1 of 2

অলৌকিক জলযান – ১৩

।। তেরো।।

ভোরবেলা মৈত্রের উঠতে একটু বেলা হয়ে গেল। বোধহয় মৈত্র রাতে সেই স্বপ্নটা দেখছিল। বোধহয় স্বপ্নটা এত দ্রুত মাথার ভেতর পাক খাচ্ছিল যে কখন ভোর হয়ে গেছে মৈত্র টের পায়নি। একটা মাছের কঙ্কাল, তিমি মাছের কঙ্কাল বড় পাইন গাছে কেউ ঝুলিয়ে রেখে গেছে। সে স্বপ্নে সব সময় গাছটার নিচে দাঁড়িয়েছিল। কাজে যাবার সময় বার বার স্বপ্নটার কথা তার মনে হচ্ছে।

কাল মদ বেশী মাত্রায় হয়েছে। ঘুমও ভাল হয়নি। আর একটু ঘুমোলে বেশ ভাল হত। কিন্তু রাত থাকতেই সাতটার ঘণ্টা পড়ে গেছে। এখনও ডেকে আলো জ্বালা। সারেঙ ওপরে দাঁড়িয়ে টান্টু বলছেন। এনজিনরুমে অনেক কাজ। জাহাজের এসব কাজ বন্দরে না এলে করা যায় না। কিনার থেকে লোকজন উঠে এসেছে। এনজিনে ওয়েলডিং-এর কাজ। পুরানো জাহাজ় বলে, এটা থাকে তে ওটা খসে যায়। যতক্ষণ বন্দরে জাহাজ ততক্ষণ ওয়েলডিং।

সকাল থেকেই মৈত্রের মেজাজ খারাপ। অমিয়র জন্য এটা হয়েছে। কাল মৈত্র অনেক প্যাসু হেরেছে। হেরে যাওয়ার মূলে অমিয়। সেই লোকটার একাউন্টে টাকা না পাঠাতে পারলে শেফালী তাড়াতাড়ি টাকা পাবে না। একটা ড্রাফট যাবে। তাছাড়া রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কিছু নিয়ম কানুন আছে, সব ঠিকঠাক করে পেতে পেতে এমনিতেই দেরি হয়ে যাবে। যদি মানুষটা আজ আসে, এলে দুপুরে আসবে, তখন জাহাজে কে না কে উঠে আসে ঠিক থাকে না। জাহাজ-ডেকে হাজার রকমের মানুষ। কেউ কাউকে চেনে বলে মনে হয় না। কনট্রাকটারদের লোকই বেশি। নানা জায়গায় মেরামত করছে ওরা। এ- সময়ে মালটা নামিয়ে দেওয়া খুব সহজ! সেই মানুষটি আসবে কনট্রাকটারের লোক হয়ে। কারো কোন সন্দেহ করার কারণ থাকবে না!

সেই একঘেয়ে কাজ। বন্দরে একরকম, সমুদ্রে অন্যরকম। জেটিতে ভীষণ ব্যস্ততা। মাল কেবল নেমে যাচ্ছে। মেজ-মালোম ফল্কায় ছুটে যাচ্ছেন। বড়-মালোম হিসাব মেলাচ্ছেন। পাঁচটায় ছুটি হলে আবার স্নান। মেসরুমে বসে আহার। তারপর ফুরফুরে পাখির মতো বন্দরে নাইটিঙ্গল দেখতে নেমে যাওয়া।

সিঁড়ির মুখে অমিয়র সঙ্গে দেখা। অমিয় মগে চা নিয়ে নিচে নামছে। সিঁড়িতে নামার সময় মৈত্র বলল, কাল তোর জন্য এসব হল।

—বা বেশতো। খেললি তুই, আর দোষ আমার!

—তোর জন্যই তো বের হওয়া।

—ন্যাকামি করবি না।

—আজ আর কোথাও যাচ্ছি না। সোজা ঠিক জায়গায় চলে যাব।

—যাবি না তো যাবি না। আমাকে কি বলছিস!

এবং অমিরর আর ইচ্ছা হল না কথা বলতে। ছোটবাবু ওদের কথা কাটাকাটিতে খুব মজা পায়। এবং সে জানে এটা খুব সাময়িক। আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।

জাহাজ থেকে নেমে যাবার মুখে মৈত্রের মনে হল, কেউ ওকে ডাকছে। সে দাঁড়াল। ডেকবোসান এদিকে আসছে। ওর হাতে একটা চিঠি। শেফালীর চিঠি সে বুঝতে পারে। এখন সে নামতে পারে না, চিঠিটা পড়া দরকার। সে ফের ফোকসালে ফিরে গেল। আলো জ্বেলে বসল। ছোটবাবু অথবা অমিয়কে সে সঙ্গে নিচ্ছে না। একাই যাবে ভেবেছে। তারপর চিঠির ভাঁজ খোলার সময় অন্যবারের মতো তেমন সুগন্ধ পাচ্ছে না যেন। আর লেখাটা মনে হল বড় হিজিবিজি, এবং এখন সে বুঝতে পারল, আগের চিঠিটা অনেকদিন আগে শেফালী লিখেছিল। বুনো-এয়ার্সের ডাকঘরে অনেকদিন পড়েছিল হয়ত অথবা এজেণ্ট অফিসে। আর এ-চিঠি সদ্য লেখা। চিঠিটা পড়তে পড়তেই বুঝল, শেফালী ভয়ঙ্কর অসুস্থ। দুর্বলতার জন্য ভালভাবে চিঠিটা লিখতে পারেনি। চিঠিটা পড়তে পড়তেই সে কেমন বিচলিত বোধ করছে। হিজিবিজি লেখা স্পষ্ট বুঝতে পারছে না। সময় লাগছে পড়তে। লিখেছে ওর বমি ভয়ানক হচ্ছে। কিছু খেতে পারছে না। বিছানার সঙ্গে শরীর মিশে গেছে। শেষে লিখেছে, টাকার খুব দরকার। তুমি যে টাকা দিয়ে গিয়েছিলে সব শেষ। মাসে মাসে যে টাকা কোম্পানীর ঘর থেকে আসে ওতে কি হয় বল! ডাক্তার আর ওষুধে সব ফুরিয়ে গেছে। তুমি কবে ফিরছ, জাহাজ কবে ফিরবে। আবার কোথায় যাচ্ছ ঠিকানা দেবে।

মাঝে মাঝে অনেক অস্পষ্ট কথা লেখা আছে। সে ঠিক তা এখনও উদ্ধার করতে পারেনি। যেন একটা নাম হ্যাঁ বিমল, ফের এসেছিল। শেফালী লাইনটা আবার নিজেই কেটে দিয়েছে। দুর্বল হাতে ভালভাবে কাটতে পারেনি। বিমলের স্ত্রী শেফালী, কথাটা মনে হলেই ভেতরে সে ভীষণ কষ্ট পায়। বিমল ওর বন্ধু, বিমল খুব জাহাজের গল্প শুনতে ভালবাসত। বিমল, সরকারী অফিসে কি একটা বড় চাকুরে। বিমলের কথা মনে হলেই মনে হয়, লোকটা আস্ত শয়তান!

তখন মৈত্র সবে মাত্র কার্গো লাইনের জাহাজে কাজ নিয়েছে। সফর ঘুরে এসে কেমন শেয়ানা হয়ে গেল সে। পৃথিবীর অনেক দেশ সে দেখেছে। রয়েল নেভিতে সে সুযোগ তেমন ছিল না। সফর শেষে এভাবে বাড়ি ফিরলে সে রাজার মতো চলাফেরা করত। পৃথিবীর সব বন্দরের যাবতীয় সুখ যেন ওর দু’পকেটে। সে যেন সেইসব সুখের গল্প দু’পকেটে ভরে ফেরি করতে ভালোবাসে। সে, গল্প বলার সময় শেফালীকে একজোড়া ম্যানিলা হ্যাম্পের চটির গল্প শুনিয়েছিল। সে যে কি আগ্রহ! একজোড়া ম্যানিলা হ্যাম্পের চটি না পরতে পারলে শেফালী বুঝি ভাবল, বেঁচে থেকে সুখ নেই। বেঁচে সুখ নেই, বেড়িয়ে সুখ নেই। কি সুন্দর সুন্দর গল্প বলত শেফালীকে, মিয়ামি বিচের সুন্দরীদের প্রতিযোগিতার গল্প শুনলে শেফালী হাঁ করে থাকত। শেফালীকে সে কুহকে ফেলে দিয়েছিল। এবং যা হয়ে থাকে, সেই থেকে এমন সুন্দরী বৌটা বিমলের, ওর কাছে চলে আসতে চাইল। লাজ- লজ্জা সব সে হারিয়ে ফেলল।

মৈত্র বলল, তাহলে তুমি শুভেন্দু মৈত্র, মনে মনে বিমলের নাম শুনলে কষ্ট পাও। বিমলের এখন কি ইচ্ছে সে এত দূর থেকে জানতে পারে না। সে চলে এলে বিমল সব লুটেপুটে খেতে পারে। বিমলের সুবিধা ওর চেয়ে অনেক বেশি। বিমল তো অন্য একটা মেয়েকে ঠিক মিয়ামি বিচে নিয়ে গেছে, তবে আর কেন! শেফালীর কি দরকার, বিমলের কথা লেখার! শেফালী কি বিমলকে এখনও ভুলতে পারেনি। শেফালী কি বিমলকে…কারণ মৈত্র নেই, মৈত্র জাহাজে চলে গেছে, তুমি এ-সময় আমার কাছে কাছে থাকো।

সে চিঠিটা ভাঁজ করে পকেটে ভরে রাখল। অমিয় দুবার এসেছে, একটা কথাও বলেনি। মৈত্র কোথায় যাচ্ছে, জানতে চায়নি। যেন অমিয় অথবা মৈত্র কেউ কাউকে চেনে না। ছোটবাবু আজ বেশ সকাল সকাল মেজ-মালোমের সঙ্গে কিনারায় নেমে গেছে। বোধহয় এসব ছোটবাবুর ঠিক ভাল লাগেনি। ছোটবাবু চাপা স্বভাবের মানুষ। নানাভাবে চেষ্টা করেও ছোটবাবুর কিছু জানা যায় না। ওর চিঠি আসে না। চিঠি না এলে এখন সে আর দুঃখ করে না। মন ভার করে থাকে না। ছোটবাবু নিজের দুঃখ বোধহয় নিজের ভেতর সবসময় লুকিয়ে রাখে। ছোটবাবুকে ঠিক মৈত্র বুঝতে পারেনা।

চারপাশটা দেখতে দেখতে নেমে গেল মৈত্র। চারপাশে তেমনি আলো জ্বলছে এবং আলোর বাহার। সে তার ভেতরে একাকী হেঁটে যাচ্ছে। দুপুরবেলা, সে ঠিক নামিয়ে দিয়েছিল মালটা। এখন সে রাজার মতো হাঁটতে পারে। কারণ টাকা পয়সার ভাবনা তার নেই। এখন শুধু পাঠানোর ভাবনা। সামনে সেইসব টিউলিপ ফুলের গাছ, সেইসব লাইটপোস্ট, সেইসব পাখিরা একরকমের, অথবা তেমনি নাইটিঙ্গেল পাখিরা উড়ছে।

সেই টাওয়ারটা, সামনে। ঘড়িতে পাঁচটা বাজার শব্দ। লোকটার কাছে সে ঠিকানা ভালভাবে জেনে নিয়েছে। সে এখন শুধু সেদিকেই যাবে। অন্য কোথাও নয়। লাল নীল বলের কথা, মেয়ের বাও করা চোখের কথা দু-একবার মনে হয়েছে। সে একেবারে আমল দেয়নি। বাস, মানুষজন, নিচে ট্রেন ছুটে যাচ্ছে। বেশ ভিড়। এবং মানুষের শরীরে বিদেশী গন্ধ। সে ওদের পাশ কাটিয়ে গেলেই কেমন একটা আশ্চর্য গন্ধ পায়। ওর মনে হল তখন, না খেয়ে জাহাজ থেকে নেমে আসা ঠিক হয়নি। আসলে অমিয়কে সে এড়িয়ে থাকতে চেয়েছিল। একটু খেয়ে নিতে হয়। খুব খিদে পেয়ে গেছে। ফিরতে ফিরতে রাত হবে বেশ। কারণ যা বলেছে, তাতে ওকে কেরিয়েম্বুজ পার হয়ে যেতে হবে। সে রেস্তোঁরাতে ঢুকে খাবার চাইল। বড় রেস্তোঁরা। পাশে রেকর্ড-প্লেয়ারে নানারকম গান। কাউন্টারে দামী কাচের ভিতর মেমসাব, মুখে সেই সরল মিষ্টি হাসি। কি করে যে ওরা এমন সুন্দর হাসতে পারে। এতবার হাসতে ওদের কষ্ট হয় না! মেয়েরা এমনভাবে হাসলে সে শেফালীর কথা মনে না করে পারে না। আর মনে হলেই শির-শির করে শরীরে একটা শীতের মতো ঠাণ্ডা। চোখ মুখ জ্বালা করতে থাকে।

সে ইচ্ছে করেই আর মেমসাবের দিকে তাকাল না। সে স্যাণ্ড-উইচ এবং কিছু গ্রীণ পিজ সেদ্ধ চেয়ে নিল।

তখন অন্য এক যুবতী মেমসাব, সে এসে আর কি লাগবে জানতে চাইছে।

সে বলল, আর কিছু চাই না।

—একটু চা?

—চা লাগবে না।

—খুব ভাল আইসক্রিম কফি আছে।

মৈত্র বলল, না।

—অক্‌সটেল পরিজ আছে!

মৈত্র বলল, না।

—ড্রিংকস!

—ইয়েস।

এবং এ-ভাবে দামী মদ, সাদা টাওয়েল, অর্থাৎ টাওয়েল পাল্টে দিয়ে গেল মেয়েটা। অর্ডার নিচ্ছে যেসব মেয়েরা ওরা খদ্দেরদের খুব পাশাপাশি থাকছে। ঘুরছে ফিরছে। অনেক সময় কেউ কেউ পাশে বসে সঙ্গ দিচ্ছে। বোধহয় মৈত্রকে মেয়েটি পাশে বসে চিয়ার-আপ করছিল।

মৈত্র বলল, দু পেগ।

দু পেগ এলে, একটা নিজের কাছে টেনে নিল, অন্যটা মেয়েটিকে এগিয়ে দিল।

—আমাকে! সব ইসারাতে কথাবার্তা।

—ইয়েস।

—নো।

—খুব রাগ করব। হাত ঘুরিয়ে মুখ ভার করে বোঝাল, না খেলে সে দুঃখ পাবে।

মেয়েটি এবার টেনে নিল গ্লাসটা। আর ঠিক তখনই অমিয় হাজির। ঠিক ওৎ পেতে আছে। মৈত্রের আবার পায়ের রক্ত মাথায়।

—কিরে মেয়েছেলে নিয়ে মদ খাচ্ছিস! তুইতো আচ্ছা লোক। এই বৌকে টাকা পাঠানো! মৈত্র আরও দু পেগের অর্ডার দিল। তারপর সে খেল না। উঠে পড়ার সময় অমিয়র হাত ধরে

বসিয়ে দিল। শালা খা, যত পারিস মদ মেয়েছেলে খা।

—বা বেশ মৈত্র, তুই নিজে খেয়ে আমার নামে বিল রেখে যাচ্ছিস!

মৈত্র অযথা কথা বাড়াল না। কাউন্টারের সামনে সে বিল মেটাবার জন্য দাঁড়াল।

অমিয় প্রায় সরবত খাবার মতো চুমুক মেরে সবটা গলায়, মিনিটখানেক মুখ কুঁচকে রাখল। তারপর বলল দাঁড়া মৈত্র, আমি যাচ্ছি।

—না। তুমি বরং আর একটু খাও শালা। বলে সে কাউন্টারে ইশারা করতেই আরও দু পেগ। অমিয় লোভ সামলাতে পারল না। পরের পয়সায় ইচ্ছে মতো মদ খেতে কি যে ভালো লাগে। মনে মনে সে মৈত্রকে জাহান্নামে পাঠালেও এখন খুব ভালবাসছে। মরুক গে, যেখানে খুশি যাক। সে এখানে বেশ আছে। বাকি দু পেগ, একটু সময় নিয়ে খাবে।

মৈত্র ভাবল, যাক বাঁচা গেল! মেয়ে এবং মদ দিয়ে বসিয়ে দিতে পেরেছে। নতুবা সারাটা রাস্তা ভ্যানর ভ্যানর, এটা কি, ওটা কি—মেয়েটার প্রলোভনে অমিয় পড়ে গেছে। অমিয় মদ খেয়েই চলে যাবে সেখানে! তারপর খেলা আরম্ভ করবে। এবং সঙ্গে সঙ্গে মৈত্রের ফের কেন যে মদের নেশা পেয়ে গেল। ঠিক যেন জমেনি। তুমি অমিয় আমার ওপর টেক্কা দিতে চাইছ! সে ভাবল, খুব তাড়াতাড়ি যাওয়া দরকার! টাকাটা কাল পাঠালেও ক্ষতি হবে না শেফালীর। এবং মনে মনে ভাবল এক দুই করে কাঠের বল তুলে নেওয়া যাবে। চোখে যে ওর কি সব রঙীন ছবি ধরা পড়ছে এখন। এক দুই করে সব কাঠের রঙ্গীন বল ওর চোখের ওপর বেলুনের মতো উড়ে বেড়াচ্ছে। সব বল সে যেন বাজীকরের মতো আকাশে এক দুই করে অদৃশ্য করে দিচ্ছে। এমন কি মেয়েটাকে পর্যন্ত। এমন

সে দেখতে পাচ্ছে, চারপাশে বলগুলো নক্ষত্র হয়ে গেছে, এবং সে আর মেয়েটি আকাশের নিচে নক্ষত্রের পাশে দুটো মাছের মতো সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে। আহা, হরি ওঁম। বলে মৈত্র রাস্তাতেই একেবারে বেমালুম মাতালের মতো হাঁটতে হাঁটতে ঠিক জায়গায় পৌঁছে গেল। কখনও লাইনে দাঁড়িয়ে, কখনও রেলিঙে ভর দিয়ে, চুক চুক করে মদ খেল। সব নদ-নদীর জল মাথায় ছুঁইয়ে গেল যেন।

মৈত্র বার বার পেছনের দিকে তাকাচ্ছে। না, অমিয় ওকে পেছনে ফলো করছে না। জিভ বেশ ভারি ভারি ঠেকছে। কিছু রোস্ট মাংস নিয়েছিল প্যাকেটে। সে প্যাকেট খুলে রোস্ট মাংস চিবুতে থাকল। নরম জিভে এক ধরনের স্বাদ, নরম মাংস কতদিন খাচ্ছে না। কত দীর্ঘদিন…সে ভয়ঙ্কর ভাবে নরম মাংসের জন্য দীর্ঘদিন পর এক…দুই…তিন, চার…পাঁচ…ছয়, সে দীর্ঘদিন পর ছয় থেকে বারোটা লাল নীল বল চোখের সামনে ভাসতে দেখল। কার্নিভেলের মেয়েটা যেন এখন ওর সামনে ফের বাউ করছে।

তারপর ওর আর কিছুই মনে আসছিল না। শুধু লাল নীল বল, হলুদ রঙের কাঠের ট্রে, রুপোর স্টিক এবং মেয়েটির আশ্চর্য সরল হাসি অথবা দু হাঁটু ভাঁজ করে সামান্য নুয়ে বাউ, সে যেতে যেতে এসবই মনে করতে পারছে। সে রিঙের সামনে দাঁড়িয়ে গলায় টাই টেনে দিল। সে ভীষণ স্মার্ট হবার চেষ্টা করছে। সে মাথার টুপিটা আরও টেনে দিল মুখের কাছে। সব কাউন্টার থেকে সেই এক সরল হাসি, এখানে আসুন স্যার। আপনার জন্য আমরা নানারকম মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা রেখেছি। সে সব কিছু না শোনার চেষ্টা করছে। মাথার টুপিতে যতটা পারছে কপাল মুখ ঢেকে দিচ্ছে।

তারপর সেই সরল অনাড়ম্বর হাসি। হাতে রুপোর স্টিক, এরেনার ভিতর হাতে চাবুকের মতো খেলা বেশ জমে উঠবে। মেয়েটি রুপোর স্টিক দিয়ে বল ঠেলে দিচ্ছে। মৈত্র সোজা বল তুলে নিল না। সে শুঁকে শুঁকে কি যেন টেবিলের চারপাশটা দেখছে। আসলে সে নুয়ে দেখছে। কোথায় কি রেখা অথবা ভাঁজ রয়েছে টেবিলের দাগগুলোর ভেতর সে যেন খুব ভালভাবে দেখছে। দেখলে মনে হবে, সে শুঁকে যাচ্ছে টেবিলের চারপাশটা।

আর রূপোর স্টিকে মেয়েটি পায়চারি করতে করতে মাঝে মাঝে লাঠি ঘোরাচ্ছে। কেউ কেউ দোকানের সামনে পায়চারি করছে। ওরা তিন-চার দান হেরে যেতেই মুখ গোমড়া করে ফেলেছে। মেয়েটা পরেছে নীল রঙের ট্রাউজার। মনে হয় কোন নরম পাখির বুকের পালক দিয়ে সে তৈরি করেছে তার পোশাক। ওর পোশাকের ভেতর কি যে সব সুন্দর সব লতা-পাতা আঁকা ছবি। ওর পোশাকে আছে ভীষণ চাকচিক্য। মৈত্র এমন পোশাক জীবনেও যেন দেখেনি। হাতের কাছে ফুলের মতো গাউনের হাতা। ফুলে আছে। আর বুকের কাছে শরীরের সঙ্গে জামা সেঁটে আছে। স্তন এমন উঁচু করে রাখার কি যে দরকার! সে ভালভাবে তাকাতে পারছে না পর্যন্ত। মাথায় মেয়েটি আর টুপি পরেনি। চুলে বব্ ছাঁট। কোঁকড়ানো কালো চুলে নীল চোখে এক দুর্ধর্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী। মৈত্র দান তুলে নিল।

মেয়েটি ভেবেছিল সে খেলবে। কিন্তু আশ্চর্য, না খেলা না, প্যাসু গুনে গুনে দেওয়া। মৈত্র বরং বলগুলি নিয়ে তারের ওপর খেলা দেখানোর মতো বল হাওয়ায় ছুঁড়ে দিতে থাকল। আসলে মৈত্র জানে বেশি রাতে ওর খেলা জমবে। সে এখন যেন মেয়েটার বল ছুঁড়ে ছুঁড়ে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। এখানে আসুন, খেলুন, খুব সহজ খেলা, আপনার যা দরকার লাগে নিয়ে যান। কেবল রিঙের মেয়েটি বাদে। এর জন্য আমি শেষ খেলা খেলব ভাবছি মশাইরা। সে ঘুরে ঘুরে বলের নানা ট্রিক্স—জ্যাবের ভিতর কানের ভাঁজে এবং মাথায় বল রেখে ব্যালেন্সের খেলা—এবং লোক জমে গেলেই, কিছু কিছু লোক খেলতে আরম্ভ করে দেয়। দিলে যা হয় নেশা লাগে। হারতে থাকে। টেবিলে প্যাসু গুনে শেষ করতে পারে না মেয়েটি।

কে বলবে এখন মৈত্র এই রিঙের খদ্দের! সে কখনও মেয়েটাকে টাকা গুনে দিতে পর্যন্ত সাহায্য করছে! একা পেরে উঠছে না। সে মেয়েটার হয়ে রুপোর স্টিকে বল ঠেলে দিচ্ছে। ভিড় কমে গেলেই সে আবার রুপোর স্টিকের মাথায় বল রেখে ব্যালেন্সের খেলা আরম্ভ করে দেয় এবং এভাবে সে এই রিঙে একজন মজাদার মানুষ।

মৈত্র থামের আড়াল থেকে কখনও কখনও মেয়েটিকে দেখছে। সে আর খেলা দেখাচ্ছে না। এই ভিড়টা কেটে গেলেই আরম্ভ করবে। কিন্তু মনে হল, কেউ যেতে চাইছে না। কেউ খেলছে, কেউ মজা দেখছে। এমন একটা রিং ছেড়ে কারো যেতে ইচ্ছে করছে না। অথচ অন্য রিঙগুলো ফাঁকা হয়ে গেছে। কেবল এখানেই ভিড়। আচ্ছা মুশকিল হল। সে চারপাশে তাকিয়ে এবার এগিয়ে গেল। বল গড়িয়ে আসছে, আর সে ধরে ফেলছে। অর্থাৎ সে এবার খেলবে এবং ক্রমে ক্রমে বলগুলো ট্রে থেকে তুলে নিল। অর্থাৎ সে কাউকে আর খেলতে দিচ্ছে না। যাদের খেলে অভ্যাস যারা জানে মেয়েটির নানা রকমের বাহাদুরী, তারা মুচকি হাসছিল, বোকা জাহাজিটা মরবে। বেটা এক আজগুবী মানুষ।

এবার মৈত্র এবং মেয়েটি। মৈত্র চুপচাপ খেলে যেতে থাকল। প্যাসগুলো ড্রয়ারে রেখে তালা মেরে দিল মেয়েটা। কারণ একা যখন এবং সামনে জাহাজি মানুষ, সে ঠিক ভরসা পাচ্ছে না। সে এখন রুপোর স্টিকে চিবুক রেখে মৈত্রের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে আছে। মানুষটা বিদেশী এবং জাহাজি মানুষ। জাঁহাজি মানুষকে পোশাকে ঠিক চেনা যায়। মানুষটা ভীষণ বেপরোয়া। একসঙ্গে অনেকগুলো প্যাসু বাজী রেখেছে। মরদের মতো খেলে যাচ্ছে। অথচ মুখে ভীষণ তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ভাব মেয়েটির। যেন এমন সে কত খেলোয়াড়দের দেখে থাকে রোজ।

রাত বাড়ছিল। ভেতরে ভেতরে মৈত্র মরিয়া হয়ে উঠেছে। আর হেরে যাচ্ছে। এত হেরে গেলে রিঙেরও বদনাম। মেয়েটি জাহাজি মানুষটার ওপরে করুণা বশেও হয়তো রিঙের সব বল তুলে বড় একটা কাচের পাত্রে রেখে দিচ্ছে। কাচের পাত্রে তুলে দেওয়ার অর্থ আর না। একটু পর সব বন্ধ হয়ে যাবে। আর খেলা হবে না। এবার জাহাজে ফের।

মৈত্র এবার ঝুঁকে দাঁড়াল। ইশারা করল। এবং হাতের পাঁচ আঙ্গুলে কিছু বোঝাতে চাইল।

মেয়েটি বুঝল, পাঁচ প্যাসু! মেয়েটি ঠোঁট উল্টে দিল।

মৈত্র আসলে আজও একগাদা প্যাসু হেরে গেছে। সে এই হেরে হেরে মেয়েটিকে জিতে নিতে চাইছে। সে পাঁচ আঙ্গুলে পঞ্চাশ প্যাসু বলতে চেয়েছে, মেয়েটি কি বুঝেছে কে জানে।

মৈত্রের হাতে এখন আর কোনও বল নেই। সদরে যারা ব্যাণ্ড বাজাচ্ছে যারা ব্যাগ-পাইপ বাজাচ্ছিল এখন তারা পর্যন্ত বাজনা থামিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ এবার ছুটি। মেয়েটিও একসময় ওকে পাহারা রেখে বাক্সের সব প্যাসু ভেতরে কোথায় জমা দিয়ে এল। ঝাঁপ ফেলে দিচ্ছে। ডেনছিগোতে একজনও বসে এখন মদ খাচ্ছে না। কার্পেট তুলে ফেলা হচ্ছে। গোটা কার্নিভেল এখন ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেছে। কেমন নিঝুম। দু-একজন মাতাল পুরুষ অথবা রিঙের মেয়েরা বের হয়ে যাচ্ছে। ওদের দেখে মৈত্র আরও অস্থির হয়ে উঠছে।

মৈত্র’ আর থাকতে পারল না। সে দশ আঙুলে, দেখাল, একশ। একশ প্যাসু দেব মেয়ে।

মেয়েটি কোন কথা বলল না। সে মৈত্রের মুখের ওপর ঝাঁপ ফেলে দিল। এবং মৈত্রের দিকে সে আর ফিরে তাকাল না। হন হন করে সদর দরজার দিকে হাঁটতে থাকল। মৈত্র কেন জানি ডাকতে সাহস করল না। ওর চোখের ওপরে রাতের এমন সুন্দর নাইটিঙ্গেল পাখি অদৃশ্য হয়ে গেল। সে হায় হায় করে উঠল।

.

রবিবার সুতরাং সকলের ছুটি। ডেক এবং এনজিন জাহাজিদের কোন কাজ নেই। ডেক-ভাণ্ডারি এবং এনজিন-ভাণ্ডারির কেবল কাজ গ্যালিতে। মেসরুমবয় এবং মেটদেরও কাজ থাকে। স্টুয়ার্ড ইকবাল সাহেব ভোরে উঠেই চিফ কুক এবং ভাণ্ডারিদের রসদ দিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং তিনিও প্রায় ছুটি উপভোগ করছিলেন। অফিসার এনজিনিয়াররা ছুটির দিন বলে বেশ রাত করে জাহাজে ফিরেছে। ওরা এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি।

ভোরের দিকে ছোটবাবু একবার উঠেছিল। কি ঘন কুয়াশা চারপাশে! কুয়াশার জন্য কিছু দেখা যাচ্ছে না। সে কুয়াশা এবং শীতের জন্য ফের এসে শুয়ে পড়েছে। মৈত্র জেগেছিল। সে খুটখাট শব্দ হতেই কম্বল সরাল মুখের। অমিয় এখনও ঘুমোচ্ছে। ওকে ডাকতে সাহস হচ্ছিল না। কাল কিনারায় সে শেষ পর্যন্ত কি কাণ্ড করে ফিরেছে কে জানে। ছোটবাবু হয়তো ফের নাক ডাকিয়ে ঘুমোবার জন্য কম্বলের ভিতর ঢুকে যাচ্ছে।

অথচ একটু চা না খেলে হচ্ছে না। কাজের কোন তাড়া নেই। যতক্ষণ পারা যায় শুয়ে থাকা। আলস্য সারা শরীরে। এবং এ জন্যই যত হিজিবিজি চিন্তা থেকে রক্ষা পাবার জন্য ডাকল, এই ছোটবাবু।

কম্বলের ভেতর থেকে জবাব এল—হুঁ

—একটু চা খাওয়াবি?

—খুব ঠাণ্ডা ওপরে। কুয়াশা। কিছু দেখা যাচ্ছে না।

মৈত্র বুঝতে পারল ছোটবাবু কিছুতেই এখন উঠতে চাইছে না। এত শীতে সহজে কেউ উঠতে চায় না। কিন্তু ওকে উঠতে হবে। সে আর শুয়ে থাকতে পারবে না। তাকে একবার বাথরুমে যেতে হবে। শেফালী নানাভাবে সারারাত বিব্রত করেছে। রাতে ওর ভাল ঘুম হয়নি। সকালে শেফালীর কথা ভেবে ভীষণ মায়া হচ্ছিল। শেফালীকে কাল বিকেলে একেবারে ভুলে গিয়েছিল। কাল রাতে এবং মধ্য রাতে, অন্তত স্বপ্নটার আগে পর্যন্ত শেফালীর কথা মনে করতে পারেনি। ভোর রাতে ঘুমের ভেতর প্রথম একটা অপরিচিত মুখ, ঠিক কুয়াশার ভেতর দাঁড়িয়ে থাকলে যেমন লাগে, তেমনি শেফালী দাঁড়িয়েছিল। সে প্রথম বুঝতে পারেনি শেফালী। পরে যেন মনে হয়েছে চেনা চেনা। তারপরই যখন চোখ তুলে তাকাল, একেবারে শেফালী। বিমলবাবুর ভালবাসার স্ত্রী শেফালী। শুভেন্দু মৈত্রের কিডন্যাপ করা বৌ। বিমলবাবু যে বৌর ওপর অধিকার ছেড়ে দিয়ে ভেবেছিল, বাঁচা গেল। যা উত্তাপ মেয়ের বিমলবাবুর পক্ষে বোধ হয় সামলানো কঠিন ছিল বৌকে।

ভেতর বাইরে কোথাও তেমন সোরগোল নেই। কাজের জন্য কোনো কিনারার লোক ডেকে উঠে আসেনি। ফল্কায় কাজ হচ্ছে না। কাঠের পাটাতনে ঢাকা। সকালে বড়-মালোম আর কাপ্তান নিচে নেমে গেছে। ওরা যাবে গীর্জায়। বাথরুম থেকে ফিরে এলে, শরীর খুব ঝরঝরে এবং হাল্কা মনে হচ্ছে। ওর ইচ্ছা হচ্ছিল, এখন চুপচাপ এক কাপ চা খায়। এ সময় সামান্য ধূপের গন্ধ থাকলে যেন ভাল হত। ফুলের গন্ধ অথবা চন্দনের সৌরভ হলে যেন মন্দ হয় না। রাতে সব পাপ কাজের কথা সে ভুলে যেতে পারত। রাতের শেষে জলের নিচে, নীল স্ফটিক জলে সে তবে হয়তো আর শেফালীকে বিশ্রীভাবে শুয়ে থাকতে দেখত না।

সে নিজেই চা করে আনল। ছোটবাবু এবং অমিয়কে ডেকে চা দিল। ওদের জড়ানো চোখ। কোনরকমে চা খেয়েই আবার কম্বলের নিচে। যেন ওরা এমন সুখ সহজে হাতছাড়া করবে না। চা খেতে খেতে কেন যে গত সফরের সেই মেয়ে, এলসা দ্য কেলি, ওর মা স্যালেস দ্য কেলি, সেই মামাবাবু ক্যাপ্টেন ফ্রগের কথা মনে পড়ছে। দুপুরের দিকে কোথাও বের হয়ে পড়তে হবে। বের হতে না পারলেই সেই গোলকধাঁধা। সে বুঝতে পারছে, কিছুতেই আর জাহাজে সে থাকতে পারছে না।

এবং এভাবে সে ভাবল, যদি বিকেলের দিকে ছোটবাবুকে নিয়ে বের হওয়া যায়। ছোটবাবুর ভেতর কেমন একটা সরল অনাড়ম্বর জীবনযাপন আছে, যা মুগ্ধ করে বিস্মিত করে। সে পাশে থাকলে বোধহয় সাহস পাবে। সুতরাং অমিয়কে সঙ্গে না নিয়ে বরং সে ছোটবাবুকে সঙ্গে নিয়ে বের হবে। ছোটবাবু মেজ-মালোমের সঙ্গে বের হতে পারে। সে চা খেতে খেতে বলল, আমার সঙ্গে এক জায়গায় যাবি ছোট!

—কোথায়!

—সে আছে, তোকে নিয়ে যাব। খারাপ জায়গা না। তোকে এলসা দ্যর কথা বলিনি! ওদের ওখানে যাব।

কম্বলের নিচে অমিয় মিউ মিউ গলায় বলছে, আমিও যাব।

—না, তোমাকে নেব না!

—না নিলেও যাব। আমি যাব কিন্তু বলছি।

—আচ্ছা ঝামেলা হল দেখছি!

ছোটবাবু বলল, চলুক না মৈত্রদা। ও আবার একা ঘুরে বেড়াবে কোথায়!

যেন মৈত্রকে রাগিয়ে দেবার জন্য কম্বলের ভেতর থেকেই জিজ্ঞাসা করল অমিয়—কিরে টাকা পাঠালি?

—তোমাকে বলব কেন? আমার পার্সোনাল ব্যাপারে ঝুট ঝামেলা করবে না।

এত শীতে ওরা আর ঘুমোতে পারছে না। দুজনই উঠে বসেছে। ছোটবাবু মুখটা শুধু বের করে রেখেছে। অমিয় তাও না। সে বসে আছে সব ঢেকে। এমন কি মুখে ঠান্ডা লাগার ভয়ে সে ঘোমটার মতো কম্বল মুখের ওপর ফেলে দিয়েছে। মৈত্রও বাংকে বসে পড়ল। টাকা পাঠাতে পারেনি, আজ ঠিক পাঠাবে। এলসা দ্য কেলির বাড়ি হয়ে বিকেলে চলে যাবে ঠিক জায়গায়। অমিয় থাকলে প্রলোভনে পড়ে যেতে পারে।

ছোট বলল, তুমি তো সবই বল।

—তা বলি।

—তবে আর না বলে থাকছ কেন?

—না, পাঠাই নি।

অমিয় বলল, তাড়াতাড়ি পাঠা।

—সে আমি বুঝব।

এবং এভাবে ওরা ঠিক দুপুরে বের হয়ে গেল। ওরা জেটি ধরে হেঁটে গেল। এরা ভারতবর্ষের মানুষ, এদের দেখলেই কেউ কেউ ভারতবর্ষের মানুষ বলে চিনতে পারে। ওরা যে, শীত-কাতুরে ভীষণ, তাও বুঝতে পারে। কারণ সকালটা এত কুয়াশা আর ঠান্ডা ছিল হাত-পা কেউ গরম রাখতে পারে নি। দুপুরের দিকে কুয়াশা কেটে গেলে যা হয়, রোদ, মনোরম রোদ, রোদের ভেতর হেঁটে যাচ্ছে, হাল্কা মসলিনের মতো রোদ। ওরা তার ভেতরে হেঁটে যাচ্ছে অথচ শরীরে ওভারকোট, হাতে দস্তানা, মাথায় মাংকি ক্যাপ, যেন ওরা বরফের দেশে এসে গেছে। এখন তো এখানে শীত চলে যাবার সময়। বরং এদেশে এখন বসন্তকাল পড়বে। ওরা এমন ঢেকে-ঢুকে হেঁটে গেলে, কেউ কেউ হেসে ফেলে। আর তখনই বুঝতে পারে, ওরা ভারতবর্ষের মানুষ, একটু ওরা শীতকাতুরে। ওদের ক্ষমা করে দেওয়া চলে।

কেউ হেসে ফেললে, মৈত্র হাতজোড় করে ক্ষমা চায়। তখন রাস্তার লোকজন ওদের দেখার জন্য ভিড় করতে থাকে। সে তাদেরও হাত জোড় করে ক্ষমা প্রার্থনা করছে। কেউ বুঝি ঠিক ঠিক বুঝতে পারে না। অমিয় তখন সুযোগ বুঝে আবোল-তাবোল অশ্লীল বাংলা কথাবার্তা যা মুখে আসে বলে যায়। ছোটবাবুর এসব শুনলে কান গরম হবার কথা। কিন্তু এখন কেমন সহ্য হয়ে গেছে। অমিয় অনেকের নামকরণ পর্যন্ত করে ফেলেছে। যেমন বড় মিস্ত্রির কথা উঠলেই অমিয় বলবে, শালা মগরবাজ আজও দেখলাম ঠিক নাগর সেজে চলে গেল রে মাইরি। মেয়েটার কি যে অল্প বয়স!

সুতরাং এভাবে ছোটবাবু আনন্দই পায়। বিশেষ করে এই যে অচেনা শহর, মানুষজন, তাদের কথাবার্তায় সে নানাভাবে মজা পায়। সে জানে না তখন তার ভেতরে আছে এক প্রচন্ড দুঃখ। নিশিদিন সে দুঃখ সুপ্ত থাকে ভেতরে। ছোটবাবু সেজন্য কখনও খুব উচ্ছল হতে পারে না। ভেতরে উচ্ছাস থাকলে সেও বোধহয় গলা মিলিয়ে বাংলা অশ্লীল সব কথাবার্তা বলে মজা করতে পারত। কিন্তু সে পারে না।

মৈত্র যেতে যেতে এক সময় বলল, এদেশের মেয়েরা দেখতে আশ্চর্য সুন্দর। অমিয় বলল, সে তো জাহাজেই টের পাচ্ছি।

—বোধহয় পৃথিবীর আর কোথাও এমন সুন্দর যুবতী দেখতে পাবে না।

—তা জানি না। ছোট বলল।

—না পাবে না। এমন রঙ, এমন চোখ, এমন চুল পৃথিবীতে আর আছে বলে আমি জানি না।

—হবে হয় ত।

—এলসা ছিল, এদের ভেতর রাজকন্যা।

—তাই বুঝি।

—শালা ব্যানার্জী, এই ঠিক তোর স্বভাবের মতো ছিল রে, শালা কোথাকার এক অপোগন্ড, তাকে কিনা এদেশের এমন সুন্দর ‘মেয়েটা ভালবেসে ফেলল।

—ভালবাসার কথা কেউ বলতে পারে না। কখন কিভাবে যে সব হয়ে যায়।

—হেলেন অফ ট্রয়! মেয়েটাকে আমি পৃথিবীর ট্রয় নগরীর হেলেন ভেবে থাকি। সে প্রায় দু হাত তুলে বলে উঠল, হার মিরাকল ফেস চার্মস্ মি। .

—তা হলে চল দেখা যাক তোমার হেলেনকে। অমিয় বলল, দ্যাখো আমার সঙ্গে ভিড়িয়ে দিতে পার কিনা। তবে আমি ঠিক এখানে থেকে যাব। পৃথিবীর আর কোথাও গিয়ে আমার কাজ নেই, ট্রয় নগরীর হেলেনকে নিয়ে শুধু ঘুরব। কাজ করতে আমার বয়ে গেছে!

—কি আজেবাজে বকিস না।

এই হচ্ছে মৈত্রের স্বভাব। কখন যে সে খুব ভালো মানুষ হয়ে যায় বোঝা যায় না। এলসাকে নিয়ে মৈত্র কোন ঠাট্টা পছন্দ করছে না। এলসা ওর আত্মীয়র কাছাকাছি যেন। সে শেষে বলল, আয়। লেন্দ্রো এলেন থাউজেন্ড টু। এই নম্বর। সে তার ডাইরি থেকে নম্বর টুকে এনেছিল। যেতে যেতে বাড়ির গায়ে নম্বর মিলিয়ে দেখছে। সে এই শহরের সব কেমন গোলমাল করে ফেলছে। এতবার এসেও ঠিক মনে রাখতে পারছে না। সব বাড়িঘর দেখতে এক রকমের, রাস্তা এক রকমের, সোজা একেবারে ছককাটা। একটা বাড়ির সঙ্গে অন্য বাড়ির কোন অমিল নেই এদিকটায়।

মৈত্র জাহাজেই এলসার নানারকমের গল্প ছোটবাবুকে বলেছে। ছোটবাবুর তখন মনে হয় সব বন্দরের ছোটখাট ঘটনা মৈত্র জানে। এবং সে প্রায় ঐতিহাসিকের মতো। যা জানে বলে যায়, বন্দরের বিধি-নিষেধ সে সব জানে। ঘুরে বেড়াও ক্ষতি নেই, ফুল কেন ক্ষতি নেই কিন্তু আর বেশিদুর যাওয়া ঠিক না। আর যারা জাহাজি ওরা বলবে যদি বন্দরে মেয়েমানুষই না পেলে তবে কেন যে জাহাজি হওয়া। এমন সব নিয়মকানুন চলতি আছে জাহাজে। আর যেহেতু মৈত্র ওদের প্রায় গার্জিয়ানের মতো বন্ধুর মতো, তার কথা নানাকারণে রাখতে হয়। ওরা হাঁটতে হাঁটতে মৈত্রের কথামতো রাস্তাঘাট পার হয়ে যাচ্ছে।

মৈত্র যেতে যেতে বলল, এই শোন তোরা আবার ওকে বলিস না, ব্যানার্জী বিয়ে করেছে। ব্যানার্জী শিক্ষকতা করছে। তোদের তো বলতে কিছু আটকায় না। আর দেখবি, এলসা কি সুন্দর ইংরেজি বলে। ও হল ইতালির মেয়ে। বাবা ওয়েলসের। ভদ্রলোক এখানে তেলের ব্যবসা করতে এসে কার- এ্যাকসিডেন্টে মারা যান। আর শোন, যাচ্ছি যখন, একটু কেনাকাটা দরকার।

অমিয় সেই যে চুপ করেছে, আর একটি কথাও বলছে না। সামনের সেই টাওয়ারের ঘড়িতে দুটো বাজার শব্দ। মৈত্রের বুকটা ধ্বক করে উঠল। পাশেই যেন কেউ বিউগিল বাজাচ্ছে আর যেন ক্যারাভেন যায়, নানা রকমের উটের মুখ বোধ হয় সদর দরজায় টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। মৈত্র এসব ভুলে থাকার জন্য একটা ফুলের দোকানে ঢুকে কিছু ফুল কিনে ফেলল। সেলেস দ্যর জন্য কিছু ফল। আর সে জাহাজ থেকে নেমে আসার সময় দু-প্যাকেট ক্যাপস্টেন সিগারেট নিয়েছে। মামাবাবু এ- সিগারেট খুব পছন্দ করেন। এখানে ভালো টোবাকো পাওয়া যায় না। দু-প্যাকেট ক্যাপস্টেন পেলে কি যে খুশী হবে!

মৈত্রের সব জানা বলে, সে যেতে যেতে বলল, এটাই ফ্লোরিদার সব চেয়ে বড় বাড়ি। তুই এখানে ঢুকলে আমাদের এমব্যাসি-হাউজ দেখতে পাবি। পাশে একটা বড় রেস্তোঁরা আছে। মাঝ ভাজা পাওয়া যায়। অলিভ-অয়েলে রান্না। খেতে খারাপ লাগবে না। কতদিন মাছ খাই না। ওরা তিনজন সময় কাটাবার জন্য বসে চা খেল। এখানে এসেই কেন জানি মৈত্রের মনে হয়েছে, ওরা খুব তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। একটু পরে না গেলে ঠিক হবে না। ওরা চা খেল, মাছ-ভাজা খেল। মেয়েদের সঙ্গে আড্ডা জমাতে চাইল। একটা কথাও বুঝছে না বলে, অমিয় ধুস্ শালা বলে ওঠে পড়ল।

বের হতেই মনে হল শহরময় বড় গন্ডগোল আরম্ভ হয়ে গেছে। মানুষজন ছুটোছুটি করছে। যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে। কিছু স্টেনগানের শব্দ। পুলিশ এবং কিছু মিলিটারি ঘুরে গেল। ওরা এ- দেশের মানুষদের মতো ঠিক কোনও গলি-ঘুঁজি খুঁজে পেল না। দোকানের ভেতর ঢুকতে গিয়ে দেখল, সব ঝুপঝাপ সাটার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। জানালা-দরজা সব বন্ধ। ওরা এবার এলোপাথারি ছুটতে গিয়ে বুঝতে পারল, ঠিক হবে না। ওরা একটা বড় ক্যামাও গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে পড়ল। গাছটার চারপাশে নাবালকের মতো ঘুরে মরার সময় মনে হল, সব আবার ঠান্ডা। গাড়ি ঘোড়া চলছে, কেন এটা হল বুঝতে পারছে না। একটা মানুষের খোঁজে কারা এসে ফিরে গেছে। ধরতে পারেনি। পাশের এক বৃদ্ধা ওদের ক্যামাও গাছের চারপাশে ঘুরতে দেখে হেসে ফেলল। বলল, স্পষ্ট ইংরেজিতে বলল, তোমাদের কিছু হবে না বাছা। তোমরা ঘোরাফেরা কর, ময়ফেল কর। তারপর নিজে কেমন বিড় বিড় করে বকতে থাকল, পেরণ সরকারের পতনের পরই এমন আকছার ঘটনা ঘটছে।

ওরা এখনও হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে কেরিয়েম্বুজ পার হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে আপেলের গাছ, চেরিফলের গাছ। কিছু আঙুরলতা দেয়ালের ওপর। আর সদর দরজায় তেমনি সেই বড় টিউলি প গাছটি আছে। ওরা সহসা গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে পড়ল।

টিউলিপ গাছটায় তেমনি ফুল ফুটে আছে। পাশে পাথরে নানাবর্ণের অর্কিডের ছড়াছড়ি। কিছু ফুলের চাষ লনে, পাশে গোলাপের বাগান। বড় বড় বেগুনি রঙের লাল রঙের গোলাপ ফুটে আছে। আর লনে সব ডেইজি ফুল, ফুটে আছে। হলুদ রঙের ছোট ছোট ফুল, এবং কেউ যেন জানালায় এখন চাঁদমালার মতো গুচ্ছ গুচ্ছ সান-ফ্লাওয়ার টাঙিয়ে দিয়ে গেছে। এমন সুন্দর টিপটপ সাজানো বাড়ি, অথচ জানালা বন্ধ, দরজা বন্ধ, কেউ নেই। ওরা কি কোথাও শীতের ছুটিতে চলে গেছে? জানালায় পারসিমন লতা ঝুলছে। এতটুকু ধুলো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন নয়। যেন কেউ এখুনি দরজা বন্ধ করে বাইরে গেছে।

মৈত্র বলল, রোজই এসে দেখতাম, ব্যানার্জী এবং এলসা এখানে বসে রয়েছে। ব্যানার্জী নানা রকমের গল্প বলছে। সবই আমাদের দেশের গল্প। ও যে কত জানত। ভাল ইংরেজি বলতে পারত ব্যানার্জী। কলেজে পড়েছে। তোর চেয়ে বয়সে বড় ছেলেটা। বেশ কিন্তু ছিল তবে খুব ভীতু। না হলে এলসাকে ফেলে এ-ভাবে কেউ চলে যায়! তারপর সে একটু হেসে বলল, আসলে ও হারামজাদা একটা অমানুষ। আমরা অমানুষ লেখাপড়া না শিখে, ও-শালা অমানুষ লেখাপড়া শিখে।

একসময় মৈত্র বলল, চারপাশে নানারকমের ঘটনা ঘটছে, হয়তো সেজন্য দরজা-জানালা সব বন্ধ। সে এবার দরজায় দাঁড়িয়ে বেল টিপল। বেশ শব্দ হচ্ছে। বাজছে বেলটা। কিন্তু কেউ এসে দরজা খুলে দিচ্ছে না।

কোন সাড়া পেল না মৈত্র। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। ভেতরে ওরা কোন আলো জ্বলতে দেখল না। ওরা কি তবে শহর ছেড়ে চলে গেছে। সেলেস দ্য ক্যালি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপিকা। সেবারে ব্যানার্জি দরজাতেই পথ হারিয়ে অনেক রাত অবধি অপেক্ষা করেছিল। ভোর হলে পুলিশের শরণাপন্ন হবে, এমন একটা ভাবনা মনে মনে। সে সদর দরজার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল, যেমন একজন মাতাল মানুষ অথবা বাজ-পড়া মানুষ মরে যাবার পরও দাঁড়িয়ে থাকে, ঠিক তেমনি সে একজন প্রায় চেতনাহীন মানুষ, সকাল না হলে সে এখান থেকে নড়বে না ভেবেছিল। ঠায় দাঁড়িয়ে একটা লাঠিতে ভর করে রাত কাটাবে ভেবেছিল। শহর ঘুরতে বের হয়ে ওর এমন বিপাক। সে জানত না স্পেনীশ না জানলে, শহরে এমন বিপাকে পড়তে হয়।

তারপর মৈত্র শার্শির ভেতর দিয়ে উঁকি দেবার চেষ্টা করল। না কিছু দেখা যাচ্ছে না। সে বলল, ভাগ্যিস এই দরজা দিয়ে সেলেস দ্য ক্যালী বাড়িতে ফিরছিলেন। দরজায় একজন মানুষ! কপালে টুপি নামানো। প্রথম তিনি ভেবেছিলেন মাতাল মানুষ। এ-ভাবে মানুষেরা শহরের রাস্তায় চুপ চাপ দাঁড়িয়ে থাকে কখনও! তিনি প্রথম ওকে স্পেনীশ ভাষায় কিছু জিজ্ঞাসা করেছিলেন। কিন্তু কোন উত্তর না পেলে ইংরেজিতে। ব্যানার্জী ইয়াংকি কিনা তাও।

না এখনও কেউ আসছে না। এ-ভাবে এখানে দাঁড়িয়ে থাকাও খারাপ দেখাচ্ছে। সে যেন কথা প্রসঙ্গে আবার সব বলে যেতে থাকল, সে-রাতে ব্যানার্জীকে সরষে ফুল দেখতে হত। সেলেস দ্য ক্যালীর এমন কথা তার কাছে প্রায় তখন ঈশ্বরের সামিল। সে বলেছিল, মাদাম আমি ইয়াংকি নই। মাদাম আমি মাতাল নই। আমাকে ভয় পাবার কিছু নেই। আমি জাহাজি, ভারতীয়। শহর দেখতে বের হয়ে পথ হারিয়েছি।

অমিয় বলল, একেবারে নবকুমার দেখছি।

—প্ৰায় তাই।

এখন মনে হয় ঘরের ভিতরে কেউ পায়চারি করছে।

দরজা খুললে মৈত্র বলল, গুড ইভিনিং মাদাম

তিনি কিছু বললেন না। তারপর যেন কি ভেবে বললেন, গুড-ইভিনিং। আপনারা…….।

—চিনতে পারলেন না মাদাম! আমি মৈত্র।

—মৈত্র! অনেকক্ষণ পর যেন বুঝতে পারলেন। আবার এসেছ!

—হ্যাঁ, মাদাম। আবার এসেছি।

তারপর মৈত্র তাঁর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল, এ অমিয় আর এ ছোটবাবু। গত সফরের ব্যানার্জীর মতো এক ফোকসালে আমরা থাকি।

এলসাকে দেখা যাচ্ছে না। এ-সময় সে বাড়ি নাও থাকতে পারে। তবু উঁকি ঝুঁকি মারল সে। সেলেস দ্য বুঝতে পেরে বললেন, সে নেই। তারপর বললেন, এস ভেতরে। আকাশ ক’দিন থেকে বেশ পরিষ্কার কি বল?

–তা ঠিক।

–তোমরা আসবে বলেই হয়ত, বলে তিনি সামান্য হাসলেন।

মৈত্র লক্ষ্য করছে, সেলেস দ্য কেমন বুড়ি হয়ে গেছেন। মামাবাবু নেই। তার কুকুর নেই। এলসা মামাবাবুর সঙ্গে কোথাও যেতে পারে। যেন এখানে এলসা না থাকলে আসার কোন মানে হয় না। কিন্তু এলসা সম্পর্কে সেলেস দ্য আর কিছু বলছে না।

মৈত্র এবার বসতে বসতে অন্য কথা পাড়ল। বলল, ক্যাপ্টেন সাবকে দেখছি না। ওর কুকুরটা। তিনি থাকলে দেখতে ছোটবাবু যুদ্ধের গল্প খুব জমে উঠত। মামাবাবু যুদ্ধ ছাড়া কিছু বোঝেন না।

সে এখন এভিতাতে আছে। সমুদ্রের ধারে তাঁবু বানিয়ে নিয়েছে। বেশ আছে।

—কি করছেন এখন?

—কিছুই না। সারাদিন কুকুর মেজিকে নিয়ে সমুদ্রের ধারে ছুটে বেড়ায়। সারা দুপুর সমুদ্রের নিচে ডুবুরিদের সঙ্গে সাঁতার কাটে। হাতে ওর একটা বর্শা থাকে। ম্যাকরল মাছ মেরে খেতে খুব ভালবাসে। সে এখন কুকুর বাদে কিছু জানে না। মেজির জন্য সে এ-শহর ছেড়ে চলে গেছে।

ছোটবাবু বলল, মেজির বুঝি শহর ভাল লাগছিল না?

—না। শহরে সে ভালভাবে ছুটতে পারে না। ফাঁকা জায়গা না হলে আয়াস পায় না মেজি। তাছাড়া একটি লোককে মেজি কামড়ে দিয়েছিল। ফ্রক ফাইন দিয়েছে। তা ছাড়া সরকার পক্ষের উকিল গুলি করে মারার জন্য সওয়াল পর্যন্ত করেছিল।

—তাই বুঝি। অমিয় খুব সহজভাবে বলল। আর অমিয় এবং মৈত্র কি ভদ্র এখন। অশ্লীল কথাবার্তা বলতে পারে মুখ দেখে এখন তা বিশ্বাসই হয় না।

—ওর ভীষণ ভয়, মেজিকে কেউ একদিন না একদিন ঠিক গুলি করবে। সে শেষ পর্যন্ত সব ছেড়েছুড়ে চলে গেল।

মৈত্র যাকে খুঁজছে, তাকে দেখতে পাচ্ছে না। সেলেস দ্যকে খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। ফ্রক এখানে নেই। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মানুষটা জার্মানির হয়ে লড়েছেন। কত রকমের নিষ্ঠুর মৃত্যুর গল্প যে করেছেন, করতে করতে হেসেছেন। মৃত্যুর জন্য, ধ্বংসের জন্য ওঁর কোন দুঃখ ছিল না। তিনি এখন একটা কুকুরের প্রাণ বাঁচাতে সমুদ্রতীরে বনবাসে চলে গেছেন। মানুষের মাঝে মাঝে কি যে হয়?

ঘরে নীল রঙের কার্পেট পাতা। সবুজ, হলুদ, লাল সব কৃত্রিম ফুলের যেন ছড়াছড়ি কার্পেটে। দেয়ালে সাদা রঙ, কিছু ছবি। এলসার ছবি নেই। এ-ঘরে আগে মৈত্র এলে এলসার একটা বড় ছবি দেখতে পেত। এলসার হাতে টেনিস র‍্যাকেট। সে ছুটে গিয়ে বল মারছে এমন একটা ভঙ্গিতে তোলা ছিল ছবিটা। এত সুন্দর ছবিটাও এ ঘরে নেই। কেবল যীশুর একটা কাঠের মূর্তি। আর কোণে সবুজ বাতিদান। ফুলদানিতে কেউ ফুল তুলে রাখেনি। বোঝাই যায় এ-পরিবারে কোথাও একটা বড় রকমের ঝড় গেছে। সেলেস দ্য সেই ঝড় নিয়ে বেঁচে আছেন।

সেলেস দ্য এক সময় এভিতাতে কি করে যাওয়া যায় তার সবরকমের পথঘাট বলে দিলেন মৈত্রকে।

ছোটবাবু এলসার কথা ভাবছিল। ঘরের ভেতর কেমন একটা বিদেশী গন্ধ। অমিয় উসখুশ করছে। এমন একটা ছুটির দিনে, এ-ভাবে বসে থাকতে তার ভাল লাগে না। কেমন একটুতেই একঘেয়ে। কেন যে এ-ভাবে আসা! সেলেস দ্য ছোটবাবুকে বললেন, কেমন লাগছে আমাদের শহরটা।

—খুব সুন্দর। ছিমছাম। আমার তো খুব ভাল লাগে হেঁটে বেড়াতে। কিন্তু কেউ এখানে ইংরেজি বোঝে না। পথ হারাব ভেবেই খুব বেশি দূর যেতে পারি না।

এ-সব কথাও তেমন জমছে না। একটু কফি করতে সেলেস দ্য ভেতরে গেছেন। তখন অমিয় বলল, এই ওঠ। আমার ভাল লাগছে না।

ছোটবাবু বলল, এলসা থাকলে আমাদের খুব ভাল লাগত।

মৈত্র বলল, মনে হয় কোথাও গেছে। ঠিক এসে যাবে। এলসা মাকে বাদে থাকতে পারে না।

অমিয় যেন কেমন ক্ষেপে গেল—দেখছিস বুড়ি খুব সেয়ানা। মেয়ের কথা কিছু বলছে না।

—বেশি বললে ভাবতে পারে, এলসাকে আমাদের খুব দরকার। তিনি খারাপ ভাবতে পারেন।

অমিয় বলল, এ-দেশের মেয়েরা ভাল কবে। ব্যানার্জী যাবার সময়, তুমি বিহনে প্রাণ বাঁচে না আমার, আর চলে গেলেই নটে গাছটি মুড়ল, আমার গল্প ফুরোল

মৈত্র বলল, এই আসছে!

অমিয় হেসে দিল, বলল, সেলেস দ্য বাংলা জানেন বুঝি।

—এটা অসভ্যতা। তুই যখন ইংরেজি জানিস, যখন আমরাও মোটামুটি জানি, তখন ওঁর সামনে বাংলা বলা অভদ্রতা।

এই প্রৌঢ়ার সঙ্গে গল্প করতে মৈত্রেরও খুব একটা ভাল লাগছে না। মৈত্র এ-সব দেশগুলোতে ঘুরে বেশ একটা নিজের মতো স্বভাব গড়ে তুলেছে। সে এখন সেলেস দ্যকে সাহায্য করছে কাজে। মৈত্রকে দেখে মনে হয় সে যেন এ-পরিপারের কেউ। তাকে কিছুতেই আর ভাবা যায় না, সে কখনও কোন জুয়ার রিঙে দাঁড়িয়ে আঙ্গুল ফাঁক করে বলতে পারে, পঞ্চাশ অথবা একশ।

সেলেস দ্য বললেন, রাস্তায় গন্ডগোল দেখে দরজা জানালা বন্ধ করে রেখেছিলাম। একটা লোককে কারা খুঁজে বেড়াচ্ছে। কে যে সে! তার কি নাম আমরা জানি না। তার একটা নাম আইখম্যান। শোনা যায় ওটা নাকি মানুষটার ছদ্মনাম। আসল নাম কেউ জানে না।

–সে কে!

সে অনেক কিছু ছিল। তার নিষ্ঠুরতার শেষ ছিল না। সে এ-দেশে পালিয়ে আছে, কি করে যে এ-সব খবর রটে যায়! সে এখানে আসবেই বা কেন!

—তা ঠিক।

—কি করত?

—যুদ্ধের সময় কনসেনট্রেশন ক্যামপে ইহুদীদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করত।

—ভয়ঙ্কর!

—হুঁ। ভয়ঙ্কর। বলেই সেলেস দ্য খ্রীষ্টের ছবিটা দেখলেন।

ওরা প্রত্যেকেই এখন বেশ আগ্রহ নিয়ে শুনছিল। এবং মাঝে মাঝে জুতোর শব্দ অথবা কোন শব্দ শুনলে দরজার দিকে তাকাচ্ছে, না কেউ না। একটা পাতা পড়ার শব্দ, না কেউ না, বোধহয় ও-পাশের সিঁড়িতে কোন ভাড়াটে মানুষ উঠে যাচ্ছে। ছোটবাবু ঠিক বুঝতে পারে না, এলসাকে দেখার এমন আগ্রহ কেন। যেন ওরা ওকে দেখে না গেলে প্রায় ট্রয়ের হেলেনকে দেখার সুযোগ হারাবে। মৈত্র সুন্দরীদের সম্পর্কে বড় বেশি খুঁতখুঁতে স্বভাবের। তার মুখে এসব কথা, সুতরাং ওরা ভাবছিল, সেই মহিমময়ী এসে গেলে চারপাশের যত কিছু সহসা ফুলে ফলে ভরে যাবে। আর এমন একটা লোভে পড়ে গিয়ে কেউ উঠতে পারছে না।

কফি অথবা খাবার, কিছুই ভাল লাগছে না। সেলেস দ্য ভীষণভাবে ওদের জাহাজ, ওরা তারপর কোথায় যাচ্ছে, ওরা বাড়িতে মাকে চিঠি লেখে কিনা, আর কে কে আছে, এ-সব জানতে চাইছেন। এবং এ-জন্য প্রশ্নের পর প্রশ্ন

কিন্তু এ-সবের জন্য ওরা এখানে আসেনি। ওরা এসেছে এলসার জন্য। যে প্রতিদিন জাহাজঘাটায় ওর ছোট্ট বেবিমোটর নিয়ে অপেক্ষা করত। কি যে ছিল ব্যানার্জীর, কি যে ছিল ব্যানার্জীর চোখে! অনেক রাতে জাহাজে পৌঁছে দিয়েছিলেন সেলেস দ্য। পরদিন মেয়েকে পাঠিয়েছিলেন খোঁজ নিতে, সে কেমন আছে। ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে শীতে অসুখে পড়ে যেতে পারে। বিকেলে ব্যানার্জী দেখেছিল একটি মেয়ে, চুল তার কবেকার……..কি যেন গাছের ছায়ায় দাঁড়ানো একটা মেয়ে, ভারি সুন্দর, ভারি লম্বা, ভারি হাসি-খুশি। তাকে সে খুঁজতে এসেছে। সে আছে, ভালই আছে, এবং সে নিচে নেমে গেলে বলেছিল, তুমি কোনদিকে যাবে? ব্যানার্জী বলেছিল, কোথাও না। আবার হারালে, কে আমাকে পৌঁছে দেবে।

এলসা বলেছিল, আমি।

এ-সব গল্প মৈত্র বলেছিল। অমিয় শুনে বলেছিল, কিছুটা গানের সুরে, এলসা আহা, আমরা হারিয়ে গেলে পৌঁছে দেবে না। আমি বার বার হারিয়ে যাব।

সেলেস দ্য দুটো প্লেট আনতে গেলে অমিয় প্রায় গানের সুরে হাত তুলে গুনগুন করে গেয়েছিল—বার বার হারিয়ে যাব।

—অমিয় তুই একটা জংলি

—তা তুমি বলতে পার।

—নমস্কার! একশবার নমস্কার। তোমাকে নিয়ে কোনও ভদ্র-পরিবারে যাওয়া ঠিক না।

সে বলল, আচ্ছা নমস্কার। আমিও আর যাব না। কেবল দয়া করে এলসাকে এখন দেখিয়ে দাও। দেখাতে না পারলে জাহাজে ফিরে শালা তোমাকে পেঁদাব।

মৈত্র ক্ষেপে গেল খুব। অথচ সে মুখ ভার করতে পারে না। এবং অমিয় এটা বুঝেই ফেলেছে। ঘন্টাখানেক সময় পার করে দিতে পারলেই মৈত্র সব ভুলে যাবে। সেলেস দ্য এলে সেও খুব গম্ভীর হয়ে গেল। একেবারে অসীম সমুদ্রে পাল তুলে দিয়েছে। মস্তো সিরিয়াস মুখ সবার।

মৈত্র যেন নিজের মান সম্মান বাঁচানোর জন্য বলল, আজ উঠি মাদাম।

—কেন! এতো সকাল সকাল। বোস না। গাড়িটা বেচে দিয়েছি। না হলে তোমার বন্ধুদের নিয়ে শহরটা ঘুরতে পারতাম। ওরা এখানকার সবকিছু দেখে গেলে আমার ভাল লাগত। এমন শহর, এমন সুন্দর জায়গা পৃথিবীতে আর নেই।

মৈত্র যেন দুঃখ দিতে চায় না। সে বলল, আমরা আবার কাল আসব।

অমিয় যেন নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচল। আর একটা চান্‌স।

সেলেস দ্য বললেন, কাল এস কিন্তু! অনেকদিন একা একা আছি। কেউ এখন আসে না। রিটায়ার করেছি বছরের ওপর। সেলেস দ্যর গলা কেমন ভারী ভারী। তারপর কেমন সহজ গলায় বললেন, তোমাদের এখানে ভাল লাগছে না বুঝতে পারি। তোমরা এখন শুধু খাবে দাবে, ঘুরে বেড়াবে। আনন্দ করবে। বড় সুখের সময় এটা।

—না না আপনি তা মনে করবেন না। আপনাকে আমাদের খুব ভাল লেগেছে। আমরা কাল ঠিক আসব। ছোটবাবু খুব আন্তরিক গলায় বলে অপলক সেলেস দ্যকে দেখল।

অমিয় বলল, এলসাকে বলবেন, আমরা এসেছিলাম।

সেলেস দ্য কালীকে মনে হচ্ছিল তিনি এবার দূরে হেঁটে যাবেন। এবং ছায়ার মতো গাছপালার ভেতর অদৃশ্য হয়ে যাবেন। তিনি কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। কিছু বললেন না।

অমিয় বলল, বলবেন কিন্তু মনে করে আমরা এসেছিলাম বলবেন।

সেলেস দ্য ওদের সঙ্গে সদর পর্যন্ত হেঁটে গেলেন। তারপর তিনি দাঁড়ালেন। বললেন, কাল এস। তারপর হেসে বললেন, এলসা বেঁচে নেই।

মৈত্র সহসা কিছু বলতে পারল না।—এমন একটা ফুলের মতো মেয়ে মরে গেল।

—হ্যাঁ মরে গেল মৈত্র। তোমাদের যাবার মাস তিনের ভেতর সেও চলে গেল।

ওরা কেউ আর এক পা বাড়াতে পারছে না। অমিয় যে অমিয়, যার মুখে কিছু আটকায় না, সেও বড় কোনও নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে মনে হয়। মনে হয় নিঃসঙ্গ, বড় বেশি নিঃসঙ্গতা। নদীর বুকে ঢেউ উঠে শান্ত হয়ে গেল সব। সে চোখ তুলে সেলেস দ্যকে দেখার চেষ্টা করল না। ওর ভয় ধরে গেছে। মুখটা কেমন দেখাবে কে জানে! দুঃখী মুখ দেখতে তার ভাল লাগে না।

মৈত্র বলল, কি হয়েছিল?

–কি হয়েছিল জানি না। কেমন এক মেলাঙকোলিয়া। চুপচাপ থাকত, কথা বলত না। ক্ৰমে রোগা হয়ে গেল। চোখের ওপর আমার সুন্দর মেয়েটা পোড়া কাঠ হয়ে গেল। সে খেতে চাইতো না। কারো সঙ্গে কথা বলতে চাইত না।

—কিন্তু ও যে একটা চিঠি লিখেছিল। পানামা ক্যানেলে আমাদের তখন জাহাজ। আমরা নিউজিল্যান্ড যাচ্ছি। ব্যানার্জী, চিঠির কথা আমাকে বলেছিল।

—ওটা ওর শেষ চিঠি।

—সামান্য একটা মাত্র লাইন। ডোন্ট ফরগেট মি। এমন কিছু বোধহয় লিখেছিল।

—কি লিখেছিল আমি বলতে পারব না। তবে চিঠিটা যখন লেখে, তখন আমি ছিলাম। তখন ও বিছানা থেকে উঠতে পারে না, খুব দুর্বল। ওর কিছু লেখার আর তখন ক্ষমতাও ছিল না। ছোটবাবুর কেন যেন মনে হয় পৃথিবীতে মানুষের দুঃখটা এক রকমের। ভালবাসা এক রকমের মা-মাসীরা পৃথিবীর সব সময় এক রকমের হয়।

এলসাকে সে দেখেনি, তবু কেন যে মনে হয়, এলসা পৃথিবীর এমন মেয়ে যার তুলনা নেই। সেও যেন এলসার জন্য এ-দেশে থেকে যেতে পারত। পৃথিবীর এমন সুন্দর মেয়েটা, ভালবাসতে গিয়ে মরে গেল।

রাস্তায় নেমে হঠাৎ চেঁচিয়ে বলল, ব্যানার্জীটা কি অমানুষ!

—অমানুষ কিনা জানি না। দুঃখটা ওর দিকেও ছিল। অথচ দ্যাখ ভেবে পাই না, ওর বাবা কেমন মানুষ। আমরা লিখেছিলাম, এমন একটি ঘটনাতে আপনার মত দেওয়া উচিত।

—তিনি কি লিখেছিলেন?

—জানি না। তবে উনি ব্যানার্জীকে ঠিক কিছু লিখেছিলেন। কি যে লিখেছিলন! সে অমানুষের মতো তারপরই কাজটা করে ফেলল। এলসাকে বলল, হয় না, আমি এখানে থেকে যেতে পারি না। থাকলে, খুব স্বার্থপরের মতো কাজটা হবে।

ছোটবাবু বলল, এখানে থাকলে সেটা অবশ্য হত। আমাদের ভারতবর্ষের মানুষরা এমন ঠিকই ভাবতেন।

অমিয় ধমক লাগাল, রাখ তোর কথা। আসলে ব্যানার্জী অমানুষ। না হলে এমন কাজ কেউ করে না। সে ভয় পেয়ে গেছিল শেষ পর্যন্ত।

মৈত্র, আর একটু ব্যাখা করল, ওর বাবা সেকেলে মানুষ

—সবার বাবারাই সেকেলে থাকে। ভালবাসার সে দাম দেবে না সেজন্য!

ছোটবাবু বলল, কোথাকার একটা ছেলে, কোথাকার একটা মেয়ে, মেয়েটা কিনা, একটা ছেলেকে দেখেই প্রেমে পড়ে গেল। তারপর মরে গেল। ভাবা যায় না!

মৈত্র বলল, মানুষের নিষ্ঠুরতা নানা রকমের থাকে। ব্যানার্জী পরে যা বলেছিল, জাহাজে মাঝে মাঝে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেলে বলত, বাবার চিঠিটাতে মায়ের সতীত্ব প্রমাণের কথা ছিল।

—তার মানে!

—মানে, আমার জাতক হলে তুমি এ কাজ করবে না, ওর বাবা লিখেছিল।

—হায় ভারতবাসী, হাসতে হাসতে গলায় ফাঁসি। সত্যি এমন হয়!

—ব্যানার্জীর বেলায় এটা হতে দেখেছি। সে আছে, বেশ আছে। বউ আছে। বউ জানেনা এ সব। আমরা এখানে মেয়েটার জন্য কষ্ট পাচ্ছি।

অথচ ওরা হাঁটতে হাঁটতে দেখল, রাত হয়ে গেছে। শো-কেসগুলোতে আলোর বর্ণমালা। কত সব বিচিত্র বর্ণের ছবি। কত সব সাজগোজ, কত সব লোভের পাখী ডানা মেলে উড়ছে। এ-সব দেখলে তারপর বুঝি মনে থাকে না, কোথাকার কে এলসা, কে ব্যানার্জী, কে সেলেস দ্য অথবা কোনও ক্যাপ্টেনের সমুদ্রতীরে বনবাস, তার প্রিয় কুকুর মেজিকে নিয়ে সে আছে। কেবল মনে হয় উটের মতো মুখটি তুলে এক অতীব নিষ্ঠুর খেলা মানুষের ভেতর বেঁচে থাকে, বেড়ে ওঠে, অবহেলায় দূরে ঠেলে দেয়া যায় না। মানুষ তার অতীব এক দাস। তাল-বেতাল সে তার স্বভাবে।

মৈত্র এখন প্রায় দৌড়ে দৌড়ে হাঁটছিল। দেরি হলে কার্ণিভেল ভেঙ্গে যাবে যেন। অথচ মুখে কিছু বলছে না। সে কেবল হেঁটে যাচ্ছে। ওরা ওকে অনুসরণ করে হাঁটছে। বাসে অথবা ট্যাকসিতে ওরা যাচ্ছে না। অথবা মনে হয়, ছেলেমানুষের মতো মৈত্র মেলায় যাচ্ছে, ঘোড়দৌড় হয়ে গেলে সব গেল। সে ঘোড়দৌড় দেখার জন্য জোরে হাঁটছে যেন। কোন দিকবিদিক জ্ঞান থাকছে না।

এবং মনে হয় তিনজনেই ভুলে কার্ণিভেলে ঢুকে গেছে। কেউ একটা কথা বলছে না। মেলাটা ঘুরে চলে যাবে।

সেই এক চারপাশে নানাবর্ণের দোকান। মদের বোতল, রিঙ, সুবেশা রমনী। পিস্তলের খেলা অথবা ম্যাগপাই। কৃত্রিম হ্রদ, কৃত্রিম পাহাড়। আর হাজার হাজার জুয়ারি ছুটছে। ছুটির দিন বলে হয়ত এমন হয়েছে। নিয়ন আলো। আলোর রঙে রিঙের যুবতীদের মুখ ঝলমল করছে। আর কেউ কেউ খেলছে, হাঁটছে। কেউ কেউ নাচছে এবং গাইছে। যুবক-যুবতীরা হাসি মসকরা করছে। ওরা ছুটছে, খেলছে। ওরা সামনের পাহাড়ের টানেলে ঢুকে যাচ্ছে। সব নকল পাহাড়, নকল টানেল। যেন এই যে মানুষেরা তোমরা ভারি নকলনবিশ, আসলে চেহারা তোমাদের এমন নয়—কি যে সব ভাবছে মৈত্র। গত সফরে মৈত্র এক জাহাজি বন্ধু ব্যানার্জীর সঙ্গে এই টানেলের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল।

অন্ধকার গুহামধ্যে মৈত্র বাঘ হরিণ থেকে আরম্ভ করে কতকালের ভয়ঙ্কর মুখ পর্যন্ত দেখেছে। সবই নকল। ভয় দেখানোর জন্য এমনভাবে সাজিয়ে রাখা। এবং কত সব মুখোশের ভেতর ভূতের হাত-পা নাড়া। ওরা ভয় পায়নি। এলসা ওদের সঙ্গে ছিল। হঠাৎ ঢুকলে ভয় পাবার কথা। কিন্তু এলসা ছিল ভারি ভাল মেয়ে। ব্যানার্জি ভয় পাবে বলে প্রথম সে ঢুকতেই চায়নি।

এ-ভাবে এলসা মরে গেলে মনে হল, ফুল ফোটার সময় হলে মৌমাছিরা উড়ে আসে। ফুলের মতো মেয়ে এলসা। এলসা এখন নাগালের বাইরে। হায়, এলসা ভালবেসে মরে গেল! হায়, এলসার হাতের দস্তানা পর্যন্ত সাদা রঙের ছিল। এলসা পোশাক পরতে ভালবাসত সাদা রঙের। ওর চুল ছিল নীল রঙের, মুখে ছিল গোলাপী আভা, আর চোখে ছিল সুন্দর নীল রঙের সমুদ্র। তাকালে চোখ ফেরানো যেত না। মাথায় সোনালী টুপি, ময়ূরের পালক গোঁজা। সবুজ ঘাস মাড়িয়ে গেলে ওর পা খুব সুন্দর দেখাত।

আর এ-ভাবে ফুল ফোটার সময় হলে, মৌমাছিরা সব উড়ে আসে। দু-পেগ গিলে ফেলতেই মৈত্রের এমন মনে হল। স্মৃতির ঘর থেকে কি সব উড়ে আসছে! সে যেন কেবল এলসার মুখ দেখতে পাচ্ছে। এলসার মুখ-চোখ এমন কি শেষদিন সে কি পোশাক পরেছিল, গাউনের রঙ কি, সব মনে করতে পারছে। তারপরই যেন মনে হয়—কি ফুল ফুটতে পারে এ সময়। গাছে গাছে কি ফুল থাকবে। ফুলের সৌরভের জন্য মানুষেরা এত উড়ে বেড়ায় কেন! এমন কি, কি রঙের জুতো পরতে ভালবাসত এলসা, সে এইসব চারপাশে লোকদের ভিড় দেখেও ভুলে যাচ্ছে না। আসলে ফুলের জন্য বড় লোভ মানুষের। এই লোভ মানুষকে খারাপ করে দেয়, নৃশংস করে তোলে। ফুলের পাপড়ি ছিঁড়ে খেতে ভালবাসে মানুষ।

এবং এই লোভের জন্য এই যে এক লোভ, আমি আমার জন্য, আমার ভালবাসার জন্য আমি, আমি কোন বস্তুতে নেই, আমি আছি আমিতে। সুখ, আমার সুখ লোভ আমার নিজের। সুতরাং আমি যখন আমিতে, শেফালীর জন্য কি করতে পারি। এখন শেফালীর কথা মনে এলেই, ওর পুরু ঠোঁটের কথা মনে হয়। জংঘার কথা মনে হয় এবং এক সুরভিত অঞ্চলের কথা মনে হয়। সে তখন কেমন মানুষ থাকে না, লোভের পাখি হয়ে অদৃশ্য জায়গাগুলোতে বসতে চায়। এবং যেন কার্ণিভেলের সেই মেয়েটা ওকে এভাবে বসতে ডাকছে। সে পারছে না।

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে এখান থেকে চলে যাবে। এখানে থাকলেই একটা লোভের পাখি, পাখির কেবল উড়ে যাবার বাসনা, বসার বাসনা। কাল সব টাকা সে পাঠিয়ে দেবে। আজও নানা কারণে দেরি হয়ে গেল। এবং এ-ভাবে যখন সে প্রায় ড্রাইভ দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিল তখনই দেখল, কে যেন ওর সামনে একটা রুপোর স্টিক ঝুলিয়ে রেখেছে। সে চোখ তুলে তাকাতেই দেখল, ওকে দেখে মেয়েটি বাউ করছে। বাউ করতে গিয়ে হাঁটুর ওপর এতটা গাউন তুলে ফেলেছিল যে, একটু হলেই সে সব দেখে ফেলত।

আর সঙ্গে সঙ্গে সে কেমন হয়ে গেল। ওর হাত-পা শিথিল। সে নড়তে পারল না। যেন কেউ সমুদ্র দেখাবে বলে, অথবা পাহাড় থেকে দূরবীনে অনেক দূরের নক্ষত্র দেখাবে বলে ওকে ডাকছে। সে প্রায় পাগলের মতো লাল নীল বলের পাশে দাঁড়িয়ে গেল। এবং সে সার্কাসের হাতি-ঘোড়া লুফে নেবার মতো বলগুলোকে হাওয়ায় ছুঁড়ে দিয়ে লুফে নিল।

সদর দরজায় তখন লোকটা বেশ জোরে জোরে ব্যাগপাইপ বাজাচ্ছে। সে নাচছে কোমর দুলিয়ে, পা তুলে নাচছে। মানুষের এমনই স্বভাব, শুয়োরের বাচ্চারা আবার বড় বড় কথা বলে! সে সেজন্য পা তুলে পাছা দুলিয়ে ঘুরে ঘুরে নেচে যাচ্ছে। সে ঠিক জানে, মানুষের স্বভাব কি! তখন মৈত্র খেলতে থাকল। খেলতে খেলতে সে যে মৈত্র, সে-কথা একেবারে ভুলে গেল।

অমিয় বলল, এটা কি হচ্ছে!

মৈত্র কিছু বলছে না। অমিয় অথবা ছোটবাবুকে সে চেনে না মতো। ওরা চলে গেলে যেন ভাল হয়। আসলে সে ওদের নিয়ে এসেছিল সঙ্গে পাহারা দেবে বলে। এখন এরা থাকলেই অসুবিধা। ওরা চলে গেলে সে ভীষণ খুশী হবে! সে বলল তোরা জাহাজে যা। আমি পরে যাচ্ছি। ওরা হাঁটতে থাকলে সে বলল, চিনে যেতে পারবি তো?

অমিয় বলল, খুব।

ছোটও খুব বলে চলে গেল।

আর যুবতী রুপোর স্টিক নিয়ে হাঁটছে। রিঙে বাঘের খেলা দেখাচ্ছে যেন। বল এগিয়ে দিচ্ছে। মৈত্র খুব একটা আজ হারছে না। সে খেলছিল আর চোখে চোখে কথা বলে যাচ্ছে। সে মাঝে মাঝে চোখ টিপে দিচ্ছিল। মেয়েটা এজন্য কিছু বলছে না। রিঙে বাঘের খেলায় বাঘটা একটু হাই তুলবে, হাউ করে উঠবে, কতটা কি করবে মেয়েটা যেন জানে।

এবং এ-ভাবে সে আর মৈত্র এক ভয়ংকর খেলায় মেতে উঠেছে। এ-খেলা শেষ হতে সময় নেবে। অন্য যারা খেলছিল, তারা মৈত্রের সঙ্গে পেরে উঠছে না। কেউ কেউ মৈত্রের অসম্ভব রকমের মার দেখে হাততালি দিচ্ছিল পর্যন্ত। বড় রকমের মার দেখে কেউ কেউ আর খেলতে সাহস পাচ্ছে না! তখন সেই যুবতী আগুনের মতো জ্বলছে। মৈত্রের চোখ দেখলে টের পাওয়া যায়। মেয়েটি সাদা জ্যাকেট পরে আছে। ক্ষণে ক্ষণে যুবতী পোষাক পাল্টে আসছে, তাঁবুর পাশে নিজের ছোট্ট ঘরটায় গেলেই মৈত্র বুঝতে পারে কিছু একটা এবার হবে। কিন্তু কিছু হয় না। ব্যাগপাইপের সুর ক্রমে থেমে আসে। মৈত্র আরও রাত বাড়ার আশায় আছে।

ওদিকে ক্রমে কার্ণিভেলের আলো নিভিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এবং ইতস্ততঃ অন্ধকার। ফিসফিস্ শব্দ কেউ জোরে জোরে গলা ছেড়ে গান গাইছে। মৈত্র গানের কোন কথা বুঝতে পারছে না। কোথাও ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে কেউ গাছের নিচে। সব অস্পষ্ট। জলের মতো শব্দ কোথাও। টুপটাপ শব্দের খেলা। যুবতী এবার সব বলগুলি তুলে নিচ্ছে। আর না। রাত অনেক হয়েছে।

মৈত্র খেলতে না পেরে থামে হেলান দিল। সিগারেট খেল থামে হেলান দিয়ে তারপর ফের হাতের পাঁচ আঙ্গুলে মেয়েটার চোখে তিন-চারবার নাচাল। ইশারায় টাকার অঙ্ক বোঝবার জন্য পাঁচ আঙ্গুলে পাঁচ রকমের নোট গুঁজে দিল।

যুবতী সামান্য হাসল। তারপর ভালমানুষের মতো দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে দিচ্ছে। বের হয়ে হাঁটতে থাকল। একবার তাকাল না। মৈত্রের এবার ওর ওপর লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে হল। তারপর সে দৌড়ে আগে চলে গেল। দু-হাত তুলে আগলে দিল ওর পথ। মরিয়া হয়ে গেছে মৈত্র। কিন্তু মেয়েটি ওর হাতের নিচ দিয়ে গলে গেল। তারপর একটু দূরে গিয়ে ফের বাউ। আমার পেছনে এস না, তোমাকে গুডবাই। ওর চোখের ওপর দিয়ে মেয়েটা চলে গেল। বাস-স্ট্যান্ডে মানুষের ভিড়ের ভেতর ঢুকে দাঁড়িয়ে আছে। মৈত্র কিছু আর করতে পারছে না। হাওয়ায় ঘুসি মেরে কেবল হাঁটছে। একটুকুর জন্য ফসকে গেল।

.

সে জেটিতে কখন ঢুকে গেছে খেয়ালই করেনি। দুধারে বড় বড় ক্রেনের নিচ দিয়ে সে উঠে গেল। সিঁড়ি ধরে জাহাজে ওঠার সময়ই সে সমুদ্রের গর্জন শুনতে পেল। কেমন শোঁ শোঁ বাতাসের শব্দ। শরীর টলছে। সে একা! খালি ডেক। কেউ জেগে নেই বোধহয় জাহাজে। একটা বেড়াল থাকলে এই রাতে মিউ মিউ করে ডাকতে পারত। ফোসকালে ঢুকে সে আলো জ্বেলে জল খেল ঢকঢক করে। ওর ভীষণ তেষ্টা পেয়েছিল।

পরদিন যথারীতি মৈত্র কাজ করল এনজিন রুমে। আজ তাকে বাকি টাকাটা পাঠাতেই হবে। একটার পর ছুটি হয়ে গেছে। এনজিন রুমে মেরামতের কাজ বেশি। ওদের হাতে কাজ কম। ছুটি হলে সে বাংকে শুয়ে ক’বার শেফালীর চিঠি পড়ল। চিঠি পড়লেই মনে হয় শেফালী ওর ভীষণ কাছে, যেন পাশে বসে রয়েছে। দূরের চিঠি কত যে কাছের মনে হয়, তখন ওর ভাল লাগে না। কেমন সে, বাড়ি ফেরার জন্য অধীর হয়ে পড়ে। চিঠি পড়লেই ওর ইচ্ছে হয় সমুদ্রের মাছ হয়ে সে যদি চলে যেতে পারত। জল কেটে নদীর মোহনায় উঠে যেতে ইচ্ছে হয়। তারপরই মনে হয় সে জানালায় দাঁড়িয়ে আছে। শেফালী তখন দাঁতে ফিতে কামড়ে চুল বাঁধছে। কপাল ভাল রাতে সে কোনও স্বপ্ন দেখেনি। যে-ভাবে সে গত রাতে মেয়েটার পেছনে ছুটেছিল, রাতে তার ঠিক স্বপ্ন দেখার কথা। যেন মানুষটা তিমি শিকারে বের হয়েছে, আর ফিরে আসছে না। সমুদ্রের ধারে তেমনি বৃদ্ধ পাইন গাছে, মাছের, বড় হাঙ্গর হবে হয়ত অথবা হিংস্র তিমি মাছের কঙ্কাল ঝুলছে। তার নিচে কেন যে মৈত্র দাঁড়িয়ে থাকে কেবল।

অমিয় ভেতরে ঢুকে বলল, মৈত্র জানিস, কাল লোকটাকে শেষ পর্যন্ত ধরতে পারেনি। পালিয়েছে।

—কোন লোকটা?

—আরে খুব খারাপ লোক। গত যুদ্ধে ওর নাকি নিষ্ঠুরতার তুলনা নেই। লোকটার নাম আইখম্যান। এখানে লোকটা পালিয়ে আছে। এখানে ওর ছদ্মনাম। নাৎসি জার্মানীর ইহুদি নিধনের পান্ডা।

—ইহুদি নিধন মানে?

—তুই একটা আস্ত জাহাজি। গত যুদ্ধের খবর রাখিস না! কনসেন্ট্রাসন ক্যাম্প, গ্যাস-চেম্বার, এ-সবের নাম জানিস না!

—লোকটার সঙ্গে তার কি সম্পর্ক?

—সেই তো সব করিয়েছে।

–ধ্যাৎ, ও করাবে কেন। অমন একটা ভাল কাজ পেলে তুইও করতিস।

—কি নিষ্ঠুর কাজ বল!

—ও তো সাক্ষাৎ মহাদেব।

—বাজে কথা।

—বাজে কথা কি?

—লোকটাকে পুড়িয়ে মারা উচিত। আমাদের মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে শুনে।

—ও-ভাই সব এক ব্যাপার। বলে আর দাঁড়াল না মৈত্র। পোশাক পাল্টে ওপরে উঠে গেল। সে জাহাজ থেকে নেমে পড়ল, কিছুতেই লোভে পড়ে যাবে না। লোভে পড়ে গেলেই রক্ত গরম হয়ে যায়। কিন্তু সে যত শহরের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে, তত শুনতে পাচ্ছে তার পাশে কারা নেচে নেচে ব্যাগ-পাইপ বাজাচ্ছে। সে কিছুতেই জায়গা মতো যেতে পারছে না। সবাই নেচে নেচে যাচ্ছে, সে তার ভেতর মিশে না গেলে কেমন একা পড়ে যাবে। ওর আসলে ইচ্ছা হচ্ছিল না কোথাও সে যায়। বরং সেই উটের মত মুখটি তুলে যারা ব্যাগ-পাইপ বাজায় সেখানে যেতে পারলে যেন ভালো হত। মেয়েটির সুন্দর চোখ সমুদ্রের মতো নিরীহ চোখ তাকে কিছুতেই আর কিছু আছে পৃথিবীতে, ভাবতে দিল না।

এবং এ-ভাবে মৈত্র দেখল, সে ঘুরেফিরে কার্ণিভেলের দরজায়। আর ব্যাগ-পাইপ বাজিয়ে যাচ্ছে লোকটা। নতুন মনে হয়, একই লোক বাজায় না। সাজ পাল্টে পাল্টে যায়। লোকজন ভিড় করে দাঁড়িয়ে গেটে। সে ভেতরে ঢুকলে অন্যদিনের মতো মেয়েটা বাউ করল। মেয়ে তুমি এভাবে কেন যে গাউন টেনে হাঁটু ভাঁজ করে দাও। এমনভাবে গাউন টেনে ওপরে তুললে আমি ঠিক থাকতে পারি না।

সে খুবই হুঁশিয়ার। টাকা নষ্ট করলে তার চলবে না। যত রাতই হোক আজ যে-কোনভাবে যুবতীর পায়ে গড় হতে হবে। না হলে সে পাগল হয়ে যাবে। মৈত্র এ-জন্য খুব রয়েসয়ে খেলছে। কখন কার্ণিভেলের সব মানুষরা চলে যাবে, কখন ঝাপ বন্ধ করে মেয়েটি হাঁটবে, এখন সে সেই আশায় আছে।

মেয়েটির হাতে তেমনি রুপোর স্টিক। সবার সঙ্গে সে প্রাণখুলে হাসছে। মৈত্রের এসব ভাল লাগছে না। ধমক দিতে ইচ্ছে ইচ্ছে, না এমন কর না। এমন করলে ঠিক ভালবাসা হয় না।

যেন এই মেয়ে এবং সে রিঙের মালিক! এক বোতল মদ নিয়ে এল। দুটো গ্লাসে দু-জন ভাগ করে খাচ্ছে। মৈত্র মেয়েটির হয়ে খেলা পরিচালনা করছে। সে নিজে না খেলে অন্যদের বল এগিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু শেষের দিকে যারা এল, তাদের সে খেলতে দিল না। ওরা খেলতে আরম্ভ করলেই সহজে ঝাঁপ বন্ধ হবে না। ওরা রাত করে ফেলবে। মৈত্র তখন নিজে সব বল তুলে খেলতে থাকল। সে ওর সময় মতো তবে ঠিক ওকে কাছে পেয়ে যাবে।

মৈত্রকে এখন দেখলে মনেই হয় না সে বিদেশে এসেছে। যেন এই মেয়ে এবং সে কতকাল একসঙ্গে আছে। কতকাল থেকে সে এবং এই মেয়ে সমুদ্রের ধারে বসে রয়েছে। ওদের মাথার ওপর অজস্র টিউলিপ ফুল ঝরছে। ওরা ফুলের নিচে কবরের মতো শুয়ে আছে। বোঝাই যায় কেউ কারো ভাষা জানে না। বরং শেফালীর কথা মনে হলে, কেন যে মনে হয় শেফালী এই মুহূর্তে তার কেউ না। সে বিমলবাবুর ভালবাসার স্ত্রী।

এক সময় রাত গভীর হলে মৈত্র দেখল যুবতী দোকান বন্ধ করছে। সে টাকা গুনে কোথায় কাকে দিয়ে এল। মৈত্র ওর পাশে পাশে হাঁটছে এখন। সে বন্ধুর মতো হেঁটে যেতে থাকলে মেয়েটি গাউন টেনে বাউ করতে চাইল। গুড-নাইট বলতে চাইল। কিন্তু মৈত্র ছেড়ে দেবার পাত্র না। সে সোজা এবার ওর পকেট থেকে সব প্যাসগুলো তুলে ধরল নাকের কাছে। চকচক্ করছে। লোভে পড়ে যাক্ মেয়েটা, এত প্যাসুর লোভ মেয়েরা সামলাতে পারে না। কিন্তু কেমন নির্বিকার তবু মেয়েটি। মৈত্রের পায়ের রক্ত মাথায়। ঝাঁ-ঝাঁ করছে শরীর। এবার হাতের ঘড়ি, আংটি পারলে যেন পোশাক খুলে সব দিয়ে-থুয়ে সে পায়ে পড়ে থাকতে চায়। তখন মেয়েটি ওর হাতে হাত রাখল। এ-ভাবে রাস্তার ওপর এ-সব ঠিক না। সন্তানের মতো স্নেহের চোখে তাকাল। তারপর সবাই জেগে আছে, সে ইশারায় শহরের আলো ঘরবাড়ির দিকে আঙ্গুল তুলে এমন বলতে চাইল। এখনও পুলিশের টহল আছে মোড়ে মোড়ে। আর এই কার্ণিভেলে সব বাতি নিভে যায়নি। সব মানুষ চলে যায়নি। শিশুর মতো এত অধীর হলে চলে না।

তারপর কি যেন জানে এই মেয়ে। সে শিস্ দিতেই একটা নতুন ঝকঝকে ট্যাক্সি সামনে হাজির। দরজা খুলতে না খুলতে মৈত্র ডাইভ মেরে একেবারে ভেতরে। মেয়েটিও ভেতরে। ওর কি যে মনে হচ্ছে এখন! মাথার ওপরে আকাশ আছে, নক্ষত্রেরা জ্বলছে সে বুঝতে পারছে না। চারপাশের বাড়ি ঘর আলো, গাছপালা ফেলে কোথায় যে যাচ্ছে গাড়িটা। সে কিছুই দেখছে না। সে পাশে বসে মেয়ের শরীরের মনোরম গন্ধ নিতে নিতে দু’হাতে জড়িয়ে ধরল। তারপর একটা হাত পেছনে ফেলে দিল। অন্য হাতটা সে সামনে জড়িয়ে যেন সে শীতের রাতে মেয়েটাকে নিয়ে চাদরের নিচে ওম পোহাচ্ছে। যতক্ষণ এভাবে থাকা যায়। কিন্তু মৈত্র দেখছে, সে খুব বেশিদূর এগোতে পারছে না। মেয়েটা বাধা দিচ্ছে। কি যে করে! কামড়ে খামচে এখন যেন ফালা ফালা করে দিতে ইচ্ছা হচ্ছে। অথচ সে পারছে না। এমন নির্বিকার মেয়েরা থাকতে পারে তার বিশ্বাস হয় না।

এবং এ-ভাবে সে ভেতরে খুব বেশি অস্থির হয়ে উঠলে দেখল, মেয়েটা তাকে হাত তুলে কি দেখাচ্ছে।

সে দেখল, একটা গীর্জা। গীর্জার মাথায় ক্রস।

মৈত্র এ সব মানতে চাইছে না। সে উপুড় হয়ে ট্যাকসিতেই…

মেয়েটা সবলে যেন দু-হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছে মৈত্রকে। এ-দেশের টাকসিওয়ালাদের এমন দৃশ্য দেখা হামেশা অভ্যাস, রাত হলেই ওরা এমন সব ঘটনা দেখতে পায়। অথচ মৈত্রকে তখন অধীর হতে দেখে, আশ্চর্য সুন্দর ইংরেজিতে বলছে, ওয়েট ম্যান। ওয়েট। সি উড ক্যারি ইউ টু হার হোম। আসলে ট্যাকসিওয়ালাদের নানারকম প্যাসেঞ্জার বইতে হয় বলে, ইংরেজিটা কিছু শিখে নিয়েছে। এবং সে ইংরেজি বুঝতে পারছে দেখে, মেয়েটাও ভাঙ্গা ভাঙ্গা একটা দুটো ইংরেজি বলতে চাইল। কিন্তু মৈত্র কিছু বুঝতে পারছে না। আকাশে বেশ মেঘ। সে শহর পার হচ্ছে এটা বুঝতে পারছে। এবং এক সময় এমন শীতে বেশ জোরে বৃষ্টি।

এইসব বৃষ্টিপাতের ভেতর রাস্তার আলো ঝাপসা। কাচে জল পড়ে পড়ে সামনের সব কিছু ধূসর করে রেখেছে এবং আশ্চর্য উষ্ণতা ভেতরে। যেন কতকাল থেকে, মনে হয় আজন্ম এমন এক ভূখণ্ডের জন্য মৈত্র অপেক্ষা করে আছে। মেয়ের স্কার্ট হাঁটুর ওপরে উঠে গেছে। ওর বার বার নরম জায়গাগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখার কি যে ইচ্ছে! যেন ছুঁতে না পেলে মরে যাবে। আর নরম চুল, ফাঁপা এবং ফুরফুর করে সামান্য কাচের ফাঁকে বৃষ্টির ছাঁট, চুল উড়ছে ফুরফুর করে, সে সেই নরম চুলে মুখ ডুবিয়ে দেবার জন্য আকুল হতে গিয়ে দেখল, একটা পুরানো বাড়ির সামনে গাড়ি থেমেছে। দরজায় কেউ দাঁড়িয়ে। মেয়েটির হাতে সে একটা প্যাকেট দিল। সর্বেশা অর্থাৎ মদ, উগ্র মদের গন্ধ চারপাশে। মৈত্র এ-পাশে ও-পাশে ফ্লাটবাড়ির মতো সাহেব মেমদের মুখ দেখে ক্রমে দোতলার সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে উঠে গেল। একটা ক্রাচ ঠিক দেয়ালে হেলান দেওয়া, কেউ ভেতরে আছে মনে হয়। দরজা খুলে গেলে দেখল, আধপোড়া একজন মানুষের মুখ। সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দরজার কাছে এল। দরজা খুলে দিয়ে যেন সে কাউকে চেনে না মতো এবং সঙ্গের লোকটি কে, তার সম্পর্কে পর্যন্ত কোন উৎসাহ নেই, লোকটা এমন কি একবার মৈত্রের দিকে তাকাল না পর্যন্ত। সে কেমন যেন সব সময় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে কিসে, হেঁটে হেঁটে ভেতরের দরজা দিয়ে পাশের ঘরে চলে গেল। লোকটার মুখে ভীষণ ক্রুরতার ছাপ। মৈত্রের এ হেন দৃশ্যে ছুটে পালাবার কথা, কিন্তু আশ্চর্য সেই মায়াবিনী তাকে কিছুতেই যেতে দিচ্ছে না। এবং দরকার হলে মৈত্র দ্বন্দ্বযুদ্ধে লোকটাকে ডাকবে। পৃথিবীতে সে আর পাশের যুবতী, আর কিছু আছে এ-মুহূর্তে সে জানে না। সে বিশ্বাসও করে না। সে বলল, মেয়ে আর কতক্ষণ!

যুবতী ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে কিছু বলে গেল। যেন বলা এমন অধীর হলে চলে না! তুমি কেমন জাহাজি হে! আমার মানুষকে দেখার পরও আছ, ভাবা যায় না।

হায় যুবতী জানে না, মৈত্র আর এক পা নড়তে পারছে না। সে যুবতীর ওপর এবার যেমন বাঘে শিকার নিয়ে পালায় প্রায় তেমনি ছোট কচি হরিণশিশুর মতো ঘাড়ে গলায় চুমু খেতে থাকল আর সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, মেয়েটার ভেতরে একটা দুর্গন্ধ। সে এতক্ষণ কেন যে পায়নি! সে বলল, মেয়ে তোমার পিঠে এগুলো কিসের দাগ!

মেয়েটির শরীরে কোন পোশাক নেই। জঙ্ঘার পাশে আশ্চর্য নীল সুবর্ণ বাতিঘর। অথচ পিঠে লাল ছোট ছোট বিজবিজে ঘা। লোকটার মুখ আধপোড়া। চামড়া ওঠানো মুখ। কি যে ভয়ঙ্কর আর কুৎসিত। পাশের ঘরে লোকটির গোঙানি শোনা যাচ্ছে। মৈত্র মেয়েটির স্তনে হাত রাখল। মৈত্র জীবনে যেন যুবতী দেখেনি, সুবর্ণ বাতিঘরে আলো জ্বালায় নি, সে শরীরের সব অংশের ভেতর নিমজ্জমান এক নেমকহারাম। যেন সে কিছুই ছুঁতে চাইছে না। যেন এই শরীরে পৃথিবীর সব কিছু মেয়েটি জড় করে রেখেছে। কোথায় সামান্য বিজবিজে ঘা, অথবা এটা যে এক অতীব কঠিন অসুখের চিহ্ন তা সে বুঝতে চাইছে না। যুবতী নানাভাবে চাইছে ওকে ফিরিয়ে দিতে। এমন অসুখ নিয়ে আমার কিছু ভাল লাগে না। তুমি পাগলামি কর না। তুমি শুনতে পাচ্ছ না, দূরে কোনো গীর্জায় ধর্মীয় সংগীত বাজছে। তুমি কি জান না, সমুদ্র কি নীল আর গভীর! তোমার শরীর নষ্ট হয়ে যাবে ম্যান।

ভাল কথা কে শোনে! পাশের ফ্ল্যাটে মিউজিক বাজছে। সমুদ্রে—ধীরে ধীরে অথবা, গভীর সমুদ্রে হাওয়ায় যেন বৃষ্টিপাতের শব্দ ধীরে ধীরে ঝম্ ঝম্ শব্দের মতো। যেন সহসা অতিদূর থেকে কোন সমুদ্রপাখির ডানার শব্দ ক্রমে এগিয়ে আসতে আসতে সহসা বাতাসে বৃষ্টিপাতের ভেজা গন্ধ পেয়ে ওপরে উঠে যাওয়া। অনেক ওপরে। আবার কখনও পাখিটা যেন পাখা বিস্তার করে প্রবহমান ধারায় নেমে আসছে। মেয়েটি মিউজিক শুনতে শুনতে কেমন অধীর গলায় বলল, ম্যান, আমাকে ক্ষমা কর। আমি পারব না। ভেবেছিলাম আমার সব দেখে তুমি ভয় পাবে। ঘাবড়ে যাবে।

মৈত্র পায়ের কাছে মাথা নিচু করে বসে রয়েছে। সে অনুমতি চাইছে। সেও যেন সেই মিউজিকের ভেতর এই মেয়েকে কেমন সুগন্ধী হয়ে যেতে দেখছে। ওর হাত-পা কাঁপছে, কান গরম হয়ে গেছে, সে পায়ের কাছে পড়ে থেকে বলছে যেন, আমি মরে যাব মেয়ে। সব দিয়েছি। আরও দেব। মেয়েটির কষ্ট হচ্ছিল। সে জানে, ব্যবহারে, এই যুবক, ক্রমে তার পুরুষের মতো হয়ে যাবে। ওর ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। ভীষণ। সে এ-সব থেকে পরিত্রাণের জন্য এখন জুয়ার রিঙে কাজ নিয়েছে। এমন একজন আধপোড়া কঠিন অসুখের মানুষকে নিয়ে যখন শরীরের বিজবিজে ঘা ক্রমাগত পাগল করে দেয়, অস্থির করে তোলে তখন এক অপার্থিব চিৎকার এবং দেয়ালে ক্রমাগত মাথা ঠুকে মরা

মৈত্র বলতে চাইল কিছু। বলতে পারছে না। ছেলেমানুষের মতো শরীরের সর্বত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে। দেবীপ্রতিমার গায়ে হাত দেবার মতো। অথবা সন্তান মায়ের স্তন নিয়ে যে-ভাবে খেলা করে, তেমনি পুষ্ট স্তন হাতে নিয়ে বসে থাকা। যেন মৈত্র এখন এ-শরীর দিয়ে হলেও, সে নিঃশেষ হয়ে গেলেও পায়ের নিচে পড়ে থাকবে।

মেয়েটির সত্যি কষ্ট হচ্ছিল। সে বলল, এস। মৈত্র একেবারে শিশু হয়ে গেল। যে-যেভাবে মৈত্র চাইল, ঠিক সেভাবে তাকে শুইয়ে রাখল পাশে। আর সব কিছু নিয়ে মৈত্র এমন ছেলেমানুষী করতে থাকল যে শুড়শুড়ি, কি যে শুড়শুড়ি, মেয়েটি ভীষণ জোরে হাসতে থাকল। সে ওর শরীর সরিয়ে নিতে থাকল। না না, ওটা কি করছ ম্যান! আমার ভীষণ শুড়শুড়ি লাগছে। এখানে না। এখানে না।

কে শোনে কার কথা, সারাক্ষণ জাহাজি মানুষের প্রেম কি যে নিদারুণ! এক অতিকায় হাঙ্গরের সমুদ্রে ডুব দিয়ে আহার অন্বেষণের মতো। মেয়েটি বলল, ম্যান, তোমার ভীষণ কষ্ট?

মৈত্র বলল, ভীষণ।

—এখন ভাল লাগছে? —ভীষণ ভাল লাগছে।

—তুমি কতদিন আছ?

—কিছুদিন।

তারপর মৈত্র সুন্দর বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ল। সারারাত ওপাশের ঘরে লোকটা চেঁচাচ্ছিল। মৈত্র কিছু শুনতে পায়নি। গভীর রাতে ঘুম ভাঙলে মনে হল মেয়েটি ওর পাশে নেই। সে দেখল ঘর অন্ধকার। পাশের ঘরে আলো জ্বলছে। যুবতী এখন ওর স্বামীর পাশে।

মৈত্র আবার ঘুমিয়ে পড়ল। ওর কোন হিংসে হচ্ছিল না। বরং এক অতীব শান্তি শরীরে, কি যে মহিমময়ী মনে হচ্ছে যুবতীকে। ওর ভাল লাগছিল ঘুমিয়ে পড়তে।

খুব সকালে সে শুনতে পেল। ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে বলছে, ম্যান, বেলা হয়েছে। এবারে ওঠো। জাহাজে ফিরতে হবে।

ঠিক যেন শেফালির মতো গলা। কি যে আপন আর সুন্দর এই বেঁচে থাকা! সে পাশ ফিরলে দেখল, চা। যুবতীর শরীরে কপালে পবিত্রতা। মৈত্র উঠতে পারছে না। ভীষণ লজ্জা করছে। আলনা থেকে মৈত্রকে ওর পোশাক এনে দিল। মৈত্রকে অবোধ বালকের চেয়ে বেশি কিছু মনে হচ্ছে না। যুবতী সামান্য হেসে বলল, ম্যান চা ঠাণ্ডা হচ্ছে।

মৈত্র কম্বল কোমর পর্যন্ত জড়িয়ে নিল। সেন্ট্রাল হিটের জন্য বেশ আরাম বোধ হচ্ছে। সে চা খেতে খেতে বলল, কোথাও আর যাব না। থাকব। এখানেই থেকে যাব।

—থাকলে মারব। ওঘরে গিয়ে একটু বোস। এত বেশি ভাঙ্গা ভাঙ্গা কথা যে মৈত্র কিছুই বোঝে নি। তারপর ইশারা করলে, বুঝল, এ-বাড়িতে এসে গৃহকর্তার সঙ্গে একটু আলাপ হবে না, এটা ঠিক না। মৈত্র বাথরুমে ঢুকে গেল, স্নান করল, পোশাক পাল্টাল, এবং সেই কঠিন পোড়া অসুস্থ মানুষটার সঙ্গে কথা বলার জন্য মাথার কাছে একটা চেয়ারে বসল।

লোকটির কথা বলতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল, তবু বলল, সাহস আছে তোমার।

মৈত্র কিছু বলল না।

সে নিজের মনে মনে বিড়বিড় করে বলল, সাহস আমারও ছিল। এখন কিচ্ছু নেই। তারপর ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকল। একেবারে ভীষণ শূন্যতা চোখে। মৈত্র আর বসে থাকতে সাহস পেল না। ওর সত্যি এবার লোকটাকে ভয় করছে। সে বলল, আসি। সে উঠে প্রায় দৌড়ে পালাবার মতো সিঁড়ি ধরে নামতে থাকলে দেখল, যুবতী পেছনে পেছনে নেমে আসছে। সে বলল, তুমি চিনে যেতে পারবে না। আমার সঙ্গে যাবে।

যেন সে কতদিন পর এক সুদীর্ঘ প্রবাস থেকে ফিরে এসেছে। মেয়েটিকে তার কিছুতেই মনে হচ্ছে না, দূরের, যেন সে-আছে, তার চারপাশেই আছে, কতকালের চেনা প্রিয়জনের মতো, ওর চোখ ভারি হয়ে আসছিল। মৈত্র বলল, আবার আসব।

যুবতী ওকে জাহাজঘাটায় নামিয়ে বলল, না। আর আসবে না। সে একটু থেমে বলল, ডাক্তার দেখাবে।

মৈত্র বলল, আমার কিছু হবে না।

যুবতী তবু বলল, না হলেও দেখাবে। বলবে সব। পিঠে বিজবিজে ঘা, সব খুলে বলবে। না বললে আমি কষ্ট পাব।

মৈত্র মেয়েটির কথাবার্তা এখন যেন মন দিয়ে শুনছে না। সে আর কি দিতে পারে। সব দিয়েছে, তার আরও কিছু থাকলে মেয়েটিকে এমুহূর্তে দিয়ে দিতে পারত। বড় বেশি ছোট মনে হচ্ছে নিজেকে। সে এত খাটো মাপের মানুষ। সে বলল, এসে গেছি।

গুড বাই। মেয়েটি গাড়িতে বসে হাত নাড়ল। শিফনের ফ্রক গায়ে। মাথায় উলের টুপি। মুখটা সব দেখা যাচ্ছে না। মৈত্র নুয়ে হ্যাণ্ডসেক করল। আসলে নুয়ে ওর সুন্দর মুখটা আর একবার দেখতে চাইল। কি কোমল, আর নরম, আর বড় বেশি স্নিগ্ধতা চোখে মুখে! সে কিছুই বলতে পারল না। ধীরে ধীরে ক্রেনের লম্বা ছায়া অতিক্রম করে জাহাজে উঠে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *