা একা পায়চারি করে ক্লান্ত হত। মানুষটার কাজ কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। এত কি যে কাজ! এমন অসীম নীল সমুদ্রে একটু পাশাপাশি বসে সামান্য মদ আর মাংসের রোস্ট। নক্ষত্রেরা মাথার ওপর দুলছে। এ-হেন সময়ে মানুষটার চার্ট-রুমে কেবল কাজ। কেবল বই ঘেঁটে ঘেঁটে দেখা। রিপোর্ট লেখা। জাহাজের হাল তবিয়ত কেমন যাচ্ছে তার একটা বিবরণ প্রতিদিন লগবুকে রাত জেগে লিখে রাখা। যেন জাহাজটাই মানুষটার কাছে সব, এলিস তাঁর কেউ নয়। তখন বোধহয় এলিসের ভীষণ অভিমান হত। চোখে জল আসত। সে যে এমন সুন্দর পোশাকে অপেক্ষা করছে মানুষটার জন্য তার দাম দিতেন না তিনি।

স্যালি হিগিনস আরও সব মনে করতে পারেন এবং এ-সব মনে হলে তিনিও ভুলে যান বারোটায় লাঞ্চ সাজানো হচ্ছে ডাইনিং হলে। ভুলে যান, তাঁর পায়ের কাছে চুপচাপ বসে রয়েছে বনি। বনি এখন নানাভাবে স্বপ্ন দেখতে পারে সে-সবও ভুলে যান। যেমন ভুলে যেতেন, জাহাজে অন্য সুন্দর সব যুবকেরা যাদের কাজ এনজিনে অথবা ডেকে, যারা অফিসার জাহাজের, তাদের একঘেয়ে সমুদ্রযাত্রা ক্যাপ্টেনের সুন্দরী স্ত্রী অনেকটা লাঘব করে দিচ্ছে। ফাঁক পেলেই তারা এলিসের চারপাশে ঘুরঘুর করছে। দুটো একটা কথা বলার জন্য সারাদিন স্বপ্ন দেখছে। এখন যেন তিনি সব বুঝতে পারেন। বয়স হলে সবার সব দোষত্রুটি সহজেই ক্ষমা করে দেয়া যায়। এবং নিজেকেই সব কিছুর জন্য দায়ী ভাবতে বেশি ভাল লাগে।

তিনি মেয়ের মাথায় আঙুল চালিয়ে বললেন, চুল আবার বেশ বড় হয়ে গেছে।

বনি জবাব দিল না।

—চুল কাটবে না?

—না বাবা।

কি করুণ সেই স্বর বনির!

হিগিনস আবার বললেন, কেন?

—চুল কাটতে আমার ভাল লাগে না বাবা।

—কিন্তু জাহাজ যে খুব খারাপ জায়গা বনি!

হিগিনস মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু আর বলতে পারলেন না।—ওঠো। বারোটা বাজবে এবার।

—তুমি যাও আমি যাচ্ছি।

আসলে বনি বসে আছে ছোটবাবুর জন্য। এখানে বসে থাকলে অনেক নিচে, সেই স্টোকহোলডে উঁকি দিলে ছোটবাবুকে দেখা যায়। ছোটবাবুকে দেখার একটা নেশা হয়ে গেছে বনির। বনি জানে ছোটবাবু এখন বাংকারে। খুব সন্তর্পণে কান সজাগ রাখলে শোনা যায় ছোটবাবুর গাড়ি টানার শব্দ। গাড়ি এনে সুটের মুখে উপুড় করে দিচ্ছে। ছোটবাবু উঠে এলে আর একবার মনে করিয়ে দিতে হবে।

ছোটবাবু উঠে এলে সে ফের বলল, মনে আছে তো।

—খুব।

সে এবার আনন্দে শিস দিয়ে উঠল। ছেলেদের পোশাকে থেকে থেকে সে ছেলেদের মতো শিস দিতে শিখে গেছে। সে মাঝে মাঝে শিস দিয়ে গান গায়। পায়ে তাল ঠুকতে থাকে—অথবা কেবিনে পোশাক পাল্টানোর সময় সে পায়ে তাল দিয়ে গান গায়। তার মনের ভেতর থাকে অজস্র দুষ্টুমী বুদ্ধি। ছোটবাবু কেবিনে এলে সে কি কি করবে, এবং ছোটবাবুকে কি কি ভাবে হতবাক করে দেবে এ-সব ভাবতে ভাবতে সাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে যায়। নরম শরীরে, এবং কি যে কোমল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, সে নরম হাতে সারা শরীরে দামী সাবান বুলিয়ে দেবার সময় অজস্র ফেনা এবং নাভির নিচু অংশে সোনালি রেশমের মতো বিজবিজে এক আরামদায়ক ঘটনা। কি যে হচ্ছে সব শরীরে, যত এমন সব হচ্ছে তত ছোটবাবুর জন্য মায়া তার বেড়ে যাচ্ছে।

ডাইনিং হলে সবাই দেখল জ্যাক ভীষণ চঞ্চল। ওর চোখ দুটো ভীষণ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে আজ। সে উত্তেজনায় ভালভাবে খেতে পর্যন্ত পারল না। দেখলেই মনে হয়, জ্যাকের জীবনে চরম কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। অথচ কি সেটা জ্যাক নিজেও বুঝি ভালভাবে জানে না।

ঠিক চারটে ত্রিশে ঘুম থেকে উঠে মনে হল ছোটবাবুর, কোথাও আজ তার যাবার কথা! জ্যাক তাকে ডেকেছে। গোপনে যেতে বলেছে। কেন যে জ্যাক ডাকল! যত সময় এগিয়ে আসছে তত বুক কাঁপছে! সারেঙসাব বার বার বলেছেন, ছেলে, জাহাজ খারাপ জায়গা। সাবধানে চলাফেরা করবে। জ্যাক তাকে আবার কোনো বিপদে ফেলবে না তো! জ্যাকের দুষ্টুবুদ্ধি তাকে কোনো বিপদে ফেলবে না তো! এখন অবশ্য কিছু সে করতে পারে না। জ্যাককে কথা দিয়েছে, শুধু কথা কেন, জ্যাক তাকে আদেশ করতে পারে। জ্যাক যা যা বলবে সে তা করতে বাধ্য। ইচ্ছে করলে জ্যাক ওকে একটা ক্লাউন বানিয়ে ফেলতে পার। সে তখনও কিছু বলতে পারবে না।

সে তার সবচেয়ে ভাল পোশাক বের করল। কিন্তু জ্যাক গোপনে যেতে বলেছে। ভাল পোশাকে গেলে জাহাজিদের মনে সংশয় দেখা দিতে পারে, জাহাজ সমুদ্রে, বন্দর কবে পাবে ঠিক নেই, এখন থেকেই সাজগোজ করে বসে থাকা! সুতরাং সে পরেছে একটা হাফ-হাতা সিল্কের গেঞ্জি। নানারকমের ছবি গেঞ্জিতে। যেমন কোথাও উট অথবা বাঘের ছবি আবার কোথাও জলের মাছ ডাঙায় লাফিয়ে পড়েছে। আবার কোনো বনাঞ্চলের ছবি, ছোট্ট একটা মেয়ে—হাতে তার খেলনা, সে বসে আছে গেঞ্জির নিচু দিকটায়। এবং এ-ভাবে সে তার গেঞ্জিতে পৃথিবীর যাবতীয় জীবজন্তু নিয়ে যখন সত্যি হাজির তখন ঠিক ঘড়ির কাঁটায় পাঁচটা বাজে। সে দেখল কেবিনের দরজা বন্ধ। সে পরেছে কালো রঙের প্যান্ট। কালো রঙের প্যান্ট পরলে ছোটবাবুকে কেমন বেশি লম্বা দেখায় বেশি সাহসী দেখায়। সে চারপাশে সতর্কভাবে তাকাচ্ছে। কেউ দেখছে কিনা। না কেউ নেই। সে ধীরে ধীরে দরজায় কানপেতে ডাকল, জ্যাক, আমি ছোটবাবু। তুমি আমাকে আসতে বলেছিলে।

আর আশ্চর্য, দরজা সামান্য ঠেলে দিতেই খুলে গেল। ভিতরে কোন আলো জ্বালা নেই। চারপাশটা কেমন অন্ধকার লাগছে। সে বুঝতে পারছে না, ভেতরে সত্যি কেউ আছে কিনা। পোর্ট-হোলের কাচে পর্দা টানানো। বাইরের এতটুকু আলো কেবিনে আসতে পারছে না। জ্যাক কোথায়! সে ভয় পেয়ে গেল। সে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। জ্যাক কি তাকে ছেলেমানুষের মতো আড়ালে দাঁড়িয়ে হেই করে উঠতে চায়, ভয় দেখাতে চায়। দেয়ালে তেমনি নীল রঙের লাইফ বেল্ট, বাংকের মাথায় সোনালী লাইফ-জ্যাকেট দুলছে।

সে আবার ডাকল, জ্যাক তুমি কোথায়!

কোন উত্তর নেই।

সে এবার বলল, জ্যাক আমাকে ভয় পাইয়ে তোমার কি লাভ!

এবার মনে হল কেউ খুব ধীরে ধীরে বলছে, আমি এখানে ছোট।

ছোট তবু বুঝতে পারল না জ্যাক কোথা থেকে কথা বলছে। কেবিন আর ততটা অন্ধকার মনে হচ্ছে না। দামী মেহগিনি কাঠের বাংক। বাংক না বলে দামী খাট বলাই ভাল। দু’জন অনায়াসে পাশাপাশি শুতে পারে। পাশে আর একটা বাংক—মোটা তোয়ালে বিছানো। ডানদিকে কাঠের বড় আলমারি। আলমারির ওদিকটায় সে আর একটা দরজা দেখতে পাচ্ছে। ওটা বোধ হয় বাথরুমের দরজা। সুন্দর ক্যালেণ্ডার দেয়ালে। তারিখের ওপর লাল দাগ। সব এখন স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জ্যাক তখন আবার ওকে বলছে, আমি এখানে।

তারপর ছোট দেখল ক্রমে একটা আলো ফুটে উঠছে কেবিনের ভেতর। ক্রমে কেমন দিনের বেলার মতো, ঠিক ঠিক দিনের বেলা বললে ভুল হবে, পুজো মণ্ডপে যে রঙিন আলো থাকে তেমনি এবং এ-ভাবে এক মায়াবী জগৎ গড়ে তুলে কি যে লাভ জ্যাকের। সে এবার এক পা এগিয়ে গেলে দেখতে পেল, দেয়ালের নতুন ক্যালেণ্ডারে এক বালিকার ছবি। ঠিক বালিকা বলা যাচ্ছে না, কেমন ব্যালে-গার্লের মতো। বালিকা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দেখা যাচ্ছে না, নরম নীলাভ চুলে প্রজাপতি আঁটা ক্লিপ। সাদা রিবন। এবং গলায় মুক্তোর মালার মতো পবিত্রতা চারপাশে ঘিরে আছে। সে হতবাক। সে কি বলবে ভেবে পেল না। আসলে এই জ্যাক, না এটা কোন যাদুকরের ছবি, সে নিজেকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। বার বার চোখ মুছে বলছে, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না তুমি কোথায় জ্যাক। দোহাই তুমি আমাকে ভয় পাইয়ে দিও না। আমি কিন্তু দৌড়ে পালাব।

বনি নিজের ভেতর তন্ময় হয়ে আছে। সে কিছুতেই এমন পোশাকে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না। সাদা সার্টিনের ফ্রক, হাঁটু পর্যন্ত ফ্রক নেমে গেছে, ফ্রকে নানা বর্ণমালা অথবা চাঁদমালা বলা যায়, এবং পায়ে সে পরেছে সাদা দামী হাবসী লেদারের সু এবং দামী মোজা ওর পায়ের চারপাশটা কি যে আশ্চর্য স্নিগ্ধ করে রেখেছে! সে বলল ছোট আমি এখানে।

ছবিটা তবে কথা বলছে! সুন্দর ঘ্রাণ শরীরে। সেই যে মহার্ঘ ঘ্রাণ ওরা মাঝে মাঝে জাহাজে পায়, তেমনি এক ঘ্রাণ! সে বলল, তোমার মুখ দেখতে পাচ্ছি না জ্যাক। তুমি কোথায়!

জ্যাক এবার দুপা এগিয়ে এল এবং মুখ তুলে দাঁড়াল। যেন, এই যেন আমি, আমি বনি, আমার কিছু আর ভাল লাগে না। সমুদ্রে আমি ভীষণ একা। এবং এ-সব কথা সে একটাও উচ্চারণ করতে পারল না। আর তখন কেমন নেশার মতো ছোটবাবু কাছে এগিয়ে যেতে যেতে সহসা হা-হা করে হেসে উঠল, জ্যাক তুমিও! জ্যাকের ট্রাপে সে কিছুতেই পা দিচ্ছে না। জ্যাক তাকে সত্যি ক্লাউন বানিয়ে দিতে চায়। সাধারণ কার্গো জাহাজে মেয়ে দেখা ভূত দেখার সামিল। সে বলল, তুমিও! অমিমেষের মতো মেয়ে সেজে মজা করছ জ্যাক। ঠিক না। সঙ্গে সঙ্গে সারেঙসাবের কথা মনে হল। বলল, আমি যাচ্ছি জ্যাক। তুমিও অনিমেষের মতো দেখছি ঠিক ফলস্ পরে…..দ্যাটস ভেরি আগলি।

সঙ্গে সঙ্গে আর্তনাদ। বনি প্রায় হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। যেন সে অনেক কষ্টে তার অসম্মান হজম করছে। এবং ধীরে ধীরে আঙুল তুলে দরজার দিকে দেখাল, প্লিজ ইউ গো

এবং প্রায় দৌড়ে বের হয়ে যেতে দেখা গেল ছোটবাবুকে। ছোটবাবু হাঁপাতে হাঁপাতে পিছিলে এসে দাঁড়ালে সবাই ওকে ঘিরে দাঁড়াল। ভূত দেখলে যেমন মুখের চেহারা হয়, ঠিক তেমনি, শূন্য দৃষ্টি। সবাই নানাভাবে প্রশ্ন করলেও একটাও কথা বলতে পারছে না ছোটবাবু। সে এ-সব কাউকে বলতে পারে না। জ্যাক সত্যি এবার তবে ওর পেছনে লেগে গেল। সে এখন কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।

আর তখনই জ্যাক নিজের পোশাকে বাইরে বের হয়ে এল। সে পরেছে আজ নীল রঙের ঢোলা সার্ট। সে পরেছে শিকারীর বেশ, এবং সে পাখি দুটোর পেছনে প্রায় ছোটখাটো অরণ্যদেব হয়ে গেছে! জাহাজের এ-দড়ি ঝুলে, কখনও বোট ডেক থেকে ফল্কায় নেমে আসছে। আবার লাফিয়ে উইনচে উঠে যাচ্ছে। আবার কখনও আরও ওপরে। সে যেন এখন পাখি দুটোকে না ধরতে পারলে বাঁচবে না। সে সিঁড়ি বেয়ে মাস্তুলের ডগায় উঠে গেল। যত ছোটবাবু এমন দেখছে তত তাজ্জব বনে যাচ্ছে। সে ভাবল এখন পালিয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই। এবং তখনই হাঁক, হেই ছোট, কাম-অন।

সে কাছে গেলে বলল, গেট দ্যাট বার্ড।

ছোট দেখল, জ্যাক মিসেস প্যারোর দিকে হাত তুলে দেখাচ্ছে।

ছোটবাবু দাঁড়িয়ে থাকল তেমনি। জ্যাক ভীষণ ক্ষেপে গেছে। পাখিটা হাতে পেলে হয়তো পাখা ছিঁড়ে দেবে, মুন্ডু ছিঁড়ে ফেলবে। জ্যাক সব পারে। জ্যাককে সে কেন যে এসব বলতে গেল!

