1 of 2

অলৌকিক জলযান – ১২

।। বারো।।

সেই জেটি সেই প্রশস্ত পথ সামনে। অদূরে ওরা শহরের ভিতর স্কাইস্ক্রেপার তেমনি দেখতে পাচ্ছে। ডেকে দাঁড়ালে চার পাশে অজস্র জাহাজ। জাহাজের চিমনি। সব চিমনি থেকে ধোঁয়া ওঠে না আজকাল। মোটর ভেসেলে কোন ধোঁয়া থাকে না। কিন্তু ওদের জাহাজে অথবা অন্য অনেক জাহাজ যেখানে ইনজিন কয়লায় অথবা তেলে চলে, সেখানে চিমনিগুলোর অল্প ধোঁয়া। বাকি চিমনিগুলো ঝক্‌ঝকে। মাস্তুলে সব নানা বর্ণের পাখি। ডেকে মানুষের ভিড়। সারি সারি ট্রাক, অথবা মালগাড়িতে ক্রেনে মাল নামানো হচ্ছে। এবং গাদাবোটগুলোকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ছোট ছোট মোটর বোট। নানা রকমের পতাকা উড়ছে চারপাশে। এবং জাহাজের সিটি……বাজছে……. কোথাও। সব জাহাজেই জাহাজিরা এখন সুখী’ পায়রার মতো উড়ছে। কখন সন্ধ্যা হবে, কখন ওরা ছুটি পাবে, ছুটি পেলেই সেজে-গুজে লারে লারে গান গলায়, অথবা শিস দিতে দিতে ওরা নেমে যাবে বন্দরে।

অমিয় বলল, মৈত্র, এমন বন্দরে না নেমে থাকা যায়!

—নামব না বলিনি তো, আমাকে একদিন নামতেই হবে।

—সে তো তোর মালের জন্য। অমিয় ফিফিস্ গলায় বলল, আমার একা নামতে ভয় লাগে। ওর যেন বলার ইচ্ছে এবার ঠিক বড়-মিস্ত্রির সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। দেখা হয়ে গেলে ধরা পড়ে যাবে। সে যদি কোন রকমে মৈত্রের সঙ্গে যেতে পারে, তবে তার আড়ালে আবডালে ঠিক নেমে যাওয়া যাবে।

মৈত্র বলল, নামব, কিন্তু খবরদার কোথাও যাবি না আমাকে ফেলে। আমি যা বলব তা করবি। কোথাও ঢুকতে পাবে না, কোনও কার্নিভালে ঢুকতে পাবে না!

—তুই তো আচ্ছা লোক মৈত্র। তোর জন্য শেষ পর্যন্ত রাস্তায় হাঁটতে পারব না, কোনও রেস্তোরাঁতে ঢুকতে পারব না।

—তা আমি বলছি না।

—বলতে বাদ রেখেছিস কি! কার্নিভেলে ঢুকবি না। তবে খাব কি, দেখব কি! জাহাজে আসার মজাটা কোথায়।

—ঘুরে দ্যাখো। পথ ধরে হেঁটে যাও। সুন্দরী মেয়েদের গন্ধ পাবে। পার্কে কত সব ফুল, বাড়িগুলোর সামনে কত যে ফুল! মেয়ে দ্যাখো ফুল দ্যাখো তবে ছুঁতে যাবে না। লোন্দ্রা এল্যান ধরে গেলে বিচ পাবি সমুদ্রের। বিচে ওরা নাঙ্গা হয়ে শুয়ে থাকে।

—আর কি দেখব?

—যদি তুই না বের হস, জাহাজেই যদি থাকিস, তবে দেখবি, সামনের পার্কটায় শহর থেকে কচিকাচা মেয়েরা এসে বিকেলে ভিড় করবে। রং-বেরঙের ফ্রক গায়ে, আর কি সুন্দর পা। পা দেখলেই মনে হবে সারা জীবন এই পা জড়িয়ে পড়ে থাকি। কোথাও আর যেতে ইচ্ছে হবে না।

অমিয় ডেকের ওপর দু’ হাত ছুঁড়ে বলল, ফাইন। কবে যাবি?

—তোর খুব লোভ অমিয়। তোকে নিয়ে যাওয়া যাবে না।

—আমি ভালছেলে হয়ে থাকব মাইরি। তুই বিশ্বাস কর আমি হারামিপনা করব না।

—তোর স্বভাব ভাল না।

—গঙ্গার জলে মুখ ধুয়ে নেব। স্বভাব ভাল হয়ে যাবে।

—নোনা জলে ভাসলে গঙ্গার জলে স্বভাব ভাল হয় না।

—ধুস্ শালা। তোর সঙ্গে আমি বের হচ্ছি না। একাই বের হব।

—আরে না না। আমি যাব তোর সঙ্গে।

—ঠিক?

—ঠিক।

—কথা দিচ্ছিস তবে?

—হ্যাঁ, যাব বলছি। সব চিনিয়ে দিতে হবে না! সব সফরে তো আমি আর তোর সঙ্গে যাচ্ছি না। কোথায় কে বেকুব বানিয়ে দেবে কে জানে।

আর তখন জাহাজের ওপর ডেক-সারেঙ, এনজিন-সারেঙ যে যার দল নিয়ে নিচে ওপরে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। মৈত্র এনজিনে নামার আগে এসব গল্প করছিল। দুটো বয়লার নেভানো। একটা বয়লার সামান্য চালু রাখা হয়েছে। জেনারেটর চালু রাখার জন্য স্টিমের দরকার।

ডেক-জাহাজিরা জল মারছে ডেকে। বড় বড় পাটের গাঁট নেমে যাচ্ছে এখন। ডেরিকে পাটের গাঁট নামানো হচ্ছে। ফল্কায় একটা ক্রেনও কাজে লেগে গেছে। যত তাড়াতাড়ি করা যায়। বিশ বাইশ দিনের আগে তবু জাহাজ খালাস হচ্ছে না। অন্ততঃ এরা বিশ বাইশ দিন এ-বন্দরে থাকতে পারবে, ঘুরে বেড়াতে পারবে। তারপর জাহাজে কি বোঝাই হবে জাহাজিরা বলতে পারে না। মাল বোঝাই হলে আরও ক’দিন। তারপর ফের সমুদ্রে ভেসে পড়া।

বন্দরে প্রথম দিন বলে জাহাজিদের তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেল। বারোটায় খানা খেতে এসে সবাই শুনল ছুটি। সবাই এখন হল্লা করছে বাথরুমে। একসঙ্গে স্নান করা যায় না। গরম জলের অভাব। যে যার গরম জলের টব টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সবাই মাজাঘষা করছে। এবং স্নান করার সময় কিছু অশ্লীল গান যা কানে শোনা যায় না। কে গাইছে। গাইছে অনিমেষ। ডেক-জাহাজি। সে ইয়াসিনের গলা জড়িয়ে নেচে নেচে গাইছে, ওলো সখি ললিতে যাচ্ছি আমি গলিতে। সে এটা ধুয়া দিচ্ছে নেচে নেচে। নেচে নেচে সে মেয়েদের মতো গাইছে। এবং কেউ হয়তো ওরই ভিতর অনিমেষের পাছা টিপে দিয়ে মজা লুটছে। অনিমেষের মুখ চোখ কিছুটা মেয়েলি ধরনের। শ্যামলা রং। জাহাজে থেকে আরও উজ্জ্বল হয়েছে। এবং ডেক-জাহাজিরা ওকে জড়িয়ে ধরে রঙ্গরস করে থাকে। মাঝে মাঝে অনিমেষ ক্ষেপে যায়। তখন সবাই হা-হা করে হাসে।

মৈত্র, অমিয়, ছোটবাবু তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়েছে। ছোটবাবুর জন্য মৈত্র পোশাক বের করছে। ওর ভালো পোশাক সে দিচ্ছে ছোটবাবুকে পরতে। এবং ছোটবাবু পরেছে, সাদা কটনের ফুলসার্ট, চকলেট কালারের প্যান্ট, নীল রঙের কোট, সবুজ টাই। এবং সমুদ্রে ঘুরে ঘুরে শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশের যে ছবি ফুটে ওঠে, এই পোশাকের ভেতর ছোটবাবুকে তেমন মনোরম লাগছে দেখতে। এত ভাল লাগছে ছোটকে যে মৈত্র একেবারে হাঁ করে তাকিয়ে থাকল। বলল, তোকে ছুঁলে মনে কোন পাপ থাকে না। তোর সঙ্গে ঘুরে বেড়ালে, আমরা ভাল হয়ে যাব।

অমিয় উদাস গলায় বলল, ছোটকে যে কেন নিয়ে যাওয়া। তুমি বাপু ক্যাপ্টেনের পোলাডার লগে যাও না ক্যান!

ছোট বলল ওপরে যাচ্ছি। তোরা আয়। সেও ওকে বিদ্রূপ করতে পারত কিন্তু করল না।

সে ওপরে উঠে গেল। মৈত্র, অমিয়, দ্রুত ওপরে উঠে গেল। আহা কতদিন পর এই মাটি! সে শহরের ভিতরে ঢুকে যাবে ওদের সঙ্গে। ওর সব কিছু মনে হচ্ছে মনোহারিণী। সে দেখল, তখন জ্যাক ডেকে দাঁড়িয়ে আছে। জ্যাক বোধ হয় পাখি দুটোর জন্য বাকসে খাবার দিচ্ছে। পাখি দুটার জন্য এখন জ্যাক সবচেয়ে বেশি সময় দিচ্ছে। সে আরও কিছু লক্ষ্য রাখতে পারে। মাঝে মাঝে জ্যাক পিছিলের দিকে তাকাচ্ছে।

ছোট জানে, ওখানে গেলে ওর দেরি হয়ে যাবে। সেদিকে একেবারে সে গেল না। শিস দিতে দিতে ওরা নেমে গেল। তিনটে বাজে। সূর্য হেলে গেছে। চারটা বাজলেই সন্ধ্যা হয়ে যাবে। রোদে কোন উত্তাপ নেই। সোনালী রোদ, এবং চারপাশে যেন অতীব মায়াবি মানুষেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। দিনের বেলা এইসব ফুল-ফল পাখি আর আশ্চর্য রূপবান মানুষের রাজত্বে জ্যাক যে তাকে লক্ষ্য করছে ছোট দেখছে না।

আকাশ স্বভাবতই পরিচ্ছন্ন। পার্ক থেকে ফুলের গন্ধ আসছে। সবুজ চারপাশে, মাঝখানে কালো এ্যাসফাল্টের রাস্তা শহরের দিকে গেছে। নানা বর্ণের গাড়ি চারপাশে। জেটিতে কিছু সৌখিন মেয়ে পুরুষ দাঁড়িয়ে জাহাজের মাল নামানো দেখছে। আশ্চর্য ওরা কোন কাস্টমসের ঝামেলা অথবা বেড়াজাল এখানে দেখতে পেল না। সামনের পার্কটা মেলার মতো হয়ে গেছে। মানুষের ভীষণ ভিড়। ছোট বড় ছেলে যুবা এবং বৃদ্ধারাও আছেন। মৈত্র এ সময় ওদের নিয়ে শহরের দিকে উঠে যেতে থাকল। মৈত্র খুব সাদাসিদে পোশাক পরেছে। ট্রাউজার, মোটা উলেন জামা, গলায় মাফলার, ওপরে লম্বা কোট। সে টাই লাল রঙের পরতে ভালবাসে। বড় রাস্তা, প্রশস্ত ফুটপাথ, মাঝে মাঝে এভিনিউ, ভিন্ন ভিন্ন গাছের সমারোহ। গাছের নিচে সুন্দরী যুবতীরা ঘোরাফেরা করছে।

তখন আপেলয়ালা হাঁকল, আ…..পে…..ল!

কেউ হাঁক দিল, এমিগা! কোমো ইস্তা ওস্তে।

ওরা এদেশের মানুষদের কথাবার্তা বুঝতে পারছে না। ইংরেজি বললে কেমন এ-দেশের মানুষেরা হাবাকালা হয়ে থাকছে। সাধারণ মানুষ একেবারেই ইংরেজি জানে না। ওরা দুটো একটা স্পেনীশ কথাবার্তা শিখে নিয়েছে। ফলে ওরা প্রায় সময়ই এদেশের মানুষদের কাছে বাংলা বলছে। বাংলা- উর্দু এবং পৃথিবীর যে কোনও ভাষা ওরা বলে গেলেও কিছু বুঝবে না। ওরা সেজন্য নিজের খুশিমতো যা ইচ্ছা বলে যাচ্ছে। এবং অমিয়র যা স্বভাব। সে খুব খারাপ কথা মেয়েদের বলছে। ওরা অমিয়র কথা শুনে হাসছে। যেন মৈত্র, অমিয় বিদেশী মানুষ, ওদের কথা বুঝতে না পারলে ছোটবাবু বেশ মজা পায়।

ছোটবাবু দেখল সামনে একটা টাওয়ার। মৈত্র ঘুরে ফিরে আগে দেখেছে বলে, সে জানে কোথায় কিভাবে যাওয়া যায়। ঠিক টাওয়ারের নিচে স্টেশন। ওরা আন্ডার গ্রাউন্ড ট্রেন ধরে ফ্লোরিদাতে যখন পৌঁছল, তখন রাত হয়ে গেছে। তখন শহরে সব আলো তারাবাতির মত জ্বলছে। আর সব কাচের শো-কেসে দামী শহরটা মনে হয় ঢুকে গেছে। বড় বেশি কৌতূহলী করে রাখে মানুষগুলোকে। সব স্বপ্নের দেশের মতো মানুষ মনে হয়। এমন সাজানো গোছানো শহর পৃথিবীতে আর কোথায় আছে ওরা জানে না। কোন চার্চ থেকে ধর্মীয় সঙ্গীত ভেসে আসছে। আর পথ জুড়ে তখন কোলাহল। ওরা হাঁটছে শিস দিচ্ছে, বাংলা গান গাইছে। কোথাও ঢুকে কফি খাচ্ছে। ঠাট্টা মসকরা করছে মেয়েদের সঙ্গে। মৈত্র মাঝে মাঝে অমিয়কে সাবধান করে দিচ্ছে। বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে অমিয়—এতটা ঠিক না। সে ভাবছে এখন সেই মানুষটার বাড়ি খুঁজে বের করতেই হবে। সেখানে গেলে সে দেশে টাকাটা পাঠিতে দিতে পারবে। এখানে সে সেই মানুষের নামে একটা একাউন্ট করে নেবে। সেই সব করে দেবে ওর হয়ে। কিন্তু মৈত্র সেই বাড়িটা ঠিক খুঁজে পেল না।

মৈত্রকে খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। টাকাটা খুব তাড়াতাড়ি পাঠানো দরকার। অথচ এখানেই সেই সাহেব লোকটা থাকত। সাহেব বিনিময়ে কিছু টাকা নেয়। আর একবার সে বাড়তি টাকা এভাবে পাঠিয়েছে। এবারেও বাড়তি টাকা তার হবে।

অমিয় হাঁটতে হাঁটতে বলল, কত পাঠাচ্ছিস?

—তা হাজার প্যাসু পাঠানো দরকার। আজ কিছু দিয়ে যেতাম। বলতাম, সে যেন আমার নামে পাঠিয়ে দেয়। বাকিটা কাল দেব।

ছোটবাবু সব বালকের মত দেখে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে সে চিৎকার করে বলছে কি গ্রান্ড! কিন্তু মৈত্র লোকটার বাড়ি ঠিক হদিস না করতে পারায় কোনো কথা বলছে না। কেবল অমিয়কে পারে না বলে মৈত্র জবাব দিচ্ছে।

—মোটামুটি বৌর কাছে খুব বড় মানুষ হয়ে বেঁচে থাকিস।

—তাছাড়া কি। যা টাকা পাই ওতে শেফালীর মতো মেয়ে বিয়ে করা যায় না। কম পাঠালে আমার সম্মান থাকবে না।

—তার মানে!

—মানে, বৌ বলবে, আমি ছোট কাজ করি। ঠিকমতো টাকা পাঠাতে পারি না।

—তার মানে তুই বৌকে বড় কাজটাজ করিস বলেছিস?

—হ্যাঁ, তাই। শেফালী জানে জাহাজে আমি এনজিন রুমে ভাল কাজ করি। অনেক টাকা পাই।

—এভাবে মিথ্যা বলে লাভ!

—লাভ, শেফালীর মতো মেয়েকে কাছে পাওয়া। বলে, মৈত্র অমিয়কে একটু অন্যমনস্ক করার জন্য বলল সামনে শো-কেসটার পাশে দ্যাখ।

—কিছু দেখছি না! একটা ওভারকোট ঝুলছে না!

—হ্যাঁ।

—নিচে কিছু দেখা যাচ্ছে?

—ও মা। চারটা পা। বলেই অমিয় ছুটতে চাইল। মৈত্র হাত ধরে ফেলল, ধীরে অমিয়। ওদিকে চল। সে টেনে অমিয়কে অন্য রাস্তায় নিয়ে গেল।

এবার মৈত্র বলল, সেবারে, এভাপেরুনকে নিয়ে কি একটা উৎসব চলছিল! ওঃ কি জাঁকজমক।

ওরা তিনজনেই দেখল, এভাপেরুনের একটা বড় মূর্তি। এবং কিছুটা মা মেরীর মতো মুখ চোখ।

ছোটবাবু বলল, এখানে একটু বসলে হয় না। হাঁটতে হাঁটতে পা ধরে গেছে। বেশ সুন্দর জায়গা। শীতটাও কম মনে হচ্ছে।

মৈত্র তখন একটা গাছের পাতা ছিঁড়ে বলল, এ গাছটার নাম জানিস? সে পাতাটা দু আঙ্গুলে পিষে ওদের নাকের কাছে নিয়ে গেল, কেমন সুন্দর গন্ধ দ্যাখ। এটা বুনো মূস্কোদাইন।

অমিয় বলল, সামান্য খাব।

ছোটবাবু বলল, আমিও।

মৈত্র বলল, পয়সা কে দেবে?

—কেন তুমি! এত টাকা কামাবে, আর খাওয়াবে না!

—ঢুকলে যে বের হতে চাইবে না। ভেতরে হাড়ের খেলা দেখাবে। সব বাঁদরের হাড়। আমার পকেটের সব ফাঁকা করে দেবে। তোমরা বাবা সুবোধ বালকের মতো হেঁটে এস তো। কোরিত্রম্বুজ হয়ে সোজা জাহাজে ফিরে যাব।

অমিয় বলল, আসলে শালা তুমি চিপ্পুস। তারপরই সে চিৎকার করে উঠল, মৈত্র, দ্যাখ, দ্যাখ! মৈত্র তাকাল ডান দিকে। ঠিক মোড়ের মাথায় একটা স্টেশনারি দোকান। দোকানের সামনে একটা সেলস-গার্ল। খুব সরলভাবে অমিয়কে দেখে হাসছিল। অমিয় বলল, কি চমৎকার হাসে রে! মেয়েটার সঙ্গে একটু কথা বলে আসি!

—যা দ্যাখ, কি বলে।

অমিয় ফিরে এলে মৈত্র বলল, কিরে কিছু বলেছে?

—না। আমার কথা কিছু বুঝতে পারছে না!

—মাগীকে আচ্ছা খিস্তি লাগা।

—খিস্তি করলে হাসছে। আর কিছু বলছে না। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে রে। তবু কিছু বলছে না।

মৈত্র বলল, ছোটবাবু যাবে নাকি! মেয়ে মানুষের হাসি দেখে আসতে পার।

ছোট বলল, তুমি বরং যাও। রেলিঙে একটু বসছি আমি। হাঁটতে হাঁটতে কোমর ধরে গেছে। একটা ট্যাকসি নিতে পারতে। বাসে উঠে যেতে পারতাম।

—হাঁটাপথ সব চিনি। কিন্তু বাসগুলো কোথায় যায় জানি না। লেখা দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। হেঁটে হেঁটে আমি শহরটাকে ঘুরতে পারি, কিন্তু গাড়িতে উঠলে, কিছুতেই বোঝাতে পারি না কি করে জাহাজঘাটায় যাব। ওরা যে জাহাজটাকে কি বলে!

অমিয়র মনে হল এটাও মৈত্রের ভুজং ভাজুং। ছোটবাবু আর অপেক্ষা না করে রেলিঙে বসে পড়ল। মৈত্র তখন বলছে, আমি যাচ্ছি। দেখি কি বলে। সে গিয়েই বলল, চেঙ্গেরিতা। আরও কি বলল, তারপর একটা ইটালিয়ান কম্বল দরদাম করে কিনে ফেলল। মৈত্র হ্যান্ডশেক পর্যন্ত করল। অমিয় ভীষণ রেগে যাচ্ছে। সেও হাত বাড়িয়ে দিল। ওর সঙ্গেও হ্যান্ডশেক করছে। বেশ মজা লাগছে। সে বলল মৈত্রকে, শালা তুমি ভোজবাজি জানো। তুমি আমাদের রাজা।

মৈত্র এবার ঘড়ি দেখল। রাত খুব বেশি হয়নি। ওরা যদি ট্রেনে যায় তবে সামান্য পথ। এই ফালং-এর ‘মতো হবে। ইচ্ছা করলে হেঁটেও যাওয়া যায়। কিন্তু বেশি রাত করে জাহাজে ফেরা মৈত্রের পছন্দ নয়। একবার পাবে ঢুকে গেলে অমিয়কে তোলা যাবে না। বরং যাবার সময় ছোটবাবুকে একবার কার্নিভেলটা দেখিয়ে নিয়ে যাবে। সে ট্রেনে উঠে গেল। এক সময় ঠিক জায়গায় নেমে গেল। পাতাল রেলে চড়তে পেরে ছোটবাবু খুব খুশি। পাশেই বোধহয় কার্নিভেলের সদর দরজা। কোনটা কি সে বুঝতে পারে না। তার কাছে সব এক রকমের মনে হয়।

ওরা কার্নিভেলের গেটে দেখল, উর্দিপরা দারোয়ান। মাথায় উটপাখির পালখ গোঁজা। গেটের ওপরে নিয়নের বড় হরফে লেখা নাম। বড় বড় সিংহ, বাঘের মুখোস ঝুলানো। পাশে ক্লাউনের কায়দায় নাচতে নাচতে একটা সাহেব ক্ল্যারিওনেট বাজাচ্ছে। পাশে সারি সারি চারটা টিকিট ঘর। খুব বড় লাইন নেই অথবা এখন রাতের বেলা বলে যে যার মতো আগেই ঢুকে গেছে। যারা গেছে তাদের অনেকে বের হয়ে আসছে। ওরা তাড়াতাড়ি টিকিট পেয়ে গেল। ওরা ভিতরে ঢুকে দেখল, বেশ হল্লা, মদ খেয়ে কেউ কেউ বেলল্লাপানা করছে। এখানে ইচ্ছা করলে দু পেগ মেরে নিলে মন্দ হয় না। খালি চোখে দেখার চয়ে, যেন সামান্য গোলাবী নেশা করে দেখলে জমে ভাল। এবং চারপাশে নীল আলো। ছোটবাবুকে এক পেগের বেশি দেবে না। কারণ ও বোধহয় খেলে জীবনে প্রথম খাবে। খেয়ে স্ট্যান্ড করতে পারবে কিনা কে জানে।

ঢোকার মুখে দেখল একটা আলোর মুরগী ঘুরে ঘুরে ডিম পাড়ছে। নীচে এক বৃদ্ধা, হাতে ছোট বাসকেট। একটা করে মুরগিটা ডিম পাড়ছে, একটা করে বৃদ্ধা বাসকেটে রেখে দিচ্ছে। এটা হয়তো কোনও বিজ্ঞাপন। কিসের বিজ্ঞাপন ওরা বুঝতে পারল না। ওরা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে মুরগির ডিমপাড়া দেখল। দেখতে দেখতে মৈত্র বলল, হাফ পয়সা উসুল।

অমিয় বলল, উসুল।

মৈত্র ছোটবাবুকে বলল, এদিকটাতে একটা টানেল আছে। ভিতরে খুব অন্ধকার। গুহা, ঝর্ণা, বরফের পাহাড় আর মাঝে মাঝে নকল সাপ, বাঘ, হরিণ, মানুষের কঙ্কাল ঘোরাফেরা করছে! খেলনার রেলগাড়িতে উঠে গেলে বেশ আধঘন্টার মতো নিচে ঘুরিয়ে আনবে।

ওরা টানেলের ভেতর ঢুকল না। দুটো মাঝারি তাঁবু পার হয়ে গেল। মৈত্র অথবা ছোটবাবু না বললে, সে কোনও পাবে ঢুকবে বলে আশা করে না। যে কোন সময় মৈত্র বলতে পারে।

একটা তাঁবুতে তখন কে যেন সুর করে মেঠো গান গাইছে। এবং ওরা দেখতে পেল, ঠিক গানের সমের সঙ্গে একটা করে পুতুল ওপরে উঠে যাচ্ছে। তার ঠিক ফাঁকে মানুষেরা গোল চাকতি বসিয়ে দু এক বোতল মদ জিতে নেবার চেষ্টা করছে। অনেকে পারছে না, কেউ কেউ পারছে। এটা একটা জুয়া খেলার তাঁবু। কেউ কেউ তখুনি বোতল জিতে দাঁতে কামড়ে ছিপি খুলে ঢক ঢক করে খাচ্ছে। এরা কোনো জাহাজের জাহাজি হবে। মৈত্র খেলার মতো করে দশটা চাকতি সোজা তুলে নিল। মাত্র চার প্যাঁসুর বাজি। সে দশটা চাকতি ছুঁড়ে সহজেই তিনটে চাকতি পুতুল নামা-ওঠার ফাঁকে জায়গামতো বসিয়ে দিল। অমিয় দেখল, হাতের টিপ মৈত্রের অসামান্য। সে সহজেই তিনবার জিতে দু বোতল, এই আট আউন্সের মতো করে হবে, বেশ পেয়ে গেলে বললে, নে। খাব খাব করছিলি, বসে বসে খা। মাগনায় যখন পেয়ে গেলাম—বলে মৈত্র ওদের দুজনকে নিয়ে একটা বসার মতো জায়গা খুঁজে নিল। সামনেই গোল গম্বুজের মতো তাঁবু। এক প্যাসু দিলেই লাল নীল চেয়ার পাওয়া যায়। এক প্যাসু দিলে গ্লাস। ওরা সেখানে বসে গ্লাস নিল। ছোট বড় হলুদ রঙের টেবিল আর ছোট বড় মাঝারি মানুষের কোলাহল। মেয়েরা যেন বেশি মাতাল। কখনও খেতে খেতে গাইছে, কিসব এটটিন পেটটিন………..তারপর তোতালামিতে পেয়ে যায়। আর গাইতে পারে না। মৈত্র বলল, খাও বাপু। কিন্তু বেশ্যা মেয়েরা বেশ তক্কেতক্কে আছে। একেবারে বেহুঁশ হবে না। ছোট, তুমি কি খাবে দ্যাখো। এটুকু খাও। তোমার শীত থাকবে না। রাতে ভাল ঘুম হবে। সকালে বাউয়েলস্ একেবারে ক্লিয়ার। ও শালীর শালীরা যে কি গাইছে!

এভাবে মৈত্র খেতে থাকল। সে একাই খেয়ে ফেলল পুরো একটা। অন্যটা ওরা দুজনে ভাগ করে খেয়েছে। বেশিটা অমিয়, কমটুকু ছোটবাবু। ছোটবাবু গলায় ঝাঁঝ পাচ্ছে। বড় বিদঘুটে ব্যাপার, কেন যে লোকে খায় সে বোঝে না। এটা যে মৈত্র কি করছে। সে টাকা দিয়ে আরও দু বোতল নিজে কিনে এনেছে। সেই খুব বেশি সাবধানী ছিল, একটুতেই কেমন যেন এখন একগুঁয়ে হয়ে গেছে। মৈত্রদা এত মদ খেতে পারে, জাহাজে ছোট একেবারে বুঝতে পারেনি।

এভাবেই মৈত্র জাহাজি মৈত্র হয়ে যায়। এভাবেই সে তার সংসারের কথা ভুলে গেল। শেফালীর কথা ভুলে গেল। মৈত্র, জাহাজি মৈত্র, এখন ঘাসের ওপর দু-পা ছড়িয়ে মদ খাচ্ছে। সামনে সব নীল লাল স্কার্ট পরা মেয়েরা হেঁটে যাচ্ছে। ওদের উরু দেখা যাচ্ছিল। পুরুষ্ট উরু। কোথাও নাচ হচ্ছে। কোথাও থেকে ব্যান্ডের বাজনা ভেসে আসছে এবং ব্যান্ড বাজলেই মেয়েরা ওর চোখের ওপর ফুলের মত হয়ে যায়। যেন ঈশ্বরের বাগানে এরা সব সদ্য ফোটা ফুল। ওর কেন যে সব ফুল তুলে নিতে ইচ্ছে করে। এবং একটা একটা করে ফুলের পাপড়ি ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। পাপড়ি ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে ইচ্ছে করে কেবল।

জায়গাটা এখন প্রায় উৎসবের মতো। কচি কচি মেয়েরা গ্যাসের বেলুন বাতাসে ভাসিয়ে দিচ্ছে। বালিকারা কোল্ড ড্রিঙ্কস খেয়ে মৈত্র এবং অমিয়কে দেখছে। ওরা দেখে তাজ্জব, এমন দু তিনটে দৈত্যের মতো মানুষ এখানে বসে হামেসা মদ খেয়ে যাচ্ছে কেন। ওদের মায়েরা তখন এত বেশি উরু খালি রেখেছে যে মৈত্র বেশিক্ষণ স্থির থাকতে পারছে না। অমিয় এবং ছোটকে ধাক্কা মেরে প্রায় যেন উঠে গেল। এবং বালিকাদের মায়ের সঙ্গে অশ্লীল কথা বলার চেষ্টা করল। শীতের ঠান্ডায় ছোটবাবুর কান লাল হয়ে উঠল মৈত্রের কথা শুনে।

অমিয় রেগে গিয়ে নিজের পয়সায় আরও চার আউন্সের বোতল কিনে ফেলল। সে স্টুয়ার্ডের কাছে যে পয়সা পেয়েছে সবটাই পকেটে। মৈত্র কি ভেবেছে!

যাতে মৈত্র না দেখে, একটু দূরে বসে অমিয় খাচ্ছিল। আর আকাশ দেখছিল। মনে হয় ওর কাছে আকাশটা খুব নিচে নেমে এসেছে। রাত বাড়ছিল। মৈত্র দেখল, অমিয় পাশে নেই। ছোট সামান্য খেয়েই শরীর ছেড়ে দিয়ে চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিয়েছে। সে দেখল, ভারি ঝামেলা। ওর নেশা কেটে যাবার মতো। সে তাড়াতাড়ি উঠে গেল ছোটর কাছে, কি বাবু ভাল লাগছে না। ছোট মাথা ঝাঁকাল। মৈত্র ভাবল, এখন জাহাজে ফেরা দরকার। কি যে মোহের ভিতরে পড়ে যায় সে।

মৈত্র অমিয়কে বলল, এই কি হচ্ছে!

—কি আবার হচ্ছে।

মৈত্র দেখল, আধ বোতলের মতো এখনও বাকি। সে সেটা উপুড় করে দিল। তারপর অমিয়কে ভীষণ মাতলামি করতে দেখে বলল, এক থাপ্পড় মারব মাতলামি করলে। পা ঠিক রাখবি।

কে কার পা ঠিক রাখে! অমিয়র ঠিক রাখতে গিয়ে নিজের পা ঠিক রাখতে পারছে না। অমিয় বলল, তুই আমার সঙ্গে এমন করিস কেনরে! আমি কি করেছি তোর সঙ্গে।

—তুমি শালা মুখ উঁচু করে রেখেছ কেন! কি দেখছিস ওপরে।

—কিছুই দেখছি না। কবে আমরা দেশে ফিরব মৈত্র?

—আমি তার কি জানি!

—তুই আমাকে একা ফেলে যাবি না?

মৈত্র ওর হাত ধরে টেনে তুলে দিল। মৈত্র এবং ওরা দুজন প্রায় টলতে টলতে হাঁটছে, কেবল ছোটবাবু টলছে না। কিন্তু কেমন যেন বমি বমি পাচ্ছে। ভেতরে অস্বস্তি হচ্ছিল। এখন সে আর কোথাও যেতে চাইছে না, শুধু জাহাজে ফিরে যেতে চাইছে। তবু সে, মৈত্র অথবা অমিয়কে ফেলে যেতে পারে না। সে ওদের সঙ্গে হাঁটতে থাকল। ওরা সোজা ডেনছিগোর দিকে যাচ্ছে। ওরা নকল এরোপ্লেনে চড়ল না। নকল মোটরে উঠে দাপাদাপি করল না। সামনের একটা মঞ্চের দিকে ওরা হেঁটে গেল। সামনের মঞ্চটায় উঠে গেলে কেবল ঘুরতে থাকে, উড়তে থাকে, উপরে উঠলে বেশ একটা মেজাজ আসে। তখন মনে হয় এই সংসার, যুবক যুবতী সহবাস সব এই কার্নিভেলের মতো। নিছক খেলনা। গত সফরে ওখানে উঠে মৈত্র বমি করে দিয়েছিল।

ফেরার পথে মৈত্র বলল, কিরে ফের যাবি? তুই ছোটবাবু?

অমিয় বলল, আমি যাব না। গেলেই শুয়োরের বাচ্চার সঙ্গে ঠিক দেখা হয়ে যাবে।

মৈত্র বুঝতে পারল না অমিয় কাকে গালাগাল করছে।

—শুয়োরের বাচ্চা খুব জ্বালাচ্ছে।

—কে শুয়োরের বাচ্চা?

—আছে। ওকে শালা এমন শিক্ষা দেব না।

মদ খেলে নানাভাবে ভেতরের দুঃখ উথলে ওঠে। এটাও এমন একটা কিছু হবে। মৈত্র কথাটার তেমন গুরুত্ব দিল না। সে ছোটবাবুকে বলল, চল, ওদিকটায় ঘুরে যাই। সর্টকাট হয়ে যাবে। জুয়ার আড্ডাগুলোর পাশ দিয়ে সামনের রাস্তায় পড়তে পারব।

অমিয় ধরা গলায় বলল, কোনদিকে?

মৈত্র বলল, ওদিকে। খেলতে পারবি না কিন্তু।

অমিয় বলল, তুই না খেললে, আমি খেলছি না।

—ছোটবাবু সাবধান।

—আমার টাকাই নেই।

অমিয় বলল, তুমি ছোটবাবু কিন্তু ভীষণ চালাক লোক। একটা প্যাসু তুললে না।

মৈত্র বলল, কিছু তোমাকে তুলতে হবে ছোটবাবু। তোমার দুটো স্যুট কেনা দরকার। সেকেণ্ডহ্যাণ্ড মার্কেটে খুব সস্তায় পেয়ে যাবে।

ছোট বলল, অনেকদিন এখানে আছি তো। কাল তুলব ভাবছি।

—তোমার শরীর কেমন লাগছে?

—খারাপ না। বেশ ভাল লাগছে। আগের মতো খারাপ লাগছে না।

মৈত্র বলল, কেমন সস্তায় মদ খাইয়ে দিলাম।

অমিয় বলল, অনেক ধন্যবাদ। বলে, অমিয় হাত তুলে দাঁড়িয়ে থাকল। যেন সে মৈত্রকে আশীর্বাদ করছে। ওর হাত শিথিল। হাওয়ায় যেন হাত টলছে। ছোটবাবু বলল, এভাবে হেঁটে যাওয়া যাবে না। বরং একটু বসে গেলে হয়। অমিয়র নেশাটা যদি কমে।

—এখানে কোথায় বসবি! শালা সব সোনার ঈগলেরা উড়ছে। চল একটু ফাঁকা জায়গা দেখে বসি।

সুন্দরী যুবতীদের ছেড়ে যেতে ইচ্ছা হচ্ছিল না অমিয়র। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে শিস মারছে। মৈত্র এবং ছোটবাবু এখন জাহাজে ফেরার জন্য আকুল। হয়তো গিয়ে দেখবে, শেফালীর চিঠি এসেছে আবার। বন্দরে সে তিনটে চারটে চিঠি পেতে পারে। শুধু এক খবর। টাকা, খরচ শেফালী দুহাতে করতে ভালবাসে। এখন তো শেফালীর দরকারেই লাগবে টাকাটা। শেফালীর সব চিঠিই নতুন মনে হয়, তাজা মনে হয়। যত পুরানো থাকুক, এত দূর দেশে এসে সে সব সময় চিঠিতে শেফালীর শরীরের ঘ্রাণ পায়। শেফালীর শরীরের গন্ধ চিঠিতে যেন লেগে থাকে।

সে শেফালীর চিঠি পেলে সব ভুলে থাকতে পারে। বন্দরে নেমে এদিক-ওদিক ঘোরার আকর্ষণ বোধ করে না। কোন বারে, রেস্তোরাঁয়া বেশ্যালয়ে ঘোরার নিদারুণ অভ্যাস ওর মনের ভেতর থেকে মুছে যায়।

মৈত্র এবার বলল, অমিয় তুই থাক, আমরা চলে যাই।

—আমাকে ফেলে চলে যাবি! আমি একা যেতে পারব!

—তবে চল। বেশ রাত হয়ে গেছে। সামনে অনেকগুলো জুয়ার আড্ডা পড়বে।

—তুমি আমার জী-গুরু-দোস্ত। তোমার কথা না শুনলে চলে।

তারপর ওরা সেই নকল মঞ্চ পার হয়ে গেল। ডানদিকে আর একটা বড় হলঘর। ভিতরে নাচ হচ্ছে। ক্যারিওনেট বাজছে। এবং একটা লোক ম্যাণ্ডোলিন বাজিয়ে ষাঁড়ের মতো চিৎকার করে গাইছে। এইসব চেঁচামেচি অথবা গান ভীষণ উত্তেজিত করে রেখেছে চারপাশটা। ডেনছিগোর বাইরে যেসব ফুলের গাছপালা অথবা সারি সারি পাম গাছের নকল জঙ্গল, বনের ভিতর মাঝে মাঝে লাল আলোর সংকেত, অর্থাৎ ওখানে কেউ কেউ যুবক যুবতীরা শুয়ে নীল আকাশ দেখছে, অথবা নতুন নক্ষত্রের জন্ম দিচ্ছে। লাল আলোর সংকেত, এদিকে না, এদিকের জায়গা দখল, অন্যদিকে, অন্যদিকে খুঁজে নাও। জায়গা পেয়ে যাবে। এখানে এসে মৈত্র বলল, ভালছেলের মতো চোখ বুজে থাক। তাকাবি না।

—খুব মজা। হোঁচট খাই আর কি! তুই চোখ বুজে হাঁট না। অমিয় বরং লাল আলোর পাশ দিয়ে হেঁটে গেল। যেন সে এর ভিতর একটা জায়গা খুঁজতে এসেছে। আসলে ওর দেখা চাই, কে, কিভাবে কিসব চালাচ্ছে। এটা যে কি শহর! সে বুঝতে পারে না, খোলা আকাশের নিচে এসব হয়! ও কেমন ক্রমে অধৈর্য হয়ে পড়ছে।

ছোটবাবু বলল, আমার ভয় করছে মৈত্রদা, এর ভিতর দিয়ে আসা ঠিক হয়নি। কেউ কিছু বলতে পারে।

—আরে আয়তো। এরা কেউ কিছু বলবে না।

মায়াবিনী আলো চারপাশে, ছোটবাবুর মনে হচ্ছিল, সে একেবারে কেমন হাবাকালা হয়ে যাচ্ছে। সব এত স্পষ্ট! সে লজ্জায় তাকাতে পারছে না, কেমন এক অপরাধবোধ এবং ভেতর থেকে আবার শীত উঠে আসছে। খোলামেলা জায়গায় এসব এ-ভাবে হয় সে জানত না। চারপাশে সারি সারি নানা ভঙ্গীতে উলঙ্গ হয়ে শুয়ে আছে তারা। কেউ ওভারকোট পেতে নিয়েছে, কেউ কিছুই পেতে নেয়নি। দেখে মনে হয়, শীতটিত ওদের শরীরে লাগে না। সে প্রায় দু’লাফে জায়গাটা পার হয়ে গেল যেন। অমিয়কে টানতে টানতে নিয়ে আসছে মৈত্র। কলার ধরে টেনে আনছে।

জুয়া খেলার মেলায় ঢুকে মৈত্র অমিয়র কলার ছেড়ে দিল। এবং মৈত্র এসব জায়গায় গত সফরে বেশ গচ্ছা দিয়ে গেছে। তখন মৈত্র একা ছিল, দায়-দায়িত্ব কম ছিল। জুয়া খেলার আসরটাই মৈত্রের কাছে কার্নিভেলের মজার জায়গা। দোকানগুলো ওর সব চেনা। সে মুখগুলো পর্যন্ত মনে করতে পারে। কিন্তু এখন সে দেখছে সব কেমন বদলে গেছে। নানাবর্ণের বেলুন, কাগজের ফুল উড়ছে হাওয়ায়। সে আগের কাউকে দেখছে না। দুজন বেশ বলবান মানুষ, ওদের কোমরে মোটা বেল্ট, পায়ে হাঁটু পর্যন্ত সু, এবং হাতে লম্বা চামড়ার দস্তানা, ওরা খেলছে। দুজন মেয়ে দুপাশে দাঁড়িয়ে ওদের রিভলবারে গুলি ভরে দিচ্ছে। ওদের দেখেই বুঝল, এরা ঠিক জাহাজি। ওরা আসলে পাশের মেয়েদুটোকে ধরার জন্য জুয়া খেলে পয়সা নষ্ট করছে। রাত বাড়লে, এরা ঠিক মেয়েদুটোকে কোথাও নিয়ে যাবে। মৈত্র এবার দেখে অবাক হল, আগের বয়সী যুবতীরা একজনও নেই। খুব অল্পবয়সের ফুলের মতো নরম মেয়েরা এখন দোকান আগলাচ্ছে। আর এভাবে কি যে হয়ে যায় মানুষের, মৈত্র যেতে যেতে নীল লাল রঙের, কাঠের বল, গড়িয়ে দিতে পারলেই বাজি মাত, এক প্যাসুতে একটা নতুন কোট মিলে যাবে… যেন এখন ইচ্ছে মৈত্রর একটা কোট এক প্যাসুতে মিলে গেলে মন্দ হয় না। মাত্র এক প্যাসু ওর হাত ভীষণ পাকা। সে পাকা জুয়াড়ীর মতো অল্পবয়সের মেয়েটির সামনে দাঁড়িয়ে গেল। এই শহর, এত বড় শহর, আর এখানে মেয়েরা এখন জুয়ার রিঙে বসে থাকে ভাবতেই শরীরের ভেতর কেমন শিহরণ খেলে গেল। সে এবার হামলে পড়ে দুটো কাঠের বল বাজীকরের মতো তুলে নিল। বল দুটো ওপরে ছুঁড়ে দিয়ে আরও তিনটে লাল নীল বল বাতাসে এক এক করে পাঁচটা বল খেলাতে থাকল। পাঁচটা ক্রমে আরও তিনটা তারপর চারটা টপাটপ তুলে হাওয়ায় ভাসিয়ে রাখল। দুটো হাতে বারোটা বলের খেলা। অমিয়, ছোটবাবু এমনকি রিঙের মেয়েটা পর্যন্ত তাজ্জব বনে গেল।

অমিয় চিৎকার করে বলল, শুয়োরের বাচ্চা তুমি সার্কাসে তবে সিংহের খেলা দেখাতে!

মৈত্রের ইচ্ছে হল, গালে ঠাস করে চড় বসিয়ে দেয়। কিন্তু মদ খেলে হুঁশ থাকে না। শিশুর মতো সরল কথাবার্তা। তাছাড়া এমন এক তাজা মেয়ে সামনে। এমন একটা আশ্চর্য খেলার সব তামাসা মাটি। সে খুব সহজভাবে বলল, সিংহের খেলা নয় রে। এটা রিঙের খেলা দেখাচ্ছি। এবং এভাবে সে কখনও বারোটা বল পেছনে হাতের ভিতর অদৃশ্য করে ফেলেছে, আবার কেমন সব এক এক করে হাত নামিয়ে ট্রেতে রেখে দিচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি হাততালি দিয়ে উঠল এবং রূপোর স্টিকে একটা বল এগিয়ে দিল মৈত্রের কাছে।

মৈত্র বলল, না। আজ না মেমসাব। অনেক রাত হয়ে গেছে। কাল খেলব। তারপর আঙ্গুল তুলে অমিয়কে দেখাল। যেন বলা, মাতাল। এক্কেবারে মাতাল।

মেয়েটি কিছুই বুঝল না। শুধু রুপোর স্টিক দিয়ে আরও দুটো বল মৈত্রের দিকে এগিয়ে দিল। সেই সরল হাসি। এবং এখন আর এ-মেয়েটিকে কম বয়েসী মনে হচ্ছে না। খাটো স্কার্টের ভেতর উরু দেখে সে বুঝল, খুব সেয়ানা মেয়ে। ফুলের পাপড়ি ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়।

—না মেমসাব। ঘরে আমার বিবি আছে। ও জানতে পারলে রাগ করবে।

মেয়েটি কিছু বুঝতে পারছে না। বোকার মতো হাসছে। মেয়েটি বোধ হয় বুঝেছে মানুষটা জাহাজি। রাত হলে সব জাহাজিদের ভিড় এখানে। মৈত্রকে ভীষণ লোভী দেখাচ্ছে! মেয়েটি ওর দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। মৈত্রের যেন সাহস নেই এখন রিং ছেড়ে যায়। মাত্র এক প্যাসুর খেলা। সে না খেললে, মেয়েটার কাছে ছোট হয়ে যাবে। সে এবার প্যাসু ছুঁড়ে দিল। দুটো বল, রুপোর স্টিক হাতের কাছে। ট্রেতে এমন অনেক লাল নীল বল। সে বল গড়িয়ে দিল। বল গড়িয়ে অন্য দিকে চলে গেল! সে ঠিক জায়গার বল গড়িয়ে দিতে পারল না।

মেয়েটি মৈত্রকে হেরে যেতে দেখেও হাততালি দিল। খুব খেলা দেখানো হচ্ছিল! এখন সব ভোজবাজি শেষ। মেয়েটি যেন এবার ওকে শেখাতে পারে। সে বাইরে বের হয়ে মৈত্রের পাশে দাঁড়াল। বোধ হয় বলল, এই দ্যাখ্যো সাঁইয়া। সে দুটো বল ঠিক ঠিক জায়গায় গড়িয়ে দিল। যেন খুব সহজ।

মৈত্র এবার দু প্যাসু দিয়ে তিনটি বল নিল। কোন দিকে তাকাল না। ছোটবাবু একটা থামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মৈত্রের টিপ দেখছে। মৈত্র এবার খুব সহজে একটা বল জায়গামতো পৌঁছে দিল। ছেলেবেলায় টিপ্পি খেলত। খেলাটা হুবহু একটা আধুনিক টিপ্পি খেলা। সে অনেকগুলো টিপ্পি বাঁচিয়ে সহজেই রাজা টিপ্পিটাকে গর্তে ফেলে দিতে পারত। সুতরাং মৈত্র একবার জিতেই ভেবেছে, মেয়েটার ঠিক জামা-কাপড় খুলে নিতে পারবে। কিন্তু পরে চার বার মেরে একবার। সে ফের প্যাসু দিয়ে দশটা। একটাও গেল না। মেয়েটা তেমনি ঠোঁট টিপে হাসছে। বড় সুস্বাদু খাদ্যের মতো হাসিটা ওকে প্রলোভনে ফেলে দিচ্ছে। সে ইতিমধ্যে দশ প্যাসুর মতো হেরে গেছে। অমিয় নাইটের মতো এগিয়ে এসে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিল মৈত্রকে, খেল মেমসাব। তোমারে উলঙ্গ কইরা দিমু। অমিয় দেশের ভাষায় এবারে কথা বলতে লাগল।যা খেইল দেখামু, বোজবা কারে কয় বাঙ্গাল! বলে অমিয় আট প্যাসুতে ষোলটা কাঠের বল তুলে খেলতে গিয়ে দেখল সব কটা কাঠের ট্রেতে উঠে গেছে। সুতরাং এক ধাক্কায় ওকে সরিয়ে সামনে দাঁড়াল মৈত্র। হা-হা করে হাসল। সে এবার ষোল প্যাসুতে বত্রিশটা বল কিনে ফেলল।

ষোল প্যাসু হেরে যেতেই শেফালীর মুখ মনে পড়ে গেল। হয়ত এতক্ষণে জাহাজে শেফালীর আর একটা চিঠি এসে গেছে। রোজ রোজ সে শেফালীর চিঠি পাবে আশা করে। সে তাড়াতাড়ি খেলা শেষ করে বুঝল জেতা যাবে না। কিন্তু মেয়েটা এমন অবজ্ঞার হাসি হাসছে যে পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যাচ্ছে। হাতে রুপোর স্টিক। যেন রিঙের ভেতর এখন মেয়েটা ইচ্ছে করলে সিংহের খেলা দেখিয়ে দিতে পারে। দু-একবার জিতে গেলে প্যাসু ডাবল ফিরিয়ে দিচ্ছে। সবই অবহেলাভরে। কেমন ঝর্ণার উৎস থেকে কল কল করে নেমে দু’পাড়ের সব ভাসিয়ে দেবার ইচ্ছে। যত এমন হচ্ছে তত মৈত্রের জেদ। সে এবার সব বলগুলো কোলের কাছে টেনে নিলে, মেয়েটি চোখের ইসারায় বলছে, আর কেন, এবার যাও। কাল, মাথা ঠাণ্ডা করে এস। খেলতে পারবে।

মৈত্র খিস্তি করল এবার, ছেনালী হচ্ছে! খেলবে না! সে এলোমেলোভাবে এক গাদা প্যাঁসু পকেট থেকে তুলতেই, মেয়েটি দ্রুত স্টিক হাতের ওপর ঘোরাতে থাকল। যেন মেয়েটির ইচ্ছে না, মৈত্র আর খেলুক। রেগে গেলে খেলা ঠিক হয় না। লোকটা ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলছে। অথবা বলার ইচ্ছে যেন, লক্ষ্মী ছেলের মতো জাহাজে যেতে বললাম, তুমি বাপু ফের একগাদা নোট বের করেছ। কি করা। খেলা যাক। সে ট্রে এগিয়ে দিল।

ছোটবাবু বলল, কি তুমি জাহাজে যাবে না!

—দাঁড়া!

মেয়েটি ততক্ষণে ওদের জন্য তিন কাপ কফি আনিয়ে দিয়েছে। ওরা দাঁড়িয়ে খাচ্ছে। অমিয় পাশে একটা টুলে বসে রয়েছে। সে দাঁড়াতে পারছে না। কফিটা খেলে নেশা মরে যাবে। মেয়েটির এমন সৌজন্যবোধ দেখে ছোটবাবু কেমন অবাক হয়ে গেল!

মৈত্র কফি খেতে খেতে টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়েছে। কফি খেতে খেতে দাবার ছকের মতো কি যেন পরীক্ষা করছে। টেবিলের ওপর গোটা ছকটাতে কি যেন যাদু আছে। মেয়েটি যতবার বল গড়িয়েছে, প্রত্যেকবার ঠিক জায়গায় পৌঁছে গেছে। সে পারছে না কেন বুঝছে না। মৈত্র, শেফালীর মতো দুর্ধর্ষ মেয়েকে সামলায়, সে চাল-চলনে লড়নেওয়ালার মতো, তার কাছে এই মেমসাব সামান্য মেয়ে, তার কাছে সে বার বার হেরে যাচ্ছে।

চারপাশে অনেকে দাঁড়িয়ে ওর খেলা দেখছে। ছোটবাবুর কফি শেষ। কেউ কেউ বল নিয়ে খেলবে ভাবছে, কিন্তু মৈত্রকে ও-ভাবে হেরে যেতে দেখে সাহস পাচ্ছে না। মনে হয় ওরা সবাই মেয়েটিকে চেনে। সে সবাইকে খেলার জন্য স্টিক দিয়ে বল ঠেলে দিচ্ছে। মৈত্র ওদের কথা বুঝতে পারছে না। সবাই স্প্যানীশ বলছে। তার জন্য মৈত্রের কোন অসুবিধা হচ্ছে না। সব দেশে সাধারণ বাজার করবার মতো বিদ্যা তার আছে। কিছুটা দর কষার মতো, কিছুটা চিটাগাঙ এবং সন্দিপী নিরক্ষর জহাজিদের ইংরেজির মতো। দর-দামের কথা বললে, হাউ মুচ মেমসাব, অর্থাৎ হাউ মাচ মেমসাব! সুতরাং মৈত্র প্রায় বোবার সামিল। সে, সব রেখাগুলো টেবিলের পরীক্ষা করছে। সে যেন এই ছকের ভেতর মেয়েটির মুখ দেখতে পাচ্ছে। বড় কোমল মুখ। নাক লম্বা। চুল কালো নীল চোখ। আর গায়ের মাংস আপেলের পিঠের মতো। পরনে লাল স্কার্ট, আঁটা ফ্রক, কোট শাদা রঙের। গলায় নীল পাথরের মালা, মাথায় লাল টুপি। তাতে পাখির পালক গোঁজা। কপালের কিছুটা কালো মখমলের জাল দিয়ে ঢাকা। চোখের নিচে কেমন নীলাভ রঙের আবছা অন্ধকার। মৈত্র মেয়েটিকে বেশিক্ষণ ছকের ভিতর দেখতে পেল না, অমিয় এসে কলার চেপে ধরেছে, এই যাবি কিনা বল!

—যাব, চল। মৈত্র এবার মেয়েটির দিকে তাকাল। মেয়েটি ওকে দু হাঁটু ভাঁজ করে বাউ করল। মৈত্র, মাথার টুপি খুলে ওর বাউকে সম্মান জানাল। তারপর কোনও দিকে তাকাল না। সে সোজা অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে থাকল। সে ছোটবাবু এবং অমিয়র সঙ্গে একটা কথাও বলল না। রাত গভীর। রাস্তায় লোক চলাচল কমে গেছে। কোথাও বোধ হয় এখন স্কাইলার্ক ফুল ফুটছে। ওরা ফুলের গন্ধ পাচ্ছে। টাওয়ারের বড় ঘড়িটাতে ঘণ্টা বাজছে এক দুই তিন…এভাবে অনেক। মৈত্র এমন সময়ে করুণ গলায় বলল, আমার জাহাজে যেতে ইচ্ছে করছে না রে। মেয়েটার পায়ের নিচে আমার পড়ে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *