1 of 2

অলৌকিক জলযান – ১১

॥ এগার ॥

রাতে রাতে বন্দরে ঢুকেছিল জাহাজ। সেণ্টিসে রসদ, মন্টিভিডিওতে কয়লা, জল আর কিছু না—জাহাজিরা অন্ধকার রাতে বন্দর স্পষ্ট দেখতে পায়নি। কেমন পাহাড়ী ছায়ায় লাল-নীল আলোর মালা, কেউ জাহাজ থেকে নামতে পারেনি। সবাই অন্ধকারে বন্দরের দৃশ্য দেখছিল। অন্ধকারে বন্দর ঠিক চেনা যায় না। কেমন একরকমের মনে হয়। কোনটা সেণ্টিসে কোনটা মন্টিভিডিও বোঝা যায় না। জাহাজ অন্ধকারেই আবার সমুদ্রে নেমে এসেছিল। ভোর রাতে জাহাজ গভীর সমুদ্রে নেমে গেছে। খুব একটা গভীরে যায়নি, উপকূলের আশেপাশে জাহাজ সারাদিন চলেছিল। দু’দিনের বেশি জাহাজের মানুষেরা দেখেছে ছায়া ছায়া উপকূল ভাগ। কেমন মেঘের মতো সমুদ্রের দিগন্তে ঝুলে আছে। দক্ষিণ আমেরিকার এই সব পাহাড়ী উপকূল কেমন রুক্ষ। গাছপালা চোখে পড়ে না। পাথর আর পাহাড় দক্ষিণে, যত এগিয়ে যাচ্ছে, শীত তত আরও বাড়ছে। প্রায় হাড়-কাঁপুনি শীত। পোর্ট এলিজাবেথ থেকে সাতাশ দিনের মতো জাহাজ ছেড়েছে। ক্রমে দক্ষিণ আমেরিকার কেপহর্ণের দিকে যাচ্ছে। প্রায় একশো আশি ডিগ্রী বরাবর দক্ষিণে এখন জাহাজ নেমে যাচ্ছে। যেন এভাবে আর কিছুদূর গেলেই জাহাজ দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছে যাবে। মৈত্র শীতে ভীষণ কাঁপছে। সে মোটা কম্বল গায়ে পোর্ট-হোল দিয়ে কিছু দেখছে। গ্যাস-পাইপ ফোকসাল উষ্ণ রাখতে পারছে না।

সামনের বন্দরে ওরা কিছুদিন থাকতে পারবে। এদের পক্ষে এটা আশার কথা। শুধু জল আর মাঝে মাঝে দ্বীপ, অথবা সমুদ্রে কেবল চলা নিশিদিন। এনজিনের ঝ্যাক ঝ্যাক শব্দ, স্টিয়ারিং এনজিনের কক্ কক্ শব্দ বিরক্তিকর। মাঝে মাঝে একেবারে অসহ্য। সুতরাং বন্দরে জাহাজ ঢুকে গেলে জাহাজিদের মনে হয়, পৃথিবীতে মানুষেরা ডাঙ্গায় বেঁচে থাকে। ডাঙ্গায় নেমে গেলেই মনে হয়, মাটির মতো প্রিয় আর কিছু নেই।

জাহাজিরা বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠছে। বন্দর আসছে বন্দর দেখা যাচ্ছে। রাত এগারোটা পর্যন্ত অনেক জাহাজি জেগে ছিল, বন্দর দেখতে পাবে বলে। ডেক-সারেঙ বলে গেছে, বারোটার আগে দেখা যাবে না। তবু প্রত্যাশা, কখন যে কে দেখে ফেলবে, অনেক দূরে ছায়া ছায়া মেঘের মতো ডাঙ্গা, অথবা সেই সন্ধ্যা থেকে হল্লা করছে জাহাজিরা, ঐ দ্যাখো। সারেঙ হেসে বলেছে, আরে না, ওটা দ্বীপ টিপ কিছু হবে। সময় না হলে জাহাজ বন্দর পায় না। সময় না হলে যেমন ওঁর দেখা মেলে না, এও বাবুরা তেমনি।

অমিয় বলল, তা চাচা যা বলেছেন।

ডেক-সারেঙ তার দলবল নিয়ে জেগে আছে। একটা দেড়টায় জাহাজ বন্দরে ঢুকে যাবে, ওদের বাঁধা-ছাঁদার কাজ। ডেক-জাহাজিরা এখন ঘুমোচ্ছে। সারেঙ ঠিক ঘুমোতে পারছে না। যদি বেচাল কিছু হয়ে যায়। সে একেবারে জাহাজের বাঁধা-ছাঁদা শেষ করে ঘুমোতে যাবে।

এবং এ-সময়ে ছোটবাবু খবর নিয়ে এল, দেখা যাচ্ছে।

এখন বাথরুমে স্নান করা। মৈত্র একটু আগে উঠে এসেছে। সে স্নান করে নিচে পোর্ট-হোলে কেবল কিছু দেখছে। অমিয় ঢুকে বলল, মৈত্র তুই জেগে আছিস! বললি যে শরীরটা ভাল না।

অমিয় এবং ছোটবাবু স্নান সেরে এসেও দেখল, মৈত্র পোর্ট-হোলে দাঁড়িয়ে কি দেখছে! চোখ কেমন ঘোলা ঘোলা। ছোটবাবু কখনও মৈত্রকে এভাবে দ্যাখেনি। জাহাজে এ মানুষটাকে সে প্রায় সারেঙসাবের মতো ভেবে এসেছে। সেই মানুষ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে কেমন ভয় পাবার কথা।

অমিয় বলল, ছোটবাবু, শুয়ে পড়। সে মৈত্রকে বলল, হ্যারে তুই কি দেখছিস।

—কিছু না।

এবার অমিয় বলল, ছোটবাবু কি মজা! কাল থেকে ওয়াচ থাকবে না। ও—ভাবতে কি ভাল লাগছে! কদিন থাকবে জাহাজ!

মৈত্র পোর্ট-হোল থেকে নড়ছে না। নিচের বাংকে ছোটবাবু ওপরের বাংকে অমিয়, কখনও কখনও ওরা পাল্টে নেয় বাংক। এ-ফোকসাল ওদের তিনজনের। এ-ফোকসালে একটা বাংক বেশি। মৈত্রের ওপরের বাংক খালি। মৈত্র এখনও পোর্ট-হোলে দাঁড়িয়ে আছে। মৈত্র কখনও কখনও ওপরের বাংকে শুয়ে থাকে।

অমিয় স্নান করায় হি-হি করে কাঁপছে। সে লেপ, কম্বল, যা আছে সব নিয়ে একেবারে জাম্বুবানের মতো শুয়ে পড়েছে। মাথায় মাংকি ক্যাপ পরে শুয়েছে। সব একেবারে বরফ হয়ে থাকে। সে দেখল মৈত্র তখনও নড়ছে না। অমিয় বিরক্ত হয়ে বলল, ধুস শালা, কি যে দ্যাখে! এই মৈত্র, ঘুমালে ঘুমো না হয় ওপরে গিয়ে বন্দর দ্যাখ। আলো নিভিয়ে দেব।

মৈত্র এবার তাকাল।

অমিয় বালিস থেকে মাথা তুলে বলল, হ্যাঁরে তুই কি দেখছিস?