—আমি বলছি, আমি জ্যাক বলছি। এবং জ্যাকের সেই সুন্দর মুখ কি ভীষণ ক্ষিপ্ত! ওর এমন সুন্দর চোখে কি গভীর ক্ষত!

ছোট বলল, প্লিজ!

জ্যাক ফের বলল, ধরে দাও।

তা ক্যাপ্টেনের জেদি ছেলে। মাথায় কি যে তার হয়, সে আর কি করে, সে কথা না শুনে জ্যাককে অবমাননা করতে পারে না। সে কাতর গলায় বলল, দিচ্ছি।

কারণ সে জানে পাখি দুটো ওর পোষমানা, অবশ্য এখন এ মুহূর্তে ওরা কি করবে সে বুঝতে পারছে না। ধরা যত সহজ ভেবেছিল, আসলে তত সহজ নয়। কারণ ওরা বোধহয় টের পায় সব। তারপর ছোট লাফিয়ে ফল্কায় উঠে গেল। এবং তখন জ্যাক ছুঁড়ে দিল ওর হাতের দস্তানা। ছোট টেনেটুনে পড়ে নিল দস্তানা। এবং সে দেখতে পেল মিসেস স্প্যারো মাস্তুলের ডগায় বসে রয়েছে। সে খুব সন্তর্পণে মাস্তুলের ডগায় দড়ি ঝুলে উঠে গেল। পাখিদুটো আবার উড়ে গেল। ছোট তখন পাখিদুটোর নাম ধরে ডাকছিল। ফিরে আসতে বলছিল। যেমন মাথার ওপর ঘুরে বেড়ায় উড়ে বেড়ায়, ছোট যেন এখনও ওদের তেমনি কাছে চাইছে। কিন্তু পাখিরা বুঝি বুঝতে পারে ঠিক। ছোটর ডাকে কেউ আর কাছে আসছে না। ওরা গ্যালির ছাদে বসে নিশ্চিন্তে পাখা ঠোকরাচ্ছে।

ছোট সেখান থেকে লোহার তার বেয়ে নেমে গেল। অনায়াসে সে যেখানে যখন খুশি উঠে যেতে পারছে। দেখলে মনে হবে পাকা জাহাজি। লম্বা সফরে ছোট, পাকা জাহাজি বনে গেছে এবং এই দুরন্তপনা এনজিন সারেঙের ভাল লাগছিল না। এত বেশি উড়ে বেড়ানো ভালো না। ছোটবাবুর কান্ড দেখে সারেঙ মাঝে মাঝে চোখ বুজে ফেলেছেন ভয়ে। যেন ছোট মজা করছে নিজের জীবন নিয়ে। রাগে শরীর কাঁপছে তাঁর। কি যে দরকার কাপ্তেনের ছেলেটার সঙ্গে ভাব করার। একেবারে কথা শোনে না ছোট। কান ধরে নামিয়ে আনলে এখন ঠিক হয়। কাপ্তানের ছেলেটার জন্য তাও করতে পারছেন না।

তখন ছোট আবার ছাদ থেকে লাফ দিয়ে ডেকে নেমে পাখি দুটোর পেছনে দৌড়াল। সেও যেন এ-জাহাজে আর একটা পাখি হয়ে গেছে। পাখির মতো ফল্কায় ডেকে মাস্তুলে মাংকি অ্যায়ল্যান্ডের ছাদে কখনও উইংসে ঝুলে সে বার বার পাখি দুটোকে ওর কাঁধে অথবা মাথায় এসে বসতে অনুরোধ করছে। কিছু করবে না। যেমন জাহাজে ছিল তেমনি থাকবে ওরা। আর নিচে তখন জ্যাক। সে দু হাত তুলে বেশ মনোরম এক রিঙের খেলোয়াড়ের মতো খেলা দেখাচ্ছে। কেবল ছোটবাবুকে উত্তেজিত করে যাচ্ছে—ওহো! পারলে না। ইউজলেস।

বুঝি রক্তের ভেতর থেকে তেজী ঘোড়ারা। এ-সব বললে আরও তেজী স্বভাবের হয়ে যায়। -ওই ওদিকে চলে গেল। দ্যাখো ফওর-মাস্টে গিয়ে বসেছে। ছোট লাফিয়ে উঠে গেলে জ্যাক চিৎকার করতে থাকল উড়ে যাচ্ছে, তোমার কানের পাশ দিয়ে পালিয়ে গেল। এনজিন-রুমে ঢুকে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ছোট দড়ি ঝুলে একেবারে মাংকি আয়ল্যান্ডের মাথায়। তারপর স্টেনসান ধরে নিচে সোজা ঝুলে পড়ল।

ছোট এ-ভাবে স্কাইলাইটের সিঁড়িতে নেমে গেল। এনজিন-রুমের ভেতর ঢুকে গেল। প্রায় গ্লাইড করার মতো দু’রেলিঙে হাত রেখে নেমে যাচ্ছে। হাওয়ায় পা ভাসিয়ে দুহাতে ভর করে ক্রমে নিচে, নিচে নেমে যাচ্ছে। আর পেছনে জ্যাক তার চেয়ে যেন এককাঠি ওপরে।

মৈত্রের ইচ্ছে হল একবার, ঘাড় ধরে তুলে নিয়ে আসে। চা করে বসে রয়েছে, চা ঠান্ডা হচ্ছে। পাখি দুটোর পেছনে লেগেছে। কিন্তু কাপ্তানের দুরন্ত ছেলেটা আছে সঙ্গে। আর সাহসে কুলাল না। অমিয় চা হাতে নিয়ে ওপরে উঠে গেলে দেখল, ছোটবাবু মেইন-মাস্টের ক্লোজ-নেস্টে দাঁড়িয়ে আছে। সে আকাশ দেখছে, কি সমুদ্র দেখছে না পাখি দুটোকে খুঁজছে অমিয় বুঝতে পারছে না। ডেকে দাঁড়িয়ে আছে জ্যাক। অমিয়র হাতে ছোটবাবুর চা। অমিয়, যে অমিয় জাহাজে ভয়ঙ্কর খেলায় মেতে উঠেছে এবং ঘোস্ট খেলা, বেশ জমে উঠেছে, যদিও সে জানে না শেষ পর্যন্ত কিভাবে শেষ হবে খেলা সেও জ্যাককে দেখে ট্যাসে গেল। ডেকে বলতে পারল না ছোট, তোর চা। চা ঠান্ডা হচ্ছে।

আর ছোটও তখন ঠান্ডা একেবারে ঠান্ডা। ঠিক বুঝতে পারছে না, এমন নিরিবিলি সমুদ্রে দিগন্তরেখায় এটা কি দেখা যাচ্ছে! যেন এক অতিকায় মনস্টার আকাশ কালো করে এগিয়ে আসছে ক্রমশঃ। ক্রমশঃ ওটা বড় হয়ে যাচ্ছে এবং বিদ্যুতের তরঙ্গমালা ওর মাথায় খেলে গেলে সহসা সাইরেন বেজে উঠল। সারেঙ, ডেক সারেঙ কাপ্তান যে-যার মতো চোঙ মুখে ফুঁকে যাচ্ছে—নিচে নেমে যাও। নিচে।

জ্যাক পাগলের মতো হাত ওপরে তুলে চিৎকার করে উঠল, দি ব্রেকার! ছোট তাড়াতাড়ি জলদি। ছোট, দাঁড়িয়ে থেকো না।

বোধহয় কখনও কখনও এ-সব অতিকায় মহামায়া মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। ছোট কেমন ক্ৰমে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। ওর শরীরে শক্তি নেই, হাত-পা শিথিল, নিচে কি করে নামতে হয় সে যেন জানে না। জ্যাক পাগলের মতো হাঁকছে, এবং একে একে এনজিন-সারেঙ, মৈত্র, মনু, জব্বার এবং সেকেন্ড অফিসার ছুটে এসেছে। জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ছোট তেমনি দাঁড়িয়ে—তারপর কেমন হাত তুলে দিল ওপরে। আকাশ ছুঁতে চাইল যেন।

মৈত্র আর পারল না। ওটা মরবে। ও জানে না, ওটা কি আসছে। ভাসিয়ে নিয়ে যাবে কোথায় অপোগন্ডটা জানে না। সে উপরে উঠে গেল। ক্রোজ-নেস্টে উঠে চুল ধরে নামাবে ভাবল। তখন কাপ্তান চিৎকার করছে, জ্যাক! সেকেন্ড অফিসার জ্যাককে টানতে টানতে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ক্রমে এসে গেল, এসে গেল, ভেসে গেল—ছোটবাবু রব উঠে যাবার মুখে দড়ি ধরে, ঝুলে একেবারে আফট-পিকে। কিন্তু পারল না। শেষ রক্ষা করতে পারল না। সে উইন্ডসেলে আটকে গেল। এবং পড়ে গেল। অমিয় সারেঙ জব্বার সবাই ধরাধরি করে নিয়ে আসার আগেই—দি ব্রেকার। ওরা সিঁড়ির মুখে ঠেলে দিল ছোটকে। এবং অনেকটা উঁচুতে জাহাজ উঠে গেছে। ওদের ভাসিয়ে নিয়ে যেত, কিন্তু ওরা ব্রেকারের মুখে পড়লে কি করতে হয় জানে, এবং সারেঙ-সাব এই বুড়ো বয়সেও স্টেনসান ধরে ভেসে থাকলেন। জল জাহাজের ওপর দিয়ে নেমে গেল। দেখলেন তিনি একা। ডেকে কেউ নেই। তাকাতে না তাকাতেই আবার একটা ব্রেকার। আবার জলে ডুবে ডুবে মরণ খেলা! খেলার মতো খেলা। জাহাজ অনেক ওপরে উঠে নিচে নেমে গেল। তিনিও জলের ভেতর থেকে উঠে এলেন! এবং মনে হল, আবার ব্রেকার আসছে। অনেক দূরে। মেসরুমে এসে বুঝতে পারলেন তিনি পাগলের মতো জীবন বিপন্ন করে ছোটকে বাঁচিয়ে এনেছেন। ছোটকে ঠেলে ঢুকিয়ে না দিলে সে অসীম তরঙ্গ মালায় সমুদ্রের গভীরে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত। তিনি মৃত্যুর মুখোমুখি এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলেন ভাবতেই কেমন শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল। নিচে নামার শক্তিটুকু পর্যন্ত নেই। সমুদ্রের এইসব সহসা জলোচ্ছাস বেশীক্ষণ থাকে না। কেউ সঠিক জানে না, কেন এমন হয়! কোন বেতার সংকেত পর্যন্ত পাওয়া যায় না। হয়তো বা কোনও টাইডল ওয়েভ হবে, যাই হোক ব্যাপারটা গুরুতর বোঝা গেল যখন আকাশ পরিষ্কার, সমুদ্র শান্ত যেন জাহাজ সমুদ্রে কিছুক্ষণ ডুব-সাঁতার কেটে আবার অবিরাম ভেসে চলেছে। তখন মৈত্র সারেঙের ঘরে উঁকি দিয়ে বলল, জলদি! সারেঙের ঘর তখন লোকজনে ঠাসা।

—কেন কি হল!

—শিগগির আসুন। ছোটর মাথায় কি ঢুকে আছে।

—মানে! এবং সঙ্গে সঙ্গে ভেজা জামা কাপড়ে নেমে গেলেন। দেখলেন ঘাড়ের ওপরে একটা পেরেকের মতো। এতক্ষণ ছোট ভয়ে কিছু বলে নি। জামা রক্তপাতে ভিজে গেলে, অমিয় চিৎকার করে উঠেছিল, ছোট, রক্ত!

ছোট কিছু বলেনি। অনেকক্ষণ থেকেই এটা হচ্ছে। মাঝে মাঝে গোপনে সে হাত দিয়েছে মাথায়, বুঝতে পারছে ভীষণ কিছু একটা হয়েছে কিন্তু সবাই ওর ওপর এমন ক্ষেপে আছে যে, বলতে সাহস পায়নি। সে অসহ্য কষ্ট ভোগ করছে। চোখ বুজে দাঁত চেপে সহ্য করছে। বসে আছে। কেমন হিতাহিত জ্ঞানশুন্য মানুষের মতো ওর চোখ মুখ দেখাচ্ছে।

সারেঙ-সাব বললেন, আমি যাচ্ছি।

ছোট বলল, কিছু হয়নি। কেটে গেছে একটু। এর জন্য লাফালাফি।

সবাই ছোটর ফোকসালে ভিড় করেছে।

ছোট কেমন বিব্রত বোধ করতে থাকল। সমস্ত শরীরে অসহ্য জ্বালা। কেমন ঘুম ঘুম এবং নেশার মতো মনে হচ্ছে। সে নিজেকে শক্ত রাখছে। জাহাজে আবার দুর্ঘটনা। সে নিজেকে ভীষণ অপয়া ভাবতে থাকল। ওর জন্য সবাই এভাবে বিব্রত হচ্ছে দেখেও একটা সংকোচ ভেতরে। সে আর পারছিল না। মৈত্র গরমজল করে এনে, ক্ষতস্থান ধুয়ে দিচ্ছে। সারেঙ সেকেন্ড অফিসারকে ডেকে আনলে বোঝা গেল দুর্ঘটনা অতীব—কারণ তখন বেতার সংকেত পাঠানো হচ্ছে। ক্যাপ্টেন নিজে এসেছেন ছুটে। চীফ-অফিসার এসেছে। জ্যাক খবর শুনে যখন এল, তখন ছোট লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। সাদা চাদরে শরীর ঢাকা। মাথায় ব্যান্ডেজ, মাথা কাত করা। চোখে কি ছোটবাবু দেখতে পাচ্ছে না। জ্যাকেেক দেখে ছোট এতটুকু চিনতে পারল না যেন। যেভাবে তাকিয়েছিল, তেমনি সাদা চোখে তাকিয়ে আছে। চোখের পলক পড়ছে না।

তখন রেডিও-অফিসার কাপ্তানের ঘরে। সেকেন্ড-অফিসার রিপোর্ট করেছেন। কাপ্তান দেখে সই করলেন। ডাকলেন, রেডিও-অফিসারকে। রেডিও রোমাকে জানাও, সিপ সিউল ব্যাঙ্ক। কোল-বয় ছোট- বাবু। অ্যাকসিডেন্ট। অ্যাকসিডেন্ট রিপোর্ট দাও।

রেডিও-অফিসার বললেন, নিয়ারেস্ট স্টেশন ক্যালিফোর্ণিয়া।

—তাকে জানাও।

রেডিও অফিসার তাড়াতাড়ি রেডিও-মেডিকাল ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করে জানালেন, জাহাজ ঘুরিয়ে দিতে হবে। এক্ষুনি।

—কোথায়?

—জাহাজ ভিকটোরিয়া পোর্টে ভিড়িয়ে দিতে বলছে। রিস্ক নিতে রাজী হচ্ছে না।

জাহাজের মুখ আবার ঘুরিয়ে দেওয়া হল। জাহাজের মুখ এখন পশ্চিম-উত্তর-পশ্চিম। জাহাজ এখন যত তাড়াতাড়ি ভিড়িয়ে দেওয়া যায়।

এবং খবর এই ফোকসালে এসেও পৌঁছে গেল। খারাপ খবর। সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। সেকেন্ড- অফিসার শেষ রাতের দিকে কোরামিন দিয়েছেন ছোটকে। কেমন ধীরে ধীরে ছোটর চোখ বুজে আসছে। তেমন রক্তপাত হয়নি! একটা লোহার শক্ত মতো কিছু মাথার ভিতর ঢুকে আছে। মাঝে মাঝে মৈত্র স্থির থাকতে না পেরে ডেকেছে, ছোট! সারেঙ ডেকেছেন, ছেলে, কোনও ভয় নেই, আমরা তো আছি! জ্যাক নির্বাক। জ্যাক ডাকে নি। সে সারাক্ষণ এই ফোকসালে ছোটর শিয়রে বসে রয়েছে। কাপ্তানবয় খেতে ডেকেছিল, সে খেতে গেছে।

খাওয়ার পর ব্রীজে বাবার পাশে কিছু সময় চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল। কাপ্তান বলতে পারতেন, বনি তুমি বড় হয়ে যাচ্ছ। তুমি এ ভাবে ছোটকে বিপদের মুখে ফেলে না দিলেও পারতে। কিন্তু মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারেন নি। ভারী দুঃখী মুখ। বনি যেন এ জাহাজে এখন সবচেয়ে দুঃখী। এবং বড় তার অপরাধ। সে মাথা নিচু করে রেখেছিল। বনির বোধহয় এটা স্বভাব, অপরাধ করে ফেললে সে মাথা নিচু করে রাখে। তখন হিগিনস বলেছিলেন, যাও শুয়ে পড়গে।

বনি যায় নি। সে তেমনি দাঁড়িয়েছিল।

হিগিনস জানেন, এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে বোঝা যায়, বনির কিছু বলার ইচ্ছে। তিনি বলেছিলেন, আমাকে কিছু বলবে?

—ছোটবাবুর ফোকসালে যাব।

হিগিনসের মনে হল, মেয়েটা বুঝতে পেরেছে তার অপরাধের কথা। তিনি মেয়ের বোধবুদ্ধিতে খুশী হলেন। বলেছিলেন, না গেলেও কিছু কেউ ভাববে না।

বনি তখন কিছু না বলে নেমে যাচ্ছিল। বনি যখন ভাল হয়ে যায় সত্যি ভাল হয়ে যায়। আসলে বনির বয়সে এমন একজন ছোট্ট নাবিকের মায়ায় পড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। কেমন এক অমলিন ঘ্রাণ বনির শরীরে। বুড়ো বয়সে কিছুতেই মেয়েটাকে দুঃখ দিতে মন চায় না। তিনি ফের ডেকেছিলেন, বলেছিলেন, যাও। দুষ্টুমি কর না। ঘুম পেলে চলে এস। এবং সারেঙকে ডাকিয়ে জানিয়েছিলেন, জ্যাক যাচ্ছে, ছোটবাবুর ফোকসালে। লক্ষ্য রেখ। আসলে হিগিনস মেয়ের কথা ভেবে না নিজের কথা ভেবে বললেন, বুঝতে পারলেন না। সকালের রোদ জাহাজে, এত বড় একটা দুর্ঘটনা এই জাহাজে ঘটেছে বোঝাই যায় না। কাপ্তানের উৎকণ্ঠা দেখলে শুধু বোঝা যায়। কারণ তিনি এখন লগ-বুগে গত রাতের রিপোর্ট পড়তে পড়তে কেমন থমকে গেছেন। তিনি বনির কথা লেখেন নি। বনি যে ছোটবাবুকে পাখি ধরার জন্য ডেকেছিল, এবং ছোটবাবু বনির কথা মতো কারণ ছোটবাবু তো সামান্য জাহাজি, সে বনি কিছু বললে না করে থাকে কি করে—অথচ রিপোর্টে এ-সব কিছু নেই। তিনি লগ- বুকে আসলে লিখেছেন, ভয়ঙ্কর ব্রেকারের মুখে পড়ে গিয়ে ছোটবাবুর এই দুর্ঘটনা। বনিকে তিনি একেবারেই জড়ান নি।

রিপোর্ট পড়তে পড়তে বয়সের কথা মনে হল। ধর্মাধর্মের কথা মনে হল। এই শেষ সমুদ্রসফর তাও মনে হল তাঁর। সারাজীবন চেষ্টা করেছেন জাহাজের সব রকমের কাজে সৎ থাকতে। এবং ভাঙ্গা জাহাজেই প্রায় সব সফর বলে তিনি জীবনে সৎ থাকা বাঞ্ছনীয় ভেবেছিলেন। যেন কোম্পানী তাঁকে ভাঙ্গা জাহাজ দিয়ে পরীক্ষা করেছিল, তুমি কেমন নাবিক দেখা যাক হে। তখন জাহাজ সাউথ সিতে, কাপ্তান ম্যানিলি অসুস্থ। তাকে কিঙস আয়াল্যান্ডে নামিয়ে দিলেই তার এসেছিল, হিগিনস জাহাজ হোমে নিয়ে যাবে। ডেক-অ্যাপ্রেন্টিস থেকে আজ পর্যন্ত যা যা উন্নতি, সব এ জাহাজেই।

লগ-বুকের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি নুয়ে নুয়ে কি দেখছেন। বয়সের জন্য চোখে কম দেখেন। কাছের জিনিস আরও কম। চশমায় যেন কুলোয় না এমন নুয়ে নুয়ে বার বার রিপোর্টটা পড়ছেন। ভীষণ সতর্ক হয়ে যাচ্ছেন। এই যে জাহাজ কোর্স পাল্টে অন্য পোর্টে ঢুকে যাচ্ছে সব ক্ষয়ক্ষতি দেবে বীমা কোম্পানী। এদিক-ওদিক হলে দেবে না। বনির কথা লেখা থাকলে তো আর কথাই নেই। এবং এ- সময়ে মেয়েটার ওপর তিনি কেমন বিরক্ত বিব্রত এবং তালা টেনে টেনে যখন দেখলেন খুব সুরক্ষিত, কেউ পড়তে পারবে না কি লেখা আছে, তখন চীফ অফিসার ছুটে এসেছিল, লগ-বুকে এটা লেখা দরকার। কাপ্তান বলেছিলেন, আমি লিখেছি। আমার খেয়াল আছে। তিনি বনিকে বাঁচিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে রিপোর্ট লিখেছেন। এবং এ-সময় এত বেশি ধূর্ত মনে হল নিজেকে যে জাহাজে ঠিক কিছু অঘটন ঘটবে—যে-জাহাজ ওঁর জন্য এত করেছে, শেষ সফরে তিনি আবার তার লগ বুকে ঠিক কাপ্তানের মতো সাহসী কাজ করছেন না। দুর্বল কাপুরুষের মতো তিনি এটা কি যে করে ফেলেছেন বনির কথা ভেবে!

আর তখনই বোধ হয় মনে হয় তিনি ক্যাপ্টেন স্যালি হিগিনস। সোজা হয়ে দাঁড়াতে চান। দু হাত ওপরে তুলে বলতে চান, আমাকে রক্ষা করুন প্রভু। আপনি মঙ্গলময়। তিনি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে করতে একেবারে তখন দাসানুদাস হয়ে যান। মনেই থাকে না একটা জাহাজের ওপর অপরিসীম ক্ষমতা তাঁর। তখন বনির কথা লিখলেও কিছু আসে যায় না। নিজের কথা লিখলেও আসে যায় না। তাঁর বয়স তাঁকে নিজের ওপর আরও বেশি যেন প্রভুত্ব দিয়েছে। তিনি অবহেলায় সব কেটেকুটে যা সত্য তাই লিখলেন। জবাবদিহি তিনি গ্রাহ্য করলেন না।

আর তখনই দেখলেন জাহাজ বন্দরে ঢুকছে। জাহাজ বাঁধাছাদা হচ্ছে। এ্যাম্বুলেন্স রেডি। ছোটবাবুকে স্ট্রেচারে নামানো হচ্ছে। ভাবলেন সঙ্গে যাওয়া দরকার। বনি এবং সেকেন্ডকে সঙ্গে ডেকে নিলেন। সারেঙ, এনজিন-বড়-টিন্ডাল যাবে। এজেন্ট-অফিসের লোক এবং একজন ডাক্তার ওর সিঁড়িতে তখন উঠে আসছে।

একটা লেগুনের মতো সরু খালবিল যেন এ-বন্দরে ঢুকে গেছে। সমুদ্র থেকে এই লেগুন ধরে এলে দু’পাশে সব পাহাড়, এবং গাছপালা। ওরা তখন এত বেশি সবাই চিন্তিত ছিল যে এমন সুন্দর দৃশ্য কারো চোখে পড়েনি। একটা লম্বা ব্রীজ চলে গেছে দু-পাড়ের শহরের ওপর দিয়ে। লেগুনের জলে জাহাজ এস এস সিউল ব্যাঙ্ক বাঁধা। লেগুনের নীল জল, এবং দুপাশের গাছ পালা পাহাড় মিলে এ-জাহাজ কটা দিন বন্দরে কাটিয়ে দিল। হিগিনস এখানে কিছু মেরামতের কাজ সেরে নিলেন। ছোটবাবুর মাথার খুলিতে জঙ-ধরা পেরেক সামান্য ঢুকে গেছিল এবং অপারেশনের পর তাড়াতাড়ি আরোগ্য লাভে সবাই খুশি। হাসপাতালে একমাত্র এনজিন-সারেঙ এবং সেকেন্ড অফিসার বাদে কেউ যেতে পারছে না। ওরা ছোটবাবু কেমন আছে দেখতে যায়। ওরা ফিরে এলে জ্যাকের কোনো আর অস্বস্তি থাকে না। সে কখনও এত বেশি অধীর থাকে যে হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় ব্রীজের নিচে। এবং বাদামী রঙের মানুষ, চুল কোঁকড়ানো, ঠোঁট পুরু মানুষ দেখে দেখে যখন ক্লান্ত তখনই হয়তো দূরে ব্রীজের ওপর দিয়ে সে দেখতে পায় সেকেন্ড অফিসার ডেবিড আসছে।

তখন জেটিগুলোতে কি সব অতিকায় শব্দ, আকরিক লোহা সব জাহাজে বোঝাই হচ্ছে। এবং এমন সব অতিকায় শব্দ যে জ্যাক যতই জোরে চিৎকার করুক, কাছে না এলে ডেবিড কিছু শুনতে পায় না, অথবা তখন হয়তো কোন মোটর-গাড়ি পেছনে দাঁড়িয়ে প্যাঁক প্যাঁক করছে, জ্যাকের কানেই যাচ্ছে না, পেছনে কোন মোটর-গাড়ি থাকতে পারে, পৃথিবীতে এখন একটা খবর বাদে অন্য কোন খবর আছে সে জানে না।

জ্যাক বলল, আমরা কবে যেতে পারব?

—কাল।

—সত্যি!

জ্যাক আনন্দে ডেবিডের পিঠে ঘুসি বসিয়ে দিল।

—ও লাগছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *