অলৌকিক আধুলি রহস্য!
ইদানীং রোজ ভোরবেলা জগিং শুরু করেছি। আমাদের এই ছোট শহরে অত সকালে রাস্তাঘাট একেবারে নিরিবিলি হয়ে থাকে। তাতে শীতকাল। খেলার মাঠ পেরিয়ে নদীর ধার অব্দি গিয়ে বাড়ি ফিরতে এক কিলোমিটার দৌড় হয়ে যায়। গা ঘেমে ওঠে।
আমার ভাগ্নে শ্ৰীমান ডন টের পেয়ে একদিন বলল,–চোরটাকে ধরতে পেরেছিলেন মামা?
চোর? কোথায় চোর? আকাশ থেকে পড়লুম। আমি তো জগিং করছিলুম, হতভাগা! চোর কোথায় দেখলি?
ডন আকাশ থেকে পড়ল, জগিং! ও মামা, জগিং মানে কী? তুমি তো দৌড়চ্ছিলে।
গম্ভীর হয়ে বললুম, জগিং মানে দৌড়-ব্যায়াম। এতে স্বাস্থ্য ভাল থাকে। খিদে বাড়ে। জম্পেশ রকমের ঘুম হয়।
ডন খুশি হয়ে বলল, আমিও জগিং করব, মামা।
–বেশ তো। ভোর ছয়টায় ঘুম থেকে উঠিস। তোর তো সাতটার আগে ঘুমই ভাঙে না।
পরদিন অবশ্য ওকে বিছানা থেকে টেনেই ওঠাতে হল। কিন্তু অতটুকু ছেলে। খেলার মাঠ অব্দি গিয়ে ধুস বলে নেতিয়ে বসল! আমি হাসতে-হাসতে ধুকুর-ধুকুর দৌড়ে নদীর ধারে রোজকার টারগেট পোডোমন্দির চক্কর দিলুম। তারপর খেলার মাঠে এসে দেখি, ডন। ফের পুরোদমে শুরু করেছে। মনে-মনে বললুম, ভালো! বাহাদুর ছেলে!
তারপর টের পেলুম ব্যাপারটা। ডন আসলে পাড়ার সেই বদরাগী নেড়ি কুকুরটাকে উচিত শিক্ষা দিতে চলেছে। তার হাতে আধলা ইট। কুকুরটা লেজ গুটিয়ে ঝিলের ধারে রামু-ধোপার গাধার পেটের তলা দিয়ে বেমালুম অদৃশ্য হয়ে গেল।
এইতে বুঝি গাধাটা অপমানিত বোধ করে চার ঠ্যাং তুলে লাফ দিল। তখন শ্রীমান বেগতিক দেখে থমকে দাঁড়াল। কাছে গিয়ে বললুম, খুব হয়েছে। তোমার দ্বারা জগিং হবে না। বাড়ি এসো।
ডন ফিক করে হেসে বলল,–তখন অমন বসে পড়লুম কেন বলো তো মামা?
–দৌড়তে পারছিলে না বলে।
ডন বলল,-যাঃ! সেজন্যে নাকি! একটা আধুলি পড়ে ছিল যে ওখানে।
সে আধুলিটা দেখাল। চকচকে নতুন আধুলি। বললুম, কার পড়ে-উড়ে গেছে আর কী? ওটা দিয়ে যদি ফের ঘুড়ি কেনার মতলব করিস, গাঁট্টা লাগাব বলে দিচ্ছি। গাছে ঘুড়ি আটকাবে আর আমাকে গাছে চড়তে হবেকক্ষনো না।
ডন মনমরা হয়ে বলল, তাহলে কী করব বলল না মামা?
–বরং কোনও ভিখিরিকে দান করে দিস। পুণ্যি হবে।
বাড়ির কাছাকাছি এসে দেখলুম শীতের রোদে রাস্তার মোড়ে সেই অন্ধ ভিখিরিটা বসে আছে–রোজই থাকে। ডনকে ইশারা করলে সে গম্ভীর মুখে আধুলিটা ভিখিরির মগে ঠকাস করে ফেলে দিয়ে এল। বোঝা যাচ্ছিল, আধুলিটা নিয়ে তার কোনও মতলব ছিল।
সন্ধ্যায় এক কাপ চা নিয়ে আরাম করে বসে একটা গোয়েন্দা গল্পের পাতায় চোখ রেখেছি, ডন এসে বলল, মামা, ও মামা! দ্যাখো দ্যাখো–সেই আধুলিটা না?
ডনের হাতে একটা আধুলি ছিল। সেটা কুড়িয়ে-পাওয়া আধুলিটার মতোই নতুন এবং চকচকে বটে। বললুম,–সেই আধুলিটা, কী বলছিস? এটা তুই তো ঠকাস করে ভিখিরির মগে ফেললি সকালে?
ডন চোখ বড় করে বলল, অবাক, মামা অবাক! পিসিমা একটা টাকা দিয়েছিল আমাকে, জানো তো? টাকাটা নিয়ে গেলুম হাবুবাবুর দোকানে খাতা কিনতে। এই দ্যাখো খাতাটা।
সে খাতাটা দেখাল। বিশ্বাস করে বললুম, আধুলিটা বুঝি হাবুবাবু দিলেন?
ডন চাপা গলায় বলল, দিলেন তো! ও মামা, এটা সেই আধুলিটা সত্যি বলছি, দ্যাখো না ভালো করে। ঠিক সেইটে। কুড়িয়ে পেতে কতক্ষণ ধরে দেখেছিলুম না? সেই লাল ফুটকিটা পর্যন্ত। দেখতে পাচ্ছ?
তর্ক করে লাভ নেই ওর সঙ্গে। ঝামেলা বাড়বে। হাত বাড়িয়ে বললুম, ওটা আমায় দে। তার বদলে তোকে আট আনা দিচ্ছি।
ডন একপা পিছিয়ে বলল, উঁহু! এটা দিয়ে আমি ম্যাজিক করব না বুঝি?
–বেশ, তাই করিস। যা এখন!
ডন বলল, তুমি বিশ্বাস করলে না তো? ঠিক আছে। কাল ভোরবেলা জগিং করবার সময় ফের এটা ভিখিরিকে দেব। দেখবে, ফের ঘুরে আসবে আমার হাতে।
পরদিন ওকে ঘুম থেকে ওঠাতে হল না। আমাকেই বরং ওই ওঠালে। মামা ভাগ্নে মিলে ঠান্ডা হিমে ভোরবেলায় ধুকুরপুকুর দৌড় শুরু করলুম। আজ ওর খাতিরে একটু আস্তে। নদীর ধারে পোডোমন্দির ঘুরে খেলার মাঠ পেরিয়ে রাস্তায় পৌঁছে লক্ষ করলুম ডনটা একটুও কাবু হয়নি। রহস্যটা কী?
মোড়ের অন্ধ-ভিখিরিকে দেখে আধুলিটার কথা মনে পড়ল। বললুম,–হ্যাঁরে, আধুলিটা ওকে দিবি বলেছিলি যে?
দিচ্ছি।–বলে ডন ভিখিরির কাছে গেল।
ঠকাস শব্দ এবং ভিখিরির আশীর্বাদ শুনে বুঝলুম, মুদ্রাটি যথাস্থানে গেছে।
এদিন ছিল রবিবার। ডন একদফা পাড়া ঘুরতে বেরিয়েছিল। এগারোটা নাগাদ তার পায়ের ধুপধুপ আওয়াজ শুনলুম। তারপর এক চিকুর, মামা! মামা! ম্যাজিক, মামা, ম্যাজিক। তারপর হাঁফাতে-হাঁফাতে ঘরে ঢুকে সে বলল, বলেছিলুম না! এই এই দ্যাখো।
ওর হাতে সেই আধুলিটার মতোই চকচকে নতুন আধুলি দেখে হাসতে-হাসতে বললুম,–চালাকি? কোত্থেকে নতুন একটা আধুলি এনে বলছ সেইটে?
ডন কঁদো-কঁদো মুখে বলল, তোমার দিব্যি, মামা! মা পান কিনতে পাঠিয়েছিল। পানওয়ালা এটা দিল। সে আমার হাতে ওটা গুঁজে দিল। তুমি দেখে রাখো না! এই লাল ফুটকিটা দেখছ-ওইটা দেখেই চিনতে পারছি!
–ঠিক আছে। আমার কাছে থাক এটা। আমি নিজে পরীক্ষা করে দেখবখন!
ডন ছোঁ মেরে আধুলিটা তুলে নিয়ে ছিটকে সরে গেল। রাগী মুখ করে বলল, দিচ্ছি তোমায়! অত করে মার কাছে বকুনি খেয়ে এটা ফিরে পেলুম। এ দিয়ে ম্যাজিক করব।
পরদিন ভোরে জগিং করতে গিয়ে নদীর ধারে পোড়োমন্দির চক্কর দিচ্ছি, হঠাৎ খেয়াল হল শ্রীমান সঙ্গে নেই। ঘুরে দেখি অনেকটা দূরে খেলার মাঠে ছোট্টটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেতেই ঊ্যা করে বলল,–আধুলিটা হারিয়ে গেছে মামা!
রাগ করে বললুম,–বেশ হয়েছে হতভাগা ছেলে! আধুলি হাতে নিয়ে কেউ দৌড়ায়?
ডন আমাকে খামচে ধরে থামাল। তারপর চোখ মুছতে মুছতে বলল,-খুঁজে দাও না মামা। আমার ম্যাজিক করা হবে না যে!
ঘাসে শিশির চকচক করছে। সূর্যটা সবে বিছানা থেকে উঠে বসে হাই তুলছে। পিটপিটে চাউনি। তার ওপর উত্তরে হাওয়ার ঠান্ডা হিম দুষ্টুমি। এমন সময় একটা আধুলি খুঁজে বের করা বড় কষ্টসাধ্য কাজ। ডনের খাতিরে তবু অনেক কষ্ট করতে হল। কিন্তু তার পাত্র পাওয়া গেল না। ডনকে বললুম,–ঠিক এখানেই পড়েছে তার মানে কী? অন্য কোথাও ফেলেছিস তাহলে।
ডন জোরের সঙ্গে বলল,–এখানেই!
কিন্তু প্রচণ্ড খুঁজেও আধুলিটা পাওয়া গেল না। কাজেই আমাদের পায়ের শব্দে রাস্তার মোড়ের অন্ধ-ভিখিরি নড়েচড়ে বসলেও তার মগে ঠকাস করে সেই মিঠে শব্দটা বাজল না। বেচারা নিশ্চয় খুব মনমরা হয়ে গেল।
মনমরা হয়ে রইল শ্রীমানও। শরীর খারাপ বলে স্কুলে গেল না। বিকেল নাগাদ ভাবলুম ছেলেটাকে চাঙ্গা করা উচিত। আমার ডাক শুনে ডন চোখ পিটপিট করতে করতে ঘরে ঢুকল। তারপর নিজের বুড়ো আঙুলের দিকে তাকিয়ে বলল, কী?
ওকে টেনে আদর করে বললুম, যা হওয়ার হয়ে গেছে! ও নিয়ে মন খারাপ করে লাভ নেই। চল, বাইরে কিছুক্ষণ ঘুরে আসি। মন ভালো হয়ে যাবে।
ডন ঘাড় গোঁজ করে বলল, শ্যাব–একটা আধুলি দাও, নতুন আধুলি না হলে নেব না কিন্তু।
আধুলি? –চিন্তিত হয়ে বললুম। আধুলি যদি না থাকে, সিকি হলে চলবে না?
ডন ঠোঁটের কোণায় কেমন একটু হাসল,–তোমার টেবিলের ড্রয়ার খুঁজে দ্যাখো না।
টেবিলের ড্রয়ারে খুচরো পয়সা রাখি, একথা সত্য। ডনের এ খবর জানা থাকার কথা নয়–এ বাড়ির কারুরই নয়। খুঁজতে গিয়ে পেয়েও গেলুম একটা আধুলি। এবং চকচকে আনকোরা আধুলিটা। ডনের তর সইল না, খপ করে কেড়ে নিল। তারপর উল্টে-পাল্টে দেখতে-দেখতে আচমকা এক চিল-চিকুর ছাড়ল, মামা, ও মামা! ম্যাজিক, মামা, ম্যাজিক!
অবাক হয়ে বললুম, কী রে?
সেই লাল ফুটকিটা। ডন নাচতে নাচতে বলল, আমার আধুলি। আমার আধুলি। দ্যাখো, দ্যাখো!
হাঁ করে তাকিয়ে ছিলুম। ওর হাত থেকে আধুলিটা নিয়ে আরও অবাক হলুম। এ কী! সত্যি সেই লাল ফুটকিওয়ালা আধুলিটা যে! কোথায় পেলুম এটা কার, কিছুতেই মনে পড়ল না। কিন্তু জিনিসটা যে অলৌকিক এতে আর সন্দেহ থাকা উচিত নয়।
আর এত ঠিক, এই পড়ে পাওয়া অলৌকিক আধুলি যখন ডনকে ভালোবেসে ফেলেছে, তবে ডন এটা মোড়ের অন্ধ-ভিখিরিকে দিক কিংবা হারিয়ে ফেলুক, আবার তার কাছে এ-হাত সেহাত ঘুরে ফিরে আসবেই। নিজেকে চেনাবার জন্যে কপালে একটা লাল ফুটকি তো থাকবেই। সুতরাং ডন দৌড়ে বেরিয়ে গেলে ওর দিকে প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলুম। এমন ভাগ্নের মামা হওয়াটাও তো কম গর্বের কথা নয়।