—কিছু না।

—কিছু দেখছিস ঠিক!

—একটা তিমি মাছ!

—হ্যাঁ, তিমি মাছ। বলে কি রে! আরে ছোটবাবু, অঃ ছোটবাবু তুমি ঘুমালে নাকি! শুনছ ছোটবাবু, সে লাফ দিয়ে সব লেপ কম্বল ফেলে দিয়ে একেবারে নিচে নেমে গেল। সে মৈত্রকে সরিয়ে এনে পোর্টহোলে মুখ এগিয়ে দিলে, দেখল সামনে শুধু অন্ধকার সমুদ্র। অনেক দূরে বন্দরের আলো দেখা যাচ্ছে। নীল অন্ধকারের ভেতর যেন আলোর অজস্র মালা। এবং দূরে লাইট-হাউসের আলো। ঘুরে ঘুরে লাইট-হাউস জাহাজগুলোকে পথ দেখিয়ে যাচ্ছে। এবং অন্ধকারের ভেতর কিছু জাহাজ সমুদ্রে ইতস্তত নোঙর ফেলে রেখেছে দেখতে পেল।

অমিয় এবার পোর্ট-হোলে চিৎকার করতে থাকল, কোথায়, কোনদিকে! অন্ধকারে তুই তিমি মাছ দেখবি কি করে। বলে অমিয় সরে এল!

মৈত্র আবার যথারীতি পোর্ট-হোলে মুখ রেখে দেখতে থাকল।

অমিয় পাশে দাঁড়িয়ে বলল, দেখতে পাচ্ছিস?

—হ্যাঁ।

ছোটবাবু এখন কি করবে ভেবে পেল না। ঠাণ্ডায় পা গরম হচ্ছে না ছোটবাবুর। পা গরম না হলে ওর ঘুম আসে না। কিন্তু কি যে শীত! পায়ের হাঁটু পর্যন্ত একেবারে ঠাণ্ডা বরফ। সে স্নানের সময় গরম জল হাঁটু পর্যন্ত ঢালে। সে পায়ে গরম উলের মোজা পরে শোয়। জ্যাক ওকে দুটো দামী দস্তানা দিয়েছে উলের। শীতে হাত বরফের মতো। মাঝে মাঝে অসাড় লাগে। সে দস্তানা পরে থাকে। কাজ করার জন্য জ্যাক ওকে দুটো ভারি চামড়ার দস্তানা দিয়েছে। এবং পারলে যেন জ্যাক তাকে সব দিয়ে দেয়। সে এখন যা কিছু পরে আছে প্রায় সবই জ্যাকের দেওয়া। বেশ গরম! অমিয় অথবা মৈত্রের মতো সে শীতে তেমন কষ্ট পায় না। পা গরম হলেই ঘুম চলে আসবে। কিন্তু মৈত্র আর অমিয় পোর্ট-হোলে কি যে দেখছে বার বার!

অমিয় ফের পোর্টহোল থেকে মুখ তুলে আনল।—সব বাজে কথা। গুল!

মৈত্র বলল, তুমি হতভাগা কিছু দেখতে পাবে না। তুমি একটা আস্ত ষাঁড়।

—আমি আর কি দেখতে পাব! কেবল অন্ধকার সামনে, কিছু জাহাজ নোঙর করা। জলে ফসফরাসের লাল ফুলকি। তুমি একটা মরুভূমির উট।

—তা হলে তিমি মাছ দেখতে পেলি না!

—না।

—তা হলে বড় একটা বাঁশ দ্যাখ। ওতে একটা তিমি মাছের কঙ্কাল ঝোলানো আছে।

—পাগল আর কি! বলে সে এক লাফে আবার ওপরের বাংকে উঠে গেল। আসলে মৈত্র ওর স্ত্রী শেফালীর চিঠির কথা বলছে। বন্দরে এলেই বোধ হয় ওর বৌর কথা বেশি মনে হয়। ওর ঘুম আসে না। অমিয় মুখে মাথায় লেপ কম্বল যা আছে সব দিয়ে ঢেকে দিল। শেফালি চিঠিতে সব সময় একটা তিমি মাছের কথা লেখে। বোধহয় মৈত্র জাহাজ নোঙর ফেললেই তিমি মাছটা দেখতে পায়।

পরদিন সুবোধ বালকের মতো ঘুম থেকে উঠেই মৈত্র চা করে আনল। কাজ কাম সেরে বারোটায় স্নান করার জন্য বাথরুমে ঢুকে গেল। পোশাক খুলে ফেললেই আয়নায় নিজের শক্ত শরীর দেখার ইচ্ছে। কিন্তু শীতে সে দাঁড়াতে পারে না। সে তার পেশী দেখতে দেখতে কেমন শরীরে অনবরত গরম জল ঢালতে থাকে। হাতের পেশী দেখতে দেখতে সে শেফালির কথা মনে করতে পারে। শেফালি উঁচু লম্বা মেয়ে। সহবাসে শরীর বড় মনোরম। দস্যুর মতো তুমি, দস্যুর মতো আমাকে মেরে ফেলতে পার না–শেফালির এমন কথা কিনারায় এলেই তাকে পাগল করে দেয়। আমাকে তুমি মেরে ফেল আর পারছি না অথবা কেন যে এখন মৈত্রের মনে হয় শরীরের কষ্ট শেফালির বড় বেশি উগ্র। বাথরুমে অথবা কম্বল গায়ে চুপচাপ শুয়ে থাকলে শেফালির সব খালি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চোখে দেখতে পায়। তখন মৈত্রের শরীরে শীতটা বাড়ে।

বস্তুত মৈত্র বন্দরে এলেই শেফালির কথা বেশি মনে করতে পারে। বন্দরের গাছপালা, পারসিমন লতার গুচ্ছ অথবা স্কাইলার্ক ফুলের হলুদ রঙ ওকে মাতাল করে ফেলে। মৈত্র, সুখী এবং সৎ মৈত্র যাতে থাকতে পারে, তার জন্য কি যে ওর চেষ্টা!

স্নান সেরে বের হলে মৈত্র দেখল, অমিয়, ছোটবাবু, টেবিলে থালা সাজিয়ে বসে আছে।

খাবার সময় মৈত্র অমিয়কে বলল, দেখ অমিয় তুই নতুন এয়েছিস। শহর বন্দর সম্পর্কে তোর কোনও ধারণা নেই। লরেঞ্জো মরকুইসে, ডারবানে যা সব করেছিস, এখানে যেন এ সব না হয়। সব কিছুর একটা সীমা আছে।

—আমি কি করেছি!

—যাকগে, বলে দিলাম, যদি সাবধানে চলাফেরা না কর তবে কে কাকে রক্ষে করে। তারপর কেমন যে সে সহসা উত্তেজিত হয়ে গেল, শালা তুই এটা কলকাতার মদ পেয়েছিস। ঢক ঢক করে এতটা খেয়ে ফেললি! বিদেশী মদে কত ঝাঁজ তুই জানিস!

—না।

মৈত্র মাংসের হাড় চিবুচ্ছিল। সে ছোটবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, কেমন লাগছে ছোটবাবু?

—ভাল।

—দেখেছ, কি সব পরীদের মতো মেয়েরা গাছের নিচে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারপরই বলল, তোমাকে নিয়ে আমার ভয় নেই ছোটবাবু। যত ভয় অমিয়কে নিয়ে। একটু থেমে বলল, এখানে মেয়েদের কি বলে জানো?

অমিয় ক্ষেপে যাচ্ছিল। মৈত্র তাকে আর একটা কথা বলছে না।

ছোটবাবু মুখ তুলে তাকালে বলল, চেঙ্গেরিতা। শালা চেঙ্গেরিতাই বটে। যেমন রঙ, তেমনি বাহার। আর শালার কেবল খাই খাই! গাউনের নিচে কেবল…।

অমিয় থালা নিয়ে উঠে যাবার সময় শুধু বলল, কেবল খাবলা খাবলা। ও হাত দিলে কি যে মজা! আমি যাব। তুমি যা করতে পার কর শালা। বলে সে মেসরুম থেকে বের হয়ে গেল।

মৈত্র চিৎকার করে উঠল, মরবে! শালা মরবে।

ছোট বাবু সকালে ঘুম থেকে উঠে, সত্যি অবাক হয়ে গেছিল। জেটির পাশেই নানা রকম ফল ফলের গাছ, বড় বড় গাছ সমুদ্রের ধারে। সমুদ্র এখানে লেগুনের মতো নয়, অথবা নদী ধরে ভেতরে ঢুকেও বন্দর নয়, একেবারে সমুদ্রের ধারে শহর। জেটি থেকে একটু এই ফার্লং-এর মতো হাঁটলে শহরের ভেতরে ঢুকে যাওয়া যায়; এবং পেছনে তাকালে বিশাল সমুদ্র, শান্ত, নীল রঙের ভেতর এই সব সারি সারি জাহাজ, এবং জাহাজের পাশে যে সব গাছেরা ফুলেরা ছড়িয়ে আছে তাদের ভেতর এমন সব সুন্দর সুন্দর যুবক-যুবতীদের ঘুরে বেড়াতে দেখে ছোটবাবু ভীষণ অবাক হয়ে গেছিল। সামনে দাঁড়িয়ে আছে বড় বড় স্কাইস্ক্র্যাপার। সে জাহাজের বোট-ডেকে উঠে গেলে সব দেখতে পায়। এবং কালো এসফাল্টের পথ ধরে গোলাপী আভা মুখে মেয়েরা, ঠিক গোলাপী বললে ভুল হবে কিছুটা যেন নীল রং ফুটে বের হচ্ছে চোখের নিচ থেকে। সে ভেবেছিল দেবদেবীদের মুখ চোখ এমন হবার কথা, মানুষের মুখ চোখ এত সুন্দর হয় সে জানত না।

সুতরাং মৈত্র বলল, খুব খারাপ জায়গা বাপু। খুব সাবধানে চলাফেরা করবে। একা একা বের হবে না। বের হলে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।

অমিয় এবং ছোটবাবু এই প্রথম সমুদ্রে বের হয়েছে, প্রথম প্রথম যতটা অবাক হবার কথা তার চেয়েও বেশি অবাক সব কিছু দেখে। মৈত্র স্পেনীশ মেয়েদের এমন সব গল্প বলেছে যে নেমে গেলে আর ফিরে আসা যায় না। কি যে মোহ থাকে। টাকা পয়সা সব রেখে একেবারে নাঙ্গা হয়ে ফিরতে হয়।

ওরা দুজন আবার শিশুর মতো চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল।

অমিয় তবু যেমন বলে থাকে, একটু বলে ফেলা যেন, যত বাজে কথা।

মৈত্র বলল, একবার খপ্পরে পড়লে বুঝতে পারবে।

অমিয় কি ভাবল, তারপর বলল, তুই বের হবি না?

—পাগল! বের হয়ে সব টাকা গচ্ছা দিই আর কি! এখন আমার খুব টাকার দরকার। আমাকে বে-হিসেবী হলে চলে!

ওরা তাড়াতাড়ি খেতে থাকল তারপর। কিছু জাহাজি রেলিঙে ভর করে গাছের ছায়ায় যুবক- যুবতীদের দেখছে। কিছু জাহাজি কলম্বো থেকে যে সব কাঠের হাতি, ময়ূরের পাখা কিনে নিয়েছিল বিক্রির জন্য—তারা ফোকসালে বসে সেই সব হাতী, পাখা সাফসোফ করছে। কারণ বিকেলে বন্দরে কত যে পাখী উড়বে। বন্দরে সব টিউলিপ গাছে কত ফুল ফুটে থাকবে। আর কত যুবক-যুবতী হেঁটে হেঁটে বন্দরে চলে আসবে হাওয়া খেতে। আশ্চর্য এই বন্দর। আসলে সব বড় বড় বার্চ জাতীয় গাছ চারপাশে। এবং গাছে সব হলুদ রঙের পাতা। নিচে লাল নীল স্কার্ট পরা যুবতী। হাতে কালো দস্তানা। মাথায় কালো টুপি। রঙ ওদের পাকা আপেলের মতো। মুখে ওদের সরল হাসি। আর কি অসামান্য রূপ। স্পেনীশ যুবতীদের চোখ কালো চুল কালো—সোনার হরিণের মতো পরম লোভের বস্তু। খেতে খেতে মৈত্র বন্দরের সব খবর দিয়ে যাচ্ছে।

ছোটবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, খুব সাবধান! মারা পড়বে। রাম রাবণের যুদ্ধের কথা মনে আছে? সোনার হরিণের জন্য রাম যে রাম যে শালা পিতৃ আজ্ঞা পালনের নিমিত্ত বনে গিয়েছিল, যে শালা রাম মনুষ্য নয়, দেবতা, সে পর্যন্ত সোনার হরিণের লোভ সামলাতে পারে নি-রে অমিয়। আর ছোটবাবু তুমি তো মনুষ্য জাতির অপোগণ্ডো।

অমিয় বলল, কোথাও একা যাচ্ছি না। তোর সঙ্গে যাব।

ছোটবাবু বলল, আমিও।

তখন গ্যালিতে ভাণ্ডারি, গলা বাড়িয়ে ওদের কথা শুনছে। বুড়ো মানুষ। রোগা। হাত পা কাঠির মতো। সে গলাটা কচ্ছপের মতো বের করে রেখেছে যেন। এটা শীতকাল, গ্যালীতে পর্যন্ত ঠাণ্ডা। ওর চোখ মুখ ঠাণ্ডায় সাদা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। মৈত্র বলল, কি শুনছ চাচা?

—আপনেগ রসের কথা শুনছি।

—আমি ঠিক বলিনি?

—ঠিক বেঠিক জাহাজ না ছাড়লে বোঝা যাবে না। বলেই ভাণ্ডারি গলাটা টেনে নিল ভেতরে। ওরা তিনজনই শেষ পর্যন্ত ভয়ে জাহাজ থেকে নামে নি। ঠিক নামে নি বললে ভুল হবে ছোটবাবু মাটি দেখলে না নেমে থাকতে পারে না। সে একটু সমুদ্রের ধারে ধারে ঘুরে এসেছে। একটু ভেতরে ঢুকলে লেন্দ্রো-এলেন। সে ঠিক জানে না কতদুর গেলে লেন্দ্রো-এলেন, তবু সে কিছুদূর গিয়ে বুঝতে পেরেছিল এমন শীতে সে বেশিদূর হাঁটতে পারবে না। সমুদ্র থেকে কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস একেবারে সব হিম করে দিচ্ছে। অথচ এ-দেশের মেয়েরা ছেলেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে টেনিস খেলছে। ওদের শরীরে যেন শীত লাগছে না। সে ওদের দেখে অবাক না হয়ে পারছিল না।

রাতের বেলা মনে হল ঠাণ্ডা আরও বেড়েছে। কেমন জ্যোৎস্নার মতো সারাদিন ঠাণ্ডা। শীতের রোদে দাঁড়ালে মনে হয় না রোদ। তবু যতক্ষণ রোদ ছিল জাহাজিরা ওপরে উঠে দাঁড়াতে পারছে, সন্ধ্যা হলে কেউ আর ওপরে থাকছে না। যারা বের হবার এ-শীতেও বের হয়ে যাচ্ছে। বড়-মিস্ত্রি সেই এক পোশাকে ক্রাচে ভর করে নেমে যাচ্ছে। মাঝ বয়সী মেমসাব ওকে ধরে ধরে গাড়িতে তুলে নিচ্ছে। জ্যাক বিকেলের দিকে ওর বাবার সঙ্গে এজেন্ট অফিসে গেছে। হয়তো কোথাও ওর বাবার পার্টি আছে। সেখান থেকে ফিরতে রাত হবে। চিঠি পত্র এসেছিল। ওর কোন চিঠি নেই। সে আর চিঠির আশাও করে না। আত্মীয়-স্বজন কিছু কলকাতায় আছে। ওদের ঠিক ঠিকানা ওর জানা নেই। সে মানুষ হিসেবে অগোছালো—তার কিছু ঠিকঠাক থাকে না। এমন কি জাহাজে ওঠার আগে যে দূর সম্পর্কের আত্মীয়টি ভীষণ সদাশয় ছিলেন, সে তাদের ঠিকানায় চিঠি দিতে পারত। কিন্তু সেটাও সে এখন খুঁজে পাচ্ছে না। কাজেই সে আর কিছু করতে পারে না। শেষ পর্যন্ত সে ঠিকানা লিখে বাসে রেখেছিল তো। এখন কিছুই মনে করতে পারছে না। আসলে এ-কাজটার সঙ্গে ওর মনের কোন সংযোগ নেই। যেন কোনরকমে সিঁড়ির ধাপ ভেঙ্গে ওপরে ওঠা। ঠিকমতো উঠতে পারবে কিনা জানে না। জাহাজে জ্যাক আছে, মৈত্র এবং অমিয়, সারেঙসাব, ইয়াসিন অনিমেষও আছে। ওরা আছে বলেই সে নিঃসঙ্গ নয়। সে এখন জ্যাকের কাছ থেকে নানারকম সমুদ্র বিষয়ক বই নিয়ে আসে। সমুদ্রের ওপর পড়াশোনা করতে ওর ভাল লাগে। এখন সে মার্কোর্পলোর ভ্রমণ কাহিনী পড়ছে। আসলে মানুষ এ-সব বই পড়লে মনে মনে সমুদ্রে না গিয়েও সমুদ্রে ভেসে চলতে পারে। অনেক সময় ওর ইচ্ছে হয় সেও লিখবে এমন একটা কাহিনী। কারণ মার্কোপলোর চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয় তার এই সমুদ্রযাত্রা।

রাত এভাবে জাহাজে বেড়ে যায়। স্টিয়ারিং এনজিনে কোন শব্দ নেই। ওপরে সমুদ্রের হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। তার শব্দ এবং সমুদ্র থেকে ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে। এ-বাদে কিছু শব্দ নেই। ক্রেনগুলো কাল থেকে এদিকে ঠিক ফল্কা বরাবর দাঁড়িয়ে যাবে। কাল থেকে মাল খালাস আরম্ভ হবে। ফল্কার কাঠ তোলা হবে কাল। কিনার থেকে মানুষ জন দলে দলে উঠে আসবে। এমন নিঃশব্দ, নির্জন তখন থাকবে না জাহাজ। দীর্ঘদিন পর জাহাজ বন্দরে এসে ভিড়লে কেমন সব চুপচাপ হয়ে যায়। সমুদ্রে পিচিঙের বিরাম থাকে না, কম বেশি, এনজিনের শব্দ সব সময়। সেটা সহসা বন্ধ হয়ে গেলে কেমন ভুতুড়ে মনে হয় জাহাজটাকে। কেমন একেবারে সব কিছু থেমে যায় যেন। কেউ সিঁড়ি ধরে নেমে এলে জুতোর শব্দ এত স্পষ্ট যে তখন ভীষণ অস্বস্তি লাগে।

যারা হাতী এবং ময়ূরের পালক নিয়ে দোকানের মতো ওপরে সাজিয়েছিল, তারা পর্যন্ত নেমে এসেছে। কিনার থেকে তেমন কেউ আর ওপরে ওঠে আসে নি। কাল খবর রটে যাবে শহরে। ভারতবর্ষ থেকে জাহাজ এসেছে। ওরা প্রতিবারের মতো এবারে ময়ূরের পালক, কাঠের হাতী নিয়ে এসেছে। সুন্দর সুন্দর সব চাকচিক্যময় হাতী, কালো রঙের, আর ময়ূরের পালক ড্রইংরুম সাজাবার পক্ষে কি যে দরকারী। আর কি সস্তা! কেবল যমুনাবাজুর গ্যালিতে ডেক-ভাণ্ডারির গলা পাওয়া যাচ্ছে। সে বোধহয় উনুনের ছাই ঝাড়ছিল। সে বোধহয় উনুন পরিষ্কার করে রাখছে। অথবা এও হতে পারে—সে রাতে বন্দরে যাবে বলে সব ঠিকঠাক করে রাখছে। বেশি রাতে ফিরলে সকাল সকাল উঠতে কষ্ট হবে। হাতের কিছু কাজ সে সেরে রাখছে আগে থেকে।

মৈত্র শুয়ে শুয়ে চিঠি পড়ছিল। ওর বৌ যথানিয়মে চিঠি লিখে থাকে। বন্দরে এলে সবাই চিঠি না পেলেও যেন কথা থাকে সে চিঠি পাবে। কি যে লেখা থাকে চিঠিতে! ছোটবাবু দেখেছে অনেক সময় মৈত্র পালিয়ে পালিয়ে বৌর চিঠি পড়ে। কেউ এলেই সে লুকিয়ে ফেলে। অথবা ধরা পড়ে গেছে মতো মুখ করে রাখে। ছোটবাবু জানে, সে ঘুমিয়ে পড়লেও মৈত্র চিঠি পড়ে। তখন অমিয় কিছু বলে না। সে একটা ক্রাইম নভেল পড়তে থাকে শুয়ে শুয়ে। কারণ সে হয়তো জানে চিঠি পড়া মৈত্রের সারা রাতেও শেষ হবে না। সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চিঠিটা পড়ে। তারপর চিঠি লিখতে বসে। শীতের জন্য সে মাঝে মাঝে চা করে আনে। চা খেতে খেতে কত কি যে ভেবে সে চিঠি লেখে।

অমিয় মাঝে মাঝে ধুস্ শালা বলছে। কাকে ধুস্ শালা বলছে বোঝা যাচ্ছে না। মৈত্রকে না শীতের জন্য ধুস্ শালা বলছে ছোটবাবু বুঝতে পারছে না। মৈত্র আলো জ্বালিয়ে রেখেছে বলে অমিয়র ঘুম নাও আসতে পারে, অথবা শীতের জন্য, না কি সে ক্রাইম ফিকশানে কোনও এমন চরিত্র পেয়ে গেছে যাকে মাঝে মাঝেই ধুস্ শালা বলা যায়। ধুস্ শালা বললে, শীত কমে যায়, মৈত্রকেও বুঝিয়ে দেওয়া যায়, আলো জ্বালিয়ে রাখার জন্য ঘুম আসছে না।

মৈত্র দেখল, তখন ছোটবাবু পাশ ফিরছে। ছোটবাবু ঘুমোবে এখন হয়ত। এক কাপের মতো চা করে এনেছিল, সে তবু বলল, কি রে খাবি, যা ঠাণ্ডা। চা খেলে ভাল লাগবে। আর সঙ্গে সঙ্গে দুজনেই লাফ দিয়ে উঠল। গলায় মাথায় মাফলার ঢেকে, কম্বল, লেপ মুড়ে একেবারে দুজন এসকিমোর মতো উঠে বসেছে। হাত বের করছে না পর্যন্ত। পারলে যেন মৈত্রকে এখন চা খাইয়ে দিতে হবে। আর উঁ হুঁ হুঁ এমন শব্দ, মুখ থেকে বাষ্প বের হচ্ছে গাদা গাদা।

মৈত্র চা খেয়ে বাংকে উঠে গেল। এত তাড়াতাড়ি ওর ঘুম আসে না। তবু বাজি ধরার মতো সে বন্দরে না নেমে থেকেছে। ওর জন্য ছোটবাবু অমিয় নামে নি। ছোটবাবু একটু ঘুরেই উঠে এসেছে জাহাজে। কিন্তু বন্দরে এলে জাহাজ থেকে না নেমে থাকা ভীষণ কষ্টের। ওর চিঠি পড়তে পড়তেই মনে হল, কতকাল থেকে সেও মাটি না ছুঁয়ে আছে। সে তো মানুষ। সে কি করে ডাঙায় না নেমে থাকে। জাহাজে থাকলেই সে শেফালীর কথা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না। সে শেফালীর মুখ ভাবতে ভাবতে অথবা ওর চিঠি পড়তে পড়তে সত্যি একটা অসুখে পড়ে যায়। সে কম্বলের নিচে তখন হি হি করে শীতে কাঁপতে থাকে। আর তখন মনে হয় শেফালীর ভীষণ অবিশ্বাস মৈত্রকে। সে ফিরে গেলেই ভূতে পাওয়া রুগীর মতো ছিঁড়ে খেতে চায়, সে সমুদ্রে ভাল মানুষ থাকে কি করে।

সময়-অসময় পর্যন্ত বোঝে না মানুষটা। পাগলের মতো ভালবাসার জায়গাগুলো নিয়ে পড়ে থাকে। তখন একেবারে সরল মানুষ। শেফালীকে ছেড়ে সে কোথাও যাবে না। দু’দণ্ড কোথাও দেরি করে না। যেন শেফালীর শরীর পেলে মৈত্রের আর কিছু লাগে না। আর কি আছে শেফালীর। লম্বা যুবতী শেফালী। শরীরের সর্বত্র মহিমময় ঈশ্বর সবকিছু ভরে দিয়েছেন। মনে হলেই মৈত্রের শেফালীর সবকিছু মনে পড়ে যায়। এবং এভাবেই মৈত্র জাহাজে তার সফর শেষ করে দেয় ভেবে ভেবে।

অথচ সে আবার একনাগাড়ে বেশি দিন ঘরে থাকতে পারে না। এক সময় মনে হয় শেফালীকে আর তেমন ভাল লাগছে না। বরং শেফালীকেই মনে হয় ভীষণ বেপরোয়া। সে শেফালীর কাছে এতটা আশা করে না। তখন শেফালীকে ভীষণ ওর বাজে লাগে। আবার নোনা জল, সমুদ্রে সফর। জাহাজের জন্য উঠে পড়ে লাগা। টাকা কমে আসে, কতদিন বসে খাওয়া যায়, সে শেফালীকে নানাভাবে বোঝাতে থাকে, এবার সমুদ্রে বের হওয়া দরকার। বের হয়ে গেলেই যত মায়া ফের গড়ে ওঠে শেফালীর জন্য। সে শেফালীকে ছেড়ে সত্যি বেশিদিন সমুদ্রে থাকতে পারে না।

কখনও শেফালী বলবে, তুমি থাকো কি করে? কষ্ট হয় না?

মৈত্র হেসে বলত, তোমার কথা ভেবে ভেবে সফর শেষ করে দিই।

শেফালীর তখন বলার ইচ্ছে হত, তুমি মিথ্যা কথা বলছ। আমাকে সত্যি কথা বলছ না। অথচ শেফালীর বলার সাহস হত না। মানুষটি যা একগুয়ে, কখন কি করে বসবে কে জানে। তাই চিঠিতে সেই যেন মায়ের মতো লেখা, অথবা সেই জাহাজডুবির গল্প মনে করতে পারে মৈত্র, যেন শেফালী প্রত্যেক চিঠিতে লিখতে চায়, সাগরে জাহাজডুবি হয়েছে। সমুদ্রে সাঁতার কাটছে বাবা এবং ছেলে। ছেলে কিছুতেই আর পারছে না। মাঝে মাঝে ডুবে যাচ্ছে। তখন যেন বাবা বলছেন, তুমি নক্ষত্র দেখতে পাচ্ছ, ঐ যে দূরে আকাশে নক্ষত্র, ঠিক তার নিচে তোমার মা একটা ঘরে বসে রয়েছেন। আমাদের জন্য গরম খাবার টেবিলে সাজিয়ে বসে আছেন। অপেক্ষা করছেন কতক্ষণে আমরা যাব। তুমি তবু তলিয়ে যাচ্ছ কেন জলে! জলের নিচে সব বড় বড় হাঙর, জোরে হাত-পা নাড়তে পারছ না। আমরা এসে গেছি, ঐ তো সেই পাহাড়টা, তুমি কতদিন তার ওপর দাঁড়িয়ে দূরের জাহাজ দেখেছ। দেখতে পাচ্ছ পাহাড়ের মাথায় আলো জ্বলছে। আর একটু কষ্ট করলেই আমরা সেখানে আহার এবং উত্তাপ পাব জান। সামান্য ধৈর্য, অধৈর্য হলে আমরা উভয়ে তলিয়ে যাব।

শেফালীর যেন এভাবে বলার ইচ্ছে আমরা উভয়ে তলিয়ে যাব শুভেন্দু। আমি তোমার জন্য আহার এবং উত্তাপ সবই সঞ্চয় করে রাখছি। ঘরে ফিরলে আহার এবং উত্তাপ যা খুশি তোমার, যতটুকু ইচ্ছা সব চেঁটেপুটে নিও। এই উত্তাপের জন্য অন্যত্র হেঁটে যাবে না কথা দাও। আমার কাছে এক বাতিঘর সম্বল। সমুদ্রে ডুব দেবার প্রলোভন জাগলে নিজের বাতিঘরটির কথা ভেবো। শেফালীর চিঠিতে এমন অজস্র কথা থাকে। যার উত্তর দেবার সময় মৈত্র ভীষণ ভাবনায় পড়ে যায়।

মৈত্র ডাকল, অমিয়, রাত কত হয়েছে খেয়াল আছে?

—তোর বৌকে চিঠি লেখা শেষ?

—শেষ।

—ছোটবাবু কি করছে?

—ঘুমোচ্ছে।

—তুই শুয়ে পড়। আর একটু বাকি আছে, ওটুকু হলেই শুয়ে পড়ব। তুই ঘুমিয়ে পড় না।

—ঘুম আসবে না।

—কেন, আলো জ্বালা বলে?

—না। বৌটার বাচ্চা হবে। টাকা পাঠানো দরকার।

—টাকা পাঠাতে লিখেছে?

—হ্যাঁ।

—তাহলে সারেঙসাবকে বলে টাকা তুলে নিবি। কাল তো শুনলাম, কে কত তুলতে চায় একটা লিস্ট চেয়েছে।

মৈত্র আর কিছু বলল না। সে কম্বলের নিচে হাত রেখে, হাত-পা গরম করার চেষ্টা করল। কখনও হয়ত ঘসে ঘসে কানে হাত চেপে ধরেছে। কিছুটা এভাবে ওর শরীর গরম হয়। তারপর সে মুখে মাথায় কম্বল টেনে দেবার সময় দেখল, ছোটবাবুর লেপ কম্বল পা থেকে সরে গেছে। এই হয়েছে জ্বালা। ঘুমালে ছোটবাবুর কোন হুঁস থাকে না। সে উঠে লেপ-কম্বল টেনে দিল। ছোটবাবুকে দেখলেই বোঝা যায়, খুব ছেলেমানুষ। ঘুমিয়ে থাকলে ওকে আরও বেশি ছেলেমানুষ লাগে। ছোটবাবুকে নিয়ে ভয় আছে। এ-বয়সটা খুব ভয়ের। অতি সহজে কোন যুবতী ওকে সম্বল করে বনবাসে চলে যেতে পারে। পোর্টহোল বন্ধ। দরজা বন্ধ। ঘরে, বাইরের ঠাণ্ডা ঢুকতে পারছে না। আলো জ্বালা থাকলেই যেন ভাল। যতটুকু উত্তাপ পাওয়া যায়। ছোটবাবু পায়ে মোজা পরেই শুয়ে পড়েছে। হাতে দস্তানা। ছোটবাবু যে ভীষণ শীতকাতুরে এই থেকে বোঝা যায়।

এমন সময় অমিয় দেখল, বড় টিণ্ডাল মৈত্রও নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। সে বইয়ের পাতা ভাঁজ করে শুয়ে পড়বে ভাবল। ঘুমিয়ে থাকলে মৈত্রের মুখ সে তার বাংক থেকে স্পষ্ট দেখতে পায়। সে ওপরের বাংকে থাকে। মাঝে মাঝে মৈত্র ঘুমের ভিতর হাসলে টের পায় অমিয়, মৈত্র স্বপ্ন দেখছে। স্বপ্ন দেখলে সাধারণতঃ বৌকেই দেখতে পায়। ওরা একসঙ্গে সেই কলকাতা বন্দর থেকে আছে। নানাভাবে দেশের কথা উঠলে মৈত্র, ওর বৌ সম্পর্কে বলেছে। ওদের ভালবেসে বিয়ে। মৈত্রের স্ত্রী সুন্দরী, এ-কথাও মৈত্রের কাছ থেকে শোনা। এবং দেখতে ভালো। আর শেফালীর ভালবাসার জুড়ি নেই। সে প্রায় মাঝে মাঝে কেঁদে ফেলার মতো মুখ করে বসে থাকত, স্ত্রীর কথা মনে হলেই মৈত্র একেবারে চুপচাপ। কথা প্রসঙ্গে মৈত্র কত যেন কথা বলে—আর জাহাজে আসছে না, এমনও বলে মাঝে মাঝে। বয়স বেড়ে যাচ্ছে, এ-বয়সে একটা কাজ ডাঙায় খুঁজে না নিলে সারাটা জীবন সমুদ্রে কাটবে! সফরে সফরে সে টাকা জমাচ্ছে।

মৈত্র এভাবে কত রকমের পরিকল্পনা করে থাকে। সে কতবার যে বলেছে টাকা সঞ্চয় করছি অমিয়। চিরটাদিন জাহাজে কাজ করতে ভাল লাগবে না। তুইও জমা। টাকা অযথা নষ্ট করবি না। জাহাজের একটা পয়সাও আমি নষ্ট করছি না। মদ খাচ্ছি না। কার্নিভেলে যাচ্ছি না। জুয়া খেলছি না। কিনারার এক খদ্দের ধরতে হবে শুধু। কথা আছে মানুষটা জাহাজেই আসবে। যদি জাহাজ থেকে নির্বিঘ্নে নামাতে পারি, তবে দু’পয়সা হয়ে যাবে। যা সামান্য আয় এতে বাড়ে। আমি এজন্য কাঠের হাতী আনিনি, ময়ূরের পালক আনিনি।

অমিয় বলেছিল, একটা কেলেঙ্কারী না হয়।

—কি আর হবে। ধরা পড়লে চুপ মেরে যেতে হবে। কার জিনিস কে খোঁজ রাখে।

—আমার এসব ভাল লাগে না মৈত্র।

মৈত্র বলল, আমারও কি ভাল লাগে! বউ সুন্দরী হলে অনেক খরচ।

মৈত্রের ঐ অভ্যাস। দোষ ত্রুটির জন্য সে সবরকমের যুক্তি-তর্ক খাড়া রাখে। না পারলে চুপ। কোন কথা বলবে না। চুপচাপ কাজ করবে। তখন মনে হবে, ছোটবাবু এবং অমিয় জাহাজে সত্যি কয়লায়ালা, সে বড় টিণ্ডাল। আস্কারা দিয়ে মাথায় তুললে যা হয়। কথা না বলে সে মনে করিয়ে দেয় সে জাহাজের বড় টিণ্ডাল। অমিয় এবং ছোটবাবু তখন একেবারে ঠিক ঠিক কয়লায়ালার মতো ব্যবহার করতে থাকে। টিণ্ডাল সাব, খানা রেডি।

মৈত্র আরও গম্ভীর হয়ে যায়।—খুব মজা, হারামজাদা, পঙ্গপালের দল। সে তেড়ে যায় ছোটবাবুকে। ছোটবাবু আর অমিয় তখন ডেকের ওপর ছুটে গিয়ে হা-হা করে হাসতে থাকে।

রাত থাকতে অমিয়র ঘুম ভেঙ্গে গেল। বন্দর এলে ওয়াচ থাকে না। কাজের চাপ কম। সাতটা থেকে কাজ আরম্ভ। অমিয়র ইচ্ছে ছিল ছ’টা পর্যন্ত ঘুমাবে। একঘণ্টার ভেতর বাকি কাজ অর্থাৎ হাত-মুখ ধোয়া, বাথরুমের কাজ, এবং অন্যান্য, যেমন চর্বি ভাজা রুটি-চা এসব খাওয়ার কাজ সেরে ফেলতে পারবে। তারপর টান্টু বললেই লাফিয়ে কাজে বের হয়ে যাওয়া। অথচ ঘুম যে কেন রাত থাকতে ভেঙ্গে গেল। বেশ রাত। সকাল হতে হতে সাতটা বেজে যাবে। তবু তখন কিছুটা অন্ধকার থাকে। অন্ধকারে এনজিনরুমে নেমে যেতে হবে। সে ঘড়িতে দেখল পাঁচটা বাজেনি। সে ফের লেপ- কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করল। কিন্তু ঘুম এল না। সে কম্বল গায়ে উঠে বসল। বাথরুমে যেতে হবে। শীতের সময় যতক্ষণ পারা যায় চেপেচুপে পড়ে থাকার স্বভাব। সে বুঝতে পারল এর জন্য ঘুম ওর ভেঙ্গে গেছে। সে নেমে ওপরে ওঠার সময় ভাবল, দরজাটা বন্ধ করে আসেনি। সিঁড়ির মুখে, আলোটা সবসময় জ্বালা থাকে। দরজা খোলা রাখলে ঘরে অন্ধকার থাকে না। সে নেমে গিয়ে দরজা ফের বন্ধ করে দিল।

তারপর ধাপে ধাপে ওপরে উঠতেই মনে হল, পূবের দিকটা বেশ ফর্সা মতো। সে রাতে এটা লক্ষ্য করেনি। একটা দ্বীপ-টিপ থাকবে। সেখানে আলো থাকতে পারে। নানাভাবে চারপাশের আলো মিলে এমন দেখাতে পারে। নতুন বন্দর। সামনে জেটি পার হলে বড় বড় গাছ। আলো-অন্ধকারে গাছগুলোকে বড় রহস্যময় লাগছিল। মৈত্র বলেছে জেটি পার হলে শহরের পার্ক। সমুদ্রের বুক থেকে এই পার্ক উঠে এসেছে যেন। এই পার্কে টিউলিপের ফুল প্রচুর ফোটে। ফুলের লোভে শহরের সব উঠতি বয়সের মেয়েরা এখানে বিকেল হলেই চলে আসে।

এইসব মেয়েরা স্বাভাবিকভাবেই জাহাজিদের ভীষণভাবে মাতাল করে দেয়। এবং এখানে এক কার্নিভেল আছে, কার্নিভেলে গুহাপথ আছে অথবা রিঙের খেলা, মোটর রেস আছে যা মৈত্র এবং নাবিকদের পক্ষে ভীষণ লোভের। মৈত্র বলেছে মাথা ঘোরাবার পক্ষে জুয়োখেলায় যে-কোন রমণীই যথেষ্ট।

প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় ওর ঘুম ভেঙ্গে যেতে পারে। খুব বেশি ঠাণ্ডা পড়লে ওর শীতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। এখন সে কেবল চা খেয়ে কিছুটা শরীর গরম করতে পারে। সে গ্যালিতে ঢুকে দেখল, উনুনে আঁচ দেওয়া আছে কিনা। সে দেখল আছে। ছাই ঝেড়ে সামান্য কয়লা দিয়ে দিল। ভাণ্ডারির এখন ওঠার সময়। ভাণ্ডারি উঠে খুশিই হবে দেখে।

সে চা নিয়ে এসে দেখল, মৈত্র আলো জ্বেলে ঘরে বসে আছে। মুখে-চোখে ভয়ঙ্কর বিরক্তিকর রেখা ফুটে উঠেছে। ওর হাতে চা দেখেও একটা কথা বলল না। ভয়ঙ্কর কিছু হলে এমন হয়। অমিয় বলল, কি রে, কি হয়েছে! শরীর খারাপ!

সে কেমন আরও ক্ষেপে গেল। কথা বলল না। তোয়ালে মগ নিয়ে ওপরে উঠে গেলে অমিয় হেসে ফেলল, শালা আমার নীতিবাগীশ। মৈত্র নেমে এলে বলল, বন্দরে ভিড়তে না ভিড়তেই।

—হ্যাঁ ভিড়তে না ভিড়তেই। সে একবার অমিয়র দিকে তাকাল না পর্যন্ত। শরীর সাফসোফ করে এসে শীতে আরও কাবু হয়ে গেছে। সে কোনরকমে কম্বলের নিচে ঢুকে যেতে পারলে যেন বাঁচে। সে আণ্ডার-ওয়ারটা লকারের মাথায় শুকোবার জন্য ছড়িয়ে দিল।

—নীতিবাগীশদের এই হয়। অমিয় চা খেতে খেতে ব্যঙ্গ করল।

মৈত্র জবাব দিল না।

—সারাদিন বৌ বৌ। আর শালা মানুষ বিয়ে করে না বুঝি!

—বিয়ে না করলে এসব কথা মানায় না। তুমি তো বাউণ্ডলে। বাপের খেয়েছ, বোনের মোষ তাড়িয়েছ। ইচ্ছে করেই মৈত্র বন না বলে বোন বলল।

অমিয় ও-কথায় কান দিল না। বলল, আমার হলে বেশ ভাল লাগে। বলে সে বেশ জোরে জোরে কথা বলতে চাইলে মৈত্র বলল, আস্তে, ছোটবাবু ঘুমোচ্ছে। ওরও ঠিক হয়ে যাবে। যেভাবে ঘুমোচ্ছে!

লেপের নিচে ঢুকে বলল, তুই কার মুখ দেখিস অমিয়?

—কত মুখ। কেবল দেখতে পাই একটা ফ্রক-পরা মেয়ে দৌড়াচ্ছে। আমি তার পেছনে ছুটছি। তারপর কোনরকমে ছুঁয়ে দিলেই আমার হয়ে যায়। খুব বেশি দূর যেতে পারি না। তারপর আর মুখটা মনে পড়ে না। সে হেঁটে হেঁটে অনেক দূরে চলে যায়। আমার আর তখন কোনও মুখের কথা মনে থাকে না। সকালে উঠে কাকে দেখে রাতে কলিসানটা হল কিছুতেই মনে করতে পারি না।

মৈত্র বলল, আমার সব মনে থাকে।

—কি দেখলি আজকে।

—দেখলাম…….এই দেখলাম।

—বলতে চাস না?

—না, তোর এই আর কি, শেফালীকে দেখলাম। না বললে কি আর হবে। তোমাদের তো সবই বলি। তবে তোরা পঙ্গপালের দল, বিয়ে করিসনি, তোদের বলা ঠিক না। তোরা তবে খারাপ হয়ে যাবি।

—ধুস্ শালা। তুই খারাপ করার কে রে? বাদ দে! চা খাবি?

—খাওয়াবি!

—মুখ সাদা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। অনেকটা গেছে? চা খেলে আরাম পাবি।

—অনেকটা। মৈত্র বলতে গিয়ে মুখ গোমড়া করে ফেলল।

ওরা বসে বসে দুজন বেশ অনেকক্ষণ কথা বলল। এখন আর মনে হচ্ছে না, ওরা চার মাস আগেও ছিল অপরিচিত। কত সহজে সব কথা বলে ফেলতে পারে সবাই। মৈত্রের যা-কিছু কথাবার্তা সব এদের সঙ্গে। এরা মৈত্রের বন্ধু আবার সহকর্মী। আবার একেবারে অধস্তন মানুষের মতো ব্যবহার করতেও ছাড়ে না। তথাপি এই বাংকে অথবা ফোসকালে এলে ওরা বুঝতে পারে, যত দেশ ছেড়ে ক্রমে দূরে সরে যাবে, তত ওরা পরস্পরের ঘনিষ্ঠ হবে। জাহাজ তো সবেমাত্র চলতে আরম্ভ করেছে। বলতেই বলে ব্যাঙ্ক লাইনের সফর। সহজে শেষ হয় না।

সকাল হলে অমিয় পোর্ট-হোলের কাচ খুলে দিল। সাতটা কখন বেজে গেছে। অথচ সারেঙ টান্টু বলছে না! কাকে কোথায় কাজ করতে হবে বলছে না। অমিয় অবশ্য জানে তাকে কোথায় কাজ করতে হবে। কারণ, ছোট টিন্ডালের সঙ্গে স্মোক-বসে তার কাজ আছে। বন্দরে এলেই বয়লারের সব স্মোক-বক্স পরিষ্কার করে ফেলতে হয়। এবং এ-কাজটা একমাত্র কোলবয়দের দিয়ে করিয়ে নেওয়া হয়। ছোটবাবু হয়তো ডেকে কাজ করবে। ডেকে কাজ দিলে ছোটবাবু বেশ সব দেখে বেড়াতে পারবে।

সিঁড়িতে এখন জাহাজিদের ওঠানামার শব্দ। জেটিতে লোকজনের ভিড়। বড় বড় ক্রেন সব এগিয়ে আসছে। ওরা ফোকসালে বসে দেখতে পাচ্ছে। সামনের পোর্ট-হোল খোলা। কিনারায় মানুষ জড় হচ্ছে। ওরা গ্যাঙওয়ে দিয়ে উঠে আসছে। কেউ কেউ দল বেঁধে, কাজের পোশাকে গাছের নিচে জটলা করছে। বেশ একটা উৎসবের মতো মনে হয়, যেন সাড়া পড়ে যাবার মতো। ডেক-জাহাজিরা ফল্কায় কাঠ খুলে দিচ্ছে। ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছে কাঠ। আর হাজার হাজার পাখি উড়ছে মাথার ওপর, সমুদ্র পাখি। এদের ডানা তেমন বড় নয়। পাখিগুলো প্রায় কবুতরের সামিল। ওদের ডানার শব্দ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। অমিয় বসে বসে পোর্ট-হোলের ঘুলঘুলিতে বন্দরের দৃশ্য দেখতে থাকল। বড়-মিস্ত্রিকে খুব ভয়। সে খুব সাবধানে চলাফেরা করছে। এবং রক্ষে বড়মিস্ত্রি কোনদিন ডেকে বের হয় না। এতদিন পর দেখলে নাও চিনতে পারে। তবু আরও কিছুদিন সাবধানে থাকা ভালো।

এভাবে কেন যে বন্দরের দৃশ্য দেখতে দেখতে কখনও বড়-মিস্ত্রির গোলগাল মুখ এবং অবয়ব চোখের ওপর ভেসে ওঠে। সে দৃশ্যটা ভুলে যেতে চায়। বরং ভাল লাগে, সেইসব বড় বড় গাছ, টিউলিপ ফুলের গাছ, গাছে সাদা অথবা মেরুণ রঙের ফুল—বন্দরে ফুলের ছবি, মেয়েরা সোনালী গাউনে ঢেকে চুপচাপ হেঁটে চলে আসবে, ওদের কালো চোখ, নীল চুল, সুষমায় ভরা মুখ, সে একটু ছুঁয়ে দেখবে তাদের—আর কিছু না। বন্দরে এর চেয়ে বেশি কিছু চায় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *